০৯. সন্ধ্যাবেলা হারুন বাসায় ফিরে দেখেন

সন্ধ্যাবেলা হারুন বাসায় ফিরে দেখেন গেস্টরুমের দরজা খোলা। সেখানে কে যেন শুয়ে আছে। বাইরে থেকে জুতা দেখা যাচ্ছে। জুতা পায়ে বিছানায় শোয়া। আশ্চর্য তো।

হারুন বললেন, গেস্টরুমে কে ঘুমাচ্ছে?

মলিনা বলল, ভাইজান ঘুমাইতাছে। আমারে বলল, মলি কফি খাব। ভাইজান আমারে পুরা নামে ডাকে না, মলি ডাকে। ঘরে ছিল না কফি। দারোয়ান দোকানে পাঠায়া কফি আনাইলাম। মগভর্তি কফি নিয়া গেলাম, ও আল্লা ভাইজান ঘুমে।

হারুন বললেন, ভ্যারভ্যার করবে না। ভাইজানটা কে? ঝেড়ে কাশ।

মলিনা বলল, কাশ থাকলে না কাশবো। ভাইজানের নাম রাশেদ।

যে জিনিসপত্র ফেলে চলে গিয়েছিল?

জ্বে।

আবার উদয় হয়েছে কেন?

আফা গিয়া নিয়া আসছেন। ভাইজান ছিলেন হাসপাতালে। খুবই খারাপ অবস্থায় ছিলেন। অবস্থা এমন যে ভাইজান বিছানায় শোয়া, আজরাইল খাটের নিচে ঘাপটি মাইরা বসা।

আর কথা বলবে না। রূপা কোথায়?

আফা বাজার সদাই করতে গেছে। ভাইজান গরুর মাংস দিয়া পরোটা খাইতে চাইছে। ঘরে মাংস নাই।

অচেনা এক লোক ঘরে ঢুকেই গরুর মাংস পরোটা খেতে চাইল আর তোমার আপা মাংস কেনার জন্যে ছুটল কসাইয়ের দোকানে?

মলিনা বলল, কসাইয়ের দোকানে যাবেন কেন? আগুরায় গেছে। সহজ কথা বললে বুঝেন না। আপনে এমন মসিবতের মানুষ।

ডেকে তোল তোমার ভাইজানকে।

একটা রোগী মানুষ। ঘুমাইছে। আমি তারে ডাইকা তুলব, এমুন পাষাণী আমি না। প্রয়োজনে বাসার কাম ছাইড়া গারমেন্টে চাকরি নিব। গারমেন্টে ছুটি আছে, ওভাবটাইম আছে, মেডিকেল আছে। বাসাবাড়ির কামে বকা ছাড়া কিছুই নাই।

হারুন গেস্টরুমে ঢুকলেন। সব রহস্যের এখনই মীমাংসা হওয়া দরকার।

রাশেদ মনে হয় জেগেই ছিল হারুনকে ঢুকতে দেখে সে বিছানা থেকে নামলো। হাসিমুখে বলল, আপনি নিশ্চয়ই রূপার বাবা।

হারুন বললেন, হ্যাঁ। আপনার পরিচয় প্রথম শুনি। আপনি কে? আপনার ব্যাপারটা কি?

রাশেদ বলল, আপনি কি আমার উপর কোনো কারণে রেগে আছেন? আমার সঙ্গে রাগ করার মতো বড় কোনো অপরাধ আমি করিনি। আপনি কি জানতে চান বলুন। আমি বলছি। আমার নাম নিয়েই এর মধ্যে জেনেছেন। আবারও বলি–আমার নাম রাশেদ রহমান।

থাকেন কোথায়?

আমেরিকায়। মোরহেড স্টেটে।

করেন কি?

মোরহেড স্টেট ইউনিভার্সিটিতে গত বছর অঙ্কের লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছি।

হারুন চেষ্টা করছেন রাগটা ধরে রাখতে পারছেন না। রাগ দ্রুত কমা শুরু হয়েছে। তাঁর সামনে দাঁড়ানো রাজপুত্রের মতো ছেলের উচিত সিনেমায় নায়কের রোল করা। সে শেখাচ্ছে অঙ্ক। পুরনো দিনের এক নায়কের সঙ্গে। ছেলেটার চেহারার মিল আছে। সে কে? উত্তম কুমার না তো? না উত্তম কুমার না। উত্তম কুমার এত সুন্দর না।

ম্যাথমেটিক্সের কোন ব্রাঞ্চে আপনার পড়াশোনা?

টপলজি।

Ph.D ডিগ্রী নিশ্চয়ই আছে?

জী আছে।

মলিনাকে কফির কথা বলে ঘুমিয়ে পড়লেন। কফি কি এখন খাবেন? খাব।

আপনি অঙ্কের লোক ইতিহাসের বিষয়ে আপনার আগ্রহ থাকার কথা না। আগ্রহ কি আছে?

আমার সব বিষয়েই প্রবল আগ্রহ।

হারুন ইতস্তত করে বললেন, আমি ইতিহাসের মানুষ। একটা এক্সপেরিমেন্টাল ইতিহাসের বই লিখছি।

এক্সপেরিমেন্টাল মানে কি?

বইটা লিখছি কবিতায়।

রাশেদ আগ্রহের সঙ্গে বলল, প্রফেসর গ্যামো একটা অঙ্কের বই কবিতায় লিখেছিলেন। বইটার নাম Math in Rhymes.

বলেন কি?

