নবম পরিচ্ছেদ
০১.
রানীর জন্মোৎসবেই সময়ের হিসাব। তখন অঘ্রানের প্রথম, নভেম্বরের মাঝামাঝি, জন্মোৎসব দু সপ্তাহও দূরে নয় আর। শীত পড়েছে। হালকা রাগ নেমেছে শয্যায়।
সেদিন রবিবার। বাগচীর ঘুম ভেঙেছে যেন, কিন্তু এখনো সে শয্যায়। রবিবার বলে? ছুটির দিনেই কিন্তু অন্যদিনের আগে তার কাজের দিন শুরু হয়। সে কি অসুস্থ? উল্টো বরং নরম, ল্যাভেন্ডারগন্ধী রাগের নিচে তার শরীরটা সুস্থ, সানন্দ, বিশেষ রকমে হালকা। তার কি স্কুলের কথা মনে নেই? বরং এখনই সে ঘুমে জড়িয়ে ভাবছিলো, গতবারের চাইতে এবার তার স্কুলে ছুটি বেশি। রাসের ছুটি, জন্মোৎসবের ছুটি, বড়দিনের ছুটি। গতবার রাসের ছুটি ছিলো না।
অন্যান্য সকালে বাগচী উঠে যাওয়ার পরে কেট তার নিজের শয্যা ত্যাগ করে। নির্দিষ্ট অভ্যস্ত সময় পার হতে দেখে কেট উঠে, গোসলখানা ঘুরে হাত-মুখ মুছতে দুই খাটের মাঝখানে রাখা আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিলো। তখন রাত্রিবাস থেকে দিনের হাউসকোটে যাওয়ার সময়। কারো রাত্রিবাস ল্যাভেন্ডারগন্ধী মসলিনের হতে পারে। কেট ভেবেছিলো বাগচী ঘুমিয়ে আছে, উপরন্তু শয্যার দিকে পিছন ফিরেই তো সে। কিন্তু প্রতিবিম্বর মুখ তো শয্যার দিকেই।
বিস্মিত বাগচী পাশ ফিরেছিলো। সে ভাবলো : ক্রিস্টমাসে কেটকে নিয়ে কলকাতা গেলে হয়। গতবার সে সময়ে রাজকুমারের কলকাতা যাওয়ার কথা ছিলো, তাদের সঙ্গী হওয়ার আমন্ত্রণ ছিলো। কিন্তু ব্যাপারটা তেমন ঘটেনি, রাজকুমার নৌকাবহরে পশ্চিমভ্রমণে গিয়েছিলেন। …এবার তাদের বিবাহের পঞ্চম বার্ষিকী এগিয়ে আসছে। সে সময়ে অবশ্যই স্কুলের পরীক্ষা চলতে থাকবে। তা কেটের এতদিনে ত্রিশ হবে। পরীক্ষা নেওয়ারই পরীক্ষা, লেখার বদলে মুখে। নতুন পদ্ধতি বটে। তত শোবার ঘরের আয়না…। তাছাড়া, সলজ্জ বাগচী ভাবলো,কাল বিকেলে চরণ দাস যে চিঠি দিয়েছে, বেশবড়ো চিঠি। বানান দেখে বলতে পারো না, কিন্তু উচ্চারণ রলে, রেভরেন্ড ফাদার সিবাস্টিয়ান বলে। দ্যাখো, কীবল কাল আবার এসেছিলো বিকেলে। তখনই চরণ দাসও চিঠিটা এনেছিলো। কেমন সব যোগাযোগ নিত্য ঘটছে। কীবল এসেছিলো রলের কথা বলতেই। ফলে রলের। চিঠিটানা খুলেই জানা গিয়েছিলো রলে এ অঞ্চলে একটা মিশন হাউস করতে চায়। কীবল চলে গেলে চিঠি খুলে অবাক। রলের চিঠি। মিশন হাউস তো বটেই, সম্ভব হলে সে একটা স্কুল, একটা হাসপাতালও করতে চায়। …গাছটা বেশ বড়ো, রুক্ষ মোটা ত্বক; হঠাৎ ফুল ফুটলে কেমন ছেলেমানুষ দেখায়। এরকম একটা অনুভূতির পাশ দিয়ে বাগচী স্থির করলো, বেশ আরামই লাগছে, ব্রেকফাস্টের ডাক পেলে উঠলেই হবে।
কিন্তু কেট এলো। কোমরের অ্যানে বোঝা যায় ব্রেকফাস্ট তৈরিতে ব্যস্ত ছিলো সে। বিছানার পাশে এসে বললো, অতিথি।
বাগচী তো জেগেই ছিলো। উঠে বসে বললো, কে, রলে নাকি?
কেট বললো, ওই যে যার প্রার্থনা, ও গড, মেক মি এ সেন্ট বাট নট ইয়েট।
-আমারে করো সন্ত, কিন্তু এখনই নয়! সে কি? বাগচীবিছানা থেকে নামলো। আন্দা করতে পেরে হেসে উঠলো, গুড, গ্রেশাস, ব্রেকফাস্টে বসতে বলেছো নিশ্চয়।
বললেন, তাঁর প্রাতরাশ শেষ হয়েছে। তাহলেও পাছে আমরা ভাবি পানাহারে তা ছোঁয়া যাওয়ার কুসংস্কার আছে, তাই টেবিলে বসতে রাজী হয়েছেন।
বাগচী আর একবার হেসে বললো, ঠিকই ধরেছি তবে। ভদ্রলোক কিন্তু সবসময়েই ভেবে কথা বলেন, ভেবে কাজ করেন। তোয়ালে হাতে গোসলে যেতে যেতে বাগচী। দাঁড়ালো; কেটের চিবুকের নিচে আঙুল রেখে বললো–মেক মি এ সেন্ট বাট নট ইয়েট প্রার্থনাটা প্রকৃতপক্ষে কার বললো– তো?
-কেন, সেন্ট টমাসের নয়?
কেটের চিবুক ঈষৎ উঁচু করে বাগচী বললো–আমার, আমার, রেভরেন্ড এন্ড্রুজ বাগচীর।
বাগচীর বসবার ঘরে তখন যে অপেক্ষা করছিলো সে সর্বরঞ্জন প্রসাদকুসুম নিয়োগী। ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় স্কুলে যে তিনজন শিক্ষক এসেছেন তাদের প্রধানতম, সহকারী প্রধানশিক্ষক বলা হয়। প্রায় এক বৎসর এই গ্রামে আছেন কিন্তু এখনো অনেক পরিস্থিতিতে তাকে নবাগত মনে হয়। ইতিপূর্বে একদিন কেট তাকে সেন্ট ফ্রান্সিস বলেছিলো। চেহারা দেখেই মন্তব্য। সর্বরঞ্জন অবশ্যই বৃদ্ধ নয়। হয়তো পঁয়ত্রিশ হয়েছে। কিন্তু ইতিমধ্যে তার কথায় অর্ধেক থাকে ধর্ম সম্বন্ধে। তার দিকে চাইলেই যা দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা তার শ্মশ্রুজাল। প্রচুর আবক্ষ সেই দাড়ি সাধুসন্তের কথা মনে আনে, কিন্তু তা ঘনকৃষ্ণ হওয়ায় যেন বিপরীতমুখিনতাও। তার পরনে গলাবন্ধ কোট, ঢিলে সাদা ট্রাউজার্স। কলকাতার আধুনিকতা, কিন্তু সম্ভবত ক্ষারে কাঁচা এবং ইস্ত্রিও হয়নি। পোশাকটা ঘোষণা করছে সর্বরঞ্জন সাদাসিধে, মিতব্যয়ী, কিন্তু অন্যদিকে কতটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ক্লিনলিনেস ইজ নেকস্ট টু গডলিনেস, সন্দেহ কী?
বসবার ঘরে ঢুকে নিয়োগীকে দেখে বাগচীর সন্ত টমাসের রসিকতাটা আবার মনে এলো। সে প্রফুল্ল বোধ করলো। স্কুল সম্বন্ধে কেটের রসিকতায় সস্নেহ ভাবটা স্পষ্ট থাকে।
সর্বরঞ্জন হেসে বললো–এখানে বলা দরকার তার এই থ্রি পিস নাম ইংরেজ ক্রিশ্চানদের অনুরূপ হলেও এখানে সুবিধার জন্য সংক্ষেপ করা হচ্ছে। আমি একটু ভুল করেছি, সার, আমার ধারণা ছিলো আপনি ব্রাহ্মমুহূর্তে শয্যাত্যাগ করে থাকেন।
ব্রাহ্মমুহূর্তে! বাগচী চশমার কাঁচ দুটোকে রুমালে মুছে নিলো।
-উপাসনার সেটাই প্রকৃষ্ট সময় নহে কি? এবং যেহেতু আপনি ধার্মিক, সুতরাং অবশ্যই উপাসনা করে থাকেন,এবংসুতরাংব্রাহ্মমুহূর্তে শয্যাত্যাগ করতে অভ্যস্ত ধরে নেওয়া যায়। নিয়োগী হাসলো। বিহ্বল বাগচী বললো, আপনি অবশ্যই ব্রাহ্মমুহূর্তে উপাসনা সমাধা করেছেন?
সর্বরঞ্জন মাথাটাকে একবার ডান কাঁধে আর একবার বাঁ কাঁধের উপরে ছোঁয়ালো। তার মুখে একটা শুভ্র উজ্জ্বল হাসি দেখা দিলো, (সেই প্রচুর কালো দাড়িকে ছাপিয়ে হাসির পক্ষে যতটুকু তা সম্ভব) সে বললো–ওটাই কি ডায়েরির দৈনিক হিসাবে জমার দিকে প্রথম অঙ্কপাত হয় না?
ব্রেকফাস্টের আগে কেউ যদি বাড়ি বয়ে এসে প্রার্থনার কথা আলোচনায় আনে তবে তাতে একটা কৌতুকের দিক থাকে। কিন্তু ব্যাপারটা বাগচীকে চিন্তার বিষয়ও এনে দিলো। সে অপ্রতিভভাবে হেসে বললো–ওটা নিশ্চয়ই সবসময়েই জমার দিকে পড়ে, কিন্তু স্বীকার করছি, আমার জমা অনেক কম।
সর্বরঞ্জন দাড়িঢাকা চিবুক উঁচুনিচু করলো। সে কি বিব্রত অথবা আনন্দিত? কিন্তু সুশিক্ষা এমন উল্লাসকে মনে গোপন রাখতেই বলে। সুতরাং তা গোপন করতে সে যথেষ্ট বিব্রত হয়ে পড়লো।
বাগচী বললো–মিস্টার নিয়োগী, আপনার নিশ্চয় গুরুতর কিছু প্রয়োজন আছে, কেউ কি অসুস্থ? কিংবা আপনি কি স্কুল সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করবেন? কিংবা ব্যক্তিগত কিছু?
সর্বরঞ্জন বললো–আমি আপনাকে অন্যবিষয়ে কিছু বলতে এসেছিলাম। কিন্তু স্কুলের কথাটা যখন উঠে পড়লো তখন বলি। আজই তো স্কুলে বিভিন্ন শ্রেণীর জন্য পরীক্ষক নির্বাচন করা হবে, এই সুযোগে মৌখিক পরীক্ষা নেওয়ার প্রস্তাবটা আর একবার ভেবে দেখলে হয় না? এমনকী শিরোমণিমশায়ও বলছিলেন ব্যাকরণজ্ঞান না হলে, শুদ্ধ বানান লিখতে না জানলে বিদ্যাশিক্ষাই হয় না। মৌখিক পরীক্ষায় ছাত্ররা ব্যাকরণ বানান ইত্যাদিকে ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ পাবে না কি?
শিরোমণি? বাগচীর মনে পড়লো কিছুদিন আগে শিরোমণিকে উঁচু ক্লাসে সংস্কৃত ও বাংলা পড়ানোর জন্য নিযুক্ত করা হয়েছে। স্কুল সম্বন্ধে তার চিন্তায় যে কয়েকটি মানুষের। কথা মনে আসে শিরোমণি এখনো তাদের মধ্যে একজন নয়। সে বললো–এটা তো পরীক্ষা নেওয়ার পরীক্ষামাত্র। যদি দেখা যায় ব্যর্থ হচ্ছে, আগামীবছরে পুরনো বিধিতে ফেরা যাবে। আগেও বলেছি হিমালয়কে ঈকার দিয়ে লিখলে বা ভাবলে তার উচ্চতা কমে না, তুষারও হ্রাস পায় না।
-কিন্তু এর একটা অন্য দিক আছে, সার। কিছুদিন পরে পুস্তকগুলি ভাষার ব্যাপারে স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠবে না?
-সে যখন আমাদের এই ছাত্ররা বই লিখবে। বাগচী হাসলো, তাছাড়া আপনি অবশ্যই জানেন, বানান কোনো ভাষাতে স্থির নয়, ব্যাকরণ ইতিমধ্যে বদলাচ্ছে; আমরা ইতিমধ্যে করিবেক আমাদিগের ইত্যাদি পদ এমনকী স্কুলেও ব্যবহার করছি না।
–তাও যদি মেনে নেওয়া হয় বিদ্যালয়-পরিদর্শকের মতকে অবহেলা করে কলকাতার পদ্ধতিকে গ্রাহ্য না করে, এই এক নতুন পথে চললে আমরা কি দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বো না?
বাগচী হেসে উঠলো, কিন্তু তখনই সস্তৃত হলো, বললো– কলকাতার লোকসংখ্যা কি সারা দেশের লোকসংখ্যার চাইতে বেশি। তাদের সংস্কৃতিকে কি সারা দেশের সংস্কৃতি করতে হবে? সেখানে কি ইংরেজির কয়েকটা শব্দ জানাকে সংস্কৃতির লক্ষণ মনে করা হচ্ছে না?
নিয়োগী বললো–সার, আপনার প্রশ্রয় আমাকে তর্ক করতে সাহসী করছে। কলকাতার ইংরেজি শিক্ষার উপরে জোর দেওয়া হয়। কিন্তু তা কি অন্যায়? সেকালের রাজা রামমোহন, একালের বিদ্যাসাগর কি ইংরেজি শিক্ষার গুণগ্রাহী নয়?
বাগচী বললো–উভয়েই বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র কিন্তু তারা কি ইংরেজি পড়ে পণ্ডিত? কিন্তু আসল কথাটা তা নয়। আপনি কি এ দেশের চাষীদের সঙ্গে, স্ত্রীলোকদের সঙ্গে ধর্ম নিয়ে, রামায়ণ মহাভারত পুরাণ ইত্যাদি নিয়ে, পাপ পুণ্য সমাজ নীতি ইত্যাদি নিয়ে আলাপ করেছেন? তাদের অক্ষরজ্ঞান নেই, কিন্তু
-সেটা হয়তো কথকতা ইত্যাদির ফলে। কিন্তু তাদের সেই জ্ঞানই তো কুসংস্কারের উৎস।
কুসংস্কার? হয়তো, হয়তো। আমি চাইছি আমাদের ছাত্ররা আপাতত ইতিহাস ভূগোল বিজ্ঞান চিকিৎসা সম্বন্ধে অনেক কিছু, আর তা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জানুক। সময়ের ব্যবধান কমাতে চাইছি। শুধু ইংরেজি ভাষার উপরে জোর দিলে একটা ইংরেজিনবিশ সংখ্যালঘিষ্ঠ শ্রেণী তৈরী হবে যারা আর সকলকে মূর্খ আর কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনে করবে।
এই বলে বাগচী হেসে উঠলে। কিন্তু আলোচনাটাকে গুটিয়ে নিতে সাহায্য করলো কেট। সে ঘোষণা করলো ব্রেকফাস্ট দেওয়া হয়েছে। বাগচী দাঁড়িয়ে উঠে বললো–আসুন, আসুন টেবলে যাওয়া যাক।
আলাপটা এখানে মুলতবী হতো। কিন্তু নিয়োগীর ব্রেকফাস্টেনা বসেও টেবলে বসার বিষয়টা তো আগেই স্থির করা হয়েছে। সে তো ক্রিশ্চানদের সঙ্গে এক খাওয়ার টেবলে বসতে না পারার মতো কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দিতে পারে না, সুতরাং সে সেই ব্রেকফাস্টা টেবলের পাশেই বসলো।
বাগচীর এইসময়ে একবার রলের চিঠির কথা মনে হলো, একবার চরণ দাসের ডিসপেনসারির কথা মনে হলো, কিন্তু সেসব দিকে মন দিলে নিয়োগীর দিকে অনাদর দেখানো হয়ে যেতে পারে এই আশঙ্কায় সে তার দিকে ফিরে বললো, বলুন মিস্টার নিয়োগী, আমি কোন বিষয়ে আপনার কাজে লাগতে পারি? আপনার দরকারী কথা না বলে এতক্ষণ আমি অন্য কথা বলেছি; দুঃখিত।
সর্বরঞ্জন প্রসাদ বললো–সমস্যা দু রকমের সার। আমি গতকাল স্কুল থেকে বাড়ি যাওয়ার সময়ে এ বছরের ছুটির তালিকা এবং আগামী বছরের তালিকার খসড়াটাকে দেখছিলাম। দেখলাম, রানীমার জন্মতিথির উৎসবের কাছেই লাল কালিতে নতুন একটা ছুটি বসানো হয়েছে রাস উপলক্ষ্যে। আগামী বছরের খসড়ায় দেখলাম কালী, লক্ষ্মী, সরস্বতী ইত্যাদি তো বটেই শিবচতুর্দশী উপলক্ষ্যেও ছুটি হবে।
বাগচী বললো–এ বছরের রাসপূজার কথা আমার জানা ছিলো না। শিরোমণিমশায়। কয়েকদিন আগে এ ব্যাপারে অনুরোধ করেছিলেন। আগামী বছরের শিবচতুর্দশীর ছুটির কারণ রানীমা ফরাসডাঙায় যে শিব স্থাপন করেছেন, শুনতে পাচ্ছি সে সময়ে সে উপলক্ষ্যে ভারি বড়ো মেলা হবে। কাছারিও বন্ধ থাকবে হয়তো।
এ ব্যাপারে, সার, দেওয়ানজিরও কি এই মত?
তিনি স্কুলের এসব ব্যাপারে আমাকেই মত স্থির করতে বলেন।
-তাহলেই দেখুন, সার, এসব অন্যায়ের সব দায়দায়িত্ব আমাদেরই থেকে যাচ্ছে। এই বলে সর্বরঞ্জন প্রসাদ বেশ খানিকটা মাথা ঝাঁকালো। বললো, আপনি আমার উপরওয়ালা। ডিসিপ্লিনের জন্য আপনার কথা আমাকে মানতেই হবে। কিন্তু এও আমি বলে দিচ্ছি, এতে আমার অন্তরলোকের সায় নেই। প্রত্যেকের একটা মিশন আছে। আমাদের ছাত্ররা যদি তাদের পিতামাতার অন্ধকারাচ্ছন্ন পুতুলপূজার মানসিকতায় ফিরে যায় তবে বৃথাই আমাদের শিক্ষাদীক্ষা, বৃথাই শিক্ষকতা করা।
বাগচী হাসিমুখেই বললো–ছাত্রদের পিতামাতারও নিজস্ব মত থাকতে পারে।
–অন্যায় মতও মানতে হবে?
অন্যায় বলছেন?
অন্যায় নয়? রাসের কথাই ধরুন। ওটার মতো কুৎসিত জঘন্য নীতিহীন কিছু হতে পারে? লাম্পট্যের জঘন্য প্রকাশ ছাড়া কিছু বলবেন?
-ওটা তো ধর্মের ব্যাপার। শিরোমণি বলছিলেন। আমি ঠিক জানি না।
সর্বরঞ্জনের মুখ গম্ভীর হলো, জমকালো দেখালো তাকে। ধর্ম এবং নীতিহীনতা, এটাই তো সে বলতে চাইছিলো। বিষয়টার নীতিহীনতাকে আক্রমণ করতে পারলে পুতুলপূজাটাকে সার্থক আক্রমণ করা যায়। এটাই তো প্রমাণ পুতুলপূজা কত আবিলতা সংগ্রহ করতে পারে। সে বললো–তাহলেই দেখুন, ওটা কি ধর্ম! মহিলা উপস্থিত না থাকলে বলতে পারতুম ধারণাটাই কী জঘন্যভাবে কুৎসিত।
এমনকী সর্বরঞ্জনের মুখে দাড়িহীন অংশটুকু যেন লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো। নিয়োগীর কথা বলার ভঙ্গি, মুখচোখের চেহারা দেখে রাস উৎসব সম্বন্ধে বাগচী প্রকৃতই ভীত হলো। তাকে দুশ্চিন্তা করতে দেখা গেলো। সে বললো–আপনি শিরোমণির সঙ্গেও আলাপ করুন। আপনার মত তাকে জানান। স্কুলে নীতিহীন ব্যাপারে উৎসাহ দেওয়া যায় না।
কেট বাংলা বোঝে, বলে। সুতরাং ইতিমধ্যে সেও কুণ্ঠিত হয়ে উঠেছিলো। সেদিকে লক্ষ্য রেখে বাগচী তাড়াতাড়ি আলাপটাকে ঘুরিয়ে নিতে বললো–আপনার বাড়ির খবর বলুন, ছেলেমেয়েদের স্বাস্থ্য ভালো থাকছে তো? এই সমাজে আপনার স্ত্রীর অসুবিধা হচ্ছে না তো? আপনার বাসগৃহ সম্বন্ধে কিছু করা দরকার আছে কি? আপনার বেতন জানুআরি থেকে পুরো একশো করা যায় কিনা এ সম্বন্ধে দেওয়ানজি ভেবে দেখবেন বলেছেন।
আলোচনাটা এদিকে ফিরলে কেট বিস্কুট ও কফি এগিয়ে দিলো। সর্বরঞ্জন তা গ্রহণ করে উৎফুল্ল হলো। সুনীতির সার্থক সুপ্ৰয়োগে কার না সুখ হয়?
বলা বাহুল্য বাগচীদের প্রাতরাশ সেদিন অন্য অন্য দিনের মতো হলো না। বাগচী আলোচনাটাকে গ্রাম সম্বন্ধে, গ্রামজীবনের সুবিধা অসুবিধা সম্বন্ধে, নিয়োগীর সুবিধা অসুবিধা সম্বন্ধে ধরে রাখলো। অন্যান্য দিনের মতো তাদের পরস্পরের অন্তরঙ্গ বিষয় নিয়ে আলাপহলোনা। কেট নিয়োগীকে একবার আরো কিছু খেতে অনুরোধ করে ভাবলো, এসব হয়তো আমার ভাবা উচিত নয়, কিন্তু ভদ্রলোকের দাড়িটাকে অন্যের বলে মনে হয় যেন। আর এই মাথা নেড়ে কথা বলার ভঙ্গি? বাগচী একবার ভাবলো, ভদ্রলোক ছুটির ব্যাপারটাকে কত কঠিনভাবে নিয়েছেন দ্যাখো! ব্রাহ্মমুহূর্তে উঠে চলে এসেছেন, কারো গৃহস্থালিতে ব্যাঘাত হয় কিনা তা ভাবার অবকাশ পাননি।
প্রাতরাশ শেষ হতেই বাগচী পাইপ হাতে টপ হ্যাট মাথায় বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। অন্যান্য দিনের মতো পাইপ মুখে কেটের সঙ্গে আধঘণ্টা নিছক গল্পগাছা করার সুযোগও আজ ছিলো না।
তা দেখে বাগচীর সহিসও তার টাট্টু নিয়ে এলো।
বাড়ির বাইরে পথে এখন সকালের রোদ। উজ্জ্বলতায় ও কবোষ্ণতায় তা তৃপ্তিদায়ক। রবিবারের অভ্যাসমতো বাগচী চরণের ডিসপেনসারির কথা ভাবলো। ইতিমধ্যে সে বোধ হয় দেরি করে ফেলেছে।
সর্বরঞ্জন বললো–আপনি কি এখনই বেরোচ্ছেন, সার? আমার আলাপের দ্বিতীয় বিষয়টার দিকে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছিলাম।
-ও, হ্যাঁ, বলুন বলুন। চলুন তাহলে আমরা হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি।
তারা হাঁটতে শুরু করলো। সহিস অগত্যা টাট্টু নিয়ে পিছনে হেঁটে চললো।
সর্বরঞ্জন বললো–এবার এ গ্রামে নাটকও হচ্ছে।
নাটক? মানে থিয়েটার? কলকাতায় হুজুগ উঠেছে বটে। হঠাৎ হচ্ছে যে?
–রানীমার জন্মোৎসবে।
বাহ! অন্যান্যবার শুনেছি যাত্রা হয়। তো আপনি এবং আমাদের সব শিক্ষকই অবশ্যই আমন্ত্রিত হবেন। শুনেছি খুব আনন্দ হয়।
–তা হয়তো হবে। কিন্তু থিয়েটার বলে কথা? বেশি বাস্তব নয়?
–যাত্রার চাইতে সাসপেনসন অব ডিসবিলিফ বেশি হয় বলছেন?
