সত্যান্বেষী
০১.
অন্য সময় হলে নগরীর এই বিশেষ স্থানে এখন খুব একটা আলো দেখা যেত না। কেমন যেন একটা প্রায়ান্ধকার পরিবেশ। দু-চারটি ঘরে অবশ্যই প্রদীপের আলো চোখে পড়ত। এমনকী দু-চারজন রাজপুরুষকেও দেখা যেত। দেখা যেত–তারা ঘর খুলে জরুরি কাজকর্ম সারছেন। প্রদীপের মৃদু আলোয় কখনও মদনসেনা বা বসন্তমঞ্জরীর মতো সুন্দরী সাধারণীর মৌক্তিকামবদ্ধ চিকুর মাঝে মাঝে উদ্ভাসিত হয়ে উঠত ওইসব রাজপুরুষের ঘরে। তবে এখন সে রকম নয়। অন্য সময় হলে সন্ধ্যার এই প্রথম প্রহরেও নগর-কোটালের নজরদারি এবং হুঁশিয়ারি এমন পর্যায়ে পৌঁছত যে, প্রয়োজনে আসা অস্থায়ী গৃহবাসীরা কোটালের কর্তব্যজ্ঞানে যতখানি খুশি হতেন, তার থেকে বেশি আহত বোধ করতেন।
আজ কিন্তু সেরকম নয়। নগরীর এই অংশের সর্বত্র আজ রাজপুরুষের গতায়াত। নগরীর কেন্দ্রস্থলে যে সভাগৃহটি রয়েছে, তাতে আজ প্রচুর আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক, যুক্তি-কুযুক্তির অবতারণা করে সভাসদেরা নানা উন্মাদনা সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু ফল হয়নি কিছু। এই সভাগৃহের প্রাণপুরুষ আজ অনুপস্থিত; তিনি ঝটিতি সভাগৃহে এসেই চলে গেছেন। সভাসদরা তাঁকে নিয়েই এতক্ষণ আলোচনা করছিলেন এবং এই আলোচনা হবে জেনেই তিনি হয়তো চলে গেছেন।
নগরীর প্রান্তে রাজার এই সভাগৃহ খুব পুরনো নয়, এমনকী নগরীটিও নতুন। মথুরা রাজ্যের একনায়ক কংস যখন বেঁচে ছিলেন, তখনও এই নগরীর প্রতিষ্ঠাই হয়নি। কংস মারা গেলে তার দুই স্ত্রী অস্তি এবং প্রাপ্তি বিধবার বেশে প্রবেশ করলেন মগধরাজ্যে।
মগধরাজ জরাসন্ধ কংসের শ্বশুরমশাই। কৃষ্ণের হাতে জামাই কংসের অপমৃত্যু ঘটায় তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে মথুরা আক্রমণ করেন। মথুরা রাজ্যের শাসন এবং নিয়ন্ত্রণ তখন মূলত কৃষ্ণের হাতেই ছিল। কংস মারা যাবার পর তার বৃদ্ধ পিতা উগ্রসেনকে কারাগৃহ থেকে মুক্ত করে এনে মথুরার সিংহাসনে বসিয়েছিলেন কৃষ্ণ। জামাই কংসের এই অপমান এবং মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য জরাসন্ধ মথুরা আক্রমণ করেন। একবার-দুবার নয়, অন্তত উনিশ বার।
কৃষ্ণের সঙ্গে সরাসরি জরাসন্ধের লড়াই দু-তিনবারের বেশি হয়নি। কিন্তু তাতেই কৃষ্ণ বুঝে গিয়েছিলেন যে, জরাসন্ধের সঙ্গে লড়াই অত সহজসাধ্য নয়। ভারতবর্ষের প্রায় সমস্ত রাজারাই জরাসন্ধের শাসনাধীন। তার সম্মিলিত বাহিনীর সামনে যাদব-বৃষ্ণিদের চতুরঙ্গিণী সেনাও অতি দুর্বল প্রতিপক্ষ। কৃষ্ণ তাই তাঁর নিজের আত্মীয়স্বজন এবং কংসপিতা উগ্রসেনের পরমাত্মীয় পরিজনদের সবাইকে ডেকে বললেন–আমাদের জ্ঞাতিগুষ্টি এবং পরিবার যেমন বেড়ে গেছে, তাতে এই মথুরাপুরীর মতো ছোট্ট জায়গায় আমাদের আর স্থান সংকুলান হয় না। তা ছাড়া জায়গাটাও এমন অরক্ষিত যে, শত্রুরাও বড়ো সহজে এখানে প্রবেশ করে–ইয়ঞ্চ মাথুরী ভূমিরপ্পা গম্যা পরস্য তু। অতএব কৃষ্ণ যখন মথুরা নগরী ছেড়ে অন্য কোথাও যাবার প্রস্তাব করলেন, তখন যাদবদের জ্ঞাতিগুষ্টি সকলেই একবাক্যে রাজি হলেন। কৃষ্ণের ব্যবস্থা সব পাকা। তিনি পূর্বাহেই গরুড়কে জায়গা খুঁজতে বলেছিলেন। গরুড় কৃষ্ণের ভৃত্য এবং সারথি। এই মানুষটি ভারতবর্ষের আদিম-সমাজের কেউ হবেন। ইনি একটি পাখির মুখোশ ব্যবহার করেন কখনও বা পাখির ডানাও। নির্বিষ সাপ অথবা সর্পজাতীয় সরীসৃপ তার খাদ্যের মধ্যে পড়ে। কৃষ্ণ এই ভৃত্যটিকে পরম বিশ্বাস করেন এবং গরুড়ও তার প্রভুর জন্য করতে না পারেন এমন কোনো কাজ নেই। গরুড় এসে কৃষ্ণকে বলেছিলেন–আপনার কথামতো ভূমি অন্বেষণ করতে করতে যে জায়গাটা আমার শেষ পর্যন্ত পছন্দ হয়েছে, সেটি কুশস্থলী। এই প্রদেশের চারদিকেই প্রায় সমুদ্র। পূর্ব ও উত্তর দিকের জমি কিছু ঢালু এবং শীতল। এই জায়গাটা মনোমতো করে সাজিয়ে নিলে জরাসন্ধের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবার আদর্শ জায়গা হবে সেটা। গরুড়ের পছন্দ করা জায়গা কৃষ্ণের পছন্দ হল। এবার সবাইকে বোঝাতে হবে। মুশকিল হল, মথুরার অধিপতি উগ্রসেন নামেই রাজা। তাকে সব সময়ই প্রায় গণতান্ত্রিক নিয়ম মতে চলতে হয়। আসলে যাদবদের জ্ঞাতিগুষ্টির মধ্যে এমন কতকগুলি বড়ো মানুষ ছিলেন, যাঁদের প্রত্যেকেরই একেকটা দল ছিল। তা ছাড়া যাদবদের মূল বংশ পুত্র-পৌত্র-পরম্পরাক্রমে ভেঙে ভেঙে চার-পাঁচটি বড়ো গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। এই একেকটি গোষ্ঠীর নাম ছিল সংঘ। ভোজ বৃষ্ণি, অন্ধক, কুকুর-যদুবংশের এইসব বড়ো বড়ো সংঘ মুখ্যের নামেই এখনও এই গোষ্ঠীগুলি পরিচিত।
মথুরাপুরীর ঠিকানা পালটানোর জন্য সমস্ত সংঘমুখ্যদের ডেকে কৃষ্ণ অনুমতি চাইলেন। তারা সব একবাক্যে কৃষ্ণের কথায় সায় দিলেন। মথুরাপুরীর সমস্ত লোক কুশস্থলীতে উপস্থিত হবার আগেই উপযুক্ত স্থপতিকে দিয়ে সেখানে রাজসভা তৈরি করালেন কৃষ্ণ। রাজসভা থেকে অশ্বগতির দূরত্বে কতকগুলি ছোটো ছোটো বাসভবন নির্মিত হল। সেখানে প্রয়োজনীয় সময়ে ভোজ, বৃষ্টি, অন্ধকদের সংঘমুখ্যরা এসে রাত্রিবাস করবেন এবং নির্ধারিত আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন। আপনারা জানেন, আজও সেই সভা বসেছিল। উত্তাল সভায় জোর আলোচনা চলছিল কৃষ্ণকে নিয়েই। কৃষ্ণ সভাগৃহ ছেড়ে এসেছেন বেশ খানিকক্ষণ স্থানীয় আবাসে ফিরে আসার পর ভৃত্য তাকে জানাল–শৈনেয় সাত্যকি এসেছিলেন।
-কতক্ষণ?
–তা, অর্ধ প্রহরকাল হয়ে গেছে।
–তিনি এখন কোথায়?
–পুনরায় সভাগৃহে ফিরে গেছেন। সভাগৃহ ছেড়েই তিনি এসেছিলেন এখানে। তবে তিনি বলে গেছেন–তিনি আবার আসবেন, সভার কার্যকাল শেষ করে।
.
০২.
কুশস্থলীর এই জায়গাটার নতুন নামকরণ হয়েছে দ্বারকা। আর যে সভাগৃহে আজ উত্তরঙ্গ আলোচনা চলছে কৃষ্ণকে নিয়ে, সেই সভাগৃহের নাম সুধর্মা। সভায় তাঁকে নিয়ে যে আলোচনা চলছিল তাতে অস্বস্তি বোধ করছিলেন কৃষ্ণ। আলোচনার অর্ধপথেই তিনি সভাগৃহ থেকে বেরিয়ে এসেছেন। কিন্তু সোজাসুজি সুধর্মার প্রাঙ্গণে অবস্থিত স্থানীয় আবাসে ফিরে আসেননি তিনি। তাঁর মন আজ বড়ো বিষণ্ণ।
দ্রুতগতি অশ্বে আরোহণ করে তিনি দ্বারকার কেন্দ্রস্থলে চলে এসেছেন। এখানে তাঁর পিতা বসুদেবের গৃহ। পিতৃগৃহের অদূরেই তাঁর নিজস্ব ভবন। বসুদেবের গৃহের সামনে তিনি অশ্বের গতি কমালেন, বাড়ির সামনে এসে ঘোড়াটিকে বেঁধে রাখলেন একটি স্তম্ভের সঙ্গে। বাড়ির বাইরে থেকেই রমণীকণ্ঠের চাপা হাসির শব্দ তার কানে এল। বুঝলেন–অন্তৰ্গহে রুক্মিণীর কাছেই কেউ এসেছে। কৃষ্ণের হাতে সময় বেশি নেই। রুক্মিণীর সঙ্গে একটু দেখা করেই তিনি চলে যাবেন। অন্তগৃহে রুক্মিণীর ঘরে ঢুকতেই রুক্মিণী যেমন কৃষ্ণকে দেখে অবাক হলেন, তেমনই কৃষ্ণ অবাক হলেন অপরা রমণীকে দেখে। রমণীর বয়স আঠারোর বেশি নয়। কৃষ্ণ তাঁকে চেনেন বটে, তবে নানা কারণে বেশি ঘনিষ্ঠতার চেষ্টা করেন না।
রুক্মিণীই এখনও পর্যন্ত কৃষ্ণের একমাত্র মহিষী। মথুরায় থাকাকালীনই। বিদর্ভদেশের এই অসামান্যা রমণীর সঙ্গে তার বিবাহ হয়েছে। স্বামী ছাড়া রুক্মিণী কিছু বোঝেন না। শোনা যায়, বৈদভী রমণীরা অসম্ভব সুন্দর কথা বলেন। স্বভাব এবং বাক্যের বিদগ্ধতা তাদের এত বেশি যে, কবিরা বলে থাকেন–বিদর্ভসুন্দরীরা কোন কাজে ‘হ্যাঁ’ বলছেন, আর কোন কাজে না’ বলছেন, তা ভালো করে বোঝা যায় না।
কিন্তু ভারী আশ্চর্য, বিদর্ভের সেরা সুন্দরী হওয়া সত্ত্বেও রুক্মিণী বড় সরল প্রকৃতির মানুষ, বড় সহজও বটে। এমনকী কৃষ্ণের সামান্য পরিহাস-বাক্যও তিনি এমন সরলভাবে বিশ্বাস করেন যে, কৃষ্ণই অবাক হয়ে যান। অবাক হয়ে ভাবেন–এই সুকুমারমতি রমণীই একদিন তাকে গোপনে চিঠি লিখে প্রেম নিবেদন করেছিলেন। এও সম্ভব! কৃষ্ণ একদিন এই বিদর্ভ-নন্দিনীকে বলেছিলেন–বিদর্ভের স্বয়ংবর-সভায় কত বড়ো বড়ো রাজা-মহারাজারা তোমার পাণিপ্রার্থী ছিলেন। তুমি তাদের ছেড়ে কেন যে আমার মতো এক পরান্নপ্রতিপালিত সাধারণ মানুষকে বিয়ে করলে তা ভাবলে অবাক লাগে। এইটুকু শুনে রুক্মিণীর খারাপ লাগলেও তিনি কোনো প্রত্যুত্তর করেননি। কিন্তু পরিহাসপ্রিয় কৃষ্ণ আরও বলেছিলেন–তুমি বরঞ্চ আরেকটা বিয়ে করো রুক্মিণী। বেশ একটা সম্পন্ন রাজার ঐশ্বর্যশালী পুত্রের সঙ্গে তোমার বিয়ে হোক। তুমি কত সুখে থাকবে। কত ভোগ, কত বিলাসের উপকরণ পাবে তুমি। পরিহাস বেশিদূর এগোতে পারেনি। রুক্মিণী অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। পরম প্রিয় কৃষ্ণের জায়গায় অন্য কাউকে স্বামী কল্পনা করাটা তাঁর পক্ষে এতই অসম্ভব। রুক্মিণীর সঙ্গে এতদিন সংসার করে কৃষ্ণও বুঝেছেন–একমাত্র এই পরম বিশ্বস্তা রমণীটিই তাঁকে নিষ্কলুষভাবে শ্রদ্ধা করেন। তাঁর যে কোনো দোষ থাকতে পারে, নিত্য অথবা নৈমিত্তিক কোনো কর্মে তার যে কোনো ত্রুটি ঘটতে পারে–এ তিনি বিশ্বাসই করেন না। কৃষ্ণের বিষণ্ণতার দিনে তার মনের কষ্ট যখন চরমে ওঠে, তখন যেন এই শ্রীময়ী রমণীর ব্যক্তিত্ব মাতৃত্বের সর্বংসহ রূপ ধারণ করে। কৃষ্ণ সেই কারণেই সভাগৃহ ছেড়ে এখানে এসেছেন।
কৃষ্ণকে দেখা মাত্রই রুক্মিণী শশব্যস্তে তার পরম প্রিয় স্বামীর কাছে এসে দাঁড়ালেন। পরম রমণীয়তায় তার হাতখানি ধরে বললেন–আর্যপুত্র! এমন অসময়ে? আপনার সভাগৃহের কাজ কি শেষ হয়ে গেছে? রুক্মিণীর ঘরে যে অন্যতরা রমণীটি আছেন, কৃষ্ণ সে বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন। কৃষ্ণকে। দেখা অবধি সে রমণীর হাসি আরও বেড়েছে। কৃষ্ণকে উত্তর দেবার সুযোগ না দিয়েই সে বলে উঠল—
বউরানি! তুমি ওঁর ফিরে আসার কারণ বুঝতে পারনি? তোমার মতো এক অনুপমা সুন্দরীকে বাড়িতে রেখে রাজসভার ওই বুড়ো উগ্রসেনের দাড়িওয়ালা মুখ, অক্রমশায়ের ক্রুর চিৎকার–এসব কি ভালো লাগে নাকি? কৃষ্ণ রমণীর কথার কোনো উত্তর দিলেন না। তার মন আজ বিক্ষিপ্ত আছে। অন্যদিকে এসব কথায় কৃষ্ণ কী ভাববেন, সেই ভাবনায় রুক্মিণী বলে উঠলেন–
–তুই থামবি? আর্যপুত্র! আপনার শরীর ঠিক আছে তো?