অসম্ভব সুন্দর বই। আপনি পড়তে চাইলে আমি ব্যবস্থা করব।

অবশ্যই পড়তে চাই।

ইন্টারনেটে বইটা আছে। আমি ডাউন লোডের ব্যবস্থা করছি। আমাকে দয়া করে আধঘণ্টা সময় দিন।

হারুন বললেন, আগে কফি খাও। তারপর ডাউন লোড, আপ লোড যা করার করবে। তুমি বয়সে ছোট এই জন্য তুমি করে বলেছি।

রাশেদ বলল, আপনি আমাকে অবশ্যই তুমি করে বলবেন। আমি, বয়সে ছোট বলে আপনার মেয়ে রূপাকে তুমি বলেছিলাম। সে রাগ করেছিল।

হারুন দুঃখিত গলায় বললেন, আমার এই মেয়ে নিজেকে মনে করে মহাজ্ঞানী। মায়ের স্বভাব পেয়েছে। তার মা নিজেকে মহাজ্ঞানী ভাবে। রূপার মায়ের সঙ্গে যে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে এটা কি রূপা তোমাকে বলেছে?

জী না।

ওইসব কথা বলতে সে লজ্জা পায়। তার সম্মানের হানি হয়। তোমার কাছে বলতে কি সমস্যা কিছুই বুঝলাম না। সে তো আর ঢাক পিটিয়ে বলছে না, নিজের লোকের কাছে বলছে। মান সম্মান নিয়ে বসে থাকার কোনো অর্থ আছে, তুমি বল।

রাশেদ বলল, কোনো অর্থ নেই।

আমি যে ছাদে মাছ চাষ করি, রূপা তোমাকে বলেছে?

বলে নি। কি মাছ চাষ করেন?

দেশি মাছ, কৈ, শিং, মাগুর, তেলাপিয়া। কৈ মাছগুলি কেন জানি মরে যায়। সাত দিনের মাথায় মরে ভেসে ওঠে।

রাশেদ বলল, মৎস্য বিশেষজ্ঞ কারোর সঙ্গে আলাপ করা দরকার।

মৎস্য বিশেষজ্ঞ পাব কোথায়?

মৎস্য বিশেষজ্ঞ তো আপনার ঘরেই আছে।

কে? তুমি না-কি?

ইন্টারনেট। গুগল সার্চ দিলেই বের হয়ে পড়বে। আমি বের করে দেব। তার আগে চলুন আপনার মাছের খামার দেখে আসি।

হারুন আনন্দের সঙ্গে বললেন, চল যাই। কফি ছাদে বসে খাওয়া যাবে। ছাদে বাগান করেছি। বাগান তোমার পছন্দ হবে। রূপার অবশ্য পছন্দ না। তার ধারণা ছাদে আমি জঙ্গল বানিয়েছি। যে কোনো সময় জঙ্গলে বাঘ দেখা যাবে। সস্তা মেয়েলি রসিকতা। বাগান সম্পর্কে তোমার যদি কোনো সাজেশান থাকে দিতে পার।

দুজন ছাদে উঠে গেল।

 

রূপা বাজার নিয়ে ফিরেছে। গেস্টরুমে কেউ নেই। বসার ঘরেও কেউ নেই। রূপা বলল, মলিনা! উনি কি চলে গেছেন?

মলিনা হাসিমুখে বলল, ভাইজান ছাদে। বিরাট গফ চলতাছে। খালুজান এমন গফ দিতাছে, আমি অবাক মানছি। যান দেইখা আসেন। দেখলে মজা পাইবেন।

মদিনা কোথায়?

দরজা বন কইরা বসা। খালুজান কফি চাইছে, আমি মদিনারে বললাম, যা কফি দিয়া আয়। সে বলল, যামু না। আমি বললাম, যাবি না কেন? তুই ভূতের সাথে পীরিত করতে পারবি আর মেহমানের সামনে যাইতে পারবি না।

রূপা নিজের ঘরে ঢুকল। ঘরের কোনায় মদিনা চুপচাপ বসে আছে। তার মাথা নীচু। রূপা বলল, কোনো সমস্যা মদিনা?

মদিনা না সূচক মাথা নাড়ল।

রাশেদ সাহেবকে দেখেছ?

হুঁ।

 

উনি মানুষ কেমন?

মানুষ কেমন আমি তো আফা বলতে পারি না।

মদিনা তোমার সঙ্গে আজ রাতে আমি আলাদা করে বসব। তোমাকে দেখে কেন জানি মনে হচ্ছে তুমি কিছু বলতে চাচ্ছ। বলতে পারছ না।

আফা চা খাবেন? চা আইন্যা দেই?

চা খাব না। বাবাকে ডেকে নিয়ে আস।

মদিনা বলল, আমি ছাদে যাব না আফা।

যাবে না কেন?

মদিনা চুপ করে রইল।

তুমি কি কোন কারণে রাশেদ সাহেবের সামনে যেতে চাচ্ছ না?

মদিনা এই প্রশ্নেরও জবাব দিল না। অন্যদিকে তাকিয়ে রইল।

 

হারুন তাঁর রহস্য খাতা খুলেছেন। রহস্যময় যেসব খবর পত্রিকায় ওঠে তিনি তার পেপার কাটিং জমা করেন।

হারুন রহস্য খাতা রাশেদের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, রাশেদ! এই ছেলেটাকে দেখ–বালক পীর। সপ্তাহে একদিন সন্ধ্যা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত সে যাকে যা বলে তাই হয়। নাম ওসমান। বাবা দিনমজুর। আমি গিয়েছিলাম দেখতে। হাজার হাজার মানুষ। ভিড় ঠেলে এগুতে পারলাম না।

ব্যাপারটা কি আপনার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়?

আমার উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ এবং না। জগৎ রহস্যময় এটা তুমি মান, না-কি মান না?