–আমাদের ছাত্ররাও তো তা দেখবে।
–খুব সম্ভব। শুনেছি রাজবাড়ির দরজা সে রাতে বন্ধই হয় না।
-তাহলেই দেখুন, সার! উপরন্তু যদি তারা দেখে তাদের একজন শিক্ষকই সেই অভিনয়ে অংশ নিচ্ছে–
–সে কী? কে? বাগচী অবাক হলো।
আমাদের চরণ দাস।
বাগচী হো-হোকরে হেসে উঠলো চরণ দাসকে অভিনয় করতে দেখার কল্পনায়। পথের ধারে সে দাঁড়িয়ে পড়লো। হাসি থামলে বললো–বলেন কী, আমাদের চরণ দাস? তার চোখের সামনে ধুতি, বেনিয়ান,দড়ির মতো পাকানো চাদর গলায় গম্ভীরমুখ এক যুবক ভেসে উঠলো যে কাজের ব্যস্ততায় প্রায়ই দাড়ি কামায় না।
গম্ভীর স্বরে সর্বরঞ্জন প্রসাদ বললো–টকমাত্রেই নারীচরিত্র থাকে নাকি? সেই নারীচরিত্রের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত কোনো পুরুষচরিত্রে অভিনয় করা কি ভালো?
বাগচীর গায়ে সকালের রোদ পড়ছে। আবার গাছপালা থাকায় কুয়াশাও আছে। পথের ধারের গাছের ডালপালার ছায়া যেমন পথে তেমনি তার গায়ে জালি কাটছে। সে হেসে বললো–এই এক মহা অনিষ্ট, আজন্ম আমরা নারীচরিত্রের সঙ্গে জড়িত। ওতপ্রোতভাবেই। এমনকী আমরা শুরু হচ্ছি নারীর উদর থেকে।
একী অদ্ভুত কথা!একটা কঠিন আঘাত পেলো সর্বরঞ্জন। একী সাংঘাতিক কথা বলছেন এত হালকা সুরে হেডমাস্টারমশাই! হায়, সুনীতি বলে কিছু আর রইলো কি? কিন্তু সেও অনেক যুদ্ধের পোড় খাওয়া সৈনিক; হয়তো হেরেছে বেশি, কিন্তু জয়লাভও করেছে। সে তার বক্তব্য বাছাই করে নিলো। তার দাড়িটা কেঁপে উঠলো একবার। সে বললো–না না, না, একে আমরা বোধ হয় এত সহজে চিন্তা থেকে সরিয়ে দিতে পারি না। তাদের এই নাটকে পরনারী ধর্ষণের কথা আছে, আয়োজন আছে। জগদীশ্বর আমাদের পাপ কথন ক্ষমা করুন। নিয়োগী দু হাত তুলে দুটি তর্জনী অনেকটা করে নিজের দুকানে ঢুকিয়ে দিলো যাতে তার নিজের কথাটাও সবটুকু কানে না যায়।
কারো কারো কৌতুকবোধ বেয়াড়া রকমের থাকে। মনে হলো, বাগচী আবার হেসে উঠবে। কিন্তু সে বরং থমকে গিয়ে চিন্তা করলো। নিয়োগীর প্রকাশটা কৌতুকের হতে পারে, কিন্তু এর মধ্যে চিন্তার বিষয় থেকে যাচ্ছে। নারীধর্ষণ অসম্ভব ঘটনা নয়, কোনো নাটকে তার চিত্রণও থাকতে পারে, কিন্তু তার সঙ্গে একজন শিক্ষকের অভিনয়ে সংযোগ থাকা উচিত হয় কি? বাগচীর হাতের ছাতাটা একবার দুললল, সে বললো, আচ্ছা, এ বিষয়ে আমি চিন্তা করবো, চরণের সঙ্গে কথা বলে নিই।
প্রকৃতির স্নিগ্ধ কবোষ্ণতা এই ছুটির দিনে বাগচীর আরামদায়ক বোধ হচ্ছিলো। এমনও হতে পারে, ব্রেকফাস্ট অন্যান্য দিনের মতো স্বচ্ছন্দ হয়নি, এখন কিন্তু জীর্ণ হতে হতে স্নিগ্ধ পুষ্টিতে তার কোষগুলিকে হৃষ্ট করছে। বাগচী বললো–আচ্ছা নিয়োগীমশায়, আপনার কি মনে হয়, এ গ্রামটার কিছু কিছু বিশেষত্ব আছে? কথাটা বোধ হয় এই, আনন্দদায়ক শান্তি এখানে খুঁজলে পাওয়া যেতে পারে।
–ঈশ্বরের কৃপায় তা হতে পারে, সার।
নিশ্চয় নিশ্চয়, তিনি কৃপা না করলে কৃপা চাইবার বুদ্ধিও হয় না, এরকম শুনেছি। আপনাকে একটা ভালো সংবাদ দিতে পারি, আপনার মতও জেনে নিতে পারি। এ অঞ্চলে রেভরেন্ড রলে নামে একজন ক্যাথলিক মিশনারী একটি মিশন হাউস করতে চাইছেন। ইংল্যান্ডের নতুন ক্যাথলিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত এঁরা।
–এ তো আশ্চর্যের কথা, সার, ভারি আশ্চর্যের কথা!
–হয়তো পরে একটা স্কুল কিংবা চিকিৎসালয়ও হবে সেই মিশনে।
নিয়োগী বললো–না, না, সার, এর চাইতে পরমাশ্চর্যের বিষয় আর কিছু হতে পারে ।
তারা পাশাপাশি হেঁটে চললো। বাগচীর একবার মনে হলো তার পক্ষে এখনই কি ঘোড়ায় ওঠা ভালো হবে? তার আর মিস্টার নিয়োগীর উদ্দেশ্যে এখন কিছু পার্থক্য আছে বটে। কিন্তু একজন ভদ্রলোক তার বাড়িতে এসেছিলেন, তাকে কী করে বিদায় নিতে বলা যায়? আলাপ চালিয়ে নিতে সে বললো, ক্যাথলিকরা কিন্তু এ রকম সাকার পূজাই করে থাকে। পুতুল না হোক, মূর্তি থাকে।
নিয়োগী বললো–অবশ্যই সার, তা কিন্তু পবিত্র ক্রিশ্চান ধর্ম।
কিন্তু সে অন্যদিকে ভাবছিলো, অন্তত তার ঠোঁট এবং চোয়াল কিছু চিবানোর ভঙ্গিতে নড়ছিলো। সে বললো–সার, আমাদের চরণ দাসের পদস্খলনের ব্যাপারটা-না, না, সার, এ কথা আমাকে বলতেই হবে-ওঠা তুচ্ছ ব্যাপার নয়। যদিও হয়তো স্ত্রীলোক অভিনয় করবে না, কিন্তু কী মারাত্মক, বিশেষ এই গ্রামে, রুগ্নদেহে কুপথ্য সম্বন্ধে যেমন, এ বিষয়ে সতর্ক থাকতেই হবে।
বাগচী ভাবছিলো, তার নিজের ধর্ম যা ক্যাথলিক বা প্রটেস্ট্যান্ট কিছুনয়, তাতে ঈশ্বরের কোনো আকার করার কথা ওঠে না, ওদিকে কিন্তু ভাবতে গেলেই আকার একটা আসে। ফলে অন্যমনস্ক থাকায় সে নিয়োগীর কথা সবটুকু শুনতে পায়নি। রোগের কথায় উৎকর্ণ হয়ে বললো–কী বলছিলেন? এই গ্রামে কি বিশেষ রোগের কথা বলছিলেন? বিশেষ কোন প্রাদুর্ভাব নাকি? শুনিনি তো!
নিয়োগী বললো–সত্যভাষণের সুযোগ সত্যই কম। সুযোগ হলে তার সদ্ব্যবহার করা উচিত। আপনি যখন এই গ্রামে ক্যাথলিক রলের মিশন হাউস কল্পনা করে প্রফুল্ল, তখনই দেখুন, কত না জাঁকজমক সহকারে শিবমন্দির হচ্ছে এই গ্রামে।
–রানীর মন্দিরের কথা বলছিলেন কি? ওঁরা ধনবান, জাঁক হবেই। গ্রামটাও ওঁদের।
কিন্তু, নিয়োগীর মুখ আরো গম্ভীর হলো, সে বললো–এও কি ভালো সেই বিগ্রহ প্রতিষ্ঠায় রক্তচন্দন ব্যবহৃত হবে? বাগচী হো হো করে হেসে উঠলো, কিন্তু তৎক্ষণাৎ বললো–আমার লঘুভাব ক্ষমা করবেন, বিশ্বাস করুন শিব প্রতিষ্ঠায় রক্তচন্দন প্রয়োজনের কিংবা অধর্ম তা আমার জানা নেই। আপনার কি মনে হয় শ্বেতচন্দনই প্রশস্ত?
নিয়োগী বললো–না,না, এসব ব্যাপার লঘুভাবে দেখা উচিত হয়না। রক্তচন্দন কি রক্তের প্রতীক নয়? তাতে কি লিঙ্গ উপাসনা আরো বাস্তব হয় না। তিনি আমাদের অন্নদাত্রী, কিন্তু একবারও না বললে সত্য কুণ্ঠিত হয়। যে প্রকার শুনি তা হয়তো চন্দন নয়, রানীমার রক্তই।
নিয়োগী দুই কানে আবার তো আঙুল ঢোকালো বটেই, শিউরে উঠে চোখ দুটিও বন্ধ করে ফেলো। বাগচীর মুখ নিরতিশয় গম্ভীর। সে বললো, নমস্কার মশাই, আপনার বাসা অদূরে। তাছাড়া ডিসপেনসরিতে রোগী আসার সময় হয়ে যাচ্ছে।
বাগচী পিছনে তাকিয়ে তার সহিসকে দেখতে পেলো। সে টাট্টু নিয়ে এতক্ষণ নিঃশব্দে অনুসরণ করেছে। টাটুটা নিচু, চড়তে সহজ। বাগচী লাগাম হাতে নিয়ে টাটুতে বসলো।
যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে তখন রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার সুযোগ চলে গিয়েছে; নবকৃষ্ণ, মতি শীল, এমনকী দ্বারকানাথ হওয়ারও সুযোগ কম। তখনকার কলকাতায় নিম্নমধ্যবিত্তদের একরকম প্রাবল্য চোখে পড়ে। কেরানি, মুৎসুদ্দি, দালালের। দালাল, শিক্ষক, কিছু উকিল, কিছু ডাক্তার, বড়ো জোর ডেপুটি, এবং দোকানদার, অর্ধ বেকার, বেকার। এদের এক অংশ খুব লিখতো, বক্তৃতা দিতে, পত্রিকা ছাপাতে। গবেষণা করতে হলে এইসব কাগজপত্রই হাতের কাছে। ফলে এ রকম ধারণা হয়, কলকাতায় তখন সমাজ ও ধর্মের সংস্কার ও সংস্কৃতি বিষয়ের আলোচনা ছাড়া কিছু নেই, সেই যুগটাই ছিলো সংস্কৃতি পুনরুদ্ধারের। তা অবশ্যই হয় না। তখনো যুগটা খাওয়া পরার দরুন অর্থ সংগ্রহের যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলো।
এখনো যেমন তখনো তেমন কলকাতার হালফিলের চালচলনকে সংস্কৃতি মনে করা হতো, যদিও হয়তো সংস্কৃতি কথাটা তখনো জন্ম নেয়নি। তখনকার দিনে মধ্য, নিম্নমধ্যবিত্ত স্কুলে কলেজে পড়া মানুষদের মধ্যে ধর্মমত, সুনীতি, দুর্নীতি নিয়ে, স্ত্রীলোকের শিক্ষা ও নানা রকমের সমাজ-সংস্কার নিয়ে আলাপ আলোচনা যথেষ্ট গুরুত্ব পাচ্ছিলো। গো-মাংস খেয়ে, মদ্যপান করে সমাজ-সংস্কার করার চাইতে বিধবাবিবাহ প্রবর্তন, বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ রোধ, স্ত্রীলোকের শিক্ষা ও তাদের পর্দার বাইরে আনা এগুলোই সমাজ-সংস্কারের উপাদান হিসাবে মূল্য পাচ্ছে ক্রমশ যদিও কি উকীল, কি ডাক্তার, কি ইংরেজ ব্যসায়ীর মুৎসুদ্দি, কিছু সঙ্গতি হলেই উপপত্নী বা রক্ষিতা রাখাকে জীবনের সাফল্যের নিদর্শন মনে করছে। তখন মিশনারীরা ১৮৫৭র আশঙ্কাকে কাটিয়ে উঠতে না পেরে ক্রাইস্টের মত প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় ধর্মের কুৎসা প্রচারের ব্যাপারটায় ঢিলে দিয়েছে। ভারতীয়রা বুঝতে পারছে, নামে মাইকেল, এমনকী রেভরেন্ড যুক্ত হলেও জীবনের প্রেয় সহজলভ্য হয় না। কিন্তু পৌত্তলিকতা যে মন্দ তা নিয়ে তর্কের অবকাশই ছিলোনা। শিক্ষিত হলে কথা নেই, এমনকী স্কুলের ছাত্র কী এক গ্লানিতে উপনিষদে মুখ লুকাবে যেন। ইংরেজ রাজা হওয়ায় এই এক সুবিধাও ছিলো, পথেঘাটে প্রকাশ্যে ধর্ম নিয়ে কথা বললে কাজীর লোকেরা ধরতে আসে । তখন তো নতুন যে ব্রাহ্মধর্ম তাতেও কোন শাখা আভঁ-গার্দ এমন তর্ক যেন দেখা দেবে। বেদ অপৌরুষের কিনা, উপাসনা-বেদীতে অব্রাহ্মণ বসবে কিনা এসব সমস্যা পার হয়ে তখন উপবীত ত্যাগের আন্দোলন হচ্ছে। আদি ব্রাহ্মসমাজ থেকে নববিধান বিচ্ছিন্ন হয়নি বটে, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় ক্রাইস্ট সম্বন্ধে কোনো কোনো মন্তব্যের ফলে কোনো কোনো ব্রাহ্ম পত্রিকার গ্রাহক থাকতে অনিচ্ছুক হচ্ছেন। তখনো কেশবচন্দ্র রামকৃষ্ণের সংস্পর্শে ব্ৰহ্মকে মা বলে ডাকতে শুরু করেননি, বিজয়কৃষ্ণ নিরাকার ত্যাগ করে সাকারে ঝোঁকেননি। তাহলেও ধর্ম তখন এক নিরতিশয় উত্তেজক বিষয়। অন্যদিকে তখন এদেশের ভাষায় নাটক লেখা হচ্ছে। এটা কৌতুকের যে নাটকের পৃষ্ঠপোষকেরা ব্যক্তিগত জীবনে মদ ও ভ্রষ্টাদের সঙ্গে যেভাবেই সংশ্লিষ্ট হোক, নাটকে সেসবের সমালোচনা দেখা দিচ্ছে, রায়তদের কষ্টের ইঙ্গিত থাকছে। কিন্তু সেই সব প্রাগ্রসর মানুষের প্রাগ্রসর অংশে নাটক সম্বন্ধেই বিরূপতা দেখা দিচ্ছে, কারণ নাটক অলীক, নারী-সংযুক্ত বিষয়। তখন এক দল মদ খেতে না শেখায় পুত্রস্থানীয়দের কী করে ভদ্রসমাজে পরিচিত করবেন ভেবে চিন্তিত, অন্য এক অংশে তখন মদ্যপান নিবারণ সম্বন্ধে ভাবা হচ্ছে।
ঠিক এইসময়েই সর্বরঞ্জন কুসুমপ্রসাদ রাজনগরের জ্ঞানদা বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক-শুনতে পেলো, মানুষের গলায় কেউ তাকে কিছু বলছে। তার সামনে, পিছনে, পায়ের নিচে কয়েক গজ রৌদ্রে উজ্জ্বল পথ, তার বাইরে কিন্তু বৃত্তাকারে কুয়াশা। সে শুনলো:করুণাময় আর বিধানচন্দ্র দুজন আলাদা বাবু, হুজুর কাকে খবর দিতে বলেছেন?
নিয়োগী পিছন ফিরে দেখলো বাগচীর সহিস কয়েক হাত দূরে করজোড়ে দাঁড়িয়ে। দ্যাখে, তার মুখে কিনা এই সকালেই একটা ঘাসের উঁট। নিয়োগী একবারমাত্র তাকে দেখে নিয়ে দম দম করে হাঁটতে শুরু করলো। সে অবশ্যই অন্য অনেক আদর্শবান ব্যক্তির মতো নিরর্থক, অসত্য অকিঞ্চিৎকরকে পিছনে ফেলে চলতে শিখেছিলো।
.
০২.
টাট্টুর উপরেই ট্যাকঘড়ি বার করে বাগচী দেখলো, নটা বাজতে চলেছে। চরণ দাসের বাড়ি কম করেও এক ক্রোশ। টাটুটাকে দ্রুততর করতে তার পশমদার ঘাড়ে চাড় দিয়ে যা, যা বলতে সেটা গলা লম্বা করে তা দুলিয়ে কঁকিয়ে গতির পরাকাষ্ঠা অভিনয় করলো। বাগচী তাকে আরো গতিশীল করতে পিছন দিকে হাত বাড়িয়ে তার নিতম্বদেশে যু, যুঃ বলে চাপড় দিলে টাট্টু একেবারে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়ালো। বাগচী অবাক। টাটুর আপাদমস্তক দেখে নিয়ে গোড়ালি দিয়ে তার পেটে আঘাত করে হেট, হেটবলাতে টাট্টু আবার তার নিজের চালে চলতে আরম্ভ করলো।
বাগচী চশমা খুললো, রুমালে মুছলো, হাসলো। ব্যাপারটা ধরতে পেরে মনে মনে বললো, তাহলে এই গাধাটা চু চু আর যুঃ যুঃর তফাত বোঝে না।
তখন তার চারিদিকে ঈষৎ রঙিন কুয়াশার মধ্যে আরামদায়ক টাটকা রোদ, ভিতরেও জীর্ণমান ব্রেকফাস্টের কবোষ্ণতা। সে এক চম্পক করাঙ্গুল দেখতে পেয়ে মনে মনে হাসলো, তৃপ্তি বোধ করলো, স্থির করলো কেটকে বলতে হবে, অতটা করে চিনি যেন টাট্টুকে আর না খাওয়ায়। কিন্তু আগে যে চিন্তাটা মনে ছিলো সেটাকে খুঁজে পেলো না। অস্পষ্টভাবে মনে পড়লো, বিষয়টা বোধ হয় আত্মা আর মন। আত্মাও কাজ করে, মনও করে। যত বুদ্ধিসুদ্ধি তা তো মনেরই, তাহলে আত্মা কীভাবে কাজ করে? মনের কাজগুলোকে কি এরকম বলবে যে তার সঙ্গে খানিকটা বুদ্ধি করে চলার, লাভক্ষতির, মানিয়ে নেওয়ার চিন্তা থাকে, যতই আন্তরিকতা থাকুক?
এখন ভাবার সময় নয় এই ভাবতে গিয়ে সে ভাবলো কাল সন্ধ্যার কফির সময়ে, রাতের ডিনারের সময়ে কেটকে বিশেষ উত্তেজিত দেখাচ্ছিলো। বিশেষ তার গাল লাল হয়ে উঠেছিলো, চোখ উজ্জ্বল হচ্ছিলো। গাইসের চিঠির কথা উঠেছিলো আবার।
এটাও তার ভাববার বিষয় কিনা সন্দেহ। সকালে আয়নার সামনে তখন কেট কিন্তু ভেবেছিলো সে ঘুমিয়ে আছে। আজ দেরিই হয়ে গেলো ডিসপেনসারিতে যেতে। তা, কেট অবশ্যই সুন্দরী, গড়নটাও, তাতে প্রাচুর্যও আছে। এবার তার ত্রিশ হবে। আর তাদের বিবাহের তো এবার পঞ্চবার্ষিকী।
সে এদিক ওদিক চাইলো। সব চাইতে কাছের মানুষ একটা খেজুর গাছের মাথায় রস সংগ্রহ করছে। অবশ্যই বলতে পারো তার মতো চল্লিশের এক রেভরেন্ড পাদরির এসব ব্যাপারে বাক্যব্যয় করা উচিত হচ্ছে না। কেট নিশ্চয়ই বুদ্ধিমতী, সংসারের ব্যাপারে পদক্ষেপগুলো হিসাব করা। আর তুমি কি কল্পনাও করতে পেরেছিলে, কত সহজে পরিবর্তন আনা যায়, কথাটা বলা যায় কাল রাতে কেট যা বললো–! আমাদের সংসার এবার পূর্ণ হোক। অবশ্য এখন বলতে পারো, কালকের রাতের পোশাকে আর চুলের খোঁপায় কিছু বিশেষ ছিলো। খুব সোজা কথা–একটু মুখ লাল করে বলা, সংসার পূর্ণ হোক।
এরকমও সে শুনেছে যে কোনো এক বসন্তের প্রভাবে উভয়ে যখন কী এক লাবণ্যে পূর্ণপ্রাণ…কেট খুব বুদ্ধিমতী, হিসাব করে চলে। তা বুদ্ধির তো সেটাই ধর্ম। কিন্তু তুমি কি বলবে সন্ধ্যার সেই উত্তেজনা গাইলসের চিঠি নয়? একটা পরিবর্তন কিন্তু।
বাগচী ভাবলো, ও সেই নারীসংযোগের কথা। আচ্ছা আচ্ছা, নিয়োগীমশায়কে ওভাবে পথের উপরে ত্যাগ করা ভালো হয়নি। দেখা হলে ক্ষমা চেয়ে নিলে হবে। সে মনে মনে হাসলো, কিন্তু লক্ষ্য করো কি ক্যাথলিক রলে, কি বৌদ্ধ শ্ৰমণ, কি হিন্দু সন্ন্যাসী পরিহার করতে বলে। তাকে কিছু লজ্জিত দেখালো। না, নিয়োগীকে দোষ দেওয়া যায় না।
বাগচী কিছু অন্যমনস্ক থাকায় চরণের সেই ডিসপেনসারির বারান্দার ভিড়টাকে লক্ষ্য করেনি। ফলে সে কাছাকাছি যাওয়ামাত্র চারিদিকে একদল ছাত্রকে দেখতে পেলো। তাদের মধ্যে দুএক পা এগিয়ে তার মনে হলো, এ সময়ে এখানে তাদের থাকার কথা নয়। সে বললো–তোমরা এখানে? কয়েকজন একসঙ্গে বললো–আমাদের ইসমাইলের চোখটা তো সারবে সার? বাগচী নিজেই তাদের সমস্যা ও উত্তেজনার কারণটাকে দেখতে পেলো। বারান্দায় বেঞ্চিতে বসা এক বালকের চোখ কপাল জড়িয়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা। বাগচীর এক হাতে লাগাম, অন্য হাতে ছাতা, সে দুটিকে দুজনের হাতে দিয়ে বারান্দায় উঠে কোটটাকে তৃতীয় জনকে ধরতে বলে ব্যান্ডেজ খুলতে শুরু করলো। অসুখটা কঠিন। চোখটা বিশ্রীরকমে ফুলে বন্ধ হয়ে আছে। যে তুলো দেওয়া হয়েছে তাতে রক্তের চিহ্ন। অন্যটিও আক্রান্ত, কিছু কম। বাগচী সস্নেহে ব্যান্ডেজটা আবার বেঁধে দিলো।
একজন ছাত্র বললো–ওকে ওষুধ দেন সার।
স্বভাবত ধীরভাষী চরণ ধমকে উঠলো–ওষুধ দেওয়া হয়েছে। যাও এখন, বিরক্ত কোরো না।
ছাত্ররা হকচকিয়ে বারান্দা থেকে নেমে গেলো।
বাগচী বললো, তোমাদের ইসমাইল আমাদের বুঝি কেউ নয়? তুমি কিন্তু টক খেও ইসমাইল। ভয় পেয়ো না, চরণবাবু তো ওষুধ দিয়েছেনই। ইসমাইল কি ওষুধ নিতে আবার বিকেলে আসবে, চরণ?
চরণ অন্য দিনের চাইতে অনেক গম্ভীর। সে বললো–আমি ওকে সেরকমই বলেছি সার।
ছাত্ররা চলে গেলে চরণের বারান্দা ফাঁকা হয়ে গেলো। বাগচী রসিকতা করে বললো– দ্যাখো তোমার ওষুধের গুণ, ডিসপেনসারিতে একজন রোগী নেই।
চরণ বললো–এখন মসুর কলাই-এর ক্ষেত করার সময়, যার যেটুকু অঘ্রাণের ধান আছে কাটার সময়। দুএকজন এসেছিলো, ওষুধ নিয়ে গিয়েছে।
আলাপটা এগোলো না। ব্যাগ কাঁধে ডাকহরকরা দেখা দিলো। সেখানে বসেই ডাকের ব্যাগ নিলো চরণ, তেমন একটা মুখ বন্ধ ব্যাগ এনে দিলো ডাকহরকরাকে। চরণ যখন ডাকের এই কাজ করছে, বাগচী ভাবলো কী অদ্ভুত কাজ করে এই লোকটি। সকালে ডাকের কাজ করে, সেখান থেকে স্কুলে, আবার কিছু ডাকের কাজ, বিকেলে এই ডিসপেনসারিতে ওষুধ বিলোয়, নিজের ক্ষেতখামারের কাজ তো আছেই। নিয়োগী আসার পর থেকে সন্ধ্যায় ইংরেজি শিখছে। রবিবারেও এই ডাক এলো।
হরকরা চলে গেলে বাগচী বললো–রোগী আসে আমি দেখবো, তুমি ডাকের কাজ করতে পারো। চরণ ডাকের কাজ করতে শুরু করলো। বাগচী বসে রইলো খানিকটা সময়। এক এক করে দু-তিনজন রোগী এলো। তাদের বিদায় করে পাইপ ধরালো বাগচী। সে অনুভব করলো তামাকটা বেশ ভালো, আর এখনকার আবহাওয়াটাও। তাছাড়া কেট দেখা যাচ্ছে চিরদিনই বেশ সাহসী। ভাবো, সেবার রাজকুমারের সঙ্গে গড়ের জঙ্গলে চলে যাওয়া। অবশেষে ঘড়ি দেখে বললো–আর মিনিট দশেক। তোমার কাজ হলো? আজ দিনটা বেশ ভালো। ভাবছি তোমাকে সঙ্গে করে কিছুটা ঘুরি। আমার কিছু সিল্ক কেনার ইচ্ছা হচ্ছে যদি পাই। দেখা যাক না, কী বলে?
