সতী
দেওরালার ভয়াবহ ঘটনা আমাদের সত্য সত্যই বিচলিত করে তুলেছে— আমরা আমাদের ধর্ম-সামাজিক পরম্পরার বিভিন্ন ধারা আলোচনা করতে শুরু করেছি। এ কী কেবল একট বিচ্ছিন্ন ঘটনা? না কি ইতিহাসে ঐতিহ্যে এর শিকড় সুদূর প্রসারিত? এই ঘটনা কি স্বেচ্ছায় আত্মহত্যা না কি তার শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়রা, প্রতিবেশীরা প্রয়োজনীয় ইন্ধন জুগিয়েছিল অথবা কোনও নির্মম চক্রান্তের শিকার হয়ে তাকে অনিচ্ছায় প্রাণ দিতে হল? নিহতের অথবা তার স্বজনবর্গের মানসিক অবস্থা যাই হোক না কেন, যে তথ্য আমাদের প্রকৃত ভাবে আহত এবং বিস্মিতও করে তা হল এই যে, বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এই ঘটনা সত্যই ঘটেছে। এ কথাই আমাদের বিভ্রান্ত করে, এক প্রতিস্পর্ধার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়: এই হত্যা কেবল ঘটেইনি, বহু দৃষ্টিকোণ থেকেই এই ঘটনার প্রশংসা এবং অভিনন্দন জানানো হয়েছে। সে কি কোনও ধর্মীয় প্রেরণার বশবর্তী হয়ে না কি অন্য কোনও আবেগের ফলে? ভবিষ্যতে আরও অনেক মৃত্যুকে প্রতিহত করার জন্য কেমন করে এই প্রেরণাকে বিনষ্ট করা যায়?
রূপ কানোয়ার ‘সতী’ হয়েছেন। ‘সতী’ শব্দের অর্থ কি? আমাদের ভুললে চলবে না যে ভারতীয় ভাষাগুলির ক্ষেত্রে ‘সতী’র কোনও পুংলিঙ্গ প্রতিশব্দ নেই। অর্থাৎ সম্পূর্ণ ভাবে এবং বিশেষ ভাবে শব্দটির নৈতিক তাৎপর্য কেবল কোনও নারীর প্রতিই প্রযোজ্য। কী এই তাৎপর্য? ‘সদ্যবিধবা নারী তার মৃত স্বামীর চিতায় আরোহণ করে এবং নিজেকে উৎসর্গ করে, প্রথমত পরলোকে তার স্বামীর স্বচ্ছন্দ অবস্থানের জন্য, দ্বিতীয়ত স্বর্গে চিরকাল স্বামী সঙ্গ সুখের আশায়।’আলোচ্য বিশেষ ঘটনার ক্ষেত্রে আমরা জানতে পারি যে রূপ কানোয়ারের স্বামী ছিল নির্বীর্য, তাই তার মৃত্যুর কিছুদিন আগেই সে স্বামীকে ত্যাগ করেছিল অপর এক পুরুষের জন্য। তাই সঙ্গত ভাবেই প্রশ্ন ওঠে অনন্তকালের জন্য সেই স্বামীর সঙ্গলাভের আশায় কি সে সত্যই ব্যাকুল ছিল? হয়তো এ সম্ভাবনা তার কাছে ভয়াবহ হয়েই দেখা দিয়েছিল।
রূপ-এর আত্মোৎসর্গের বিভিন্ন ব্যাখ্যা, অন্তত যুক্তি ও মানবতার বিচারে যে তথ্য তাৎপর্যপূর্ণ, তা হল বহু শাস্ত্রগ্রন্থ এবং সমাজের একটি বৃহৎ অংশের মিলিত সিদ্ধান্ত এই যে স্বামীর চিতায় আত্মহননই সদ্যবিধবার উচিত কাজ। এখানে আমাদের মনে রাখতে হবে, স্বামীর মৃত্যু ছিল স্বাভাবিক। কোনও সচেতন আত্মহত্যার পিছনে যে বাড়তি যন্ত্রণা, সে দুর্ভোগ তাকে সহ্য করতে হয়নি। মৃত্যু যখন উপস্থিত হল, তখন তার সামনে কোনও বিকল্প ছিল না, কিন্তু তার বিধবা পত্নীর ক্ষেত্রে ছিল। তবু কোন অমানবিক পারিপার্শ্বিক ওই বিধবাকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিল?
সম্ভবত সহমরণ প্রথার শিকড় বহু দূরে প্রসারিত। অথর্ববেদ-এ আমরা দেখি ‘আমরা মৃতের বধূ হওয়ার জন্য জীবিত নারীকে নীত হতে দেখেছি অথবা এই নারী প্রাচীন প্রাথারই অনুগমন করছে।’ (অথর্ববেদ ১৮:৩:১,৩)। এই প্রথা কত প্রাচীন? এটি কী প্রাগার্য যুগের? সম্ভবত তাই। কারণ, গ্রিক, রোমান, জার্মান অথবা কেল্টিক প্রাচীন সাহিত্যে অর্থাৎ অন্যান্য সমগোত্রীয় ইন্দো-ইউরোপীয় সাহিত্যে স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীকে দাহ করার কোনও সাক্ষ্য পাওয়া যায় না। যেখানে অথবা যখনই এর সূচনা হয়ে থাক, প্রমাণ রয়েছে যে আর্য ও প্রাগার্যদের মিশ্র জনগোষ্ঠী অন্তত আংশিক ভাবে, সাময়িক ভাবে হলেও অথবা আঞ্চলিক ভাবে এই প্রথাকে গ্রহণ করেছিল, যদিও কখনওই প্রথাটি বহুল প্রচলিত হতে পারেনি। মহাভারত-এ পাণ্ডুর মৃত্যুর পরও কুন্তী বেঁচে থাকেন। মাদ্রীর স্বেচ্ছায় মৃত্যু কোনও সহমরণের ঘটনা নয় বরং অপরাধবোধে আত্মোৎসর্গ। মনে হয় যে ওই সময়ে এই প্রকার সহমরণ ছিল বিকল্প প্রথা। মূল কাব্যে মাদ্রীর মৃত্যু একক ব্যতিক্রম মাত্র। উভয় মহাকাব্যেই অধিকাংশ বিধবা জীবিত থেকেছেন; স্বর্গে অনন্তকাল স্বামীসঙ্গে বাস করার প্রলোভনে কেউ তাঁদের আত্মহননে প্রলুব্ধ করেনি। যখন হর্ষচরিত রচিত হয়েছিল সেই সময় উত্তর ভারতীয় সমাজ এক অনুদার সংরক্ষণশীল পরিস্থিতির মধ্যে দিন কাটাচ্ছিল। তবুও যখন যশোবতী, তার স্বামীর মৃত্যুর পর চিতারোহণে উদ্যত হলেন, কেউ তাঁকে উৎসাহিত করেননি; বরং যাদের কাছে তিনি বিদায় নিতে গেছেন তাঁরা প্রত্যেকেই তাঁকে নিরস্ত করেছেন। এরও পূর্ববর্তী সাহিত্যে কালিদাসের কুমারসম্ভব কাব্যে দেখা যাচ্ছে স্বামীর বিয়োগে কাতর রতি আত্মহত্যায় উদ্যত বলে কবি বর্ণনা করছেন, এর খুব সম্ভাব্য কারণ, বাস্তবে তা ঘটবে না। রঘুবংশ একাধিক রাজার মৃত্যুর উল্লেখ আছে কিন্তু স্বামীর সহমৃতা একটিও বিধবার কথা নেই। পরবর্তী যুগের সাহিত্যে, বিশেষ করে রাজতরঙ্গিনীর মতো প্রাচীন মধ্য যুগের সাহিত্যে, স্বামীর সহমরণে যাওয়ার ঘটনা বহুবার উল্লেখিত হয়েছে, সমাজের প্রশংসাও পেয়েছে।
মহাভারত-এ দক্ষযজ্ঞের একাধিক বিবরণ রয়েছে কিন্তু শিব-নিন্দার কারণে দক্ষযজ্ঞ ধ্বংসের উল্লেখ নেই। অতঃপর শিব ক্রোধে যজ্ঞ পণ্ড করেন। পরবর্তী পুরাণগুলিতে, বায়ু পুরাণ (৩০:৪০-৪৫) স্কন্দ পুরাণ ও বামন পুরাণ-এ কাহিনিটির উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এই পরিচিত কাহিনির একটি বিশদ সংস্করণ পাওয়া যায় অর্বাচীন, গৌণ শিব পুরাণ-এ (১৭:২৫-২৯)। এখানে পতিব্রতা স্ত্রী সতী, তাঁর স্বামীর নিন্দা সহ্য করতে না পেরে স্বেচ্ছায় প্রাণত্যাগ করেছেন। কিন্তু অগ্নিদগ্ধ হয়ে নয়। এই কাহিনিতে সতী বিশেষণটি (প্রকৃতপক্ষে তাঁর নাম) একটি নূতন মাত্রা পেয়েছে: যখন স্বামীর অপমান হয় তখন স্ত্রীর জীবন সম্পূর্ণ অর্থহীন, তাই তিনি স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে বেছে নিয়েছেন। দক্ষের কন্যা পুনর্জন্ম নিলেন হিমালয় দুহিতা পার্বতী রূপে এবং আবার শিবকেই বিবাহ করলেন। সতী-র ভাবমূর্তিতে এবার নূতন একটি সংজ্ঞা যুক্ত হল: স্বামীর সম্মান রক্ষার জন্য তিনি স্বেচ্ছায় মৃত্যু বরণ করলেন। এ কথা বলা নিষ্প্রয়োজন যে সমস্ত সাহিত্যের কোথাও স্ত্রীর সম্মান বা মর্যাদা রক্ষার জন্য স্বামীর পক্ষে কোনও প্রকার দুশ্চিন্তার অবকাশ রাখা হয়নি। কারণ খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়, কখনওই মানুষ হিসাবে সামাজিক সম্মান মেয়েদের প্রাপ্য ছিল না। তাই ধৃতরাষ্ট্রের সভায় কুরু বৃদ্ধদের মতো প্রত্যেকেই বিনা প্রতিবাদে নারীর নিগ্রহ এবং অপমান প্রত্যক্ষ করেছে।
সতীদাহের সূত্রপাতে দেখা যায় ধর্মশাস্ত্রে ও পুরাণগুলির চিন্তাধারায় যেখানে একে পবিত্ৰ, কর্মের আখ্যা দেওয়া হয়েছে। ব্যাসস্মৃতি-র নিদান অনুসারে কেবলমাত্র ব্রাহ্মণ-নারীর—অন্য কোনও বর্ণের নয়— অধিকার আছে নিজের স্বামীর চিতায় দগ্ধ হওয়ার। ‘এবং যদি সে জীবিত থাকে, তবে উত্তম বস্ত্র ও গহনা পরিত্যাগ করবে, এবং তপস্যার দ্বারা শরীরকে শুদ্ধ করবে।’ (২:৫৩) এখানে একটি বিকল্প রয়েছে: বিধবা নারী তপস্বিনী হয়ে বেঁচে থাকতে পারতেন; পরাশরের ধর্মসূত্র-তেও বিকল্প ব্যবস্থার স্বীকৃতি রয়েছে: যে নারী স্বামীর মৃত্যুর পর তপস্যাচরণ করে থাকেন তিনি তপস্বীদের মতোই স্বর্গলাভ করেন। (৪:২৭) কিন্তু তার একটু পরেই বলা হয়েছে মানুষের শরীরে সাড়ে তিন কোটি লোম থেকে, যে নারী মৃত্যুতেও তার স্বামীকে অনুগমন করে, সে স্বামীর সঙ্গে ৩৩] বৎসরই স্বর্গবাস করে।’ (৪:২৮) এখানে অন্তর্নিহিত বক্তব্য এই যে জীবিত থাকার বিকল্প নিকৃষ্ট নারীর জন্যই প্রযোজ্য; সতী নারী সহমরণের পথ বেছে নেন এবং স্বর্গে চিরকাল স্বামীসঙ্গ লাভ করেন। সদ্যবিধবাকে তার দুর্বল, বিহ্বলতর মুহূর্তে এই কথা বলা হত। দক্ষসংহিতা-তে বলা হচ্ছে, যে সতী নারী স্বামীর মৃত্যুর পর অগ্নিতে প্রবেশ করে সে স্বর্গে পূজা পায়। যেমন করে সাপুড়ে সাপকে তার গর্ত থেকে টেনে বার করে তেমন ভাবে সতী তার স্বামীকে নরক থেকে আকর্ষণ করে এবং তার সঙ্গে সুখে থাকে। হারীত সংহিতা-য় বলা হয়েছে ‘যে নারী স্বামীর চিতায় আত্মোৎসর্গ করে সে তার, পিতৃকুল, স্বামীকুল উভয়কেই পবিত্র করে।’ (৫:১৬০) যাজ্ঞবল্ক্য অবশ্য সহমরণকে অনুমোদন করেন না; সেখানে বলা হয়েছে স্বামীহারা পত্নীর দায়িত্ব নেবেন তাঁর পিতা-মাতা, শ্বশুর-শাশুড়ি, এমনকী ভাইরাও মাতুল। অন্যথায় তার নামে নিন্দা হবে। (১:৮৬) বৃদ্ধ হারীত সংহিতা বলে কোনও বিধবা রমণী দিনে দুই বার মাত্র আহার করবে এবং সুগন্ধি ফুল, অলংকার, রঙিন পোশাক ও কাজল পরিত্যাগ করবেন।’ (১১:২০৫-২১০)
যাজ্ঞবল্ক্যের মতোই বিষ্ণুধর্মসূত্র-এর লেখকও বলেন বিধবা নারী আজীবন কঠোর সংযম অভ্যাস করবেন। (২৫:১৪) যদিও তিনি তার স্বামীর চিতায় মৃত্যুও সমর্থন করেন। মাদ্রী পাণ্ডুর চিতাতেই অনুমৃতা হয়েছিলেন, কিন্তু এ ঘটনা সহমরণের উদাহরণ নয়। পাণ্ডুর প্রতি অভিশাপের শর্ত অবমাননার জন্য প্রায়শ্চিত্তের চেষ্টামাত্র। মহাভারত-এর অর্বাচীন সংযোজিত অংশ মৌষল পর্বে কৃষ্ণের চার স্ত্রী রুক্মিণী, রোহিণী, ভদ্রা এবং মদিরা তাঁর চিতায় সহমৃতা হয়েছিলেন। এমনকী বসুদেবের আট পত্নীও তাঁর মৃত্যুর পরে সহমরণে গিয়েছিলেন। মনে হয় বৃষ্ণি ও সাত্বতদের মধ্যে এই প্রথা প্রচলিত ছিল। কোনও কোনও নারী তাদের স্বামীর মৃত্যুর পরে অথবা শীঘ্রই অগ্নিপ্রবেশ করেন, কারণ স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ তাঁদের কাছে অসহনীয় ছিল; যদিও কখনওই কোনও স্বামী বিচ্ছেদ বা মৃত্যুর দুঃখে নিজে মৃত্যুকে বরণ করেননি। ভারতীয় সাহিত্যে স্ত্রীর মৃত্যুতে স্বামীর আত্মোৎসর্গের কথা কোথাও পাওয়া যায় না।
যাজ্ঞবল্ক্য স্বামীর মৃত্যুতে স্ত্রীর সহমরণের বিধান না দিলেও তাঁর ভাষ্যকারেরা নিজেদের মতের সমর্থনে যাজ্ঞবল্ক্যের বক্তব্যকে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর একটি বিধিকে উদ্ধৃত করে মিতাক্ষরা টীকা বলে কোনও অন্তঃস্বত্ত্বা বা সদ্যোজাত শিশুর জননী ভিন্ন অব্রাহ্মণ চণ্ডাল সব নারীর জন্যই সহমরণ বাধ্যতামূলক। কিন্তু যাজ্ঞবল্ক্যের নিজের শাস্ত্রে বলা হয়েছে বিধবা তার পিতামাতা অথবা স্বামীর পিতামাতার পরিবারে অন্তর্ভুক্ত থাকবে সুতরাং সে জীবিতই থাকবে। কিন্তু যাজ্ঞবল্ক্যের মানবিকতাবোধ তাঁর টীকাকারেরা কল্পনা করেননি বরং পরিবর্তনশীল সামাজিক বিধির স্রোত অনুযায়ী তাঁর শাস্ত্রবিধানকে পরিবর্তিত করেছেন। এমনকী স্বভাবত সংরক্ষণশীল মনুও কিন্তু বিধবার জন্য সংযত নিয়ন্ত্রিত জীবনের বিধান দিয়েছেন, স্বামীর সঙ্গে সহমরণের বিধান নয়। তিনি বলেছেন ‘বিধবার ভক্ষ্য হবে শুধু ফলমূল এবং ফুল, সে শীর্ণ হবে, কোনও অসম্পর্কিত পুরুষকে এমনকী নাম ধরেও সম্বোধন করবে না। (৫:১৫৭) এখানে শীর্ণ’ হওয়ার যে বিধান তার অন্তর্নিহিত অর্থ হল ‘আয়ুক্ষয়’, কিন্তু সদ্য বৈধব্যের পরই মৃত্যুর সঙ্গে এর পার্থক্য আছে। ভাষ্যকার মেধাতিথি এই শ্লোকের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন ‘পুরুষের পক্ষে যেমন, স্ত্রী লোকের পক্ষেও তেমন, আত্মহত্যা সমর্থন যোগ্য নয়। যদিও অঙ্গিরস বলেন স্বামীর চিতায় মৃত্যুই নারীর পক্ষে বাধ্যতামূলক, কিন্তু এ ক্ষেত্রে মৌলিক বিধিকেই (নিত্যবিধি— এক্ষেত্রে আত্মহনন উচিত নয়) অনুসরণ করতে হবে। যদি কোনও বিধবা ফললাভের তীব্র (অন্যায্য, উদগ্র) আশায় প্রলুব্ধ হয়ে আত্মহত্যা করে তবে শাস্ত্রানুসারে কাজ করা হল না। বৌধায়ন ধর্মসূত্র বলে যে, ‘বিধবা এক বছরের জন্য মধু, মাংস, মদ্য এবং লবণযুক্ত আহার্য ত্যাগ করবেন।’ (২:২:৬৬-৬৪) এখানে লক্ষণীয় এই যে অবিধবাদের জন্য মাংস ভোজন ও মদ্যপানের পরোক্ষ স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
সাধারণত সকল শাস্ত্রকারই আত্মহত্যাকে হীন অপরাধ বলেছেন কিন্তু মিতাক্ষরা এবং অপরার্ক ভাষ্যে বলা হয়েছে ‘সতী’র ক্ষেত্রে অর্থাৎ সহমরণের ক্ষেত্রে আত্মহত্যা কোনও অপরাধ নয়। অপরার্ক, আপস্তম্বকে উদ্ধৃত করে বলছেন, যে নারী মায়াবশে ভ্রান্ত হয়ে চিতা থেকে নেমে আসে সে ‘প্রাজাপত্য’ প্রায়শ্চিত্তের মাধ্যমে নিজেকে শুদ্ধ করতে পারে। এখানে লক্ষ্য করা উচিত যে, সমস্ত পৃথিবীতেই আত্মহত্যা নিজের প্রতি একট হিংসাত্মক অপরাধ বলে গণ্য হয়। তবুও যদি ও সব যুগেই এই সত্য পুরুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, নারীর ক্ষেত্রে কিন্তু ‘সতী’র মতো আত্মহত্যার ঘটনা কোনও পাপ বা অপরাধ তো নয়ই, বরং পুণ্যকর্ম।
আত্মরক্ষার প্রবৃত্তি বিশ্বজনীন এবং সমর্থনযোগ্য (তুল বহু প্রচারিত উক্তি: আত্মানং সততং রক্ষেৎ— নিজেকে সর্বদা রক্ষা করবে) কিন্তু যখন কোনও নারী চিতা থেকে নেমে এসে নিজেকে রক্ষা করতে যায় তখন সে কাজ পাপ হয়ে দাঁড়ায়। অঙ্গিরসকে উদ্ধৃত করে বলা হয় ‘সতী নারীর চিতায় আত্মোৎসর্গের কোনও বিকল্প নেই।’ ‘সতী’র প্রতিশব্দ হল ‘সাধ্বী’ এবং ‘সতী’ শব্দের মতো এরও কোনও ‘পুংলিঙ্গ’ শব্দ নেই। ‘সৎ’-অর্থ ভাল। যদি কোনও নারী সারা জীবন পবিত্র এবং ভাল থেকে থাকে তবু মৃত স্বামীর জন্য আত্মহনে অস্বীকৃত হলেই সে হয়ে যায় মন্দ—অসতী, অসাধ্বী।
স্মৃতিশাস্ত্রের নব্য মধ্যযুগীয় পণ্ডিত রঘুনন্দন। তিনি অঙ্গিরসকে উদ্ধৃত করে বলেন ‘সেই নারী যে চিতারোহণ করে, এর অর্থ থেকে বোঝায় অন্যান্য যে সব নারী সতী হতে চাইতই না তাদের জন্য বিকল্প পথ খোলা ছিল। রঘুনন্দন অনুমোদন করেন যে বিধবার পক্ষে শ্রেষ্ঠ পন্থা হল মৃত স্বামীর চিতায় আরোহণ করা, কিন্তু তিনিও যারা স্বামীর মৃত্যুর পরে বেঁচে থাকতেই চায় তাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা রেখেছেন। তাঁর মতে, যে সতী হয় সে হল শ্রেষ্ঠ কিন্তু, অন্যরাও থাকতে পারে; যারা শ্রেষ্ঠ না হলেও বাঁচতে চায়, সে জন্য তাদের পাপী মনে করা উচিত নয়। বিষ্ণু ধর্মশাস্ত্র-তেও এই দুটি বিকল্পকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। স্বামীর মৃত্যুর পর (নারী) সংযত তপস্বিনীর জীবনযাপন করবে অথবা স্বামীর তিায় আরোহণ করবে। এখানে লক্ষণীয় এই যে প্রথম বিকল্পটি বেঁচে থাকাকেই সমর্থন করে।
কী এই সংযম? যৌন জীবন থেকে বিরতি— তাম্বুল, প্রভৃতি পরিত্যাগ ইত্যাদি। ইত্যাদি শব্দটির ব্যাখ্যায় টীকাকার উল্লেখ করেছেন কাঁসা, প্রভৃতি ধাতুর পাত্রে আহার এবং প্রসাধন দ্রব্যাদি বর্জনের কথা। এই প্রসাধন দ্রব্যাদি কী? রঘুনন্দন বলেন, ‘এই অভ্যঞ্জন একটি চিকিৎসা শাস্ত্রের ব্যবহারিক প্রয়োগ, এর অর্থ হল সেই পরিমাণ কেশ-তৈল যা মাথা থেকে দুই কাঁধ এবং বাহু পর্যন্ত লিপ্ত হতে পারে আর অল্প পরিমাণকে বলা হয় মাষ্টি।’ অনেক অর্বাচীন শাস্ত্র গ্রন্থে বিধবার জন্য দিনে একবার আহারের বিধান দিয়েছে, এবং তাকে পালঙ্কে শোবার অনুমতিও দেওয়া হয়নি— অন্যথায় তার স্বামী পরলোকে দুর্গতি ভোগ করবে। স্কন্দপুরাণ বলে বিধবা যদি কবরী রচনা করে তাহলে স্বামীর পক্ষে তা পাপ হয়ে দাঁড়ায়। উদাহরণ আরও দেওয়া যায়; কিন্তু শাস্ত্রীয় এই সব বিধিনিষেধের অন্তর্নিহিত চিন্তা খুবই স্পষ্ট। এই সব হীনবুদ্ধি শাস্ত্র গ্রন্থগুলির উদ্দেশ্য হল ন্যূনতম মানবিক সুখ সুবিধা থেকেও বিধবাদের বঞ্চিত করা। এই প্রসঙ্গে স্মরণীয় যে বিগতদার ব্যক্তির জন্য শোকপালনের সীমা মাত্র একদিন, যার পরে সে কেবল পুনর্বিবাহ করতেই পারে না, তার জন্য পুনর্বিবাহ করার বিধানই দেওয়া হয়েছে।
হারীত ‘সাধ্বী’ নারীর সংজ্ঞা দিয়েছেন ‘স্বামী যখন দুঃখ পায় তখন সে দুঃখ পায়; স্বামীর সুখ ভোগে সে সুখ পায়, স্বামী গৃহ ছেড়ে গেলে তাকে দেখে মনে হয় ভেঙে পড়েছে এবং সে ব্যাকুল হয় এবং স্বামীর মৃত্যুতে প্রাণ ত্যাগ করে।’ এই প্রকার নারীই পতিব্রতা। এই গ্রন্থটিকে বলা হয় অর্বাচীন বৈদিক সাহিত্য। মহাভারত-এ বলা হয়েছে যথাযথ সময়ে (অর্থাৎ স্বামীর মৃত্যুর পরে) যদি নারীরা তাদের (মৃত্যুতেও) অনুসরণ করে, এমনকী অনুরাগ, ক্রোধ ভয় অথবা ভ্রান্তির বশে, তবুও সেই সব নারীরা পবিত্র হয়ে ওঠেন (মতান্তরে এই সব প্রবৃত্তি থেকে নারীরা সহমরণের মাধ্যমে পবিত্র হয়ে ওঠেন)। ব্রহ্মপুরাণ বলে যদি স্বামীর প্রবাসে মৃত্যু হয়ে থাকে তবে স্ত্রীর কর্তব্য স্বামীর পাদুকা বুকে ধরে অগ্নিপ্রবেশ করা। আমরা লক্ষ্য করি যে, সমস্ত পরবর্তী শাস্ত্রগুলিই ক্রমান্বয়ে এমন এক পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে চলেছে যেখানে বিধবা নারীর বেঁচে থাকার অধিকার হারিয়ে যাচ্ছে।
ঋগ্বেদ-এর একটি অর্বাচীন অংশের উদ্ধৃতি দিয়ে রঘুনন্দন বলেন নারীর আত্মহত্যা করা উচিত নয়। বিভিন্ন মত আলোচনা করে তিনি বলেছেন ব্রাহ্মণ-বিধবা কেবলমাত্র স্বামীর চিতায়, পৃথক কোনও চিতায় নয়, মৃত্যুকে বেছে নিতে পারেন। এই ভাবে তিনি ব্রাহ্মণ বিধবার জীবনের সম্ভাবনাকে আংশিক ভাবে হলেও সম্ভাব্য করেছেন। ব্যাস ধর্ম শাস্ত্র বলে, ‘যদি স্বামী এমন দূরত্বে মারা যায় যে, পথ এক দিনের, তবে যতক্ষণ না স্ত্রী সহমরণের জন্য উপস্থিত হচ্ছে ততক্ষণ দাহ করা উচিত নয় এবং যে অগ্নিকর্তা সে উভয়েরই পারলৌকিক ক্রিয়া করবে।’ ভারতের মতো উষ্ণ দেশে মৃতদেহের একদিন অপেক্ষা করার ফলাফল সহজেই অনুমান করা যায়, তবে এই বিধিনিষেধ কেন? এর ফলে বিধবার জীবিত থাকার আশা ক্ষীণতর হয়। বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থের মূল প্রতিপাদ্য সংক্ষেপে এই কথাই বলে: হয় তাকে স্বামীর সঙ্গেই দাহ করা অথবা তার জীবৎকালকে করে তোল জীবিতমৃত্যু।
ব্রহ্মপুরাণ বলে, যে নারী স্বামীর বংশরক্ষার জন্য স্বামীর চিতায় আরোহণ করতে উদ্যত, তার জন্য উপস্থিত সকলে তাকে চিতারোহণে সাহায্য করবে। এই আবৃত্তি করে এই সব পবিত্র সুসজ্জিত নারীরা পতিব্রতা; তাঁরা তাঁদের স্বামীর দেহের সঙ্গে সঙ্গে চিতায় প্রবেশ করুন; এই কথা শুনে পতিব্রতা বিশ্বস্তা স্ত্রী পিতৃমেধ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে স্বর্গলাভ করবেন। রঘুনন্দন তাঁর ভাষ্যে বলেছেন পিতৃমেধ অনুষ্ঠান হল চিতায় আরোহণ করা। এ কথা বলার প্রয়োজন নেই যে, স্বর্গের এই পথ খোলা আছে শুধু বিধবার জন্য, বিপত্নীকের জন্য নয়।
বিষ্ণু ধর্মশাস্ত্র একটি সঙ্গত প্রশ্ন তুলেছে: এই ভাবে আত্মহননের কাজ নারীর পক্ষে পাপজনক কিনা— এ বিতর্কের সিদ্ধান্ত এই যে, যেহেতু তার স্বামীর চিতারোহণ করছে সে হেতু এই মৃত্যু আত্মহত্যা নয়। স্বামী এমনই এক পূত পবিত্র বস্তু যার ফলে তার চিতায় আত্মহত্যাও আর আত্মহত্যা থাকে না, পুণ্যকর্ম হয়ে দাঁড়ায়। সংক্ষেপে, বিধবার মৃত্যুই ভাল, সুতরাং বিভিন্ন কথায় সহমরণকে পুণ্যকর্ম বলে ঘোষণা করে তাকে উৎসাহ দেওয়া হয়। এরপরে রঘুনন্দন অনুত্তেজিত সুচিন্তিত ভাবে সতীর অন্ত্যেষ্টি ও শ্রাদ্ধক্রিয়া সম্পর্কে মতামত দিয়েছেন।
ব্যাসস্মৃতি বলছে চিতায় বিধবা নারী তার স্বামীর মৃতদেহে আলিঙ্গন করবেন; অথবা তার মস্তকমুণ্ডন করতে হবে। (২:৫৫) অন্যান্য শাস্ত্রেও এই প্রকার সব নির্দেশ পাওয়া যায়। যে যুক্তিতে তাকে প্রসাধন, সুগন্ধি, ফুল, ইত্যাদি ব্যবহার থেকে বিরত করা হয় সেই একই যুক্তিতে এই মুণ্ডনকে উচিত মনে করা হয়, যাতে তার চেহারায় নারী সুলভ আকর্ষণ না থাকে, সে কোনও পুরুষকে প্রলুব্ধ করতে না পারে। কিন্তু এই সমস্ত সাবধানতামূলক বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও পুরুষের প্রলোভন বাধা পেত না এবং যুগে যুগে পুরুষের যৌন আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য বিধবাই হয়েছে সহজলভ্য শিকার। আশ্চর্যের কিছু নেই যে, স্কন্দপুরাণ বলে, সমস্ত রকম অশুভ দ্রব্যের মধ্যে বিধবা হল অশুভতম। (৩:৭:৫০-৫১) ষষ্ঠ শতকে বরাহমিহির, তাঁর বৃহৎসংহিতা-য় বলেন, অহো নারীর প্রেম কি সুদৃঢ়, তারা স্বামীর দেহ ক্রোড়ে নিয়ে অগ্নিতে প্রবেশ করে। (৭৪:২৩)
নারদ স্মৃতিতে সাত প্রকার নারীর কথা বলা হয়েছে: (১) যার পূর্বে একজনের সঙ্গে বিবাহ হয়েছে; (২) কুমারী; (৩) যে বিধবাকে তার শ্বশুরকুল তার স্বামীর বংশে অন্য কাউকে সমর্পণ করেছে; (৪) নিঃসন্তনা বিধবা; (৫) যে বিধবা তার দেবরকে বিবাহ করতে অস্বীকার করে এবং নিজের পছন্দ মতো কাউকে বিবাহ করে; (৬) যে বিধবা যাকে কিনে আনা হয়েছিল অথবা যে বিদেশি এবং নিজে ইচ্ছা মতো যে অন্য কাউকে বিবাহ করে; এবং (৭) যে বিধবাকে তার গুরুজনেরা কোনও অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির হাতে দান করেন। এর মধ্যে শেষের চার শ্রেণিকে বলা হয় বহির্মুখী বা স্বেচ্ছাচারিণী অর্থাৎ বারাঙ্গনা, যদিও শেষোক্ত জন তার গুরুজনদেরই আজ্ঞা পালন করে। শাস্ত্রগ্রন্থ এই সাতজনকে বলেছে ‘পুনর্ভূ’ অথবা ‘অন্যপূর্বা’ অর্থাৎ যে নারীর পূর্বে অন্য পুরুষ ছিল। যাজ্ঞবল্ক্য ধর্মশাস্ত্র বলে পুনর্ভূ দুই প্রকার— কুমারী এবং অ-কুমারী; মনু (৯:১৭৬), বিষ্ণু ধর্মসূত্র (১৫:৮, ৯), বশিষ্ঠ ধর্মসূত্র (১৭:১৮) ‘পুনর্ভূ’র কথা বলেছে। গ্রন্থগুলিতে সতীদাহের বিকল্পের অবকাশ আছে।
বিধবার জীবিত থাকার সামাজিক অধিকার বিষয়ে এই বিতর্ক শুরু হয়েছে, ঋগ্বেদ-এর অর্বাচীন অংশের একটিমাত্র মন্ত্রের বিষয়ে বিভিন্ন ভাষ্য থেকে। প্রসঙ্গত ঋগ্বেদ-এর এই অংশটি দেশজ অধিবাসীদের সঙ্গে বহিরাগত জনগণের সংমিশ্রণ এবং উভয়ের সাংস্কৃতিক একীভবনের পরবর্তীকালে রচিত। এই মন্ত্রে কোনও সদ্যবিধবাকে সম্বোধন করা হয়েছে, যে চিতায় তার স্বামীর মৃতদেহের পাশে শুয়ে রয়েছে আত্মহননের সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে: ওঠো, হে নারী, যে শুয়ে আছে মৃতকে আলিঙ্গন করে, তুমি জীবিতের রাজ্যে এসো, যে পুরুষ তোমার হাত ধরে আছে তার স্ত্রীর অধিকার স্বীকার কর। (১০:১৮:৮)। কে তার হাত ধরে জীবিতের রাজ্যে নিয়ে যেতে চায়? আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র বলে এই পুরুষ হল তার দেবর, মৃত স্বামীর শিষ্য অথবা পুরাতন ভৃত্য। (৪:২:১৮) এখানে বহু বিষয়ে আমরা প্রশ্ন করতে পারি: তবে কী ওই বিধবা সতীর ভূমিকাটি অভিনয় করছে? অতঃপর দেবর অথবা অন্য কেউ তাকে চিতা থেকে হাত ধরে তুলে আনে (সম্ভবত দেবর শব্দটির উৎপত্তি ‘দ্বি—দুই বর’ এই ভাবে। এমনকী এখনও ওড়িশা এবং অন্যান্য রাজ্যের কোনও কোনও স্থানে কনিষ্ঠ দেবরের সঙ্গে বিধবা ভ্রাতৃবধূর পুনর্বিবাহ প্রথা চালু আছে। তৃতীয়ত, সহমরণে বাধা দেওয়ার কারণ বলা হয়েছে বংশ রক্ষার কাজ অব্যাহত রাখা, প্রজনন। ভাবী জননীর অকাল মৃত্যুকে প্রতিহত করা হয়েছে, কারণ নারীর প্রসবিনী শক্তি এবং সন্তানলাভ করা সমাজের প্রয়োজন ছিল। কোষগ্রন্থ শব্দকল্পদ্রুম-তে বলা হয়েছে দিদিষু শব্দের অর্থ ‘পুনর্ভু’; সেই জন্যই তাকে পুনর্বিবাহের প্রেরণা দেওয়া হয়েছে। মনে হয় স্বামীর চিতায় বিধবার আত্মাহুতি দেওয়ার প্রথা কোনও প্রাগার্য প্রথা, সম্ভবত সিন্ধু সভ্যতায় এই প্রথার প্রচলন ছিল, ইন্দো ইওরোপীয় সভ্যতায় এর কোনও সমর্থন পাওয়া যায় না। সুতরাং এই প্রথা অনুসরণে উদ্যত কোনও নারীকে (আর্য পুরুষদের অনার্য পত্নীরা নিজেদের প্রথা পালনে উদ্যোগী হতেই পারেন) অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী আর্য প্রথা মানতে বাধ্য করা হতেই পারে; সেই ঘটনাই আলোচ্য ঋগ্বেদের মন্ত্রে বর্ণনা করা হয়েছে। বিধবা নারীর পুনর্বিবাহের কিছু কিছু ঘটনা গ্রিক, লাতিন ও জার্মান সাহিত্যে দেখা যায়।
ঋগ্বেদ পরবর্তী ভারতীয় সাহিত্যে ক্রমান্বয়ে বিধবাকে দেখানো হয়েছে অশুচি ও অশুভ রূপে, তাঁর বেঁচে থাকার অধিকার হয়ে উঠেছে বিতর্কের বিষয়। তারপর বিভিন্ন উদ্দেশ্যমূলক পরিস্থিতির চাপে ওই ঋগ্বেদীয় মন্ত্রটির অর্থকে, সমাজপতিদের অনুকূলে পরিবর্তিত করে নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী শাস্ত্র ঋবিধান বলে, কেবল মাত্র নিঃসন্তান বিধবাকেই জীবিতের রাজ্যে ফিরিয়ে আনা চলে। (৩:৮:৪) অর্থাৎ মৃতের পারলৌকিক কাজ করার জন্য একজন যথাযথ অধিকারী চাই। কোনও কোনও শাস্ত্রে দেখা যায় দেবরের সঙ্গে বিধবার বিবাহ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। কিন্তু ঋগ্বেদ-এর আর একটি মন্ত্রের অর্থ বিষয়ে কোনও সংশয় থাকে না। অশ্বিনদ্বয়কে সম্বোধন করে বলা হয়েছে— অন্য কে তোমাদের (সূক্ত দ্বারা) স্তুতি করেছে, যেমন করে কোনও বিধবা শয্যায় তার দেবরকে সন্তুষ্ট করে। (১০:৪০:২) অতএব, ঋগ্বেদ-এর যুগে বিধবারা বেঁচেই থাকত এবং দেবরকে বিবাহও করত। এই প্রথা সে যুগে অবশ্যই বহুপ্রচলিত ছিল, অন্যথায় উপমা হিসাবে ব্যবহৃত হত না। অথর্ববেদ-এ এক নারীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে যে একাধিক বিবাহ করেছিল। (৯:৫:২৭) এমনকী দশজন স্বামী গ্রহণের কথাও বলা হয়েছে। (৫:১৭:১৯) এখানে অন্তত দ্বিতীয় ক্ষেত্রে বিধবার পুনর্বিবাহ যে প্রচলিত ছিল তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে। অথর্ববেদ-এ অবশ্য দু’বার সহমরণেরও উল্লেখ আছে। এই ভাবে এই প্রথার উদ্ভব ও প্রয়োগ যে প্রাগার্যদের মধ্যে ছিল না বোঝা যায়। হয়তো এটি সিন্ধু সভ্যতার প্রথার একটি স্মৃতিচিহ্ন। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ-এ প্রার্থনা করা হয়েছে, আমি যেন ইন্দ্রাণীর মতো অবিধবা হই। (৩:৭:৫:৫১) এখানেও স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবার বেঁচে থাকার পরোক্ষ ইঙ্গিত পাচ্ছি, কারণ বৈধব্যের দুঃখ যন্ত্রণার ভোগ সতীর কাছে অজানা।
রামায়ণ ও মহাভারত-এর মূল অংশে কোনও সতীদাহের ঘটনা নেই; মাদ্রী অনুতাপে আত্মহনন করেন কারণ তিনি পাণ্ডুর কামনার বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন। আর্য বসতিগুলির চারপাশের সমাজে এই প্রাগার্য প্রথার প্রচলন ছিল, সুতরাং স্বাভাবিক ভাবেই আর্যদের উপরেও এই প্রথার সক্রিয় প্রভাব পড়েছিল। কিন্তু রামায়ণে দশরথের তিন পত্নী; তারা, মন্দোদরী; ইন্দ্রজিৎ অথবা কুম্ভকর্ণের পত্নীরা কেউই স্বামীর সঙ্গে চিতা আরোহণ করেননি। মহাভারতেও সত্যবতী, কুন্তী, অম্বিকা, অম্বালিকা, দুঃশল। এবং দ্রৌপদী— তাঁর চার স্বামীর মৃত্যুর পরও বেঁচেছিলেন।
খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে খ্রিস্টিয় দ্বিতীয় শতক পর্যন্ত সময়ে উত্তর ভারতে বিদেশি অভিযানের মিছিল চলেছিল। এর ফলে সামাজিক পরিমণ্ডলে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছিল। ভগবদ্গীতা প্রথম থেকে দ্বিতীয় শতকে রচিত। এই গ্রন্থে কৃষ্ণ অর্জুনকে যুদ্ধের কুফল সম্পর্কে উপদেশ দিচ্ছেন— এতে বংশক্রম বিনষ্ট হয় এবং এর ফলে পরম্পরাগত ধর্ম ক্ষয় পায়। এইরূপ ঘটনা ঘটলে সমস্ত পরিবার অপবিত্র হয়, অভিজাত কুলনারীরাও দুষ্ট ব্যবহার করেন এবং বর্ণসংকর ঘটে থাকে। (১:৩৯:৪০) এই সব দুষ্টা কুলনারীদের মধ্যে যুদ্ধ-বিধবাদের দেখা যেতে পারে কারণ অর্জুন এখানে যুদ্ধ ও তার ফলাফল বিষয়েই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। অন্য ভাবে বলতে গেলে, যদি স্বামীর মৃত্যুর পরও বিধবা জীবিত থাকে, সে অন্য স্বামী বরণ করতে পারে এবং তারই ফলে ঘটে যাবে সর্বাধিক ভয়াবহ বিপদ— বর্ণসংকর। তখন পরিবার এবং তার ধ্বংসকারী উভয়েরই গতি হয় নরকে, পিতৃপুরুষের সংকার সঠিক ভাবে হয় না এবং তারা নরকে পতিত হয়। (১:৪২) এ কথা সহজবোধ্য এবং এ জন্যই সতী প্রথা উজ্জীবিত হয়, অংশত এই ভাবে ব্যাপক সামাজিক অবক্ষয় রোধের জন্য।
গুপ্তযুগে মনুর নির্ধারিত নীতিই প্রচলিত ছিল। (তুলনীয় রঘুনন্দন ১:১৭) যদিও মনু বিধবার জন্য স্বামীর চিতায় মৃত্যুর বিধান দেননি, তবু তিনি কঠোর সংযমবিধি নির্দেশ দিয়েছেন। এই যুগে পুরাণগুলি রচিত হতে শুরু করেছিল এবং সেগুলির মাধ্যমে নারী ও শূদ্রের প্রতি অবদমনের এক ক্রমবর্ধমান চিত্র পাওয়া যায়। সম্প্রদায়গত পুরোহিতগণ কয়েক শতক ধরে পুরাণ রচনা করে আসছিলেন; তাঁদের ধর্ম ও দর্শনগত মতবাদ ছিল ভিন্ন, কিন্তু নারী ও শূদ্রের প্রতি নিপীড়ন করতে তাঁরা প্রকৃতপক্ষে একমত ছিলেন।
বেদ-পরবর্তী যুগ থেকে পৌরাণিক যুগ পর্যন্ত কুড়িজন শাস্ত্রকার তাঁদের গ্রন্থ রচনা করেছেন: বহু বিষয়ে তাঁদের মতভেদও আছে। কেউ কেউ বিধান দিয়েছেন স্বামীর সঙ্গে বা তারপরে সতীদাহ করতে, কেউ বলেছেন শুধু ব্রাহ্মণ বিধবারাই এই ভাবে মারা যেতে পারেন; অন্যরা শুধু কঠোর নিয়ম পালন করবেন। কেউ কেউ বলেন যে সব বিধবা এই ভাবে মৃত্যুবরণ করেন তাঁরা পিতৃকুল ও পতিকুল উভয়েরই পূর্বপুরুষদের মুক্তি দেন। অন্যরা বলেন সাপুড়ে যেমন গর্ত থেকে সাপকে টেনে বার করে তেমন করেই একজন সহমৃতা সতী তার স্বামীকে নরক থেকে উদ্ধার করে। এই ভাবে বিষয়টি অনুমান করা হয় যে, যে স্বামী কোনও গুরুতর অপরাধ করে নরক ভোগ করছে, তাকে উদ্ধার করার একমাত্র উপায় হল পত্নার আত্মহত্যা। যে স্বামী তার নিজের পাপের জন্য নরকবাসের যোগ্য, সে উদ্ধার পেতে পারে একটি নিরপরাধিনী মেয়ের মৃত্যুতে— এই বিধানের অন্তর্নিহিত অবিচারে কোনও সংশয় নেই; ঠিক যেমন যে নারী পাপ করছে তাঁকে বাঁচাবার জন্যও কোনও দুশ্চিন্তা দেখা যায় না। সারা জীবন নীরবে স্বামীর সেবা করে যাওয়া আর তার মৃত্যুতে আত্মহত্যা করা, নারীর জন্য এই বিধান দেওয়া হয়েছে। কোনও কোনও শাস্ত্র আর একটু অগ্রসর হয়েছে: সে স্বর্গে তার স্বামীর সঙ্গে বাস করবে ত্রিশ কোটি বছর কিংবা তার শরীরে যত লোম আছে তত বছর, যখন স্ত্রীর মৃত্যু হয় স্বামীর আগে, তখন কিন্তু স্বামীর জন্য এমন কোনও নিষ্ঠুর বিধান নেই যাতে সে চিরদিন তার স্ত্রীর সঙ্গে বাস করবে। প্রচলিত প্রবাদ হল ভাগ্যবানের বউ মরে, অভাগার গরু। শাস্ত্র বিধান দেয় স্ত্রীর মৃত্যুতে স্বামীর শোক পালন এবং অশৌচ মাত্র এক দিনের। তারপরে তার পুনরায় বিবাহ করাই উচিত।
কানে-র আট খণ্ডে রচিত ধর্মশাস্ত্র বিষয়ক ইতিহাসে ‘সতী’ বিষয়ক কয়েকটি অধ্যায় আছে। তাঁর দেওয়া পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় যে, উনবিংশ শতকের বাংলায় (যা তখন বারাণসী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল) সতীর সংখ্যা সর্বনিম্ন ৩৭৮ (১৮১৫ খ্রি.) সর্বোচ্চ ৮৩৯ (১৮১৮ খ্রি.)। এবং, ১৮১৫ থেকে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কেবলমাত্র বাংলাতেই সংখ্যাটি ২৩৬৬, যার মধ্যে শুধু কলকাতাতেই সতীদাহের সংখ্যা ১৮৪৫। কানে-র মতে এর মুখ্য কারণ হল শুধু বাংলাতেই দায়ভাগ স্মৃতির অনুসরণ করা হয়, (বাকি ভারতবর্ষ মিতাক্ষরাকে অনুসরণ করে), এবং এই স্মৃতি অনুযায়ী বিধবাই স্বামীর সম্পত্তির অধিকারিণী। জনৈক জিতেন্দ্ৰিয় পরবর্তীকালে সংযোজন করছেন, ‘নিঃসন্তানা বিধবা তার স্বামীর সমস্ত সম্পত্তির নিঃশর্ত অধিকার পাবেন।’ কানে যথার্থই অনুমান করেছেন যে, পাছে বিধবা তার স্বামীর সম্পত্তির অধিকার চেয়ে বসে সেই ভয়ে তাকে সক্রিয় প্রেরণা দিয়ে এবং প্রচ্ছন্ন ভাবে ভয় দেখিয়ে স্বামীর চিতায় মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য করা হয়। ব্যবসায়ী আর উদ্যোগপতিরা যেহেতু বেশির ভাগই ছিলেন কলকাতাবাসী, তাই এখানে সতীর সংখ্যা এত নির্মম ভাবে বেশি— যাতে আইনানুযায়ী বিধবারা বিশাল সম্পত্তির অধিকারিণী হয়ে বসতে না পারে।
সমস্যা দুটি: পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, বিধবাদের স্বামীর চিতায় উঠতে প্রেরণা দেওয়া হত, জোর করে নিয়ে যাওয়া হত। তা যদি না হত তাহলে স্বামীর মৃত্যুতে যে বিধবা যথেষ্ট সম্পত্তি পেয়ে অর্থনৈতিক ভাবে স্বাধীন হচ্ছে সে কেন সহমরণে যাবে? সুতরাং নিকটবর্তী আত্মীয় এবং অর্থলোভী অন্যান্য উত্তরাধিকারীরা মেয়েটিকে সতী হওয়ার জন্য ভয় দেখায়, মিষ্টি কথায় ভোলায়। কিন্তু সেই সব বিধবারা যাঁরা এই সব প্রেরণাকে জয় করেও বেঁচে ছিলেন ও স্বামীর সম্পত্তির অধিকার নিয়েছিলেন— পরিসংখ্যান বলে সতীদের চেয়েও তাঁদের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু এই সব জীবিত বিধবাদের পরিণতি কি হয়েছিল? ব্রহ্মচর্য— সংযমের জীবন। অন্যান্য কিছু তপস্বী সম্প্রদায় যাঁরা ব্রহ্মচর্য অভ্যাস করতেন তাঁদের মাথা মুড়িয়ে, দিনে একবার মাত্র আহার করে বেঁচে থাকতে হত। ব্রহ্মচারী ছাত্রের সংযম-চর্যা শেষ হত তার স্নাতক হওয়ার পর। তারপর সে দিনে দু’বার আমিষ আহার করতে পারত, সুগন্ধ, প্রসাধন, অলংকার ব্যবহার করতে পারত। কোনও ব্রহ্মচারীকে কখনও অশুভ, অমঙ্গলকারী বলা হয় না। সুতরাং বিধবার ব্রহ্মচর্যা এক অদ্ভুত প্রকারের, যার লক্ষ্য হল বিধবাকে বঞ্চিত ও নিপীড়িত করে তার মৃত স্বামীর আত্মার উপকার করা।
দায়ভাগ-এর প্রাধান্য সত্ত্বেও, তার স্বামীর সমস্ত সম্পত্তিতে তত্ত্বগত ভাবে অধিকার থাকা সত্ত্বেও, অশিক্ষিত বঞ্চিত সন্তানহীন বিধবার পক্ষে তার মৃত স্বামীর শক্তিমান পুরুষ আত্মজনের নিরাবরণ অর্থলোভের বিরুদ্ধে কী করা সম্ভব? এ সত্ত্বেও যদি সে পিতৃপরিবারের সাহায্যে নিজের দাবি প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, কেবলমাত্র সেই সম্ভাবনার ভয়েই সম্ভাব্য অধিকারিণীদের পুড়িয়ে মারা হত। বহু নারীর কাছে স্বামীর সম্পত্তির তত্ত্বগত অধিকার যে কেবল মরীচিকা ছিল, সে সত্য প্রমাণিত হয় সামান্য সাহায্যের ভরসায় বেঁচে থাকা কাশীবাসিনী বাঙালি বিধবার বিপুল সংখ্যা থেকে। বৃহত্তর সংখ্যায় বিধবারা তাদের আত্মীয়দের নিপুণ ছলচাতুরীর ফলে আইনসঙ্গত অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এরা বেঁচেছিল— বেঁচে থাকে— আত্মীয়দের বাড়িতে গলগ্রহ, বিনা বেতনের ঝি-এর মতন।
দ্বিতীয় সমস্যা হল, মিতাক্ষরা অনুসারী রাজ্যগুলিতে, যেখানে সন্তানহীনা বিধবা কেবল আশ্রয় আর খাদ্যের অধিকারী, এবং স্বামীর সম্পত্তিতে তার কোনও অধিকারের আশা নেই, সেখানে কী কোনও সতী ছিল না? মিতাক্ষরা-র শাসন মেনে চলা এমনই একটি অঞ্চল হল রাজস্থান। তবে কেন সেখানে জহরব্রতের (স্বামীর মৃত্যুতে নারীর স্বেচ্ছামৃত্যু) এত ব্যাপক প্রচলন? এ তো আক্ষরিক অর্থে গণ-আত্মহত্যা। এই সমাজ অনুমোদিত গণহত্যার ব্যাখ্যা কী? এখানেই একটি বাস্তব সমস্যা দেখা যায়।
হিন্দু সমাজ কোনও দিনই নারীর স্বতন্ত্র স্বাধীন পরিচয়কে মেনে নেয়নি বরং বারবার ঘোষণা করেছে যে, নারী স্বাধীনতা পাওয়ার যোগ্য নয়। তার উচিত স্বামীর পদাঙ্ক ছায়ার মতো অনুসরণ করা। যে সব অধিকার মানুষকে স্বাধীনতা দিতে পারে— শিক্ষা, সঙ্গী নির্বাচনের অধিকার, স্বাধীন বৃত্তি, সম্পত্তির অধিকার, নিজের দেহের ওপর অধিকার, সন্তান ধারণের সিদ্ধান্ত বজায় রাখার অধিকার, সমাজ শাসনে অথবা রাষ্ট্র শাসনে অংশ নেওয়া বা নিজের মত প্রকাশের অধিকার, নারী কখনওই এগুলি ভোগ করেনি। অবশ্যই কোথাও কোথাও কোনওখানে এর ব্যতিক্রম থাকতে পারে কিন্তু এগুলি শুদুই ব্যতিক্রম, নিয়মকেই কেবল প্রতিষ্ঠা করেছে। সমাজ কোনও কুমারী বা বিধবার সামাজিক সত্তাকে স্বীকৃতি দেয়নি; এখানে তার একটাই পরিচয়— সে কারও পত্নী। স্ত্রী রূপে তার আদর্শ কী? সতী হওয়া, পতিব্রতা হওয়া। স্বামীর প্রতি নিবেদিত প্রাণ হওয়া শব্দটির একটি তির্যক অর্থ আছে— স্বৈব স্বামী। আমাদের মনে রাখতে হবে এই অর্থে ‘সতী’র কোনও পুংলিঙ্গ শব্দ নেই, যেটা হতে পারত ‘পত্নীব্রত’, কিন্তু হয়নি। আবার পতিব্রতা শব্দের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এটা উচ্চ আদর্শ।
মহাভারত-এ বনপর্বে (এই অংশটি মহাকাব্যে ভার্গব প্রক্ষেপণের শেষতম অংশ এবং চরিত্রগত ভাবে প্রাক্ পৌরাণিক) সত্যভামা দ্রৌপদীকে প্রশ্ন করেছেন, তুমি কেমন করে তোমার পাঁচ স্বামীকে সন্তুষ্ট রাখ? উত্তরে দ্রৌপদী পতিব্রতার আদর্শ সম্পর্কে দীর্ঘ ভাষণ দিয়েছেন, যেটি সম্ভবত ভারতীয় সাহিত্যে পতিব্রতার সর্বপ্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্য সংজ্ঞা। (৩:২২২-২২৩) এর শুরুতেই দেখা যাচ্ছে— ‘অহংকার, কামনা, ক্রোধ ত্যাগ করে আমি সস্ত্রীক পাণ্ডবদের সেবা করি।’ (২২৮-১৮১) প্রত্যেক পাণ্ডবেরই দ্রৌপদী ছাড়া অন্য পত্নী ছিল। পতিব্রতা নারী প্রথম যে বস্তু ত্যাগ করবেন তা হল অহংকার, ব্যক্তির আত্মমর্যাদা। এরপর দ্রৌপদী, স্বামীর কাছ থেকে নারীর প্রাপ্য বিষয়ে একটি তালিকা দিয়েছেন— সন্তান, সুখভোগের নানা বস্তু, শয্যা, সুখাসন, পোশাক, মালা, সুগন্ধি, স্বর্ণ এবং নানা দুর্লভ দ্রব্য। (২২৩:৩) এর আগে তিনি বলেছেন স্বামী সন্তুষ্ট হলে তিনি এগুলি দিয়ে থাকেন, অন্যথায় নয়। বলা নিষ্প্রয়োজন যে এই তালিকায় ভালবাসা বা শ্রদ্ধার কোনও স্থান নেই। আর এ কথাও সুস্পষ্ট যে, এই সব উপহারের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সম্পর্ক কিন্তু জৈবিক স্বাচ্ছন্দ্য বা বস্তুগত সুখকে ছাপিয়ে যেতে পারে না। দ্রৌপদীর আলোচনা থেকে ধারণা পাওয়া যায় যে, পতিব্রতার আদর্শ হল স্বামী ও তার সংসারের প্রতি নিরবচ্ছিন্ন অক্লান্ত সেবা আর সম্পূর্ণ আত্মবিলোপ। শেষেরটিই পতিব্রত্যের ধারণার কেন্দ্রবিন্দু। পতিব্রতা তার নিজের পরিচয় সম্পূর্ণ লোপ করে স্বামীর স্বার্থসাধন করে যাবে। তবেই তার বিশেষণ হবে ‘পতিব্রতা’।
মানবিক মর্যাদার পক্ষে যা কিছু অতি গুরুত্বপূর্ণ তার সব কিছু থেকেই আমাদের সমাজ নারীকে বঞ্চিত করেছে; সুদূর বৈদিক যুগেই সে তার শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছিল, চিরকাল স্বাধীন জীবিকার অধিকার থেকে সে বঞ্চিত, জীবনের জন্য তার পাথেয় হল দৈহিক সৌন্দর্য, যৌবন, কর্মক্ষমতা, সন্তানধারণের যোগ্যতা; তার মনকে কখনও স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি, তাই সে নিজেকে কখনও স্বাতন্ত্র্যের সঙ্গে সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। স্বাধীন অস্তিত্বের আস্থা ও যোগ্যতা ছাড়া তার অস্তিত্ব কেবল প্রাণীরূপে, শূদ্রের মতোই সে-ও কেবল প্রভুর সম্পত্তি। এই পরিস্থিতিতে, শাস্ত্র নারীর জন্য একটিই ভূমিকার নির্দেশ দিয়েছে— পতিব্রতার ভূমিকা। কেবল এই কাজটিতে সফল হলেই একজন নারী জনগণের মনোযোগ পেতে পারে। সার্থকতার উপায় হল স্বামী ও শ্বশুরকুলের সেবায় তাদের প্রসন্নতার জন্য নিঃ শব্দ আত্মসমর্পণ।
যদি সে পাদ-প্রদীপের আলোয় আরও বেশি করে আসতে চায় তবে সেই ভাবে গুরুত্ব পাওয়ার উপায় হল সতী হওয়া, যা পতিব্রতার জীবনের চূড়ান্ত পর্যায়। সমস্ত পুরাণগুলি এবং পরবর্তী সাহিত্যের অধিকাংশই সতীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ভারতীয় নারীর অন্তর্নিহিত মূল্যবোধের মধ্যে এই ধারণা কাজ করে যে, একজন সতী তার স্বামীর সঙ্গে চিরকাল স্বর্গে বাস করে। একজন সুখী বিবাহিতা রমণীর কাছে এ এক লোভনীয় প্রস্তাব। কিন্তু অন্য দিকে যে নারী তার স্বামীর দ্বারা নিপীড়িতা, অবহেলিতা— তার কাছে এই চিন্তা বিতৃষ্ণাই সৃষ্টি করে। এর পরেও যদি ‘সতীর প্রাতিষ্ঠানিক ধারণা তার কাছে কোনও ভাবে অর্থবহ হয় তবে তার কারণ হল সতীদাহের পটচিত্রের মতো প্রেক্ষাপট, এর চোখ ধাঁধানে। নাটকীয় অতিম দৃশ্য, যেখানে শাঁখ বাজে, ঢাক ঢোল বাজে, জনতা জয়ধ্বনি করে আর সামাজিক উত্তেজনা ও ধর্মের বাতাবরণ তৈরি হয়। এই দৃশ্যপটের মধ্যে নায়িকা, সদ্যবিধবা নারী নববধূর মতো সাজে; তার শ্রেষ্ঠ পোশাক পরে, সিঁদুর কাজল ফুলমালা চন্দন আলতায় সুসজ্জিত হয়ে ধীরে ধীরে সে চিতায় ওঠে; তার স্বামীর পা দুটি বুকে আঁকড়ে ধরে কিংবা মৃতদেহকে দুই বাহুতে আলিঙ্গন করে; এই ভাবে যতক্ষণ না আগুন জ্বলে সে বিভ্রান্তির সঙ্গে অপেক্ষা করে। শেষ মুহূর্তে সে যাতে বিচলিত না হয়, এবং নীতিগত, দৃশ্যগত ভাবে ছন্দপতন না ঘটে, সে জন্য শুভাকাঙ্ক্ষিীরা তাকে উত্তেজক পানীয় পান করায়। এমনকী পরে যখন আগুনের লেলিহান শিখা অসহনীয় হয়ে ওঠে: পানীয়ের নেশা কেটে যায়; তখন যদি সেই বিধবা বিচলিত হয়ে পড়ে; ‘সতী’র মহিমা ক্ষুণ্ণ হওয়ার ভয় দেখা দেয়; যদি সে চিতা থেকে নেমে আসতে চায়— তখন সেই শুভাকাঙ্ক্ষীরাই তাকে বাঁশের লাঠি দিয়ে চেপে ধরে; প্রতিবেশী, পুরোহিত, সমাজকর্তা সকলেই অনুষ্ঠানের সাফল্যের জন্য অতিমাত্রায় সাহায্য করতে চায়। তারা গান করে, ঢাক বাজায়, এত উচ্চ জয়ধ্বনি দেয় যে, সতী যা কিছু বলতে চায় সবই উচ্চনাদে ঢেকে যায়।
যেখানে বিধবা স্বেচ্ছায় সতী হতে চেয়েছেন সেই রকম কয়েকটি মাত্র ব্যতিক্রমী উদাহরণ ছাড়া, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আত্মরক্ষার সহজাত প্রবৃত্তি কাজ করে এবং দীর্ঘকালীন সামাজিক শিক্ষাকে বিনষ্ট করে তার সেই প্রবৃত্তি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু একবার যখন ধার্মিক প্রতিবেশী আঁর সমাজের নৈতিক রক্ষাকর্তারা সিদ্ধান্ত নেন যে। মেয়েটিকে সতী হতেই হবে এবং যদি কোনও দুর্বল মুহূর্তে সে সম্মতি দিয়ে থাকে— বা না দিয়ে থাকে— তবু সে ভাগ্যের হাত থেকে অব্যাহতি পায় না। আমাদের মনে পড়ে সেই অধ্যক্ষের কথা, যিনি জয় সম্পর্কে সুনিশ্চিত ছিলেন, কারণ, তিনি বিশ্বাস করতেন ঈশ্বর তাঁদের জয়ে সাহায্য করবেন তাই অধস্তনদের উপদেশ দিতেন ‘ঈশ্বরে সর্বতো ভাবে বিশ্বাস রাখ কিন্তু বারুদ শুকনো রাখতে ভুল কোর না।’ ঠিক তেমনই, সম্ভাব্য সতীর উদ্দেশের দৃঢ়তা আর ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি পুরোপুরি ভরসা না রেখে লোকেরা প্রয়োজনীয় নৈতিক ও দৈহিক সাহায্য নিয়েই উপস্থিত থাকে, যাতে জীবিত বিধবাদের বিশ্বাস সতীদাহের উপর থেকে টলে না যায়। এও সত্য হতে পারে যে, সমাজে বিধবাদের দুর্বিষহ সামাজিক ও দৈহিক দুর্দশা কোনও কোনও নারীকে প্রেরণা দিয়েছিল সব দুর্গতির একবারেই শেষ করতে। তাই শুভানুধ্যায়ীদের অনুপ্রেরণা, ঘটনার তাৎক্ষণিক গরিমার মোহ আর পরলোকের দুর্দশার ভয় কিংবা স্বর্গের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ছবি এই সব কিছু মিলেই মেয়েটিকে এই সিদ্ধান্ত নিতে উদ্যোগ জোগায়। আর তারপর সমাজ তাকে সেই সিদ্ধান্তে অবিচলিত থাকতে সাহায্য করে। পৌরাণিক কাহিনিতে পতিব্রতার কর্তব্যের মহিমাকীর্তন করা হয়েছে: এক পতিব্রতা সতী তার লম্পট কুষ্ঠরোগী স্বামীকে প্রতি সন্ধ্যায় পিঠে বয়ে গণিকাগৃহে নিয়ে যায় আর সকালে ফিরিয়ে আনে— সমাজের এই মূল্যবোধই বিধবা হত্যার প্রেরণা জোগায় আর তারপর তাকে ‘সতী’র সম্মান দেয়। এমনকী পুরুষ পুরোহিতদের নির্ধারিত নিয়মে বাঁধা এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজেও কিন্তু সতীপ্রথা টিকে থাকত না, যদি নারী নিজেই পরলোকের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর না হত, যদি তার আত্মীয়স্বজনদের প্রলোভনে মন্ত্রণায় বিচলিত না হত।
নারী নির্যাতনের অন্যান্য উপাদানের মতোই এই সতীদাহের মূলও তারই অবচেতনের গভীরে প্রোথিত এবং কুসংস্কারে লালিত অজ্ঞানে আচ্ছন্ন এই নারীর জন্য সমাজ পালানোর কোনও রাস্তা খুলে রাখেনি। মাঝে মাঝে যদি দু-একজন নারী সহমরণে না যান তবে তো ‘সতীত্বের গৌরবময় স্মৃতি জনচেতনায় মলিন হয়ে যাবে। এবং যদি মাঝে মাঝে সতীর স্মৃতিতে মন্দির, প্রার্থনাকক্ষ গড়া হয় তবে তো পুরোহিতদেরই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত হয়। আর যুগ যুগ ধরে যে অতিকথা সরবে ঘোষিত হয়ে আসছে যে, কেবলমাত্র কোনও হিন্দু নারীই তার স্বামীর জন্য জীবন দিতে পারে (অন্যান্য ধর্ম ও সংস্কৃতিতে অনুরূপ উদাহরণগুলি অগ্রাহ্য করে এবং এই সব নারীদের ‘সতী’ আখ্যাও দেওয়া হয় না) সেই দাবি ও যুগে যুগে প্রমাণিত করা যায়। সুতরাং মাঝেমাঝে কোনও অভাগিনীকে পুড়িয়ে মেরে যদি সতীত্বের গৌরব শিখা অম্লান থাকে তবে সমাজের, বিশেষ করে পুরোহিত ও নীতিবাগীশদের স্বার্থ রক্ষিত হয়। বৃহৎসংহিতা-র যুগ থেকেই সমাজ এই অতিকথা ঘোষণা করে আসছে যে, নারী তার স্বামীর প্রতি ভালবাসার জন্যই সহমরণে যায়। এই মিথ্যার অবসান হওয়া উচিত। যদি স্বামীর প্রতি প্রেমে এক নারী আত্মহত্যা করে তবে কেন আজ পর্যন্ত কোনও স্বামী তার স্ত্রীর চিতায় আত্মহত্যা করেনি? এ তো হতে পারে না যে, আজ পর্যন্ত কোনও স্বামী তার স্ত্রীকে ভালবাসেনি যদি সতীদাহের ভিত্তি হত প্রেম, তবে আমরা অবশ্যই কিছু কিছু ঘটনা দেখতে পেতাম যেখানে মৃত স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীও সহমরণে গেছেন। কিন্তু তা হয়নি, এ বিষয়ে কোনও শাস্ত্রীয় বিধি ও নেই। সুতরাং মূল ব্যাপার হল, স্বামীর স্বার্থে স্ত্রীর সম্পূর্ণ আত্মবিসর্জন; আর সতীদাহ এই আজীবন নাটকেরই পঞ্চমাংশের শেষ দৃশ্য। আজ একুশ শতকের দরজায় দাঁড়িয়ে আমরা এই সতীদাহের সগর্ব প্রশংসা শুনছি। আর সমাজ এই ভাবে কৌশলে নারীহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে, কারণ, ভারতবর্ষে পুরুষহত্যা অপরাধ, কিন্তু নারীহত্যা তা নয়। পরিবর্তে ধর্মের নামে পবিত্রতার নামে নারীহত্যা করতে পারা সমাজের কাছে সর্বদাই গৌরবের বস্তু। হিন্দু সমাজ ভয় দেখাচ্ছে যে, এই পবিত্র হত্যাকার্যের অধিকারে তারা কোনও হস্তক্ষেপ সহ্য করবে না। আত্মহত্যা যে অপরাধ, সেখানে লিঙ্গভেদ থাকা উচিত নয়, সে কথা সরিয়ে রেখে সেই আত্মহত্যাকে করে তোলা হয়েছে পুণ্যকর্ম— পুণ্য অগ্নিকে উজ্জীবিত রাখার জন্য সেই আত্মহত্যার স্থলে মন্দির তোলা হচ্ছে। যতদিন শিক্ষা, প্রগতি, যুক্তিনির্ভর বৈজ্ঞানিক ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে এই জঘন্য ধর্মীয় অন্যায় নরনারীর চেতনা থেকে উৎপাটিত না হয়, সমাজ সচেতন ভাবে এই সব ঘটনাকে প্রতিরোধ না করে, এই অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি না দেয়, ততদিন শুধু রূপ কানোয়ারের সঙ্গে সঙ্গেই সতী প্রথার শেষ হবে না।