অপরা রমণী আবার উত্তর দিল–ঠিক ছিল না, এই তোমাকে দেখেই ঠিক হল। এই অষ্টাদশী রমণীটিকে কৃষ্ণ আজকাল রুক্মিণীর ভবনে মাঝে মাঝে দেখতে পান। রমণী অতিশয় সুন্দরী এবং লোক পরম্পরায় কৃষ্ণ জানেন যে, এই রমণীটির জন্য যাদব-বৃষ্ণি কুলের অনেকেরই হৃদয় বিগলিত। রমণীর কথার সূত্র ধরেই কৃষ্ণ জবাব দিলেন
–কথাটা একেবারে মিথ্যে বলনি। রুক্মিণীকে দেখে সত্যিই ভালো লাগছে। তবে তোমার কাছে আমার একটা জিজ্ঞাসা আছে–অক্রমশায়ের চিৎকারটা আমার কাছে ক্রুর লাগতেই পারে, তোমার কাছেও কি তাই? রমণী লজ্জা পেল। কৃষ্ণের কথার কোনো উত্তর দিল না সে। ওই একটি কথাতেই রমণী সাময়িকভাবে স্তব্ধ হল। অবশ্য তার ভাব-ভঙ্গি দেখে এমন মনে হল না যে, সে চুপ করেই থাকবে। একটু সময়ের জন্য সে পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে রুক্মিণী ভবনের মর্মর-প্রস্তর বৃথাই খুঁড়ে চলেছিল বটে, কিন্তু মাঝেমাঝেই সে চঞ্চলভাবে কৃষ্ণ এবং রুক্মিণীকে লক্ষ করতে লাগল। কৃষ্ণ রুক্মিণীকে উদ্দেশ করে বললেন–
–আচ্ছা রুক্মিণী! তোমার বিয়ের সময় সেই যখন তুমি ভবানী মন্দিরে পুজো দেবার জন্য বিদর্ভ নগরের উপান্তে এসে দাঁড়িয়েছিলে, সেই দিনটার কথা তোমার মনে আছে? রুক্মিণী পুলকে বিস্ফারিত হয়ে বললেন
সেদিনের কথা কি ভোলা যায়, আর্যপুত্র। বিদর্ভের রাজসভায় সেদিন কত রাজা-মহারাজারা উপস্থিত। শিশুপাল-জরাসন্ধরা আমাকে নিয়ে পিতা ভীষ্মকের সঙ্গে দরবার করছেন। আর সেই সময়ে আমি সখীদের নিয়ে ভবানী মন্দিরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
–আর আমি কেমন তোমার সখীদের অবাক করে দিয়ে তোমাকে চুরি করে নিয়ে এলাম বিদর্ভ থেকে।
একটু হেসে কৃষ্ণ আবার বললেন–আচ্ছা! এই ঘটনার পর থেকে তুমিও কি আমাকে চোর ভাব, রুক্মিণী! যেমন শিশুপাল ভাবেন, জরাসন্ধ ভাবেন, তুমিও কি তাই ভাব, রক্মিণী! কৃষ্ণের কথার ধরন দেখে রুক্মিণী একটু অবাক হলেন। তার প্রিয় স্বামীটি তো এত গম্ভীরভাবে কথা বলেন না কখনও। রুক্মিণী অবশ্য নিজের স্বভাব অনুযায়ী বলে চললেন–
–সেদিন আমাকে যদি তুমি চুরি না করতে, তাহলে যে সিংহের যোগ্য ভাগ শৃগালের ভোজ্য হত। তা ছাড়া চুরি কীসের? তোমার সঙ্গে সমবেত রাজাদের যুদ্ধ হয়েছিল। জ্যেষ্ঠ বলরাম স্বয়ং যুদ্ধ করেছিলেন। ওরা তো সব হেরে পালিয়েছিল। এর মধ্যে আবার চুরি কোথায়?
আগন্তুক রমণী এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবারে সুযোগ পেয়ে বলল
–তবু, তবু এটা চুরি। আর চোর বলে তোমার বেশ নাম আছে ঠাকুর! তোমার ছোটোবেলার গল্প শুনেছি যথেষ্ট। তোমার চুরির জ্বালায় বৃন্দাবনের বৃদ্ধারা অতিষ্ঠ হয়ে তোমার পালিকা জননীর কাছে নালিশ জানিয়েছিলেন। তারপর ব্রজপুরের যুবতী রমণীদের কথাও শুনেছি, তুমি তাদের বসন….
–তুই থামবি? রুক্মিণী চেঁচিয়ে উঠলেন। ও বড় প্রগলভা হয়ে উঠেছে, আর্যপুত্র। ওর কথায় কিছু মনে কোরো না।
রুক্মিণী কপট রাগে পরিচিতা রমণীর দিকে তাকিয়ে বললেন–
–দাঁড়া, তোর ব্যবস্থা করছি। আজই তোর বিয়ের জন্য কথা বলতে যাব আমি।
রমণী বলল–আমার বিয়ে? যিনি আমায় বিয়ে করতে আসবেন, তাকে যে তোমার আর্যপুত্রের কাছে চুরি তালিম নিতে হবে আগে। তারপর তো?
.
০৩.
দীপকর একটু আগেই কৃষ্ণের ঘরে একটি তৈলপুর প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। প্রদীপের আলো একটু বেশিই লাগছে যেন। কৃষ্ণ দীপকরকে বললেন–প্রদীপ স্তিমিত করো। দীপকর প্রদীপের বর্তিকার অগ্রাংশ তেলের ভিতর ডুবিয়ে দিতেই প্রদীপের আলো মৃদু হল। কৃষ্ণ আপন শয্যায় হস্তোপধানে অর্ধশায়িত হয়ে কী যেন চিন্তা করতে লাগলেন। ঠিক এই সময়ে গৃহভৃত্য কৃষ্ণকে এসে জানাল
–প্রভু! হার্দিক শতধন্বা এসেছেন আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য।
–শতধন্বা। তার তো আসার কথা ছিল না। তুমি তো বললে–সাত্যকি এসেছিলেন এবং আবারও তিনি আসবেন? কই সে তো এল না! যাই হোক, হঠাৎ শতধন্বা কেন এখানে এল–তা তো বুঝতে পারছি না। তার তো এখনও সুধর্মা সভাতেও আসার এবং বসার বয়স হয়নি?
কৃষ্ণের এতগুলি উচ্চকণ্ঠ স্বগতোক্তি শুনে ভৃত্য কিঞ্চিৎ বিব্রত হল। সে বলল–
–আমি কি তাকে বারণ করব এখানে আসতে? কৃষ্ণ লজ্জিত হয়ে বললেন, না না, বারণ করবে কেন? নিয়ে এসো তাকে। শতধম্বা এক কিশোর বালক। কৃষ্ণেরই জ্ঞাতিবংশের ধারায় তার জন্ম। আত্মীয়তার সম্বন্ধে একটু দূরগত হলেও যদু-বৃষ্ণিদের রক্তের টানে কৃষ্ণ একে খুব দূরের লোক ভাবেন না। বিশেষত এর দাদা কৃতবর্মা একজন সংঘমুখ্য। তিনি সুধর্মা সভায় আলোচনাচক্রে যোগও দিয়েছেন। কিন্তু শতধন্বা কৃতবর্মার ভাই হলেও বয়সে কিশোর। এখন এই সন্ধ্যার অন্ধকারে কোথা থেকে কী কারণে সে এখানে এসে উপস্থিত হল–কৃষ্ণ ধারণা করতে পারছেন না।
শতধন্বা ঘরে প্রবেশ করেই সহাগত ভৃত্যের দিকে মাঝে মাঝে তাকাতে লাগল। কৃষ্ণ বুঝলেন–শতধন্বা গোপন কথা বলতে চায়। ভৃত্যকে চলে যেতে বললেন কৃষ্ণ। ভৃত্য চলে যেতেই কৃষ্ণ শতধন্বকে বললেন–তোমাকে বড় ক্লান্ত দেখাচ্ছে, বৎস! শীতল পানীয় আনতে বলি?
শতধন্বা প্রত্যাখ্যান করে বললেন–আমার কিছু কথা আছে আপনার সঙ্গে। কৃষ্ণ বললেন–সে তো বুঝতেই পারছি। এখানে এখন মশা-মাছিও নেই। তুমি নিঃসঙ্কোচে বলো। শতধন্বা খুব তাড়াতাড়ি নিজের প্রসঙ্গে আসতে চাইলেন। কিন্তু তিনি যে কথা বলতে চাইছেন, তার জন্য কিছু ভণিতাও দরকার। নতুবা তার কথাটা খুব আকস্মিক এবং বিভ্রান্তিকর বলে মনে হতে পারে। শতধন্বা বললেন–আপনি আমার জ্যেষ্ঠভ্রাতৃতুল্য। একমাত্র আপনিই আমায় সাহায্য করতে পারেন।
কৃষ্ণ বললেন–কোনো যুদ্ধ-বিগ্রহের ব্যাপার কি, শতধন্ব? কাউকে দণ্ড দিতে হবে? অথবা তোমার পৈতৃক বিষয়-আশয় নিয়ে কি কৃতবর্মার সঙ্গে কোন…..! শতধন্বা মাঝপথেই কৃষ্ণকে থামিয়ে দিয়ে বললেন–সে সব কিছুই নয়, আর্য! আজ আমি দ্বারকাতেই ছিলাম। আর্যা রুক্মিণীর বাসগৃহের পার্শ্বপথ ধরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে দেখলাম সাত্রাজিতী সত্যভামা আর্যার গৃহ থেকে দ্রুত নির্গত হলেন। কিছুক্ষণ পরে আপনাকেও আমি নির্গত হতে দেখেছি।
–তাতে কী হল’-কৃষ্ণ অবাক হলেন। সে রুক্মিণীর সঙ্গে নর্মালাপ করতে এসেছিল। সুযোগ পেয়ে আমার সঙ্গেও খানিক রহস্যালাপ করে গেল। শতধন্বা বললেন–সে কি আমার কথা বলল, কিছু? এক মুহূর্তের মধ্যে কৃষ্ণ সব বুঝে গেলেন। ভাবলেন–একটু মিথ্যাচার করলে যদি এই কৈশোরগন্ধী যুবকের মন শান্ত হয়। কৃষ্ণ বললেন-না তেমন কিছু নয়, তবে সে জিজ্ঞাসা করেছে–শতধন্বাকে আমার কেমন লাগে? তা আমি বলেছি, খুব ভালো। মহামহিম হৃদিকের পুত্র, যোদ্ধৃশ্রেষ্ঠ কৃতবর্মার ভ্রাতা তো আর সাধারণ মানুষ হতে পারেন না।
শতধন্বা বড় খুশি হলেন। ওই রমণীর কথা তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু কৃষ্ণ কি সত্য কথা বলছেন? তার সন্দেহ হয়। শতধন্বা কৃষ্ণের কাছে অনুনয়ের সুরে বললেন–আমাকে একটি বিষয়ে কথঞ্চিৎ সাহায্য করবেন, আর্য! একমাত্র আপনিই পারেন আমার তৃষ্ণা মেটাতে। কৃষ্ণ বললেন–বলো বৎস! তোমার তৃষ্ণাটি কী আগে শুনি। শতধন্ব বললেন-তৃষ্ণা? বৈদগ্ধ্যের তৃষ্ণা, যদুবংশ-স্তম্ভিণী এক মোহিনী মায়ার তৃষ্ণা।
কৃষ্ণের দ্বারে আঘাত পড়ল আবার। শতধন্বার কথা শেষ হল না। দ্বারপাল জানাল–আর্য সাত্যকি এসেছেন। কৃষ্ণশতধন্বাকে বললেন–তোমার কথা বোধহয় আমি খানিকটা বুঝেছি। কাল যদি পরিপক্ক হয়, লগ্ন যদি অনুকূল হয়, তবে তোমার তৃষ্ণা মিটতেও বা পারে। তোমার সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন আছে। তুমি ধৈর্য ধরো।
শতধন্বা বিদায় নিলেন। সাত্যকির সঙ্গে তার দেখাও হল। সাত্যকি শতধন্বা আগমনের কোনো মূল্য দিলেন না। মৃদু হাস্য বিনিময় করে তিনি কৃষ্ণের কাছে উপস্থিত হলেন। কৃষ্ণ স্বাগত জানিয়ে বললেন–কী সংবাদ, সাত্যকি? তুমি একবার এসে ফিরে গেছ। রাজসভার জরুরি বিতর্ক ছেড়ে হঠাৎ তুমি চলেই বা এসেছিলে কেন?
–আমার সহ্যের সীমা অতিক্রান্ত হয়েছিল। আপনিই বা চলে এলেন কেন, আর্য?
-যে সভা আমার সম্বন্ধেই কথা বলতে চায়, যে সভায় আমার সম্বন্ধে কটুক্তি চলছে, সেখানে আমি উপস্থিত থাকলে আমার প্রতিপক্ষেরা কি মনপ্রাণ খুলে কটুক্তি করতে পারবে? তুমি কী বল?
–কিন্তু প্রাণখোলা সেই কটুক্তির প্রস্রবণ আমাদের কাছে কি খুব শ্রবণ-রসায়ন বলে আপনার মনে হয়?
–তা নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু তাদের মনে যা আছে, তাও সম্পূর্ণ উদগীর্ণ হওয়া প্রয়োজন। নইলে, উদরের অজীর্ণ বাষ্প তাদের কেবলই পীড়া দেবে। আমি সব সহ্য করতে পারি কিন্তু নিন্দুকের মুখে বাষ্প-স্তম্ভিত উদ্গার আমার কাছে অসহ্য মনে হয়। তার চাইতে বমন শ্রেয়।
সাত্যকি বুঝলেন, কৃষ্ণর অন্তরে ক্রোধ ঘনীভূত হয়েছে। অবশ্য স্নেহাস্পদ সাত্যকির সামনেই মনের ভাব যা একটু প্রকাশ করে ফেললেন তিনি। নইলে রাগ হলেই রাগ প্রকাশ করে ফেলার লোক তিনি নন। কৃষ্ণ যদুসভার আলোচনার প্রসঙ্গ টেনে সাত্যকিকে বললেন–তা আমায় নিয়ে কে কী বললেন একটু বলো।
সুমিত্র-সংঘের জ্যেষ্ঠ পুরুষ প্রসেনের মৃত্যুর দায় এখন আপনার ঘাড়েই পড়েছে।
–সে কী? তিনি তো বনের মধ্যে আকস্মিকভাবে নিহত হয়েছেন শুনেছি। সেখানে আমার কী করার আছে।
–শুধু হত্যাই নয়। মহামূল্য মণিটিও আপনিই চুরি করেছেন বলে দ্বারকার লোকেরা কানাকানি করছে এবং এই কানাকানি আপনার ভালোবাসার জ্ঞাতিগুষ্টির অপপ্রচারের ফলেই সম্ভব হয়েছে।
-কে এই অপপ্রচার করেছেন বলে তুমি মনে করো?
–আমার মনে করা-করিতে কিছু যায় আসে না। আমি গুপ্তচর নিয়োগ করে পূর্বাহেই খবর পেয়েছি, এই অপপ্রচারের মূলে আছেন অক্রূর।
–অক্রূর! তার স্বার্থ কী এখানে?
–সে কথা বারান্তরে জানাব। আপনার কাছে শতধন্বা কেন এসেছিল?
শতধন্বার প্রসঙ্গ আসা মাত্রই কৃষ্ণের গাম্ভীর্য লঘু হল। এই ছেলেটিকে কৃষ্ণের ভালো লেগেছিল। কৃষ্ণ মুখরভাবে বলে উঠলেন–আর বোলো না। কিশোর বালক। বাসন্তিক পুষ্পের মধু•তার মনে। এই বালক সত্রাজিতের কন্যারত্ন সত্যভামাকে ভালোবাসে।
সাত্যকি কৃষ্ণকে আর বেশি কথা বলার সুযোগ দিলেন না। বললেন–আপনি অক্রূরের স্বার্থের কথা জিজ্ঞাসা করছিলেন না আর্য? আপনাকে জানিয়ে রাখি–পৃষ্ণিবীর অক্রূরও সত্যভামাকে ভালোবাসেন।
কৃষ্ণ ভৃত্যকে ডেকে প্রদীপের আলো বাড়িয়ে দিতে বললেন। সাত্যকি বিদায় নেবার আগে জানিয়ে গেলেন–অক্রূরের কথা যখন বলেই ফেললাম, তখন বারান্তরে আরও একজনের কথা জানাব। কৃষ্ণ সাগ্রহে জানালেন তিনিও সাত্রাজিতী সত্যভামার প্রণয়ী নাকি? শিকার তো মাত্র একটিই, শিকারি অনেক মনে হচ্ছে।
সাত্যকি–আপনি এত কষ্টকর এবং পুরুষ উপমা দেবেন ভাবিনি। আপনিই তো পূর্বে শতধন্বার কথা বলতে গিয়ে বসন্তের মধুর কথা বলেছেন। তাই বলেছিলাম-বসন্ত একটি মাত্র পুষ্পের হৃদয়েই মধু সঞ্চিত করে ক্ষান্ত হয় না, সমস্ত পুষ্পের হৃদয়েই তার মধু দেওয়া থাকে। তবে বলুন, মধুকরী এখানে মাত্র একটিই, এবং শ্রুত আছি–মধুকরীর স্বভাব খুব চঞ্চল হয় না। কবে, কখন, কোথায় সে মধুচক্র রচনা করবে, সে তার নিজের ওপরেই বড় বেশি নির্ভর করে। আশা করি, আর্যা রুক্মিণীর ভবন সাত্রাজিতী সত্যভামার মধুসঞ্চয়ের ঠিকানা নয়?