চরণ বললো–দু-তিন দিন আগে সেই আর্মেনি শিশাওয়ালকে দেখেছিলাম। তার কাছে সিল্ক নেই?
শিশাওয়াল কলকাতা থেকে নৌকা সাজিয়ে অন্যান্য বছরের মতো এবারও এসেছে। তার ব্যবসাই এটা। পণ্যের দিক দিয়ে সে একচেটিয়া। এসব অঞ্চলের ধনীদের, মধ্যবিত্তদের, এমনকী নিম্নমধ্যবিত্তদের উপযুক্ত পণ্য থাকে তার। মুখ্যত অবশ্য মরেলগঞ্জের কুঠিয়ালদের এবং রাজবাড়ির অর্ডার-সাপ্লায়ার। শিশাওয়াল নামও পণ্য থেকেই। কাঁচের শীট, গ্লাস টাম্বলার, চিমনি, ডোম, ঝাড় এসব তো বটেই, নানা আকারের মদের বোতলও অবশ্যই থাকে। কলকাতার আধুনিকতার কথা মনে রেখেই কুঠি ও রাজবাড়ি থেকে অর্ডার দেওয়া হয়। কিন্তু আধুনিকতার সৃষ্টি তো মুখ্যত বণিকের পণ্যে, সুতরাং আমদানি অর্ডারকে ছাপিয়েই যায়। অবশ্যই তার সেলসম্যানশিপও যথেষ্ট। সে ধনীদের শাল, দোশালা, বনাত আনে। নানা দামের রাগ-কম্বল আনে, সূতার বস্ত্র ইত্যাদিও আনছে নিম্নমধ্যবিত্তদের জন্য।
সম্ভাব্য রোগীদের জন্য অপেক্ষা করতে করতে বাগচী শিশাওয়াল থেকে রানীমার জন্মোৎসব, তা থেকে নাটকের চিন্তায় পৌঁছে মনে মনে হাসলো। জিজ্ঞাসা করলো–আচ্ছা, চরণ, খবরটা আজই শুনলাম, তোমরা নাকি এবার থিয়েটার করছে রাজবাড়িতে?
চরণ লজ্জায় মুখ নামালো।
বাগচী বললো–কী নাটক? সে কি আমি পড়েছি?
চরণ বললো–প্রথমে ঠিক হয়েছিলো নীলদর্পণ।
বাগচী মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললো–কিসের দর্পণ? রসো রসো, মনে পড়ছে। গত মাসে দেওয়ানজি যে কয়েকখানা বই স্কুলে দিয়েছেন তার মধ্যে এটা ছিলো। কিন্তু ভাষা সহজ হলেও তা কিন্তু ছাত্রদের পড়ানো যায় না। ভাষা সহজ ভালো, কিন্তু অত গেঁয়ো ভালো নয়। বলবে ঘরের চারপাশের ভাষা। কিন্তু ঘরের চারপাশে তোজঞ্জালও থাকে। কিছুউপরে উঠতেই না স্কুল।
চরণ বললো–দেওয়ানজির সেরেস্তদার বেজো কলকাতা থেকে বইটা এনেছে। তা কিন্তু আমরা করছি না। গৌরীরা বুড়ো শালিখ পছন্দ করেছে, আর একেই কি বলে।
এসবও কি বেজোবাবু এনেছে? কার লেখা,কী বৃত্তান্ত সেসবনাটকের? চরণ বললো– হ্যাঁ সার, বেজোই এনেছে। মাইকেলসাহেবের লেখা।
কিন্তু বাগচী তখন নীলদর্পণের কথাই ভাবছিলো। সেই নীলকরদের অত্যাচারের কথা যা সেই নাটকে দগদগে করে আঁকা। সেই দাদন আর দাদনের নীল আদায়ের জন্য গাদন। সে বললো–আচ্ছা, চরণ, তোমার সেই ডানকানার খৃস্টানি আত্মার কাগজপত্তর জাল করার, লাখ বছর ঘুমিয়ে থাকার গল্প মনে আছে?
-ওটা, সার, গ্রাম্যরসিকতা হয়েছিলো। চরণ অপ্রতিভ হলো।
না চরণ, না। তোমাদের সেই রসিকতা বেশ তীক্ষ্ণ ছিলো। বলতে কি তোমাদের সেই আলাপ নীলদর্পণে ঢুকিয়ে দিলে মানাতো। সে তুলনায় নীলদর্পণের রসিকতাই মোটা।
চরণ অবাক হয়ে বাগচীরমুখটাকে দেখে নিলো। সে জানে হেডমাস্টারমশাই-এর চিন্তার খেই ধরা তার পক্ষে সম্ভব নয়। দেওয়ানজির বন্ধু, আচারে ব্যবহারে সংস্কৃতিতে যিনি পুরোপুরি ইংরেজ, তিনি এ বিষয়ে কী ভাবছেন কে জানে! নীলদর্পণই এখনো মনে রেখেছেন,হয়তো শোনেননি যে তারা নীলদর্পণ নাটক করছেনা। মুখটা যেন থমথম করছে।
বাগচী বললো–দ্যাখোচরণ, লোকে বলে আত্মা কৃতকর্মের বিচারের জন্য অপেক্ষা করে থাকে, কেউ বলে পাপের শাস্তি সঙ্গে সঙ্গে হয়, এরকম মতও আছে–পাপপুণ্য, তার শাস্তি পুরস্কার সমাজ শাসনে রাখার জন্য তৈরী গল্প। কিন্তু, চরণ, অন্যকে পীড়ন করা যে পাপ এ কিন্তু খৃস্টানরাও স্বীকার করে।
চরণকে আজ অন্যরকমই দেখাচ্ছে। সে যেন কোথা থেকে মনকে ফিরিয়ে আনলো, বললো–কিছু বলবেন, সার? বাগচী প্রশ্নটায় অবাক হলো। বললো–তুমি কিছু ভাবছিলে, চরণ, আমার বক্তৃতাটা মাঠে মার খেলো। কোন রোগীর কথা ভাবছো? আচ্ছা, চরণ, তুমি কি মিশন হাউস দেখেছো? মনে করো, এই অঞ্চলে একটা মিশন হাউস হচ্ছে। সেখানে ইংল্যান্ডের মিশনারিরা থাকবেন।
চরণ বললো–মরেলগঞ্জের কুঠিতে একাধিক ইংরেজ সপরিবার আছেন।
চরণের তুলনাটা তার কাছে এত ভ্রমাত্মক যে বাগচী হেসে বললো–মনে হচ্ছে তুমি মিশনারীদের দ্যাখোনি। আমি তোমাকে তাদের ধর্মমত মানতে বলছি না। আমিও সব মানি না। মিশন হাউসের সঙ্গে শিক্ষাদীক্ষা, বদান্যতা, পরোপকার, আধুনিকতা অনেক কিছু জড়িত থাকে। মরেলগঞ্জের কুঠিয়ালদেরই কেউ কেউ এ ব্যাপারে উৎসাহী। তুমি তো কীবল সাহেবকে নিজেই দেখেছো আমার কুঠিতে।
-তবেই তো, সার। দা ডেভিল ওয়জ সিক দা ডেভিল এ সেন্ট উড বি।
কী বললে? ডেভিল?
চরণ তাড়াতাড়ি বললো–হয়তো আমারই ভুল, সার।
না, চরণ, তোমার ইংরেজি উচ্চারণটা ভালোই। আমি মনে করতে পারছি না ছড়াটা কোথায় শুনেছি। কিন্তু দ্যাখো, এ অঞ্চলে মিশন হাউস হলে আমাদের গ্রামেরও পরিবর্তন হবে। তাছাড়া নতুন আদর্শ চোখের সামনে থাকা ভালো। আমাদের পুরনো আদর্শ প্রয়োজনমতো বদলে নিতে পারি। তাতে ভালো হয়।
-ভালো হয়?
তর্কে অভ্যস্ত পাদরির সতীদাহ নিবারণ ও বিধবাবিবাহ আইনের কথা মনে এলো। যুক্তি হিসাবে এটাকেই সে খুব জোরালো মনে করলো, কারণ চরণ নিজেই বিধবাবিবাহ করেছে। সে বলতে গেলে এদেশে কিছুদিন আগেও বিধবাদের পুড়িয়ে মারা হতো, এখন প্রয়োজনে তারা বিবাহিত হচ্ছেন। কিন্তু নিতান্ত ব্যক্তিগত এই যুক্তি থেকে সে নিজেকে সামলে নিলো।
পাইপটা ঝেড়ে পকেটে রেখে সে ঘড়ি দেখে হেসে বললো–দশটা বাজলোচরণ। আমি তোমাকে মিশনারিদের সম্বন্ধে অনেক বলতে পারতাম। কিন্তু এখন চলল, একটু ঘুরি। সিল্ক খুঁজতে হলে তুমি তাঁতিদের কাছেই যাও, তাই নয়?
চরণ বললো, চলুন সার, আমি দুমিনিটে তৈরী হয়ে আসছি।
চরণ দাস অন্দরে গেলে বাগচী ভাবলো : এটাও ভেবে দেখার মতো বৈকি যে মিশনারিদের প্রধান উদ্দেশ্য ধর্মান্তরীকরণ। কিছু মানুষকে তা ক্রিশ্চান করতে চেষ্টা করবেই। চরণ কি এই ভেবেই বিরক্ত? এটা কি চিন্তায় উঠে আসেনি, কিন্তু মনের তলায় আছে এমন স্বজাতিক্ষয়ের আশঙ্কা?
চরণ প্রস্তুত হয়ে এলে তারা বেরিয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ তারা পাশাপাশি নিঃশব্দে হেঁটে চললো। পরে বাগচী বললো–সব যদি ছেড়েও দাও চরণ, মিশনারিরা ইংরেজ শাসনকে তাড়াতাড়ি টেনে আনতে পারে। পথঘাট হবে, হয়তো রেল এসে যাবে, হয়তো তারে খবর পাঠানোর বন্দোবস্ত হবে।
এটা একটা কৌতুকের ব্যাপারই হলো। বাগচী টের পেলো না এই পথঘাটের কথাটা এইমাত্র বাইরে থেকে তার মনে ঢুকলো। তারা ফরাসডাঙার দিকে চলেছেতখন। তারা তখন যেখানে তার কিছু দূরে পথের উপরে বেশ কয়েকজন মানুষ কিছু মাপজোখ করছে। ওভারসিয়ার সুরেন তাদের নেতা। বাগচী যেন তাদের লক্ষ্যে আনলোনা, কিন্তু যেন আগের তর্কের টানে বললো, রাণিমার শিবমন্দির হচ্ছে, তাতে কত লোক একবছর থেকে কাজ পাচ্ছে, দেখেছো? মিশন হাউসও খুব ছোটো হয় না। তাদের বাড়িঘর পথঘাট তৈরীতেও কত লোক কাজ পাবে দেখো।
আলাপটা ক্রিশ্চান মিশন হাউসের অনেক বড় বড় সম্ভাব্য উপকরণ থেকে অকস্মাৎ কিছু লোকের কিছুদিন ধরে মজুরি পাওয়ার সম্ভাবনায় নামলে চরণ হেসে ফেলো। আশ্চর্য রকমে অন্যমনস্ক না হলে এমন হওয়ার নয়। হেডমাস্টারমশায়ের কথা। কিন্তু তার কথাও অনেকক্ষণ থেকে কি একগুঁয়ের মতো শোনাচ্ছে না? সে যেন একমত হওয়ার সুযোগে স্বস্তি পেয়ে বললো–তা ঠিকই, সার। শিবমন্দির শুধু নয়। ডাকঘরের পর থেকেই এবার পাকা সড়কের কাজ শুরু হয়েছে। শুনছি নাকি রাজবাড়ির সদর থেকে শিবমন্দির তকএকই পাকা রাস্তা হবে, আমাদের স্কুলের পাশ ছুঁয়ে, পুরনো ঝিলের উপরে অ্যাকোয়াডাক্ট তৈরী করে। চাষআবাদ নেই, কাজকর্ম নেই এমন লোকজনের উপকার হচ্ছেই তো বটে।
বলো কী? এসব বলোনি তো আগে? বাগচী হো হো করে হেসে উঠলো। বললো– তুমি তো আচ্ছা অন্যমনস্ক লোক হে! সামনে কত লোক সড়কের কাজ করছে দ্যাখোনি? ওখানে সুরেনবাবুদের দেখছি। মুখ ঘুরিয়ে চলো। বন্ধুদের দলে জুটে থিয়েটারে মাতো যদি আমার রেশম খোঁজাই হবে না।
খানিকটা দূরে গিয়ে বাগচী বললো–এত সব সড়ক কি শুধু শিবমন্দিরে যেতেই মনে করো?
চরণ বললো–শুনছি সেখানে পেত্রোর বাংলোও নতুন করে করা হচ্ছে। একটা নতুন বাড়িও নাকি উঠবে কলকেতার সাহেববাড়ির কায়দায়।
-তাহলেই দ্যাখো। আচ্ছা, সেখানে সে বাড়িটা কেন হবে আন্দাজ করছো?
চরণ বললো, ওটা তেমন তেমন সাহেবসুবোদের জন্য গেস্টহাউস হতে পারে। হতে পারে রাজবাড়ির কেউ থাকবেন, রানীমাও হতে পারেন।
বাগচী ভাবনো, রানীমা, রানীমা কেন? তা, শুনেছি রাজাদের বিবাহ হলে তেমন ব্যবস্থা হয়। চরণ চিন্তা করলো, তার কথাটা কি শ্লেষের মতো শুনিয়েছে? এ বিষয়ে সে হেডমাস্টারমশায়ের সঙ্গে একমত যে রাজবাড়ির মন্দির, সড়ক ইত্যাদির ব্যাপারে মানুষ কাজ পাচ্ছে। তা দরকার ছিলো। কুমোর, কামার, তাঁতি, চাষীদের কাজের বয়স হলেই বর্ণগত জীবিকা ধরবে সে সুযোগ আর কোথায়? তাদের কেউ কেউ জীবিকা পাচ্ছে। কিন্তু আর সব জমিদারের মতো রানীমা যদি কলকাতা ঘেঁষা হতেন? সে মনে মনে হাসলো: আসলে বিধবা রানীমা ক্রিস্টান ব্রাহ্মদের ব্যাপারগুলোকে ম্লেচ্ছকাণ্ড ভেবে কলকেতার দিকে যেতে চান না। তাই উপকার।
.
০৩.
তখন তারা ফরাসডাঙা দিয়ে চলেছে। বাগচীর মন ততক্ষণে পথঘাট থেকে রেশমের দিকে সরে গিয়েছে। সে বললো–এবার তাহলে আমাদের এই গ্রাম ক্রমশ হুগলী চুঁচুড়া, শ্রীরামপুরের মতোই একটা শহর হয়ে উঠবে দেখো। কিন্তু পরক্ষণেই বললো–এদিকেই কোথায় ধনঞ্জয় বসাকের বাড়ি, সেদিকেই চলল।
সেকালটা, অবশ্যই, রাজনগরে আর এমন ছিলো না যে বাগচী যে কোনো সকালে বেরিয়ে তার আশামতো ব্রোকেড-সিল্ক দূরের কথা গরদ-মটকাই পেয়ে যাবে। সে প্রথমে বসাক-পাড়ার ধনঞ্জয় পরে মালিকপাড়ার মেহেরালির দেখা পেলো। চিকিৎসার সূত্রে তারা পূর্ব-পরিচিত বটে। তাঁতিদের মধ্যে দবীর বক্সের সাগরেদ আল্লারাখা বসাকের কথা বাদ দিলে তারাই এ অঞ্চলে প্রধান।
ধনঞ্জয়ের লম্বাৰ্তাতঘরে তখন তাত চলছিলো; অন্তত চারখানায় কাজ হচ্ছিলো; তারই একখানায় সে নিজে। সে জানালো রাজবাড়ির উৎসবের দরুণ সে কিছু তসরের গড়ার বরাত পেয়েছে। শীতে ওম দেবে, কিন্তু খসখসে আর মোটা। হুজুরের হুকুম পেলে সে পরে এক থান তসর বুনে দিতে পারে। গরদ চাইছেন, সে সুতো নেই। বামুনমশায়রা মাঝে মাঝে তসর কেঠো নেন, গরদ কে নিচ্ছে আর? শুনেছি মালিকবাড়ির ওরা রাজবাড়ির দরুন গরদের শাড়ির বরাত পেয়েছে। দেখুন ওখানে, তাছাড়াও গরদ বুনছে কিনা। সুতোনাকি রাজবাড়ির সরকারই এনে দিয়েছে।
বাগচী জিজ্ঞাসা করলো–এখানে বুঝি গরদের সুতো হয় না?
-হতো তো। সে কিন্তু পেত্রোসাহেবের আমলে। ফরাসডাঙার আধখানায় উঁতচাষ ছিলো, আজ্ঞা।
-এখন বুঝি তসরের সুতো হয়। বামুনদের লাগে বলছিলে।
–আজ্ঞে না। সেও তো আনাতেই হয়। দামে কম,ঝুঁকি কম। বামুনে তসর বছরে দশখানা বিকোয়, দাম পেতে আজ্ঞে একবছর। কিনছে কে যে কাটুনি সুতো কাটে, তাঁতি তাঁত বয়? জোলাপাড়ায় দেখুন গামছা আর মোটা সুতোর মাঠা। আট আনায় যে মিলেন শাড়ি, তাঁতি দিনরাত খেটে ডেড় টাকায় দিতে পারবেনি। আর বামুনমশায়রা যে কিনবে আমরা আগে তো দেবো-থোবো। আমরা গিইচি তো তেনারা রইলেন? শাপমুন্যিরও আর আগুন নেই।
বাগচী হেসে ফেলো, কিন্তু বললো–না, না, বোধ হয় ঠিক বলছো না। পিয়েত্রো গত বলে খরিদদাররাও গত হবে কেন?
ধনঞ্জয় বললো–এখন বুঝি, আগেই টান ধরেছিলো। এখন ভাবলে বুঝি, ত্রিশ বছর থেকে তাঁতের বৃদ্ধি বন্ধ ছিল। সাহেব থাকা তক বাজারের কথা ভাবতাম না। বোনা মাল গুদামে পৌঁছে দিলে হলো, সুতো চাই, আনো গুদাম থেকে। দেখতে হতো মালটা কী হচ্ছে, তাতে হাঁকফাঁক না পড়ে।
-তাহলে বলছে, পিয়েত্রোর মতো মহাজন আর একজন না-আসা পর্যন্ত তসর গরদ আর উঠতি হচ্ছে না।
আজ্ঞে না। নামার দিকে। বরাত ছাড়া, আগাম দাদন ছাড়া কে বুনবে? কী এক মিলেন কাপড় হয়েছে, তাই নাকি বাবুয়াদের ফ্যাশোয়ান। সাপানে কাচো, গরমে ইস্তিরি চালাও। কে আর তিনগুণ দিয়ে রেশম কিনছে?
বাগচী বললো–হ্যাঁ, ধনঞ্জয়, কী হবে তাহলে এখন?
ধনঞ্জয় বললো–জন্ম থেকেই শুনছি, কী হবে? বোকার জাত সার, ধানপানের কাজ জানি না, রোদজল সয় না, কাদাপাকে গা ঘিনঘিন। কী হবে দেখেন গে ওস্তাগর পাড়ায়। দরজায় দরজায় রঙের ভ্যাট, ধুমসো চাড়ি-গামলা, কাঠের ছাপা, ইস্তিরির কুঁদো। সাদামাটা রেশম চলে না, কে আর কিনছে? রঙিন আর ফুলদার
বাগচী অপ্রতিভের মতো হেসে বললো–তাহলে ব্রোকেড দূরের কথা?
ধনঞ্জয় বললো–চরণভায়া, মাস্টারসাহেবকে নিয়ে মালিকবাড়ি যাও। মেহেরচাচার পাগলামি আছে। বোরকেট করলেও করে দিতে পারে।
মেহের মালিকের বয়স অনেক হবে। মুখে সাদা কিন্তু সৌখীন ফরাসী কায়দার দাড়ি। কথা বলার আগে ঠোঁটে হাসি জড়ায়।
বাগচী তার কাছে মেমসাহেবের গাউনের উপযুক্ত সিল্কের কথা বলতেই সে বললো–সে আর হয় না।
-ব্রোকেড চেনো, মালিক?
মেহের আলির আত্মসম্মানে আঘাত লাগলো। কী একটা বলতেও যাচ্ছিলো–কিন্তু কথাটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে বললো, পেত্রো বুজরুকের বাপেরা আমার আব্বাজান আর চাচাজীকে চুরি করে এনেছিলো মুকসুদাবাদ থেকে। ভরার খুবসুরৎ হিন্দু মেয়ে দেখে নিকাহ দিয়েছিলো।
বলো কী? বাগচী হেসে ফেলো।
–জি, চাবুক খাও, নয় বোরকেড়। রেশমে ফুল ফোঁটাও, ঠাসসা যেন জল না গলে। বোনো জমিজিরৎ মৌরসীতে। লেকিন বিশ থান বোরকে।
–এসব গল্প।
কারিগরে আর ফকিরে ওই এক মিল, হুজুর। কারিগরের বিশ থান হয়ে ওঠে না, ফকিরও খোদাকে পায় না। কিন্তু এই জমিজিরত পেত্রোদের দেওয়া। তো, ওদিকে দবীর বক্সের দবীরখানি মসলিন, ইদিকে আব্বাজানের মালকানি বোরকেডের নাম ছিল, হুজুর। লোকে বলতো, আঙুলে হয় না শুধু, তুকতাক আছে।
বাগচী বললো–ব্রোকেড হয় না, ঠাসা জমির গরদও কি হয় না?
তখন মেহের তার তাতঘরে ঢুকলো। লম্বা উঁচু আটচালাটায় তখনো আট-দশখানাঠাত। তিন-চারটিতে কাপড়, একজন একটিতে কাজ করছে। মেহের জানালো সে তার ছোটো ছেলে। মেহের নিজেই তাঁতের উপরে ঝুঁকে বললো–এসব কাপড়ে কি আপনার হয়? কিন্তু কাপড় দেখে বললো, না, হুজুর, এ আপনাকে দেওয়া যায় না। ছেলেকে হেঁকে বললো, এ রকম কেন রে?
ছেলে বললো–ওখানা রাজবাড়ির নয়। হীরু মহাজনের দরুন। সে বলেছে, মুখপাত, ঠেসে দিও, সব ঠাসলে দামে পোষায় না।
মেহের আলি বললো–না হুজুর, এদিকে ঘুরে লাভ নেই। আপনি বরং আল্লারাখার খোঁজ নেন। সে এখনো রাজবাড়ির দরুন গরদ বোনে।
বাগচী বললো–কাপড় নাই পেলাম। এই আলাপও ভালো লাগছে। কিন্তু, ওস্তাদ, এরকম হলো কেন?
মেহের বললো–হয়েছে কি আজ? তিন কৃড়ির উপরে দশ হলো, তিন কুড়ির খবর রাখি। পেত্রোদের স্থায়ী গুদাম হওয়ার আগে পূজা ঈদের ছমাস আগে দাদন বরাত নিয়ে সাধাসাধি, এক, দেড় মাস আগে কুতঘাটে নৌকার ভিড় লাগতো মহাজনের। রেশম তো বটে, সুতোর শাড়ি নিয়ে কাড়াকাড়ি। সেসব নৌকা বন্ধ হলো; এক কুড়ি বছর আগে পেত্রোদের জাহাজ চলাও বন্ধ হলো।
মেহের থামলো একটু, পরে হেসে বললো–তো পেত্রো বলতেন, মেহের, হাজার বছর ধরে কাপড় দিয়ে সোনা লুঠেছে ওদের, এবার ওরা আইন করে কাপড় দিয়ে সোনা লুঠবে। শুধু কি কাপড়? ইস্তক খোস্তা, কুড়ুল, দা, হেঁসো সেই জাহাজে আসছে। বাগচী বললো–মেহেরমিঞা, তোমার বোরকেড জাহাজে নাই উঠলো,এদেশেও তো বহু লোক
হুজুর ফেশোয়ান বদলায়। পাঁচ সাল আগেও বুজরুক খাঁর কিস্তি যেতো লখনউ। এখন, হুজুর, সেখানে সে ফেশোয়ান নেই। কে আছে কলকেতায় মুকসুদাবাদে দবীরখানি মসলিনের শাড়ি পিন্ধে, কামিজ বানায়, দোপাট্টা পিন্ধে? কে আছে হুজুর, মালকানি বোরকেটের শেরোয়ানি, আছকান, চোগা পিন্ধে?
