০৯. শিমুলতলার স্থায়ী বাসিন্দার সংখ্যা

আর কিছুদিনের মধ্যেই এই শিমুলতলার স্থায়ী বাসিন্দার সংখ্যা পঞ্চাশ ছাড়িয়ে গেল। এখানে গুপ্তধন পাওয়া যায়নি, ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে কেউ সুযোগ সুবিধে দেওয়ার আহ্বান জানায়নি, তবু এত মানুষ চলে আসছে কীসের টানে? হয়তো কিছু গুপ্তধনই পেয়েছে, যা চোখে দেখা যায় না, যার নাম শান্তি।

খুব বুড়ো বুড়ি কেউ আসে না, একেবারে কম বয়সিও বিশেষ নেই, আসে শুধু সেই ধরনেরই নারী-পুরুষ, যারা কোনওরকম নিপীড়ন কিংবা অসম্মানের বাধ্যতা থেকে পালিয়ে এসে নতুন জীবন গড়তে চায়। জীবিকার জন্য এখানে কঠিন পরিশ্রম করতে হয়, কিন্তু কারুর প্রভুত্ব কিংবা ফতোয়া মানতে হয় না। ক্রীতদাস প্রথা এখন আইনত নিষিদ্ধ হয়ে গেছে বটে, তবু সমাজের নিচু তলার বহু মানুষই আজও ব্যবস্থার দাস। এই অরণ্য উপনিবেশে সকলেই মুক্ত আর স্বাধীন। অন্দরমহলের অবরোধ আর নানা রকম নিষেধের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এসে নারীরাও এখানে দিনের আলোয় স্বচ্ছন্দ পায়ে ঘুরে বেড়ায়।

বর্ষা শেষ হয়ে গেছে, নদী নালায় এখনও জল কমতে শুরু করেনি। অনেক গাছেই নতুন পাতা গজিয়েছে। এই সময় কোথা থেকে যেন ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি আসে। আকাশের মেঘে কালো রং মুছে গিয়ে দেখা যাচ্ছে সাদা সাদা ছোপ। আর জঙ্গলের মধ্যে জলাশয়গুলির ধারে ধারে ফুটে উঠছে কাশ ফুল।

এই নতুন পল্লি থেকে কিছুটা দূরেই একটা ছোট নদী, তার নাম ভোরাই। ছোট বটে, কিন্তু ভরা বর্ষায় তার খুব তেজ ছিল, তীর উপচে উঠেছিল জল। সেই ভোরাই নদীতে এখন অনেক মাছ, বিশেষত বড় বড় শোল মাছের দাপট খুব।

শোল মাছ বেশ তেজি আর শক্তিশালী হলেও ধরা সোজা। তারা খুব গভীর জলে থাকে না, মাঝে মধ্যেই উপরিতলে ভেসে ওঠে, পাড়ে দাঁড়িয়েও ছায়ার মতন দেখতে পাওয়া যায়। এই মাছ হয় দুঃসাহসী কিংবা নির্বোধ, মানুষ দেখলেও অদৃশ্য হয়ে যায় না। তারা জাল ছিঁড়ে পালিয়ে যেতে পারে, কিন্তু বল্লম কিংবা ল্যাজা দিয়ে গেঁথে ফেলা যায়। নতুন বসতির বাসিন্দারা অনেকে এখন এই শোল মাছ মারায় মেতে উঠেছে।

শোল ছাড়াও পোনা মাছও দেখা যাচ্ছে বেশ। এই সময় পোনা মাছ ডিম পাড়ে, ডিম ফুটে বাচ্চাগুলো ঝাঁক বেঁধে যায়, স্বচ্ছ জলে অনেক সময়ই। সেই ঝাঁক চোখে পড়ে। অত ছোট মাছ কেউ ধরে না, তবে ওদের মাকে আশেপাশেই দেখা যাবে বলে মৎস্য-শিকারিরা ওত পেতে থাকে।

লালনও দুপুরবেলা আরও কয়েক জনের সঙ্গে মাছ ধরছিল, দুদ্দু শাহ। ছুটতে ছুটতে এসে বলল, লালনভাই, লালনভাই, তোমারে একজন ডাকতে আসিছে। শিগগির আসো–-।

লালন বিস্মিত হয়ে বলল, আমারে ডাকে?

কেডা? দুদ্দু বলল, তা তো জানি না। একজন ভদ্দরলোক, বাবুগগা মতন, সঙ্গে একটা ছেলেও আছে।

লালন ভুরু কুঁচকে রেখেই আবার জিজ্ঞেস করল, কোনও ভদ্দরলোক আমারে চেনবে কেমনে? আমার নাম ধইরা ডাকছে?

দুন্দু বলল, হ। পায়ে জুতা আছে, তাই দেইখ্যাই তো বোঝলাম যে, কোনও বাবু টাবু হবে।

লালন বলল, খাইছে! জমিদারগো কেউ আইল নাকি? সঙ্গে প্যায়দা আছে?

দুদ্দু বলল, না, প্যায়দা নাই। শুধু দুইজন।

লালন অনুমানও করতে পারল না, বাবুশ্রেণির কে তার খোঁজ নিতে আসবে এখানে। যাই হোক, গিয়ে তো দেখতেই হবে।

একটা পোনা মাছ ধরেছে লালন, সেটা সে জুবের নামে একজনের হাতে। দিয়ে বলল কমলিকে পৌঁছে দিতে। কালুয়া চলে যাবার পর লালন আর নিজের জন্য রান্না করে না। অন্য কারুর না কারুর ঘরে খায়।

একটা ভাঁজ-করা লুঙ্গি পরা, সর্বাঙ্গে জল কাদা মাখা লালন শিমুল গাছ তলায় এসে দেখল, একটা শুকনো গাছের গুঁড়িতে বসে আছেন দুজন বাবু। একজনের বয়স তেমন বেশি না-হলেও মাথার চুলে একটু পাক ধরেছে, অন্যজন সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ। দুজনেই ধুতি ও পিরান পরা, পায়ে জুতো।

লালন ও দুন্দু সেলাম দিয়ে তাদের সামনে দাঁড়াল।

একটু বয়স্ক মানুষটি লালনের সর্বাঙ্গে দুবার চোখ বুলিয়ে বললেন, তুমিই লালন? তুমি আমাকে চেনো?

লালন হাত জোড় করে কাঁচুমাচু ভাবে বলল, আজ্ঞে না হুজুর। লোকটি বলল, আমার নাম শ্রীহরিনাথ মজুমদার। আর এই আমার তরুণ বন্ধু মীর মোশাররফ হোসেন। তুমি আমাকে চেনো না? আমি বিখ্যাত মানুষ।

কত সাহেবসুবো, জমিদার, কলকেতা-ঢাকার মানুষও আমাকে চেনে, আর তুমি আমার নাম শোনোনি?

 লালন আবার একই ভাবে বলল, না হুজুর।

হরিনাথ এবার হা-হা করে হেসে উঠে বলল, আমি মোটেই কেউকেটা নই, কীটস্য কীট। আমার ধনবল নাই, শিক্ষা গৌরব নাই, একখান ভদ্রস্থ ভদ্রাসনও নাই, তবু কিছু মানুষ এই নামটা জানে। কেন জানে? আমি গ্রামবার্তা প্রকাশিকা নামে একখান পত্রিকার এডিটর। তুমি সে পত্রিকা পড়েছ কখনও?

লালন বলল, হুজুর, ভাইগ্য দোষে আমার ল্যাখ্যাপড়া কিচ্ছু হয় নাই। আমি পড়তে লেখতে জানি না। আমারে মাপ করবেন।

হরিনাথ বলল, হুজুর হুজুর করছ কেন? আমি কি তোমার মালিক না মুরুব্বি? আমার সঙ্গে আপনি-আজ্ঞেও করতে হবে না। বললাম তো, আমি। অতি সাধারণ মানুষ। আমার পত্রিকা তুমি পড়ো না, তাতে দোষের কিছু না। অনেকেই পড়ে না। কেউ কেউ পড়ে। দুই-চারজন পয়সা দিয়ে কেনে। আবার কেউ কেউ পরে দাম দেব বলে আর দেয় না। তোমরা দুইজন খাড়াইয়া রইলে কেন, বসো।

লালন আর দু একটু দূরত্ব রেখে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে। এখনও এই দুজনের আগমনের হেতু ওরা বুঝতে পারছে না।

অল্পবয়সি ছেলেটি চুপ করে বসে ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক দেখছে। হরিনাথ আবার বলল, আমার কাগজের আমিই এডিটর, আমিই লেখক, রিপোর্টার, আমিই দপ্তরি, আমিই মোড়ক করি পোস্ট অফিসে দিই। আমি নিজে নিজেই এই দিকের গ্রামে গ্রামে ঘুরি। কত গ্রামে কত অভাব, রাস্তা

নাই, ইস্কুল-মাদ্রাসা নাই, আছে শুধু দারিদ্র্য, অশিক্ষা আর কুসংস্কার, তার উপরে আছে জমিদারের অত্যাচার। সেই সব কথা কিছু কিছু লিখি। তুমি শুনে আশ্চর্য হোয়ো না, আমার এই ক্ষুদ্র পত্রিকায় লিখলে কিছু কিছু কাজও হয়। ইংরেজ রাজত্বের অনেক দোষ থাকলেও তারা জমিদারদের বাড়াবাড়ি দেখলে দমন করে। আবার অনেক বদ ইংরেজও আছে, ইংরেজ পুলিশ, অত্যাচারী নীলকর সাহেব, তাদের কথাও লিখতে ছাড়ি না। সেইজন্যই তোমাদের এই নতুন গ্রামটা দেখতে এসেছি। তুমি এখানকার মোড়ল?

লালন বলল, আজ্ঞে না। আমি না, আমি না। হরিনাথ জিজ্ঞেস করল, কয়েকজন যে বলল, এটা লালন সাঁই-এর গ্রাম। তুমি না, তবে কে মোড়ল?

 লালন বলল, সেরকম তো কেউ নাই। আমি অন্য সকলেরই মতন একজন।

হরিনাথ বলল, হু। জঙ্গলের মধ্যে যে বসত গড়েছ, জমিদার কি তোমাদের এই জমির পাট্টা দিয়েছে?

না তো

খাজনা দাও? আজ্ঞে, খাজনার কথাও জানি না। এই যে জমি-জঙ্গল সব কিছু, তা কোন জমিদারের তা জানো?

না, তাও জানি না! বাঃ বেশ! যার যেখানে ইচ্ছা, সেখানেই বাড়ি-ঘর করে থাকতে পারলে তো এই পৃথিবীটা স্বর্গ হয়ে যেত হে!

আপন মনে একটু হেসে হরিনাথ পাশ ফিরে বলল, মীর, জমিদারদের কথা এদের জানিয়ে দিই, কী বলে?

মীর বলল, অবশ্যই জানানো উচিত। জমিদারের পেয়াদারা এসে তো যে কোনও সময়েই এদের উচ্ছেদ করে দিতে পারে।

হরিনাথ লালনদের বলল, শুনলে তো মীরের কথা। তোমরা কিছুই না। জেনে পরম সুখে আছ। কিন্তু যে-কোনও সময়েই তোমাদের এই ভিটেমাটি চাটি হয়ে যেতে পারে। এই সুখের জীবন এক নিমেষে শেষ হয়ে যাবে।

লালন বলল, জমিদারের পেয়াদাদের কথা মাঝে মাঝে শুনি। কার জমিদারি তা জানি না। ভেবেছি, সবই তো পরমেশ্বরের দান।

হরিনাথ বলল, পরমেশ্বর মাথায় থাকুন। এই ধরাধামে রাজা, জমিদার, ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ এদের কাছেই মাথা নত করে থাকতে হয়। মূল্য না-দিলে কোনও কিছুর উপরে অধিকার জন্মায় না।

মীর বলল, এ তল্লাটের জমিদারি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে ক্রয় করেছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর।

হরিনাথ জিজ্ঞেস করল, তুমি তাঁর নাম শুনেছ নিশ্চয়ই? এবারেও লালন অপরাধীর মতন মুখ করে বলল, না, সে সৌভাগ্য আমার হয় নাই।

তাঁর পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরই বর্তমান জমিদার। তাঁর নামও জানো না? তিনি তো সর্বজন পূজ্য, দেশ-বিদেশ খ্যাত মহাপুরুষ। তবে, মহাপুরুষ হলেও জমিদার হিসেবে খুব কড়া।

আমি ঠাকুরদের জমিদারির কথা জানি। কিন্তু এখন কে জমিদার আর কতখানি তাদের এলাকা, তা জানি না।

দেবেন্দ্র ঠাকুর যখন মহাল পরিদর্শনে আসেন, তখন সব প্রজাদের নজরানা দিতে হয়। তাঁর আমলে অনেক দরিদ্র প্রজা সর্বস্বান্ত হয়েছে। তিনি যতদিন মহর্ষি হননি, ততদিন তবু গরিব-দুঃখী প্রজারা তাঁর কাছে ধর্না দিতে পারত, তিনি কারুকে কারুকে দয়া করতেন। এখন তিনি ব্রাহ্ম সমাজের মহাগুরু, নিরাকার পরম ব্রহ্মকে নিয়েই এত ব্যস্ত যে, গরিবের কথা শোনার সময় তাঁর নেই। দুঃখী মানুষদের কান্না তার কানে যায় না। তিনি আমার ওপরে মোটেই সন্তুষ্ট নন। আমি তাঁর জমিদারিতে প্রজাদের অবস্থার কথা কিছু কিছু লিখেছি যে।

মীর বলল, আপনাকে অপছন্দ করার আর একটা কারণও আছে। আপনি আগে ছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের পাণ্ডা, এখন ব্রাহ্ম ধর্ম ছেড়ে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর চ্যালা হয়েছেন।

হরিনাথ বলল, কিছুদিন আমি ব্রাহ্ম ধর্মের দিকে আকৃষ্ট হয়েছিলাম ঠিকই। এখন আর আগ্রহ বোধ করি না। ব্রাহ্মদের রকম সকম আমার কেমন যেন স্বদেশীয় মনে হয় না। লালন, তুমি কোন ধর্ম মাননা? তোমার এখানে তো হিন্দু-মুসলমান দুরকম মানুষই আছে দেখছি। কয়েক জনের সঙ্গে কথাও বলেছি।

লালন বলল, এখানে যার যেমন খুশি ধর্ম মানে! এমনকী একজন মানুষ দুই রকম ধর্মও মানতে পারে। মানে তো দেখি। আর আমরা গান নিয়া থাকি।

হরিনাথ বলল, বাঃ, সে তো খুব অপূর্ব। তুমি নিজে কী মাননা? তোমাকে অনেকেই লালন সাঁই বলে। তুমি কি জন্মগত ভাবে মুসলমান?

মীর বলল, লালন কি মুসলমানের নাম হয়? তোমার পুরা নাম কী?

লালন বলল, পুরা নাম কিছু নাই। আমি সামান্য মানুষ, ওইটুকু নামই যথেষ্ট। আমার বিদ্যা-বুদ্ধিও কম। আল্লা কিংবা পরমেশ্বরের লীলার কথা মস্তকে ধারণ করার মতন শক্তি নাই। এখনও তো মানুষরেই ভালো করে চিনলাম না। মানুষ কত বিচিত্র। আমি তো নিজেরেই এখনও জানি না। আমি কোথা থেকে এসেছি, কোন অরূপের ধাঁধায় ঘুরতেছি, তাও তো বুঝি না।

হরিনাথ বলল, আত্মানং বিদ্ধি। নিজেকে জানো। এ তো বহু বহুকালের তত্ত্ব।

মীর বলল, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।

লালন বলল, এসব তত্ত্বও আমি বুঝি না। গোস্তাকি মাফ করবেন, একটা কথা কব? আমি মুখ্যুসুখ্যু মানুষ, কথা দিয়া অনেক কিছুই বুঝাইতে পারি না। তখন এক একটা গান মনে আসে। একটা গান শুনাতে পারি?

হরিনাথ বললেন, গান? বেলা বেড়েছে, আমাদের এবার যেতে হবে। ঠিক আছে, একটা গান গাও, তার বেশি না।

লালন একটুও চিন্তা না করে গান ধরল:

সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে
লালন ভাবে–জাতির কী রূপ
দেখলাম না এই নজরে।

কেউ মালা কেউ তসবি গলায়
তাইতে তো জাত ভিন্ন বলায়
যাওয়া কিংবা আমার বেলায়
জাতের চিহ্ন রয় কার রে?

যদি সুন্নত দিলে হয় মুসলমান
শরীর তবে কী হয় বিধান?
বামন চিনি পইতে প্রমাণ
বামনি চিনি কীসে রে?

জগৎ বেড়ে জাতের কথা
লোকে গৌরব করে যথা তথা
লালন সে জাতের ফাতা
ঘুচায়েছে মাঠ বাজারে!

গান শেষ হতে একটুক্ষণ চুপ করে বসে রইল হরিনাথ। তারপর সে বিহুলভাবে বলল, এ কী গান শুনালে সাঁই! চণ্ডীদাসের মতন কোনও পদকর্তাই তো এমন সহজ-সরল ভাবে আমাদের ঘরের কথা শোনাতে পারেন নাই। তাই না মীর? এর যে অলৌকিক শক্তি আছে মনে হয়।

মীর এতটা মুগ্ধ হয়নি বোধহয়। সে শুধু বলল, হুঁ।

হরিনাথ আবার উচ্ছ্বসিতভাবে বলল, আরও অনেক গান শুনতে ইচ্ছে করছে, আর যেতে ইচ্ছে করছে না।

মীর বলল, কিন্তু যেতে হবে। মজুমদারসাহেব, আর বেশি দেরি করা যাবে না।

হরিনাথ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চলো। লালন, তুমি আজ থেকে আমার দোস্ত হলে। আমি তোমার এখানে আবার আসব। তুমিও যেও এই দরিদ্রের কুটিরে। আরও অনেক গান শুনে ধন্য হব।

লালনকে পাশে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হরিনাথ বলল, শোনো লালন ভাইডি, এই নতুন বসতিতে তোমরা সুখেশান্তিতে, গান-টান নিয়ে আছ বেশ কথা। কিন্তু জানো তো, এ দুনিয়াটা শক্তের ভক্ত, নরমের যম। এর পর যখন রটে যাবে যে, এই গ্রামের মানুষ শুধু নাচে আর গায়, কোনও অস্ত্র ধরতে পারে না ন্যাড়া-নেড়িদের মতন, তখন দেখবে নানা দিক থেকে চোরাগোপ্তা আক্রমণ শুরু হয়ে যাবে। তুমি হিংসা করবে না, কিন্তু হিংসাকে আটকাবার জন্য শক্তিরও দরকার। আর তুমি শুধু এই গ্রামে আবদ্ধ থেকো না, বাইরে বেরোও। সাঁই, তুমি এসো এই অধমের গরিবখানায়।

হরিনাথের কথাগুলি মনে ধরেছে লালনের। সে গ্রামের সমর্থ পুরুষদের নিয়ে লাঠি খেলার চর্চা শুরু করে দিল। কাশেম যখন খোঁড়াতে খোঁড়াতে এক পাশে এসে বসে থাকে, তখন লালনের বড় মায়া লাগে। কাশেমেরও নিশ্চয়ই লাঠি ধরতে ইচ্ছে করে, কিন্তু উপায় নেই।

কাশেম আর কমলি পরস্পরকে চেয়েছিল। মাঝখান থেকে জাত ও ধর্ম। এসে সাংঘাতিক বাধা দিল। তাতে এই দুটি জীবন প্রায় নষ্ট হতে বসেছে, কিন্তু তাতে জাত ও ধর্মের কী লাভ হল? মানুষকে কষ্ট দিয়ে ধর্ম? কে জানে!

লাঠি খেলা ছাড়াও আরও একটা খেলা শেখাল শীতল নামে একজন নতুন আবাসিক। রণ-পায়ে চড়া। লম্বা লম্বা বাঁশের তৈরি রণ-পায়ে উঠে। ভারসাম্য রাখা সহজ নয়, প্রথম প্রথম ধপাস ধপাস করে পড়ে যেতে হয়। বেশ কয়েকদিন ধরে শিখতে লাগে। লালন এতে বেশ উৎসাহ পেয়ে গেল, এবং কিছুদিনের মধ্যেই সে শিখে গেল বেশ ভালোভাবে।

এই রণ-পায়ে চেপে দ্রুত অনেক দূর যাতায়াত করা যায়। জল-কাদার বাধাও অতিক্রম্য।

এখন লালন পাঁচ-ছজন সঙ্গীকে নিয়ে রণ-পায়ে উঠে জঙ্গলের মধ্যে ভ্রমণ করতে যায় প্রায়ই। এমনকী জঙ্গলের বাইরে হাটে যাওয়ারও সুবিধে হয়। তবে হাটের ঢাকার আগে রণ-পাগুলি রেখে যায় জঙ্গলের মধ্যে।

একসঙ্গে এত মানুষের বসতি হয়েছে বলে জঙ্গলের হিংস্র জানোয়াররা আর এদিকে বিশেষ আসে না, শিয়াল ছাড়া। শিয়াল মানুষের গ্রামের আশেপাশেই ঘুরঘুর করে। নিজেরা ভালো শিকার করতে পারে না, তাই চুরি করাতেই তারা দক্ষ। ফাঁক পেলেই মুখে তুলে নিয়ে যায় হাঁস-মুরগি।

জঙ্গলের মধ্যে রণ-পায়ে ঘোরার সময় কয়েকবার বাঘডাসার ডাক শুনেছে আর ভাল্লুক দেখেছে লালনের দলবল। এমনকী কালীগঙ্গা নদীর ধারে একদিন একটা বাঘও দেখা গিয়েছিল। কিন্তু এত লম্বা লম্বা মানুষ দেখার অভিজ্ঞতা নেই সেইসব হিংস্র জানোয়ারদের। তারা ভয় পেয়ে ল্যাজ গুটিয়ে দৌড়োয়। বাঘটাও ঝাঁপ দিয়েছিল নদীর জলে।

ওই কালীগঙ্গা নদীর ধারেই একদিন একটা মজার ব্যাপার হল। শেষপর্যন্ত অবশ্য ব্যাপারটা আর মজার রইল না।

সেদিন বিকেল শেষ হতে না-হতেই অন্ধকার হয়ে এল আকাশ। অসময়ের মেঘ গুরুগুরু গর্জন শুরু করল। লালন আর তার দলবল বেড়াতে বেড়াতে জঙ্গলের মধ্যে অনেকটা দূরে চলে গিয়েছিল, ফেরার পথ ধরার আগেই নামল বৃষ্টি।

ঝড়-বৃষ্টিতে তেমন ভয় নেই, কিন্তু বজ্র পতনের বাড়াবাড়ি হলে বিপদ আছে। বাজ পড়েও কিছু কিছু মানুষ মারা যায়। গাছতলা কিংবা খোলা। জায়গায় দাঁড়ানোও নিরাপদ নয়।

তখন ওদের মনে পড়ল, নদীর ধারে একটা শ্মশানে একটা প্রাচীন কালী। মন্দির আর তার সামনে একটা ছাউনিও আছে। সেখানে আশ্রয় নেওয়া যায়।

সেই শ্মশানে এসময় একটি মাত্র শবযাত্রী দল উপস্থিত। চিতা সাজানোও হয়ে গেছে। বৃষ্টির জন্য আগুন ধরানো হয়নি। জনা পাঁচেক শবযাত্রী গুটিসুটি মেরে বসে আছে সেই ছাউনিতো।

এমন সময় তারা দেখল বৃষ্টি আর সন্ধ্যার আবছায়ার মধ্য দিয়ে বিরাট লম্বা লম্বা একদল ভূত ধেয়ে আসছে তাদের দিকে। অনেক গপ্পো-উপকথায় ভূতেদের এরকম দীর্ঘ শরীরের বর্ণনা থাকে।

ওরে বাপ রে, মা রে বলে ভয়ার্ত চিৎকার করতে করতে শবযাত্রীরা দৌড় লাগাল। পড়ে রইল তাদের মর্ডা, কেউ জলে ঝাঁপ দিল, কেউ অদৃশ্য হয়ে গেল তিরবেগে ছুটে।

এই কাণ্ড দেখে লালন ও তার সঙ্গীরা হো-হো করে হাসতে লাগল। সেই হাস্যধ্বনি পলায়নপর শবযাত্রীরা শুনে আরও মনে করল ভৌতিক ব্যাপার। এমনকী, ও মশায়রা যাবেন না, যাবেন না, ভয় নাই, ফিরা আসেন, এই আহ্বান শুনে আরও ভয় বেড়ে গেল তাদের।

লালনদের হাসি আর থামে না। রণ-পা থেকে নেমে তারা বসল সেই চালার নীচে। সেখানে অনেকগুলি সরায় রাখা রয়েছে কলা ও কিছু অন্য ফল, আতপ চাল, জবা ফুল। এসব কীসের জন্য? ওরা কি কালী মন্দিরে পুজো দেবার কথাও ভেবেছিল? কিন্তু এই পরিত্যক্ত মন্দিরে তো অনেকদিন পুজো হয় না, ঠাকুরের বিগ্রহও নেই। তা হলে?

এই শবযাত্রীরা আজ রাত্রে আর ফিরবে না, তা বোঝাই যায়। শীতল বলল, এই ফলমূলগুলা আমরাই খাই না কেন?

এতে কারওই আপত্তির কোনও কারণ নেই। ওরা খেতে শুরু করল। মহানন্দে। ক্ষণেক পরে শুনতে পেল গোঙানির শব্দ।

এবার এদের ভয় পাবার পালা। মড়াটা কি জেগে উঠল নাকি প্রেত হয়ে? শঙ্কিতভাবে তাকাল এ ওর মুখের দিকে।

তবে, ওপরতলার মানুষ অপ্রাকৃত ব্যাপারে যত ভয় পায়, নীচের তলার মানুষ তত ডরায় না। ভূত-প্রেত নিয়েই তাদের বেঁচে থাকতে হয়।

কেউই দৌড় মারল না। লালন, শীতল আর মোয়াজ্জেম একসঙ্গে উঠে এসে মৃতদেহের ওপর ঢাকা দেওয়া চাদরটা সরিয়ে দিল এক টানে।

তারপরই তারা তাজ্জব। দেহ একটা নয় দুটো। একসঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে দড়ি দিয়ে বাঁধা। তলারটি একজন পুরুষের, পাকা চুল-দাড়ি সমেত বৃদ্ধ, আর ওপরেরটি এক তরুণী নারীরা গোঙানি আসছে ওই নারীর কণ্ঠ থেকেই।

বেশ কয়েক মুহূর্ত এরা হতবাক হয়ে বসে রইল। ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধে হল না মোটেই। পলাতক লোকগুলি সতীদাহ করতে চেয়েছিল। বৃদ্ধ স্বামীর সঙ্গে তার এক স্ত্রীকে সতী নাম দিয়ে পুড়িয়ে মারা বে-আইনি বলে ঘোষণা করেছে ইংরেজ সরকার। কিন্তু গ্রাম-গঞ্জে সে ব্যাপার এখনও গোপনে ঘটে। বিধবা যাতে গলগ্রহ হয়ে না-থাকে কিংবা তাকে সম্পত্তি দিতে না-হয়, তার জন্য পুড়িয়ে আপদ চুকিয়ে দেওয়াই সুবিধেজনক।

লালন ও অন্য দুজন চটপট বাঁধন খুলে দিল। বৃদ্ধটি সন্দেহাতীত ভাবে মৃত, আর রমণীটির নাড়ি বেশ সচল। তার চেতনা নেই পুরোপুরি। সাধারণত এইরকম অবস্থায় নারীদের আফিং খাইয়ে রাখা হয়, যাতে চিৎকার-টিৎকার না-করতে পারে। আর সেইজন্যই পুজোর আয়োজন। কোনওরকমে নমো নমো করে একটু পুজোর ভান করলেই মানুষ পুড়িয়ে মারার মতন নৃশংস কাজের ওপরেও পুণ্যের ছোঁয়া লেগে যায়।

এবার বোঝা গেল, ওই লোকগুলো অমনভাবে ছুটে পালাল কেন। শুধু ভূতের ভয় নয়, তাদের মনে ছিল অপরাধবোধ, ধরা-পড়ার আশঙ্কা।

নদী থেকে সরা ভরতি করে বারবার জল এনে ছিটিয়ে দেওয়া হতে লাগল নারীটির চোখে মুখে। বেশ কিছুক্ষণ পরে সে চোখ মেলে অস্ফুটস্বরে কী যেন বলল, তা বোঝা গেল না।

এর মধ্যে বৃষ্টি ধরে গেছে। এবার ঘরে ফিরলেই হয়। কিন্তু এই রমণীকে নিয়ে কী করা যাবে। আর ওই বৃদ্ধের লাশেরই বা কী ব্যবস্থা হবে? চিতা যদিও সাজানো রয়েছে, কিন্তু প্রবল বৃষ্টিতে কাঠ একেবারে জবজবে ভিজে, ভিতরে জলও জমে আছে। সারা রাতেও আগুন জ্বালানো সম্ভব হবে না। আর লাশটি এখানে ফেলে রেখে গেলে শিয়াল-কুকুরে ছিঁড়ে খাবে। এর মধ্যেই শিয়ালের উপস্থিতি কাছাকাছি টের পাওয়া যাচ্ছে।

আর অর্ধ-অচেতন জীবন্ত নারীটি?

শিয়ালের দল তাকেও ছাড়বে না।

আর যদি বা সে আত্মরক্ষা করে কোনওক্রমে বেঁচে থাকতেও পারে, তা হলে কাল দিনেরবেলা পলাতক শ্মশানবন্ধুরা ফিরে এসে তাকে প্রথমেই বাঁশ পিটিয়ে মেরে ফেলবে, তারপর পচা-গলা লাশটির সঙ্গেই আবার চিতায় চাপাবে।

শীতল আর জুড়ান বাল্যকালে এরকমই দেখছে। সতী হবার জন্য কোনও নারীকে একবার শ্মশানে নিয়ে এলে আর ফিরিয়ে নিয়ে যাবার প্রথা নেই। চিতার আগুন গায়ে লাগার পর কেউ যদি সহ্য করতে না-পারে, যদি লাফিয়ে নেমে আসতে চায়, তখন তাকে তিন-চারজনে মিলে বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে আগুনের মধ্যেই চেপে ধরে থাকে। আর দুএকজন খুব করে কাঁসর ঘণ্টা বাজায়, যাতে তার কান্না ও আর্তনাদ শুনতে না-পাওয়া যায়। অর্থাৎ মৃত্যু এর অবধারিত।

শীতল, মনসুর, জুড়ানদের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ এই বিষয়ে আলোচনা। করল লালন। সহজে একমত হওয়া যাচ্ছে না। মৃতদেহটিকে না-হয় নদীর জলে ভাসিয়ে দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু রমণীটিকে কি সঙ্গে নিয়ে যাওয়া। হবে? সে যদি নিজের গ্রামে ফিরে যেতে চায়? সন্তান থাকলে তার টানে সেরকম চাইতেই পারে। কিন্তু একবার এতগুলি পুরুষের সঙ্গে কোথাও রাত্রি কাটালে তার গ্রামে ফিরে যাবার সম্ভাবনা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। আর যদি ওকে সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়, তাই-বা কী করে সম্ভব? সবাই এসেছে। রণ-পায়ে, এ রমণী হাঁটতে পারবে না, আর কারুর পক্ষে ওকে বয়ে নিয়ে যাওয়াও তো সম্ভব নয়।

সুতরাং ওকে নিয়তির হাতে ছেড়ে চলে যাওয়াই তিন-চারজনের মত হল।

লালন বিশেষ তর্ক করেনি। সকলের সিদ্ধান্ত শোনার পর সে বলল, তা হলে তোমরা আর দেরি কইরো না। আগাইয়া পড়ো।

শীতল বলল, সে কী? আর তুমি?

লালন বলল, আমি একটু বসি। অর জ্ঞান ফেরলে জিজ্ঞাসা করব, ও কোথায় যাইতে চায়।

মনসুর বলল, সে কী, তুমি একা একা এইহানে বইয়া থাকবা?

লালন বলল, বসি!

রমণীটি উঠে বসে বিড়বিড় করে কিছু বলতে লাগল। তারপর কিছুটা স্পষ্টভাবে বোঝা গেল; এইডা কোথায়? আমি কি স্বর্গে আইছি?

দুজন হেসে উঠতেই তাদের ধমক দিল মনসুর।

রমণীটি আবার উতলা হয়ে বলল, কও না, এইডা কি স্বর্গ?

মনসুর তাকে বলল, না দিদি, এইডা স্বর্গ না। এইডা শ্মশান।

ঠিক যেন বুঝতে না-পেরে রমণীটি জিজ্ঞেস করল, তয় কি এইডা নরক? আমারে নরকে পাঠাইছে?

এবার লালন বলল, না, এইডা স্বর্গও না, নরকও না। তুমি মরো নাই।

নারীটি দুহাতে নিজের বুক চাপড়াতে চাপড়াতে বলতে লাগল, মরি নাই? কেন মরি নাই? আমি কোথায়? তোময়া কারা?

তাকে বোঝাতে অনেকটা সময় লাগল। সে এমনই উতলা হয়ে উঠেছে যে, কোনও কথাই শুনতে চায় না।

এর মধ্যে ওরা মৃতদেহটি ভাসিয়ে দিল জলে।

তারপর লালন ও মনসুর নারীটির দুহাত ধরে তুলে হাঁটিয়ে নিয়ে চলল। তাতে অবশ্য সে আপত্তি করল না। কিন্তু আপন মনে অনেক কথা বলে যেতে লাগল।

ওরা দুজন ওদের রণপা ফেলে রেখে গেল। পথ বলতে সেরকম কিছু নেই। চতুর্দিকে থিকথিকে কাদা। তার মধ্যে একজন প্রায় অর্ধচেতন নারীকে ধরে ধরে নিয়ে যাওয়া খুবই কষ্টকর।

শিমুলতলায় পৌঁছোতে অনেক রাত হয়ে গেল। 

এই দুর্যোগের মধ্যে লালনরা কয়েকজন ফেরেনি বলে অনেকেই উদবিগ্ন হয়ে জেগে বসে ছিল। দলটিকে ফিরতে দেখে সবাই হইহই করে উঠল।

লালন কমলিকে ডেকে বলল, এই একজন নতুন অতিথ আইছে। অর এখন মাথার ঠিক নাই। দ্যাখ, যদি একটু শান্ত করতে পারোস। দুগগা ভাত খাওয়াইতে পারলেও ভালো হয়।

একটা আগুন জ্বালা, সেই আগুন ঘিরে বসে আছে অনেক নারী-পুরুষ। এখানে এসে পৌঁছে রমণীটির কী মনে হল কে জানে।

সে অবশ্য পাখির মতন আর্ত গলায় চেঁচিয়ে উঠল, আমি মরি নাই? কেন মরি নাই? মারো, আমারে মারো, মাইরা ফেলো।

কমলি তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, দূর বোকা। মরবি কেন? এহানে কেউ তরে মারবে না।

সে তবু বলতে লাগল, না, আমি মরব। আমার আর কিছু নাই, আমারে মাইরা ফেলাও তোমরা!

কমলি বলল, অনেক ভাইগ্যে মানুষ হইয়া জন্মাইছিস। মরবি ক্যান? আরও যত দিন বাঁচবি, ততদিন কত কী দেখবি! কত লীলা।

একজন বলল, কমলি, অরে একটা শুকনা শাড়ি পরায়ে দে। আমাগোও খুব ভুক লাগছে। সবাই মিলা খাব এখন।

কমলি প্রায় জোর করেই টানতে টানতে মেয়েটিকে নিয়ে গেল নিজেদের ঘরের দিকে। মনসুর সবাইকে শোনাতে লাগল আজ সন্ধ্যার অভিযান কাহিনি।

দুদু একটা শুকনো গামছা এনে লালনকে বলল, ওস্তাদ, মাথাটা ভালো করে মুছে নাও। তারপর একটা বিড়ি ধরাও।

গাছের গুঁড়িটায় বসে লালন বিড়ি টানতে টানতে চেয়ে রইল দূরের অন্ধকারের দিকে।

এত ঝড় বৃষ্টির পরও আকাশ মেঘলা। তারই ফাঁকে ফাঁকে একটু একটু দেখা যাচ্ছে চাদ। তার মাথার মধ্যে একটা কথা ঘুরতে লাগল। বেঁচে ওঠার পরও ওই স্ত্রীলোকটি মরতে চাইছে কেন? হয়তো ওর জীবন এমনই দুঃখে ভরা, বেঁচে থাকতে এক বিন্দু সুখ কখনও পায়নি। কিন্তু মৃত্যু কি শান্তি দিতে পারে? বেঁচে থাকার দুঃখ কষ্ট ছাড়িয়েও কি মাধুর্যের সন্ধান পাওয়া যায় না?

হঠাৎ লালনের বুকে যেন একটা বড় ঢেউয়ের ঝাঁপটা লাগল। সে আপন মনে গেয়ে উঠল।

এমন মানব জনম আর কী হবে
মন যা করো তুৱায় করো এই ভবে।

দুদ্দু বলল, কী গাও ওস্তাদ, জোরে গাও! আমরা সবাই শুনি। লালন আবার গাইতে লাগল, একটুও না-থেমে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে: 

এমন মানব জনম আর কি হবে
মন যা করো ত্বরায় করো এই ভবে।
অনন্তরূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই
শুনি মানবের উত্তম কিছুই নাই।
দেখো দেবতাগণ
করে আরাধন
জন্ম নিতে মানবে।

শীতল বলল, ঠিকই কইছ সাঁই। দ্যাবতারাও মানুষ হইয়া জন্মায় কীসের টানে?

লালন বলল, আমি কিছু কই নাই। ওই যে কমলি কইল, অনেক ভাইগ্যো মানুষ হইয়া জন্মাইছিস… তাইতেই আমার মনে আসল:

কত ভাগ্যের ফলে না জানি
মন রে পেয়েছ এই মানব তরণী…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *