সন্ন্যাসী বিদ্রোহ
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে উৎকটভাবে প্ৰকাশ পেয়েছিল বাঙালীর বিদ্রোহী মানসিকতার। এই সময়ের সব চেয়ে বড় বিদ্রোহ হচ্ছে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ। এটা ঘটেছিল ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পটভূমিকায়। এই বিদ্রোহেই আমরা এক মহিলাকে নেতৃত্ব করতে দেখি। সেই মহিলা হচ্ছে দেবী চৌধুরাণী। বিদ্রোহের অন্ততম নেতা হচ্ছে ভবানী পাঠক। দুজনেই ঐতিহাসিক ব্যক্তি। ১৭৬৭ খ্রীস্টাব্দে ঢাকায় ইংরেজদের কাছে অভিযোগ আসে যে ভবানী পাঠক নামে এক ব্যক্তি তাদের নৌকা লুঠ করেছে। ইংরেজরা তাকে গ্রেপ্তার করবার জন্য সৈন্যসামন্ত পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু তাকে বন্দী করতে সক্ষম হয় না। ভবানী পাঠক ইংরেজদের দেশের শাসক বলে মানতে অস্বীকার করেন। দেবী চৌধুরাণীর সহায়তায় তিনি ইংরেজদের ওপর হামলা চালান। তার ফলে ময়মনসিংহ ও বগুড়া জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে শাসন ব্যবস্থা আচল হয়ে পড়ে। লেফটানেণ্ট ব্রেনের নেতৃত্বে পরিচালিত ইংরেজবাহিনী তাকে এক ভীষণ জলযুদ্ধে পরাজিত করে ও ভবানী পাঠক নিহত হন। উত্তরবঙ্গে এই বিদ্রোহের অন্যতম নেতা ছিল ফকির সম্প্রদায়ের মজনু শাহ। মজনুর কার্যকলাপে উত্তরবঙ্গ, ময়মনসিংহ ও ঢাকা জেলায় ইংরেজরা নাস্তানাবুদ হয়। সশস্ত্র বাহিনীর সাহায্যে তাকে দমন করা সম্ভবপর হয় না। ভবানী পাঠকের সন্ন্যাসীর দলের সঙ্গে মজনুর ফকির দলের একবার সজঘর্ষ হলেও, তারা সঙ্ঘবদ্ধ হয়েই নিজেদের কার্যকলাপ চালাত। তাদের কার্যকলাপের অন্তভুক্ত ছিল জমিদারদের কাছ থেকে কর আদায় করা, ইংরেজ সরকারের কোষাগার লুণ্ঠন করা ইত্যাদি। তবে জনসাধারণের ওপর তারা অত্যাচার বা বলপ্ৰয়োগ করত না। ১৭৮৬ খ্রীস্টাব্দের ২৯ ডিসেম্বর তারিখে মজনু পাঁচশত সৈন্যসহ বগুড়া জেলা থেকে পূর্বদিকে যাত্রা করবার পথে কালেশ্বর নামক জায়গায় ইংরেজবাহিনী কর্তৃক মারাত্মকভাবে আহত হয়। মজদুর দল বিহারের সীমান্তে পালিয়ে যায়। মাখনপুর নামক স্থানে মজনুর মৃত্যু হয়।
সন্ন্যাসীদের একজন মঠাধ্যক্ষ কৃপানাথের কথা আমরা আগেই বলেছি। বাইশ জন সহকারী সেনাপতিসহ তিনি দুপুরে ইংরেজবাহিনীদ্বারা ঘেরাও হলে, তিনি বিপদ বুঝে নেপাল ও ভুটানের দিকে পালিয়ে যান।
উত্তরবঙ্গে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের অপর একজন নেতা ছিলেন দর্পদেব। ১৭৭৩ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজবাহিনীর সঙ্গে তিনি এক খণ্ড যুদ্ধ করেন।
কুচবিহারে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের অন্যতম নায়ক ছিলেন রামানন্দ গোঁসাই। ১৭৭৬ খ্রীস্টাব্দে দিনহাটা নামক স্থানে তার বাহিনীর সঙ্গে লেফটানেণ্ট মরিসনের এক প্ৰচণ্ড যুদ্ধ হয়। ইংরেজবাহিনীর তুলনায় অস্ত্রশস্ত্ৰ স্বল্প ও নিকৃষ্ট থাকায় তিনি গেরিলা যুদ্ধের কৌশল অবলম্বন করে মরিসনের বাহিনীকে সম্পূর্ণ পরাজিত করেন। ইংরেজবাহিনী ছত্ৰভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়।
সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ১৭৬৩ থেকে ১৮০০ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত চলেছিল। এই বিদ্রোহের শেষ পর্বের যারা নায়ক ছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখনীয় ইমামবাড়ী শাহ, বুদ্ধ, শাহ, জহুরী শাহ, মূসা শাহ, সোভান আলি প্রমুখ। আরও একজন ছিলেন, তার নাম জয়রাম। তিনি ছিলেন একজন এদেশীয় সুবেদার। ১৭৭৩ খ্রীস্টাব্দে ইংরেজবাহিনীর সঙ্গে সন্ন্যাসীবাহিনীর যে সংগ্ৰাম হয়, তাতে তিনি কয়েকজন সিপাইসহ সন্ন্যাসীদের সাহায্য করেছিলেন। সেই যুদ্ধে ইংরেজবাহিনী পরাজিত হয়েছিল। জয়রাম কিন্তু ইংরেজদের হাতে ধরা পড়েন। ইংরেজরা তাঁকে কামানের তোপে হত্যা করে।
ইংরেজদের সঙ্গে সংঘর্ষে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের অপর একজন নেতা জহুরী শাহ-ও ধরা পড়ে। বিদ্রোহের অপরাধে তাকে ১৮ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
সন্ন্যাসী বিদ্রোহের শেষ পর্বের শ্রেষ্ঠতম নায়ক ছিল মুশা শাহ। তিনি ছিলেন মজনু শাহের যোগ্য শিষ্য ও ভ্রাতা। ১৭৮৬ খ্রীস্টাব্দে মজনুর মৃত্যুর পর তিনিই বিদ্রোহ অব্যাহত রাখেন। ১৭৮৭ খ্রীস্টাব্দের মার্চ মাসে তিনি রাজশাহী জেলায় প্ৰবেশ করেন। সেখানে রাণী ভবানীর বীরকন্দাজ বাহিনী তাঁর প্রতিরোধ করে। কিন্তু মুশা বরকন্দাজবাহিনীকে পরাজিত করেন। ১৭৮৭ খ্রীস্টাব্দের মে মাসে লেফটানেন্ট ক্রিষ্টির নেতৃত্বে এক ইংরেজবাহিনী মুশাকে আক্রমণ করে। ইংরেজ বাহিনী মুশার পশ্চাদ্ধারন করেও তাকে বন্দী করতে পারে না। পরে ফেরাগুল শাহের নেতৃত্ব নিয়ে যে দ্বন্দ্ব হয়, সেই দ্বন্দ্বে মুশা ফেরাগুলোর হাতে নিহত হন।
সন্ন্যাসী বিদ্রোহের শেষ পর্বের অপর এক প্ৰধান নেতা ছিলেন সোভান আলি। এক সময় তিনি বাঙলা, বিহার ও নেপালের সীমান্ত জুড়ে এক বিরাট এলাকায় ইংরেজশাসক ও জমিদারগোষ্ঠীকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিলেন। দিনাজপুর, মালদহ ও পূর্ণিয়া জেলায় ইংরেজ কুঠি ও জমিদার-মহাজনদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাবার সময় তার সহকারী জহুরী শাহ ও মতিউল্লা ইংরেজদের হাতে ধরা পড়ে ও কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়। পালিয়ে গিয়ে তিনি আমুদী শাহ নামে এক ফকির নায়কের দলে যোগ দেন। কিন্তু ইংরেজদের হাতে এ দল পরাজিত হয়। এই পরাজয়ের পর ৩০০ অনুচর নিয়ে ১৭৯৭-১৭৯৯ খ্রীস্টাব্দ পৰ্যন্ত উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় তিনি ছোট ছোট আক্রমণ চালান। তাঁকে গ্রেপ্তারের জন্য ইংরেজ সরকার চার হাজার টাকা পুরষ্কার ঘোষণা করে। তাঁর শেষ জীবন সম্বন্ধে আমরা কিছু জানি না।
শেষ পর্যন্ত ইমামবাড়ী শাহ ও বুদ্ধ, শাহ বগুড়ার জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের ঝাণ্ডা উড্ডীন রেখেছিলেন।
একদিকে যেমন ‘সন্ন্যাসী বিদ্ৰোহ’ চলছিল, অপরদিকে তেমনই ইংরেজশাসক ও জমিদারগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দেশের মধ্যে গণ-আন্দোলন ও চলছিল। তাদের মধ্যে উল্লেখনীয় চুয়াড় ও বাগড়ী নায়েক বিদ্রোহ, চাকমা বিদ্রোহ, ঘরুই বিদ্রোহ, হাতিখেদা বিদ্রোহ, বাখরগঞ্জের সুবান্দিয়া গ্রামের বিদ্রোহ, ত্রিপুরার রেজশনাবাদ পরগণায় সমশের গাড়ীর বিদ্রোহ ও শতাব্দীর শেষের দিকে তন্তুবায়দের ওপর ইংরেজ বণিকদের উৎপীড়নের বিরুদ্ধে তন্তুবায়দের বিদ্রোহ। এসব বিদ্রোহ সম্বন্ধে বিশদ বিবরণ যাঁরা জানতে চান, তাঁরা আমার ‘প্রসঙ্গ পঞ্চবিংশতি’ বইখানা পড়ে নিতে পারেন।