ছেলে একবার বিগ্ড়ে উঠলে আর সুযুত হওয়া ভার। শিশুকাল অবধি যাহাতে মনে সদ্ভাব জন্মে এমতো উপায় করা কর্তব্য, তাহা হইলে সেই সকল সদ্ভাব ক্রমে ক্রমে পেকে উঠতে পারে তখন কুকর্মে মন না গিয়া সৎকর্মের প্রতি ইচ্ছা প্রবল হয়, কিন্তু বাল্যকালে কুসঙ্গ অথবা অসদুপদেশ পাইলে বয়সের চঞ্চলতা হেতু সকলই উল্টে যাইবার সম্ভাবনা। অতএব যে পর্যন্ত ছেলেবুদ্ধি থাকিবে সে পর্যন্ত নানা প্রকার সৎ অভ্যাস করানো আবশ্যক। বালকদিগের এইরূপ শিক্ষা পঁচিশ বৎসর পর্যন্ত হইলে তাহাদিগের মন্দ পথে যাইবার সম্ভাবনা থাকে না। তখন তাহাদিগের মন এমতো পবিত্র হয় যে কুকর্মের উল্লেখমাত্রেই রাগ ও ঘৃণা উপস্থিত হয়।
এতদ্দেশীয় শিশুদিগের এরূপ শিক্ষা হওয়া বড়ো কঠিন, প্রথমতঃ ভালো শিক্ষক নাই—দ্বিতীয়তঃ ভালো বহি নাই—এমতো এমতো বহি চাই যাহা পড়িলে মনে সদ্ভাব ও সুবিবেচনা জন্মিয়া ক্রমে ক্রমে দৃঢ়তর হয়। কিন্তু সাধারণের সংস্কার এই যে কেবল কতকগুলিন শব্দের অর্থ শিক্ষা হইলেই আসল শিক্ষ হইল। তৃতীয়তঃ কি কি উপায় দ্বারা মনের মধ্যে সদ্ভাব জন্মে তাহা অতি অল্প লোকের বোধ আছে। চতুর্থতঃ শিশুদিগের যে প্রকার সহবাস হইয়া থাকে তাহাতে তাহাদিগের সদ্ভাব জন্মানো ভার। হয় তো কাহারো বাপ জুয়াচোর বা মদখোর, নয় তো কাহারো খুড়া বা জেঠা ইন্দ্রিয়দোষে আসক্ত—হয় তো কাহারো মাতা লেখাপড়া কিছুই না জানাতে আপন সন্তানাদির শিক্ষাতে কিছু-মাত্র যত্ন করেন না ও পরিবারের অন্যান্য লোক এবং চাকরদাসীর দ্বারা নানা প্রকার কুশিক্ষা হয়—নয় তো পাড়াতে বা পাঠশালাতে যে সকল বালকের সহিত সহবাস হয়, তাহাদের কুসংসর্গ ও কুকর্ম শিক্ষা হইয়া একেবারে সর্বনাশোৎপত্তি হয়। যে স্থলে উপরোক্ত একটি কারণ থাকে, সে স্থলে শিশুদিগের সদুপদেশের গুরুতর ব্যাঘাত—সকল কারণ একত্র হইলে ভয়ঙ্কর হইয়া উঠে— সে যেমন খড়ে আগুন লাগা— যে দিক জ্বলে উঠে সেই দিকেই যেন কেহ ঘৃত ঢালিয়া দেয় ও অল্প সময়ের মধ্যেই অগ্নি ছড়িয়া পড়িয়া যাহা পায় তাহাই ভস্ম করিয়া ফেলে।
অনেকেরই বোধ হইয়াছিল পুলিশের ব্যাপার নিষ্পন্ন হওয়াতে মতিলাল সুযুত হইয়া আসিবে। কিন্তু যে ছেলের মনে কিছুমাত্র সৎসংস্কার জন্মে নাই ও মান বা অপমানের ভয় নাই তাহার কোন সাজাতেই মনের মধ্যে ঘৃণা হয় না। কুমতি ও সুমতি মন থেকে উৎপন্ন হয় সুতরাং মনের সহিত তাহাদিগের সম্বন্ধ—শারীরিক আঘাত অথবা ক্লেশ হইলেও মনের গতি কিরূপে বদল হইতে পারে? যখন সারজন