কৃষ্ণ অবাক হয়ে চটুলভাবে বললেন–সাত্যকি! ধনুক-বাণ ছেড়ে তুমি কথঞ্চিৎ ভরতমুনির নাট্যশাস্ত্রে মন দিলে পারো। একটি টীকা রচনা তোমার পক্ষে একটুও অসম্ভব নয়।
সাত্যকি একটু অপ্রস্তুত হলেন। বিদায় নিলেন সঙ্গে সঙ্গে।
একটি বিশাল ফুকারে ‘হমধ্যবর্তী পূর্বোত্তেজিত তৈলপুর প্রদীপ নিভিয়ে দিতে চাইলেন কৃষ্ণ। প্রদীপের বর্তিকা ফরফর শব্দে আপত্তি জানিয়ে একবার মৃদু হল, একবার উত্তেজিত হল, শেষে পূর্বের মতোই সদর্পে জ্বলতে লাগল। কৃষ্ণ সুমিত্র-সংঘের দ্বিতীয় পুরুষ সত্রাজিতের গৃহে রওনা হলেন। তখন রাত্রি এক প্রহর হয়ে গেছে। হয়তো এত রাত্রে সত্রাজিতের বাড়িতে যাওয়া ঠিক হবে না।
.
০৪.
যে মানুষটির ওপর চুরির দায় এসে পড়ল, যে মানুষটির ওপর খুনের দায় চেপে গেল, সেই মানুষটি কৃষ্ণের মতো এক বিশাল ব্যক্তিত্ব বলেই পূর্বের ঘটনা একটু জানতেই হয়। অনেকেই জানেন-কৃষ্ণের জন্ম হয়েছে বৃষ্ণিবংশের ধারায়। কৃষ্ণের বৃদ্ধ প্রপিতামহ হলেন এই বৃষ্ণি। তিনি দুটি বিবাহ করেছিলেন। এক স্ত্রী গান্ধার রাজ্যের মেয়ে, অন্যজন মদ্রভূমির। এঁদের নামও তাই গান্ধারী এবং মাদ্রী। গান্ধারীর একমাত্র পুত্রের নাম সুমিত্র। কেউবা তাকে অনমিত্র বলেও ডাকেন। আমরা যে সত্যভামার কথা বলছিলাম, তিনি এই বংশেই জন্মেছেন এবং তার পিতার নাম সত্রাজিৎ। আর যিনি খুন হয়েছেন সেই প্রসেন হলেন সত্রাজিতের বড়ো ভাই।
বৃষ্ণির দ্বিতীয় স্ত্রী বহু পুত্রবতী ছিলেন। তাঁর প্রথম পুত্রের ধারায় অক্রূরের জন্ম। অক্রূরের পিতামহ পৃফির নামেই তার সংঘটি বিখ্যাত হয়েছে। কৃষ্ণ-বলরাম জন্মেছেন মাদ্রীর দ্বিতীয় পুত্রের বংশে। কৃষ্ণ-বলরাম শূর সংঘের জাতক আর মাদ্রীর তৃতীয় পুত্রের বংশে জন্মেছেন সাত্যকি, তার পিতামহ শিনির নামেই বিখ্যাত হয়েছে শিনি সংঘ বা শৈনেয়গণ। লক্ষণীয়, এঁরা পরস্পর পরস্পরের ভাই-বেরাদর, তবে সম্পর্কটা সামান্য দূরগত। বয়সটাও সবার একরকম নয়। এঁদের মধ্যে সবার বড়ড়া যদি হন অর, তবে সর্বকনিষ্ঠ হলেন সাত্যকি অথবা শতধন্বা। এক জায়গায় এরা সবাই বৃষ্ণি–কেননা, সত্যভামা বলুন আর অরই বলুন, কৃষ্ণই বলুন অথবা সাত্যকি–এঁদের সবারই বৃদ্ধ-প্রপিতামহ হলেন বৃষ্ণি। আর পূর্বে যে শতধন্বার কথা বললাম, তিনি জন্মেছেন স্বয়ং বৃষ্ণির নিজের দাদা অন্ধক বংশের ধারায়। শতধন্বার দাদার নাম কৃতবর্মা, মহাভারতের বিশাল যুদ্ধে তাঁর কথা স্মরণ করতেই হবে।
তবে যে সময়ের কথা আমরা এখন বলছি, তা ভারতযুদ্ধের অনেক আগের কথা। সত্যভামার পিতা সত্রাজিৎ একটি মহামূল্যমণি পেয়েছিলেন, যার নাম স্যমন্তক-মণি। পৌরাণিক উপাখ্যান অনুযায়ী সত্রাজিৎ সূর্যদেবের বন্ধু ছিলেন। একদিন সূর্যদেব সত্রাজিতের সামনে উপস্থিত হয়ে তাঁকে বর দিতে চাইলেন। দ্বারকার সমুদ্র-তীরে একাকী দণ্ডায়মান সত্রাজিৎ সূর্যের কাছে কোনো বর চাইলেন না। চাইলেন শুধু স্যমন্তক। সূর্যের দেওয়া স্যমন্তক মণির মালা গলায় দুলিয়ে সত্রাজিৎ যখন দ্বারকার পথে হেঁটে চললেন, তখন মনে হল যেন সূর্যদেবই পা ফেলেছেন ভঁয়ে।
পৌরাণিক কথকঠাকুর জানিয়েছেন–স্যমন্তক মণি নাকি প্রতিদিন আট ভার সুবর্ণ প্রসব করত। অর্থাৎ যে ঘরে এই মণি থাকবে, সে ঘরে অর্থসম্পত্তির অভাব থাকবে না একটুও। এমনকী যে রাজ্যে এই স্যমন্তক মণি থাকবে, সেই রাজ্যে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি এবং আর কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগও ঘটবে না। সত্রাজিৎ এই মণিটি এনে তার নিজের দাদা প্রসেনকে দিলেন ভালোবেসে। তবে তার এই ভালোবাসার মধ্যে স্বার্থ ছিল কিছু। কেন, সেটা বলি।
লোকপরম্পরায় তিনি জানতে পেয়েছিলেন–এই মণিরত্নের ব্যাপারে কৃষ্ণের কিছু কৌতূহল ছিল। সেটা স্পৃহা বা লোভও হতে পারে। অবশ্য কৃষ্ণ এই মণিটি চাইছিলেন দেশের রাজা উগ্রসেনের স্বার্থে। যে মণিরত্ন দেশের এবং দশের উপকার সাধনে সমর্থ, সেটি যদি রাজার কাছে থাকে, তবে দেশেরই তো উপকার। তার ওপরে কংসের মৃত্যুর পর উগ্রসেন বৃদ্ধ বয়সে নতুন করে রাজ্যের ভার নিয়েছেন। কৃষ্ণের ধারণা ছিল, মণিটি উগ্রসেনের কাছে থাকলে রাজা হিসেবে তার সুবিধে হবে। অন্যদিকে স্যমন্তক-মণির মতো উৎকৃষ্ট বস্তু তো দেশের রাজারই যোগ্য অথবা প্রাপ্য। যাই হোক, কাছের লোকজনের কাছে নিজের তর্ক-যুক্তি, একটু-আধটু প্রকাশ করে ফেলার ফলে সে কথা সত্রাজিতের কানেও এল। কংসহন্তা কৃষ্ণের গৌরব তখন চরমে উঠেছে, জরাসন্ধের বিশাল ব্যক্তিত্বকে ঠেকিয়ে রেখে সমস্ত যদুমুখ্যদের বিশ্বাসও তিনি অর্জন করেছেন। এহেন কৃষ্ণ যদি সত্রাজিতের কাছে স্যমন্তক মণি চেয়ে বসেন, তাহলে সত্রাজিতের পক্ষে না বলা সম্ভবই নয়। ঠিক এই রকম একটা বুদ্ধি করেই সত্রাজিৎ প্রসেনের কাছে মণি রাখতে দিয়েছিলেন। কৃষ্ণ যদি কোনো কারণে মণিটি চান তো সত্রাজিৎ বলবেন–ওটি তো দাদা প্রসেনকে দিয়েছি, কী করে আপনাকে দিই?অন্যদিকে কৃষ্ণ যদি প্রসেনের কাছেমণি চান তো তিনি বলবেন–ছোটো ভাইয়ের জিনিস। ভালোবেসে দিয়েছে। কী করে আপনাকে দিই। অর্থাৎ না দেবার যুক্তি সাজানোই ছিল।
সত্যি কথা বলতে কি, সুমিত্র-সংঘের প্রথম পুরুষ সত্রাজিতের দাদা প্রসেনের কাছে স্যমন্তক মণিটি কিন্তু চেয়েওছিলেন কৃষ্ণ। প্রসেন অবশ্যই দেননি। অন্যদিকে কৃষ্ণও জোর খাটাননি। হাজার হলেও এঁরা তার আত্মীয় স্থানীয়, এঁদের সঙ্গে পূর্ব পিতামহক্রমে তার রক্তের সম্পর্ক আছে। তার ওপরে আছে জনমত। যাদবদের মধ্যে সংঘমুখ্যরাই জনমত তৈরি করেন। প্রসেন এবং সত্রাজিৎ অন্ধবংশের প্রধান পুরুষ। কৃষ্ণ তাই জোর করেননি। জোর করলে তিনি মণি পেতেন জেনেও জোর করেননি।
কৃষ্ণ মণি না পেয়ে ফিরে গেলেন এবং মণির অধিকার নিয়ে আর মাথাও ঘামাননি। কিন্তু প্রসেনের নিজের অতিরিক্ত সতর্কতার কারণেই স্যমন্তক মণি নিয়ে নানা গণ্ডগোল পাকিয়ে উঠল।সর্বত্র শোনা গেল–প্রসেন মহামূল্য মণিটি গলায় দুলিয়ে মৃগয়ায় বেরিয়েছিলেন এবং একটি পাহাড়ের কাছে বনের মধ্যে তিনি খুন হয়ে গেছেন। মণি আর তার গলায় নেই এবং এদিক-সেদিক সেটি পড়েও নেই। পরিষ্কার খুন।
যাদবদের সমস্ত সংঘমুখ্যের কাছে প্রসেনের মৃত্যুর খবর পৌঁছল। প্রত্যেকে বলাবলি করতে লাগলেন–কৃষ্ণ এক সময় প্রসেনের কাছে মণিটি চেয়েছিলেন, প্রসেন দেননি। হয়তো সেই কারণেই আজ প্রসেনকে এইভাবে বেঘোরে বনের মধ্যে মারা যেতে হল। যদুকুলের প্রত্যেকেই কৃষ্ণের অসাধারণ রাজনৈতিক বুদ্ধি এবং তার কূট অভিসন্ধির বিষয়ে সচেতন ছিলেন। তারা বিশ্বাস করতেন, অন্যে যা পারেন, কৃষ্ণ তা নিশ্রুপে সাবহেলে করতে পারেন। এ খুনও কৃষ্ণই করেছেন এবং মণিটি যে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না, এর পিছনেও কৃষ্ণের কারসাজি আছে। ঠিক এই রকম একটা অবস্থায় যাদব সংঘমুখ্যদের জরুরি সভা বসেছে উগ্রসেনের নেতৃত্বে এবং কৃষ্ণের আত্মনিন্দার প্রসঙ্গে সভা উত্তাল হয়ে ওঠায় সে সভায় বসে থাকতে পারেননি। তিনি সভাশেষে যদুমুখ্যদের সিদ্ধান্তগুলি শুনতে চাইছিলেন। কিন্তু সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ হয়নি। কারণ কৃষ্ণের মতো এক বিরাট মানুষের ওপর অধিক্ষেপ রচনা করে যে সভা শুরু হয়, সে সভায় সিদ্ধান্ত হওয়া অত সহজ নয়। কিন্তু সভার বহুলাংশের মনোভাবটা কী–তা সাত্যকির মাধ্যমে কৃষ্ণের কানে এসেছে এবং আমরাও তা শুনেছি। কী অবস্থায়, কোন সময়ে হতভ্রাতৃক সত্রাজিতের কাছে কৃষ্ণ গেছেন, তা আমরা বলেছি। এইবার অন্যত্রও একটু দৃষ্টি দিতে হবে।
.
০৫.
অন্ধক-বৃষ্টি অথবা ভোজকুলের মধ্যে যত রমণী আছেন, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী হলেন সত্রাজিতের কন্যা সত্যভামা। যাদবদের রাজনৈতিক সামাজিক পরিমণ্ডলে সামান্য গণতান্ত্রিকতার স্পর্শ থাকায় এই সমাজের রমণীরাও ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশের রমণীদের চেয়ে খানিকটা উদারপন্থী এবং খানিকটা প্রগতিশীল। সত্যভামা অবশ্য সবার চেয়ে আরও এককাঠি এগিয়ে। পিতার আদরিণী কন্যা হওয়ার ফলে স্ত্রীসুলভ সংকোচ এবং ভয় তার মধ্যে একটু কম। খানিকটা স্বাধীনচেতা এবং খানিক প্রগলভাও বটে। দ্বারকার সংঘমুখ্যদের ভবনে তিনি একাকিনী যাতায়াত করেন এবং যাদব যুবকদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তিনি একাশবাহিত লঘু রথ তীব্র বেগে সঞ্চালিত করতে পারেন।
সত্যভামার সৌন্দর্যের মধ্যে এমনই এক উদ্দাম-মাধুর্য আছে, এমনই এক দীপ্র প্ররোচনা আছে, তাতে কোনো যুবক তার দিকে প্ৰেমনত নয়নে একান্তে তাকিয়ে থাকতে পারে না। তার মনের স্পর্শ পেতে হলে এমনই উচ্ছলভাবে তার সঙ্গে মিশতে হয়, তার নব যৌবনোদ্ধত বিচিত্র অত্যাচার এমনই সহিষ্ণুভাবে মেনে নিতে হয় যে, হয় সে যুবক এক মুহূর্তে সুন্দরী সত্যভামার দাসে পরিণত হয়, নয়তো অক্ষম ঈর্ষায় পলায়ন করে। অন্যদিকে, যে মুহূর্তে একটি যুবক তার দাসে পরিণত হয়, সেই মুহূর্ত থেকেই ওই যুবককে সত্যভামার আর পছন্দ হয় না। সেই যুবকের সমস্ত বৈচিত্র্য যেন ফুরিয়ে যায় তাঁর কাছে। সুন্দরী সত্যভামার প্রণয়প্রার্থী অনেক; তাদের মধ্যে অনেকে আবার সত্যভামার প্রেমের সঙ্গে সত্রাজিতের স্যমন্তক মণিটির জন্যও অত্যন্ত লালায়িত।
সত্যভামা এঁদের কাউকেই পছন্দ করেন না। তাবৎ পুরুষসমাজের ওপর তার এই নাসিকা-কুঞ্চিত ব্যবহার দেখে সত্রাজিৎ মনে মনে শঙ্কিত হন, কিন্তু তিনিও যে আপন কন্যাটিকে খুব ভালো করে বোঝেন, তা নয়। ভারী আশ্চর্য, পুরুষসমাজের কোনো যুবক তাকে কী বলল, তার উত্তরে তিনি কী বললেন, কীভাবে তিনি কার সপ্রেম আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন–এই সমস্ত কথা যার সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা করেন। সত্যভামা, তিনি তার সমবয়সি নন, কোনও সখীও নন। তার বয়স সত্যভামার চেয়ে অন্তত পাঁচ-ছ বছর বেশি। তিনি কৃষ্ণ-প্রেয়সী রুক্মিণী।
সত্যভামার উচ্ছল উদ্দাম ব্যবহার পরম প্রশ্রয়ে রুক্মিণী মেনে নেন। আর যখন একেবারেই সহ্য করতে পারেন না, তখন সমস্ত সমস্যার সমাধান হিসেবে একটিই কথা বলেন তিনি। বলেন–ওই আমারটির সঙ্গেই শেষ পর্যন্ত তোর বিয়ে দিতে হবে। নইলে তোর সঙ্গে কেউ এঁটে উঠতে পারবে না। সত্যভামা তখন রুক্মিণীকে ঠেস দিয়ে বলেন–তোমার স্বামীটি তো আবার বাগদত্তা কন্যাকে চুরি না করে বিয়েই করতে পারেন না। তা আমি ভাবছি-একজনকে আমিই কথা দেব এবং আমার ধারণা–অক্রূরমশাই এ ব্যাপারে সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি।
পৃষ্ণিবীর অক্রূরের ওপর রুক্মিণীর কিছু রাগ আছে। তিনি জানেন–অত্যাচারী কংসের দূত হয়ে তিনিই প্রথম কৃষ্ণকে বৃন্দাবন থেকে আনতে গিয়েছিলেন এবং তার স্বামীটিকে ঠেলে দিয়েছিলেন মৃত্যুর মুখে। এর মধ্যে যে অক্রূরের কিছু রাজনৈতিক চাল ছিল, সে সব কথা রুক্মিণী বুঝতে চান না, বুঝতে পারেন না। কংসের দূত হয়ে তার প্রিয় স্বামীটিকে অক্রূর কেন নিয়ে এসেছিলেন–একমাত্র এই অপরাধেই অক্রূর রুক্মিণীর কাছে এক পীড়াদায়ক মানুষ বলে পরিচিত।
রুক্মিণী যখন সত্যভামার মুখে অক্রূরের নাম শুনলেন, তখন তার একটু রাগই হল। কপট রাগ দেখিয়ে বলেও ফেললেন সে কথা–আর লোক পেলি না যাদবকুলে, ওই অর? ওঁর বয়স কত জানিস?