বাগচী তা সত্ত্বেও বললো–শুনে মনে হয় বরাত ছাড়া, আগাম টাকার দাদন ছাড়া তাতে বসতে চাও না।
মেহের আলি একটু ভেবে বললো–হুঁজুর, সুতোর টাকা বরবাদ, এক মাসের পরিশ্রম বরবাদ যদি এক থান বুনে একবছর বসতে হয় তা বেচতে। আসলে, হুজুর, রোগটা অনেক দিনের। সেই ছিয়াত্তরের রক্তবমি। রাজবাড়ি আর পেত্রার চেষ্টায় ওস্তাদেরা বেঁচেছিলো, কিন্তু পাঁচআনি লোক, কাটুনি জোলা, রজক ওস্তাগর, কামার কুমোর, গুড়ে, চাষী শেষ হয়েছিলো। পেত্রো বলতেন, তারপরে শরীর সারেনি, জাতটাই আধহাত কমে গিয়েছে।
বাগচীর কৌতূহল বাড়ছিলো। রাজনগর-ফরাসডাঙার এ অঞ্চলের খ্যাতিটা তাহলে ছিলো তাঁতের। সেজন্যই বর্ধিষ্ণু। নতুবা শুধু ধানে, তিলে আর গুড়ে বোধ হয় অত বাড়ি রাজবাড়ি এতদিন ধরে গড়ে ওঠে না। সে বললো–আসলে তোমাদের বাজার চাই, বাজারে নিয়ে যাবে দাদনদার বরাতদার মহাজন চাই।
মেহের আলি বললো–আমার ছোটো দামাদের ভাই মহাজন হতেছিলো, এ গেৰ্দের মাল নিয়ে দুসাল কলকেতায় গেলো।
-তারপর?
–মিয়াদ খাটছে।
–সে কী?
মেহের বললো–দাদনদার হতে রাজার জাত হতে হয়। দামের কাজ আদায় হয় না সহজে, আগাম টাকা গরীবের পেটে ঢুকে যায়। আদায় করতে-তো ইংরেজ তা করেঝকে অন্যের মিয়াদ হয়।
.
০৪.
মাসদেড়েক পরে এইসব কথা বিচিত্রভাবে বাগচীর মনে ফিরেছিলো চরণের বাড়িতে বসেই। সে তো পিয়েত্রোর কাছেই শুনেছিলো সেই পাঠান-মুঘল আমলে, ইউরোপেও যেমন, ধর্ম নিয়ে বর্বরতা ছিলো, কিন্তু প্রতিবাদও ছিলো; ক্ষুধা ছিলো, সোনা-জহরৎ ছিলো,নবাব রাজা ওমরাদের বিলাস ছিলো, সোনাও ফিরতে কারিগরদের হাতে। এখন প্রতিবাদ নেই, সোনাজহরৎ নেই, কারিগর নিশ্চিহ্ন। সে চিকিৎসক এবং সেটা তো ডিসপেনসারি। হঠাৎ এরকম ঘোর লেগেছিলো তার মনে! তার স্কুল, ছাত্র, হাটবাজার, লোকজনের চলাফেরা এসব কি সেই ছিয়াত্তরের উচ্ছিষ্ট।
কিন্তু সেদিন তখন বেলা হয়েছে। প্রথম শীতের হলেও, বেলা বারোটায় প্রকৃতি তপ্ত, প্রখর। তারা চরণের বাড়ির দিকে ফিরছিলো। বাগচী লক্ষ্য করলো, চরণ এতক্ষণ সঙ্গে থেকেও একটা কথাও বলেনি। সে হেডমাস্টারের এই রেশম খোঁজায় কৌতুক বোধ করছে না তো? তার এই রেশম খোঁজা কি অস্বাভাবিক ব্যাপার হলো? সে বললো–হা চরণ, তুমি কি সেই অসুস্থ ডেভিলের কথা ভাবছো এখনো?
চরণ বললো–ওরা দাদন-বরাতের কথা বললো।
বাগচী বললো–তাই তাই। সিল্ক নেই বলে এমন করে নেই তা কি তুমি জানতে?
চরণের বাড়ির কাছাকাছি এসে বাগচী বললো–তোমাদের সেই নাটকের কথা যা বলছিলাম।
নাটক হবে। তবে আমি ঠিক ওতে নেই।
বাগচী ভাবলো, দ্যাখো, কেমন সমস্যার সমাধান হয়ে গেলো।
চরণের বাড়িতে টাট্টুর লাগাম হাতে নিয়ে সে বললো––ও হা, ইসমাইলের চোখটা! মার্ক সল দিয়েছো তো? তাই দিও আবার।
টাট্টুরও ক্ষুধার সময়। সেটা একটু তাড়াতাড়ি চলছে চেষ্টা করে, এমনকী তার ক্ষুরে ঘোড়ার মতো না হোক পটপট করে একটা শব্দ হচ্ছে। বাগচী তখন ভাবলো, কী লজ্জা থেকেই বাঁচা গেলো! ভাগ্যে সিল্ক পাওয়া যায়নি। তার চল্লিশ হয়েছে। কেটের ত্রিশ হবে। আজ সন্ধ্যায় পিয়ানো বাজাতে বলা যায়। আমি চরিতার্থ, হে ঈশ্বর! কিন্তু সিল্ক কিনে দিলেই তা বেমানান হতো। এই সিল্ক খোঁজার গল্পও কি বলা যাবে? কেটের তো এমন মনে হতে পারে, সে কাল রাত্রিতে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এসব তারই পুরস্কার দেওয়ার ইচ্ছা। না, না। এ রকম ধারণা অন্যায় হবে যে একজন শুধু কেটকে নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলো না।
সে যখন সার্বভৌমপাড়ার পাশ কাটিয়ে গঞ্জের রাস্তা ধরছে, ভাবলো, তাহলে এতদিন এসব ব্যাপারে সিদ্ধান্তে নেওয়ার ভার আলোচনা না করেও কেটের উপরেই রাখা ছিলো? কেটই দেখতে গেলে তাদের সংসারে ভিন্নজাতীয়া হিসাবে অতিথি। ব্যাপারটা কি এই ভিন্নজাতীয়তার দরুন সমস্যা হয়ে ছিলো? স্বীকার করতেই হবে, কেট যেমন বুদ্ধিমতী, তেমন জেদী। এ দুটোর প্রকাশের সময়েই তাকে কিন্তু ভালো দেখায়।
বাগচী তখন স্কুলডাঙার দিকে যাওয়ার প্রধান পথগুলোর একটির কাছে। সেটার ধার দিয়ে একসারি গাছ থাকায় তার সবটুকু চোখে পড়ছে না। সে ভাবলো, যা স্বাভাবিক তা নিয়ে সে ভাবছেই বা কেন? …সকলেই ভাবে? তাও কিন্তু তার এই চল্লিশে কাউকে জিজ্ঞাসা করতে পারে না। কেটকে জিজ্ঞাসা করা যায় না। না, না। এটা তার নিজস্ব সিক্রেট থাক।
রবিবার থাকায় যোগাযোগ হলো একটা। একটা হাঁক শুনে সে চমকে উঠলো। সে দেখতে পেলো, যেখানে সে প্রধান পথটায় উঠবে সেই মোড় দিয়ে একজন যাচ্ছে বটে। তার পরনে ট্রাউজার্স, কিছুটা বিবর্ণ চেক্ ফ্ল্যানেলের শার্ট, মাথার চুল বেশ লালচে, মুখের রং গাজর জাতীয়। হলুদ হলে, মাথার চুল কালো হলে চীনা বলা যেতো। অন্তত তার পিঠে কলকাতার চীনা ফিরিওয়ালাদের মতো কাপড়ের গাঁটরি। দৃশ্যটা বাগচী মনের মধ্যে নিতে না নিতে আবার হাঁকটা শুনতে পেলোবনাত, বনা-ত, বনা-ত।
সেদিকে চোখ থাকায় বাগচীকে আবার মৃদুভাবে চমকাতে হলো, তার টাট্টু এখন যেভাবে চলেছে তাতে যে কোনো লম্বা লোক অনায়াসে তার পাশে পাশে চলতে পারে, লম্বা পায়ে চললে তাকে ছাড়িয়েও যেতে পারে। বাগচী শুনতে পেলো তার কনুইয়ের কাছে কে বললো, গুড মর্নিং, সার; যদি অনুমতি করেন, আপনার কুঠিতে যেতে চাই। আজ রবিবার বলেই এই পথে এসেছি। কয়েকপিস্ ভালো শাল আছে, সার। গত রবিবারে আপনাকে পাইনি।
বাগচী হাসিমুখে ওসবে আমার দরকার নেই বলে নিরস্ত করতে যাচ্ছিলো, কিন্তু তার আগেই শিসাওয়াল উঁচু গলায় গজ দশেক আগে চলা সেই ফিরিওয়ালাকে ডাকলো। বাগচী লাগাম টেনেছিলো। সেই ফিরিওয়ালাও পিছিয়ে এলো। সে কাছে এলে শিশাওয়াল বললো– আলফ্রেড মিনহাজ ডিসিলভা আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট, রেভরেন্ড ফাদার বাগচী, হেডমাস্টার।
ভদ্র বাগচী বললো, হাউ ডু ইউ ডু মিস্টার ডিসিলভা।
মিনহাজ তার হলুদ দাঁতে হেসে ইংরেজিতে বললো, থ্যাঙ্ক ইউ, মিস্টার। কিন্তু আমার প্রিন্সিপ্যাল আমার নামটা প্রায়ই গুলিয়ে ফেলেন, আমি ডিসিলভা নই, রিয়ালি আইম ও সুলিভান।
তখন সেখানে আলাপ করার সময় নয়। বাগচী কিছু বলার আগেই শিশাওয়াল, যার প্রকৃত নাম য্যাকব ফেলিসিটার, বললো–ডিসুলিভান, তুমি ছোটো গাঁটরি আর পিতলের গজকাঠিটা আমাকে দাও। আর বিকেলের আগে পুবদিকটা শেষ করে এসো।
ও ‘সুলিভান তার বড় গাঁটরির নিচে থেকে একটা ছোটো গাঁটরি বার করে দিলো। তার হাতে এতক্ষণ বোঝা যায়নি, দুটো গজকাঠি ছিলো। তার একটা ফেলিসিটারকে দিয়ে আবেগহীন মুখে হাঁটতে শুরু করেই হাঁক দিলোবনাত। য্যাকব বললো–শুধু বনাত কেন? চাদর, চেকচাদর বলল, সুতি দোরুখী আলোয়ান বলেও হাঁক দাও। দিনে খানদশেক চাদর কাটা চাই।
ও ‘সুলিভান জোরে চাদ্দর বলে হাঁক দিলো।
বাগচী জিজ্ঞাসা করলো–চেকচাদর কী?
এবারের ফ্যাশান, সার। উল আর সূতোয় মিশানো, নানা রঙের চেক। অল-উল বলে চলে যাচ্ছে। তিন থেকে চারে দিচ্ছি রং অনুসারে। তাঁতের একটা মোটা সুতোর চাদর যেখানে দুটাকা, রঙিন সুতোর চাদর বারো আনা থেকে দেড় টাকায় দিচ্ছি। দোরুখীগুলো দুটাকায়। চলুন, সার।
বাগচীর টাট্টু চলতে শুরু করলো, শিশাওয়াল তার পাশে হেঁটে চললো।
বাগচী বললো–তুমি আমার কুঠিতে যেতে চাইছে বটে, আমি কিন্তু শাল কিনবার কথা দিচ্ছি না।
য্যাকব বললো–না সার, মাল না দেখে কেন তা বলবেন?
বাগচী মনে মনে হেসে ফেলো, গতবারও এরকম ধরনের কথা হয়েছিলো বোধ হয়। ফেলিসিটার একখানা এমারেল্ড রঙের শাল না গছিয়ে ছাড়েনি, যা থেকে কেট একটা সুন্দর গাউন করেছিলো।
তার কুঠি তখনো খানিকটা দূরে। বাগচীর মন কেনাকাটা থেকে খানিকটা অন্যদিকে সরলো। সামনে খানিকটা দূরে ওসুলিভানকে দেখা গেলো। বাগচী ভাবলো, সুন্দর অসুন্দরের প্রশ্ন নয়, শুধু চুলের রংও নয়, আলফ্রেড মিনহাজ, তা সে ডিসিলভা বা ওসুলিভান যা হোক, তাকে দেখামাত্র ইউরোপীয়দের কথা মনে আসে। কিন্তু এটাও ঠিক, ভালো করে দেখতে গেলে, ড্রেগ আর স্কাম শব্দ দুটোও মনে আসে। বয়স কিছুতেই পঁচিশের বেশি নয়, কিন্তু ইতিমধ্যে অনেক গুটিযুক্ত মুখের নাকটির অগ্রভাগ লাল, অনাবৃত বাহুর উপরে অনেক ছিট, ক্ষয়গ্রস্ত হলুদ দাঁত। ইউরোপীয় নয়, এদেশে এখনো এমন কোনো ইউরোপীয়ান আসে না যাকে অন্য ইউরোপীয়ানরা ফেলিসিটারের ভারবাহী হতে দেবে। স্বজাতির মানরক্ষায় হয়তো তাকে চাকরি দিতে। বাগচীর মন আবিল করে এই চিন্তা দেখা দিলো :হয়তো টাকায় বশীভূত কোনো ন্যানীর প্রতি কোনো ও সুলিভানের লালসার ফল।
কিন্তু তখন ফেলিসিটার বলছে–সার, ম্যাডাম অনুমতি করলে তাকে তো শাল দেখাবোই, আপনাকে এখন একটা প্রস্তাব দিতে চাই। দয়া করে ভেবে দেখুন। এখন তো এটা শহর হয়ে উঠছে ক্রমশ। বেশ কয়েকটি সুরকির পথ হচ্ছে, আপনাকে একটা ফেটনের বিষয়ে চিন্তা করতে বলবো কি? মেহগ্নি কাঠ, নিকেলের কাজ, ক্যানভাসের হুড। মরেলগঞ্জের ক্রিস্টমাসের আগেই একটা দিচ্ছি।
বাগচী হেসে বললো, না না, আমি একজন স্কুল-টিচার মাত্র।
শিশাওয়াল হেসে বললো, এটা কি সমস্যা? মিদনাপুরের হেডমাস্টারসাহেবকে গত মাসে একটা ফেটন এবং একটা খাঁটি ওয়েলার দিয়েছি। এই গ্রামে প্রকৃতপক্ষে এখন মিদনাপুরের চাইতে ভালো পথ তৈরী হচ্ছে। এমনকী সার, একটা ফ্লাই আপাতত নিন। আপনার টাটুর মাপে, খুব হালকা, সিমলার রিকশার মতো, দুজনে বসা যায়, দু চাকার, হালকা সেগুন আর নিকেলের একটা ফ্লাই…
বাগচী ফেলিসিটারের কথা সবটুকু শুনতে পায়নি। সে ভাবলো, কিংবা সত্য পরিচয় খুঁজে না পাওয়াতেই ডিসিলভা হবে কিংবা ওসুলিভান–এই সমস্যা। এটা তাহলে বড়ো বড়ো শহরের উপান্তে যে মিশ্রজাতের মানুষগুলো কখনো নিজেদের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, কখনো ইউরেশিয়ান বলে পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করছে, যারা ইংল্যান্ডেরও নয়, ভারতেরও নয়, তাদের শিকড় খুঁজে বেড়ানোর সমস্যা। ও হো, এ তো গাইলসের চিঠি থেকে নামলো যেন। সে বললো, তোমার এই ওসুলিভান লোকটি…।
শিশাওয়াল হেসে বললো, সে গল্প সার। প্রথমে কলকাতার স্কুলে শিক্ষক ছিলো, শেষ চাকরি ছিলো রেলে। আমার এই চাকরি দিয়ে ভালো করিনি? খেতে পরতে পাচ্ছে, সন্ধ্যায় রম্ টানছে।
শিক্ষক ছিলো? লেখাপড়া জানে বলো?
-বিলক্ষণ! ইংরেজি বলে, লেখে। আমার কাছে চাকরি চাইতে এসে কলকাতার . কয়েকখানা পত্রিকা দেখিয়েছিলো, যাতে ওর লেখা কবিতা ছাপা হয়েছে।
–তাহলে স্কুলে চাকরি যাওয়ার হেতু? বাগচী বেশ বিস্মিত হলো। ক্রিশ্চান ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতো? ছাত্রদের হিন্দু অভিভাবকেরা আপত্তি করেছিলো?
না সার। হিন্দুদের কুসংস্কারের কথা বললে তত গোল হতো না, মদ আর গোরু না খেলে মানুষ সভ্য হয় না এ বললেও ক্ষতি ছিলো না। রটেছিলো যে, ও নাকি বলতে ভাইবোনের বিবাহে দোষ নেই। আসলে যিশুকে, মানে মাতা মেরীর কুমারীত্বেই, সন্দেহ। স্কুল কমিটির হিন্দু ক্রিশ্চান সব সভ্যই ওর বিরুদ্ধে চলে গেছলো।
তারা হেডমাস্টারকুঠির কাছে এসে পড়েছিলো। বাগচী ভাবলো, তারাও তো ক্রাইস্টকে ঈশ্বরপুত্র মনে করে না। ন্যায় অনুসারে মেরীর কুমারীত্ব মানে না। এই বেদনার চিন্তা থেকে মুখ তুলে সে কুঠির বাইরের দিকের বারান্দায় দূর প্রান্তে যেখানে ছাদ থেকে অর্কিডগুলো ঝুলছে সেখানে কেটকে দেখতে পেলো। ফুলের পরিচর্যায় নাকি অন্যমনস্ক।
ফেলিসিটার বললো, সার, আমি গেটের বাইরে দাঁড়াই, ম্যাডাম অনুমতি করলে আমি ভিতরে যেতে পারি।
গেট পার হয়ে কুঠির বারান্দায় উঠে বাগচী বললো, হ্যালো ডারলিং, আমরা এসেছি। ওখানে কী?
কেট ফিরে দাঁড়ালো। তাঁর মুখটা কি বিবর্ণ? মুহূর্তে রক্ত ফেরার চাপেই যেন স্বাভাবিকের চাইতে বেশি লাল হলো। সে হেসে বললো–একমিনিট আগে বনাতওয়ালা গেলো একজন।
বাগচীও ষড়যন্ত্রের ভঙ্গিতে হেসে বললো–বনাত কিনবে নাকি? সহিসের জন্যে? এদিকে গেটের কাছে দ্যাখো শালওয়ালা।
কেট বললো–নাঃ, কেন কিনবো? ভাবছিলাম, রাজা রামমোহন পার্লামেন্টের কাছে সেই যে দরখাস্ত করেছিলেন যাতে ইংল্যান্ডের লোকেরা বেশি সংখ্যায় এদেশে এসে বসবাস করে।
বাগচী বললো–হ্যাঁ। কিন্তু সে কথা কেন? বনাতওয়ালাকে এড়াতে পারো, শালওয়ালাকে পারবে না। গেট দিয়ে ঢুকছে দ্যাখো।
সেদিন রবিবারের লাঞ্চের তখন ঘণ্টাদুয়েক দেরি। ফেলিসিটারও ভালো সেলসম্যান। প্রয়োজনের অতিরিক্ত, গ্রামের পক্ষে তো বটেই কলকাতাতেও তেমন সুলভ নয়, এমন পণ্য বিক্রি করতে যে মসৃণ প্রগলভতা দরকার তা ছিলোই তার। সে, উপরন্তু, হাসতে জানতো, ঠাট্টায় চটতো না, ধারে পণ্য দিতে কুণ্ঠিত ছিলো না, এবং তখনো–সে অনুগৃহীত এমন ভঙ্গি তার অভ্যস্ত ছিলো। সন্দেহ হয়, ব্যবসায় লাভের অতিরিক্ত কিছু সে পেতো, হয়তো ভালো লাগার ব্যাপার। কতকটা যেন সমাজ-সংস্কার, সমাজকে আধুনিক করাইবা, যেন ওপারের সংস্কৃতিকে এদেশে বহন করে আনা। এখনকার মতো তখনো আধুনিক হতে, সংস্কৃতিবান হতে মানুষের একটা সহজ আগ্রহ তার কারণ হতে পারে।
বসতে বসতে সে ঘোষণা করলো, সে কয়েক পিস কাশ্মীরি শাল দেখাতে এসেছে। তারপর প্রায় একঘণ্টা তার সেলসম্যানশিপে বাগচীর পার্লার সরগরম করে রাখলো। একের পর এক শাল বার করে একবার তা বাগচীর হাতে, একবার কেটের হাতে দিয়ে, তাদের গুণাগুণ, দাম, কীভাবে সেগুলোর কারুকার্য নষ্ট না করেও ম্যাডামের গাউন করা যেতে পারে তার বর্ণনা দিয়ে, একশো থেকে হাজার টাকা দামের শাল দেখিয়ে, বাগচীকে কতটা কমিশন দেওয়া যায়, সে বাগচীর জন্য কতটা লাভ ছাড়তে রাজী, তা বুঝিয়েও যখন অকৃতকার্য হলো, তখন সে রুমাল বার করে কপাল ঠোকার ভঙ্গিতে ঘাম মুছে, কিন্তু হাসিমুখে, বললো–এবার অনুমতি করুন কিছু সার্জ দেখাই। বিশেষ একটা লাল সার্জ।
কেট বললো, সার্জ? নানা, দরকার নেই। তাছাড়া টমিদের রং আদৌভালোনয়। বাগচী হেসে বললো–ডারলিং, আমাদের সাহেবকে একটু কফি খাওয়াতে পারো?
কেট কফি করতে গেলো। মিনিটদশেকে কফি নিয়ে ফিরে এলো। এই সময়ে বাগচী আর একবার ওসুলিভানের কথা ভাবলো। নিজের ভারতীয় মায়ের উপরে ঘৃণা ও অবিশ্বাস থেকেই সে কি মাতা মেরীকে কলঙ্কযুক্তা মনে করে? কিংবা তা কি একরকম বাস্তববোধ? চিন্তাটা মনকে স্বস্তি দেয় না। কিন্তু ফেলিসিটার তাকে সাহায্য করলো। পানীয়র কথা থেকেই যেন তার মনে পড়েছে এমনভাবে সে বললো, বাগচীকে সে কিছু পোর্ট ও শ্যাম্পেনও দিতে পারে। মরেলগঞ্জের জন্য ও দেওয়ানজির জন্য যা এনেছিলো তার বাড়তি কিছু আছে। তাই বা কেন? সে তো মাসখানেক বাদে ফিরে আসবেই, ক্রিস্টমাসের আগেই, তখন বাগচীর পছন্দমতো ওয়াইন এনে দিতে পারে।
বাগচী বললো–একমাস পরেই আবার? এত তাড়াতাড়ি?
ফেলিসিটার এক জায়গার গল্প অন্য জায়গায় নেয়। সে বললো–মরেলগঞ্জের ওরা ক্রিস্টমাসের আগে আগে এক গ্রোস মদ চেয়েছে। অর্ধেকটাই হুইস্কি, বাকিটা ব্রান্ডি, শ্যাম্পেন আর পোর্ট।
-ক্রিস্টমাসে? এক গ্রোস? বাগচী হাসলো।
ফেলিসিটার গলা নিচু করে এক চোখ বন্ধ করে বললো–ক্রিস্টমাসের উৎসবেই। ক্রিস্টমাসের গাছের জন্য ছোট্ট ছোট্ট রঙীন ডোমেরও অর্ডার পেয়েছি। অনেকে আসবেন। আসলে কিন্তু, যেরকম শুনি, এক কমিশন, নাকি ইন্ডিগোর।
কিন্তু তখন কেট কফি নিয়ে আসায় ফেলিসিটার ধন্যবাদ দেবার তাগাদায় মরেলগঞ্জের সেই বিশেষ উৎসবের গল্প ভুলে গেলো।
কফির পরে পাত্রগুলো সরানো হলে সার্জ বার করলো ফেলিসিটার। মুখবন্ধে সে বললো, দুটোইমাত্র দেখাবে। বটল গ্রীন একটা আছে। থানের অনেকটা রাজকুমারের ওস্তাগর নিয়েছে রাজকুমারের আচকান করতে। বাকিটায় একটা ভালো জ্যাকেট অবশ্যই হতে পারে। কিন্তু যেটা সে মেমসাহেবের জন্য বিশেষ করে মনে আনছে তা লাল সার্জটা। কখনই টমি-ইউনিফর্মের লাল নয়। বলতে কী এ থানটার আধখানা দিনদশেক আগে জঙ্গিলাটের সিস্টার-ইন-লকে বিক্রি করেছে। বলতে বলতে সে সার্জটাকে বার করে হাতের খেলা দেখানোর কায়দায় আঁকি দিয়ে কয়েক ভাজ খুলে মেলে ধরলো।
যদিও প্রমাণ ছিলো না, ফেলিসিটারের কথায় ছাড়া, যে কাপড়টার আধখানা জঙ্গিলাটের বাংলোয় বিক্রি করেছে, কিন্তু কেট ও বাগচী দুজনেই কাপড়টাকে হাতে নিয়ে দেখলো। বুনোটটা মিহি, স্পর্শটা কোমল। রংটা নিয়ে একটু কথা হলো। টমিদের লাল থেকে কতটা পৃথক তা স্মৃতি থেকে ঠিক করা শক্ত হচ্ছিলো কেটের পক্ষে। তখন ফেলিসিটার হেসে বললো–ম্যাডাম এই সার্জ টমিদের গায়ে দিতে হলে মহারানীর ভারতরাজ্য বিক্রি করতে হবে।
কেট বললো– তা সত্ত্বেও–এটা অত্যন্ত দামী কাপড়।
দামের কথায় বাগচীর মুখের হাসিটা কমে গেল। তা দেখে কেট বললো–আমার তো ভালো গাউন রয়েছে অনেক।
তখন বাগচী বললো– হেসে-ফেলিসিটারের পরিশ্রমটাও ভাবো ডারলিং, একঘণ্টা গল্প শুনিয়েছে।
কেট রাজী হয়েছিলো। কাপড়টা নিশ্চয়ই ভালো। তাছাড়া বাগচীর চোখে তার আগ্রহ প্রমাণ হচ্ছিলো। সুতরাং ফেলিসিটার তার সেলসম্যানশিপ সার্থক করে বিদায় নিলো।
কেট বললো–খাবারগুলোকে বাষ্পে বসিয়ে এলাম। পনেরো মিনিটে সব গরম হবে। তখনো ঘরটায় ফেলিসিটারের অদৃশ্য উপস্থিতি বিরাজ করছে। তা অনুভব করেই যেন বাগচী। বললো–আ, ডারলিং, তোমাকে বলতে ভুলে গিয়েছি, মিদনাপুরের হেডমাস্টার একটি ফিটন কিনেছেন।
আচমকা সংবাদটা শুনে তার গুরুত্ব কোথায় তা খুঁজতে কেট কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। সংবাদটা এমনভাবে বলা যেন অন্ধকারে এই চাঁদ উঠলো। কেট হেসে ফেলো। কিন্তু বললো–সেই হেডমাস্টারকে আমরা চিনি না তবে কেন ঠাট্টা করছো?
