সম্পাদকের দপ্তর থেকে দিন সাতেকের ছুটি নিয়ে কলকাতার বাইরে যেতে হয়েছিল। ফিরে এসে দেখি টেবিলের উপর এক-বাণ্ডিল চিঠি অপেক্ষা করছে। চিঠিগুলি খুলব কি খুলব না এই প্রশ্ন মনের মধ্যে যখন দোদুল্যমান, একে একে বৈঠকের বন্ধুদের আবির্ভাব।
একজন বললেন–কী ব্যাপার, আজ কোথায় একটু জমাটি আড্ডা দেব, আপনি কি-না চিঠির তাড়া নিয়ে বসলেন?
আড্ডার সব্যসাচী সাহিত্যিক স্বভাবসুলভ টিপ্পনী কেটে মন্তব্য করলেন–তাহলে আজ আপনি আপনার প্রেমপত্রগুলি নিয়েই মশগুল থাকুন, আমরা গুটি গুটি বিদায় হই।
মনে মনে ভাবলাম প্রেমপত্রই বটে। নানা ধরনের হাতের লেখার এই বিচিত্র পত্রাবলীর মধ্যে অলংকারশাস্ত্রের যে-কয়টি রসের উল্লেখ পাওয়া যায় তার প্রত্যেকটিই আমার সামনে নীরবে অপেক্ষা করছে। রুদ্ধ খামের অর্গল উন্মুক্ত করলেই একে একে তারা কথা বলে উঠবেকেউ জানাবে হতাশার দীর্ঘশ্বাস, কেউ চায় আশার আলো, আবার কেউ অভিমানভরা কণ্ঠে জানাবে প্রত্যাখানের বেদনা। আবার এর মধ্যে এমন পত্ৰলেখকও আছেন যিনি কিছুদিন অপেক্ষার পর লেখা ফেরত চেয়ে ক্রুদ্ধ হয়ে পত্রাঘাত করলেন–
পত্রিকা সম্পাদনার কাজে আপনার কোন যোগ্যতাই নেই। হাতীবাগানের বাজারে আলুওয়ালা হওয়াই ছিল আপনার উপযুক্ত কর্মক্ষেত্র।
এ-মন্তব্য করেছিলেন রানাঘাটের এক প্রখ্যাত কবি, খর কবিতা পত্রিকায় প্রকাশে কিঞ্চিৎ বিলম্ব ঘটেছিল। আসরের তরুণ কৰিবন্ধুকে এ ঘটনা বলতেই তিনি বললেন–
আপনাদের পত্রিকার আপিস তো বর্মণ স্ট্রীটে। আপনাকে বর্মণ বাজারের আলুওয়ালা হবার উপদেশ না দিয়ে হাতিবাগান বাজারের কথা কেন বললেন?
আসরের সেই কীণকায় সব্যসাচী সাহিত্যিক টেবিলে আঙুল দিয়ে তবলার টোকা মারতে মারতে ঘাড় দুলিয়ে বললেন–হুঁ হুঁ, কথাটা বলেছে ঠিকই। হাতিবাগান নামের সঙ্গে সেই বাজারের আলুওয়ালাদের দেহগত সাদৃশ্য নিশ্চয় আছে, তা না হলে এত বাজার থাকতে হাতিবাগান কেন।
আসরের এই ক্ষীণকায় বন্ধুটি সুযোগ পেলেই আমার মূল দেহে চিমটি না কেটে পারেন না। তিনি আবার বললেন—এই চিঠির পর নিশ্চয় সেই কবির কবিতা আপনাদের পত্রিকায় আর প্রকাশিত হয় নি।
আমি বললাম-তা কেন হবে। ওই চিঠিতেই তিনি কবিতাটি ফেরত পাঠাতে বলেছিলেন; কোন মন্তব্য প্রকাশ না করে কবিতাটি তার কাছে ফেরত পাঠিয়ে দিই। ছয় মাস পর তিনি তার ভুল বুঝতে পেরে সে-কথা অসংকোচে স্বীকার করে কবিতাটি আবার আমার কাছে পাঠিয়ে দেন, যথাসময়ে তা প্রকাশিতও হয়। শুধু তাই নয়, অদ্যাবধি তার কবিতা সাধারণ সংখ্যা ও পূজাসংখ্যায় নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছে।
মনে মনে জানি এর জন্যে লেখককে অপরাধী করা অন্যায়, অপরাধ সম্পাদকেরই। সম্পাদনা-কাজে একটা নির্মমতার দিক আছে। সময় সময় তা এমন প্রকট হয়ে ওঠে যে লেখকের সেন্টিমেন্ট-এর মূল্য তাদের কাছে তখন এক কানাকড়িও থাকে না। কবিতা রচনার পরই কবি ব্যস্ত হয়ে পড়েন তা প্রকাশের জন্য। তিনি চান তার কবিতা কাব্যরসিকদের কাছে অবিলম্বে পেীছে যাক। এই অবিলম্বের কাজে বিলম্ব ঘটলেই লেখক অসহিষ্ণু হয়ে ওঠেন, তার ফলেই এ-ধরনের পত্রাঘাত।
চিন্তাজাল ছিন্ন করে গাল্পিক বন্ধু বললেন—আপনার কাছে নতুন লেখকদের যে সব চিঠি আসে তার প্রধান বক্তব্য বিষয়টি কী?
বক্তব্য সকলেরই প্রায় এক-লেখা কবে প্রকাশিত হবে, আর যদি লেখা নিতান্তই অমনোনীত হয়, তার কারণ জানিয়ে উত্তর দেবার অনুরোধ।
বন্ধুবর বললেন–আপনি কি সবাইকে উত্তরে জানিয়ে দেন কেন লেখা মনোনীত হল না?
বলেন কি মশাই! সে কখনও জানাতে আছে? প্রত্যেক লেখকেরই, সে অখ্যাতই হোক আর প্রখ্যাতই হোক, নিজের সাহিত্যসৃষ্টির প্রতি মমত্ব আপন সন্তানের মতই। সদ্যোজাত শিশু যদি কুও হয়, আপনি কখনও তার পিতার মুখের উপর তা বলতে পারেন?