সত্যভামা বললেন–বয়স তো কী হয়েছে? আরও বেশি ভালোবাসবে। বৃদ্ধস্য তরুণীর প্রবাদটা জান না নাকি?
রুক্মিণী যেন বিশ্বাসই করে নিলেন সত্যভামার কথাটা। বললেন–যা, কথা দিয়ে দে? তবে কিনা, বুড়োমানুষ বর চাস তো, মহারাজ উগ্রসেনকেই বলে দেখতে পারিস। তিনি তো বৃদ্ধস্য বৃদ্ধ, তোকে আরও বেশি ভালোবাসবেন।
সত্যভামা বললেন–তিনি তো আর আমার কাছে কোনো মধুর প্রস্তাব করেননি। যিনি প্রস্তাব করেছেন, তাকে নিয়েই তো কথা বলব।
–সে কীরে? অক্রূরমশাই তোর কাছে বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছেন নাকি?
–দেননি আবার! সেদিন আমি ভ্রমণে বেরিয়েছিলাম। একা-একাই রথে চড়ে। ইচ্ছে ছিল, রৈবতক পাহাড়ের পথটা ভালো করে চিনব। হঠাৎ দেখি, পাহাড়ি পথ বেয়ে এক অশ্বারোহী আমারই পশ্চাতে আসছে।
–তুই ভয় পেলি না?
–ভয়ের কী আছে? সে রকম বিপদ দেখলে প্রেম নিবেদন করতাম, ভক্ষক তখনই রক্ষকে পরিণত হতেন।
–নিজের ওপরে তোর তো খুব বিশ্বাস? তা, সেই অশ্বারোহী কে? অক্রূরমশাই?
–আবার কে? তিনি আমার কাছাকাছি এসে প্রথমেই আমাকে গুরুঠাকুরের মতো রথচালনার বিজ্ঞান শেখাতে আরম্ভ করলেন। বললেন–উচ্চাবচ উদঘাতিনী ভূমিতে রথচালনা করার শিল্প এখনও তোমার রপ্ত হয়নি, সত্যভামা। দাঁড়াও, আমি তোমায় শিখিয়ে দিচ্ছি। এ কথা বলেই সেই যে তিনি আমার রথে চড়ে, আমার পাশে দাঁড়িয়ে, আমার অশ্বরশ্মি সংযমনের মুষ্টিবদ্ধ হাতখানির ওপরে নিজের মুষ্টি স্থাপন করে রথ চালাতে লাগলেন, আর সে মুষ্টি শিথিল হল না। এই প্রশিক্ষণ যেন খুবই প্রয়োজন ছিল।
–তা হলে আবার বাগদত্তা হবার কথা কী বলছিলি, এ তো পাণিগ্রহণ পর্যন্ত হয়ে গেছে।
–ব্যাকরণে ভুল করছ–একে পাণিগ্রহীতা বলে, পাণিগৃহীতী নয়।
–ওই হল। তা তারপর কী হল? রথ কি রৈবতক পর্বতের চূড়ায় গিয়ে থামল?
–ঠিক তা নয়। তবে তার রথচালনার শিল্পে এবং পাহাড়ি পথের গুণে তিনি এমনভাবেই আমার গায়ের ওপর এসে পড়ছিলেন যে, তাঁর রথচালনার শিল্প অতি সমৃদ্ধ বলে মনে হল। তবু জেনো এই শিল্পই তার শেষ কথা নয়।
রুক্মিণী অবাক হয়ে বললেন–শেষ কথার আগেই তো কর্মযোগ শুরু হল। এর পরেও আবার শেষ কথা কী রে!
সত্যভামা বললেন–অক্র মানুষটা যেন কেমন! কী যে তিনি চান, তা ভালো বোঝা যায় না। যে ব্যক্তি নানা উপায়ে আমার ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করছিল, সেই অক্রূর হঠাৎই আমাকে বললেন-হার্দিক কৃতবর্মার নাম তুমি শুনেছো, তাঁকে দেখেও থাকবে তুমি উৎসবে, যজ্ঞকার্যে, অথবা পথে কোথাও।
সত্যভামা অবাক হয়েছিলেন। মানুষটি ভালো না মন্দ, নাকি বিভ্রান্ত, অথবা বিকৃত-যে কিনা এক রমণীর অতিলঘু স্পর্শ লাভের জন্য হাতের ওপর হাত রাখছে অছিলায় সে আবার আরেক জনকে ডেকে আনছে। সত্যভামার এই সংশয়িত ভাব অক্রূর বুঝে ফেলেছিলেন বোধহয়। তিনি কৃতবর্মার গৌরব প্রকাশ করে বললেন–দেশ-বিদেশ থেকে অথবা যাদবদের অঙ্গরাজ্য থেকে সামন্ত রাজারা যদি যুদ্ধের সময় যাদবদের কাছে সামরিক সাহায্য চেয়ে পাঠান, তবে সাধারণত হৃদিকপুত্র কৃতবর্মাকেই সেনাপতি হিসেবে পাঠানো হয়।
অক্রূরের মুখে কৃতবর্মার কথা শুনে রুক্মিণীর যেন সব কিছু গুলিয়ে গেল।
ভাবলেন–কৃতবর্মাও তো আরেক প্রৌঢ়, তার আবার কী কথা থাকতে পারে এই অষ্টাদশী বালিকার কাছে। প্রৌঢ়দের মনেও যে রমণীর মন নিয়ে ভাবনা-চিন্তা থাকতে পারে, রুক্মিণী সে কথা যেন বিশ্বাসই করতে চান না। প্রদ্যুম্নের জননী হবার সঙ্গে-সঙ্গেই তার এমন একটা আলুথালু অবিন্যস্ত ভাব হয়েছে যে, তিনি ভাবেন–প্রৌঢ় পুরুষের মনে পুত্রের জন্য বাৎসল্য ছাড়া আর কিছুই থাকে না বা থাকা উচিত নয়।
অক্রূর সত্যভামাকে বলেছিলেন–হার্দিক্য কৃতবর্মা তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান, তোমাকে খুব আপন করে নিতে চান। সত্যভামা বলেছিলেন–তিনি তো যথেষ্ট আপনই আছেন। একজন বৃষ্ণিমুখ্য অন্ধক গোষ্ঠীর মুখ্য পুরুষকে তিনি যথেষ্ট আপনই ভাবেন। অক্রূর বললেন, তা ভাবুন। তবে তিনি সম্পর্কটা আরও গাঢ়তর করতে চান। অবশ্য রাজকন্যার সঙ্গে এখানে রাজ্যের অভিলাষটাও আছে।
এ কথার অর্থ?
অক্রূর বললেন, অর্থ খুব পরিষ্কার। সত্যভামার সঙ্গে স্যমন্তক মণি।
সত্যভামা রাগে জ্বলে উঠেছিলেন। স্যমন্তকের জন্য যাঁরা লালায়িত, সত্যভামা অন্তত তাদের আপন করে নিতে চান না, সম্পর্কও গাঢ়তর করতে চান না।
অক্রূর বললেন, তুমি ক্ষিপ্ত হচ্ছ কেন, সত্যভামা? এমন লোকও তো এই সপ্তদ্বীপা বসুমতীতে আছেন, যিনি স্যমন্তকের অধিকার ছেড়েও সত্যভামার জন্য লালায়িত হবেন। সত্যভামা বলেন, জানি। তার কথা জানি। অজাতগুম্ফ সেই বালক। শতধন্বা। হার্দিক কৃতবর্মার ছোটভাই শতধন্বা। কত পার্থক্য? তাই না?
অক্রূর নিজের কথা বলবেন বলে এতক্ষণ ভণিতা করে শেষ পর্যন্ত বিফল হলেন। শতধন্বা কথায় চলে আসায় তার নিজের বড় অসুবিধে হল। এখন কী বলবেন তিনি? শেষে এটা-সেটা সাত-পাঁচ ভেবে শতধন্বার প্রসঙ্গ টেনেই অক্রূর বললেন–কোনো সন্দেহ নেই। সে বালক আকাশকুসুম রচনা করছে মূর্খের মতো। তবে জেনো, তোমার প্রেমের জন্য গুম্ফের যদি একান্ত প্রয়োজন হয়, তবে উপরি হিসেবে শ্মশ্রুও দিতে পারি। ও দুটিই আমার আছে। স্যমন্তকের কোনো প্রয়োজন আমার নেই, আমি শুধু সত্যভামার অনুমোদন চাই। আর কিছু নয়।
সত্যভামা সব বুঝেছিলেন এবং অক্রকে তিনি বাড়তে দেননি। বলেছিলেন, আপনি যাদব-কুলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরুষ। মহারাজ কংসের আমলেও আপনি মন্ত্রী ছিলেন, আজ বৃদ্ধ উগ্রসেনেরও আপনি প্রবর মন্ত্রী। আমার মতো এক ক্ষুদ্র রমণীর ইচ্ছা এবং অভিলাষে আপনার কী আসে যায়? আমি পিতার অধীন। আমার অনুমোদনের চেয়েও তার অনুমোদনের মূল্য অনেক বেশি।
এক দণ্ডও বিলম্ব না করে অক্রূর বলেছিলেন, আমি সত্রাজিতের সঙ্গে দেখা করতে যাব অচিরেই। কিন্তু ওই দেখা করাটা আর সেইভাবে হয়ে উঠল না। তিনি এসেছিলেন বটে, তবে অন্য কারণে। সত্রাজিতের বাড়িতে তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা প্রসেনের মৃত্যুসংবাদ এসে পৌঁছল। সংবাদ এল–স্যমন্তক মণি চুরি হয়ে গেছে। যে মহামূল্য মণিটি রক্ষা করার জন্য সত্রাজিৎ মণিটি দাদার কাছে ন্যাস হিসেবে রেখেছিলেন, সেই মণিটিও গেল, তার সঙ্গে গেল সুমিত্র সংঘের জ্যেষ্ঠ পুরুষ, প্রসেনের প্রাণ।
খবর ছড়িয়ে পড়তে দেরি হল না এবং কৃষ্ণ যেহেতু দাদা প্রসেনের কাছে স্যমন্তক মণি চেয়েছিলেন, অতএব সত্রাজিৎ তাকেই প্রথম সন্দেহ করলেন। কন্যা সত্যভামা কৃষ্ণের ভবনে যাতায়াত করেন বলে তার সামনে এই সন্দেহ ব্যক্ত করতেও দ্বিধা করলেন না সত্রাজিৎ।
সত্যভামা নানা দিক থেকে জর্জরিত বোধ করলেন। একে জ্যেষ্ঠ-তাত প্রসেনের মৃত্যু, তার মধ্যে কৃষ্ণের ওপর এই সন্দেহ–দুয়ের দ্বৈরথে সত্যভামা বড় বিচলিত বোধ করলেন। কৃষ্ণের চুরিবিদ্যার ফিরিস্তি দিয়ে দিন-রাত তিনি তাঁর সঙ্গে রঙ্গ-রসিকতা করে এসেছেন। কিন্তু আজ যখন স্যমন্তক মণি চুরির দায় কৃষ্ণের ওপরেই এসে পড়ল তখন এ মানুষটার জন্য তার মায়া হল। যাদবদের সমস্ত গোষ্ঠীর ভালোর জন্য যিনি সব সময় নিজেকেও বিপর্যস্ত করেন, সেই মানুষটিকে জড়িয়ে এই চুরির অপবাদ সত্যভামাকে ক্ষণিকের জন্য বিহ্বল করে তুলল।
ক্ষীণ কণ্ঠে একবার সত্যভামা পিতা সত্রাজিৎকে বলেওছিলেন–তুমি আর কাউকে সন্দেহ করো না কেন, পিতা?
সত্রাজিৎ বলেছিলেন–আমার আপন হাতের উপার্জিত মণির ওপর আর কারও দৃষ্টি ছিল না। আমার এই আকস্মিক লাভে আর কারও চক্ষুর পীড়াও উৎপন্ন হয়নি। এক ওই কৃষ্ণ ছাড়া। সে আমাকে বলেছিল–মণিটি দেশের রাজাকেই মানায় ভালো। দাদা প্রসেনের কাছে সে মণিটি চেয়েও বসেছিল। এর পরেও আমাকে বুঝতে হবে–এটা কৃষ্ণের কাজ নয়? তুমি জান না বৎসে, কৃষ্ণ পারে না হেন কাজ নেই।
সত্যভামা অন্তরে অন্তরে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন। তিনি স্বয়ং অক্রমশায়ের কাছ থেকে খবর পেয়েছেন–কৃতবর্মা এই স্যমন্তক মণি চান। অক্রূরমশাই যে সরস প্রস্তাব করেছেন তার কাছে, তার পিছনেও স্যমন্তক মণির উদ্দেশ্য আছে বলে সত্যভামার ধারণা। কিন্তু এই সমস্ত ঘটনাবলি পিতার কাছে বলার সময় এটা নয়। কিন্তু পিতার মুখে কৃষ্ণের সম্বন্ধে এমন জঘন্য উক্তি তিনি শুনতে প্রস্তুত ছিলেন না। ছোটোবেলা থেকে কৃষ্ণের নানান কীর্তিকাহিনি শুনে শুনে তার অন্তরে কি কৃষ্ণ এক বীরের প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন। সত্যভামা পিতার কথা সহ্য করতে পারলেন না। একটু রাগত স্বরে বলে উঠলেন–
-কৃষ্ণ পারে না হেন কাজ নেই’–কথাটা বড় সহজ হয়ে গেল না পিতা?
–সহজই তো। দিন-রাত্রির মতো সহজ। জলধারার নিম্নগতির মতো সহজ।
-এতই সহজ যে, অত্যাচারী কংস যখন যদুকুলের সমস্ত সংঘমুখ্যদের পদানত করে রেখেছিলেন, তখন কার বুদ্ধিতে তোমরা কৃষ্ণের ছত্রছায়ায় একত্রিত হয়েছিলে! তিনি পারেন না হেন কাজ নেই, বলেই কংস নিহত হয়েছেন। তিনি পারেন না হেন কাজ নেই বলেই যাদবরা মথুরা ছেড়ে এসেছে এবং আজ তারই নির্মিত দ্বারকার সুধর্মা সভায় বসে তাঁকেই চুরির অপবাদ দিচ্ছে। তিনি পারেন না হেন কাজ নেই বলেই, আজও মগধরাজ জরাসন্ধ সসৈন্যে দ্বারকায় প্রবেশ করতে পারেননি। এহেন সব কাজ যিনি করেছেন, তারই তো স্যমন্তক মণি চুরি করা সাজে, তাই না?
সত্রাজিৎ লজ্জিত হলেন, একই সঙ্গে চমকিতও হলেন একটু। তার আদরিণী কন্যার মনে কৃষ্ণ যে এভাবে জায়গা করে নিয়েছেন, তা তিনি এমন করে বুঝতেও পারেননি।
আসলে কৃষ্ণের সম্বন্ধে সত্রাজিতের ধারণাটা বদ্ধমূল হয়েছে–অক্রূর তার বাড়িতে আসার পর থেকে। প্রসেনের মৃত্যুর পর অক্রূর তাকে সমবেদনা জানিয়ে বলেছিলেন–সুমিত্র-জ্যেষ্ঠ প্রসেনের মৃত্যুর সংবাদ আপনার কাছে সহনযোগ্য নয়, তা আমি বুঝি। তার মৃত্যুর সংবাদ আমার কর্ণগোচর হবার সঙ্গে সঙ্গেই আমি একটি বিশ্বস্ত লোককে হত্যার স্থানে। পাঠিয়েছিলাম। পাঠিয়েছিলাম এই কারণে যে, প্রসেন তো মারা গেছেনই, তাকে তো আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। তবে অন্তত মহামূল্য মণিটি যাতে আপনাকে ফিরিয়ে দেওয়া যায়, তো আমি সেই চেষ্টাই করেছিলাম।
অক্রূর সত্রাজিৎকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন–আমরা বৃষ্ণি-অন্ধক গোষ্ঠীর সকলেই প্রসেনের এই মৃত্যুতে অত্যন্ত দুঃখিত। কিন্তু ভারী আশ্চর্য-প্রসেনের হাতে মৃগ-শিকারের জন্য প্রয়োজনীয় তরবারি এবং ধনুক-বাণ ছিল। তৎসত্ত্বেও একটি সিংহ কী করে তাকে বধ করল, তা আমার বোধগম্য নয়। আর মণিটিও তো কোথাও নেই! নরমাংসে সিংহের লোভ থাকতে পারে বিলক্ষণ। কিন্তু একটি সিংহ তো আর স্যমন্তক মণি চর্বণ করবে না। আমাদের গভীর সন্দেহ–কোনো লুব্ধ ব্যক্তি, যিনি স্যমন্তক মণি অধিকার করতে চেয়েছিলেন, অথচ পাননি, তারই এই কাজ।
অক্রূরের এই কথার সঙ্গে সঙ্গেই সত্রাজিতের মনে কৃষ্ণের পূর্ব সংলাপ ক্রিয়া করতে থাকে–মণিটি দেশের রাজাকেই মানায়। এটি তারই প্রাপ্য হওয়া উচিত। অরের সন্দেহে সত্রাজিৎ প্রায় নিশ্চিত হয়ে যান–প্রসেনের হত্যা এবং মণিহরণ দুই-ই কৃষ্ণের কাজ। কিন্তু কৃষ্ণের সম্বন্ধে তার এই বদ্ধমূল ধারণা যাদবগোষ্ঠীর সর্বত্র কর্ণাকর্ণি হবার পরেও আজ তার নিজের মেয়ে কেন এইভাবে বলছে সেই ভেবে তিনি আশ্চর্য হলেন।
প্রসেনের মৃত্যু বা মণিহরণের পর যাদব গোষ্ঠীর অনেকের মধ্যে সত্রাজিতের জন্য নতুন মায়া দেখা দিল। অক্রূর তো এসেই ছিলেন। এসেছিলেন কৃতবর্মাও। এমনকী সেই শতধন্বাও এসেছিলেন অক্রূর এবং কৃতবর্মার অগোচরে। শতধন্বা অবশ্য সত্রাজিতের চাইতে সাত্রাজিতী সত্যভামাকেই সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন বেশি। কৃষ্ণ এতদিন আসেননি। তাঁর সম্বন্ধে সত্রাজিতের সন্দেহ, অন্যান্য যাদব সংঘমুখ্যদের সন্দেহ এবং সুধর্মা সভায় সকলের মন্তব্য শুনে তিনি সত্রাজিতের ভবনে স্বয়ং উপস্থিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
কৃষ্ণ যখন সত্রাজিতের কাছে উপস্থিত হলেন, তখন প্রভাতকাল। সুধর্মা সভার সাময়িক আবাস থেকে আগের রাত্রে তিনি বাড়ি ফিরেছিলেন। রাত্রি হয়ে যাওয়ায় রুক্মিণীর সঙ্গে তার বেশি কথা হয়নি। তাকে শ্রান্ত-ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। বৈদভী রুক্মিণী সেটাকে পথশ্রমের ক্লান্তি মনে করে তার স্নানাহারের ব্যবস্থা করেছেন শীঘ্র। চারদিকের সমস্ত কথাবার্তা যথাসম্ভব চেপে রেখে, যথাসম্ভব স্মিতহাস্যে রুক্মিণীকে সন্তুষ্ট করে কৃষ্ণ শয়ন করেছিলেন। পরের দিন প্রভাতের আলো ফুটতেই কৃষ্ণ প্রভাতকালীন স্নানাহ্নিক সেরে রুক্মিণীকে জানালেন তিনি সত্রাজিতের বাড়ি যাচ্ছেন। রুক্মিণী কৃষ্ণকে বললেন–তার যে বড় বিপদ। কৃষ্ণ বললেন–সেই কারণেই যাচ্ছি।
কৃষ্ণ যখন সত্রাজিতের ভবনে পৌঁছলেন, তখন বেলা দুই দণ্ড পার হয়ে গেছে। দ্বারী সযত্নে কৃষ্ণকে উপযুক্ত আসনে বসিয়ে সত্রাজিৎকে ডাকতে গেল। সত্যভামা পূর্বাহেই প্রাসাদের উপরিভাগ থেকে কৃষ্ণকে দেখতে পেয়েছেন। এবং কৃষ্ণও তাকে দেখেছেন। এখন এই মুহূর্তে একটি কথা-বলা শুকপাখিকে হাতের আঙুলে নিয়ে কৃষ্ণের সামনে দিয়ে ভবনলগ্ন উদ্যানের দিকে যাবার মতো ভাব করছেন সত্যভামা। কিন্তু তাঁর যাবার ইচ্ছা নেই একটুও।
কৃষ্ণ বললেন, তুমি এর মধ্যে রুক্মিণীর কাছে যাওনি, সত্যা? সত্যভামা গম্ভীরভাবে উত্তর দিলেন, জ্যেষ্ঠতাত স্বর্গত হয়েছেন, সেটা একটা কারণ। অন্য দিকে লোকে বলছে, একজন তথাকথিত তস্করের গৃহে গতায়াত করার থেকে এই শুকপাখির সঙ্গে কথোপকথন শ্রেয়।
সত্যভামার কথা শেষ হবার আগেই সত্রাজিৎ কৃষ্ণের কাছে উপস্থিত হয়েছেন। কৃষ্ণের সম্বন্ধে তার মনে যাই থাক, সামনাসামনি তাঁকে অবহেলা করা বা লঘু করা সত্রাজিতের পক্ষে অসম্ভব ছিল। কৃষ্ণকে দেখামাত্রই সত্রাজিৎ মেয়েকে বললেন–তুমি কৃষ্ণের ভোজন-আপ্যায়নের যথাসাধ্য ব্যবস্থা করেছ তো? সত্যভামা বললেন, ‘সত্রাজিতের গৃহে আপ্যায়নের ত্রুটি হবে না। তবে এই গৃহের ভোজন তার জীর্ণ হবে কি না, সেটাই দেখার। সত্রাজিৎ লজ্জিত হয়ে বললেন–তুমি কাকে কী বলছ, মা? কৃষ্ণ ঝটিতি উত্তর দিলেন–ও ঠিকই বলছে। জ্যেষ্ঠতাত প্রসেনের মৃত্যুর পর যাদবকুলে যে দুঃখের ছায়া নেমে এসেছে, সে ছায়া ভেদ করে স্যমন্তক মণির নির্বাপিত কিরণ তাঁদের চোখে এসে লাগছে। প্রসেনের মৃত্যুর চেয়েও এখন আমি অধিক আলোচনার বিষয়।
সত্রাজিৎ অপ্রতিভ বোধ করলেন। কোনো মতে নিজের দোষ কাটানোর জন্য তিনি অক্রূরের প্রসঙ্গ টেনে বললেন–আমি তোমার সম্বন্ধে কিছুই বলিনি, বৎস! তবে অক্রূর এসে..
সত্রাজিৎকে স্তব্ধ করে দিয়ে কৃষ্ণ উত্তর দিলেন–অর, কৃতবর্মা…..এখন অনেক অনেক কিছু বলবেন। তাদের গাঢ় সমবেদনার কারণও আমি সবিশেষ জানি। তবে সমস্ত ঘটনা সুধর্মা সভায় আলোচিত হবার পর আমার দিক থেকে দায় আসে কিছু করার। আমি তাই করতে এসেছি।
সত্রাজিৎ কী বলবেন–ভেবে পেলেন না। কিন্তু কৃষ্ণের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে সত্যভামা বললেন–জ্যেষ্ঠতাতের মৃত্যুর পর আজ তৃতীয় প্রভাত। এত দিনে তুমি কী করতে এসেছ?
-আমি অক্রূর কিংবা কৃতবর্মা নই, সত্যভামা। প্রসেনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে যে দূত এসে খবর দিয়েছিল, তাকেই আপ্তপুরুষ ধরে নিয়ে মণিহরণের সমস্ত দায় কৃষ্ণের ওপর চাপিয়ে দিলাম, আর জনান্তিকে সত্যভামাকে বলে গেলাম–মণিরত্নের সংবাদ নিয়ে কী হবে, সত্যা। তুমি যে তার চেয়েও অনেক বড় রমণীমণি। আমি সেই মানুষ নই, সত্যভামা। সত্যভামার মুখে ক্ষণিকের জন্য কথা জোগাল না। পিতার সামনে কৃষ্ণ যে এইভাবে তাকে অপমান করবেন–এতটা তিনি ভাবেননি। কিন্তু তিনি যখন রূঢ় কথাই বলেছেন, তখন আরও রূঢ় হয়ে তিনি জবাব দিলেন–সত্যভামার কথা হচ্ছে না। মণিহরণের কথা হচ্ছে। সে দায় যখন তোমার ওপরেই চেপেছে, তবে সঠিকভাবে তোমারও ব্যাখ্যাত হওয়া প্রয়োজন। নচেৎ আর্যা রুক্মিণীর গৃহে গতায়াত কি সম্ভব?
-মণিহরণের দায় যখন আমার ওপরেই বর্তেছে, তখন ঘটনাস্থল থেকেই সে মণি আমি নিয়ে আসব। সাক্ষী থাকবেন অন্য যাদবরা। কিন্তু তার জন্য আর্যা রুক্মিণীর গৃহকে এমন করে কলঙ্কিত কোরো না। সে গৃহ যতখানি আমার, তার চাইতে অনেক বেশি আর্যা রুক্মিণীর।
সত্যভামা পরিধানের অঞ্চলপ্রান্ত নিজের চক্ষুর ওপর স্থাপন করে উত অশ্রু নিবারণ করলেন। তারপর দ্রুতগতিতে প্রায় ছুটেই চলে গেলেন অন্তর্গহের দিকে। যাবার সময় তার মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে একটি শব্দ উচ্চারিত হল–আর্যা রুক্মিণী!
সত্রাজিৎ কৃষ্ণের গম্ভীর ভাবভঙ্গি দেখে একটু ভয় পেলেন। বললেন–আমার এই কন্যাটি কিঞ্চিৎ প্রগলভা। ওর কথায় কিছু মনে কোরো না, কৃষ্ণ কৃষ্ণ আসন থেকে উঠে পড়েছেন ততক্ষণে। সত্রাজিতের বিনয় ভাষণ শুনে একটু ব্যঙ্গ করেই প্রত্যুত্তর দিলেন–সত্যার কথায় আমি কিছুই মনে করিনি। ও আমার সঙ্গে এইভাবেই কথা বলে। কিন্তু প্রগলভা আপনার কন্যা নন। তার চেয়েও অনেক বেশি প্রগলভ এই যাদবকুল, যারা বিনা দোষে আমাকে এক অপরাধী তস্করে পরিণত করেছে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আর্য! যথাসময়ে আপনি স্যমন্তক মণির পুনরধিকার লাভ করবেন।
কৃষ্ণ সত্রাজিতের ভবন ছেড়ে দ্রুতগতিতে অশ্বারোহণ করলেন। সত্রাজিৎ ভয় পেলেন।
.
০৭.
কৃষ্ণ গৃহ ফিরেই স্নানাহার সেরে রুক্লিণীর কাছে বিদায় নিলেন। তাঁকে জানালেন–আমার ফিরতে কয়েকদিন দেরি হবে। তুমি একদিন সাত্রাজিতাঁকে নিজেই গিয়ে নিয়ে এসো। নানা কারণে তার মন বড় দুঃখিত হয়ে আছে। রুক্মিণী স্বীকার করলেন কৃষ্ণের কথা।
রুক্মিণীর কাছ থেকে বিদায় নিয়েই কৃষ্ণ প্রথম যাদবদের সেনানিবাসে এসে একটি ছোটো সৈন্যবাহিনী চাইলেন। তিনি চান–এই সৈন্যরা জ্যেষ্ঠ বলরামের নেতৃত্বে তিন দিন পরে তার সঙ্গে মিলিত হোক রৈবতক পাহাড়ের কাছে, একটি জায়গায়। সেনাধিকারিক স্বীকৃত হবার পর কৃষ্ণ বৃদ্ধ মহারাজ উগ্রসেনের সঙ্গে দেখা করে তাকে তার সমস্ত পরিকল্পনার কথা জানালেন এবং উগ্রসেনের সঙ্গে আলোচনা করে কতকগুলি আপ্তপুরুষকে সঙ্গে নিলেন, যাঁরা মনুষ্য এবং পশুদের ক্রিয়াকলাপ, পদচিহ্ন, অঙ্গুলির চিহ্ন–সবই আন্দাজ করতে পারেন।
কৃষ্ণ এই আপ্তপুরুষদের নিয়ে দ্রুত বনের পথ ধরলেন। তিনি শ্রুত আছেন–প্রসেন একটি পর্বতের কাছে নিহত হয়ে পড়ে আছেন। যে এই সংবাদ দিয়েছিল, সে এক আদিম জনজাতির মানুষ। তার বসতি নিকটবর্তী পার্বত্য অঞ্চলে। সে প্রসেনকে মৃত দেখে যাদব রাজ্যের আটবিক প্রান্তপালকে প্রথম জানিয়েছিল এবং সেই খবর আটবিকই পৌঁছে দেয় যাদবদের সংঘমুখ্যদের কাছে। আটবিক কৃষ্ণকে খুব ভালো করে চেনে এবং তাকে দেবতাদের মত দেখে। প্রথমে আটবিক যখন সংবাদ দেওয়ার জন্য পৌঁছেছিল তখনই কৃষ্ণ তাঁকে নির্দেশ দিয়েছিলেন–ঘটনাস্থলের এক ক্রোশের মধ্যে যেন কেউ না প্রবেশ করে। কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলবে, ‘মহারাজ উগ্রসেনের আদেশ। আর মৃতদেহটিকে সযত্নে রক্ষা করবে।
আটবিকের দৃঢ়তায় কেউই মৃতদেহের কাছাকাছি যেতে পারেনি; এমনকী অক্রমশায়ের যে লোকটি ঘটনাস্থলে এসেছিল, তাকেও দূর থেকেই মৃতদেহ দেখতে হয়েছিল। মহারাজ উগ্রসেন কৃষ্ণের সঙ্গে গোপন পরামর্শের পর আদেশ দিয়েছিলেন–মৃতদেহের পশ্চান্মরণ-পরীক্ষণ চলবে এবং মৃতদেহ এখনই সত্রাজিতের হাতে দেওয়া যাবে না। এই নির্দেশ অনুযায়ী কতকগুলি আপুরুষ পূর্বেই ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেছে এবং মৃতদেহের গায়ে লতাপত্রের সুরভি লেপন করে তারাই মৃতদেহটিকে রক্ষা করছে।
কৃষ্ণ তাঁর বিশ্বস্ত আপ্তপুরষদের নিয়ে ঘটনাস্থলে এসে দেখলেন–জায়গাটি পার্বত্য বনভূমির শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। আটবিক জানাল–এই পথ ধরে গোপনে মথুরা পৌঁছনো যায়। রৈবতক পাহাড় এখান থেকে খুব দূরে নয়, বরঞ্চ বলা যায় এখানকার ছোটো ছোটো পাহাড়গুলির সঙ্গে রৈবতক পাহাড়কে একত্র করলে যে পর্বতমালার সৃষ্টি হয়, তারই একটি বনপথ ধরে গিরিখাদ বেয়ে মানুষজন মথুরায় পৌঁছয়। সাধারণ লোক এ পথে চলে না। ক্ষুদ্র শ্ৰেষ্ঠীরা দ্বারকার প্রশাসক পুরুষদের ফাঁকি দিয়ে নানা গুপ্তদ্রব্য অশ্বতরের পৃষ্ঠলগ্ন করে মুথরায় নিয়ে যায়। সেখানে দাম বেশি পাওয়া যায়। পূর্বোক্ত আটবিক বনপাল এই শ্ৰেষ্ঠী পুরুষদের ওপর নজর রাখে। তার নেতৃত্বে একটি ছোট্ট রক্ষিবাহিনীও এখানে রক্ষাকর্ম চালায়। এই জায়গার অধিবাসীরা সকলেই আদিম জনগোষ্ঠীর লোক।
প্রসেন গলায় স্যমন্তক মণি দুলিয়ে মৃগয়ায় এসেছিলেন–সাধারণ্যে এই কথা প্রচারিত হলেও কৃষ্ণ এই বনপথে প্রসেনকে মৃত পড়ে থাকতে দেখে সিদ্ধান্ত নিলেন–তিনি মথুরায় যাচ্ছিলেন। তার কারণ হল–কৃষ্ণ এক সময় প্রসেনের কাছে মণি চেয়েছিলেন এবং মণিটি যদি কৃষ্ণ ছিনিয়ে নেন এই ভয়েই তিনি মথুরা নগরীর কোথাও কারও গৃহে মণিটি রেখে আসতে যাচ্ছিলেন। মথুরায় যাদব গোষ্ঠীর বিখ্যাত কোনো ব্যক্তি এখন থাকেন না। মগধরাজ জরাসন্ধের ভয়ে সকলেই এখন দ্বারকায় প্রস্থিত। এই অবস্থায় কোনো এক অখ্যাত মানুষের ঘরে মণিটি রেখে আসলে সাময়িকভাবে কৃষ্ণকে এড়ানো যাবে–এই ছিল প্রসেনের ধারণা। কৃষ্ণ প্রসেনের মৃতদেহ নিরীক্ষণ করে দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করে স্বগতোক্তি করলেন-বেচারা প্রসেন! নিজেও বাঁচলেন না, মণিটিকেও বাঁচাতে পারলেন না। আমার কিছু ব্যক্তিত্ব আছে বলেই কি আমি আপনার বহুমূল্য স্যমন্তক মণিটি সবলে গ্রহণ করতাম?
কৃষ্ণের বিশ্বস্ত আপুরুষেরা মৃতদেহের পার্শ্ববর্তী সমস্ত ভূমি নানাভাবে পরীক্ষা করে কৃষ্ণকে বলল–এটি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কোনো মুখ্য পুরুষের কাজ। মহামূল্য মণিটি সে বিক্রয় করবে বলে গ্রহণ করেনি। মণিটি এতই দ্যুতিময় যে, সে তার চমকৃতিতে মুগ্ধ হয়েই সেটি আত্মসাৎ করতে চেয়েছে। নচেৎ এই পার্বত্য জনগোষ্ঠীর কাছে ওই মণির কোনো মূল্য নেই। কৃষ্ণ বললেন, তোমাদের মত মেনে নিতে পারি, যদি উপযুক্ত প্রমাণ পাই। আপ্তপুরুষেরা প্রসেনের মৃতদেহের নিকটবর্তী স্বল্পাচ্ছাদিত তৃণভূমিতে কতকগুলি পদচিহ্ন দেখাল। পদচিহ্নগুলি সিংহজাতীয় কোনো পশুর। কৃষ্ণ বললেন–এ তো সিংহের পদচিহ্ন। তা হলে তো মহাশয় অক্রূর ঠিকই বলেছেন?আপ্তপুরুষদের প্রধান সঙ্গে সঙ্গে বললেন–কিছুটা ঠিক বলেছেন, কিছুটা নয়। আপনি আর্য প্রসেনের মৃতদেহ লক্ষ করে দেখুন–তার কপালে, উদরে নিশ্চিত প্রস্তরাঘাতের চিহ্ন আছে, কিন্তু কোথাও পাশব দংশনের চিহ্ন নেই। কৃষ্ণ বললেন–তা হলে এই হত্যা কি কোনো নরসিংহের কাজ।
আর্য! এরা নরসিংহই বটে। তবে আপনি যেমন ভাবছেন তেমন নয়।
কৃষ্ণকে পদচিহ্নগুলি ভালো করে দেখিয়ে আপ্ত-প্রধান বললেন–আসলে এই অঞ্চলের আদিম জনগোষ্ঠীর মুখ্যপুরুষেরা হাতে এবং পায়ে সিংহের নখর ব্যবহার করে। লক্ষ করে দেখুন–পদচিহ্নর অগ্রভাগে এই নখরের চাপ পরিস্ফুট, কিন্তু পদচিহ্নের পশ্চাদভাগ মনুষ্য-চরণের পশ্চাদভাগের মতোই। এই জনগোষ্ঠীর প্রত্যেকেই অসীম শক্তিধর। সিংহের মতোই তারা বলবান। এদের যুদ্ধাস্ত্র নানাবিধ প্রস্তর। নিবাস পর্বতের গুহায়।
কৃষ্ণ স্বীকার করে নিলেন আপ্তপুরুষের কথা। বললেন–এই আদিম জনজাতির কয়েকটি গোষ্ঠীর সঙ্গে আমার গভীর পরিচয় আছে। আপ্তপুরুষেরা বললেন–আমরা সে কথা জানি। যাঁদের সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে, তাঁরা পক্ষী বা সর্পের অবয়ব ব্যবহার করেন। তবে আমরা খবর নিয়ে জেনেছি, এখানে শুধু সিংহই নয়, এদের প্রতিপক্ষ জনগোষ্ঠীও কিছু কিছু আছে, যারা অন্য পশুর মুণ্ড-নখর প্রভৃতি নিজেদের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে। কৃষ্ণ আপ্তপুরুষদের সংকেত অনুযায়ী সিংহ-নখরের চিহ্ন অনুসরণ করে চলতে আরম্ভ করলেন। চলতে চলতে বেশ খানিকটা পথ অতিক্রম করার পর দেখা গেল পাহাড় শেষ হয়ে গেছে এবং বেশ খানিকটা জায়গা ঢালু খাদের মতো। বড়ো বড়ো গাছ আর পার্বত্য লতা-গুল্মে স্থানটি সম্পূর্ণ হরিবর্ণ ধারণ করেছে।
কৃষ্ণ এদিক-ওদিক দেখতে লাগলেন এবং হঠাৎই সেই আপ্তপ্রধান একটি বৃক্ষের আড়াল থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন–আর্য এদিকে আসুন। আমার বিশ্বাস প্রমাণীকৃত প্রায়। এই দেখুন–আপনার সেই নরসিংহ এখানে চিরকালের জন্য শায়িত। কৃষ্ণ এসে দেখলেন–একটি মানুষের মৃতদেহ। এখানে-ওখানে চাপ-চাপ রক্ত। সিংহের নখর তার পদযুগলের সঙ্গে অবিন্যস্তভাবে লগ্ন। আপ্তপুরুষদের সহায়তা নিয়ে জায়গাটাকে তন্ন তন্ন করে খোঁজা হল। স্যমন্তক মণির চিহ্ন কোথাও নেই। তবে কৃষ্ণের ভরসা–যে স্বর্ণসূত্রের দ্বারা মণিটি প্রসেনের গলায় ঝোলানো ছিল, তার একটি ছিন্নাংশ পাওয়া গেল। স্বর্ণসূত্রের ছিন্নাংশ একটি ক্ষুদ্র বৃক্ষের শাখালগ্ন হয়ে ঝুলছিল। আপ্তপুরুষেরা ভগ্ন-বৃক্ষের সদ্যচ্ছিন্ন শাখা-পত্রাদি লক্ষ করে। কৃষ্ণকে নিয়ে যেতে লাগল।
কৃষ্ণ এর মধ্যে একটি বিশ্বস্ত পুরুষকে দিয়ে রৈবতক পর্বতের নিকটস্থিত যাদব সৈন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তারা বলরামের নেতৃত্বে ক্রমেই এগিয়ে আসছে।
আপ্তপুরুষেরা কৃষ্ণকে জানিয়েছে–দুটি আদিম গোষ্ঠীর প্রধানের মধ্যে স্যমন্তক মণির অধিকার নিয়ে যুদ্ধ হয়েছে। আপনার নরসিংহটি যাঁর হাতে প্রাণ দিয়েছেন, তিনি নিঃসন্দেহে অন্য একটি পশুচিহ্ন ব্যবহার করেন এবং সম্ভবত সেটি ভল্লুকের। কারণ ভল্লুকের নখরচিহ্ন এবং ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ঋক্ষলোম আমাদের ধারণা বদ্ধমূল করেছে। তবে এই মানুষটির শারীরিক শক্তি আরও বেশি। পথ চলতে চলতে আবারও পাহাড় আরম্ভ হয়ে গেছে।
বলরামের নেতৃত্বে ছোট্ট একটি সৈন্যবাহিনী, যার মধ্যে বিভিন্ন যাদবমুখ্যদের মনোনীত সৈন্যেরা আছেন, তারা সকলেই কৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। সৈন্যরা এখানে ওখানে অস্থায়ী আস্তানা গেড়েছে। বনের পশু মৃগয়া করে আগুনে পুড়িয়ে খাওয়া হচ্ছে। বারাহ এবং মাহিষ মাংসের রন্ধন চলছে আগুন জ্বালিয়ে। পুটপাকে সিদ্ধমাংসের আস্বাদ কৃষ্ণের কাছে ভালোই লাগছে। বলরামের কথঞ্চিৎ মদ্যপানের অভ্যাস আছে। এই বন্যভূমিতে আসার পর থেকে প্রসিদ্ধ কৈরাতক মধুর সঙ্গে পুটপাকসিদ্ধ বারাহ মাংস তাঁর অতি প্রিয় খাদ্যবস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই রকমই একদিন দ্বিপ্রহরের রন্ধন-ভোজন বন-মহোৎসব চলছে। কৃষ্ণের পূর্ব নিযুক্ত চিহ্ন-বিশেষজ্ঞদের একজন এসে তাকে জানাল–আর্য! এই স্থান থেকে কিঞ্চিৎ দূরে একটি পার্বত্যগুহার মধ্যে আমরা মনুষ্য কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছি এবং গুহার বাইরে পর্বতগাত্রে দু-তিনটি ভল্লুক-চর্ম শুষ্ক করার জন্য আতত অবস্থায় রাখা হয়েছে। আপনি চলুন। গুহার বাইরে ভল্লুকের নখরচিহ্ন সর্বত্র বর্তমান। কৃষ্ণ সঙ্গে সঙ্গে পদব্রজে রওনা হলেন এবং আপ্তপুরুষের নির্ণীত স্থানে এসে পৌঁছলেন। দেখলেন, একটি বৃহদাকার প্রস্তরে গুহামুখ ঢাকা থাকলেও তাতে সামান্য ফাঁকও আছে। কৃষ্ণ নিঃশব্দে গুহার মধ্যে প্রবেশ করলেন। গুহার মধ্যে অপূর্ব সোপানশ্রেণি। একটি মানুষের আরোহণ-অবতরণের পক্ষে যথেষ্ট। সোপানের আবর্ত একটু অবতরণের পরেই বাম দিকে ঢালু হয়ে গেছে। কৃষ্ণ অত দূর গেলেন না। ঢালু জায়গায় না গিয়ে একটি সোপানের ওপরেই তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন, অসিমাত্রসহায়।
কৃষ্ণের কানে একটি শিশুর ক্রন্দনধ্বনি ভেসে আসছিল। কৃষ্ণ বুঝতে পারছিলেন–শিশুটি একটি খেলনার জন্য বায়না করছে, কিন্তু সে যা চাইছে, তা দেওয়া হচ্ছে না। ইতিমধ্যে একটি নারীকণ্ঠের সান্ত্বনাবাণী তার কানে ভেসে এল। নারীকণ্ঠ বলছে-না না, আর কাঁদে না বাছা, সেই যে সেই সিংহটা, সে তো মেরে দিয়েছিল প্রসেনকে, আর সেই মস্ত সিংহটাকে কে মেরেছে জান? মেরেছে জাম্ববান–তোমার পিতা। আর এখন, এখন এই স্যমন্তকমণি শুধু তোমারই, আর কাঁদে না বাছা–সুকুমারক মা রোদীস্তব হেষ স্যমন্তকঃ।
সোপানশ্রেণির বামাবর্ত থেকে কৃষ্ণ দেখতে পেলেন–ছোট্ট শিশুর গলায় স্যমন্তক মণি। পূর্বে তিনি স্যমন্তক মণির কথা শুধু শুনেছেন, কিন্তু দর্শন করেননি। শিশুর গলায় স্যমন্তক মণির জাজ্বল্যমান প্রভা দেখে তিনি বিস্মিত হয়ে গেলেন। বালসূর্য যেন জমাট বেঁধে আছে একটি স্বচ্ছ হীরকখণ্ডের মধ্যে।
আড়াল থেকে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই কৃষ্ণের মনে হল–এবার শেষ অভিযানের সময় হয়েছে। তার আর দাঁড়িয়ে থাকার উপায় নেই। তিনি গুহার বাইরে এসে বিশ্বস্ত পুরুষটিকে বললেন তুমি বলরামকে সৈন্যসহ এই মুহূর্তে এখানে আসতে বল। গুপ্তচর তীব্রবেগে বলরামকে সংবাদ দিল এবং তিনি সঙ্গে সঙ্গে সসৈন্যে উপস্থিত হলেন জাম্ববানের গুহামুখে।
আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা বলরামকে জানিয়ে কৃষ্ণ তাকে গুহামুখে সসৈন্যে অপেক্ষা করতে অনুরোধ করলেন। কৃষ্ণ গুহায় প্রবেশ করলেন একা। সোপানশ্রেণির ঢালু জায়গায় উপস্থিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই রমণী তাকে দেখতে পেল। স্যমন্তক মণির উপহার সাজিয়ে যে রমণী এতক্ষণ
শিশুটিকে ভোলাচ্ছিল, সে এবার কৃষ্ণকে দেখামাত্র ভূত দেখার মতো চিৎকার করে উঠল। সোপানের ওপর থেকে একটি সবল লম্ফ দিয়ে কৃষ্ণ ঋক্ষরাজ জাম্ববানের পিঠের ওপর পড়লেন। কারণ তিনি জানতেন–ধাত্রেয়িকা রমণীটির চিৎকারের পর ওই আদিম জননেতার অবধারিত প্রতিক্রিয়া কী হবে। দুজনের মল্লযুদ্ধ আরম্ভ হল। ধস্তাধস্তি, মুষ্ট্যামুষ্টি, কেশাকেশি চলতে থাকল।
ঋক্ষরাজ জাম্ববানের নিবাসস্থলের বাইরে গুহামুখে যে সব যাদবসৈন্য দাঁড়িয়েছিল, তারা সাত-আট দিন দাঁড়িয়ে রইল ঠায়। কৃষ্ণ ফিরে এলেন না। তারা বিশ্বাস করে নিল–কৃষ্ণ মারা গেছেন। খানিকটা ভীতিও কাজ করল। কৃষ্ণের মতো বিশালবুদ্ধি যোদ্ধা যদি মারা গিয়ে থাকেন, তবে এই গুহাবিলের ভিতরে প্রবেশ করলে বিপদও হতে পারে। তারা কৃষ্ণকে গুহার মধ্যে রেখে দ্বারকায় ফিরে এল। খবর রটল–স্যমন্তক মণি উদ্ধার করতে গিয়ে কৃষ্ণ মারা গেছেন। কৃষ্ণের নিকট আত্মীয়দের মধ্যে অনেকেই তার শ্রাদ্ধশান্তিও করে ফেলল। কিন্তু কৃষ্ণ-পিতা বসুদেব কৃষ্ণের বড়ো ভাই কোনো শ্রাদ্ধক্রিয়ার মধ্যে গেলেন না। কারণ ক্ষত্রিয়ের মৃত্যুর খবর শুনেও অন্তত এক মাস অপেক্ষা করতে হয় বলে তারা মনে করেন।
.
০৮.
প্রসেনের মৃত্যুর খবর যেমন সত্রাজিতের কাছে প্রথম এসেছিল তেমনই কৃষ্ণের মৃত্যুর খবরও তাঁরই কাছে প্রথম এসে পৌঁছল। কারণ, এই দুটি মৃত্যুই সত্রাজিতের স্যমন্তক-মণির সঙ্গে যুক্ত। খবর শুনে সত্যভামা ত্বরিতগতিতে রুক্মিণী ভবনে এলেন। তিনি কৃষ্ণের এই মৃত্যুর খবর বিশ্বাস করেন না। রুক্মিণীর সঙ্গে দিন-রাত নানা বিশ্রম্ভালাপে দিন কাটাতে লাগলেন সত্যভামা। রুক্মিণী ভবনের সমস্ত কর্মকারিণীদের তিনি বারণ করে দিয়েছেন, যাতে সরাসরি কোনো খবর রুক্মিণীর কাছে না পৌঁছয়।
রুক্মিণী সত্যভামাকে ঠিক বুঝতেও পারছেন না। তাঁর ভাবভঙ্গি আচার-ব্যবহারও একটু অন্য রকম লাগছে। সবচেয়ে বড় কথা–কৃষ্ণের অবর্তমানে সত্যভামা এর আগে রুক্মিণী গৃহে মাঝে মাঝে বাস করেছেন বটে, তবে এত দিন একটানা কখনোই তিনি থাকেননি। রুক্মিণী অবাক হয়ে একবার জিজ্ঞাসাও করেছিলেন সত্যভামাকে–কী রে! কোনো দিন তো তুই এতটা কাল আমার সঙ্গে থাকিনি, বোন! তোর হলটা কী? ঘরে মন টিকছে না? সত্যভামা হেসে বলেছিলেন–আমি এবার পাকাপাকিভাবে থাকতে এসেছি। তোমার সঙ্গে আমার অনেক বিবাদ বাকি আছে। সব মীমাংসা না করে যাব না।
–তা হলে তো আবার সেই তস্কর মানুষটিকেই খবর দিতে হবে। পাকাপাকি ব্যবস্থার জন্য পাকা চোরকেই তো দরকার।
–সেই চোরের অপেক্ষাতেই আছি। তিনি আসুন, আমিও চলে যাব।
রুক্মিণী অবাক হলেন, সত্যভামা তো এতটুকুতে থামে না। দিনে দিনে সকলেরই ধৈর্যচ্যুতি আরম্ভ হল। রুক্মিণী যদিও এখনও ভালো করে কিছুই জানেন না, তবু মাঝে মাঝে তার চক্ষু দুটি অশ্রুসিক্ত হচ্ছে। সেই উদগত অশ্রুবারি আপন অঞ্চল দিয়ে মুছিয়ে দিতে দিতে সত্যভামারও চক্ষু সজল হয়ে আসছে। কিন্তু তিনি কিচ্ছুটি প্রকাশ করছেন না রুক্মিণীর কাছে। আর কত দিন? কৃষ্ণ যাবার পর থেকে আজ একুশ দিন চলে গেছে। এরই মধ্যে এক অদ্ভুত খবর এসে পৌঁছল দ্বারকায় এবং অবশ্যই রুক্মিণী ভবনে। বলা যায়-রুক্মিণীর কাছেই এ খবর প্রথম পৌঁছল। প্রতিহারিণী খবর দিল–কৃষ্ণ রথে চড়ে আসছেন এবং তার সঙ্গে নববধূ। বধূর গায়ের রং কালো। ঘনকুঞ্চিত কেশদাম। সে এক অনার্যা রমণী।
সত্যভামা ভালো করে খবর নিয়ে জানলেন–স্যমন্তক মণি পাওয়া গেছে। ঋক্ষরাজ জাম্ববান কৃষ্ণের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গিয়ে কন্যা জাম্ববতাঁকে কৃষ্ণের হাতেই তুলে দিয়েছেন। সবধূ কৃষ্ণ গৃহে ফিরছেন একই রথে। সত্যভামা রুক্মিণীকে বললেন–শুনেছ বউরানি! এক অনার্যা রমণীর পাণিগ্রহণ করে তোমার হৃদয়েশ্বর তোমারই ঘরে ফিরছেন। রুক্মিণী বললেন–অমন করে বলছিস কেন, বোন! তিনি তো আর নিজে এই বিবাহ করেননি। কেউ যদি এখন যুদ্ধজয়ের উপহার হিসেবে নিজ কন্যা সম্প্রদান করেন, তবে তিনি কী করবেন?
-তাই বলে এই অনার্যা রমণী?
-কেন, অনার্যা বলে কি সে মানুষ নয়? সে রমণীর সাধ-আহ্লাদ নেই?
–আমি তার সাধ-আহ্লাদের কথা বলছি না, শুধু তোমার স্বামীর আহ্লাদের কথা বলছি। আসলে তোমার মিষ্টি মুখের মধু খেয়ে খেয়ে তার অরুচি ধরে গেছে। এ অনার্যা রমণীকে নিয়ে এসে তিনি কিঞ্চিৎ তিন্তিড়ির ব্যবস্থা করেছেন।
-জানিস তো? তিন্তিড়ির সঙ্গে কিঞ্চিৎ সুমিষ্ট খণ্ডের মিশ্রণ বস্তুটাকে আরও উপাদেয় করে। কাজেই আমার কোনো সমস্যা নেই। তবে মিষ্ট, অম্ল-এ সমস্ত রসের ওপরেও যদি তিক্ত-কষায়ের প্রয়োজন হয়, তবেই জানবি তোরও একটা পাকাপাকি ব্যবস্থা হবে এখানে।
সত্যভামা সামান্য লজ্জা পেলেন এবং কৃষ্ণ আসছেন জেনে বিদায় নিলেন রুক্মিণীর কাছে। এক মুহূর্তের জন্য বোঝা গেল–রুক্মিণী বৈদভী। কথার এই বক্রতা একমাত্র বৈদভী রমণীর মুখেই প্রসিদ্ধ।
.
০৯.
কৃষ্ণ প্রথম রুক্মিণীর ভবনে প্রবেশ করলেন ঋক্ষরাজকন্যা জাম্ববতাঁকে নিয়ে। রুক্মিণী সানন্দে বধূবরণ করে নিজের ঘরে নিয়ে তুললেন নববধূকে। ঠাট্টা করে বললেন–এতদিনে উপযুক্ত বধু পেয়েছেন আর্যপুত্র।
কালের সঙ্গে কালো, বড় ভালো মানাবে। কৃষ্ণ রুক্মিণীর কাছে সমস্ত ঘটনা আনুপূর্বিক জানিয়ে স্যমন্তক মণি নিয়ে সত্রাজিতের গৃহে পৌঁছলেন। মণিরত্ন তার হাতে ফিরিয়ে দিতে সত্রাজিৎ যতখানি অভিভূত হলেন, তার চেয়েও ভীত হলেন বেশি। যাদবকুলের অগ্রগণ্য পুরুষকে তিনি এক সামান্য তস্কর বলে ভেবেছিলেন। সমস্ত দ্বারকায় তার নামে অপবাদ রটেছিল। সত্রাজিৎ ভয় পেলেন।
বললেন–এ মণি তোমার কাছেই থাকুক, কৃষ্ণ! তোমার যা ইচ্ছে হয় করো। কৃষ্ণ বললেন, এখন আর তা হয় না। এ মণিরত্ন আপনার। আপনার কাছেই এটি থাকুক। আপনি শুধু সত্যভামাকে জানাবেন, মণিহরণের দায় আমার ওপর বর্তেছিল। অধুনা আমি সুব্যাখ্যাত হয়েছি, আশা করি। সত্রাজিৎ দ্বিগুণ ভয় পেয়ে বললেন–তুমি ওই বালিকার কথায় কর্ণপাত কোরো না। তোমার সম্বন্ধে আমার কাছে সে যে সমস্ত কথা বলেছে, তাতে আমার ধারণা, সে চেয়েছিল তোমারই মাধ্যমে স্যমন্তক মণির রহস্য উদ্ঘাটিত হোক এবং কোনোভাবেই যেন এই মণিহরণের দায় তোমার ওপর এসে না পড়ে। কৃষ্ণ অবাক হলেন, তাহলে সত্যভামা ইচ্ছে করে তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছিল!
সত্রাজিৎকে কৃষ্ণ সানুনয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, সত্যার সঙ্গে কি একবার দেখা হতে পারে? সত্রাজিৎ কপট গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললেন, আপাতত নয়। তবে আমার একটা অনুরোধ আছে, কৃষ্ণ! সত্রাজিৎ কৃষ্ণের হাত জড়িয়ে ধরে বললেন–তুমি আমার কন্যাটিকে গ্রহণ করে আমাকে বাধিত করো, কৃষ্ণ! কৃষ্ণ বুঝলেন–সত্রাজিৎ তাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করছেন। খানিকটা অস্বীকারের ভঙ্গিতেই কৃষ্ণ বললেন–সে কী কথা? যাদবকুলে আমার চেয়ে সুযোগ্য পাত্র অনেকে আছেন এবং অনেকেই আপনার কন্যার পাণিপ্রার্থী।
–তা হোক। আমি জানি, তোমার চেয়ে যোগ্য পাত্র আর কেউ নেই। যারা আমার কন্যাকে চান, তারা সত্যি আমার কন্যাকেই চান, নাকি স্যমন্তক মণিটি চান–সে সম্বন্ধে আমার যথেষ্ট চিন্তা আছে। তুমি অস্বীকার কোরো না কৃষ্ণ। আমার কন্যাকে তোমার অপছন্দ নয়তো?
কৃষ্ণ মাথা নিচু করলেন। সত্যভামা যে এইভাবে কোনোদিন তার কাছে আসবেন, এ তাঁর স্বপ্নেও ছিল না। শৈশব থেকে এই বালিকাটিকে তিনি চেনেন। কারণে, অকারণে নানা প্রগলভ ব্যবহারে সে তাকে আকুল করে তুলেছে কতবার। রুক্মিণীকে কৃষ্ণ ভালোবাসেন ঠিকই, কিন্তু সত্যভামা যেন অন্য কিছু। তার কথাবার্তা, হাবভাব, লাস্য এত বেশি বামতাযুক্ত যে, তাকে ভালো না লেগে যায় না। যাদবকুলের অগ্রগণ্য পুরুষরা সব সময় যে রমণীকে কামনা করেন, তাকে কৃষ্ণ এত সহজে লাভ করবেন। ভাবেননি। সত্যভামার এই দুর্লভতা এবং অপ্রাপ্যতার জন্যই এক মুহূর্তের মধ্যে তিনি কৃষ্ণের কাছে গ্রহণীয়তমা বলে পরিগণিত হলেন। সত্রাজিতের সানুনয় বাক্যের পর আর তিনি দ্বিরুক্তি করলেন না। বললেন, আর্যের যেমন অভিলাষ। আপনি বিবাহের আয়োজন করুন।
.
১০.
স্যমন্তক মণি হৃত হয়েছিল–সেও একরকম মেনে নিয়েছিলেন সকলে। সত্রাজিৎ ছাড়া মণিহরণের দুঃখ আর কাউকে স্পর্শ করেনি। কিন্তু আজ যখন স্যমন্তক মণি পুনর্লব্ধ হল এবং কৃষ্ণ অপবাদ-মুক্ত হলেন, তখন যাদবকুলে নতুন এক রাজনৈতিক আবর্তের সৃষ্টি হল।
অক্রূরের গৃহে নির্জন একটি প্রকোষ্ঠে আলোচনা আরম্ভ হল দুজনের মধ্যে। হার্দিক কৃতবর্মা শুষ্ক রুক্ষ মানুষ। তার ভাষায় কোনো মিষ্টতা নেই।
তিনি বললেন–ব্যাটা গর্ভদাস এই সত্রাজিৎ। সত্যভামাকে বিয়ে দেওয়ার মতো আর পাত্র পেলি না যাদবকুলে?
অক্রূর বললেন–স্যমন্তক মণি ফিরে পেয়েছিস, ঠিক আছে। তাই বলে এত শীঘ্রই সত্যভামার বিবাহ দেওয়ার কী প্রয়োজন ছিল?
ব্যাটা ভয় পেয়েছে। কৃষ্ণ চুরি করেনি, অথচ তার নামে অপবাদ রটেছিল, এখন কৃষ্ণ যদি কোনো প্রতিশোধ নেয়? সেই ভয়েই মেয়ে দিয়ে তাকে তুষ্ট করার ব্যবস্থা করল।
–প্রতিশোধ প্রতিশোধের কী আছে? আমরা কি ছিলাম না?
–দেখো, এই কথাটা বড় শক্ত কথা। কৃষ্ণপ্রতিশোধ নেবে ভাবলে তাকে রক্ষা করা কঠিন?
কৃতবর্মা কৃষ্ণের কূটবুদ্ধির কথা জানেন। সত্যভামার ওপরেও তার লোভ তত ছিল না, যতটা স্যমন্তক মণির ওপর। কিন্তু অক্রূর মণিটিও চেয়েছিলেন, সত্যভামাকেও মনে মনে মন দিয়েছিলেন। আজ যখন সত্যভামার বিবাহ হয়ে গেল কৃষ্ণের সঙ্গে, তখন অক্রূর ভাবলেন–সত্যভামা গেছে যাক, অন্তত মণিটা তো পাওয়া যেতে পারে। অক্রূর সুকৌশলে কৃতবর্মাকে বললেন, সত্যভামাকে কৃষ্ণের হাতে তুলে দিয়ে গভীর অপরাধ করেছে সত্রাজিৎ। ওর বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই।
–সত্রাজিৎকে হত্যা করাটা কোনো কঠিন ব্যাপার নয়। তবে তাকে এমন ভাবেই মারতে হবে, যাতে আমরা কেউ দোষভাগী না হই।
-সে চিন্তা আমার। তুমি শুধু আমাকে সাহায্য করো।
অক্রূর এবং কৃতবর্মা দুজনে গোপন আলোচনা সেরে নিয়ে শতধন্বাকে ডেকে পাঠালেন। শতধম্বা কৃতবর্মার ছোটোভাই হলেও কৃতবর্মা অক্রূরের কথায় আপত্তি করলেন না। অক্রূর ভেবেছিলেন–সত্রাজিৎকে হত্যা করতে হলে এমন একজনকে কাজে লাগাতে হবে যে, সত্যভামার প্রণয়ের জন্য ব্যগ্র ছিল। অক্র এবং কৃতবর্মা দুজনেই জানতেন–শতধন্বা সত্যভামার প্রেমে উন্মত্ত। আকস্মিকভাবে কৃষ্ণের সঙ্গে সত্যভামার বিবাহ হয়ে যাওয়ায় শতধন্বা যে প্রতিশোধ স্পৃহায় জ্বলেপুড়ে মরছেন–এ কথা অক্র এবং কৃতবর্মা দুজনেই জানতেন। কিশোর মনের এই উদগ্র প্রতিশোধ-স্পৃহাকে স্পষ্ট রূপ দেওয়ার জন্য অক্রূর এবং কৃতবর্মা শতধন্বকে ডেকে এনে সত্যভামার প্রসঙ্গ উপস্থাপন করলেন। কৈশোরগন্ধী যুবকের মন ধিকিধিকি জ্বলে উঠল। অক্রূর বললেন–শতধন্বা! সত্রাজিতের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। তুমি সাবহেলে সত্রাজিৎকে হত্যা করো। ওর স্যমন্তক মণিটি ওর কাছ থেকে ছিনিয়ে নাও, আমরা তিনজনে মিলে স্যমন্তক-মণির অধিকার ভোগ করব।
শতধন্বা বললেন, সত্যভামাকে যে আমার কাছ থেকে সরিয়ে দিয়েছে, সেই সত্রাজিৎকে হত্যা করতে আমার মনে কোনো দ্বিধা নেই। কিন্তু স্যমন্তক মণি সংগ্রহ করার পর কৃষ্ণ যদি প্রতিপক্ষতা করেন। অক্রূর এবং কৃতবর্মা দুজনে একযোগে বললেন, তুমি মণিরত্ন নিয়ে এসো। তোমাকে রক্ষা করার ভার আমাদের। শতধন্বা রাজি হলেন সাগ্রহে। সুযোগও এসে গেল। হস্তিনাপুর থেকে দ্বারকায় খবর এল–পাঁচ পাণ্ডব ভাই, তাদের মা কুন্তীর সঙ্গে জতুগৃহে দগ্ধ হয়েছেন বারণাবতে। কুন্তী কৃষ্ণের নিজের পিসি। কৃষ্ণপিতা বসুদেব সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণকে বারণাবতে পাঠালেন ঘটনার সত্যাসত্য নির্ণয় করার জন্য।
কৃষ্ণ দ্বারকায় নেই–এমনই একদিন রাত্রির অন্ধকারে হার্দিক শতধন্বা সত্রাজিতের গৃহে এসে নিদ্রিত অবস্থায় হত্যা করলেন সত্রাজিৎকে। স্যমন্তক মণি হরণ করে নিয়ে তিনি অক্রূর এবং কৃতবর্মার কাছে উপস্থিত হলেন।
তারা বললেন–মণি তোমার কাছেই থাক, শতধন্বা! শতধন্বা মণি গ্রহণ করে সত্যভামার শোক বিস্মৃত হতে চাইলেন বৃথাই। যথাসময়ে সত্রাজিতের মৃত্যুসংবাদ সত্যভামার কানে পৌঁছল। তিনি অধীর হয়ে পিতৃগৃহে এলেন। কৃষ্ণের বিশ্বস্ত আপুরুষেরা তাকে জানাল–এই গুপ্ত হত্যা শতধন্বার কাজ, মণিও তিনিই হরণ করেছেন।
শতধন্বার সম্বন্ধে সত্যভামার কিছু মায়া ছিল। একটি উনিশ-কুড়ি বছরের যুবক তাকে মনে-প্রাণে ভালোবাসে এই সরসতাটুকু সত্যভামা অন্তরের গভীরে উপভোগ করতেন। কিন্তু আজ যখন তার পিতাকে হত্যা করে শতধন্বা স্যমন্তক অপহরণ করলেন, তখন তাঁর দৃঢ় ধারণা হল–তিনি নন, ওই মণিই ছিল শতধন্বা প্রকৃত লক্ষ্য। সত্যভামার কৈশোর কল্পনাগুলি মুহূর্তের মধ্যে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল। শতধম্বার মণিহরণের পিছনে অর-কৃতবর্মার কূট-কৌশল একটুও বুঝতে পারলেন না সত্যভামা। মনে মনে তিনি তখনই শতধন্বাকে হত্যা করে ফেললেন। সত্যভামা স্বামীগৃহে ফিরেই একটি একাশ্ববাহিত রথের ব্যবস্থা করলেন নিজের জন্য। তারপর সেই রথে চড়ে রওনা দিলেন বারণাবতে। একাকিনী, রথের সারথিমাত্র সহায়ে। বৃষ্ণিকুলের বন্ধু হওয়ার পর রুক্মিণী-জাম্ববতী যা ভাবতেও পারেন না, সত্যভামা সেই সাহস করলেন। সমস্ত মহিষীদের মধ্যে সত্যভামা যে কৃষ্ণের কাছে বেশি প্রশ্রয় পেয়েছিলেন, এই ঘটনা তার প্রমাণ।
সত্যভামা বারণাবতে পৌঁছে পিতার মৃত্যুসংবাদ জানালেন কৃষ্ণকে। জানালেন শতধন্বার লোভ এবং হিংসার কথা। কৃষ্ণ সত্যভামার কথা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেও একবার তাকে বোঝাতে চাইলেন। বললেন, তুমি হয়তো জান না, সত্যা। এই কিশোরকে আমি দেখেছি, তোমার প্রেমে সে উন্মত্ত, অধীর। সে কী করে…..। ক্রোধে জ্বলে উঠলেন সত্যভামা–উন্মত্তই বটে, তবে সেটা আমার জন্য নয়, স্যমন্তক মণির জন্য। নইলে সে পিতাকে এমন নৃশংস এবং কাপুরুষের মতো হত্যা করত না, অন্তত হত্যা করলেও মণিটি নিয়ে যেত না। তাতেই বুঝি–শতধন্বার উদ্দেশ্য আমি নয়, স্যমন্তক মণি।
সত্যভামার মানসিক অবস্থা বুঝে কৃষ্ণ বারণাবতে সাত্যকিকে রেখে এলেন পাণ্ডবদের অস্থি-পরীক্ষার জন্য। অর্থাৎ পাণ্ডবদের মৃত্যু হয়েছে–এ কথা তিনি বিশ্বাস করেননি। যাই হোক, সত্যভামার জোরাজুরিতে তিনি দেরি না করে দ্বারকায় ফিরে এলেন। সত্রাজিতের মৃত্যুতে কৃষ্ণের মনে একটা অন্য প্রতিক্রিয়াও হয়েছিল, যদিও সেটা সত্যভামার কাছে প্রকাশযোগ্য ছিল না।কৃষ্ণ ভেবেছিলেন–সত্রাজিৎস্বর্গত হয়েছেন, অতএব উত্তরাধিকারের নিয়ম-মতে স্যমন্তক মণি এখন সত্যভামার অর্থাৎ কৃষ্ণের।
দ্বারকায় ফিরে কৃষ্ণ দাদা বলরামকে সব ঘটনা জানালেন এবং তাঁকে সঙ্গে নিয়েই শতধন্বকে আক্রমণ করবেন ঠিক করলেন। এ খবর আগেই পৌঁছে গেল শতধন্বার কাছে। শতধন্বা প্রমাদ গণলেন, সঙ্গে সঙ্গে পূর্বের প্রতিজ্ঞা স্মরণ করিয়ে দিলেন অক্রূর এবং কৃতবর্মাকে। তার আপন জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কৃতবর্মা কৃষ্ণের প্রতিপক্ষতা করতে রাজি হলেন না। পূর্বে যে সাহস তিনি দেখিয়েছিলেন, এখন কৃষ্ণের ক্রোধোন্মত্ত মূর্তির নিরিখে সে সাহস এক মুহূর্তে উবে গেল। আর অর? ইচ্ছে করলে তিনিই কৃষ্ণের বিরুদ্ধে হয়তো বা কিছু করতে পারতেন, কিন্তু শঠতা করে তিনি আপন প্রতিজ্ঞা ভুলে গেলেন। শতধন্বার সঙ্গে তঞ্চকতা করলেন অক্রূর। তিনিও শতধন্বকে সাহায্য করতে রাজি হলেন না।
শতধন্বা সব বুঝলেন। স্যমন্তক মণি কোনোদিনই তার ইঙ্গিত ছিল। সত্যভামাকে তিনি চেয়েছিলেন, পাননি, মণি গ্রহণ করে তিনি কী করবেন? শতধন্বা অরকে বললেন–মণিটি আপনি রাখুন। বাঁচতে হলে আমাকে পালাতে হবে। অক্রূর প্রথমেই মণি নিতে চাইলেন না। ভাবলেন, যদি বিপদ ঘটে কোনো। শতধম্বা বললেন, মণি নিয়ে আমার কোন প্রয়োজন সিদ্ধ হবে? স্যমন্তক আপনার কাছেই থাক, আমার প্রয়োজন নেই মণিতে।
অক্রূর রাজি হননি। তারপর যখন শতধম্বা কথা দিলেন যে, প্রাণ গেলেও মণি কার কাছে আছে তিনি বলবেন না, তখন অক্রূর স্যমন্তক মণিটি নিজের কাছে রেখে দিলেন সাগ্রহেই।
কৃষ্ণ-বলরাম দুজনেই পলায়মান শতধন্বার পশ্চাদ্ধাবন করলেন। একটি বেগবান অশ্বে আরোহণ করে, পাহাড়-পর্বত অতিক্রম করে শতধন্বা পালাতে লাগলেন। কিন্তু ভাগ্য এমনই যে, শতধন্বার অশ্বটি মাঝপথে মুখ থুবড়ে পড়ল এবং মারা গেল। অশ্ব থেকে নেমে শতধন্বা পদব্রজে পালিয়ে চললেন আঁকাবাঁকা পথ ধরে। পাচারে গমনশীল সেই যুবকটিকে ধরে ফেলতে কৃষ্ণের অসুবিধে হল না। তিনিও অশ্ব রেখে পদব্রজেই এসেছিলেন। বেশি কথা শতধন্বার সঙ্গে হয়নি। কৃষ্ণ বললেন, শতধন্বা! আমি জীবনদান করব তোমায়। তুমি শুধু বলো–মণিটি কোথায়?
মণিতে আমার প্রয়োজন নেই কোনো, মণি আমার কাছে নেইও।
কৃষ্ণ আর একটি কথাও বললেন না। মুক্তকোষ তরবারির একটি আঘাতে শতধন্বর মুণ্ডচ্ছেদন করলেন। শতধন্বার শির-বিযুক্ত শরীরের উদগত শোণিতে ভঁর পরিধেয় বস্ত্রযুগল মাখামাখি হয়ে গেল। কৃষ্ণ সেই পরিধানের আনাচে-কানাচে স্যমন্তক মণির সন্ধান করলেন। কিন্তু কোথাও মণি পেলেন না। কাছাকাছি মণিটি কোথাও পড়ে নেই, পড়ার সম্ভাবনাও নেই। কারণ কৃষ্ণের সঙ্গে তার কোনো যুদ্ধই হয়নি, কৃষ্ণের কমলদল সন্নিভ নয়ন দুটি অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। তিনি দ্রুতগতিতে ফিরে এলেন বলরামের কাছে। বলরাম অশ্ব দুটি নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন কৃষ্ণের জন্য।
‘দাদা! স্যমন্তক মণি নেই শতধন্বার কাছে’-কৃষ্ণ চেঁচিয়ে উঠলেন। বলরাম ঠিক বিশ্বাস করলেন না। নিজের প্রিয় ভ্রাতাটিকেও বলরাম বিশ্বাস করলেন না। বললেন–তুমি এত অর্থপিশাচ! আমার কাছেও তুমি লুকোচ্ছ।
–বিশ্বাস করুন। আমি শতধন্বকে হত্যা করেছি। কিন্তু তার কাছে নেই মণিরত্ন স্যমন্তক।
–আমি বিশ্বাস করছি না এবং এই মুহূর্তে আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি। তোমার সঙ্গ করাও পাপ।
বলরাম স্বকপোলককল্পিত ধারণায় কৃষ্ণকে ছেড়ে চলে গেলেন। তখনই অপার দুঃখ হৃদয়ে বহন করে কৃষ্ণ অশ্বারোহণে সত্যভামার গৃহে ফিরে এলেন। সত্যভামার প্রকোষ্ঠে মণিময় আসনের ওপর নিষগ্ন হয়ে নিজের উত্তরীয় বসনখানি চেপে ধরলেন নিজের মুখের ওপর। সত্যভামা বললেন, আর্যপুত্র আমার পিতৃহন্তাকে উপযুক্ত শাস্তি দিয়েছ তো? তুমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলে আমার কাছে। কৃষ্ণ বললেন, খুব ভুল হয়ে গেছে, সত্যভামা! এটা একটা গভীর ষড়যন্ত্র, শতধন্বা এই ষড়যন্ত্রের বলি হল মাত্র।
-তোমার কথা ভালো করে বুঝতে পারছি না, আর্যপুত্র!
-বুঝবে কী করে? আমি শতধন্বর মুণ্ডচ্ছেদ করেছি। অথচ মণিরত্ন স্যমন্তক তার কাছে নেই। আমি শুধু শুধুই এই বালককে হত্যা করেছি।
–শুধু শুধু কেন? সে আমার পিতাকে হত্যা করেছে।
-হত্যা করেছে’ নয়, তাকে দিয়ে করানো হয়েছে। অন্যকৃত ষড়যন্ত্রে এই বালক ব্যবহৃত হয়েছে মাত্র।
কারা এই ষড়যন্ত্র রচনা করেছে!
–তারাও তোমার প্রতি আসক্ত ছিল সত্যভামা; কিন্তু সেই আসক্তির মূলে ছিল স্যমন্তক মণি। আর এই কিশোর বালক, যে শুধু তোমাকেই ভালোবাসত, ভাগ্যের বিড়ম্বনায় আজ সে প্রাণ দিল। সে কোনো অন্যায় করেনি। সত্যভামা মনে মনে তাড়িত বোধ করলেন। ওই কিশোর বালক মাঝে মাঝে নানা প্রণয় বচনে তাকে উত্ত্যক্ত করত বটে, কিন্তু তার প্রণয় যে এত গভীর তা তিনি ভাবতেও পারেননি। কৃষ্ণ বললেন–আমার সঙ্গে তোমার বিবাহ হয়েছে বলেই সে তোমার পিতাকে হত্যা করেছে, মণির জন্য নয়। মণির প্রয়োজন অন্যের, তারা তোমার প্রণয়ক্ষুব্ধ শতধন্বাকে ব্যবহার করেছে।
–আমি কেন এমন করে অপরাধী হলাম!
–অপরাধী তুমি নও। সত্যভামা! অপরাধী আমি। এই কিশোর বালক এক সময় আমার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছিল, যাতে সে তোমাকে বিবাহ করতে পারে। সামান্য কথাপ্রসঙ্গে তুমি যদি একবারও এই কিশোরের নাম উচ্চারণ করে থাক, তবে সেই কথাটুকু শোনার জন্য এই বালক অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত। আর সেই বালককে আমি নৃশংসভাবে হত্যা করলাম!
–আমাকে শাস্তি দাও, আর্যপুত্র! আমিই এই বালককে হত্যা করেছি।
–ভুল, সত্যভামা! ভুল! আজ আমি তার মুণ্ডচ্ছেদ করেছি বটে, কিন্তু তার প্রকৃত হত্যাকাণ্ড সম্পূর্ণ হয়েছে সেই দিনই, যেদিন আমি তোমাকে বিবাহ করেছি।
–তুমি এসব কী বলছ, আমার ভালো লাগছে না, একটুও ভালো লাগছে না।
–সত্যভামা! যাদবকুলের অগ্রগণ্য পুরুষেরা তোমাকে কামনা করতেন, আমি সেই প্রৌঢ় পুরুষদের গ্রাহ্য করি না। কিন্তু তোমার জন্য শতধন্বা ব্যক্তিগত প্রার্থনা আমি জানতাম। রমণী-সমাজের লোমভূতা, এতগুলি পুরুষের প্রার্থনীয়া তোমাকে যেদিন আমার হাতে তুলে দিলেন তোমার পিতা, সেদিন….সেদিন কই…আমি তো শতধন্বার নামও উচ্চারণ করিনি; তাকে তো গিয়ে বলিনি-বৎস! আমি দুঃখিত! তোমাকে আমি বঞ্চনা করেছি। বরঞ্চ আমি গর্বিত বোধ করেছি। এতগুলি পুরুষের প্রার্থনীয়া রমণী কোনো ভাগ্যবলে এখন আমার, শুধু আমারই।
কৃষ্ণ সত্যভামাকে আলিঙ্গন করলেন। দুজনের মুখে অস্ফুটে একই শব্দ উচ্চারিত হল–শতধন্বা! আলিঙ্গন প্রগাঢ় হল।