৯
রাত প্রায় ন’টা।
আমি এবং মিসির আলি সুধাকান্তবাবুর বাড়ির উঠোনে বসে আছি। সুধাকান্তবাবু চুলায় চায়ের পানি চড়িয়েছেন। তিনি আমাদের যথেষ্ট যত্ন করছেন। মিসির আলিকে খুব আগ্রহ নিয়ে বাড়ি ঘুরে-ঘুরে দেখালেন। নানা গল্প করলেন।
বাড়ি আগের মতোই আছে। তবে কামিনী গাছ দু’টির একটি নেই। মরে গেছে। কুয়ার কাছে সারি বেঁধে কিছু পেয়ারা গাছ লাগান হয়েছে, যা আগে দেখি নি।
সুধাকান্তবাবু বললেন, ‘চা খেয়ে আপনারা বিশ্রাম করুন, আমি খিচুড়ি চড়িয়ে দিচ্ছি।’
মিসির আলি অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে বললেন, ‘খিচুড়ি মন্দ হবে না। তা ছাড়া শুনেছি আপনার রান্নার হাত অপূর্ব।’
আমাদের চা দিয়ে সুধাকান্তবাবু খিচুড়ি চড়িয়ে দিলেন। মিসির আলি বললেন, ‘রান্না করতে-করতে আপনি আপনার ভৌতিক অভিজ্ঞতার কথা বলুন। এটা শোনার জন্যেই এসেছি। আগেও এক বার এসেছিলাম, আপনাকে পাই নি।’
‘জানি। খবর দিয়ে এলে থাকতাম। আমি বেশির ভাগ সময়ই থাকি।’
‘শুরু করুন।’
সুধাকান্তবাবু গল্প শুরু করলেন। ভৌতিক গল্পের জন্যে চমৎকার একটা পরিবেশ। অন্ধকার উঠোন। আকাশে নক্ষত্রের আলো। উঠোনের ওপর দিয়ে একটু পরপর হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। একটা তক্ষক ডাকছে। তক্ষকের ডাক বন্ধ হবার সঙ্গে-সঙ্গে অসংখ্য ঝিঝিপোকা ডেকে উঠছে। ঝিঁঝিপোকা থামতেই তক্ষক ডেকে ওঠে। তক্ষকরা চুপ করতেই ডাকে ঝিঁঝিপোকা। অদ্ভুত কনসার্ট!
সুধাকান্ত গল্প বলে চলেছেন। মিসির আলি মাঝে-মাঝে তাঁকে থামাচ্ছেন। গভীর আগ্রহে বলছেন, ‘এই জায়গাটা দয়া করে আরেক বার বলুন। অসাধারণ অংশ। গা শিউরে উঠছে।’
সুধাকান্তবাবু তাতে বিরক্ত হচ্ছেন না। সম্ভবত মিসির আলির গভীর আগ্রহ তাঁর ভালো লাগছে।
যেখানে মেয়েটি সুধাকান্তবাবরু পা কামড়ে ধরে, সেই অংশ মিসির আলি তিন বার শুনলেন। শেষ বার গভীর আগ্রহে বললেন, ‘আপনি যখন পালিয়ে যাচ্ছিলেন তখন মেয়েটি পিছন থেকে আচমকা আপনাকে কামড়ে ধরল?’
‘জ্বি।’
‘হাত দিয়ে ধরল না, আঁচড় দিল না—শুধু কামড়ে ধরল?’
‘জ্বি।’
‘দেখি কামড়ের দাগটা।’
তিনি কামড়ের দাগ দেখালেন। মিসির আলি পায়ের দাগ পরীক্ষা করলেন। জড়ান গলায় বললেন, ‘কী অদ্ভুত গল্প! তারপর কী হল?’
সুধাকান্তবাবু গল্পে ফিরে গেলেন।
এক সময় গল্প শেষ হল। সুধাকান্তবাবু বললেন, ‘খিচুড়ি নেমে গেছে। আপনাদের কি এখন দিয়ে দেব? রাত মন্দ হয় নি কিন্তু।’
মিসির আলি বললেন, ‘জ্বি, খেয়ে নেব। আপনাকে দু’-একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছি।’
‘জিজ্ঞেস করুন।’
‘মেয়েটি শুধু কামড়ে ধরল—হাত দিয়ে আপনাকে ধরল না কেন?’
‘আমি কী করে বলব বলুন। আমার পক্ষে তো জানা সম্ভব না।’
‘আমার কিন্তু মনে হয় আপনি জানেন।‘
সুধাকান্তবাবু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
মিসির আলি বললেন, ‘আপনার গল্পের সবচেয়ে দুর্বল অংশ মেয়েটির কামড়ে-ধরা। মেয়েটি কিন্তু পেছন থেকে আপনাকে কামড়ে ধরে নি। পায়ের দাগ দেখেই বোঝা যাচ্ছে কামড়ে ধরেছে সামনে থেকে। আপনার দাগ ভালোভাবে পরীক্ষা করলেই তা বোঝা যায়। আপনাকে আক্রমণ করবার জন্যে মেয়েটি তার হাত ব্যবহার করে নি। কারণ একটাই—সম্ভবত তার হাত পেছন থেকে বাঁধা ছিল। তাই নয় কি?’