কথাসাহিত্যিক বন্ধু বললেন—কথাটা অবশ্য ঠিক। আমারই কথা ধরুন না। আমি যখন প্রথম-প্রথম ভারতবর্ষ, প্রবাসী, বিচিত্রায় গল্প পাঠাতাম, তার কিছু ছাপা হত, কিছু হত না। ফেরত পাওয়া গল্পর জন্য সম্পাদকের জবাবদিহি কখনও তলব করি নি। তা ছাড়া আমার লেখার সবচেয়ে বড় সমালোচক আমার দু-একজন সাহিত্য-রসিক বন্ধু। যখনই কিছু লিখি, সেই লেখা নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করি ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
আমি বললাম—এইটিই তো হওয়া উচিত। নবীন লেখকরা এটুকু যদি বুঝতেন তা হলে সম্পাদকের কাজ কত সহজ হয়ে যেত, লেখকের কাছে অপ্রিয়ও হতে হত না। তা ছাড়া এ-কথাটা তাঁরা বোঝেন না যে, কেন লেখা অমনোনীত হল তার কারণ বলতে গেলে প্রত্যেক অমনোনীত লেখার জন্য সম্পদককে চিঠির বদলে প্রবন্ধ লিখতে হয়। তাতে নূতন লেখকদেরই ক্ষতি। কৈফিয়ত দিতে গেলে যে-সময় চলে যায় সে-সময়ে নতুন লেখকদের ফাইল-ভরতি রচনার অনেকখানিই পড়া হয়ে যেত।
বৈঠকের আরেক কোণ থেকে কে-একজন বলে উঠলেন-আপনারা কি সব লেখা সম্পূর্ণ পড়ে ফেরত দেন?
আমি বললাম—অধিকাংশ নবীন লেখকের একটা প্রচলিত ধারণা আছে লেখা না পড়েই আমরা ফেরত দিই। একটা মজার ঘটনা বলি। কিছুদিন আগে ফুলক্যাপ সাইজের দু-শ পাতার একটি উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি লেখকের কাছে ফেরত যাবার পরই তিনি মারাত্মক অভিযোগ করে চিঠি লিখে জানালেন যে, সম্পাদকরা লেখা না পড়েই ফেরত দেন একথা তিনি বহুজনের কাছেই শুনেছিলেন। কিন্তু আমাদের প্রতি তাঁর বিশ্বাস ও আস্থা ছিল বলে তাদের কথা অবিশ্বাস করেই তিনি উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি আমাদের কাছে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ফেরত পেয়ে বন্ধুদের কথার সত্যতা সম্বন্ধে তাঁর আর সন্দেহের অবকাশ নেই। আমরা যে না পড়েই লেখাঁটি ফেরত দিয়েছি তার প্রমাণও তিনি হাতেনাতে পেয়েছেন। পাণ্ডুলিপির ১১৫ পৃষ্ঠা থেকে ১২৫ পৃষ্ঠার একটি ধার তিনি কলে সেলাই করে দিয়েছিলেন এবং তা অক্ষত অবস্থাতেই আছে। এখন আপনারাই বুঝুন, সম্পাদককে বোকা বানাবার কত রকম ফন্দি।
বৈঠকের অপর দিক থেকে প্রশ্নকর্তা আবার বললেন–বুঝেছি। এ অভিযোগ নিশ্চয় আর খণ্ডন করতে পারেন নি।
আমি বললাম-পন না করলে কি আর পার পাবার যো ছিল। সুরসিক পণ্ডিত ডক্টর স্যামুয়েল জনসনের বিখ্যাত উক্তিটা আপনাদের মনে আছে তো–It is unnecessary to eat the whole ox to find out whether the beef is tough; এই উক্তির উদ্ধৃতি দিয়ে সোজা বাংলায় তাকে লিখেছিলাম যে, হাঁড়ির একটা চাল টিপলেই বোঝ যায় সব ভাত গলাধঃকরণ সম্ভব কি না।
আড্ডার রসিকচূড়ামণি মুখ ফসকে কাচা বাংলায় বলে ফেললেন—অর্থাৎ লেজ উন্টে দেখে নেওয়া মাদি না মদ্দা।
বৈঠকের তরুণ কবি দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন–এটা কিন্তু ঠাটার বিষয় নয়। ভেবে দেখুন, নতুন লেখকরা কত যতে, কত আগ্রহ নিয়ে, কত আশা করে তাদের লেখা সম্পাদকের হাতে তুলে দিয়ে কী উৎকণ্ঠায় দিন কাটান। এ-যেন আদরের কন্যাকে সাজিয়ে-গুজিয়ে বরের বাপের সামনে পাঠিয়ে দিয়ে দরজার আড্ডালে দাঁড়িয়ে-থাকা মায়ের উৎকণ্ঠার মত।
কবিবন্ধু কথাটা কাব্যিক উপমা দিয়েই বললেন, এবং তা অগ্রাহ্য করবার মতও নয়। কিন্তু এর আরেকটা দিক আছে ভেবে দেখবার। নতুন লেখকদের মনে একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়ে আছে যে সম্পাদকরা না পড়েই লেখা ফেরত দেন, অথবা নতুন লেখকদের লেখার প্রতি তাদের আগ্রহ নেই। এই ভ্রান্ত ধারণাটা আমার মনে হয়, কোন কালেই এদের মন থেকে দূর করা যাবে না। কিন্তু এই সব লেখকরা পত্রিকার লেখক-সুচী যত্ন সহকারে অনুধাবন করলে দেখতে পাবেন নতুন লেখকদের লেখা কী পরিমাণ আগ্রহ নিয়ে আমরা খুঁজে বেড়াই। যে-কোন পত্রিকার জীবনী শক্তিই হচ্ছে নতুন লেখকদের পাণ্ডুলিপি। তবে একথাও ঠিক, সম্পাদকরাও মানুষ। বিচারে ভুল-ভ্রান্তি তাদের ঘটতে পারে, ঘটেও থাকে। এক পত্রিকার সম্পাদকের কাছ থেকে কোন লেখা ফেরত গেলে মুষড়ে পড়বার কোন হেতু নেই। সেই লেখাই অন্য পত্রিকার সম্পাদক সমাদরের সঙ্গেই গ্রহণ করবেন। এরকম দৃষ্টান্ত রয়েছে একাধিক। শরৎচন্দ্রের উপন্যাস চরিত্রহীন-এর পাণ্ডুলিপি প্রবাসী-সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ফেরত দিয়েছিলেন এবং পরে যমুনা পত্রিকার সম্পাদক ফণীন্দ্রনাথ পাল তা সমাদরের সতেই পত্রস্থ করেন।
বৈঠকে আরেক প্রস্থ চা এসে গেল। গরম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সবাই চাঙ্গা হয়ে উঠল। আমি আবার ফিরে গেলাম আমার প্রতীক্ষারত চিঠির মধ্যে। এক-একটি করে চিঠি খুলে চলেছি, বন্ধুরা ততক্ষণ গল্পগুজবে মত্ত। একটা চিঠির মধ্যে কৌতুককর এমন কিছু মন্তব্য ছিল যা পড়ে আমি হাসি সংবরণ করতে পারি নি। আমাকে হাসতে দেখে বৈঠকের সব্যসাচী সাহিত্যিক বলে উঠলেন—একাই উপভোগ করছেন, আমরাও কি ভাগ পেতে পারি না?