রাশেদ বলল, আমার উত্তরও হ্যাঁ এবং না। একইসঙ্গে রহস্যময় আবার রহস্যময় না।

হারুন বললেন, আমার এখানে মদিনা নামের একটা মেয়ে আছে। তার নাম আমি দিয়েছি ঘড়ি-কন্যা। সে হল জীবন্ত ঘড়ি।

আপনার কথা বুঝতে পারছি না।

ধীরে ধীরে বুঝবে। একদিনে সব জেনে ফেললে হবে না। মেয়েটা সম্পর্কে রাজশাহীর দৈনিক প্রভাতে কি লিখেছে পড়ে দেখ, আমি আরেক দফা কফির কথা বলে আসি। না-কি চা খাবে?

আপনি যা খাবেন। তাই খাব।

টক দৈয়ের শরবত খাবে? টক দৈ, গোল মরিচ আর লবণ ব্লেন্ডারে দিয়ে বানানো হয়। সঙ্গে থাকে এক ফালি কাঁচামরিচ আর এক চিমটি ধনেপাতা। গ্রাসের উপর দুই ইঞ্চি পরিমাণ কুচি বরফ। এক চামচ চিনি।

শুনেই তো খেতে ইচ্ছা করছে।

সমস্যা একটাই, রূপা ছাড়া কেউ বানাতে পারে না। সে ফিরেছে কি-না কে জানে। দেখি ব্যবস্থা করি। হারুন ব্যস্ত ভঙ্গিতে নেমে গেলেন। তার এই ব্যস্ততা দেখার মতো।

বসার ঘরেই রূপাকে পাওয়া গেল। হারুন বললেন, দুটা টক দৈয়ের শরবত। কুইক।

রূপা বলল, বাবা বসো তো।

এখন বসতে পারব না। রাশেদের সঙ্গে অত্যন্ত জরুরি একটা আলাপ করছি। তুই শরবতটা বানিয়ে ছাদে পাঠানোর ব্যবস্থা কর।

শরবত বানানো যাবে না। ঘরে টক দৈ নেই।

ড্রাইভারকে পাঠা। নিয়ে আসবে।

রূপা বলল, বাবা! তুমি বসো। তোমার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে। রাশেদ সাহেবের সঙ্গে আলাপের চেয়েও আমারটা জরুরি।

বল।

তুমি বস তারপর বলব।

তুই এত ঝামেলা করিস কেন? জরুরি কথা বসে শুনতে হবে? অতি জরুরি কথা শুয়ে শুনতে হবে? আচ্ছা যা বসলাম।

রূপা বলল, বাবা শোন। রাশেদ নামের মানুষটাকে আমরা কেউ চিনি। তার বিষয়ে কিছুই জানি না। তুমি প্রথম দেখাতেই তাকে কোলে নিয়ে বসে আছ এটা কি ঠিক হচ্ছে?

হারুন বললেন, কোনো একজন মানুষকে আমার পছন্দ হাতে পারবে না?

পাঁচ মিনিটের পরিচয়ে হতে পারবে না।

পঞ্চাশ বছরের পরিচয় লাগবে? তোর মার সঙ্গে এগারো বছরের পরিচয় ছিল। তাকে চিনতে পেরেছি?

বাবা! তুমি লজিক গোলমাল করে ফেলছ।

আমাকে লজিক শিখাবি না। স্টুপিড মেয়ে।

রেগে না গিয়ে আমার কথা মন দিয়ে শোন। তুমি উঁচু তারে বাধা একজন মানুষ। কাউকে অতি দ্রুত পছন্দ হওয়া এবং অতি দ্রুত অপছন্দ হওয়া তোমার চরিত্রের অংশ। এটা ঠিক না।

কাকে অতি দ্রুত অপছন্দ করলাম? সুলতান চাচাকে।

যে ছাগলা একটা কথা চারবার করে বলে তাকে অপছন্দ করতে পারব না?

তাঁর এই স্বভাবের পরেও তাঁর সঙ্গে তোমার গভীর বন্ধুত্ব ছিল। পরপর দুদিন না দেখলে তুমি অস্থির হয়ে যেতে।

মূল কথাটা বল। রাশেদের সঙ্গে আমি কথা বলতে পারব না। এইটাই তো মূল কথা?

মূল কথা হচ্ছে তোমার ভোলাটাইল নেচার চট করে অপরিচিত একজনকে দেখিও না। সে তোমার নেচার বুঝতে পারবে না। তোমাকে নিয়ে মনে মনে হাসবে। আমোদ পাবে। তোমার কর্মকাণ্ডে কেউ আমোদ পাবে এটা আমার পছন্দ না।

হারুন উঠে দাঁড়ালেন। কঠিন গলায় বললেন, তুই কি মনে করে অচেনা অজানা একজনকে বাড়িতে এনে তুলেছিস এটা বল। তুই নিজেই তো তাকে এ বাড়িতে কোলে করে এনেছিস। আমি আনি নি।

রূপা বলল, বাবা। উনি আমার উপর রাগ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে ঝড়বৃষ্টিতে পড়ে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিলেন। আমি অপরাধ বোধ থেকে তাঁকে এ বাড়িতে এনেছি। তিনি সে রাতে ডিনার না করে চলে গিয়েছিলেন। আমি তাঁকে ডিনার করাব। তিনি যে ঠিকানায় যেতে গিয়ে ভুল করে আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন আমি নিজে তাকে সেই ঠিকানায় পৌঁছে দেব। রাতে ডিনারের পরপর এই কাজটা করা হবে।

এত দেরি করে লাভ কি? এখনি লাথি দিয়ে বের করে দে। যেখানের জিনিস সেখানে চলে যাবে।

বাবা। তুমি আবার ছেলেমানুষি শুরু করেছ।

হারুন বললেন, আমি ছেলেমানুষ তাই ছেলেমানুষি করছি। তুই বুড়ি, তুই করবি বুড়ি মানুষী। যা আমি তার সঙ্গে বাস করব না।

কোথায় যাবে?