-ঠাট্টা! একে তাই বলে বুঝি? ফেলিসিটার অন্তত একটা ফ্লাই কিনতে বলেছে আমাদের, টাটুটাই টানতে পারবে, সিমলার রিকশার মতোই-হাল্কা, সুন্দর-সেও কি ঠাট্টা?
কেট বললো–তাহলে আর কথা কী!
-এবার তুমি ঠাট্টা করলে। দ্যাখো, রাজবাড়ির হাত থেকে ফরাসডাঙা পর্যন্ত একটা মেটাল্ড রোড হচ্ছে। আর তাহলে তা থেকেও আরো ছোটো ছোটো তেমন রাস্তা বার হবে।
কেট হাসতে হাসতে বললো, পথের জন্য ফিটন না হয়ে ফিটনের জন্যই না হয় পথ । হবে, এবার বলো কোথায় যাবে। পিয়েত্রার কুঠিতে লাঞ্চ নাকি?
বাগচী বললো–আরে তা কেন? ফাদার রলের মিশন হাউসটার কথা ভুলে গেলে? সেখানে যেতে তোমার নিদেন একটা ফ্লাই লাগবে না?
কেটের মুখে হাসির পাশে ছায়া পড়লো যেন। সে বললো, কিন্তু তুমি সে বিষয়ে কিছু ভেবেছো ফাদার বাগচী?
বাগচী বললো–আমি কেন ভাবতে গেলাম? টাকাটা তো আমার নয়, মিশন হাউস বানানোর খরচ দেবে তাদের লন্ডন সোসাইটি। মরেলগঞ্জের ওদেরও উৎসাহ আছে। কীবল চাইছে রাজবাড়ির আনুকূল্য থাকে তা যেন আমি দেখি।
কেট উঠে দাঁড়ালো। বললো–চলো দেখি, খাবার এতক্ষণে গরম হয়েছে। কিন্তু ফাদার রলে তো ক্যাথলিক।
বাগচী কেটকে অনুসরণ করতে উঠলো। বললো–ওহ তুমি তাই ভাবছো? সে তো প্রটেস্ট্যান্টরাও। তারাও আমাদের ক্রিশ্চান মনে করে না। ক্যাথলিকরাই বা তা কেন করবে?
বাগচী কেটের মুখ দেখতে পেলো না, কিন্তু তার এই ভুল ধরিয়ে দিয়ে বেশ খানিকটা হেসে নিলো।
লাঞ্চে একসময়ে কেট বললো–বারেবারে চাইছো, কেন, কিছু বলবে?
–ভাবছিলাম।
কী? গাউনটার কথা বুঝি? সত্যি, কী হবে তেমন দামী পোশাকে?
বাগচী বললো–কেন? আমরা কি কলকাতা যেতে পারি না, সামনে ক্রিস্টমাস? এবার রাজকুমারের সঙ্গে সে সময়ে কলকাতা যাওয়ার প্রস্তাব আসতে পারে। আমরা যেতেও পারি।
কেট বললো–কিন্তু সেখানকার উৎসবে
-তুমি বলবে আমরা যিশাসকে ঈশ্বরপুত্র বলি না, মানবপুত্র বলি। কিন্তু তাকে সর্বোত্তম মানুষের একজন মনে করি, সেটাই আমাদের আনন্দের কারণ হতে পারে।
কেট ভাবলো, মানুষটি এই রকমই। কিছুতেই যেন বুঝবে না উৎসব একা হয় না। সমমতের দশজনকে লাগে। সেখানেও তো আমরা একাই। উৎসব বলতে যা তা পাশ দিয়ে বয়ে যাবে। কিন্তু তার ইচ্ছা হলে বাগচীর মন অন্যদিকে নিয়ে যায়। সে বললো–আচ্ছা ডারলিং, রাজকুমার কেন এ উৎসবে কলকাতা যাবেন?
বাগচী একটু ভেবে হাসিমুখেই বললো–ধর্ম নয় বলছো? না, ধর্ম নয়। রাজনীতি বলবে? তা হতে পারে, দেওয়ানজি যখন উদ্যোগী।
কেট বললো, একটু বুঝিয়ে বলো সেটা কী রকম রাজনীতি হতে পারে?
লাঞ্চের গল্প খানিকটা হালকাভাবেই হয়। কিন্তু রাজকুমারের ব্যাপার বলেই যেন কিছু গম্ভীরও হতে হয়। বাগচী বললো–আমি ঠিক বুঝি না, কিন্তু দেওয়ানজির পদক্ষেপগুলোকে সাধারণ মনে হয় না। আচ্ছা, তোমার সেই নিয়মিত টাইমস পড়া আর সেই সুবাদে বলা দেওয়ানজির মোকাবিলা কথাটা মনে আছে? তাছাড়া, কেট, ভেবে দ্যাখো, লন্ডনের ক্রিস্টমাসে গ্রামীণ লর্ডরাও এসে থাকেন।
কেটও একটু ভেবে বললো–তারা কিন্তু লর্ড-সভার সদস্য, সে দেশের রাজ্যশাসনের সঙ্গে যুক্ত।
বাগচী ভেবে ভেবে বললো–অন্নদাতা সম্বন্ধে এ রকম আলোচনা করা উচিত হয় না। আমার কিন্তু মনে হয়, এসব ব্যাপারে রানীমার, রাজকুমারের এবং দেওয়ানজির ধারণা শেষ পর্যন্ত এক নয়। যেজন্য গতবার রাজকুমার কলকাতায় না গিয়ে পশ্চিমে চলে গেলেন। দেওয়ানজি একাই ছিলেন কলকাতায়। ওদিকে বুজরুকের একটা ব্যাপারে শেষ পর্যন্ত দেওয়ানজির মতই প্রাধান্য পেয়েছিলো। কিন্তু তারপরই কোনো বিষয়ে রানীমা আর দেওয়ানজির মতের পার্থক্য এমন প্রবল যে, রানীমা দেওয়ানজির ক্ষমতা কিছু খর্ব করেছেন। অবশ্যই এসব আমরা দ্বিতীয়বার আলোচনা করবো না। আপাতত রাজপুরুষদের সঙ্গে সখ্যস্থাপন, আর একটু এগিয়ে, রাজকুমারের রাজোপাধি পাওয়াতে যাতে প্রতিবন্ধক না আসে–এরকম কোনো উদ্দেশ্য হতে পারে।
কেট বললো–আচ্ছা, বাগচী, রাজকুমারের এখন বোধ হয় সাবালকত্ব হয়েছে। তাকে কখনোকখনো বিশেষ বিষণ্ণ দেখায়। এমন কি মনে হয় তোমার, তারাজোপাধি পেতে দেরি হওয়ার জন্য হতে পারে?
তখন তো লাঞ্চ। ভালো রান্না অনেকসময়েই মনকে সেদিকে নিয়ে যায়।
বাগচী তখন লাঞ্চের পরে বসবার ঘরে। পোশাক খোলা হয়নি, পায়ে জুতোর বদলে স্লিপার। হাতে আরামদায়ক পাইপ। একবার যেন অসংলগ্নভাবে তার মনে ওসুলিভান দেখা দিলো। তেমনি অসংলগ্নভাবে সে অনুভব করলো, কেট কিন্তু খুবই সাহসী। কিন্তু রান্নাঘরের। কাজ শেষ করে কেট এলো। হেসে হেসে বললো–পোশাক খুললে না, এখনই রোগী দেখতে যাচ্ছো নাকি?
বাগচী বললো–কে বলেছে? আজ আমার ছুটি নয়?
কেট গোপনে হেসে বললো–তাহলে কী ভাবছো এমন?
–আমাদের গ্রামে শুধু রাস্তা তৈরী হচ্ছে না। রাজবাড়ির সদর-দরজাটা নতুন করে করা হয়েছে। রাজবাড়িতেও নতুন কিছু করা হবে মনে হয়। মাপজোখ হতে দেখেছি। ওদিকে ফরাসডাঙায় নাকি একটা আধুনিক প্রাসাদ হবে।
কেট ভাবলো, এটাই বৈশিষ্ট্য, পরের সুখে সুখী হয়ে ওঠা। তার বাবা এটাকেই বাগচীর সবচাইতে আকর্ষণীয় গুণ বলতেন। প্রশ্রয়ের সুরে সে বললো–ও মা! কেন?
বাগচী বললো–সম্ভবত রানীমা থাকবেন।
-কেন?
-তোমার নিশ্চয়ই জানা আছে কেট, রাজরাজড়ার ঘরে নতুন রানী এলে পুরাতন রানী ভিন্ন প্রাসাদে চলে যান।
তার মানে? কেট দুএক মুহূর্ত সংবাদটা মনে মনে ওজন করলো। বললো, ও, আচ্ছা, তাহলে ঠিকই ধরেছি।
কী ধরেছো? কেট বললো–ঠকে গেলাম। একটু বুদ্ধি করলে সংবাদটা তো আমিই দিতে পারতাম তোমাকে।
এবার বাগচীই বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো–রাজকুমারের বিবাহের কথা আগেই শুনেছো নাকি কেট?
-শুনতে হবে কেন? চোখেই তো পড়ছে।
-চোখে? সেকী! তাহলে বিবাহের অন্যপক্ষকে তুমি-ও আচ্ছা, আচ্ছা। বাগচী আনন্দে হেসে উঠলো।
–কিন্তু…, কেটের ভ্রূ একটু কুঞ্চিত হলো, বয়স একটু বেশি হলো না?
বয়স? তুমি কার কথা বলছো? নয়নঠাকরুন কি?
–তাছাড়া আবার কে? কেট উজ্জ্বল মুখে বললো, তা অবশ্যই পুরুষের চোখে ধরা পড়ে । বরং সেই বাড়তিটা অনেকসময়ে বেশি টানে। পরে, দিন গেলে
বাগচী বললো–দ্যাখো, দ্যাখো, এ ব্যাপারে আমার একটা কথা মনে হচ্ছে। বেশি তো একটু বয়েস? বলবো? বলো তো আমাদের পরিচিত জানা পুরুষদের মধ্যে ভালোবাসাকে সবচাইতে বেশি কে জেনেছে? পারলে না তো! বলবো? শেক্সপীয়র। ঠিক বলিনি?
-এখানে শেক্সপীয়র কে হচ্ছে?
দ্যাখো ডারলিংশেক্সপীয়রের অ্যান্ কিন্তু তার চাইতে বছরদশেকের বড়ো ছিলেন। জানতে না তো! দ্যাখো।
আনন্দোজ্জল কেট বললো–কী সুন্দর হবে! কী সুন্দর মানায়! আর দুজনেই যে অমৃতসরসীতে ডুবে আছেন।
.
০৫.
কিন্তু আলোর কথা বলতে হলে বলতে হবে, সে তত শুধু লাল আর কমলা নয়। নীলাভ হয়, বিষণ্ণ বাদমী হয়।
সেদিন আবার শনিবার। প্রায় সপ্তাহ ফিরে এলো। অকালে বাদল হয়েছে। স্কুল ফেরত বাগচী ঘরে বসেছে। বোঝা যাচ্ছে, আজ রাজবাড়িতে যাবেনা। ইতিমধ্যে ঢিলে নাইট-গাউন পরে সে তার পড়বার ঘরে। আলো জ্বলছে সেজে। বিশেষ কোমল আলো। কফি নিয়ে কেট সেই ঘরেই বসেছিলো। দুজনের সংসারে বারবার দেখা হয়, বারবার গল্পও হয়। টিপয়টার উপরে সেজ, তার উপরে কফির ছোট্ট ট্রে-টা রাখা। সেজের গোড়ায় বাগচীর পাইপ পাউচ। পাইপের খানিকটা অ্যাম্বার, পাউচটা বাদামী। পাশের বইটার মলাট লাল। তাতে রূপালি রংও। রূপালী অক্ষরে লেখা ইন ইমিটেশন অব ক্রাইস্ট। কেট বইটাকে ভালোভাবেই চেনে। কেম্পিসের লেখা। বাগচী কতবার পড়েছে ঠিক নেই। সে নিজেও অন্তত বারদুয়েক। রঙের কথাই যদি, বাগচীর সেই ছোটো স্টাডি নামক ঘরে তার মুখোমুখি দেয়ালে এদেশের হাতে তৈরী কাগজে এদেশের এক চিত্রকরের আঁকা, এদেশের গেরুয়া মাটির রঙে আঁকা ছবিটার কথা বলতে হয়। কীবল দেখে বলেছিলো, খুব সরল করে আঁকা, এদেশের নমাজের ছবিনাকি? কেট বলতে বাধ্য হয়েছিলো প্রার্থনারত ক্রাইস্ট। কীবল কিন্তু এসব ব্যাপারে কৌতূহলী। বলেছিলো, তাকে কি প্রার্থনা করতে হতো? কিন্তু খুব লম্বা করে আঁকা নয়? কেট আবার বলতে বাধ্য হয়েছিলো, এটায় না জেনেও চিত্রকর এল গ্রেকো নামে একজনের স্টাইলে গেছেন।
তা, কফি খেতে খেতে বাগচী তার এবং কেটের মাঝের দু-হাত শূন্যটাকে বারবার দেখছিলো। আর কফির সেই অবসরেই ডিসিলভা ওসুলিভান সম্বন্ধে বলেছিলো। কেট একেবারেই অবাক হয়েছিলো শুনে।
এখন কেট রাতের খাওয়া তৈরীতে ব্যস্ত। সংসারের কাজে এঘর ওঘরও যাওয়া আসা করছে। একটু প্রসাধনও করছে সে আজকাল। সে শোবার ঘরের আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। যেন প্রসাধন কী করবে খুঁজতে লালের ছোঁয়া লাগা নিজের চাপা রঙের মুখটাকে, আর হাত ও বাহুকে দেখলো। জ্যাকেটের হুক খুলে গলার নিচে ক্যামিসোলের উপরে দুধসাদা ভি টাকে দেখলো। একটু সরে এসে দরজা দিয়ে যেমন সম্ভব শ্যামল রঙের বাগচীকে দেখলো দু-একবার।
একটু চঞ্চল হয়ে সে বাইরে এলো, যেন বাগচীর রংটাকে ভালো করে দেখতে। সে দেখলো বাগচী পড়ছে, লাল রঙে প্রমাণ তা সেই ক্রাইস্টের অনুসরণ;বসার ভঙ্গিটানমাজের কিন্তু। দু হাঁটু একত্র, গোড়ালির উপরে বসা। আচ্ছা! ঘন কালো চুলগুলো তো বেশ বড়ো হয়েছে। বাবরির মতো দুপাশে নেমেছে কান ঢেকে। না, পড়া নয় তো। মুখটা দ্যাখো ক্রাইস্টের ছবির দিকেই। একেবারে অবাক হয়ে গেলো কেট; বাগচীর দু-চোখের কোণ বেয়ে জল নেমেছে।
.
কিন্তু সেই শনিবারের সন্ধ্যার আগে তার দুপুর আর বিকেলের কথা বলা চাই। আর তাতে একরকমের সুবিধাও আছে।
এখানে ইতিহাসের উপাদানগুলো অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য। না আছে রাজকাহিনী, না আছে পাথরে বা তামার পাতে লেখা সন-তারিখের সাক্ষ্য। অন্যদিকে নিয়োগীর মতো যারা তারা যা কিছু করে, ভাবে, বলে, লিখে রাখে, পত্রিকায় ছাপায়; যেখানে তা সম্ভব নয় সেখানে তাদের ডায়েরিগুলো সরব। ফলে ইতিহাসের কথা বলামাত্র সেই সব বিবর্ণ পত্রপত্রিকাই সত্যের সাক্ষী হয়। মনে হতে থাকে পত্রপত্রিকা অনুসারে গোটা দেশটা ওঠাবসা করতো।
সে যাই হোক, সর্বরঞ্জনকুসুমপ্রসাদ একদিন নিজেকে মার্টাররূপে দেখতে পেলো। সে অবশ্য তার ডায়েরিতে এই বিদেশাগত শব্দটাকে উল্লেখ করেনি।
সে বুঝতে পেরেছে, সুরেন ও নরেশ কলকাতার মানুষ হওয়ায় নতুন ধর্মমত সম্বন্ধে আগ্রহী বটে, কিন্তু থিয়েটারেও আগ্রহী কম নয়। চরণ দাস জনান্তিকে বলেছে থিয়েটার শেষ হওয়ার পরে সে আবার নিয়মিত বাইবেল পড়বে, কিন্তু অভিনয় না করলেও বন্ধুদের এই ব্যাপারে প্রপ্ট তাকে করতেই হবে। দ্বিতীয়ত, সে বুঝতে পেরেছে এখানকার যে শিক্ষাব্যবস্থা হেডমাস্টারমশাই প্রবর্তন করছেন তা হবে অনিবার্যভাবে কলকাতার থেকে পৃথক। এক সপ্তাহের মধ্যে মৌখিক পরীক্ষার আদর্শ প্রশ্নপত্র হেডমাস্টারমশায়ের হাতে পৌঁছে দিতে হবে।
তৃতীয়ত রাজবাড়ির ব্যবস্থাপনায় শুধু যে ফরাসভাঙার শিবমন্দির ক্রমশ উলঙ্গ হয়ে আকাশকে স্পর্শ করতে চলেছে তাই নয়, রানীমার জন্মোৎসবও এসে গেলো, যার কেন্দ্রে কালীপূজা, যার আয়োজন, আবহাওয়ার মতো নিজের গৃহকোণে বসেও অনুভব করো।
এমনকী তার সাধ্বী স্ত্রী বলছিলেন, আমাদেরও তো নিমন্ত্রণ থাকে, ছেলেমেয়েরা তো এখনো নাবালক, আলো বাজি এসব দেখলে অথবা মিষ্টান্ন খেলে দোষ কী? সে তো প্রসাদ নয় শুনেছি।
অন্যদিকে কাল বিকেলে তাকে অবাক করে সুদৃশ্য এক প্রস্থ আসবাব তার বাসায় পাঠানো হয়েছে। হেডমাস্টারমশায়ের সঙ্গে আলাপে আসবাবের কথা উঠেছিলো বটে। একজন শিক্ষকের সুবিধার কথা মনে রাখা হয়েছে। চারিদিকের ঘোর কালোর মধ্যে এগুলি ঈশ্বরের কৃপালোক বলে অনুভূত হয়।
এরই ফলে সর্বরঞ্জনপ্রসাদের মনে একইকালে বেশ কিছু হতাশা এবং অল্প পরিমাণে উৎসাহ। সেই সকালেই সে অনুভব করলো তার এই পঁয়ত্রিশ বেড়ে বেড়ে পঁয়ষট্টিতে পৌঁছালেও তাকে হয়তো এই গ্রামে অল্প পরিমাণ উৎসাহ এবং সমধিক হতাশা নিয়ে চলতে হবে। না, না, এটা অনিবার্যই। কেননা যারা বি. এ. পাশ করেই হাকিম হতে পেরেছে তাদের মতো সৌভাগ্যবান সে নয়। ডেপুটি হওয়ার দিন গতপ্রায়। এমনকী বি.এ. পাশ করার পর সিম্পসন-স্যামসন অ্যাটর্নি কোম্পানিতে যে আর্টিকেল্ড ক্লার্ক হওয়ার কল্পনা ছিলো তাও অবাস্তব। কেননা ততদিনে তার সংসার কে চালায়? এই অবস্থায় ভাদুড়ীমশায় যখন এই চাকরি করে দিলেন তখন এটাকেই ঈশ্বরনির্দিষ্ট বলে মানতে হবে এরকম সম্ভাবনার কথা হেডমাস্টারমশায় বলেছেন। যাত্রার সময়ে সমাজবৃদ্ধরা সকলেই উচ্চকণ্ঠে তাকে আশীর্বাদ করেছে। সকলেই এক বাক্যে বলেছিলো : ইহাকে ঈশ্বরপ্রেরিত জ্ঞান করবে। মনে করো তোমার বদলে যদি পৌত্তলিক কারো এই চাকরি হতো? সে কি দেশের ওই অংশকে আরো অন্ধকারাচ্ছন্ন করতে সহায়তা করতো না? এখন তোমার আলোকে কত ছাত্ৰই না আলো জ্বালে!
কিন্তু প্রদীপের এই এক অনিবার্যতা-আলোর কেন্দ্রেই দাহ থাকে।
সুতরাং তার মনে দাহ ছিলো। আপাতত তা সুরেন নরেশ প্রভৃতির নাটকপ্রিয়তা, যার অন্য নাম তার চিন্তার পরাজয়, তাকে অবলম্বন করে তীব্র। এই অবস্থায় শনিবার সকালে স্কুলের জন্য পথে বেরিয়ে তার যেন অসংলগ্নভাবে মনে হলো, সেন্ট বার্থলোমিউ-এর ওরা জীবন্তে গায়ের চামড়া তুলে নিয়েছিলো, সেন্ট ফ্রান্সিসকে ওরা পাথর ছুঁড়ে মেরেছিলো। হে প্রভু, সুতরাং আমাকে দগ্ধ করো, কে না জানে খাদ পান না পুড়লে সোনা উজ্জ্বল হয় না, না পুড়লে আলো হয় না।
এসব চিন্তার ফলে তার মুখমণ্ডলে প্রশান্ত শান্তি, চোখে নিজের পরিবেশকে লক্ষ্য করার স্থির দৃষ্টি, কিন্তু অন্তরে আলোক বিকিরণ করার আগ্রহ, যাকে জ্বালার থেকে এককালে পৃথক করা যায় না। এইসময়ে পথের উপরে শ্বেতশুভ্র আলোর মতো কিছু একটা সে দেখতে পেলো। সে ভাবলো :এই আলোক, আশ্চর্য এই আলোক! এমনকী সে যখন আরো এগিয়ে গিয়ে এই আলোকের কথা ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করার কথা ভাবছে সে দেখতে পেলো সেটার উৎস একটা সাদা রঙের ছাতা। ছাতা যখন তার নিচে শিরোমণিমশায় অবশ্যই আছে। রাজবাড়ি থেকে প্রতি বৎসরের শেষে জলপূর্ণ তাম্ৰকলস ও এই ছত্র পেয়ে থাকেন। সর্বরঞ্জন মুখ লুকিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো, তাড়াতাড়ি স্কুলের দিকে চলতে শুরু করলো। এই শিরোমণি পদাধিকার বলে তার অধস্তন, কিন্তু যেমন ঠিক তিনদিন আগে, ঠিক তিন দিন, বলেছিলো, আলো জ্বালতে ব্রহ্মের যে এত বেকুবি, কেবল পোড়াচ্ছে আর দাহ করছে আপনাদের। ঠিক জানেন তো, সে ব্ৰহ্ম কিংবা খেস্ট? তখনই ঠিক করেছিলো সর্বরঞ্জন, সম্ভবপক্ষে শিরোমণির সঙ্গে ধর্ম সম্বন্ধে কথা বলবে না আর, যদিও শিরোমণির উপস্থিতিই যেন অবিরত তাকে তর্কে আহ্বান করে।
কিন্তু সর্বরঞ্জনপ্রসাদকে পথের পাশে ঝটিতে সরে দাঁড়াতে হলো। তিনটি ঘোড়া তীরের ফলার মতো বেগে আসছে; পুরোবর্তীটির একটু পিছনে রাস্তার দুপাশে দুটি। পুরোবর্তী সওয়ার নিতান্ত তরুণ, তার পোশাক ইউরোপীয়রাইডিং কোট ও ব্রিচেস, মাথায় বারান্দা টুপি, হাতে সুদৃশ্য ডাঁটযুক্ত চাবুক। রাজকুমার কি? শ্যামল দেখালো না অনেকটা? পিছনে সওয়ার দুটিকে চেনা মনে হলো। লাটসাহেবের সওয়ারদের পোশাকই যেন, পাগড়ির রঙে তফাত। তাদের দুজনের হাতে রূপার বল্লম। পাগড়ি দ্যাখো, গাঢ় নীলে রূপালি জরি। এমন একটা ব্যাপার যা ধ্যান ভাঙিয়ে দেয়। এত তাড়াতাড়ি গেলো, বোঝা গেলো না রাজকুমার কিনা।
সে অবশ্যই মুকুন্দ যে রানীমার কাছে দরবার শেষ করে কায়েতবাড়িতে তার মায়ের কাছে চলেছে। এই ছোট্ট রিশালাটা চলেছে অবশ্যই তার সম্মান রাখতে। রাজবাড়ির ছাদ আর ঝুলবারান্দা থেকে সদরের গেট পর্যন্ত যারা সেটিকে যেতে দেখলো তারা ভাবলো এই কুমার অবশ্যই অসাধারণ সম্মানের পাত্র, যদিও সে কায়েত।
তার এইদিন পড়ানোর কাজের চাইতে অফিসের কাজ বেশি। প্রয়োজন হলে সে সুতরাং কাজকে খানিকটা পিছিয়ে রেখে চিন্তার অবসর করে নিতে পারে। সে কিছুক্ষণ মুখ নিচু করে কাজ করলো; আর তা করতে করতে একবার চরণ, আর একবার শিরোমণিকে দেখতে পেলো। এই সময়ে তার মন এরকম বললো– :ঈশ্বরের সৈনিক, অগ্রসর হও। সে অনুপ্রেরণার জন্য মনকে আঘাত করতে লাগলো।
উৎসবই উৎসবের সমকক্ষ। না, না। সে স্থির করলে তাকে একটা উৎসব করতেই হবে। যা হবে প্রকৃত উৎসব; যেখানে বেদী থেকে পরম করুণাময় একমাত্র সেই নিরাকার ঈশ্বরের প্রার্থনা হবে। তার মনে পড়ে গেলো তার শেষ সন্তানের নামকরণ-উৎসব হয়নি। আর একটি শিশুকে সত্যধর্মে অভিষিক্ত করার চাইতে উৎসবের কী এমন ভালো সুযোগ হতে পারে? এবং এটাও দেখতে হবে যে সেই উৎসব শক্তির উৎসে যুক্ত হয়। ভাবো সেই রিশালার কথা! দেওয়ানজির সহায়তায় কি রাজকুমারও একদা সত্যধর্মে উৎসাহিত হন না?