দপ্তরে প্রতি সপ্তাহে সাহিত্য-সরস্বতীর নবীন ভক্তদের কাছ থেকে পরুতের কাছে যেসব চিঠিপত্র আসে তা ছাপানো হলে পসাহিত্য একটি রীতিমত উপভোগ্য সামগ্রী হতে পারে। কিন্তু সম্পাদককে বাধ্য হয়েই এই সব পত্রাবলীর রস একা-একাই উপভোগ করতে হয়। সবাইকে ভাগ দিয়ে উপভোগের মন্ত অন্তরায় হচ্ছে, চিঠি নিতান্তই ব্যক্তিগত। সম্পাদক তা প্রকাশ করতে পারেন না, তেমন কাজ সাংবাদিকের নীতিগত বিশ্বস্ততার বিরোধী।
তবু যে-চিঠিটি আমি একাই পড়ে উপভোগ করছিলাম, বৈঠকের বন্ধুদের উপরোধে তা না শুনিয়ে পারলাম না। এই নীতিবিরুদ্ধ কাজের জন্য পত্ৰলেখকের কাছে পূর্বাহেই মার্জনা ভিক্ষা চাই।
গার্ড ই. রেলওয়ে
রামপুরহাট
সবিনয় নিবেদন,
আপনার জবাবী পোস্টকার্ডের উত্তর পেয়ে যথেষ্ট আনন্দ পেয়েছি, বেদনাও পাই নি কম। আপনি তবু ভদ্রতা করে চিঠিটা ছিড়ে ফেলে দেন নি—এই মা আনন। নইলে আর আনন্দ পাওয়ার মত কিছুই ছিল না আপনার মর্মবাণীতে।
মহিমান্বিত বিশাল সাগরের মই আপনি উদার হৃদয় এই ভেবেই আমার আশাবাণী আপনার কাছে পৌঁছে দিয়েছিলুম; কিন্তু আপনার উত্তর পাওয়ার পর এই সিদ্ধান্তেই শেষে পৌছুলাম যে, আপনি সাগর-শুকিয়ে-ওঠা দিগন্তপ্ৰসারী আলাময়ী মরুপ্রান্ত ছাড়া আর কিছু নন। সাগরের মহিমা হারিয়ে আপনি নীরস বালুচর হয়ে রুদ্রাক্ষমূতি ধরেছেন। নামের মহিমাই নেই আপনার মধ্যে। আপনার নাম মরুময় ঘোম হলে মন্দ হয় না, নয় কি?
রেলওয়েতে সামান্য গার্ডের চাকরি করি জেনে এই ধারণাই যদি করে থাকেন যে, বাণীর আসন পাতা নেই আমার মনে-প্রাণে তাহলে নিশ্চয় করে বুঝব, আপনি চরম ভুল করেছেন একটা। আমি বাণীর একনিষ্ঠ সাধক এই কথাটাই আজ গর্বভরে আপনাকে জানালাম। আমার মধ্যে যে আগামী সম্ভাবনা ও প্রতিভার অঙ্কুর প্রকাশ পেতে চাইছে আলো-ঝলমল পৃথিবীতে, আপনার মত সাহিত্যসেবী যদি তাকে এতটুকু সাহায্য করে ৰাইরের রৌদ্রকরোজ্জ্বল সাহিত্য-জগতের মুখ না দেখান-তাহলে সেই–শিশুচারা যে চিরকালের বুকে অজান্তেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। উপযুক্ত প্রার্থিতকে বিফলমনোরথ করার একটা সাবকনশাস বেদনাবোধ আছেই, পরে হয়তো একদিন অনুভব করবেন জীবনের গোধুলিবেলায়। আপনার প্রত্যাখ্যান মানেই, আমার প্রতিভার শিশুচারাকে হাতের চেটোয় নির্মমভাবে পিষে ফেলা ছাড়া আর কিছু নয়। শুধু আমার কেন, আমারই মত বহ আশাকামী সাহিত্যসেবীর প্রতিভাই অঙ্কুরে বিনাশ হয়ে গেছে আপনাদের মত প্রাণহীন বেদরদী সাহিত্যিকদের নির্মম উপেক্ষা আর তাচ্ছিল্যের চাপে। এতবড় জীবন-নাট্যের ট্র্যাজেডি আর কি আছে?
আপনি আমাকে সারমন দিয়েছেন দুটো। একটা হল—উপস্থিত পত্রিকার স্থানাভাব। দাতের মাজন, লোমনাশক সাবান আর কুঁচ তৈলের বিজ্ঞাপনে বোঝাই পাতাগুলো দেখলে স্বাভাবিকভাবে আপনার এ সারমন মাথা পেতে নিতে পারি না।
এ ছাড়াও দেখেছি, যেসব সাধারণ মামুলী গল্পকে আপনারা অতি সহজে পাসপোর্ট দিয়ে দেন মুন্ত্রণের জন্য, আমার রচনা সেগুলোর চেয়ে নিকৃষ্ট কোনও মতেই নয়। ধন্য আপনাদের গুণবিচার।
ত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত আমি জেনে এসেছি যে সুপারিশ তদ্বির জয় মামার জোর না থাকলে চাকরি, ব্যবসা, সিনেমা ও থিয়েটার-জগতে স্থান পাওয়া যায় না। কিন্তু আপনার মিষ্টি সুরের প্রত্যাখ্যানপত্র পাওয়ার পরে এও জানলাম যে বিদ্যাদেবীর রাজ্যেও উমেদারির প্রয়োজন আছে।
আপনার দ্বিতীয় সারমন কিন্তু সম্পূর্ণ বাস্তববিরোধী। অনির্দিষ্ট কালের এক সময়ে গঞ্জি একে দিয়েছেন আপনি আমার ভবিষ্যৎ বাসনার ওপর। এ যে অসম্ভব। আপনি লিখেছেন, যদি কখনও পত্রিকার পাতার সংখ্যা বাড়ানো যায়, তখন যোগাযোগ স্থাপন করবেন। ততদিন কি আমি
এই ধূলার ধরণীতে টিকে থাকব? ইতি–
ভবদীয়
সাধনকুমার দাস
চিঠি পড়া হতেই বৈঠকের এক বন্ধু বললেন–আজকালকার লেখকদের আপনারা কচি থোক। মনে করবেন না। যতই আপনারা স্থানাভাব আর পৃষ্ঠা বৃদ্ধির মামুলী যুক্তির মোয়া তাদের হাতে তুলে দেন না কেন, ভবী ভোলবার নয়।
গাল্পিক বন্ধু বললেন–এ তো তবু ভাল। জাপানে শুনেছি পত্রিকা সম্পাদকরা বৈষ্ণব বিনয়ের এক-একটি অবতার। ছাপার অযোগ্য লেখা লেখককে যে চিঠি দিয়ে ফেরত দেন তা হচ্ছে-আপনার লেখার মান এতই উচ্চস্তরের যে, এই লেখা পত্রিকায় প্রকাশিত হইলে পত্রিকার মানও উচ্চস্তরে উঠিয়া যাইবে। কিন্তু ইহার একটি বিপদ আছে। আপনার ন্যায় বিদগ্ধ মনস্বী লেখক আমাদের দেশে আর দ্বিতীয় একজনও নাই। সুতরাং আপনার রচনা প্রকাশিত হইলে পত্রিকার মান যে-স্তরে উঠিবে সে-স্তর রক্ষা করা আমাদের পক্ষে দুঃসাধ্য হইয়া পড়িবে। এই আশঙ্কা করিয়াই আপনার এই বহুমূল্যবান রচনা গভীর দুঃখের সহিত ফেরত পাঠাঁইলাম।
আমি বললাম—আমাদের দেশে তরুণ লেখকদের মনোনীত লেখা প্রত্যাখ্যান যত মোলায়েম ভাষাতেই করুন না কেন তারা বিক্ষুব্ধ হবেই। আগেই বলেছি, আপন সন্তানের মতই লেখার প্রতি লেখকদের অসীম মমতা, তাই এই বিক্ষোভ। এবং এই বিক্ষোভজনিত উষ্মভরা চিঠি সম্পাদকের দপ্তরে প্রতিদিন আসে এবং তা সম্পাদককে নতমস্তকে শিরোধার্য করে নিতে হয়। এটা তাদের নিত্য প্রাপ্য। কিন্তু শিক্ষিত প্রবীণ লেখকেরা যে কত বেশ ছেলেমানুষি করে থাকেন, তার একটা নমুনা আপনাদের দিই। এই কলকাতারই কোন একটি বিখ্যাত ইংরিজী দৈনিক পত্রিকার এক সহকারী সম্পাদক গল্প-উপন্যাস লিখে থাকেন। একবার পূজা সংখ্যার জন্য একটি গল্প তিনি পাঠান। পূজা সংখ্যা প্রকাশের পূর্বে লেখকদের নামের তালিকা প্রকাশিত হয়। তালিকা যে-দিন প্রকাশিত হয়েছে সেই দিনই দুপুরে আমার দপ্তরে ভদ্রলোকের আবির্ভাব। দেখতে নোগা এবং বেঁটে হলে কি হবে, কড়া-মেজাজী লোক। দরজার চৌকাঠ পার হয়েছেন কি হন নি-হাতের ইয়া-মোটা বেতের লাঠিটা ঠকা ঠকাস করে মেঝেতে ঠুকতে ঠুকতে আমার দিকে বাক্যবাণ ছুড়তে লাগলেন-তালিকায় আমার নাম নেই কেন?
ধরেই নিয়েছেন তালিকা থেকে ওর নাম কখনই বাদ যেতে পারে না।
আবার গর্জন-আমার লেখা আপনারা ছাপবেন কি ছাপবেন না, জানতে পারি কি?
রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত কবিতার একটা লাইন মনে পড়ে গেল। এত ক্ষুদ্র যন্ত্র হতে এত শব্দ হয়। সভয়ে বললাম-আজ্ঞে, জায়গা করতে পারি নি, তাছাড়া গল্পটা আকারেও
ওসব ঘেঁদো কথা শুনতে চাই না। লেখাটা ফেরত দিন। ওর চেহারার আস্ফালন লাঠির আস্ফালনকেও ছাড়িয়ে যায়। বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়।
তাড়াতাড়ি ফাইল থেকে লেখাটা বার করে এগিয়ে দিতেই ফস্ করে আমার হাত থেকে পাণ্ডুলিপিটা এক হ্যাচকায় কেড়ে নিয়ে বললেন–এই বলে গেলুম। একদিন লেখার জন্য আপনাকে আমার বাড়িতে দু-বেলা হাঁটাহাঁটি করতে হবে।
সঙ্গে সঙ্গে বললাম—আমিও প্রার্থনা করছি যেন সে-সৌভাগ্য আমার 071
ঝড়ের বেগে ভদ্রলোক বেরিয়ে গেলেন, আমার কথাটা শুনতে পেলেন কি না জানি নে।
বৈঠকের সেই সব্যসাচী লেখক রস দিয়ে বললেন–যা দিনকাল পড়েছে তাতে লেখা ছাপানোর এই পদ্ধতিটাই দেখছি প্রশস্ত। এক হাতে লাঠি, অপর হাতে লেখা, কোনটা চাই।।
আর গাল্পিক-লেখক বললেন–ভদ্রলোকের ভবিষ্যদ্বাণীটা কি ফলেছে?
