শেষ পর্যন্ত সরকারি চিঠি এসেছে। আগের চিঠির মেমো নাম্বার উল্লেখ করে সরকার জানাচ্ছে,
জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুলের ছাত্র সংখ্যা আশংকাজনকভাবে কমিয়া গিয়াছে। শিক্ষক সংখ্যাও অপ্রতুল। এই অবস্থায় সরকারী অনুদান কাজে আসিবে কি আসিবে না তাহা পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন। বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্যে ময়মনসিংহের ডেপুটি কমিশনারকে আহবায়ক করিয়া একটি কমিটি গঠন করা হইয়াছে। পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটিকে আগামী তিন মাসের ভিতর স্কুল সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ বিপোর্ট দেবার জন্যে অনুরোধ করা যাইতেছে।
ফজলুল করিম সাহেব দীর্ঘ সময় চিঠিটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। সব চিঠিই তিনি কয়েকবার করে পড়েন। শুধু এই চিঠিটিই একবার পড়লেন। আগামীকাল থেকে গরমের ছুটি শুরু হবে। আজ শেষ ক্লাস। ছুটির আগের শেষ ক্লাসে ছাত্ররা সব আনন্দ করে। আজ কিছুই হচ্ছে না। সব কেমন মরা। মরা। ছাত্রই নেই প্রাণ আসবে কোত্থেকে, স্কুলের প্রাণ হচ্ছে তার ছাত্র। দালান কোঠা তো স্কুলের প্রাণ না।
মওলানা সাহেব সন্ধ্যাবেলা হেডমাস্টার সাহেবের ঘরে এসে বললেন, স্যার বাসায় যাবেন না?
আপনি চলে যান। আমি একটু পরে যাব।
আপনার কি শরীর খারাপ করেছে?
না। এমনিতেই ভাল লাগছে না।
মামুন সাহেবের একটা চাকরি হয়েছে শুনেছেন বোধহয়।
না শুনিনি–কোথায় চাকরি হয়েছে?
সরকারী কলেজের লেকচারার। বরিশাল বিএম কলেজ। ইন্টারভ্যু দিয়ে এসেছিলেন। গতকাল চিঠি এসেছে।
উনার না এখানে নিরিবিলিতে থেকে বি সি এস পরীক্ষার জন্যে তৈরী হবার কথা। বি, সি,এস দিচ্ছেন না।
আমাকে বললেন–বি সি এস দেবেন না। মাষ্টারী করবেন। খুব খুশী।
খুশী হবারই কথা।
আপনাকে কিছু জানাননি?
প্রথমেই তো বলেছি জানায়নি। একই প্রশ্ন দুবার তিনবার করে কেন করেন।
ভুল হয়ে গেছে স্যার ক্ষমা করে দেবেন। ক্ষমা করলাম। আপনার কথা শেষ হয়ে থাকলে চলে যান। আমি নিরিবিলিতে কিছুক্ষণ বসে থাকব।
দুটা কথা বাকি আছে। বলেই চলে যাব। প্রথম কথাটা হল। এস,এস, সি ছাত্রদের কোচিং এর ব্যাপারে আপনি যা বলেছেন সেটা করা সম্ভব বলে আমার ধারণা। আমি মামুন সাহেবকে নিয়ে একটা পরিকল্পনা করেছি। শিক্ষকদের ডিউটি ভাগ করা হয়েছে। স্কুলের লাইব্রেরী ঘরে ছাত্ররা থাকবে।
এতগুলি ছাত্র লাইব্রেরী ঘরে থাকবে কি ভাবে?
সব ছাত্র না–আমরা ৫ জন বেছে নিব। প্রথম পাঁচ জন।
সেটা হবে না। একজনের জন্যে যে ব্যবস্থা বাকিদের জন্যেও একই ব্যবস্থা।
মামুন সাহেব বলেছিলেন যে আপনি পাঁচজনের ব্যাপারে রাজি হবেন। সবাইকে নিয়ে একটা পরিকল্পনা করা হয়েছে। সেখানে একটা ক্লাস ঘর খালি করে দিতে হবে। মামুন সাহেব পুরো ব্যাপার দেখবেন।
কলেজের চাকরি নিয়ে চলে যাচ্ছেন–তাহলে দেখবেন কি ভাবে?
এস. এস. সি পরীক্ষা পর্যন্ত উনি থাকবেন। পরীক্ষার পর কলেজে জয়েন করবেন। আমার সঙ্গে সে রকম কধ্যা হয়েছে।
ও আচ্ছা।
খুব কর্মী ছেলে। একাই একশ। উনি থাকলে আর কিছু লাগবে।
উনি নিজে থেকে রাজি হয়েছেন না আপনি বলে কয়ে ঠিক করেছেন?
নিজ থেকে রাজি হয়েছেন। আমাকে কিছু বলতে হয়নি। কলেজের এপয়েনমেন্ট লেটার পেয়ে খানিকক্ষণ খুশীতে খুব লাফালাফি করলেন তারপর আমাকে বললেন–মওলানা সাহেব, আমাদের হেডমাষ্টার সাহেব স্কুলটা নিয়ে একা একা যুদ্ধ করছেন। যুদ্ধে প্রায় পরাজিত। আমি একজন ভাল সৈনিক। এই সময়ে আমি তাকে ছেড়ে চলে যাব তা হয় না। এস, এস, সি পরীক্ষা পর্যন্ত দেখে যাবেন। তার যতটুকু সাধ্য করবেন।
ভাল।
আমার স্যার আরেকটা কথা বাকি, ঐটা শেষ করে চলে যাব।
বলুন।
একটা ভাল ছেলে পাওয়া গেছে স্যার।
ভাল ছেলে পাওয়া গেছে মানে কি? যা বলার গুছিয়ে বলুন।
রেশমীর জন্যে একটা ছেলে পেয়েছি। দোকানে কাজ করে।
ও আচ্ছা।
ছেলেটিকে খবর দিয়ে এনেছি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আপনি তার সঙ্গে কথা বলবেন?
না।
অন্য কোন সময় আসতে বলব?
মওলানা ইতস্তত করে বললেন, নানান ধরনের কথা হচ্ছে। নানান রটনা।
কি রটনা?
এইসব কথা মুখ ফুটে আপনাকে বলা সম্ভব না।
বলা সম্ভব না হলে বলবেন না।
জ্বি আচ্ছা।
মওলানা সাহেব এই সমস্যা নিয়ে আপনাকে আর মাথা ঘামাতে হবে। স্কুলের সমস্যা নিয়ে ভাবুন।
জ্বি আচ্ছা।
যাবার সময় দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে যাবেন।
মওলানা সাহেব দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে চলে গেলেন। জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুলের হেডমাষ্টার ফজলুল করিম সাহেবের চোখে পানি এসে গেছে। তিনি চোখের পানি মুছলেন না। কারণ চোখে যে পানি এসেছে তা তিনি নিজে বুঝতে পারেন নি।