সুতরাং সর্বরঞ্জন স্থির করলো : আজই, এখনই, স্কুল থেকেই সে দেওয়ানজির সঙ্গে দেখা করতে যাবে। না না, তাকে যেতেই হবে। প্রথমত আসবাবগুলির জন্য তাকে ধন্যবাদ দেওয়া যেতে পারে; দ্বিতীয়ত সে ভাদুড়ীমশায়ের চিঠি পেয়েছে গত সপ্তাহে তা জানানো যেতে পারে। ভাদুড়ীমশায় তার মুরুব্বি, তেমনি দেওয়ানজিরও বন্ধু; তাছাড়া থিয়েটার বলো, রাজবাড়ির উৎসব বলো, তিনি তো সর্বেসর্বা। আর ধর্ম ছাড়া তার উপায়ই বা কী? সে তো হাকিমও নয়, এমনকী আটিকেল্ড ক্লার্কও নয়।
দেওয়ান কুঠিতে যখন সে পৌঁছালো, হরদয়াল তার লাইব্রেরিতে। নিয়োগীর বেশ একটু অস্বস্তি বোধ হলো। একটি গৃহ যে এমন নিঃশব্দ হতে পারে তা তার অভিজ্ঞতায় ছিলো না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে কুঠির ভিতরের কোনো দেয়ালঘড়ির মৃদু টিক টিক সে শুনতে পেলো। কী করে সে খবর দেবে যে সে দেখা করতে এসেছে। অবশেষে একজন ভৃত্য। বেরিয়ে এসে তাকে ভিতরে নিয়ে গিয়ে লাইব্রেরিতে বসালো। তার জুতোজাড়া যে এক রকমের কিম্ভুত ফাপা, শব্দ করে শান্তির বিঘ্ন ঘটায় তা সে জানতো না।
ভৃত্য তাকে যে চেয়ারটায় বসিয়েছিলো সেখানে বসে লাইব্রেরি ঘরের এই ঠাসা সেলফগুলি, এখানে ওখানে ছড়ানো গাঢ় কালো রঙের সুদৃশ্য চেয়ারগুলো, ঘরের প্রায় কেন্দ্রে সুদৃশ্যতর সোফাসেট প্রভৃতি লক্ষ্য করতে করতে তার আর একবার মনে হলো, এভাবে আসা তার পক্ষে ভালো হয়নি। দুএক মুহূর্তে আলোটা চোখে ঠিক হলে সে যেন একটা সেলফের আড়ালে হরদয়ালকে খানিকটা দেখতে পেলো। আরো ভালো করে দেখতে গিয়ে সে লক্ষ্য করলো, সোফার সামনে টিপয়ের উপরে একটা চাপা রঙের তরলপূর্ণ বোতল, তার পাশে বড় করবী ফুলের মতো কিন্তু লম্বা বৃন্তের উপরে একটা গ্লাস। সেই বোতল ও গ্লাসের পাশে একখানা বই যার ভিতরে একটা সুদৃশ্য রূপার পেজকাটার। সে একটা মৃদু গোলাপী গন্ধ পাচ্ছে। তা কি ধূপের, অথবা মদের?
— দুএক মুহূর্তে হরদয়াল সেফের পাশ থেকে বেরিয়ে সোফার কাছে এগিয়ে বললো–এখানে আসুন। বসতে বসতে হরদয়াল হাসলো। আর সে হাসি যেন কোনো রমণীর হতে পারে এমন নরম এবং কুণ্ঠিত। বললো– সে–একার সংসার, বইগুলো সারা ঘরে ছড়ানো ছিলো, তাই তুলছিলাম।
সর্বরঞ্জন এক কঠিন সমস্যায় পড়লো। সোফায় বসতে বসতে সে অনুভব করলো, তার জিভটা শুকিয়ে উঠছে। এই তো মদ, যা ইতিপূর্বে ছবিতে মাত্র দেখেছে এবং যাকে সে দুশ্চরিত্রা রমণীর মতো কুহকী ও ঘৃণ্য মনে করে। সে কী করে এগুলোর উপর দিয়ে দেওয়ানজির মুখের দিকে চাইবে? সে মনে মনে ভাবলো : উনি হয়তো ক্রিশ্চান সন্তদের মতো, মদের পাশে বইটা অবশ্যই ধর্মগ্রন্থ হবে। সে আড়চোখে বইটার নামটা পড়লোওরিজিন অব স্পেসিস্। চার্লস ডারউইন নামে একজন লেখক। প্রকাশস্থল লন্ডন, ১৮৫৯।
কিন্তু হরদয়াল বললো–আপনার সব কুশল তো? আপনার কথা আমি প্রায়ই ভাবি। সাহিত্যের লোক আপনি। এখানে ছাত্রদের প্রাইমার পড়াতে আপনার অবশ্যই অসুবিধা হচ্ছে।
সর্বরঞ্জন নিয়োগী বললো–পরম করুণাময় ঈশ্বরের যদি তার এই কর্মশালাতেই আমাকে আহ্বান করার ইচ্ছা হয়ে থাকে, তবে সার, এখানে আনন্দিত হওয়াই আমার কর্তব্য।
উত্তর দিতে হরদয়ালের একটু দেরি হলো। সর্বরঞ্জনের সঙ্গে তার এটা দ্বিতীয়বার আলাপ হচ্ছে। প্রথমটা হয়েছিলো এক বৎসর আগে চাকরিতে বহাল করার ইন্টারভিউ-এ। তখন নিয়োগীর ইংরেজিটা ক্রিস্পই বোধ হয়েছিলো। সর্বরঞ্জনের এই বিশেষ ধরনের বাংলা তাকে পুরোপুরি স্তম্ভিত করতে পারলো না, কেননা কলকাতায় তার। বন্ধু ভাদুড়ীমশায়ের চারপাশে এরকম বাংলাই শোনা যায়। সে বললো–তবে তো কথাই নেই। আপনার পরিবারের সকলের স্বাস্থ্য ভালো থাকছে তো? যে কারণেই হোক এ অঞ্চলটায় ম্যালেরিয়ার উৎপাতটা কম।
নিয়োগীআবার বললো–এবিষয়েও তারই মঙ্গলময় বিধান দেখতে পাই। সে সুন্দর করে হাসলো, অবশ্যই তার প্রচুর শ্মশ্রুজালের আবরণের বাইরে তা যতটা প্রকাশ হতে পারে।
হরদয়াল বললো–আগে করা যায়নি, এবার আপনাদের কোয়ার্টারগুলোকে বড়ো করে দেবো।
হরদয়াল তার মুখের দিকে চেয়ে কথা বলছে, কিন্তু তার দৃষ্টিটা বোতলের পাশে রাখা বইটার উপরেও পড়লো, আর তা যেন সস্নেহ। মদ ঢালতে কখন এক ফোঁটা কী করে মলাটে পড়ে থাকবে। হরদয়াল তা হঠাৎ দেখতে পেয়ে কোঁচার খোঁট তুলে বিন্দুটাকে মুছে নিলো।
কিন্তু আলাপটা গতি নিতে পারছে না। হরদয়াল তো শুনতেই প্রস্তুত কিন্তু নিয়োগী অনুভব করলো এখানে বাগচীর সঙ্গে সে উপরওয়ালা হলেও, কলকাতার সমাজনেতাদের সঙ্গে, এমনকী সেখানকার ধনী মানুষদের সঙ্গে যেভাবে কথা বলা যায় এই স্থির মানুষটির সঙ্গে তার এই নিঃশব্দ লাইব্রেরিতে বসে সেভাবে কথা বলা যায় না। তার একবার মনে। হলো সে শিক্ষক, বই সম্বন্ধে কথা বলতে পারলে সুবিধা হতো। কিন্তু এই যে একখানা বই যা ১৮৫৯-এ প্রকাশিত এবং ইতিমধ্যে এখানে, তার সম্বন্ধে কি কিছুমাত্র বলার সুবিধা হচ্ছে? ওরিজিন অব স্পেসিস বাক্যাংশটার অর্থই বা কী? লেখক এই চার্লস ডারউইনবা কে? এ রকম কোনো কবির বা ঔপন্যাসিকের নাম সে কলকাতায় শোনেনি। অথচ এই নিস্তব্ধ লাইব্রেরিতে ঘড়ি টিক টিক শব্দে সময়টা দ্রুত চলে যাচ্ছে, অপব্যয়ই হচ্ছে, এবং সময়টা হরদয়ালের।
সুতরাং নিয়োগী তার মাথাটাকে কয়েকবার উঁচুনিচু করলো। অবশেষে বললো–সার, আজ যে আপনার মহামূল্যবান সময়ের খানিকটা এই যে অপব্যয় করতে উদ্যত হয়েছি, এই যে আপনার বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটিয়ে চলেছি, এসবেরই একটা উদ্দেশ্য আছে।
বলুন।
-এখানে একটি পরম করুণাময় সেই এক এবং অদ্বিতীয় ঈশ্বরের উপাসনা মন্দির হলে কি ভালো হয় না?
হরদয়াল বললো–উপাসনার ব্যাপার মিস্টার বাগচী সব চাইতে ভালো বোঝেন।
বাগচী বললো–আমি নবতর কোনো সংগঠনের কথা ভাবছিলাম, সার।
-সেটা কী ব্যাপার হচ্ছে?
সর্বরঞ্জন ক্রমশ তার চিন্তাগুলোকে গুছিয়ে নিলো। বললো–বিষয়টা আনন্দজনক নয়, সার, তা আমাকে বলতেই হবে। না, না, তা না বলে উপায় নেই। কিন্তু ঈশ্বর নিরানন্দের মধ্যেও নিজেকে প্রকাশ করেন, এই তার অভিরুচি। আর এ তো আত্মসমালোচনাও বটে। ব্রাহ্মদের অর্থাৎ যারা পরম ব্রহ্মের উপাসনা করি তাদের কাছে কি কে শুদ্র কে ব্রাহ্মণ এ বিচার থাকা উচিত? অথচ আমাদের পুরোধা কারো কারো প্রার্থনাবেদীতে ব্রাহ্মণেতর কাউকে বসতে দিতে আপত্তি, এখনো কেউ কেউ উপবীতকে আঁকড়ে ধরে আছেন। এ বিষয়ে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়।
খানিকটা বাধা দেয়ার মতো করে হরদয়াল বললো, দেবেন্দ্র ঠাকুর মশায় কলকাতার লোক, যদিও নানা অঞ্চলে তাদের জমিদারি আছে; কিন্তু তাঁর বিষয়ে আমাদের এখানে করণীয় কিছু আছে কি? এ অঞ্চলটা তার জমিদারিতে পড়ে না।
আবেগের প্রাবল্যে নিয়োগীর মাথাটা দুলে উঠলো। বললো– সে,না,না, সার, এ আমাকে বলতেই হবে। এই গ্রামে গোড়া থেকেই সবদিকে বাঁধ দিয়ে অগ্রসর হওয়া কি ভালো নয়? এমন মন্দির হওয়া উচিত যার সংবিধান বলে আচার্য হিসাবে যে কোনো সম্প্রদায়ের লোকই উপাসনায় নেতৃত্ব দেবে।
হরদয়ালের মুখে সূক্ষ্ম একটা হাসি দেখা দিলো। গতবার কলকাতায় এসব ব্যাপারে সে কিছু কিছু শুনেছিলো বটে। এমনকী তার বন্ধু ভাদুড়ীমশায়ের চারিদিকেও এ বিষয়ে উত্তেজনা ছিলো। কৌতূহলের অভাবে তা সে ভুলে গিয়েছিলো। এখন মনে পড়লো এই স্ববিরোধে কেশব সেন মশায়ের নামও শোনা যাচ্ছিলো। হরদয়াল বললো, কিন্তু এখানে তো আপনি মাত্র একা। এখানে কে আর আপনার বিরুদ্ধতা করছে? আপনাদের শুনেছি। উপনিষদ নিয়ে ব্যাপার। আপনার ব্যাখ্যার সঙ্গে এ অঞ্চলে বিরুদ্ধ মত মাত্র একজনেরই হতে পারে। তিনি শিরোমণি। তাঁকে ধর্তব্যের মধ্যে আনছি না, কারণ তিনি নিজে যেচে অনধিকারীকে উপনিষদ সম্বন্ধে কিছু বলেন না।
না, না, সার, একথা আমাকে আবার করে বলতে হবে, সার। মন্দির হওয়ার আগে থেকেই আমরা প্রার্থনাসভা করতে পারি। আর সে প্রার্থনাসভায় আপনাকেই প্রধান ও পরম পূজনীয় আচার্যরূপে পেতে ইচ্ছা করি। আর একাই বা কেন? আমার পরিবারে সাতজন তো রয়েছি।
হরদয়ালের হাসি পেলো। সর্বরঞ্জনের পরিবারের সাতজনে দু-তিন বছরের শিশু গুটি দুয়েক। কিন্তু বাড়িতে যে দেখা করতে এসেছে তাকে পরিহাস করা যায় না। সে বরং আবার শান্ত দৃষ্টিতে সর্বরঞ্জনের দিকে চাইলো। এত বিস্তৃত সে দৃষ্টি যে নিয়োগী লক্ষ্য করতে পারলো সেই চোখের প্রান্তগুলি বেশ লাল।
হরদয়াল বললো–এটা এমন সময় যে কী দিয়ে আপনার পরিচর্যা হয় বুঝি না। তাছাড়া আমার তো চাকরবাবুর্চির সংসার। আপনাকে কি কিছু পানীয় অফার করতে পারি? কী পছন্দ করেন? এটা বার্গান্ডিই, যদিও রংটা গাঢ়।
এই বলে সে বোতলের দিকে হাত বাড়ালো।
সর্বরঞ্জন জীবনে এমন বিপন্ন হয়েছে কিনা সন্দেহ। যা উপস্থাপিত হলে ডানকান সাগ্রহে অগ্রসর হয়। পিয়েত্রো যার অনুপস্থিতি অসম্মানজনক মনে করতো, এমনকী বাগচী যার কথায় হয়তো হেসে বলতো লুব্ধ হচ্ছি, সন্ধ্যায় আসবো; সর্বরঞ্জনকে তা একেবারে নির্বাক করে দিলো। সে কি উঠে দাঁড়িয়ে স্থান ত্যাগ করতে পারে? সে কি মদ্য সম্বন্ধে তার ঘৃণা প্রকাশ করতে পারে এই মানুষটির সম্মুখে?
কিন্তু মুহূর্তটি নির্বিঘ্নে পার হলো। এমন হয় যে কোনো বিষয় কোনো বিশেষ অঞ্চলের অনেক মানুষের চিন্তাকে প্রভাবিত করে। হরদয়ালের চিন্তাকে আজ সকাল থেকেই গৌরীদের নাট্যাভিনয় ব্যস্ত রেখেছিলো। সে বললো–মিস্টার নিয়োগী, বাগচীমশায় আপনার সাহিত্যজ্ঞানের বিশেষ প্রশংসা করে থাকেন। আপনি কিন্তু গ্রামের যুবকদের বিশেষ এক উপকার করতে পারেন।
অন্য আলাপে যেতে পেরে যেন নিঃশ্বাস নিতে পারলো নিয়োগী। সে সাগ্রহে বললো– কীভাবে, সার? সাধ্য হলে নিশ্চয়ই করবো।
হরদয়াল বললো–গ্রামের যুবকদের একাংশ হঠাৎ অভিনয় করতে উদ্যত হয়েছে। কিন্তু ভালোনাটক কই? বুড়ো শালিখআর একেই কি বলে এবার করতে চাইছে। আমার কাছে ভালো লাগেনি।
সর্বরঞ্জন ক্রমশ অনুভব করলো সে নাচাইতে সমস্যাটার কথা উঠে পড়লো। এটায় কি সে আশ্চর্য হবে? কিংবা দ্যাখো সপ্ৰয়াস কীভাবে ঈশ্বরের অনুগ্রহ লাভ করে। দ্যাখো এবার দেওয়ানজির মতের সঙ্গে তার মত মিলছে। সে ইতিমধ্যে চরণ দাসদের আড্ডায় একবার অন্তত রিহার্শালে গিয়ে পড়েছিলো, ফলে নাটক যে কত কুৎসিত সে বিষয়ে তার সংশয় ছিলো না। সুতরাং সে একটু সাহস করে বললো–ভালোলাগার কথাও নয়, সার। যদি অনুমতি দেন, বলবো তা জঘন্য। আমার তো মনে হয় রাজবাড়ির কোথাও এরকম নাটকের অভিনয় হওয়া উচিত হয় না।
হরদয়াল ভাবলো সেটা খুব বড় সমস্যা নয়, রানীমা আদৌ নাটক দেখতে আসবেন । রাজকুমার যদি আসেও নাটকে যেসব পুরুষের কথা বলা হয়েছে তারা এত নিম্নবিত্ত শ্রেণীর যে তাদের সস্তা দুশ্চরিত্রতাকে তার কাছে ভাঁড়ের ভাড়ামি মনে হবে। সে বললো–আপনি কি শেকপীয়রের দু-একটা কমেডি অনুবাদ করে দিতে পারেন? কী হবে বলছেন? মানুষ নাটক করতে চায়, কিন্তু ভালো নাটকই নেই।
-হয়তো তা করা যায়, কিন্তু
আমি তাও ভেবেছি। সেকষ্পীয়রের কাব্যগুণ অনুবাদে ধরা যায় না। আমার মনে হয় শেরিডান অথবা কংগ্রিবের নাটক অনুবাদ করা তার তুলনায় সহজ হবে।
সর্বরঞ্জন এক সমস্যা থেকে উঠতে গিয়ে যেন অন্য সমস্যায় ডুবে যাচ্ছে এরকম বোধ করলো। বুড়ো শালিক কুৎসিত-দেওয়ানজির সঙ্গে এই পর্যন্ত তার মত মেলায় সে উৎসাহিত হয়েছিলো, এখন সে তো এক চোরাবালিতে তলিয়ে যাচ্ছে। কংগ্রিব! সে তো ব্ল্যাকগার্ডদের সম্বন্ধে ব্ল্যাকগার্ডদের জন্য এক ব্ল্যাকগার্ডের লেখা। সে কি চূড়ান্ত নির্লজ্জ আদিরসের কথা নয়?
সে কিছুই বলতে পারলো না। সে অনুভব করলো এই অবস্থায় এই ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলেই মাত্র তার মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। কলকাতার কারো বৈঠকখানা হলে তা সে অবশ্যই করতো। কিন্তু এখানে দেওয়ানজি হরদয়ালের ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া যায় না, কেননা প্রকৃতপক্ষে এই লাইব্রেরি ঘরের বাইরে যে রাজপথ, যে স্কুল, শিক্ষকদের আবাসিক বাড়ি, এবং তারও পরে গ্রামের পরে গ্রাম, কতদূর কে জানে, সবই দেওয়ানজির বৈঠকখানা।
সাক্ষাৎ শেষ হয়েছে অথচ বিদায় নেয়ার ঠিক কথাটা ভেবে ওঠা যাচ্ছে না বলে বসে আছে এমন অবস্থাই যেন তার। এই সময়ে ঘড়িতে কোন এক আধঘণ্টা সূচনা করলো। পদার কাছে হরদয়ালের ভৃত্যের সাড়া পাওয়া গেলো। সে যেন গোসলখানায় জল দেয়া হয়েছে একরম বললো।
নিয়োগী বললো–আপনার স্নানাহার? আপনার স্নানাহারের সময় হলো?
হরদয়াল বললো–সে হবে। আপনি কংগ্রিব অথবা শেরিডান অনুবাদ করা ভেবে দেখুন।
হরদয়াল উঠে দাঁড়ালো। নিয়োগী যেন কিছু লজ্জিতভাবে নমস্কার জানিয়ে বেরিয়ে পড়লো।
ভৃত্য পর্দার এপারে এসে বললো– রান্না শেষ হলো।
তখন চিন্তার সময় নয়। তাহলেও চলো তবে বলে ভৃত্যের পিছন পিছন যেতে যেতে হরদয়াল চিন্তা করলো, আমাদের এই নতুন মাস্টারমশায়ের মনে ধর্মাভাব যত প্রবল সাহিত্যপ্রীতি কি ততটা প্রবল নয়? ধর্মের ভাব কিন্তু এখন প্রবল হচ্ছে কলকাতাতেও। একে কি ইংরেজি শিক্ষার ফল বলবে? তাহলে ও-জাতটাকেই ধার্মিক বলতে হয়।
পথে বেরিয়ে সর্বরঞ্জনও ভাবছিলো, তাহলে এতদিন যা ভেবে এসেছে তা কি সবই ভুল? তাহলে মেট্রোপলিটানের ভাদুড়ীমশাই তাঁর বন্ধুকে চেনেন কি? ভাবো দুপুরের স্নানাহারের আগে ওই মদ্যপান। না, না, এ কখনোই গোপন করা যায় না তিনি মদ্যাসক্ত। এবং ঈশ্বরেও বিশ্বাস আছে কি? ভাবো শিরোমণিকে, উপনিষদ-অভিজ্ঞ ভাবেন! অথচ ইংরেজিনবিশ সে বিষয়ে সন্দেহ কী? গায়ের সেটা অবশ্যই ড্রেসিংগাউন, কত দাম কে বলবে? সে হঠাৎ আবিষ্কার করলো। তাহলে দেওয়ানজি ডিরোজিও ধারার মানুষ, নিরীশ্বর, দুর্বিনীত, মদ্যপায়ী আধুনিকদের একজন যারা নষ্ট স্ত্রীলোক সংসর্গে সঙ্কুচিত নয়? না, না, একথা আমাকে বলতেই হবে দেওয়ানজি সেই প্রজন্মের মানুষ একসময়ে ভয়ঙ্কর রকমে আধুনিক ছিলো, কিন্তু এখন কলকাতার চোখে আর আধুনিক নয়। না, আধুনিক নয়।
হরদয়ালও ভাবছিলো। সে ভাবলো, এদিকে লক্ষ্য করো। এই চার্লস ডারউইনকে যদি বিশ্বাস করো তবে এই লাল কাপড়ের মলাটের বইটা এখন একখানা ইট যার আঘাতে অনেক গির্জার অনেক কাঁচ ঝনঝন করে ভেঙে পড়ে। যদি এঁকে বিশ্বাস করো ওটা আর বিশ্বাস করতে পারো না যে ঈশ্বর মানুষকে হাজার পাঁচেক বছর আগে নিজের আকারে সৃষ্টি করেছিলেন। একটা চাপা হাসি হরদয়ালের চাঁপা ঠোঁটে জড়িয়ে গেলো। অবশ্য ওদের কথা, হয়তো প্রমাণ করবে ডারউইন ঠিকই বলেছেন তবে তা লাল আর কালো মানুষ সম্বন্ধে। ঈশ্বর বেশ ব্লোন্ড এবং নর্ডিক, আর সেরকম মানুষ সৃষ্টির কথাই বাইবেলে আছে।
.