আমি বললাম-সেইটাই তো আমার আফসোস। আজ দশ বছর ধরে অপেক্ষা করে আছি, তাঁর বাড়িতে দু-বেলা হাঁটাহাঁটির সুযোগ আজও আমি পেলাম না।
আসরের তরুণ কবি-বন্ধু বললেন–সাধনকুমার আর লাঠিধারী লেখকের নজির থেকে নিশ্চয় আমাদের এ-সিদ্ধান্ত করা ঠিক হবে না যে, এ-ক্ষেত্রে সব নতুন লেখকেরাই সম্পাদকের শক্ত হয়ে ওঠেন।
আমি টেবিলের সেই চিঠির বাণ্ডিল থেকে একটি পোস্টকার্ড বার করে দেখালাম। পত্ৰলেখককেও অক্ষমতা জানিয়ে রচনা ফেরত দেওয়া হয়েছিল। পত্ৰলেখক সম্পাদকের মনের কথাই এই চিঠিতে ব্যক্ত করেছেন।
লোকপুর
বীরভূম
মহাশয়,
আপনার বিনীত উত্তরে কৃতজ্ঞ হলাম। আমার রচনাটি প্রকাশে অক্ষমতার জন্য ক্ষমা চেয়ে কিন্তু দুঃখ দিয়েছেন। আপনাদের পত্রিকা বাংলার সম্পদ। আমারও অংশ তাতে নিশ্চয় আছে। সাধারণ বস্তুতে কোষ-কলেবর স্ফীত না করে বিশেষ সম্ভারে তাকে সমৃদ্ধ করে ভোলাই তো কোষাধ্যক্ষের প্রকৃত কর্তব্য। তাতে ব্যক্তিবিশেষের ক্ষোভ এলেও বৃহত্তর ব্যক্তি-সমাজ আনন্দই লাভ করবে।
স্থানকালে কথাটি উপদেশের মত শোনালেও বিশ্বাস করবেন আন্তরিক ভাবেই বলছি। আপনাদের পত্রিকার সমৃদ্ধি আন্তরিকভাবে কামনা করে এবং আপনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে শেষ করছি।
ভবদীয়
দেবপ্রসাদ
সম্পাদকের দপ্তরে অধিকাংশ পত্ৰলেখক সপ্তমে সুর চড়িয়ে এই কৈফিয়ত তলব করেন যে, তাঁর মত একজন লেখকের লেখা যখন ছাপানো হয় নি তখন সম্পাদক মহাশয় যে নিতান্ত একজন অপদার্থ ব্যক্তি তা তিনি অনুগ্রহ করে সম্পাদককে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। অপর একদল আছেন স্বাদের চিঠি সম্পাদকের স্তাবকতায় ভরা।
এই সব চিঠির এ-হেন রাগানুরাগের উদ্দেশ্য কী, সম্পাদকের অবশ্য তা বুঝতে বেগ পেতে হয় না। মনের কথাটা সহজেই তাঁরা বুঝে নিতে পারেন–এবং সে-কথাটা হচ্ছে—পত্ৰলেখকরা সবাই চান তার লেখা ছাপানো হক এবং উপযুক্ত মর্যাদার সঙ্গেই ছাপানো হক।
প্রস্তাব অবশ্য মন্দ নয়, অযৌক্তিকও নয়। পত্রিকায় লেখা ছাপানোর প্রয়োজন আছে, সুতরাং সে প্রয়োজন সিদ্ধ করবার জন্য গরজ দেখানোও দোষের কিছু নয়। কিন্তু মুশকিল হল এই যে, সম্পাদক মহাশয়দের পক্ষে সব সময় এই গরজ অনুযায়ী কাজ করা সম্ভব হয় না, ফলে প্রতিদিন গাদাগাদা লেখা ফেরত যায় এবং লেখকদের নিদারুণ মনঃক্ষোভের কারণ ঘটে।
বৈঠকের একজন প্রশ্ন করলেন—কেন এমনটা হয়, এর কি কোন প্রতিকার নেই?
সেইটাই বিবেচ্য। লেখা ছাপাবার প্রয়োজন আছে, এবং এও সত্য যে, সে-প্রয়োজন প্রতিপালন করা সম্পাদকের কর্তব্য। সম্পাদকরা যদি সে কর্তব্যে পরান্মুখ হন, তবে তাদের উপর অভিযোগ করার কারণ নিশ্চয় থাকে। কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে এই কর্তব্য প্রতিপালন করার, অভিযোগ তাদের উপর বাস্তবিক করা যায় কি না অনেকে তা বুঝে উঠতে পারেন না, ফলে সম্পাদকের উপর অবিচারের একটা ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে বসেন।
লেখা ছাপানোর প্রয়োজন সত্যিই আছে, দশজনের চোখে সেগুলি পড়ে এবং তাতে কাজ হয়; কিন্তু এই কাজের দিকটা হাসিল করাই যদি সব লেখার উদ্দেশ্য হত, অন্তত শুধু সেইটুকুর উপর জোর দেওয়া হত, তবে সমস্যা বিশেষ কিছু ছিল না। পত্রিকায় লেখা ছাপানোর মূলে একটা উদ্দেশ্য থাকে সেটা আর কিছুই নয়, নিজের নামটা জাহির করা, যশ বা খ্যাতির আকর্ষণ। যশ বা খ্যাতির আকাক্ষা কারও থাকে থাকুক, সম্পাদকের তা খতিয়ে দেখার আবশ্যক ততটা থাকে না; তাঁদের দ্রষ্টব্য হল পাঠকদের মনের ক্ষুধা মিটছে কিনা। কোন লেখকের লেখা যদি পাঠকদের মনের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে, তবে সে-লেখার সূত্রে লেখক যশ বা খ্যাতি পান ভালই। তাতে পত্রিকারও যশ বা খ্যাতি বাড়ে। কিন্তু আসল উদ্দেশ্যকে বাদ দিয়ে নিছক অযোগ্যকে ভোল্লা দেওয়া সম্পাদকের কর্তব্য নয়, সে-লেখক যিনিই হন এবং যত বড় মেকদারের লোকই হন নাকেন। সাহিত্যের কমলবনে এই সব মেকদার হস্তীর উৎপাত মাঝে মাঝেই ঘটে থাকে। নিজের নাম বা যশকে বড় করে দেখিয়ে সম্পাদকদের চাটুকারিতা করা যেমনই অবান্তর বা অনাবশ্যক, তেমনই তাঁদের হুমকি দেখানও হাস্যকর। এক্ষেত্রে সম্পাদকরা নিন্দা-স্তুতিতে সমান নিরপেক্ষ থাকতে বাধ্য, বাধ্য কর্তব্য-প্রতিপালনেরই দায়িত্বে।
বৈঠকের পেট-বোগা সব্যসাচী সাহিত্যিক খোঁচা দিয়ে বললেন–সম্পাদকদের হয়ে ওকালতি করতে গিয়ে খুব যে লম্বা বক্তৃতা ঝাড়লেন। না হয় মানলুম পাঠকদের কথা ভেবেই আপনারা কর্তব্য পালন করে থাকেন। কিন্তু বিজ্ঞাপনগুলি কি পাঠকদের চক্ষুশূল নয়? আর লেখকরাই বা কেন মনে করবেন না যে, বিজ্ঞাপনগুলো হচ্ছে দেবী সরস্বতীর পূজামণ্ডপের চাদমালা আর লেখকদের রচনা হচ্ছে সেই চাঁদমালা বোলানোর সুতো। রামপুরহাটের সেই পত্ৰলেখকের অভিযোেগ কি নিতান্তই মিথ্যে?
একটা কথা ভুলে যাচ্ছেন কেন, বিজ্ঞাপন হচ্ছে যে-কোন পত্রিকার মেরুদণ্ড। মেরুদণ্ডের জোর না থাকলে সব পত্রিকাকেই খুঁড়িয়ে চলতে হয়, অবশেষে অকালেই পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটে। বিজ্ঞাপনই হচ্ছে প্রদীপের সলতে। যতই তেল ঢালুন বা পাতার পর পাতা সারগর্ভ রচনা দিয়ে ভরাট করুন, সলতে না থাকলে আলো জ্বলবে কেন? অনেকেই এটা বোঝেন না যে, শুধু সাহিত্যের মহান আদর্শ নিয়ে পত্রিকা প্রকাশ করতে গেলে না বাঁচে পত্রিকা, না টেকে আদর্শ। আদর্শ নিশ্চয় থাকবে কিন্তু সেই সঙ্গে চাই সমপরিমাণ ব্যবসা বুদ্ধি। যে-পত্রিকার পরিচালক এ-দুয়ের সামঞ্জস্য রক্ষা করতে পেরেছেন তাদেরই পত্রিকা আজ মর্যাদা আর প্রতিষ্ঠা দুইই লাভ করেছে। তা ছাড়া কাগজের এই দুমূল্যের বাজারে গ্রাহকদের কাছ থেকে যে চাদা পাওয়া যায় তাতে কাগজের দামই ওঠে না। তার উপর আছে কম্পোজ, ছাপা, বঁধাই, কর্মীদের বেতন এবং সর্বোপরি লেখকদের সম্মান-মূল্য। বিজ্ঞাপন না হলে এ-খরচটাই বা আসবে কোথা থেকে? নিছক আদর্শের জন্য ঘরের-খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে গিয়ে একাধিক প্রথম শ্রেণীর সাহিত্য-পত্রিকা বাংলা দেশ থেকে চিরকালের জন্য বিলুপ্ত হয়ে গেছে তার নজির খুজতে বেশীদুর যেতে হবে না। আমার মনে হয় বঙ্কিমচন্দ্র বঙ্গদর্শন পত্রিকা এই কারণেই বেশীদিন চালাতে পারেন নি। রবীন্দ্রনাথ সম্পাদিত সাধনা ও ভারতী পত্রিকার অচিরে বিলুপ্তি এই একই কারণে। আর রবীন্দ্রনাথের সর্বাত্মক পোষকতা সত্ত্বেও ডাকসাইটে সম্পাদক প্রমথ চৌধুরীকে কী আক্ষেপের সঙ্গে সবুজপত্র বন্ধ করতে হয়েছিল সে তত হালফিলের ঘটনা, আপনাদের অজানা নয়। জমিদারির আয় যখন কমে গেল সবুজপত্রর পাতাও ক্রমে হলদে হয়ে একদিন ঝরে পড়ল। পরবর্তী যুগে যারাই সাহিত্য-পত্রিকা প্রকাশ করেছেন তারা পূর্বসূরীদের এই অভিজ্ঞতা থেকেই প্রদীপের সলতের দিকে নজর রেখেছিলেন বলেই সে-পত্রিকা আজও সগৌরবে সুপ্রতিষ্ঠিত। অধিকাংশ পাঠক এই দিকটা বিবেচনা করেন না, তাই অকারণে পত্রিকার পরিচালক বা সম্পাকের উপর দোষারোপ করে থাকেন।
সাহিত্যে সব কারবারের কারবারী সব্যসাচী লেখক বললেন–
আপনার এই যুক্তি সম্পূর্ণ মেনে নিতে না পারলেও এটুকু স্বীকার করবই যে, আগেকার দিনে সাহিত্যিকরা লিখতেন প্রাণের তাগিদে, প্রতিদানে পেতেন যশ ও খ্যাতি। তারা ছিলেন তাতেই সন্তুষ্ট। আজকের দিনে জীবনের মূল্যবোধ গেছে পালটে। যশ ও খ্যাতির বিচার হয় টাকায়, জীবনের মূল্যায়ন হয় কাঞ্চনমূল্যে। সেদিক দিয়ে আজকের লেখকরা লাভবান। প্রাণের তাগিদকে শিকেয় তুলে রেখে টাকার তাগিদেই লেখেন, সাহিত্যপদবাচ্য হক আর না হক। এই সব লেখক সবচেয়ে বেশী আস্কার। পান পত্রিকা-সম্পাদক আর পুস্তক প্রকাশকদের কাছে।
আমি বললাম—এ নিয়ে আক্ষেপ করে লাভ নেই। আমি বলব, পাঠকরা কেন এই লেখা হুমড়ি খেয়ে পড়েন। আপনি বলবেন সম্পাদক-প্রকাশকরা কেন এ সব লেখা ছাপেন। এর কোন মীমাংসা নেই—এ হচ্ছে ভিশ্যাস সার্কল।
আমাদের গাল্পিক বন্ধু এতক্ষণে মুখ খুললেন—তাহলে আমার একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। একদিন বিকেলে কলেজ স্ট্রীটে আমার বইয়ের প্রকাশকের দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছি, এমন সময় এক যুবক কাউণ্টারে এসে জিজ্ঞাসা করলেন—আপনাদের কাছে পাঠ্যপুস্তক পাওয়া যাবে?
দোকানের মালিক বললেন–আপনি ভুল করেছেন, আমরা টেক্সট বুক। ছাপাই না।
উত্তরে যুবক বললেন— জানি। বইয়ের বাজার তো অপাঠ্য পুস্তকে ছেয়ে গিয়েছে। আমি তাই কিছু পাঠ্যপুস্তক খুঁজে বেড়াচ্ছি।
আমি বললাম—ভদ্রলোক খাঁটি কথাই বলেছেন। বই বাছতে গুদাম উজাড়। শান্তিনিকেতনে আমাদের অঙ্কের মাস্টারমশাই জগদানন্দ রায়কে আপনারা সবাই চেনেন। ছেলেদের জন্য বিজ্ঞানের বই লিখে যিনি স্বনামধন্য। তার একমাত্র ছেলে ত্রিগুণানন্দ রায়, ডাক নাম পটল। স্কুলে কলেজে খুবই মেধাবী ছাত্র ছিলেন, যৌবনে ভাল চাকরি করতেন। সেই আমাদের পটলদা হঠাৎ পাগল হয়ে গেলেন। একদিন প্রচণ্ড গ্রীষ্মের দুপুরে দেখি পটলদা মাথায় প্রকাণ্ড এক পাগড়ি বেঁধে তার উপর বীরভূমী তালপাতার একটা টোকা চাপিয়ে মাঠের মধ্যে দিয়ে চলেছেন। গায়ে গরম কোট, হাতে একটা লণ্ঠন এবং লণ্ঠনটি জ্বলছে। ওঁকে যখন জিজ্ঞাসা করা হল—কি পটলদা, দুপুর বেলায় লণ্ঠন জ্বালিয়ে কোথায় চললেন?
গম্ভীর হয়ে পটলদা শুধু বললেন, মানুষ খুজতে।
বৈঠকের এক দর্শনিক কবি বলে উঠলেন-আহা হা, কী খাঁটি কথা। দেশ যেখানে অমানুষে অন্ধকার সেখানে আলো জ্বালিয়ে খাঁটি মানুষ খুঁজতে বেরিয়েছেন। আপনাদের পটলদাকে পাগল বলছেন কি মশাই, এ-তত হাই ফিলসফি। গগন হরকরার সেই বিখ্যাত বাউল গানটা মনে পড়ে গেল–
আমি কোথায় পাব তারে
আমার মনের মানুষ যে রে।
হারায়ে সেই মানুষে, তার উদ্দিশে
দেশ বিদেশে বেড়াই ঘুরে।
সব্যসাচী লেখক দার্শনিক কবিকে থামিয়ে দিয়ে টিপ্পনী কেটে বললেন-–মানুষ নিয়ে দর্শনশাস্ত্র আওড়ানো এখন থাক। আমাদের কথা হচ্ছিল লেখক নিয়ে। ফকিরের গানটায় মানুষ-এর জায়গায় লেখক বসিয়ে দিন আমাদের আজকের আলোচনার মোদ্দা কথাটা সুড়সুড় করে বেরিয়ে আসবে এবং বই-খুজতে-আসা সেই যুবকের প্রশ্নের হেঁয়ালিটাও জলবৎ তরল হয়ে যাবে।
তরুণ কবি বলেলেন-বিষয়টা কিন্তু সত্যিই চিন্তা করবার। আপনার পটলদা দিনের আলোয় লণ্ঠন জেলে মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছেন, বই পাড়ার সেই যুবক খুজে বেড়াচ্ছেন পাঠ্যপুস্তক আর সম্পাদকরা খুঁজে বেড়াচ্ছেন মনের মত লেখক। কিন্তু এ-খোঁজার কি শেষ আছে?
এবার গাল্পিক লেখক বললেন–যে কথা দিয়ে আজকের আলোচনা শুরু হয়েছিল তাই চলুক। আপনারা বড় বাজে কথায় চলে যাচ্ছেন, কাজের কথায় আসুন। আমার প্রশ্ন হচ্ছে সম্পাদকের দপ্তরে যেসব বিক্ষোভপূর্ণ চিঠিপত্র আসে তাদের প্রধান অভিযোগটা কী?