সুধাকান্তবাবুর চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হল। একটি কথাও বললেন না।
মিসির আলি বললেন, ‘আপনার গল্পে একটা কুকুর আছে। পাগলা কুকুর। হাইড্রোফোবিয়ার কুকুর কিছুই খায় না। অসহ্য যন্ত্রণায় মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করে। অথচ এই কুকুরটা আস্ত একটি মেয়েকে খেয়ে ফেলল, পাঁচটা সুস্থ কুকুরের পক্ষেও যা সম্ভব নয়। আপনি অসাধারণ একটা ভূতের গল্প তৈরি করেছেন। কিন্তু গল্পে অনেক ফাঁক রয়ে গেছে, তাই না?’
সুধাকান্ত বিড়বিড় করে কী-যেন বললেন। আমি কাঠ হয়ে বসে রইলাম। কী শুনছি এ-সব! মিসির আলি লোকটি এ-সব কী বলছে!
মিসির আলি বললেন, ‘ব্যাপারটা কী হয়েছিল আমি বলি। আপনি চিরকুমার একজন মানুষ। আপনার মনে আছে অবদমিত কামনা-বাসনা। মহাপুরুষরাও কামনা-বাসনার ঊর্ধ্বে নন। কীভাবে যেন আপনি অল্পবয়সী একজন কিশোরীকে আপনার ঘরে নিয়ে এলেন। এই মেয়েটি কীভাবে এল বুঝতে পারছি না। বাড়ি থেকে পালিয়ে আসতে পারে, বা অন্য কিছুও হতে পারে। এই অংশটা আমার কাছে পরিষ্কার না।
‘যাই হোক, মেয়েটিকে আপনার ঘরে নিয়েই আপনি তার হাত বেঁধে ফেললেন। মেয়েটির চিৎকার, কান্নাকাটি আশেপাশের কেউ শুনল না। কারণ আশেপাশে শোনার মতো কেউ নেই। মেয়েটি নিজেকে রক্ষা করবার জন্যে আপনাকে কামড়ে ধরল। এই একটি অস্ত্রই তার কাছে ছিল।
‘অবশ্যি মেয়েটি নিজেকে রক্ষা করতে পারল না। শেষ পর্যন্ত মারা গেল।…
‘আপনি তার মৃতদেহ ঘরেই ফেলে রাখলেন। দরজা-জানালা খুলে রাখলেন, যাতে শেয়াল-কুকুর শবদেহটা খেয়ে ফেলতে পারে। এক দিনে তো একটা মানুষ শেয়াল-কুকুরে খেয়ে ফেলতে পারে না। হয়তো দু’ দিন বা তিন দিন লাগল। এই সময়টা আপনি নষ্ট করলেন না, ঠাণ্ডা মাথায় ভাবলেন। ভেবে-ভেবে অসাধারণ একটা গল্প তৈরি করলেন। সেই গল্পে সূত্র আছে, কুকুর আছে, অশরীরী আত্মীয়রা আছে। কি সুধাকান্তবাবু, আমি ঠিক বলি নি? দিন, এখন খাবার দিয়ে দিন—প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। খেয়ে নেব।‘
.
আমি অবাক হয়ে দেখলাম সত্যি-সত্যি মিসির আলি খেতে বসেছেন। সুধাকান্তবাবু তাঁকে থালা এগিয়ে দিচ্ছেন। মিসির আলি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি খাবেন না?’
আমি বললাম, ‘না, আমার খিদে নেই।’
মিসির আলি খেতে-খেতে বললেন, ‘সুধাকান্তবাবু, আপনার বিরুদ্ধে কেস দাঁড় করাবার মতো কিছু আমার হাতে নেই। যে-সব কথা আপনাকে বলেছি, সে-সব আমি কোর্টে টেকাতে পারব না, আমি সেই চেষ্টাও করব না। কাজেই আপনার ভয়ের কিছু নেই। তবে আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, আপনি থানায় গিয়ে অপরাধ স্বীকার করবেন। আচ্ছা, মেয়েটার নাম কি ছিল?’
সুধাকান্ত গম্ভীর গলায় বললেন, ‘বিন্তি। ওর নাম বিন্তি।’
‘ও আচ্ছা, বিন্তি।’
মিসির আলি খুব আগ্রহ করে খাচ্ছেন। আমি দূরে থেকে তাঁকে দেখছি। সুধাকান্তবাবুও দেখছেন। তাঁর চোখে পলক পড়ছে না। সেই পলকহীন চোখে গভীর বিস্ময়।
মিসির আলি বললেন, ‘খিচুড়ি তো ভাই অপূর্ব হয়েছে! আমাকে রেসিপিটা দেবেন তো! আমিও আপনার মতো একা-একা থাকি। মাঝে-মাঝে খিচুড়ি রান্না করব।’ বলেই মিসির আলি বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসলেন। আমি এর আগে এত অদ্ভুতভাবে কাউকে হাসতে শুনি নি, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
পরিশিষ্ট
আমার অধিকাংশ গল্পের শেষ থাকে না বলে পাঠক-পাঠিকারা আপত্তি তোলেন। এই গল্পের আছে। সুধাকান্তবাবু তাঁর অপরাধ স্বীকার করে থানায় ধরা দিয়েছিলেন। বিচার শুরু হবার আগেই থানা হাজতে তাঁর মৃত্যু হয়।
amazing
বইয়ের শেষে আমার অনুভূতি,” খাইছে রে !!! “
আমার ও একই অনুভূতি
হা হা হা হা হা
Just amazing…… Boss
অসাধারন এবং বেশ ইন্টারেষ্টিং…..
আচ্ছা…..এটা কি বাস্তব কাহিনী নাকি বানানো
Humayun is always “HUMAYUN “
মিসির আলীর রূপকারকে বিনমণ শ্রদ্ধা।