শিলং-এর টুরিস্ট লজের উঁচু রাস্তা দিয়ে দেবেন মণীশকে সঙ্গে নিয়ে হেঁটে আসছিলেন। মণীশ ঠিকমতন হাঁটতে পারছে না, দেবেন তার কাঁধের কাছের জামাটা খিমচে ধরে আছেন।
মণীশ দেবেনের চেয়ে প্রায় আধহাত বেশি লম্বা। ছিপছিপে চেহারা। মাথায় বড়ো বড়ো চুল অবিন্যস্ত। জামার বোতামগুলো খোলা।
বারান্দায় উঠে এসে দেবেন একটা ঘরে ঠকঠক করলেন। দু-টি স্ত্রীলোকের মধ্যে একজন এসে দরজা খুলে দিল, আর একজন খাটেই শুয়ে রইল।
দেবেন মণীশকে বড়ো বেতের চেয়ারটায় চেপে বসিয়ে দিলেন। মণীশের ঠোঁটে মৃদু হাসি। পকেট থেকে একটা দোমড়ানো সিগারেটের প্যাকেট বার করে একটা সিগারেট তিন-চার বারের চেষ্টায় ধরালো। তারপর এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল, আপনার সামনে সিগারেট খাচ্ছি। ডোন্ট মাইণ্ড।
দেবেন বেল বাজিয়ে বেয়ারাকে ডেকে বললেন, লিম্বু হ্যায়, লিম্বু? একগ্লাস গরম পানিমে দোঠো লিম্বু ডালকে লে আও।
মণীশ বলল, আপনার কাজ-টাজ হল, দেবেন কাকা?
প্রায় হয়ে এসেছে।
স্ত্রীলোক দু-টির দিকে চোখ ফিরিয়ে মণীশ জিজ্ঞেস করল, এরা কারা?
আমার সঙ্গে বেড়াতে এসেছে। এর নাম বকুল। আর ওর নাম লাবণ্য।
যে-মেয়েটি তখনও দেওয়ালের দিকে পিঠ ফিরিয়ে শুয়ে আছে তার নাম লাবণ্য। মণীশ তার দিকে চেয়ে হো হো করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতেই বলল, লাবণ্য? শিলং-এ লাবণ্য, হাঃ হাঃ হাঃ, নামটা পালটাতে বলুন! কোথা থেকে আবার একটা অমিত রায় জুটে যাবে। আপনি কিন্তু একটা জিনিস ঠিক বুঝেছেন, লাগে বাঙালি মেয়েছেলের খুব ডিমাণ্ড আছে।
বেয়ারা লেবুজল নিয়ে এল। দেবেন গেলাসটা মণীশের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, এটা খেয়ে নে! এতবেশি মদ খাস কেন?
মণীশ বলল, কী করব বলুন! পাহাড়ি জায়গায় সবাই মদ খায়-সন্ধ্যের পর কিছুই তো করার নেই।
তুই কাজ-টাজ কী করছিস?
কন্ট্রাক্টারি করি।
মণীশের পোশাকে চাকচিক্য আছে। দেখলে বোঝা যায়, তার হাতে কাঁচা পয়সা আছে।
সে দামি সিগারেট খায়।
কীসের কনট্রাক্টরি করিস?
যখন যা পাই। এসেছিলাম কপর্দকশূন্য অবস্থায়, কেউ পৌঁছেনি, ধর্মশালায় থাকতাম, এখন ষাট-সত্তর হাজার টাকার অর্ডার যখন-তখন নিতে পারি।
কলকাতায় আর ফিরবি না?
মণীশ এবার অহংকারীর মতন থুতনি উঁচু করে বলল, কেন ফিরব না? যখন আমি ফিরব, আমার সঙ্গে সোনা থাকবে! জানেন কার কথা? যাবো। পড়েছেন র্যাঁবোর জীবনী?
দেবেন চুপ করে রইলেন।
মণীশ সিগারেটের শেষ অংশ জুতোর তলায় পিষেই আর একটা সিগারেট ধরালো। তারপর বলল, ও, আপনি তো একসময় প্রফেসার ছিলেন! জানলেও জানতে পারেন। অবশ্য অনেক প্রফেসারও অশিক্ষিত থাকে। কী, থাকে না? আপনি কিন্তু খুব সেয়ানা দেবেনকাকা। ঠিক টাইমে মাস্টারি-ফাস্টারির মতন বাজে জিনিস ছেড়ে ব্যবসায় এসেছিলেন। টাকাই হচ্ছে আসল। টাকা না থাকলে মান-সম্মান নেই! আমার বাবাটাই শুধু বোকা থেকে গেল।
বাড়িতে চিঠি লিখিস না কেন?
একবার টাকা পঠিয়েছিলাম। বুড়ো রিফিউজ করেছে।
তোর বাবা একটুও বুড়ো হয়নি। নিশি যদি বুড়ো হয়, আমরা তাহলে কী?
আপনি ফিগারটা ঠিক রেখেছেন, কিন্তু ভেতরটা ফোঁপরা। আপনার নিশ্চয়ই ডায়াবিটিস আছে, চামড়া একটু কুঁচকেছে দেখছি।
দেবেন হাসলেন। ছেলেটা ধরেছে ঠিকই। মাতাল হলেও দৃষ্টিশক্তি তীক্ষ্ণ আছে।
তোর বাবা কিন্তু খুব কষ্ট পায়। কারুকে কিছু মুখ ফুটে বলে না।
কষ্ট পাওয়া যার নিয়তি, সে কষ্ট পাবেই।
তুই চল, আমার সঙ্গে কলকাতায় চল!
আপনার সঙ্গে কেন? কলকাতা কী কারুর বাপের জায়গা, না কারুর কেনা? আমার যখন ইচ্ছে যাব। র্যাঁবো ফিরতে পারেনি, আমি ফিরে যাব হিথক্লিপের মতন, কিংবা কাউন্ট অব মন্টেক্রিস্টো।
তুই এখনও খুব রেগে আছিস।
আপনি এক কাজ করুন দেবেনকাকা, আপনিই বরং এখানে থেকে যান। এখানকার রাস্তা ঘাটে টাকা ছড়ানো। তুলে নিতে পারলেই হয়। আমি আপনাকে ধান্দা বাতলে দেব। পাহাড়িদের ঠকানো খুব সোজা, বুঝলেন-না। আপনার মতন ধূর্ত লোক, দু-দিনে লাল হয়ে যাবেন।
তুই আমার ওপর শোধ নিচ্ছিস।
কীসের শোধ?
কলকাতায় আমি তোকে একটা চাকরি করে দিতে চেয়েছিলাম। আমি তোদের সাহায্যই করতে চেয়েছিলাম তখন।
জানি। আমার বাপ আমাকে সেই চাকরি নিতে দেয়নি। অনেষ্টি! অনেস্টি ধুয়ে জল খাবে! অনেস্টি ইজ দা লাস্ট রিসর্ট অব দা কাওয়ার্ড।
মণীশ ঘরের এখানে-সেখানে সিগারেটের ছাই ফেলছে বলে বকুল নামের মেয়েটি একটি অ্যাশট্রে নিয়ে তার পাশে রাখল। মেয়েটি কাছে আসতেই মণীশ শরীরটাকে কুঁকড়ে ফেলল। যেন কোনোক্রমে ছোঁয়া না লাগে।
মেয়ে দু-টি এপর্যন্ত নিঃশব্দ। একটিও কথা বলেনি। লাবণ্য এবার উঠে বসে বলল, পাশের ঘরের একজন লোকের খুব অসুখ।
দেবেন জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে?
হার্ট অ্যাটাক হয়েছে নাকি হঠাৎ। ডাক্তার এসেছিলেন।
মণীশ সোজা হয়ে বসে বলল, আমি বুঝি বেশিজোরে কথা বলছি।
লাবণ্য বলল, লোকটা একদম একা। সঙ্গে কেউ নেই। আমি একটু দেখে আসি ভদ্রলোককে।
লাবণ্য উঠে বেরিয়ে গেল। বকুল খাটে বসে চুল খুলল।
তোর বাড়ি কোথায়?
বাস স্ট্যাণ্ডের কাছে।
এত রাতে আর বাড়ি ফিরে কী করবি? তুই রাতটা আমার এখানে থেকে যা।
এই ঘরে?
এটা তো চারজনের ঘর। চারটে খাট আছে।
এই মেয়েদের সঙ্গে একঘরে? দেবেনকাকা, আই হেট উইমেন। আই কান্ট স্ট্যাণ্ড দেয়ার বড়ি ওডার।
দেবেন মুচকি হেসে বললেন, বকুল ইংরেজি বোঝে। বকুলও হাসছে। মণীশ তাতে একটুও অপ্রস্তুত হল না। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চলি।
ততার সঙ্গে আমার অনেক কথা ছিল।
আসলে তা নয় দেবেনকাকা, আপনি ভাবছেন, আমি মাতাল অবস্থায় ঠিকঠাক ফিরতে পারব কি না? কোনো চিন্তা নেই, শিলং-এর সব কটা ট্যাক্সিওয়ালা আমাকে চেনে। আমি ততা নাইট বার্ড।
বকুল খাট থেকে নেমে এসে মণীশের হাত ধরে বলল, কেন, এক্ষুনি চলে যাবে কেন? বোসো–
মণীশ যেন একেবারে শিউরে উঠল। ছটফট করে বলল, ছুঁয়ো না, ছাড়ো আমাকে, এই হাত ছেড়ে দাও!
বকুল বলল, কেন বাপু, আমাকে দেখলে কী এতই ঘেন্না হয়?
ছাড়ো! সরে যাও আমার কাছ থেকে। গায়ে একেবারে নরকের গন্ধ!
দেবেন বলল, ছেড়ে দাও বকুল, ছেড়ে দাও!
বকুল বলল, বাবা, এত রাগি লোক আগে কখনো দেখিনি। সবসময় রেগে রেগে কথা।
দেবেন বললেন, তাও তো ওর বাবাকে দেখনি।
হ্যাঁ দেখেছি। সেই যে আসবার সময়, বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় গাড়ি ঠেললেন।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি কী করে বুঝতে পারলে?
ও ঠিক বোঝা যায়। গলার আওয়াজের মিল আছে, আরও মিল আছে।
ওদের চেহারার কিন্তু মিল নেই। বাপের মতন চেহারা ছেলেরা কেউ পায়নি।
রক্তের সম্পর্ক থাকলে একটা-না-একটা মিল থাকবেই!
মণীশ বলল, রক্তের সম্পর্ক থাকলে কিছুতেই এড়ানো যায় না, না? যদি একটা রাস্তায় হারানো ছেলে হতাম! ব্লাড ইস আ সুইট জুস!
তুই কিন্তু থেকে গেলে পারতিস।
না দেবেনকাকা, চলি!
দেবেন ওর সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এলেন বাইরে। তারপর আবার বললেন, অনেকগুলো ঘর খালি আছে, তুই থাকলে কোনো অসুবিধে হত না।
না!
—মণীশ, শোন! তোর বাবা আমার অনেক দিনের বন্ধু। ও তো একইরকম থেকে গেল। আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় ওর জন্য কিছু করি। মানুষটা সৎ ঠিকই, কিন্তু এমন গোঁয়ারগোবিন্দ!
দেবেনকাকা, আপনি মেয়েছেলে নিয়ে এখানে ফুর্তি করতে এসেছেন, হঠাৎ পরোপকার করার ইচ্ছে জাগল কেন?
তুই ওদের যা ভাবছিস, ওরা সেরকম নয়। ওরা আমাকে সঙ্গ দেয়, কিন্তু ওরা যথেষ্ট রেসপেকটেবল। তোকে দেখে আমার খুব আনন্দ হয়েছিল, ভেবেছিলাম তোকে যদি কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারি, তাহলে একটা সত্যিকারের কাজ হবে। নিশি আর কদ্দিন একা সংসার টানবে? তুই যাবি? এখনও যদি যাস, তোকে আমি একটা ভালো চাকরি দিতে পারি—
মণীশ এবার দেবেনের মুখোমুখি দাঁড়াল। তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, আপনি আমাকে এখনও চাকরির লোভ দেখাচ্ছেন? আর দুটো দিন অপেক্ষা করুন, তারপর আমি, এই শালা, এই মণীশ হালদারই আপনাকে চাকরি দেওয়ার ক্ষমতা রাখবে।
এই আঘাতটা দেবেন সহ্য করতে পারলেন না। মুখটা লাল হয়ে গেল। তিনি বললেন, তোর আস্পর্ধা তো কম নয়। হতভাগা মাতাল! একেবারে গোল্লায় গেছিস।
মণীশ হা-হা করে হাসতে লাগল।
দূর হ! বেরিয়ে যা আমার চোখের সামনে থেকে।
লম্বা লম্বা পায়ে বারান্দা পেরিয়ে মণীশ রাস্তায় নামল। নির্জন রাস্তা, ঝিরিঝিরি করে বৃষ্টি পড়ছে। খানিকটা টলমল পায়ে সে হাঁটতে লাগল। একটু বাদে একটা গান ধরল সে, ভাঙা ভাঙা গলায় সেই গানটা খুব দুঃখী শোনায়।