বনে জঙ্গলে চলে যাব। গাছের ডালে ঝুলে থাকব। ক্ষুধা লাগলে গাছের পাতা খাব।

হারুন হন হন করে সদর দরজা খুলে রাস্তায় নেমে গেলেন।

রূপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাতের ডিনারের আয়োজন করতে গেল। রাশেদ নামের মানুষটার পরোটা মাংস খেতে মন চাইছে। ঝাল মাংস সঙ্গে বিসকিটের মতো পরোটা।

 

ছাদে আলো নেই। বাড়ির চারপাশের গাছপালার কারণে অন্ধকার গাঢ় হয়েছে। রাশেদ চৌবাচ্চার পাশে বসে ছিল। টক দৈয়ের শরবতের অপেক্ষা। হারুন ফিরছেন না। মনে হয় শরবত বানানোর প্রক্রিয়া জটিল। সময় লাগবে। রূপার বাবাকে রাশেদের ভাল লেগেছে। তার নিজের বাবা খানিকটা এ রকমই ছিলেন। রাশেদের মা বলতেন, মানুষ ক্যামনে চিনবি বলব?

ঘোড়া চিনি কানে
রাজা চিনি দানে
মেয়ে চিনি হাসে
পুরুষ চিনি কাশে।

ভাল জাতের ঘোড়া কান দেইখা চিনতে হয়। রাজা কত বড় তার পরিচয় হয় তাঁর দানে। মেয়েদের চেনা যায় তাদের হাসি দিয়ে। আর পুরুষ চিনতে হয় তার কাশিতে।

রাশেদ বলেছিল একজন পুরুষ মানুষ কাশবে সেই কাশির শব্দে বোঝা যাবে সে কেমন পুরুষ!

হুঁ। কাশ হইল তার গলার আওয়াজ। মানুষের গলার আওয়াজই তার পরিচয়।

হারুন নামের মানুষটার গলার আওয়াজ মোটেই ভাল না, কিন্তু মানুষটা ভাল এতে কোনো সন্দেহ নেই। রাশেদ ছাদের গাছপালা দেখছে। ছাদে বাগানের সুযোগ আমেরিকার নেই। আমেরিকার আকাশ থেকে বরফ পড়ে। বাংলাদেশের আকাশ থেকে পড়ে বৃষ্টি। গাছপালার প্রাণদায়িনী বৃষ্টি।

ড্রাম কেটে একটা কাগজি লেবুর গাছ লাগানো হয়েছে। গাছভর্তি লেবু। কি সুন্দর দৃশ্য। গাছটার একটা ছবি তুলে রাখা দরকার। গাছ নিয়ে রাশেদের মার ছড়া আছে–

আমড়া গাছে আম হয় না
কাঠাল গাছে কলা
তেঁতুল গাছে জাম হয় না
হয় না ত্রিফলা।

রাশেদ গাছ থেকে একটা লেবু ছিঁড়ল। Fresh Lemon Smell Purifies Thc Heart. লেবুর ঘ্রাণ নিয়ে হৃদয় শুদ্ধ করা যাক। রাশেদ ঘ্রাণ নিল।

অন্ধকারে ছাদে ঘুরছেন। এই যে রুফ গার্ডেন সুইচ। বাতি জ্বেলে দেই?

রূপার কথায় রাশেদ হঠাৎ চমকে উঠল। কেন চমকালো সে নিজেও বুঝতে পারল না।

মানুষের প্রতিটি কার্যের পেছনে কারণ থাকে। চমকানোর পেছনের কারণটা কি? এমন কি হতে পারে অন্ধকারে রূপার গলার স্বর অন্য রকম শুনাচ্ছে। দিন রাত্রির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের গলার স্বর বদলায়।

রাশেদ বলল, বাতি জ্বালাতে হবে না। অন্ধকারে হাঁটতে আমার ভাল লাগছে। আপনার বাবা কোথায়?

আমার উপর রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন।

কি সর্বনাশ!

রূপা বলল, সর্বনাশের কিছু না। মাসে একবার আমার উপর রাগ করে বাবা বাড়ি ছেড়ে চলে যান। ঘণ্টাখানিক পর ফিরে আসেন। বাবার সঙ্গে অনেকক্ষণ আলাপ করলেন। বাবাকে কেমন লাগল?

রাশেদ বলল, ছড়া দিয়ে বলি–

কলমে কায়স্থ চিনি
গোঁপে রাজপুত
ভাল মানুষ সেই হয়
যার কলিজা মজবুত।

আপনার বাবার কলিজা মজবুত।

রূপা বলল, অদ্ভুত ছড়া কোত্থেকে শিখেছেন?

রাশেদ বলল, আমার মার কাছ থেকে। সবকিছু নিয়ে তাঁর ছড়া আছে।

রূপা বলল, আরেকটা ছড়া বলুন তো?

রাশেদ বলল, গলা নাই গান গায়। বৌ নাই শ্বশুর বাড়ি যায়।

বাহ্ সুন্দর তো। আপনার মা কি আপনার সঙ্গে থাকেন?

না। তিনি নেত্রকোনা জেলার বাইরে কোনদিন যাননি।

বেঁচে আছেন?

না।

আপনার বাবা বেঁচে আছেন?

জানি না।

জানেন না মানে কি?