আমি বললাম—প্রধান অভিযোগ যা, তা তো আপনারা রামপুরহাটের চিঠিতেই পেলেন। তদ্বির, মামার জোর না থাকলে সম্পাদকরা লেখা ছাপেন না। সম্পাদকের বিরুদ্ধে, প্রধানত সাময়িক-সাহিত্য এবং চিরন্তন সাহিত্য এই দুই রকম মাল নিয়ে একসঙ্গে যাদের কারবার, কেউ কেউ অভিযোগ করেন যে সম্পাদক বাইরে থেকে ভাল লেখা পেলেও ছাপেন না। তাদের একটা জোটবাঁধা দল আছে, শুধু সেই লেখকদের লেখাই তাঁদের আদর পায়। এই অভিযোেগ যে কতটা ভিত্তিহীন, পত্রিকার সংশ্রবে যারাই এসেছেন তারা ভালভাবেই জানেন। ভাল লেখা যে পাওয়া কত দুর্ঘট, বাইরে যারা থাকেন, তাঁরা সে খবর রাখেন না। এমন অবস্থায় ভাল লেখা পেলেই সম্পাদকরা সেগুলি অনাদর করবেন, একি সম্ভব? পত্রিকা পরিচালনার অন্য আদর্শ বা সে সম্বন্ধে সম্পাদকের কর্তব্যের কথা যদি ছেড়েও দেওয়া যায়, তা হলেও এ-যুক্তি টেকে না। সম্পাদকরা বেশ জানেন, ভাল লেখা পত্রিকায় প্রকাশ করলে, তাদের কাগজের আদর বাড়বে, প্রচার এবং প্রসার হবে, সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞাপনও বাড়বে। অন্য কথায় ব্যবসার অর্থাৎ পয়সা আসবার পথ বেশী প্রশস্ত হবে। দলের খাতির যোগাতে গিয়ে ভাল লেখাগুলিকে বাদ দিয়ে যেসব লেখা খারাপ সেগুলিকে প্রাধান্য দেওয়ার অর্থ তাঁদের নিজেদের পায়ে কুড়ল মারা। এমন বিচার নিয়ে চলতে গেলে নিজেদের কাগজের অন্তেষ্টিক্রিয়ার দিনটা আগে নির্দিষ্ট করে নিতে হয়। সত্যিই কোন কাগজের যদি নিজেদের কোনো সাহিত্যিক দল থাকে তবে সে-দলের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে যতই বড় বড় কথা শোনা যাক না কেন, আসলে হল স্বার্থ, অর্থাৎ ভাল লেখা পাবার ব্যবস্থা করা। খাতিরে লেখা ছাপানো কালে ভদ্রে চলতে পারে, কিন্তু দলের খাতিরে কারো মন্দ লেখা বরাবর চালানো যায় না। কারণ স্বার্থের দিক থেকেই তা ক্ষতিকর। বাইরে থেকে যদি কারও ভাল লেখা পাওয়া যায় তাহলে সম্পাদকরাই তাঁকে দলে টেনে আনবার জন্য তৎপর হয়ে পড়বেন এবং সেইটিই ঘটে থাকে।
সম্পাদকের কাছে তরুণ লেখকরা হামেশাই অনুরোধ করে থাকেন তাদের লেখা কাঁচা হলেও তা প্রকাশ করে উৎসাহ দেওয়া উচিত। কিন্তু নীতির দিক থেকে সম্পাদকেরপক্ষে এমন অনুরোধ রক্ষা করা কঠিন। কারণ, সম্পাদকরা যাদের মুন খান, সোজা কথায় যারা তাদের গ্রাহক, তাদের প্রতি কর্তব্য কিভাবে প্রতিপালিত হয়—সেটিই তাদের প্রধান বিবেচ্য। ছাপানোর মূলে ব্যক্তিগতভাবে সম্পাদকের মহৎ উদ্দেশ্য যতই থাকুক না কেন, গ্রাহকেরা সে ধার ধারবেন না। অনেক সময় সম্পাদকের কাছে এমন অবোধ আসে যে আর্থিক অনটনে জীবন দুর্বিসহ, লেখাগুলি ছেপে দিলে বিপদে উপকার হয়। এক্ষেত্রে সম্পাদকের ব্যক্তিগতভাবে সৎপ্রবৃত্তি বা সাধু উদ্দেশ্য চরিতার্থ করবার জন্য গ্রাহকদের খারাপ জিনিস দেওয়া সঙ্গত হতে পারে না। সম্পাদকরা সব সময় ভাল লেখাই দিয়ে থাকেন এমন কথা জোর দিয়ে আমি বলতে চাই না। তবে তারা চেষ্টা করেন সব সময় যতটা সম্ভব ভাল লেখা দিতে।
তরুণ লেখকদের একটা কথা জানা উচিত যে, সাহিত্যভারতীর মন্দিরের পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। অনেক তিতিক্ষা, অনেক প্রতীক্ষা, অনেক ধৈর্যের প্রয়োজন সে-মন্দিরের পূজামণ্ডপে উপস্থিত হতে। অন্তরে জ্বালা নিয়েই এ-পথে এগিয়ে আসতে হবে, আঘাতে হতোদ্যম হলে চলবে না। লিখে যাওয়া উচিত, এবং সে লেখা সম্পাদকের কাছে পাঠিয়ে যাওয়াও উচিত ফলের আশা ত্যাগ করেই। এই ভাবেই একদিন কঁচা লেখা পাকা হবে, সম্পাদকরা তখন আগ্রহের সঙ্গেই সে-লেখা প্রকাশ করবেন। এমনি করেই তারাও একদিন সম্পাদকের গোষ্ঠীভুক্ত হয়ে পড়বেন।
আমার কথাও ফুল, আসরের শেষ চক্র চা-ও এসে গেল। কথায় কথায় রাত হয়ে এসেছে, সবারই উঠি-উঠি ভাব। টেবিলের উপর একরাশ খোলা চিঠি। চিঠিগুলি এতক্ষণ তাদের অনুরোধ উপবোধ রাগ অনুরাগ উম্মা আর হতাশা নিয়ে আমার কাছে কলরব করে উঠেছিল, এখন তারা শান্ত স্তব্ধ নীরব। এরা কি চিরকালের মত আমার কাছে নীরব থেকে যাবে? আমি আশাবাদী তাই আমি জানি যে, এদের মধ্যেই কোন-কোন লেখক একদিন কথা বলবে এবং সে-কথা সম্পাদকের দপ্তর ছাপিয়ে বাংলার ঘরে ঘরে ধ্বনিত হবে। সেই অনাগত পথিকের পদধ্বনি শুনবার জন্যই আমি কান পেতে আছি।