শিবুকে লইয়া পিসিমা বাড়িতে ফিরিলেন হাসিমুখে। কয়দিন পর সকলে তাহার হাসিমুখ দেখিয়া আজ আশ্বস্ত হইয়া বাঁচিল।
হাসিমুখে পিসিমা বলিলেন, শিবুকে তুমি কিছু বলতে পাবে না বউ। আমি ওকে ঘোড়া কিনে দিয়েছি। ও ফিরিয়ে দিচ্ছিল।
মা বলিলেন, তোমার ওপর কিছু বলবার আমি কে ঠাকুরঝি? শিবু তো তোমারই। তবে আমি বারণ করি কেন জান?
পিসিমা বলিলেন, সে আমি জানি। তুমি আমার চেয়ে অনেক বেশি বোঝ, সে কি আমি জানি না ভাই? শিবু এখন যতদিন পড়বে, ঘোড়ার কাছ দিয়ে যেতে পাবে না, একবার করে চড়বে শুধু। কেমন?
শেষ প্রশ্নটা করা হইল শিবনাথকে। সেও সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় নাড়িয়া সুবোধ শিশুর মত বলিল, হ্যাঁ।
রতনদিদি বলিল, এখন যা বলবে, তাতেই হ্যাঁ। ঘোড়া পেয়েছে আজ, আজ শিবুর মত সুবোধ ছেলে ভূ-ভারতে নেই।
বাড়ির সকলেই তাহার কথার ভঙ্গিমায় প্ৰাণ খুলিয়া হাসিয়া উঠিল, এমনকি শিবনাথের মা পর্যন্ত।
এই সময় গৃহদেবতার পূজক অক্ষয় মুখুজ্জে আসিয়া বলিল, কই গো, গিন্নি কই? ইয়ে কে বলে, কাল থেকে যে পুজোর বাসনগুলো মাজা হয় নাই।
অক্ষয় এই গ্রামেরই লোক, গ্রাম-সম্পর্কে নান্তির দাদামহাশয় হয়, তাই সে নান্তিকে চিন্নি বলিয়া ডাকিয়া থাকে, নান্তি তাহাতে রাগে, সেই তাহার পরিতৃপ্তি।
বলিতে ভুলিয়াছি, সেই দিন হইতে বধূর উপর নূতন কয়টি কাজের ভার পড়িয়াছে, তাহার মধ্যে দেবপূজার বাসন-মাজা একটি।
পিসিমা বলিলেন, বউমা কোথায় রে?
নিত্য আজ হাসিতে ভয় করিল না, কৌতুকভরে হাসিয়া বলিল, বউমা তোমার পালিয়েছে পিসিমা, খিড়কির পাড়ের গলি দিয়ে। আমি ডাকলাম, ও বউদিদি!—বউদিদি বোঁ-বোঁ করে দৌড়।
অক্ষয় বলিল, গিনি শিবনাথের ঘর করবে না মাসিমা, আমাকেই ওর পছন্দ–
অক্ষয়ের কথা শেষ হইল না, কঠোরকণ্ঠে পিসিমা বলিলেন, ও রকম ঠাট্টা আর কখনও যেন তোমার মুখে না শুনি অক্ষয়।
অক্ষয় অ্যাঁতকাইয়া উঠিয়া বলিল, হুঁ তা বটে, হুঁ-তা আর—হুঁ–
হুঁ কথাটি অক্ষয়ের মুদ্রাদোষ। পিসিমা বলিলেন, নিত্য, যা ডেকে আন্ তো বউমাকে।
তারপর ভ্রাতৃজায়াকে বলিলেন, বউমাকে নিয়ে তো বড় বিপদ হল বউ!
জবাব দিল অক্ষয়, এটি তাহার স্বভাব, উপস্থিত থাকিলে সে দুই কথা বলিবেই, সে বলিল, হুঁ– বিপদ বৈকি, হুঁ–
রূঢ়স্বরে পিসিমা বলিলেন, আপনার কাজে যাও অক্ষয়। সকল তাতেই কথা কওয়া–কী বদ স্বভাব তোমার!
রতন ইশারা করিয়া অক্ষয়কে প্রস্থান করিতে ইঙ্গিত করিল।
নিত্য ফিরিয়া আসিল একা। পিসিমা কঠোরস্বরেই প্ৰশ্ন করিলেন, বউমা কই?
নিত্য একটু ইতস্তত করিতেছিল, পিসিমা অসহিষ্ণুভাবে আবার প্রশ্ন করিলেন, কোথায় বউমা?
নিত্য বলিল, ওদের লোক আসছে, সব বলবে।
পিসিমা বলিলেন, ওদের লোক ওদের কথা বলবে। তোকে যা জিজ্ঞেস করছি, তার উত্তর দে।
নিত্য বলিল, এলেন না বউদিদি।
এল না!
না।
কী বললে?
সে ওদের লোক এসে–
নিত্য।
পিসিমার স্বরের প্রতিধ্বনিতে বাড়িখানা গমগম করিয়া উঠিল, নিত্য চমকিয়া উঠিল।
সে এবার বিবৰ্ণ মুখে বলিল, বউদিদি ও-বাড়িতেই থাকবেন এখন, বড় হলে—
হুঁ। আর কী কথা হয়েছে?
পুজোর বাসন মাজতে গিয়ে বালিতে বউদিদির হাত মেজে গেছে।
আর কী কথা হয়েছে?
আর পিসশাশুড়ির এত বকাঝকা কি ওই কচি মেয়ে সইতে পারে?
নান্তির দিদিমার বাড়ির একজন প্রবীণা মহিলা আসিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, নান্তির দিদিমা বললেন, নান্তি এখন ওইখানেই থাকবে। বড়সড় হোক, তারপর আসবে। নান্তির বাক্সটাক্সগুলো পাঠিয়ে দিতে বললেন।
পিসিমা কী বলিতে গেলেন, কিন্তু আত্মসংবরণ করিয়া আবার বলিলেন, শিবুর মা রয়েছে, বল।
তিনি ধীরে ধীরে উঠিয়া চলিয়া গেলেন। শিবনাথের মাকেও কিছু বলিতে হইল না, শিবনাথই এক বিপর্যয় বাঁধাইয়া তুলিল। নান্তির বাক্স-পেটরা সমস্ত নিজেই বাহির করিয়া আনিয়া বারান্দায় হাজির করিল। তারপর বিবাহের যৌতুক-ঘড়ি, চেন, আংটি, বোতাম, সোনার কলম, রুপার দোয়াত, যাহা কিছু নিজের নিকট ছিল, সমস্ত বাক্সের উপর ফেলিয়া বলিল, নিয়ে যান।
মহিলাটি, এমনকি বাড়ির সকলে পর্যন্ত বিস্ময়ে স্তম্ভিত হইয়া গিয়াছিল, শিবনাথের মায়ের মুখে কথা ছিল না।
শিবনাথ বলিল, আমার পিসিমার কথা শুনে যে না থাকতে পারবে তার ঠাঁই এ বাড়িতে হবে না। নিয়ে যান সব।
সে উঠিয়া চলিয়া গেল।
বাড়ির বাহির-দরজা হইতে কে বলিল, নিয়ে এস সব লক্ষ্মীপুরের বউ, গৌরদাস যাচ্ছে।–নান্তির দিদিমার কণ্ঠস্বর।
অকস্মাৎ একটা বিপর্যয় ঘটিয়া গেল। সমস্ত দিনটা বাড়িখানা থমথম করিতে লাগিল। সন্ধ্যায় পিসিমা বলিলেন, শিবুর আমার আবার বিয়ে দোব বউ।
শিবুর মা হাসিয়া বলিলেন, তোমার শিবু, আমায় কেন জিজ্ঞেস করছ ঠাকুরঝি? কিন্তু শিবু আরও একটু বড় হোক, অন্তত ম্যাট্রিক পাসটা করুক।
একটুখানি নীরব থাকিয়া পিসিমা বলিলেন, না, সে পারব না। যাই করুক, ও আমার শিবুর বউ।
শিবনাথের মা কোনো কথা বলিলেন না, নীরবে শুধু একটু হাসিলেন।
কিছুক্ষণ পর আবার পিসিমা বলিলেন, অন্যায় বোধহয় আমারই হল বউ।
মা বলিলেন, না।
পিসিমা বলিলেন, শিবুর মনে হয়ত কষ্ট হয়েছে, সে বোধহয় আমারই ওপর অভিমান করে–
মা বলিলেন, না। শিবু তোমাকে ভুল বুঝবে না, তুমি শিবুকে ভুল বুঝো না ভাই।
পিসিমা বলিলেন, বউমার জন্যে ঘর খাঁখাঁ করছে ভাই।