০৬.
স্কুলে পৌঁছে সর্বরঞ্জন নিজের আবিষ্কার নিয়ে নিতান্ত গম্ভীর হয়ে রইলো। সে কি আর কখনো দেওয়ানজির কাছে সাহায্য আশা করতে পারে? স্কুল ভাঙার আগে তার দুটো ক্লাস ছিলো, একটাতেও সে মন দিয়ে পড়াতে পারলো না।
সে শিক্ষকদের বসবার ঘরে গিয়ে একবার মনে করলো পরীক্ষার যে-প্রশ্নপত্র আগামী সপ্তাহে দিতে হবে সেগুলোকে আর একবার দেখে দিলে হয়। কিন্তু উৎসাহটা তৈলহীন প্রদীপের মতো নিস্তেজ। সে তখন দেরাজ থেকে একখানা খেরো বাঁধানো খাতা বার করলো। এটা তার একরকমের ডায়েরি। ক্লাসে কী পড়ানো হলো কী পড়ানো উচিত এসব যেমন থাকে, তেমনি লেখা থাকে তার নানা সময়ের চিন্তা। এটা অবশ্যই তার সেই ডায়েরি নয় যা সে বাড়িতে প্রত্যহ সন্ধ্যার উপাসনার পরে লেখে। বরং এই দুই নম্বর ডায়েরিতে যা সব থাকে তার কিছু কিছু পরিমার্জিত হয়ে বাড়ির এক নম্বর ডায়েরিতে স্থান পায়।
দুনম্বর ডায়েরি লিখতে সর্বরঞ্জন দেখলো গোলটেবিলটার একপ্রান্তে শিরোমণি এসে বসলো। কিছুপরে তার থেকে দুএকখানা চেয়ার বাদ দিয়ে চরণদাস বসলো এসে। সে একটা বাঁধানো খাতায় লাল কালো কালিতে রুল টানতে শুরু করলো। নতুন বছরের অ্যাটেন্ড্যান্স রেজিস্টার হবে।
চরণ দাসের পরনে বেঁটে আচকান জাতীয় পিরহান, পাকানো চাদর কোমর ঘিরে বুকে ক্রশ করে দুই কাঁধে। শিরোমণির গায়ে খাটো ঝুলের খাটো হাতার পাশে ডোরে বাঁধা মেরজাই, চাদরটা গলার দুপাশ দিয়ে ঝুলছে। গলার কাছে মোটা পৈতের গোছা। কিন্তু সব চাইতে দর্শনীয় তার অর্ধেকের বেশি কামানো মাথায় সাদা ধবধবে টিকির গোছাটা।
হয়তো নিঃসঙ্গতাবোধ নিয়োগীকে এত পীড়িত করছিলো যে নিজের অজ্ঞাতসারে তার মন তালাশের সুযোগ খুঁজছিলো। সে বললো–চরণদাসবাবু এখনই আগামী বছরের কাজ সেরে রাখছো? নাকি এটাও থিয়েটার সম্বন্ধে কিছু।
চরণ দাস মুখ না তুলে বললো, আগেকারটাই ঠিক। সে হাসলো। ইতিপূর্বেই থিয়েটার সম্বন্ধে নিয়োগীর সঙ্গে কিছু তর্ক হয়েছে।
সর্বরঞ্জন বললো, ভয় নেই তোমাদের। এখানে এই গ্রামে তোমাদের থিয়েটারকে কেউ নিন্দা করবে না। থিয়েটার নিয়ে আলোচনার ফলে দেখা যাচ্ছে শিরোমণিও শব্দটির সঙ্গে পরিচিত। সে বললো–তা কি বলা যায়? থিয়াটার বা অভিনয় যাই বলুন, ভালো না হলে নিন্দা হবেই।
চরণ বললো–উনি বোধ হয় অন্য অর্থে বলছেন।
-কথাটা ঠিক ধরেছো। বললো– সর্বরঞ্জন। কিন্তু তারপরে সে নির্বাক হয়ে গেলো। সে কি কখনোই প্রকাশ্যে বলতে পারে দেওয়ানজি হরদয়াল থিয়েটার নাটক সম্বন্ধে কী জাতীয় নিন্দনীয় মত পোষণ করেন? সে কি এইমাত্র ডায়েরিতে যা লিখেছিলো সেই আশঙ্কার কথা বলবে? যে অতি শীঘ্রই এই নাটকের প্রশ্রয়ে ড্রপওয়ালী, খেমটাওয়ালী, সাধারণভাবে নষ্টা স্ত্রীলোক অভিনয়ের সুযোগে কীভাবে প্রকাশ্যে বহুলোকের চোখের সামনে ক্রমশ আদরণীয় হয়তো দেবীরূপে কথিতা হবে।
সে মৃদু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, মুশকিল কী জানো, চরণ দাসবাবু, মানুষকে দেখে দেখে যে ধারণা করো আর তার প্রকৃত ব্যবহারে অনেক তফাত। এবারেও নিয়োগীর মনে দ্বিধা দেখা দিলো। সে কি বলতে পারে হরদয়ালের ব্যবহার তাকে আজ কীরকম আঘাত দিয়েছে। সে বললো, জানো খিদিরপুরে এক মিত্তিরজা আছে যিনি নতুন সত্যধর্মকে আলিঙ্গন করেছেন। কিন্তু তা করার আগে নিজেদের গৃহবিগ্রহ গোপীনাথ প্রভৃতিকে এক মন্দিরে দিয়ে এসেছেন। যাতে সেই অবস্থাতেও পূজা হয় সেজন্য সে মন্দিরকে আট-দশ বিঘা জমিও কিনে দিয়েছেন।
শিরোমণি বললো–কৌতুকের ব্যাপার তো। বিবেকের সঙ্গে রফা?
-আমার কিন্তু মশায় তা নেই। মিথ্যা মিথ্যাই। আমাদের নারায়ণশিলা বিগ্রহ ছিলো চরণ বললো–তা বুঝি গঙ্গায় দিয়েছেন?
রস, রসো, চরণদাস, শিরোমণি বললো, গঙ্গায় দেয়া তো হিঁদুআনিই হলো।
নিয়োগী বললো–আপনি যদি দয়া করে আমার বাসায় যান, দেখতে পাবেন সে শিলা আমার টেবিলে কাগজ চাপার কাজ করছে। আমি চাই আমার পুত্রেরা তাকে নুড়ি বলে জানুক। সে বললো– আবার, না না, আমাকে বলতেই হবে, আজ পর্যন্ত সেই পাথর থেকে নূপুরের শব্দও শুনিনি, বাঁশিও বাজে না। এই বলে সে হাসলো মৃদু মৃদু।
শিরোমণি তাতে প্রচণ্ড শব্দে হা হা করে হেসে উঠলো, বললো–এখানেই চিন্তার ত্রুটি। যাকে নুড়ি জ্ঞান করলেন তার আবার নূপুর অথবা বাঁশি কী? এ যে পরম ব্রহ্মের দয়াময় হওয়ার মতোই।
চরণদাস বললো, আপনি বলছেন নুড়ি ভাবলে তা নুড়ি হয়?
-তাই তো হয়ে থাকে, শিরোমণি বললো, তোমার আমার কাছে যা রক্তে বসায় মাখানো আড়াকাঠ, কারো কারো কাছে তা আবার পূজনীয় অবতারের প্রতীক। হয়তো নিয়োগীমশায়ও এমন একখানা কাঠ দেখলে যুক্তকর অন্তত বুক পর্যন্ত ওঠান।
সর্বরঞ্জনের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো। তার মুখে যে শক্ত শক্ত শব্দগুলো আসছে সেগুলো আয়ত্তে রাখা কঠিন হচ্ছে। সে বললো–সত্যি গোপন করা আমার অভ্যাস নয়। স্বীকার করি আপনি যাকে আড়াকাঠ বলছেন সেই ক্রুশ দেখলে যুক্ত করে শ্রদ্ধা জানালে লজ্জার কিছু দেখি না। আপনি ইংরেজি জানলে আপনাকে কেশব সেন মশায়ের বক্তৃতা পড়তে দিতাম। দেখতেন বড়ো বড়ো ইংরেজরাও কেন তাকে প্রশংসা করছে। না, না, একথা আমাকে বলতেই হবে, আমাদের এই দেশে এমন প্রতীকও পূজা করা হয়, যা স্বীকার করতেই হবে, যে কোনো ভদ্ৰব্যক্তিকে লজ্জিত করে। তার তুলনায় ক্ৰশ?
চরণ জিজ্ঞাসা করলো নিয়োগীমশায় ওলাবিবি, শীতলা ঠাকুরানীর কথা বলছে কিনা।
নিয়োগী বললো–আমি তোমাদের দেবতার দেবতা। মহাদেবের কথা বলছি।
কোনো কোনো কথা একটা আলগা আলগা ধরনের আলাপকে যেন বিদ্যুতের আঘাতে সজীব করে তোলে। এই ক্লাসটা শেষ হলে শনিবারের ছুটির ঘণ্টা পড়বে। শিরোমণির তখন গৃহে ফেরার কথাই মনে হচ্ছে। টেবিলের উপরে তার হাতের কাছে স্কাইলাইট থেকে রোদ এসে পড়ছে। শিরাবহুল বৃদ্ধ হাত দুটিরও যেন রোদ পোহানোর ভঙ্গি।
চরণ বললো–সে তো এক থাবা কাদা কিংবা একটুকরো পাথর । লজ্জার কী?
–কিন্তু আকৃতি? বিশেষ করে এই গ্রামে–সর্বরঞ্জনপ্রসাদ জুগুল্পিত বোধ করে থেমে– গেলো।
শিরোমণি বললো–অ। তা বিশেষ করে এই গ্রামে কেন?
নতুবা শিবলিঙ্গের গোড়ায় কারো বুকের রক্ত দেয়া হয়?
–তাকেও যৌনতাগন্ধী বলছেন? শিরোমণি হাসলো যেন।
–আপনি ব্রাহ্মণ, স্বীকার করবেন শিবপূজায় রক্তচন্দন অবিধেয়। রানীমা সম্বন্ধে আপনি যে কথা বললেন এই গ্রামে বসে আমি সেকথা মুখে আনতে চাই না।
–অর্থাৎ চিন্তা গোপন করছেন? শিরোমণি হাসলো আবার!
–তাহলে শুনতে চান? ওকে আমি পশুত্ব পূজা বলি।
শিরোমণির কৃশ শরীরে অনেক শিরাই প্রকাশমান। কপালের ঠিক মাঝখানে একটা শিরা যেন রক্তের চাপে দপদপ করছে। হঠাৎ সে ঠা-ঠা করে হেসে উঠলো। সে বললো–খুব বলেছেন। আমি শুনেছি সাহেবদের শিশুরা রুমালে বাঁধা অবস্থায় সারস দ্বারা নীত হয়। আপনি বাঙালি, আপনাদেরও তা হয় কিনা জানি না। ভেবে দেখুন নিজের জন্ম, নিজের সন্তানের জন্ম পাপপঙ্কে পশুত্বের ফলে কিনা। আমরা স্বর্গদ্বার থেকে ভূমিষ্ঠ হই কিন্তু। যদি বলেন একবারই জন্মানোর সুযোগ পেয়েছি, এ জন্ম সার্থক, তবে সেই সার্থকতার উৎস, জীবনের সবটুকু আনন্দের উৎস, মাতৃযোনির মতো কি এমন পবিত্র, মশাই?
-ছি-ছি-ছি, এসব আপনি কী বলছেন। নিয়োগী দুহাতের তর্জনীদুকানে খানিকটা করে। ঢুকিয়ে দিলো।
শিরোমণি বললো–মস্তিষ্কের সাহায্যে ব্যাপারটাকে বিবেচনা করুন। পবিত্রতার বোধ বদলাবে। রক্ত মাখানো কাঠ, যা মৃত্যু, বেদনা, প্রতিহিংসার কথা মনে আনতে পারে, তা যদি আপনারা সামনে রাখতে পারেন, তাহলে আমরা যদি আনন্দ ও জন্মের প্রতীককে সামনে রাখি তাতেই কি দোষ?
ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজলো। ছুটির ঘণ্টা শুনে সেই হলের বাইরে ছেলের দল হৈ হৈ করে বেরোচ্ছে! শিরোমণি উঠে দাঁড়ালো। বললো–নমস্কার মশায়। বুড়োর কথায় দোষ নেবেন না। আজ মাছি, কাল নেই।
কিন্তু সেদিন ভবিতব্য অন্যপ্রকার ছিলো। ভিতরের দিকের এই হলে বসে বাইরে গুঁড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে তা বোঝা যায়নি। বাতাসও ছিলো। শিরোমণি হলের দরজা পর্যন্ত গিয়ে ভিজে বাতাসের ঝাপটা খেয়ে পিছিয়ে এলো। টেবলের কাছে এসে বললো–খুব ধমক খেলাম হে চরণ, জল হচ্ছে।
চরণ বললো–তাড়া কী? বসুন।
নিয়োগীর বোধ হয় এমন স্পষ্ট, তার কাছে যা নির্লজ্জ, কথা শোনার অভ্যাস ছিলো না। সে কথা খুঁজে পাচ্ছিলো না। শিরোমণিকে ফিরে চেয়ারে বসতে দেখে সে বেশ তিক্তস্বরে বললো–আপনার এই অনুভূতিগুলিকে আমি নিতান্ত নিম্নস্তরের মনে করি। এ কথাটা আপনাকে জানানো খার।
শিরোমণি বললে–আপনি ঠিকই বলেছেন। এগুলো সেই স্তরের কথাই যখন মানুষ শিবলিঙ্গে জগৎ পিতাবৌকে দেখতে পাচ্ছে না, দেখতে পাচ্ছে না তাদের স্নেহ ঢল ঢল মুখ। হ্যাঁ হে চরণ, তুমি বাইবেল পড়ো শুনি, কালিদাস পড়েছে?
নিয়োগী বললো–আমি পড়েছি, আমাকে বলুন। কৈশোরে সে দুর্ভাগ্য হয়েছিলো আমার। কালিদাস শৈব ছিলেন, এই বলবেন তো? তাতে কিছু প্রমাণ হয় না।
শিরোমণি বললো–প্রমাণ নয়, তুলনা। আপনি হয়তো শকুন্তলমও পড়েছেন। প্রথমে শিবকে প্রণাম শেষে ভরতবাক্যেও তাই, মাঝখানে কামজ মিলন থেকে আর এক কুমারসম্ভবের পবিত্রতায় পৌঁছানো। এই এক ব্যাখ্যা হয় যে মানুষ কামজ অস্তিত্ব থেকে শিবত্বে পৌঁছাতে পারে। আদিরসকে বাদ দিয়ে নয়, তাকে দেবত্বের সার্থকতায় চালিত করেই কাব্য হয়। যদিও আপনারা ভাবেন ভগবান আদিম মানুষকে কোন এক উদ্যান থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন, এ পতন হয়নি, বরং পশুত্ব থেকে ঊর্ধ্বে চলেছে মানুষ। কিছু উন্নতি হয়েছে।
সর্বরঞ্জন বললো–থাক থাক। এতেও আপনার শিশ্নপূজার সমর্থন হয় না। সে উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ালো।
শিরোমণি স্মিত হাস্যে বললো–হয়। যতক্ষণ না তাকে জগৎপিতা যোগীশ্বর বলে বোধ হয়, জন্ম জীবন মৃত্যুর হেতু বলে মনে হয়, ততক্ষণ না হয় নিজের প্রাণশক্তির প্রতীকরূপে পূজা করুক।
শিরোমণি অভ্যাসবশে শিখায় হাত রাখলো, যেন সেটাকে বাঁধবে ফুল দিয়ে, কিন্তু আচমকা অন্যদিকে গেলো ঘটনার গতি। কে যেন জিজ্ঞাসা করলো–আপনি কি শৈব, শিরোমণিমশায়?
শিরোমণি পিছন ফিরে দেখলো, তার চেয়ারের পিছনেই বাগচী, এবং তার কাছাকাছি অন্যান্য শিক্ষকরাও। শিরোমণি বিশেষ বিব্রত বোধ করলো, কিছুটা যেন ভীতও। সে জিভ কাটলো। সে ইতস্তত করে বললো–না মশায়, বিষ্ণুকে পূজা করার চেষ্টা হয়।
বাগচী বললো–ও আচ্ছা। কিন্তু আপনি যোগীশ্বর রূপের কথা কী বলছিলেন, জগৎপিতাও বলছেন। বৃষ্টি থামেনি, আপনি বলতে পারেন।
শিরোমণি লজ্জায় অপোবদন হলো। কিন্তু সে লক্ষ্য করলো যে অন্য অনেকেই তার মুখের দিকে চেয়ে আছে। যেন সে ধিকৃত পরাজিত এক জনগোষ্ঠীর প্রতিভূ এরকম একটা অনুভব হলো তার।
সে বললো, তারপরও, কল্পনা করি, তার অনুভূতিতে যোগীশ্ব সেই রূপ ক্রমশ এক আনন্দময় জ্যোতিস্বান্ কালস্রোতে মিলিয়ে যায়। সে হয়তো অনুভব করে সেই মহাকালস্রোতে সূর্য-চন্দ্রাদি জন্মাচ্ছে, লোপ পাচ্ছে, সে নিজেকে সূর্য-চন্দ্রাদির মতো মহাকালপ্রসূত এবং তাতেই বিলীন মনে করে। সেই জগৎ-জনয়িতা মহাকালকে অনুভব করে তার জন্মের আনন্দ নেই, মৃত্যুর ভয় নেই, তার সুখ দুঃখ নেই, সে কাউকে ভয় করে না, বিদ্বেষ করে না। সে যদি কখনো বলে আমিই শিব তাহলে তা মিথ্যা হয় না।
এই বলে সে থামলো। তাকে বিশীর্ণতর দেখালো। সে মনে মনে ভাবলো : এই বিধর্মী মানুষটির কাছে কেমন বা কটু বোধ হলো তার কথা!
কিছুক্ষণ কেউই কিছু বললো– না। কিন্তু কেউ কেউ করিৎকর্মা খাকে। কৈলাসপণ্ডিত ইতিমধ্যে উঠে দরজা পর্যন্ত গিয়েছিলো। সে বললো– ধরেছে সার। এবার যাওয়া যাবে।
বাগচী হেসে বললো–পণ্ডিতমশায় দেখছি আলোচনাটা চালাতে চান না। চলুন তবে।
পথে বেরিয়ে শিক্ষকেরা শীতের এই ক্ষণস্থায়ী বৃষ্টি শীত বাড়াবে কিনা, ফসলের পক্ষে ক্ষতিকর হবে কিনা, ধান-চালের দাম এবার গতবারের চাইতে বেশি কেন ইত্যাদি আলোচনায় ব্যস্ত হলো।
শিরোমণি সকলের পিছনে হাঁটছিলো। বাগচী শিক্ষকদের পরে স্কুল থেকে বেরিয়েছিলো। কখন সে শিরোমণির কাছে এসে পড়েছে। সে বললো–এগুলো কি আপনার নিজেরই ব্যাখ্যা? কিংবা কোনো দর্শন থেকে বলছেন? হ্যাঁ, মশায়, ওই উদাসীন মহাকালের কথা? সবাই উদাস হলে কি চলবে?
শিরোমণি নিজের মনের মধ্যে খোঁজ করলো যেন, বললো–নিশ্চয়ই পূর্বসূরীদের কাছ থেকে পাওয়া। কিন্তু হঠাৎ বিশেষ কারো নাম মনে করতে পারছি না। কাল ছাড়া কি কুম্ভকারই একটা ঘট বানাতে পারে? কিন্তু উদাস না হলেও চলে। যোগীশ্বর রূপে তাঁকে আদর্শ করে লোক সংগ্রহ করা যায়। তিনি অপরের জন্য বিষ পান করেন। শিরোমণি নিতান্ত কুণ্ঠিত হয়ে হাসলো।
বাগচী এই কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কিছুক্ষণ শিরোমণির পাশে চললো। সে বিস্ময় বোধ করলো। জন্মান্তরবাদ নয়, কর্মফল নয়, সবই যেন এক উদাসীন মহাকালস্রোতে ভাসমান। কী সাংঘাতিক কথা, তাহলে ক্রাইস্ট দূরের কথা, ঈশ্বরই থাকেন কি?
শীতের এই এক পশলা বৃষ্টি ধুলোকে জব্দ করতে পারেনি। বরং বাতাস এনে ধুলোর উৎপাত বাড়িয়েছে। একবার তা উঠে শিরোমণিকে ব্যতিব্যস্ত করলো! সে চাঁদরে নাক-মুখ ঢাকলো বটে, তার পাকা চুলে, শীর্ণ দেহে ধুলোর স্তর পড়লো যেন। ধুলোয় ঢাকা ক্লান্ত শীর্ণ এক হতাশ মানুষ যেন সে।
নিজের বলা কথা চিন্তার সূচনা করতে পারে। শিরোমণি মনের তলায় চলে নিজের অজ্ঞাতে রামায়ণের ভাষায় চলে এলো। কিছু বদল করে সে ভাবলো : উনষোড়শ বর্ষ পৌত্র যে রাজীবলোচন। আজ সন্ধ্যা থেকে তাকে মেঘদূত পড়াতে হবে। বালবিধবা ভ্রাতুস্পুত্রী গৃহে থাকায় টোলেও ভট্টি ছাড়া কাব্য পড়ানো হতো না। এখন তা যায়। বাড়ির কাছাকাছি এসে সে ভাবলো : কিন্তু তা কি ভালো হচ্ছে? পৌত্র ও পুত্রতে কি বিবাদ দেখা দেবে? এ কি সত্য যা সে কখনো আশঙ্কা করে? নিজের গৃহের পরিস্থিতি সে বিশ্লেষণ করলো। এবার নিয়ে সাত বছর হলো পুত্র বিজয়কুমার কলকাতায় অর্থোপার্জনের জন্য। মাঝে কী এক পরীক্ষা দিয়ে জজ-পণ্ডিত হওয়ার চেষ্টায় ছিলো, কিন্তু জজ-পণ্ডিত কি এখনো হয়? তা কি গুজবনয়? এই সাত বছর বিজয় কালের সঙ্গে অনেক আপোস করেছে। সে ধর্মান্তরিত হয়নি বটে, কিন্তু স্মৃতিতে বিশ্বাস অনেকটাই কমেছে। সে গতবার হাসতে হাসতে তার মাকে বলেছিলো, সময়ও মুনিদের কাছে বেদের মতো প্রমাণ। কিন্তু সে আজকের নিয়োগীর মতোই উত্তেজিত ছিলো। সেদিন টোলের দু-তিনজন ছাত্র তার মায়ের পক্ষ নেওয়ায় কণ্ঠস্বরগুলো ক্রমশ উচ্চতর হচ্ছিলো। তার সে মা আর নেই। কথাগুলো কি তার সঙ্গে গিয়েছে? সে বলেছিলো, দোষটা ভাগ্যের যে ব্রাহ্মণকুলে জন্মেছি, কুল ত্যাগ করতে পারছি না। কিন্তু শীল, সোনার বেনে, কৈবর্ত, কায়েতের মুখে বামুন বামুন ঠাট্টাও শুনবো আর তাদের দেওয়া নামমাত্র বৃত্তি ভোগ করবো–তাই বা কেন? আমরাই যদি নিজেদের স্বার্থে ধর্ম তৈরী করে থাকে আমরাই তা চুরমার করে দিই না কেন? তুমি কি বলবে এই গ্রামের বাইরে শিরোমণি শব্দটাকে কেউ শ্রদ্ধা করে? তার চাইতে বামুন বিদ্যাসাগর ভালো। কলকেতায় বাস করলে খানিকটা কলকেতার মতোই হবে, বিজয়েরও হয়েছে। কিন্তু পৌত্র বৈজয়ন্তের উপরে বাড়ির প্রভাব বেশি। পৌত্রের প্রতি স্নেহাবিষ্ট হয়ে, অথবা সপরিবারে পুত্রের কলকেতায় থাকা অসুবিধার হবে এই যুক্তিতে পৌত্রকে নিজের কাছে রাখা কি ভালো হচ্ছে?
কিন্তু কাব্য পাঠের কথা হচ্ছিলো। সময় হয়েছে বটে। কাব্যের রস ও ব্যক্তির ইন্দ্রিয় কর্তৃক উপভোগ-জাত সুখ এক নয় তা বুঝতে হবে। কিন্তু রাজীবনোচন পৌত্রের বাহুও তো পরিঘসদৃশ হওয়া উচিত। কাব্যের রস সেই রকম ব্যঢ়োরস্ক পুরুষের জন্যই কি? কাব্যের স্মৃতি শিরোমণির কল্পনাকে উদ্দীপ্ত করায় সে যেন তার সম্মুখে রসপিপাসু কয়েকটি যুবাকে দেখতে পেলো।
কিন্তু কল্পনা অনেকসময়েই বাস্তবকে বৈপরীত্যর সাহায্যে স্পষ্ট করে। এসব কাব্য যাদের, মহাকাল যাদের উপাস্য, তারা চার হাতে ধনুতে জ্যা রোপণ করতে পারতো। যবন ধ্বংসী সেই সেনা নিশ্চয় ক্ষুধাখিন্ন ছিলো না।
তার চতুষ্পঠীতে কি তেমন যুবক আছে? কিংবা গ্রামে? মাংসল স্কন্ধ, সুবলিত বাহু। আর ধনুর অনুকল্প তো বন্দুক।
বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে নিজের চিন্তাগুলোকে লক্ষ্য করে সে লজ্জিত হলো। এসব কেন ভাবছে? যখন এসব কাব্য লেখা হয়েছে তখনো অপরাধগুলো সবই ছিলো, অবশ্যই ক্ষুধা, তৈল, ইন্ধন, লবণ চিন্তা ছিলো, কিন্তু একরকমের বলিষ্ঠতাও ছিলো। এইসব যে সে ভাবছে কে জানবে? শালগ্রামশিলা? ক্ষুধার অভাব, দৃপ্ত যৌবন, ধীরোদাত্ত পুরুষ শত সহস্র কুটির থেকে ছুটে আসছে, যাদের অপরাধকে ভুল বলে ক্ষমা করা যায়, তাদের জন্য কার কাছে প্রার্থনা করা যায়?
বাগচীও বাতাসের ঝাপটায় পড়েছিলো। পথের ধারের গাছগুলোর ব্যস্তসমস্ততা দেখতে পেলো। আকাশে যে হালকা মেঘ তাতে আর কি বৃষ্টি হবে? কী যেন ভাবছিলো সে? শিরোমণির কথা? সে কি তবে নিজেই জানে না তার কথাগুলোর উৎস কোথায়? এ কি নতুন দার্শনিক চিন্তার দিকে চলেছে তার মন, অসীম অকম্পিত কালকেসময়কে–সে যাকে হিন্দুরা ব্রহ্ম বলে তার প্রতিভাস মনে করছে? এ কি নতুন দার্শনিক চিন্তা যা এই গ্রামে বলা হচ্ছে? কী জানি! কিন্তু তা কি ভালো? তাহলে কি বিপন্ন হতে হয় না? ঈশ্বর থাকে না।
ঠিক এই সময়ে নিয়োগীও চিন্তা করছিলো। সে মাথা নিচু করে হাঁটছিলো, যেন সে পরাজিত। কিন্তু মনের জোরে সে এই অলীক কল্পনা থেকে মুক্ত করে নিলো নিজেকে। বাগচীকে দেখেই সে ভদ্রতায় থেমে গিয়েছিলো কেননা শিরোমণি তখন নিতান্ত অরুচিকর যৌন বিষয়ক কথা বলছিলো। কী আশ্চর্য, দেওয়ানজি এঁকেই উপনিষদের ব্যাখ্যা করার উপযুক্ত বিবেচনা করেন! কালিদাস! শকুন্তলম্! ঈশ্বর আমাদিগকে পাপ শ্রবণ ও পাপ কথন থেকে রক্ষা করুন। একবার তার মনে হলো সে নিজেকে এবং নিজের সন্তানদের পাপ থেকে উৎপন্ন মনে করে কিনা। পরমুহূর্তেই সে ভাবলো এই যে তার ঈশ্বরচিন্তায় বারবার যৌনতা যুক্ত হয়েছে এর জন্য কি সে দায়ী? অথবা এই কি অসুলিনির্দেশ যে তাকে গ্রাম ত্যাগ করতে হবে?
আদর্শবাদীদের চিন্তা অনেকসময়ে বাধার সম্মুখে অনুপ্রেরিত হয়ে ওঠে। গ্রাম ত্যাগের কাল্পনিক শূন্যতার সামনে তার চিন্তা শক্ত হয়ে দাঁড়ালো যেন। না, না, সত্যধর্মের পরাজয় হয় না। সে অতি দ্রুত চিন্তা করতে লাগলো। এই গ্রামে দেওয়ানজি নিশ্চয়ই প্রচণ্ড শক্তিশালী, না না, তা আমাকে স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু তার শক্তির উৎস? তা কি আরো শক্তিশালী নয়? সে যেন পেয়েছি পেয়েছি বলে উঠবে। সে ভাবলো, আর দিদি ব্রহ্মবালার কথা সত্য। হলে, অবশ্যই তা সত্য, রানীমা গুণাঢ্যমশায়ের কন্যা সম্বন্ধে ভাবতে রাজী হয়েছেন। আগ্রা, মথুরা, পাটনার এবং বর্তমানে কলকাতারও এই পরিবারের ন্যায় কাদের এমন সত্যধর্মে নিষ্ঠা? গুণাঢ্যমশায় কমিশরিয়াটের কনট্রাকটাররূপে ধনাঢ্যও বটেন। তাঁর কন্যা যদি রাজকুমারের স্ত্রীরূপে এদেশে আসেন? না না, দিদিকে আজই পত্র দিতে হবে। এ সম্বন্ধ ঘটাতেই হবে। রানী হতেই কি রোমসম্রাট ক্রিশ্চান হননি?
.
০৭.
বাড়ি যাওয়ার কথা সকলের আগে মনে হলেও কৈলাসপণ্ডিত সকলের পিছনে ছিলো। সঙ্গে চরণদাস। চরণদাস তো দাঁড়িয়ে থেকে স্কুলের দরজা জানালা বন্ধ করায়। কৈলাসপণ্ডিতের গন্তব্যই হারিয়ে গিয়েছে, কোথাও কোনোরকমে পৌঁছে গেলে সেখানেই নিজেকে ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছা করে। বয়স শিরোমণির চাইতে কম হবে, এমন জরাজীর্ণ যে কেউ প্রতিকারের কল্পনা করে না।
তার এই এক সুবিধা, সে দারিদ্র্যকে অনুভব করতে পারে না আর। দ্বিতীয় সুবিধা ইদানীং দেখা দিয়েছে, সে ক্রমশই অতীতকে ভুলে যাচ্ছে। তার মনে আছে বটে, এই স্কুলটা হওয়ার আগে বাংলা, অঙ্ক, ইংরেজির দু-এক কথা শিখতে তার পাঠশালাই একমাত্র প্রতিষ্ঠান ছিলো, আর দেওয়ানজির বদান্যতায় স্কুল হলেও তাকে সেখানে কাজ সুতরাং জীবিকার পথ দেওয়া হয়েছে। এখন কৈশোর-যৌবনের ঘটনাগুলোকে তার অলীক মনে হয়। সে যে কায়স্থ তা নিশ্চয় মনে আছে; পিতার নাম গোত্র মনে আছে, কিন্তু তার মুখখানা স্মৃতিতে আর আসে না। মায়ের? তা যেন ভাসে, দোলে, ডুবে যেতে চায়। কায়স্থের বিধবা। কিন্তু কী কঠোর বামনাই! সেই কঠোর একাগ্রতা ধরা পড়তো চরকা নিয়ে বসলে। তেমন সূক্ষ্ম রেশম মাকড়সাও পারে না। ফরাসডাঙার সাহেব কিনতে। আর তাতেই মা-ছেলের ভাত? মা যখন সব-সেরা কাটুনি তখনই মাসে দুটো করে উপবাস, প্রতি রাত্রিতেই অরন্ধন, মায়ের প্রতি রাত্রিতেই অভক্ষণ। শুভঙ্করে দড় পণ্ডিত জানে এসবে ভাতের প্রয়োজন এক-তৃতীয়াংশ কমে আসে। কৈলাসের আর এক সুবিধা হয়েছে এখন, বালকের মতো কথায় কথায় চোখে জল আসে, চিন্তা ভেসে ভেসে হারিয়ে যায়।
সে আজ ধর্মের কথা ভাবতে বাধ্য হয়েছে। ধর্ম? ভাবতে গেলে মায়ের সেই শীর্ণ, ক্ষুধাখিন্ন মুখটাকে মনে আসে। এখন বাতাসা-টাতাসা মানত করার দায়িত্ব তার স্ত্রীর। তার মেয়ে চারু এখন বড়ো হয়েছে, সে বরং এ ব্যাপারে মাকে সাহায্য করে। কিন্তু এই ধর্ম নিয়ে একটা বিপদ যেন ঘনিয়ে আসছে। আজ আবার নিয়োগীমশায় শিরোমণিকে চটিয়ে দিলেন।
মুশকিল! সে কিছুদিন থেকে নিয়োগীমশায়ের কাছে ঋণী বোধ করছে। অসময়ে বিনা সুদে দুচার টাকা ধার দেওয়া তো বটেই। আসল কথা তার মেয়ে চারু। বছর দুয়েক আগেও সে গ্রামের সব চাইতে গেছোমেয়ে ছিলো! এখন বিষণ্ণ হয়েছে, যোলো-সতেরো হলো তার। তার মেয়ের বিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা নেই। বছর দুয়েক আগে শেষ চেষ্টা করেছিলো সে। সে কুলীন নয় আর কুলের কথা ভাবেনা। তা সত্ত্বেও তখনই পাত্রপক্ষ সোনায় নগদে চারশো চেয়েছিলো যা তার এক বছরের উপার্জন। চারুকে দরজা বন্ধ করে থাকতে হতো যদি না নিয়োগীমশায়ের স্ত্রী তাকে ডেকে নিতেন। দিনমানের দু-পাঁচ ঘণ্টা চারু তার কাছে কাটায়, তার ছোটোছেলেটিকে বুকে করে রাখে, কুটনো কেটে দেয়, সব কাজেই সাহায্য করে। একটু রুগ্নই তিনি, সন্তানও বেশ কয়েকটি। কিন্তু তিনিও চারুকে ভালো মন্দ খেতে দেন, সেলাই শেখান, খাতা বেঁধে হাতের লেখা শেখান।
হাতের লেখা সে নিজেই পাঠশালায় শিখিয়েছিলো। কিন্তু এটা তার চিন্তার বিষয় নয়। সে নিয়োগীমশায়ের দিকে ঝুঁকেছে, তার কাছে কৃতজ্ঞ বোধ করছে। তিনি যেমন দয়াবান তেমন যদি নরম হতেন! কিন্তু তিনি দলাদলির দিকে চলেছেন। কৈলাসের আতঙ্ক হলো–এ রকম চলতে থাকলে সে নিয়োগীমশায়ের দলে গ্রামের অন্য অনেকের বিরুদ্ধে গিয়ে পড়তে পারে। উদাসীন, নিস্পৃহ শিরোমণি, আর ক্রুদ্ধ অপমানিত শিরোমণি এক নয়। কী হবে তখন গুরুর?
ভয়ে ভয়ে কৈলাস বললো–চরণ, তুমি ধর্ম-টর্ম বোঝো?
–তেমন বুঝি কোথায়?
কথাটা এগোলো না। কৈলাসের মনে তার মেয়ে চারুই ফিরে এলোদ্রুত চলেছে এমন চারু, দ্রুত কাজের হাত চলেছে এমন চারু, হাস্যময়ী এক চারু, যার হাসি দেখে তার দুঃখ। বোঝা যায় না। কিন্তু সে আজ মনকে ভেসে যেতে দেবে না। গোপনে চরণকে পাওয়া গিয়েছে। চরণের একরকম বেপরোয়া সাহস আছে যা এ-গ্রামে দুর্লভ। ভাবো নিজের বিধবা ভ্রাতৃবধূকে প্রকাশ্যে বিবাহ করা! কিন্তু কৈলাসের চোখ দুটি ছলছল করে উঠলো।
তার অনুভূতিতে এই কান্না উঠলো–ও মা, উমা, পাষাণ বলেই কি সইবে? তা সত্ত্বেও মনকে শক্ত করে সে বললো–আচ্ছা, চরণ, তুমি কি জানো, সুরেন সাঁপুই কী জাতি? বামুন কায়েত নয় বোধ হয়? তোমরা তো একসঙ্গে ওঠো বসো, খাওয়া-দাওয়া করো?
চরণ বললো–জাতি তো জানি না পোনমশাই, আর আড্ডায় অত বিচারও নেই।
–চরণ, শুনলাম, নিয়োগীমশায় ব্রাহ্মণ ছিলেন, কিন্তু সুরেন হেঁসেলে ঢোকে, খায়।
-ওদের সমাজে ওসব চলে।
এতক্ষণে কৈলাসের চিন্তা যেন একাগ্র হলো, আর তার তীক্ষ্ণতায় সে ভীত হয়ে এদিক ওদিক চাইতে লাগলো। নিয়োগীর স্ত্রী কাল বিকেলে বেড়াতে এসেছিলেন। তখন চারুর মাকে অনেক কথার মধ্যে বলেছেন, সুরেন সাঁপুই, যে নাকি রাজবাড়িতে কাজ করে, আশি টাকা বেতন পায়, যার স্ত্রী একটিমাত্র শিশু রেখে দু বছর হয় গত হয়েছেন, সেই সুরেন্দ্রর বয়স কখনই পঁয়ত্রিশের বেশি নয়। সে নাকি নিয়োগীর বাড়িতে চারুকে দেখেছে; দেখে বলেছে বেশ মেয়ে চারু।
চরণ বললো–আমি এখান থেকে কাট করবো পোনমশাই।
কৈলাস তার এই পুরনো ছাত্রটিকে যেন ইংরেজি ছড়াই পড়াচ্ছে এমনভাবে বললো– হেসে-কাট, কাট, কাট, কাটান।
চরণ চলে যাওয়ায় সে যেন বেঁচে গেলো। বললো–এসব কি লোকজনের মধ্যে ভাবা যায়? কিন্তু নির্জনে ভাবতে গিয়েও সে থরথর করে কেঁপে উঠলো। হে ঈশ্বর, করুণাসিন্ধু, রক্ষা করো, রক্ষা করো।
সে কী করে চারুকে সুরেনের স্ত্রীরূপে কল্পনা করলো! কৈলাসপণ্ডিতের শুকনো গাল বেয়ে জলের ধারা নামলো। পথের উপরে দাঁড়িয়ে যেন চারুকেই বলছে এমনভাবে যুক্তকরে কেঁদে উঠলো : ও মা, ভবদারা, পাষাণ ফেটে যায় দ্যাখো।
.
তখন চরণের খুব তাড়াতাড়ির সময়। কৈলাসপণ্ডিতকে ছাড়িয়ে এসে সে খুব তাড়াতাড়ি চলতে লাগলো। তার নিজের কৃষাণরা আসবে কাজকর্মের হিসাব দিতে, রোগীরা আসবে ডিসপেনসারিতে, ওদিকে রিহার্সালেও যাওয়া দরকার। এসব কাজ না থাকলেও তাকে তাড়াতাড়ি করতে হতো। সে জানে এ সময়ে বনদুর্গা মাঝে মাঝেই তার শোবার ঘরের জানলায় এসে দাঁড়ায়। জিজ্ঞাসা করলে স্বীকার করে না।
কয়েক পা গিয়ে সে ভাবলো, সে পোনমশাইকে ঠকায়নি। ধর্ম সম্বন্ধে সে কিছুই কি জানে? আত্মা, পরমাত্মা, দেব দেবী, ব্রহ্ম–এসব কথা সে শুনেছে। কলকাতা-ফেরত গৌরী, বেজো এরাও, সুরেনবাবু, নরেশবাবু তো কলকেতারই মানুষ, নিয়োগীমশায় তো তাকে বাইবেলই পড়ান যা ধর্মেরই বই, কাজেই ধর্মের কথা উঠে পড়েই। সেও কালই এক কঁকিবাজ ক্ষেতমজুরকে বলেছিলো–অতটা নয়, ধর্মে সইবে না।
কিন্তু ধর্ম বলে কি কিছু সত্যিই আছে যা থেকে অন্যায়ের পাপের শাস্তি হয়? কে শাস্তি পায়? সেই আত্মা বলেই কি কিছু আছে? পায় নাকি ডানকানরা শাস্তি? নাকি ওদের ধর্মে তেমন করে মানুষকে পীড়ন করা অন্যয় নয়? পাপ হয় না, বাঘ মানুষ খেলে যেমন তার পাপ নেই, যেমন আমরা মোষ-গোরুকে পিটলে পাপ নেই?
আর আত্মা? …চরণ অন্যমনস্ক হয়ে গেলো। শিরোমণি আজ নতুন ধরনের কথা বলেছেন। মানুষ নাকি দিবিহ্ত দেবতা নয়। পশু থেকে উঠছে। নিয়োগীমশায় আবার যেন বাইবেলের গল্পের মতো খানিকটা বিশ্বাস করেন। মানুষ নাকি আবার অমৃতস্য পুত্রা। ডানকানও? ওদিকে মানুষ যে দেবত্বে যাবে–শিরোমণির শরীরটা দ্যাখো। তার আর কী হবে? তবে কী আত্মা?
আত্মা সম্বন্ধে বলা ভালো নয়। নিজে সে একদিন বলেছিলো। বনদুর্গা বলেছিলো একদিন ঘাট থেকে ফিরে। আমাদের সেই পোস্টমাস্টার গোবর্ধনের কথা মনে পড়ে, চরণ?
মনে না-পড়ার কথা নয়। সে তো একইসঙ্গে তার আর বনদুর্গার বন্ধু ছিলো। তাদের বিবাহ তো তারই উদ্যোগে।
এখন তো জানাই যাচ্ছে বুজরুকের সঙ্গে সেই চলে যাওয়ার পরে আর কখনো সে ফিরবে না। কিন্তু বনদুর্গা জিজ্ঞাসা করলো–আচ্ছা চরণ, আবার কখনো কি গোবর্ধনবাবুর সঙ্গে আমাদের দেখা হতে পারে?
চরণের বলা উচিত ছিলো, তা হয় না বলেই আমরা শোকে কাদি। কিন্তু সে বোকার মতো বলেছিলো–হবে বৈকি, আমাদের আত্মা আছে না?
রাত্রিতে ছেলে ঘুমালে বনদুর্গা চরণের বিছানায় এসেছিলো। সে চরণের বক্ষসংলগ্না, কিন্তু তার চোখ দুটি প্রদীপের আলোয় অন্য সময়ের চাইতে আয়ত মনে হচ্ছিলো। সে বলেছিলো–আচ্ছা চরণ, তোমার সেই দাদার সঙ্গেও কি আবার দেখা হতে পারে-আমার কিংবা তোমার?
একটা অব্যক্ত নিষ্ঠুরতা আছে যেন কোথাও আত্মার ব্যাপারে, যার হিসাব আমাদের পৃথিবীর হিসাবকে তছনছ করে দেয়। আত্মা কি নিঃসঙ্গ যেমন সে মরেলগঞ্জের অত্যাচারে বিষণ্ণ বনদুর্গার পূর্ব-স্বামী, তার সেই জ্ঞাতি-ভ্রাতাকে কখনো কখনো কল্পনা করে?
চরণ তার বাড়ির কাছে এসে গিয়েছিলো। জানলায় বনদুর্গার চোখ দুটিকে দেখার আশায় সে চোখ তুলো, সে বরং তার বাড়ির বাইরের বারান্দার পাশে ঘোড়ার পিঠে একজনকে দেখতে পেলো।
চরণ সাগ্রহে এগিয়ে বললো–গোপালদা যে, কখন এলে? বসোনি কেন? ঘোড়ার পিঠে রয়েছো?
গোপাল বললো–তোমার সঙ্গে কইতে এলাম, চরণ, বেশ কিছুক দিন মরেলগঞ্জ যাচ্ছো নি। সেখেনে তোমার সুঁই ফাঁকা, চাষ পড়ছে না।
চরণ সলজ্জভাবে বললো–ঠিয়াটারের রির্সেল নিয়ে পড়েছি, আর কয়েকদিন। তার পরেই ভাবছি। এসো, বসিগে, পান-তামুক খাও।
না গো, চর চারিদিগে।
–এখানে চর কোথাকে? নদী ডেরকোশ।
–ভালো, ভালো। গোপাল গলা নিচু করলো, বললো, ডানকান এবার দাদন দিচ্ছে নি। চরণ বারান্দায় উঠতে থমকে দাঁড়ালো। একমুহূর্তে তার মনের আবহাওয়াই যেন বদলে গেলো। থিয়েটার, ধর্ম, বনদুর্গা এসব থেকে অনেক দূরে এই এক জায়গা। তার মুখটাই যেন সারাদিনের রোদে কালো এবং ক্লান্ত হয়ে উঠলো।
তা সত্ত্বেও সে হাসলো। বললো–বেশ যা হোক, না দেয় তোমার কী?
গোপাল বললো–মনোহর শা কইছে বিঘে প্রতি দু-দশ টাকা ঋণ দিতে পারে সাহেবকে ধরাধরি করলে।
-কেন, নীলের যন্তর কী তুলে দিচ্ছে?
–অনেক কইছে। কইছে নীলের দাম পড়ছে, ফাটকায় মার খেয়েছে সগলেই, কার ঠাকুর কোম্পানিই বরবাদ, দাদন আর হবে নি। বিঘেতে হদ্দ দশ টাকা ধার পেতে পারো।
চরণের ধোঁকা লাগলো, বললো, রসো-রসো, এর মধ্যে প্যাঁচ আসছে। অমন অখিদে হয় না। জমি বাঁধা দিয়ে ধার? ভাবতে হবে, গোপালদা।
–কিন্তুক ধার নেওয়া তো শুরু হয়েছে।
চরণের মুখ শুকিয়ে উঠলো, বললো–ভেবে দ্যাখো গোপালদা, ধার নয় নিলে, শুধবে তো সেই নীল বেচে? কিনবে তো সেই ডানকান? যদি বলে কেনার গরজ নি। যদি এমন বলে এক বিঘার নীলের দাম ঋণের টাকার কম হয়? সে মণ প্রতি দাদনের চাইতে খারাপ। না, গোপালদা, ভালো ঠেকছে নি। ঋণ নিও না। এখন তো সকলের হাতে কিছু ধান হবে। অন্তত পিছিয়ে দাও না ধার নেওয়া।
গোপাল কম অভিজ্ঞ নয়, বললো–ধান বেচে এগোতে কইছো, কজনা পারবে? খাওয়ার ধান বেচে, শেষে? সে ধান সগলে হাটে আনলে তার দামও পড়ে, বোঝো?
চরণ ভাবতে লাগলো। বললো–এতে কিন্তুক শয়তানী আছে–গোপালদা, কলকেতার শয়তানী। গত বছরের গোলমালের কথা ভাবো। যশোর-নদের কৃষকেরা এককাট্টা হয়েছিলো। আমার মনে হচ্ছে তো নীলে শালারাও এককাট্টা হচ্ছে। দু সন নীল আমদানী কম ছিলো, দাম কমে কেন?
গোপাল বললো–তোমার তো পুরো পঞ্চাশ বিঘে সেখেনে। ত্রিশে নীল করো! সব তো শুনলে, এখন?
–আরো শুনবো, গোপালদা।
–সগলে গিয়ে একবার ডানকানকে ধরলে হয় না!
না। ভাবতে দাও। অমর্ত্যদা কী বলে?
-দাবা খেলে চলতে বলছে। শোনো, চরণ, গতবার অন্য জেলার গোলমালে ডানকান নরম ছিলো। এবার?
-দাদন না-নিয়ে ইচ্ছামতো চাষ।
–কিন্তু চরণ, শেষে যদি সে তোমার নীল না-ছোঁয়, দাদনের টাকা আদায়ের তাগিদ থাকবে না। তোমার নীল কি তখন খড়ি হবে আখার?
শীতের বিকেল, তা সত্ত্বেও আঙুল দিয়ে কপালের ঘাম চেঁছে ফেলো চরণদাস। সে রেগে উঠে বললো– বললাম তো ভাবতে সময় দাও।
গোপাল বললো–আচ্ছা, চরণ, এখন তুমি খাটনি করে এসেছে। দিন তিনেকে আবার আসবো। তো দাবার মতোই ভেবো। এ সময়ে প্রতি সালেই দাদনের নগদ পায় চাষী। হঠাৎ দাদন বন্ধ হলে ধারই নিতে চাইবে। মনোহর শালা বলছিলো কলকেতায় নাকি কমিছন বসেছে। তাতেই দাদন বন্ধ। দাদনেই নাকি সাহেব কুলের বদনাম। সেজন্যেই নাকি কমিছন। রঙ্গ করে কয়েছে, তো দাদনের পাপই আর না। ভেবো নগদের অভাবে চাষীতে চাষীতে হাহাকার পড়বে।
গোপাল চলে গেলে চরণ তার দাওয়ায় গুম হয়ে বসে রইলো। ডানকানের পাঁচটা ধরেও ধরতে পারছে না। জমি খাস করতে চায় রেহানে জমি রেখে-রেখে। নাকি দাদনে ঘাটতি লাগিয়ে মণ করা আরো কম দাদন দেবে?
বনদুর্গা দরজার আড়াল থেকে শুনছিলো। গোপালের ঘোড়ার শব্দ মিলিয়ে যেতে বেরিয়ে এসে বললো–বসি তাহলে এখেনেই।
চরণ তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে হেসে বললো–চলো যাই।
বনদুর্গা বললো–হাত মুখ ধোও। রির্সেল থেকে ফেরার সময়ে একটু চুয়া আনবে।
চরণ বললো–দোক্তা ধরবে নাকি? তাকে কিন্তু দাঁত -সাধ্যি কী দাঁত কালো করি? আমার লোভই বুঝি কম? চুয়া ধূপে দিলে সুগন্ধ বেশি হয় তুলসীতলায়। আর শোনো, তোমার ঠিয়াটার দেখতে কিন্তু আমি যাবোই, আর ছেলে। নিয়ে। আমাকে একটু ভালো দেখে বসার জায়গা দিতে হবে। রানীমার জন্মতিথি কিন্তুক এসেই গেলো।