রাশেদ বলল, আমার বাবা খানিকটা আপনার বাবার মতো। তিনি মার সঙ্গে রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতেন। তাঁর রাগ সহজে পড়ত না। এমনও হয়েছে দুমাস ফিরেন নি। আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন একবার রাগ করে বাড়ি ছাড়লেন আর ফিরেন নি। মনে হয় এখনো রাগ কমেনি। বাবাকে নিয়ে অনেক গল্প আছে যদি কোনদিন গুনতে চান শুনাব।

অবশ্যই শুনব। রান্না হয়ে গেছে। আপনি যখন খেতে চান বলবেন টেবিলে খাবার দিতে বলব। বাবা গাড়ি নিয়ে যান নি। গ্যারাজে গাড়ি আছে। ডিনার শেষ করে গাড়ি নিয়ে রুনাদের বাড়ি খুঁজে বের করবেন।

তাড়িয়ে দিচ্ছেন না-কি?

রূপা বলল, না। যেটা শোভন সেটা করছি। আমাদের এখানে কেন থাকবেন।

পেইং গেস্ট হিসেবে থাকব।

আমরা পেইং গেস্ট রাখি না। এই কথায় আবার রাগ করে ঐ রাতের মতো না খেয়ে চলে যাবেন না। আপনি গোশত পরোটা খেতে চেয়েছিলেন। মাংস আমি নিজে রান্না করেছি। পরোটা তৈরি আছে। খেতে বসলেই মলিনা ভেজে দেবে।

রাশেদ বলল, আপনি আপনার বাবার মতো না। আপনি আমার খুব পরিচিত একজনের মতো। আপনার স্বরও তার মতো। প্রথম দিন ধরতে পারিনি। আজ ধরতে পেরে চমকে উঠেছি।

রূপা বলল, তার নাম কি রূপা ব্যানার্জি?

রাশেদ অবাক হয়ে বলল, কীভাবে বললেন?

রূপা বলল, আমি থট রিডিং জানি না। প্রথম দিনই তার কথা আপনি বলেছিলেন। মনে হয় ভুলে গেছেন।

হ্যাঁ, মনে পড়েছে আমি বলেছিলাম।

রূপা বলল, যার বাসায় যাচ্ছেন রুনা যার নাম, তিনি কে?

রাশেদ বলল, আমার স্ত্রী।

ছাদ অন্ধকার। আলো থাকলে দেখা যেত রূপা চমকে উঠেছে। তার মুখ হঠাৎ রক্তশূন্য হয়েছে। যদিও তার কোনো কারণ নেই। রূপা এই মানুষটার প্রেমে পড়ে নি। তার তিনটা স্ত্রী থাকলেও রূপার কিছু যায় আসে না। রূপা বলল, খাবার কি দিতে বলব?

বলুন।

আমি কিন্তু আপনার সঙ্গে খেতে বসব না। বাবার জন্য অপেক্ষা করব। অতিথি একা খাবে এটা অভদ্রতা, আগেই ক্ষমা চাচ্ছি।

রাশেদ বলল, আমার কোনো অসুবিধা নেই। আমি মলিনার সঙ্গে গল্প করতে করতে খাব।

রাশেদ বলল, আপনার কাছে পরোটা খেতে চেয়েছিলাম। এখন ত খেতে ইচ্ছা করছে, ভাত কি আছে?

অবশ্যই আছে। ভাত খেতে ইচ্ছা করলে ভাত খাবেন।

আমার বাবার প্রিয় খাবার ছিল ধোঁয়া ওঠা ভাতের উপর দুই চামচ ঘি। তার সঙ্গে ভাজা শুকনা মরিচ। আপনাদের রান্নাঘরে কি ঘি আছে?

আছে। খুব ভাল পাবনার ঘি আছে। আসুন খেতে বসুন। যেভাবে খাবার গল্প করছেন মনে হয় আপনার খুব ক্ষিধা পেয়েছে। কোক আনিয়ে রেখেছি। আপনারা যারা আমেরিকায় বাস করেন তারা খাওয়া শেষ করেই সোড় খেতে চান। ভাল কথা, আপনারা কোককে সোডা কেন বলেন?

রূপা! আমি জানি না।

রূপা আবারও চমকালো। মানুষটা এত সহজে তাকে রূপা ডাকল কেন?

রূপা ব্যানার্জির কারণে? ডেকে ডেকে অভ্যাস?

 

বাড়ির নাম মঞ্জুরী।

চারতলা বাড়ি। গেটে বাগান বিলাসের ঝাড়। গেটের দারোয়ান রাশেদকে ঢুকতে দিচ্ছে না। দারোয়ান রাশেদের কথা জানিয়ে ইন্টারকম করেছিল। বাড়ির মালিক দেওয়ান সাহেব বলেছেন, গেস্টকে বল সকালে আসতে। আমার শরীর ভাল না, জ্বর।

রাশেদ বলল, উনার সঙ্গে কথা না বললেও চলবে। তার মেয়ে রুনার সঙ্গে কথা বলব।

দারোয়ান বলল, আপনি অপেক্ষা করেন আপার সাথে কথা বলে দেখি।

রাশেদ অপেক্ষা করছে। রাতের আকাশে মেঘ। ঘন ঘন বিজলি চমকাচ্ছে। আজ বৃষ্টি নামলে ভেজা যাবে না। আবার হাসপাতাল। আবার দুঃস্বপ্ন।

গেট খুলছে। দারোয়ান বলল, গাড়ি ভেতরে ঢুকবে না।

রাশেদ বলল, আমি যে ঢুকতে পারছি এতেই খুশি।

 

রাশেদ বসার ঘরে অপেক্ষা করছে। ঘরের সাজসজ্জা খানিকটা উগ্র। একটার সঙ্গে আরেকটার মিল নেই। পাথরের অর্ধ নগ্ন নারীমূর্তির পাশে থালাভর্তি প্রাস্টিকের ফলমূল। দেয়ালে কামরুল হাসানের পেইনটিং আছে। অতি কুৎসিত ফ্রেমে চমৎকার একটা ছবি। সমুদ্রে পানি হাঁটু পর্যন্ত ড়ুবানো একটা মেয়ের ছবি আছে। এই মেয়েটা রুনা। রুনার অনেকগুলি ছবি রাশেদের কাছে। মেয়েটার মুখ শান্ত। চোখে স্বপ্ন আছে।

রুনার বাবা দেওয়ান সাহেব ঢুকলেন। রাশেদ উঠে দাঁড়াল।

তুমি রাশেদ?