মতিলালকে রাস্তায় হিঁচুড়িয়া টানিয়া লইয়া গিয়াছিল তখন তাহার একটু ক্লেশ ও অপমান বোধ হইয়াছিল বটে কিন্তু সে ক্ষণিক—বেনিগারদে যাওয়াতে তাহার কিছুমাত্র ভাবনা বা ভয় বা অপমানবোধ হয় নাই। সে সমস্ত রাত্রি ও পরদিবস গান গাইয়া ও শেয়াল-কুকুরের ডাক ডাকিয়া নিকটস্থ লোকদিগকে এমতো জ্বালাতন করিয়াছিল যে, তাহারা কানে হাত দিয়া রাম রাম ডাক ছাড়িয়া বলাবলি করিয়াছিল—কয়েদ হওয়া অপেক্ষা এ ছোঁড়ার কাছে থাকা ঘোর যন্ত্রণা। পরদিবস ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট দাঁড়াইবার সময় বাপকে দেখাইবার জন্য শিশু পরামানিকের ন্যায় একটুকু অধোবদন হইয়াছিল কিন্তু মনে মনে কিছুতেই দৃকপাত হয় নাই—জেলেই যাউক আর জিঞ্জিরেই যাউক কিছুতেই ভয় নাই।
যে সকল বালকদের ভয় নাই, ডর নাই, লজ্জা নাই কেবল কুকর্মেতেই রত—তাহাদিগের রোগ সামান্য রোগ নহে—সে রোগ মনের রোগ। তাহার উপর প্রকৃত ঔষধ পড়িলেই ক্রমে ক্রমে উপশম হইতে পারে। কিন্তু ঐ বিষয়ে বাবুরামবাবুর কিছুমাত্র বোঁধ-শোধ ছিল না। তঁহার দৃঢ় সংস্কার ছিল মতিলাল বড়ো ভাল ছেলে, তাহার নিন্দা শুনিলে প্রথম প্রথম রাগ করিয়া উঠিতেন—কিন্তু অন্যান্য লোকে বলিতে ছাড়িত না, তিনিও শুনিয়ে শুনিতেন না। পরে দেখিয়া শুনিয়া তাঁহার মনের মধ্যে কিঞ্চিৎ সন্দেহ জন্মিল কিন্তু পাছে অন্যের কাছে খাটো হইতে হয় এজন্য মনে মনে গুমরে গুমরে থাকিতেন, কাহারো নিকট কিছুই ব্যক্ত করিতেন না, কেবল বাটীর দরওয়ানকে চুপি চুপি বলিয়া দিলেন মতিলাল যেন দরজার বাহির না হইতে পারে। তখন রোগ প্রবল হইয়াছিল সুতরাং উপযুক্ত ঔষধ হয় নাই, কেবল আটকে রাখতে অথবা নজরবন্দী করায় কি হইতে পারে? মন বিগড়ে গেলে লোহার বাড় দিলেও থামে না বরং তাহাতে ধূর্তমি আরও বেড়ে উঠে।
মতিলাল প্রথম প্রথম প্রাচীর টপকিয়া বাহিরে যাইতে লাগিল। হলধর, গদাধর, রামগোবিন্দ, দোলগোবিন্দ ও মানগোবিন্দ খালাস হইয়া বৈদ্যবাটীতে আসিয়া আড্ডা গাড়িল ও পাড়ার কেবলরাম, বাঞ্ছারাম, ভজকৃষ্ণ, হরেকৃষ্ণ এবং অন্যান্য শ্রীদাম, সুবল ক্রমে ক্রমে জুটে গেল। এই সকল বালকের সহিত সহবাস হওয়াতে মতিলাল একেবারে ভয়ভাঙা হইল— বাপকে পুসিদা করা ক্রমে ক্রমে ঘুচিয়া গেল। যে যে বালক বাল্যাবস্থা অবধি নির্দোষ খেলা অথবা সৎআমোদ করিতে না শিখে তাহারা ইতর আমোদেই রত হয়। ইংরাজদিগের ছেলেরা পিতা-মাতার উপদেশে শরীর ও মনকে ভালো রাখিবার জন্য নানা প্রকার নির্দোষ খেলা শিক্ষা করে, কেহ বা তসবির আঁকে— কাহারো বা ফুলের উপর সক হয়— কেহ বা সংগীত শিখে— কেহ বা শিকার করিতে অথবা মর্দানা কস্ত করিতে রত হয়— যাহার যেমন ইচ্ছা, সে সেই মতো এইরূপ নির্দোষ ক্রীড়া করে। এতদ্দেশীয় বালকেরা যেমন দেখে তেমনি করে— তাহাদিগের সর্বদা এই ইচ্ছা যে জরি-জহরত ও মুক্ত-প্রবাল পরিব—মোহসাহেব ও বেশ্যা লইয়া বাগানে যাইব এবং খুব ধুমধামে বাবুগিরি করিব। জাঁকজমক ও ধুমধামে থাকা যুবকালেরই ধর্ম, কিন্তু তাহাতে পূর্বে সাবধান না হইলে এইরূপ ইচ্ছা ক্রমে বেড়ে উঠে ও নানাপ্রকার দোষ উপস্থিত হয়—সেই সকল দোষে শরীর ও মন অবশেষে একেবারে অধঃপাতে যায়।
মতিলাল ক্রমে ক্রমে মেরোয়া হইয়া উঠিল, এমনি ধূর্ত হইল যে পিতার চক্ষে ধূলা দিয়া নানা অভদ্র ও অসৎকর্ম করিতে লাগিল। সর্বদাই সঙ্গীদিগের সহিত বলাবলি করিত বুড়া বেটা একবার চোখ বুজলেই মনের সাধে বাবুয়ানা করি। মতিলাল বাপ-মার নিকট টাকা চাহিলেই টাকা দিতে হইত— বিলম্ব হইলেই তাহাদিগকে বলে বসিত—আমি গলায় দড়ি দিব অথবা বিষ খাইয়া মরিব। বাপ-মা ভয় পাইয়া মনে করিতেন কপালে যাহা আছে তাই হবে এখন ছেলেটি প্রাণে বাঁচিয়া থাকিলে আমরা বাঁচি ও আমাদিগের শিবরাত্রির সলিতা বেঁচে থাকুক, তবু এক গণ্ডুষ জল পাব। মতিলাল ধুমধামে সর্বদাই ব্যস্ত—বাটীতে তিলার্ধ থাকে না। কখন বনভোজনে মত্ত—কখন যাত্রার দলে আকড়া দিতে আসক্ত—কখন পাঁচালির দল করিতেছে—কখন সকের কবিওয়ালদিগের সঙ্গে দেওরা দেওরা করিয়া চেঁচাইতেছে— কখন বারোয়ারী পূজার জন্য দৌড়াদৌড়ি করিতেছে— কখন খেম্টার নাচ দেখিতে বসিয়া গিয়াছে— কখন অনর্থক মারপিট, দাঙ্গা-হাঙ্গামে উন্মত্ত আছে। নিকটে সিদ্ধি, চরস, গাঁজাগুলি, মদ অনবরত চলিতেছে—গুড়ুক্ পালাই পালাই ডাক ছাড়িতেছে। বাবুরা সকলেই সর্বদা ফিটফাট— মাথায় ঝাঁকড়া চুল, দাঁতে মিসি, সিপাই পেড়ে ঢাকাই ধুতি পরা বুটোদার এক্লাই ও গাজের মেরজাই গায়ে, মাথায় জরির তাজ, হাতে আতরে ভুরভুরে রেশমের হাত রুমাল ও এক এক ছড়ি, পায়ে রূপার বগলসওয়ালা ইংরাজী জুতা। ভাত খাইবার অবকাশ নাই কিন্তু খাস্তার কচুরি, খাসা গোল্লা, বর্ফি, নিখুঁতি, মনোহরা ও গোলাবি খিলি সঙ্গে সঙ্গে চলিয়াছে।
প্রথম প্রথম কুমতি দমন না হইলে ক্রমে ক্রমে বেড়ে উঠে। পরে একেবারে পশুবৎ হইয়া পড়ে—ভালো-মন্দ কিছুই বোধ থাকে না, আর যেমন আফিম খাইতে আরম্ভ করিলে ক্রমে ক্রমে মাত্রা অবশ্যই অধিক হইয়া উঠে তেমনি কূকর্মে রত হইলে অন্যান্য গুরুতর কূকর্ম করিবার ইচ্ছা আপনা আপনি আসয়া উপস্থিত হয়। মতিলাল ও তাঁহার সঙ্গী বাবুরা যে সকল আমোদে রত হইল ক্রমে তাহা অতি সামান্য আমোদ বোধ হইতে লাগিল— তাহাতে আর বিশেষ সন্তোষ হয় না, অতএব ভারি ভারি আমোদের উপায় দেখিতে লাগিল। সন্ধ্যার পর বাবুরা দঙ্গল বাঁধিয়া বাহির হন—হয় তো কাহারো বাড়িতে পড়িয়া লুটতরাজ করেন নয় তো কাহারো কানাচে আগুন লাগাইয়া দেন— হয় তো কোন বেশ্যার বাটীতে গিয়া শোর সরাবত করিয়া তাহার কেশ ধরিয়া টানেন বা মশারি পোড়ান কিংবা কাপড় ও গহনা চুরি করিয়া আনেন নয় তো কোনো কুলকামিনীর ধর্ম নষ্ট করিতে চেষ্টা পান। গ্রামস্থ সকল লোক অত্যন্ত ব্যস্ত, আঙুল মটকাইয়া সর্বদা বলে— তোরা ত্বরায় নিপাত হ।
এইরূপ কিছুকাল যায়—দুই-চারি দিবস হইল বাবুরামবাবু কোনো কর্মের অনুরোধে কলিকাতায় গিয়াছেন। একদিন সন্ধ্যার সময় বৈদ্যবাটীর নিকট দিয়া একখানা জানানা সোয়ারি যাইতেছিল। নববাবুরা ঐ সোয়ারি দেখিবামাত্র দৌড়ে গিয়ে চারিদিক ঘেরিয়া ফেলিল ও বেহারাদিগের উপর মারপিট আরম্ভ করিল, তাহাতে বেহারারা পাল্কি ফেলিয়া প্রাণভয়ে অন্তরে গেল। বাবুরা পাল্কি খুলিয়া দেখিল একটি পরমা সুন্দরী কন্যা তাহার ভেতরে অছেন— মতিলাল তেড়ে গিয়া কন্যার হাত ধরিয়া পাল্কি থেকে টানিয়া বাহির করিয়া আনিল। কন্যাটি ঠক্ ঠক্ করিয়া কাঁপিতে লাগিলেন—চারিদিক শূন্যাকার দেখেন ও রোদন করিতে করিতে মনে মনে পরমেশ্বরকে ডাকেন— প্রভু ! এই অবলা অনাথাকে, রক্ষা করো— আমার প্রাণ যায় সেও ভালো যেন ধর্ম নষ্ট না হয়। সকলে টানাটানি করাতে কন্যাটি ভূমিতে পড়িয়া গেলেন তবুও তাহারা হিঁচুড়ে জোরে বাটীর ভিতর লইয়া গেল। কন্যার ক্রন্দন মতিলালের মাতার কর্ণগোচর হওয়াতে তিনি আস্তে-আস্তে বাটীর বাহিরে আসিলেন, অমনি বাবুরা চারিদিকে পলায়ন করিল। গৃহিণীকে দেখিয়া কন্যা তাঁহার পায়ে পড়িয়া কাতরে বলিলেন—মা গো ! আমার ধর্ম রক্ষা করো—তুমি বড়ো সাধ্বী। সাধ্বী স্ত্রী না হইলে সাধ্বী স্ত্রীর বিপদ অন্যে বুঝিতে পারে না। গৃহিণী কন্যাকে উঠাইয়া আপন অঞ্চল দিয়া তাঁহার চক্ষের জল পুঁছিয়া দিতে লাগিলেন ও বলিলেন— মা ! কেঁদো না। ভয় নাই। তোমাকে আমি বুকের উপর রাখিব, তুমি আমার পেটের সন্তান— যে স্ত্রী পতিব্রতা তাহার ধর্ম পরমেশ্বর রক্ষা করেন। এই বলিয়া তিনি কন্যাকে অভয় দিয়া সান্তনা করণান্তর আপনি সঙ্গে করিয়া লইয়া তাঁহার পিতৃ আলয়ে রাখিয়া আসিলেন।