জী।

ছবিতে দেখেছি। হকির চেহারা এবং সামনা-সামনি চেহারা এক না। বসো।

রাশেদ বসলো। তার কাছে দৈওয়ান সাহেবকে মোটেই অসুস্থ মনে হচ্ছে। তবে ভয়ংকর বিরক্ত মনে হচ্ছে। দেওয়ান সাহেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, আমরা একটা ভুল করে ফেলেছি কাটা আর বাড়াতে চাচ্ছি না। তোমাকে আগেই জানানো হয়েছে। তারপরেও কেন এসেছ বুঝলাম না। দ্য গেম ইজ ওভার।

রাশেদ বলল, আমি রুনার সঙ্গে পাঁচ মিনিট কথা বলে চলে যেতাম।

তার সঙ্গে কি কথা বলবে। সে ভয়ংকর আপসেট। টেলিফোনে বিয়েতে সে শুরু থেকে রাজি ছিল না। আমিও ছিলাম না। কু-পরামর্শে কাজটা করেছি। ছেলে রাজপুত্র, PhD, ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। What a shame.

রাশেদ চুপ করে আছে। ভদ্রলোক প্রচণ্ড রেগেছেন। হাতের সিগারেটে দুটা টান দিয়ে ফেলে দিয়ে নতুন সিগারেট ধরিয়েছেন। ভদ্রলোকের রাগ কমার আগে কথা বলা অর্থহীন।

রাশেদ শোন, তুমি রসগোল্লা পান্তুয়া যাই হও না কেন, তুমি মূলত স্ট্রিট বয়। ভুল বললাম, তার চেয়েও খারাপ। তোমাকে ডাস্টবিনে পাওয়া গেছে। সারারাত ডাস্টবিনে পড়েছিলে। তোমার ফুসফুস এই কারণেই নষ্ট।

রাশেদ বলল, কথাগুলি আপনাকে যে জানিয়েছে সে ভুল জানিয়েছে। এটা আপনাকে আগেও বলেছি, এখনো বলছি।

তুমি কি অস্বীকার কর যে তোমার লাংস নষ্ট না?

লাংস ক্ষতিগ্রস্ত এটা ঠিক আছে। পরের কথাগুলি ঠিক না।

রূপা ব্যানার্জি নামে যে মেয়েটার সঙ্গে তুমি লিভ টুগেদার করতে এটাও ভুল?

জী ভুল।

বাঙালি মেয়ে না?

হ্যাঁ, কোলকাতার মেয়ে।

একটা বাঙালি মেয়ে জেনেশুনে এত বড় অপবাদ মাথায় নিয়ে বলবে সে তোমার সঙ্গে লিভ টুগেদার করত এবং তোমাদের একটা মেয়ে আছে তিন বছর বয়স। তার নাম নিহি।

রাশেদ বলল, আপনি অত্যন্ত উত্তেজিত অবস্থায় আছেন। তিন মিনিটে চারটা সিগারেট ধরিয়েছেন। একজন উত্তেজিত মানুষকে কিছু বোঝানো যায় না। আপনাকে বোঝাতেও চাচ্ছি না।

দেওয়ান সাহেব বললেন, আমার কথা শেষ হয় নি। কথা শেষ হোক তারপর ফড়ফড় করবে।

অবশ্যই। কথা শেষ করুন।

টেলিফোনের বিয়ে কোনো বিয়ে না। এর আইনগত কোনো ভেলিডিটি নেই। আমরা এই বিয়ে স্বীকার করছি না।

রাশেদ বলল, কোনো সমস্যা নেই। আমি বিয়ে বজায় রাখার চেষ্টা করতে আসি নি।

তাহলে কি জন্যে এসেছ?

রুনা আমাকে জঘন্য একজন মানুষ ভাবছে এটাই খারাপ লাগছে। আমি নিশ্চিত সে চমৎকার কোনো ছেলেকে বিয়ে করে সুখে জীবন কাটাবে। তবে কখনো কখনো তার মনে হবে টেলিফোনে বিয়ে করে কি ভুলই না করেছিলাম। প্রথম স্বামী ছিল ভয়ংকর। এটা তাকে কষ্ট দিবে। আমি তাকে কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলাম। সে যদি জানে তার প্রথম স্বামী খারাপ মানুষ ছিলেন তাহলে তার কষ্ট কম হবে।

প্রথম স্বামী, প্রথম স্বামী করছ কেন? তোমার সঙ্গে কি রুনার বিয়ে হয়েছে? টেলিফোনে বকর বকর করা মানে বিয়ে না। তোমরা এখনো চাক্ষুষ কেউ কাউকে দেখনি। যাই হোক আমার কথা শেষ। এখন বিদেয় হও। ফর ইওর ইনফরমেশন, এই মাসের আঠারো তারিখ আমার মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। জামাই লেফটেনেন্ট কর্নেল।

রাশেদ বলল, আমি কি তাকে বিয়ে উপলক্ষে একটা গিফট দিতে পারি।

তুমি গিফট দেবে কেন? তুমি কে?

রুনার কাছে আমি একবার জানতে চেয়েছিলাম দেশে যখন আসব তখন তোমার জন্যে কি আনব? সে বলেছিল একটা লাই ডিটেক্টর আনতে। তার এক বান্ধবীর আছে। সবাই এটা নিয়ে মজা করে। আমি একটা লাই ডিটেক্টর তার জন্যে এনেছি। খেলনা ভার্সান। গাড়িতে আছে। নামিয়ে দিয়ে যাই?

তুমি লাই ডিটেক্টর নিয়ে বিদায় হও। এই ডিটেক্টরে নিজের মিথ্যাগুলি ধরার চেষ্টা কর। ভুল ইনফরমেশন দিয়ে বিয়ে করার জন্যে আমি যে তোমাকে পুলিশে দিতে পারি এটা জান? পুলিশের এডিশনাল আইজি রুনার বড় মামা।

রাশেদ উঠে দাঁড়াল। বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছে। সে হোটেলের সন্ধানে বের হবে, না চায়ের দোকানে রাতের জন্যে আশ্রয় নেবে তা বুঝতে পারছে না। আচ্ছা গাড়ি চলতে শুরু করুক তারপর চিন্তা করা যাবে। কমলাপুর রেল স্টেশনে গেলে কেমন হয়? রাতে যদি কোনো ট্রেন পাওয়া যায় সেই ট্রেনে করে নেত্রকোনা চলে যাওয়া। স্টেশনের নাম আঠারোবাড়ি। সে গ্রামের বাড়িতে উপস্থিত হল, আর একটা মিরাকল ঘটল। জগতে মিরাকল যে একেবারেই ঘটে না, তাও না। মাঝে মাঝে ঘটে। প্লেন ক্রাশ হয়েছে। প্লেনের দুশ আশিজন যাত্রীর সবাই মারা গেছে। একজন বেঁচে আছে, সতুর বছরের বৃদ্ধ। ব্যাংকের ক্যাশিয়ার। সংসারে কেউ নেই। বৃদ্ধ নিবাসে থাকে। মেয়েকে দেখতে গিয়েছিল। ফেরার পথে দুর্ঘটনা।

বৃদ্ধ ব্যাংকারের জীবনে যদি মিরাকল ঘটতে পারে তার জীবনেও ঘটতে পারে। সে বাড়িতে ঢুকে দেখল কুয়াতলায় এক বৃদ্ধ বসে আছেন। বৃদ্ধকে দেখে রাশেদ এগিয়ে গেল। স্বাভাবিক গলায় বলল, বাবা কেমন আছ? বৃদ্ধ বলল, তুই রাশেদ? কেমন আছিস? তোর মা গেল কই? মরে গেছে না-কি?

রূপাদের ড্রাইভার বলল, স্যার এখন কোথায় যাবেন?

রাশেদ বলল, প্রথম একটা পরিচিত চায়ের দোকানে যাব। এক কাপ চা খাব। তারপর রাস্তায় খানিকক্ষণ ঘুরব। ঘুরতে ঘুরতে চিন্তা করব কোথায় যাওয়া যায়। তোমাদের বাড়িতে ফিরে যেতে পারি আবার দেশের বাড়িতেও চলে যেতে পারি।

 

হারুন বাড়িতে ফিরলেন রাত এগারোটায়। রূপা দরজা খুলে দিল। হারুন বললেন, টক দৈ এনেছি। শরবত বানিয়ে দে।

রাশেদ সাহেব চলে গেছেন বাবা। তুমি খেতে চাইলে তোমার জন্যে বানিয়ে দেই।

আমাকে কিছু না বলে চলে গেল। রূপা বলল, তুমি ছিলে না। তুমি কখন ফিরবে তাও বলে যাও নি। টেবিলে খাবার দেয়া হয়েছে। খেতে এসো।

আমি খাব না।

বাবা! আমি তোমার জনো না খেয়ে অপেক্ষা করছি।

হারুন বললেন, you go to hell. বলেই হাতের টক দৈয়ের হাঁড়ি ছুড়ে ফেললেন।

বোম ফাটার মতো হাঁড়ি ভাঙার আওয়াজ হল। মলিনা রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে হারুনের রুদ্রমূর্তি দেখে ছুটে রান্নাঘরে ঢুকে গেল।

রূপা রাতে ঘুমুতে গেল না খেয়ে। অভুক্ত অবস্থায় ঘুম আসে না। বিছানায় শোয়ামাত্র রূপার চোখ বন্ধ হয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গেই টেলিফোনের শব্দে ঘুম ভাঙল। শায়লা টেলিফোন করেছেন।

তোর বাবা কি কাণ্ড করেছে জানিস।

বাবা অনেক কাণ্ডই করে। কোনটার কথা বলছ?

আজ রাতে আমার এখানে এসেছিল তুই জানিস?

না।

আমার আর টগরের বাবার আজ একটা বিশেষ দিন। ম্যারেজ ডে। আমরা ঠিক করেছি দুজনে ঘরোয়াভাবে দিনটা পালন করব। রাতে ঘরেই ক্যান্ডেল লাইট ডিনার। এ উপলক্ষে টগরের বাবা সাত হাজার পাঁচশ টাকা দিয়ে একটা শ্যাম্পেনের বোতল এনেছে ঢাকা ক্লাব থেকে। সব জলে গেছে।

শ্যাম্পেন খেতে পার নি?

কীভাবে খাব। তোর বাবা উপস্থিত। তাকে ভদ্রতা করে টগরের বাবা বলেছে, আসুন আমাদের সঙ্গে ডিনার করুন। সে সঙ্গে সঙ্গে বসে গেছে। তার সামনে তো আর আমরা ম্যারেজ ডে সেলিব্রেট করতে পারি না।

করলে অসুবিধা কি? বাবা তোমার আনন্দ শেয়ার করত। অন্যের আনন্দ বাবার মতো কেউ শেয়ার করতে পারে না। তোমাদের ডিনারের মেনু কি ছিল?

খাবার এসেছে ঢাকা ক্লাব থেকে। চিকেন স্টেক। দেশি কায়দায় প্রণ। বিফ আইটেম ছিল। ঘটনা শোন, চিকেন স্টেক এসেছে দুটা। মানুষ তিনজন। এখন আমি যদি আমারটা দিয়ে দেই টগরের বাবা অন্যকিছু ভেবে বসতে পারে। সমস্যাটা বুঝতে পেরেছিস?

সমস্যার সমাধান কীভাবে হল?

টগরের বাবা সমাধান করল। সে বলল, আমাকে চিকেন স্টেক কেন দিয়েছ? আমি ব্রয়লার চিকেন খাই না। সঙ্গে সঙ্গে বেকুবটা বলল, আমাকে দিয়ে দিন। ব্রয়লার চিকেনে আমার সমস্যা নেই।

রূপা বলল, মা শোন আমি জানি বাবা বোকা। কিন্তু তোমার মুখ থেকে বেকুব শব্দটা শুনে খারাপ লাগছে। আমি বাবাকে সামলাব, সে যেন আর কখনো তোমাকে বিরক্ত না করে। মা আমি টেলিফোন রাখছি। আমার মনটা ভাল না।

মন ভাল না কেন?

রূপা জবাব না দিয়ে টেলিফোন রাখল। বাবা খেয়ে এসেছে কাজেই তার না খেয়ে রাত পার করায় সমস্যা কিছু নেই। সে গলা উঁচিয়ে ডাকল, মদিনা? জেগে আছ?

জী আফা।

খাবার গরম কর। আমি খাব। মলিনাকে ডেকে তুলবে না। সে বকবক করে মাথা ধরিয়ে দিবে। পরোটা ভেজে দিতে পারবে না?

পারব।

আমি শুয়ে থাকব। সবকিছু রেডি করে আমাকে খবর দিবে। যদি দেখ আমি ঘুমিয়ে পড়েছি তাহলে আর আমাকে ডাকবে না।

 

রূপা খেতে বসেছে। পাশেই মদিনা দাঁড়িয়ে আছে।

আগ্রহ নিয়ে রূপার খাওয়া দেখছে। সে হঠাৎ রূপাকে চমকে দিয়ে হাসি মুখে বলল, ভূতটা চইলা গেছে।

রূপা বলল, ভাল খবর। চলে গেল কেন?

উনারে দেইখা খুবই রাগ হইছে, তারপর চইল্যা গেছে।

রাশেদ সাহেবকে দেখে?

রূপা বলল, ভয় পেয়ে চলে গেল কেন? উনি কি ভূতের ওঝা?

মদিনা জবাব দিল না। রূপা নিঃশব্দে খাওয়া শেষ করল। হাত ধুতে ধুতে বলল, তুমি বলেছিলে উনি হাসপাতালে। কাকতালীয়ভাবে তাকে হাসপাতালে পাওয়া গেল। এ থেকে প্রমাণিত হয় না যে তুমি ভবিষ্যৎ বলতে পারি। আমার কাছে অনেকবার মনে হয়েছে আজ সুলতান চাচা আসবেন। তিনি এসেছেন তাতে প্রমাণিত হয় না যে আমি ভবিষ্যৎ বলতে পারি। বুঝেছ?

তুমি কি বলতে পারবে রাশেদ সাহেব এখন কোথায় আছেন?

জী।

আমি হঠাৎ হঠাৎ বলতে পারি, সব সময় পারি না। একটা মেয়ে আইসা আমারে যখন বলে তখন বলতে পারি। মেয়েটা পানিতে থাকে।

জলকন্যা?

জানি না আফা।

শোন মদিনা। যারা মৃগী রোগী তাদের যখন এটাক হয় অর্থাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে, ফিটের মতো হয় তখন তারা অনেক কিছু দেখে। আমার নিজের ধারণা তোমার এই রোগ আছে। আমাকে মনে করিয়ে দিবে কাল তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।

জী আচ্ছা।

কাল তোমাকে স্কুলেও ভর্তি করিয়ে দেব।

আফা মেয়েটার শইল নাই। খালি মাথা। মাথা ভর্তি চুল। চোখের মণি অনেক বড়। শাদা অংশ নাই বললেই চলে।

কোন মেয়ে?

যে আমারে ঘটনা বলে।

রূপা বলল, কাল তোমাকে যখন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব তখন তাকে এইসব বলবে। আমাকে এইসব বলার দরকার নাই। টিভিটা ছাড়। আমার ঘুম কেটে গেছে। কিছুক্ষণ টিভি দেখব।

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে মঙ্গলগ্রহের পানির সম্ভাবনা নিয়ে ছবি দেখাচ্ছে। রূপা আগ্রহ নিয়ে দেখছে। কম্পিউটার গ্রাফিক্সের তৈরি করা মঙ্গলের কিছু কাল্পনিক ছবিও দেখালো। লাল পাহাড়ের দেশে দুটি চাঁদ উঠেছে। জোছনার কি অপূর্ব খেলা। রূপা ঠিক করে ফেলেছে তার পরবর্তী ছবির নাম

মঙ্গলগ্রহে জোছনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *