০৯. শিখার ছদ্মবেশ

শিখার ছদ্মবেশ

এক – অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান তরুণীর মৃতদেহ

কিছুদিন আগে কলকাতার গড়ের মাঠে একটি অ্যাংলো—ইণ্ডিয়ান তরুণীর মৃতদেহ পাওয়া যায়, খবরটা হয়তো অনেকেরই জানা আছে। খবরের কাগজে এ সম্বন্ধে যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল, তা থেকে জানতে পারা যায় যে, মেয়েটিকে কোনো অজ্ঞাতনামা আততায়ী বিষ—প্রয়োগে হত্যা করেছিল। কিন্তু আততায়ীর কোনো খোঁজই পুলিশ পায়নি।

ময়না—তদন্তের রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, মেয়েটির বয়স বিশ থেকে একুশ বৎসর। রিপোর্টে আরও জানা যায় যে, তার দেহে বিষক্রিয়ার লক্ষণ ছিল। অবশ্য পাকস্থলীতে কোনো বিষ পাওয়া যায়নি। এই সব থেকে সন্দেহ করা হয় যে, মেয়েটির দেহে কোনোরকম তীব্র বিষ ইনজেকশন করে তাকে হত্যা করা হয়েছিল।

ডাক্তারের রিপোর্টের উপর নির্ভর করে করোণার—আদালত ব্যাপারটাকে ইচ্ছাকৃত নরহত্যা বলে রায় দেন। পুলিশ অনুসন্ধান করতে কোনোই ত্রুটি করেনি সম্ভব—অসম্ভব সব পদ্ধতি প্রয়োগ করেও পুলিশ খুনীর কোনো সন্ধান পায়নি।

মেয়েটির ফটো পুলিশ—গেজেটে প্রকাশ করা হয়। এছাড়া কয়েকখানা বহুল—প্রচারিত দৈনিক পত্রিকাতেও মেয়েটির ছবি ছেপে পুলিশ ঘোষণা করে যে, যে—কেউ এই মেয়েটির হত্যাকারীর সন্ধান দিতে পারবে, তাকে নগদ এক হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে।

এত করেও কিন্তু মেয়েটির সম্বন্ধে কোনো খবরই পুলিশ সংগ্রহ করতে পারে না। পার্ক ষ্ট্রীট থানার দারোগার উপর এই হত্যার অনুসন্ধানের ভার পড়েছিল। ব্যাপারটার কোনো কিনারা করতে না পেরে তিনি চাপা দেবারই চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু এমন সময় ওপরওয়ালার কাছ থেকে তাঁর কাছে আসে কড়া তলব।

পুলিশ—কমিশনার কড়া নোট পাঠিয়েছেন—ঐ ব্যাপারে তিনি কতদূর কি করতে পেরেছেন, তার সব খবর বিস্তারিতভাবে জানাতে।

ঐ হত্যার সংবাদ নিয়ে দিল্লীর লোকসভায় আলোচনা হওয়ায় এখন পুলিশ—কমিশনার ব্যাপারটা স্বহস্তে নিতে চান।

দিল্লীর জনৈক অ্যাংলো—ইণ্ডিয়ান সদস্য তীব্র ভাষায় কলকাতা পুলিশের সমালোচনা করে বলেন যে, কলকাতার মতো জনবহুল সহরে তাঁর সম্প্রদায়ের একটি তরুণী নিহত হ’ল এবং তার মৃতদেহটি গড়ের মাঠে পাওয়া গেল, এ কথা ভাবতেও অবাক হ’তে হয়। আরও আশ্চর্য্যের কথা এই যে, এ বিষয়ে কলকাতা পুলিশ আজ পর্য্যন্ত কিছুই করতে পারলো না! মনে হয়, ব্যাপারটা যেন তারা চাপা দিতেই চায়। তারা বোধ হয় মেয়েটির কোনো পরিচয়ই সংগ্রহ করতে পারেনি। একটি প্রগতিশীল রাজ্যের পুলিশ—বিভাগের পক্ষে এর চাইতে কলঙ্কজনক ঘটনা আর কি হ’তে পারে?

সদস্য মহাশয় আরও অনেক কথা বলবার পর যখন ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী মহোদয়কে ঘটনাটা সম্পর্কে পুলিশ কতদূর কি করেছে তার বিবরণ প্রকাশ করতে বলেন, তখন তিনি বাধ্য হয়ে ”নোটিশ চাই” বলে কোনোরকমে ব্যাপারটাকে চাপা দিতে চেষ্টা করেন।

কিন্তু সাময়িকভাবে লোকসভায় ঐ প্রসঙ্গে আলোচনা বন্ধ হলেও তিনি কড়া নোট পাঠান পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে। ঐ নোটে অ্যাংলো—ইণ্ডিয়ান তরুণীর মৃত্যু সম্বন্ধে কলকাতা পুলিশ কতদূর কি করেছে, তার বিশদ বিবরণ জানতে চান তিনি।

এইভাবে ভারত গভর্ণমেণ্টের কাছ থেকে তাগাদা পেয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। কোথাকার কোন এক তরুণী কবে কোথায় মরে পড়েছিল, সে—খবর নিয়ে কর্ত্তৃপক্ষ মোটেই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন না, কিন্তু হঠাৎ লোকসভায় বিষয়টা আলোচিত হওয়ায় এবং ভারত গভর্ণমেণ্ট থেকে কড়া নোট আসায় ব্যাপারটা রীতিমতো ঘোরালো হয়ে উঠলো।

দুই – তদন্তের তোড়জোড়

লালবাজারে পুলিশ—কমিশনারের খাস—কামরায় বসে কথা হচ্ছিলো কমিশনার মিঃ ব্যানার্জ্জী ও গোয়েন্দা—বিভাগের ডেপুটি কমিশনার মিঃ প্রভাত মিত্রের মধ্যে।

মিঃ মিত্র বয়সে তরুণ। কিন্তু তরুণ হলেও ইতোমধ্যেই তিনি প্রচুর সুনাম অর্জ্জন করেছেন। মিঃ মিত্রের কর্ম্মদক্ষতায় খুশী হয়ে গভর্ণমেণ্ট তাঁকে বিশেষ বৃত্তি দিয়ে বিলেতে পাঠান গোয়েন্দা—বিভাগীয় কাজে অভিজ্ঞ হয়ে আসবার জন্য। বলা বাহুল্য যে, মিঃ মিত্র কৃতিত্বের সঙ্গেই বিলেতের সমস্ত পরীক্ষায় কৃতকার্য্য হন।

যাই হোক, মিঃ মিত্রের বিভাগীয় কর্ম্মদক্ষতার বিষয় এখানে উল্লেখ না করে কমিশনারের সঙ্গে তাঁর কি ব্যাপারে আলোচনা হচ্ছিলো, সেই বিষয়েই আসা যাক।

কমিশনার মিঃ মিত্রকে বলেন—ভারত গভর্ণমেণ্টের চিঠি তো দেখলেন, এবার কি করা যায় বলুন তো?

—আপনি কি নির্দ্দেশ দেন?

—নির্দ্দেশ নয় মিঃ মিত্র, এই ব্যাপারে আমি আপনার পরামর্শ চাইছি। আমার মনে হচ্ছে, ব্যাপারটাকে গোয়েন্দা—বিভাগের হাতে দেওয়াই উচিত।

—আমারও তাই মনে হয় স্যর। আমার ধারণা যে, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে কোনো গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে। যে বা যারাই মেয়েটিকে হত্যা করে থাকুক, তারা যে অসদুদ্দেশ্যেই মেয়েটিকে হত্যা করেছিল, এতে কোনোই ভুল নেই। কেসটার ফাইল আগাগোড়া পড়ে দেখে আমার ধারণা হয়েছে যে, এই হত্যাকাণ্ডের কিনারা করা সাধারণ পুলিশের কর্ম্ম নয়।

—আপনি তাহলে এ—বিষয়ে কি করতে বলেন?

—আপনি কেসটাকে আইনানুগভাবে গোয়েন্দা—বিভাগের হাতে দিন। আপনার কাছ থেকে লিখিত নির্দ্দেশ না পেলে যে, ও—ব্যাপারে আমার কিছুই করবার উপায় নেই, তা আপনি ভালই জানেন।

—তা জানি বৈ কি! বেশ, আজই আমি কেসটাকে গোয়েন্দা—বিভাগের হাতে দিচ্ছি; আর ইতোমধ্যে গভর্ণমেণ্টকেও জানিয়ে দিচ্ছি সে—কথা।

—বেশ, তাই হবে। তবে আমার ইচ্ছা যে, এ—ব্যাপারে আমি মিস্ শিখা রায়ের সাহায্য নেবো। মিস্ রায় বে—সরকারী গোয়েন্দা হলেও অল্পদিনের মধ্যেই বেশ সুনাম অর্জ্জন করেছেন। তাছাড়া, তাঁর তদন্ত—পদ্ধতিও আমার খুব ভাল লাগে। আমার মনে হয়, মিস্ রায়ের মতো বুদ্ধিমতী মেয়ে—গোয়েন্দার সাহায্য পেলে এই হত্যাকাণ্ডের কিনারা করা আমাদের পক্ষে সহজ হবে।

—ভাল! তাই করুন। মিস্ রায়ের সম্বন্ধে আমিও শুনেছি। আমার পূর্ব্ববর্ত্তী কমিশনারও প্রয়োজন হ’লে মিস্ রায়ের সাহায্য নিতে আমাকে উপদেশ দিয়ে গেছেন।

তিন – তদন্ত আরম্ভ

ডেপুটি কমিশনারের কাছ থেকে অ্যাংলো—ইণ্ডিয়ান তরুণীর হত্যাকাণ্ডের তদন্ত—ভারটা নিয়ে এসে নিজের ঘরে বসে চিন্তা করছিল শিখা।

বলা বাহুল্য, ঐ হত্যা—রহস্যটাই ছিল তার চিন্তার বিষয়।

অনেক কথাই ভাবছিল সে।

”কে ঐ মেয়েটি?” ”কি তার পরিচয়?” ”কে বা কারা তাকে ঐ রকম নৃশংস ভাবে হত্যা করলে?” ”কি উদ্দেশ্য তার বা তাদের?”

এইসব কথা ভাবতে ভাবতে তার মনে হয় যে, এই বিরাট সহরের লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিতর থেকে কি করে একজন অজ্ঞাত—পরিচয় অ্যাংলো—ইণ্ডিয়ান তরুণীর হত্যাকারীকে খুঁজে বের করবে সে?

এইরকম শত শত প্রশ্ন একের পর এক এসে তার মগজের মধ্যে ঢুকতে লাগলো। শত চেষ্টা করেও সমাধানের কোনো সহজ উপায় সে ভেবে পায় না।

আততায়ী কে তার খোঁজ নেই, নিহত তরুণীটির কোনো পরিচয় জানা নেই, পুলিশ—বিভাগ যথাসাধ্য চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে মৃতার পরিচয় জানতে…

শিখার মনে হ’ল, এরকম সমস্যামূলক তদন্ত—ভার এর আগে আর কখনও পায়নি সে। কি ভাবে, কোন পথে অগ্রসর হওয়া যায়, সেই বিষয়টাই হয়ে উঠলো তার প্রথম চিন্তনীয়।

সে তখন অ্যাংলো—ইণ্ডিয়ান সম্প্রদায়ের কথা চিন্তা করতে আরম্ভ করলো। তার মনে হ’ল যে, সারা ভারতে অ্যাংলো—ইণ্ডিয়ান খুব বেশী নেই। কলকাতা, বোম্বে প্রভৃতি কয়েকটা বড় বড় সহর এবং কিছু শিল্পপ্রধান নগরী ছাড়া অন্যত্র এই সম্প্রদায়ের নর—নারীকে বড় একটা দেখতে পাওয়া যায় না। এইসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার মনে পড়লো রবিনসনের কথা।

রবিনসনের বাবা চট্টগ্রামে মিলিটারী—বিভাগে চাকরি করতেন, আর সেখান থেকেই তাঁদের পরিবারের সঙ্গে শিখার পরিচয় হয়। রবিনসন ছিল শিখার চাইতে বয়সে কিছু বড়। বছর কয়েক আগে রবিনসনের বাবা পেন্সন নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। কলকাতায় একবার শিখার দেখাও হয়েছিল রবিনসনের সঙ্গে। সে—সময় রবিনসন তাকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেছিল তাদের বাড়ীতে যেতে। তাদের বাড়ীর ঠিকানাটাও দিয়েছিল, কিন্তু নানা কাজের ঝঞ্ঝাটে শিখা আর যেতে পারেনি সেখানে।

শিখার মনে পড়লো যে, রবিনসনের ঠিকানাটা সে তার ডায়েরীতে লিখে রেখেছিল। ডায়েরী লেখা ছিল শিখার বহুদিনের অভ্যাস, তাছাড়া পুরোনো ডায়েরীগুলো ফেলেও দিতো না সে। বছর শেষ হলে আগের সনের ডায়েরী আলমারীর মাথায় তুলে রাখে সে।

রবিনসনের কথা মনে হ’তেই শিখা ভাবলে যে, রবিনসনকে দিয়ে কিছু সুবিধা হ’তেও পারে এই তদন্তের ব্যাপারে, কারণ নিহত তরুণীটিকে সে হয়তো চিনতেও পারে। এই কথা মনে হতেই সে লাফ দিয়ে খাটের উপর দাঁড়িয়ে উঠে আলমারীর মাথা থেকে পুরোনো ডায়েরীগুলো টেনে বার করতে লাগলো। অল্প একটু খোঁজ করতেই গত বছরের ডায়েরীখানা পেয়ে গেল সে। ডায়েরীর পাতা উল্টে সে দেখতে পেলো যে, এক জায়গায় রবিনসনের ঠিকানাটা লেখা আছে—

মিঃ টি, আর, রবিনসন

……রিপন ষ্ট্রীট, কলিকাতা।

ঠিকানাটা নোট—বইতে টুকে নিয়ে শিখা মনে মনে ঠিক করলো যে, কাল সকালেই সে যাবে রবিনসনের সঙ্গে দেখা করতে।

 * * *

নোট—বইতে লেখা ঠিকানামতো রিপন ষ্ট্রীটের সেই বাড়ীতে যেতেই শিখা দেখতে পেলো যে, একটি প্রৌঢ়া মহিলা নীচের বারান্দার উপরে একখানা ইজিচেয়ারে বসে উল নিয়ে কি যেন বুনছেন।

অনেক দিন পরে দেখলেও শিখার চিনতে অসুবিধা হ’ল না যে, ঐ মহিলাই রবিনসনের মা মিসেস্ পিটারসন। কিন্তু সে চিনলেও মিসেস্ পিটারসন তাকে চিনতে পারলেন না। তাই তিনি ইংরেজীতে জিজ্ঞাসা করলেন—কাকে খুঁজছো বাছা?

শিখা বললো—আমাকে আপনি চিনতে পারছেন না মিসেস্ পিটারসন? আমি শিখা—অগ্নিশিখা রায়, মেজর রায়ের ভাইঝি!

পরিচয় দিতেই মিসেস্ পিটারসন চিনতে পারলেন শিখাকে। তিনি তখন খুশী হয়ে বললেন—তুমিই সেই ছোট্ট ওগনিশিখা! কত বড়টি হয়েছো তুমি আজ! বসো মা, ঐ চেয়ারখানায় বসো।

শিখা বসলে মিসেস্ পিটারসন কাকে যেন ডাকতে লাগলেন—নেলা! নেলা! শীগগির এদিকে এসো। দেখে যাও কে এসেছে!

একটি আঠারো—উনিশ বছরের সুশ্রী তরুণী ছুটতে ছুটতে এসে শিখাকে দেখে আশ্চর্য্য হয়ে বললো—ইনি কে, মা?

মিসেস্ পিটারসন বললেন—সে কি নেলা! শিখাকে চিনতে পারছো না তুমি, চট্টগ্রামের সেই ওগনিশিখা!

এতক্ষণে চিনতে পারলো নেলা।

শিখার দিকে তাকিয়ে মিসেস্ পিটারসন বললেন—আমার ছোট মেয়ে নেলাকে মনে আছে তো শিখা?

শিখা আশ্চর্য্য হয়ে গেল নেলাকে দেখে। চট্টগ্রামের সেই ছোট্ট ফ্রকপরা মেয়েটি আজ সতেরো—আঠারো বছরের সুন্দরী তরুণী!

নেলা হাত বাড়িয়ে দিল শিখার দিকে।

শিখা দাঁড়িয়ে উঠে নেলার সঙ্গে করমর্দ্দন না করে তাকে ছোট বোনের মতো বুকের ভিতরে টেনে নিয়ে আদর করে বললো—কত বড়টি হয়েছো তুমি নেলা!

নেলা বললো—তুমিও তো কত বদলে গেছ!

এরপর বহু কথা হ’ল তার নেলার সঙ্গে। কথায় কথায় শিখা জেনে নিল যে, নেলার বাবা মিঃ পিটারসন মারা গেছেন। রবিনসন এখন চাকরি করছে আসানসোল রেলওয়ে ওয়ার্কশপ—এ। সেখানে সে অ্যাসিস্ট্যাণ্ট ফোরম্যান হয়েছে।

শিখার খবরও জেনে নিল নেলা। সে আশ্চর্য্য হয়ে গেল, যখন সে শুনলো যে, শিখা ডিটেকটিভ হয়েছে।

সে তখন তার মাকে ডেকে বললো—জানো মা, আমার এই শিখাদিদি হচ্ছেন সেই মহিলা—ডিটেকটিভ—যাঁর সম্বন্ধে কাগজে খবর বেরিয়েছিল কিছুদিন আগে।

মিসেস্ পিটারসন বললেন—সত্যি নাকি শিখা?

শিখা বললো—হ্যাঁ, মিসেস্ পিটারসন।

এর কিছুক্ষণ পরে দোতলার ঘরে বসে চা খেতে খেতে শিখা নেলাকে সেই নিহত অ্যাংলো—ইণ্ডিয়ান তরুণীটির কথা বলে অনুরোধ করলো—এই ব্যাপারে আমাকে একটু সাহায্য করবে?

নেলা বললো—কি ভাবে সাহায্য করবো, বলো?

—বিশেষ কিছু করতে হবে না তোমাকে, তুমি শুধু ঐ নিহত তরুণীটির পরিচয় জানতে চেষ্টা করবে! কি করে করবে সে—কথাও বলে দিচ্ছি তোমাকে। তুমি তোমার বন্ধু—বান্ধব সবারই সঙ্গে কথায় কথায় ঐ মৃতা তরুণীটির কথা তুলবে। তারপর জানতে চেষ্টা করবে যে, কেউ তাকে চেনে কি না? আমার মনে হয়, তোমাদের সমাজের কেউ না কেউ নিশ্চয়ই মেয়েটিকে চিনতে পারবে।

নেলা বললো—আমারও তাই মনে হয়। আচ্ছা, আমি কাল থেকেই চেষ্টা করবো খবরটা জানতে। কিন্তু…

—কিন্তু কি নেলা?

—আমি ভাবছি, মেয়েটির একখানা ফটো থাকলে ভাল হ’ত আমার কাছে।

—বেশ, ফটো আমি আজই এনে দেবো তোমাকে।

—তোমাকে একটা অনুরোধ করবো শিখা?

—কি অনুরোধ নেলা?

—আমাকে তুমি তোমার সহকারিণী করে নাও না! আমার খুব ইচ্ছা হয়, তোমার মতো গোয়েন্দাগিরি করতে।

—তুমি কি পারবে এসব কাজ? এ—কাজে প্রাণের ভয় সব সময় আছে!

—তা আমি জানি শিখা, কিন্তু প্রাণের ভয় আমি করি না। তুমি শুধু কথা দাও যে, আমাকে তুমি তোমার সহকারিণী করে নেবে।

শিখা বললো—বেশ! কালই আমি তোমাকে সঙ্গে করে ডিটেকটিভ ডিপার্টমেণ্টে নিয়ে গিয়ে আমার সহকারিণী বলে পরিচিত করে দেব ডেপুটি কমিশনারের সঙ্গে। তাছাড়া একটা রিভলভারও তোমাকে দেবার ব্যবস্থা করে দেব। কাল সকাল দশটার সময় তৈরি হয়ে থেকো তুমি,—কেমন?

চার – ফিরপো হোটেলে

পরদিন বেলা দশটার সময় নেলাকে সঙ্গে করে লালবাজার পুলিশ—অফিসে নিয়ে গিয়ে মিঃ মিত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় শিখা। তারপর মিঃ মিত্রের কাছ থেকে একখানা পরিচয়পত্র, একটা রিভলভার, মৃত অ্যাংলো—ইণ্ডিয়ান মেয়েটির একখানা ফটো ও কিছু টাকা নেলার হাতে দিয়ে সে বললো—তুমি তাহলে আজ থেকেই কাজে লেগে যাও,—কেমন?

—তাতো বুঝলাম, কিন্তু কিভাবে কাজ আরম্ভ করবো, সে—সম্বন্ধে…

নেলার কথায় বাধা দিয়ে শিখা বললো—সে—সব নির্দ্দেশ তুমি আমার কাছ থেকে যথাসময়েই পাবে। তবে কখন, কি ভাবে আর কার হাত দিয়ে যে নির্দ্দেশ পাবে, তার কিছু ঠিক নেই। এমনও হ’তে পারে যে, আমি নিজেই ছদ্মবেশে যাবো তোমার কাছে। কি ছদ্মবেশে যাবো, সে—কথাও আগে থেকে বলা সম্ভব নয়; কাজেই ছদ্মবেশেও আমাকে যাতে চিনতে পারো, তার জন্য একটা গোপন প্রতীক—চিহ্ন ধারণ করবো আমি। প্রতীক—চিহ্নটি হচ্ছে দুটো সেফটিপিন গুণচিহ্নের মতো করে আমার পোষাকের কোনো—না—কোনো জায়গায় লাগানো থাকবে। ঐ প্রতীক—চিহ্ন দেখলেই বুঝতে পারবে যে, সে আমি ছাড়া আর কেউ নয়। তাছাড়া, তুমি যেন ভুলেও আমার বাড়ীতে যেও না। কারণ, তোমার মতো মেম—সাহেবকে বাঙালীর বাড়ীতে আনাগোনা করতে দেখলে প্রতিপক্ষ সাবধান হ’তে পারে। মনে রেখো, আমরা তাদের না চিনলেও, বা তাদের কোনো খোঁজ—খবর না জানলেও তারা সব সময়ই আমাদের গতিবিধির উপর লক্ষ্য রাখছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, মেয়েটিকে যারা হত্যা করেছিল, তারা এতক্ষণ নিশ্চয়ই খবর পেয়েছে যে, আমি এই মামলার তদন্তভার হাতে নিয়েছি। তাছাড়া…

এই পর্য্যন্ত বলেই হঠাৎ থেমে গেল শিখা।

নেলা বললো—তাছাড়া কি বলছিলে?

—আমার বিশ্বাস ঐ দলের কোনো না কোনো লোক নিশ্চয়ই কলকাতায় আছে।

—এ রকম বিশ্বাসের কারণ?

—কারণ আছে বৈকি নেলা। আমার মনে হয় ওরা নিশ্চয়ই জানতে চেষ্টা করবে, পুলিশ এ ব্যাপারে কতদূর কি করতে পেরেছে। অবশ্য খুনটা যদি কোনো আনাড়ী লোকের দ্বারা হয়ে থাকে তাহলে হয়তো সে দূরে পালিয়ে থাকাই শ্রেয় মনে করবে, কিন্তু যদি এই ঘটনার পেছনে কোনো গভীরতর রহস্য বা আরও কোনো অপরাধের সূত্র থেকে থাকে কিংবা এই হত্যাকাণ্ডটা যদি কোনো বিশেষ লোকের বা দলের সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড হয়ে থাকে, তাহলে তারা অবশ্যই পুলিশের তদন্তের ওপর তীক্ষ্ন দৃষ্টি রাখবে। আর তারা যদি চালাক হয়, তাহলে আমি যে এই ব্যাপারের তদন্ত করছি সেটাও তারা জানতে পারবে। সুতরাং তুমি যে আমার সহকারী ভাবে কাজ করছো এ কথাটা গোপন থাকাই ভাল।

এই পর্য্যন্ত বলে একটু চুপ করে থেকে শিখা আবার বললো—আচ্ছা, আজ এই পর্য্যন্তই থাক, আবার দেখা হবে সময় মতো, এখন আসি, কেমন?

এই বলেই শিখা বিদায় নিয়ে চলে গেল নেলার কাছ থেকে।

 * * * *

নেলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শিখা সোজা চলে গেল এক নামকরা ইংরেজ দর্জীর দোকানে। সেখানে গিয়ে সে তার গায়ের মাপে কয়েকটা গাউন, স্কার্ট, পেটিকোট, কোট এবং অ্যাংলো—ইণ্ডিয়ান মেয়েদের ব্যবহার্য্য আরও কয়েক রকম পোষাক তৈরি করতে অর্ডার দিল। দোকানের ইংরেজ ম্যানেজার কিছুটা আশ্চর্য্য হলেও কোনো কথা না বলে অর্ডার বই বের করে মাপ—জোকগুলো লিখে নিতে আরম্ভ করলেন।

মাপ নেওয়া হয়ে গেলে তিনি বললেন—আপনার নাম?

শিখা বললো—যে কোনো অ্যাংলো—ইণ্ডিয়ান মেয়ের নাম লিখে নিন মিষ্টার।

—সে কি বলছেন মিস্! যা—তা একটা নাম কি করে লিখি অর্ডার বইতে?

শিখা তখন তার ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে তার নামের কার্ডখানা বের করে ম্যানেজারের হাতে দিয়ে বললো—আশা করি এবারে আমাকে চিনতে পেরেছেন নিশ্চয়?

‘মিস্ অগ্নিশিখা রায়’, এই নামটা দেখেই ম্যানেজার বুঝতে পারলেন যে, মিস্ রায় কোনো কারণে অ্যাংলো—ইণ্ডিয়ান মেয়ের ছদ্মবেশ ধারণ করতে চান।

তিনি তখন চুপি চুপি বললেন—বেশ! অর্ডারটা তাহলে ”মিস্ এ, পি, হিপোলেট” নামে বুক করছি আমি। কিন্তু দেখবেন—ডেলিভারী নেবার সময় যেন নাম ভুল করবেন না!

শিখা হেসে বললো—না, ভুল হবে না। তাছাড়া ডেলিভারী নিতে যে আসবে, তার হাতে তো আপনাদের দোকানের রসিদই থাকবে।

—তবুও আমাদের সাবধান হওয়া ভাল মিস্ রায়।

এই বলেই তাড়াতাড়ি অর্ডার ফর্ম্মে মিস্ এ, পি, হিপোলেট, ২৮ নং ইলিয়ট লেন, কলিকাতা—এই নামে কয়েক রকম জামার নাম ও দাম লিখে সেগুলোর অর্ডার বুক করা হলো বলে লিখে শিখার হাতে দিয়ে ম্যানেজার বললেন—আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুবই খুশী হলাম মিস্ রায়।

শিখা বললো—আমিও খুশী হয়েছি মিষ্টার…

”ডিক্রুজ—আমার নাম মিঃ ও, সি, ডিক্রুজ।”

শিখা বললো—ধন্যবাদ মিঃ ডিক্রুজ। আবার দেখা হবে।

এর দু’ দিন পরের কথা।

হঠাৎ নেলার কাছ থেকে টেলিফোন আসায় শিখা বললো—

—কি খবর নেলা? কিছু জানতে পারলে?

—পেরেছি শিখা। রাত্রি আটটার সময় ফিরপোতে এসো তুমি, টেলিফোনে এসব কথা বলতে চাইনে আমি।

 * * * *

রাত্রি আটটায় ফিরপো রেষ্টুরেণ্টের একখানি টেবিলের সামনে বসে অধীর ভাবে এদিক—ওদিক চাইছিল নেলা। হোটেলের সার্ভিস—বয় দু’বার এসে দাঁড়ালো তার টেবিলের সামনে, কিন্তু নেলা তাকে ”থোরা বাদ আও” বলে বিদায় করে দিয়ে একবার দরজার দিকে আর একবার ঘড়ির দিকে তাকাতে লাগলো।

রাত ঠিক আটটা। কিন্তু তখনও শিখার দেখা নেই।

শিখার পরিবর্ত্তে একটি তেইশ—চব্বিশ বৎসরের সুন্দরী অ্যাংলো—ইণ্ডিয়ান তরুণী এসে তার টেবিলের সামনেকার দ্বিতীয় চেয়ারখানায় বসে পড়লো।

নেলা বিরক্ত হয়ে বললো—আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে দয়া করে অন্য টেবিলে বসলে ভাল হয়।

নবাগতা তরুণীটি হেসে বললো—কেন বলুন তো? আপনি কি এনগেজড?

নেলা বিরক্ত হ’ল মেয়েটির কথা শুনে। সে বললো—বেশ! আপনিই তাহালে বসুন, আমি অন্য টেবিলে যাচ্ছি।

নবাগতা বললো—আহ—হা বসুন না। আপনার সঙ্গে আলাপ করতে ইচ্ছে হচ্ছে আমার।

নেলা বললো—আপনি তো বড্ড নাছোড়—বান্দা দেখছি। বলছি আমার সঙ্গে অন্য লোক আছে তবুও আপনি ছাড়বেন না আমাকে?

—না, আপনাকে আমি ছাড়বো না। আপনি চালাক হতে পারেন, কিন্তু আমাদের চোখে আপনি ধূলো দিতে পারেননি, গোয়েন্দাগিরিতে এখনও আপনি বড্ড কাঁচা।

—তার মানে? কি বলতে চান আপনি?

—বলতে চাই, আপনার রিভলভারটা পোষাকের ভিতর থেকে উঁচু হয়ে রয়েছে!

নেলা তাড়াতাড়ি তার জামার দিকে তাকিয়ে দেখলো, কিন্তু কোথাও জামা উঁচু না দেখতে পেয়ে কর্কশকণ্ঠে বললো—কে তুমি?

নবাগতা মেয়েটি হেসে উঠে বললো—চিনতে পারলে না তো নেলা? ভাল করে দেখ দেখি!

খুব আস্তে কথাগুলো বলেই জামার কলারটা উল্টে ধরলো সে। নেলা আশ্চর্য্য হয়ে লক্ষ্য করলো, সেখানে দুটি সেফটিপিন গুণ—চিহ্নের মতো আঁটা।

নেলা অস্ফুট কণ্ঠে বললো—শিখা!

—চুপ! শিখা নয়। মিস্ স্কট।

এই সময় হেটেলের বয় আর একবার ওখানে আসায় নেলা বললো—দো লাঞ্চ!

বয় চলে গেলে শিখা জিজ্ঞাসা করলো—কি জানতে পেরেছো নেলা?

নেলা নিম্নকণ্ঠে বললো—তোমার কাছ থেকে এই কাজের ভার নেবার পর আমি বহু জায়গায় বহু লোকের কাছে ঐ কথা বলি। ফটোও দেখাই অনেককে, কিন্তু কেউই আমাকে কিছু বলতে পারে না। প্রায় হতাশ হয়ে পড়েছিলাম, এই সময় দাদা হঠাৎ বাড়ীতে আসে দু’দিনের ছুটি পেয়ে। তাকে অবশ্য কোনো কথাই বলিনি আমি এই ব্যাপারে, কিন্তু আজ বিকেলের ট্রেনে সে ফিরে যাবার সময় গাড়ীতে বসে যখন তার সঙ্গে কথা বলছিলাম সেই সময় কি একটা দরকারে ভ্যানিটি ব্যাগটা খুলতেই সেই ফটোখানা বেরিয়ে পড়ে।

—তারপর?

—ফটোখানা দেখে সে যেন অবাক হয়ে যায়। আমাকে জিজ্ঞাসা করে, ”ও ফটো তোমার কাছে কি করে এলো?”

—তারপর?

—ঠিক সেই সময় গাড়ী ছাড়বার ঘণ্টা পড়ে। আমি তাড়াতাড়ি নেমে যেতে যেতে জিজ্ঞাসা করি যে ঐ মেয়েটিকে সে চেনে কি না?

—তার উত্তরে তোমার দাদা কি বললে?

—গাড়ী তখন চলতে সুরু করেছে। দাদা শুধু বললো যে মেয়েটিকে সে ভালভাবেই চেনে।

—তারপর?

—তারপর আর কোনো কথা হয়নি তার সঙ্গে। ট্রেন তখন বেশ জোরে চলতে আরম্ভ করেছে।

পাঁচ – ছদ্মবেশিনী

আসানসোল জংশন। ইষ্টার্ণ রেলওয়ের এটা একটা বিশিষ্ট স্টেশন। রেলওয়ের একটি বড় কারখানা আছে এখানে। সেই কারখানাতেই অ্যাসিষ্ট্যাণ্ট ফোরম্যানের কাজ করে রবিনসন। স্টেশনের কাছেই একটা সুন্দর বাংলোতে থাকে সে।

যেদিনের কথা হচ্ছে সেদিন বিকেল প্রায় পাঁচটার সময় একখানি আপ গাড়ীর কামরা থেকে আসানসোল প্ল্যাটফর্ম্মে নেমে পড়লো একটি অ্যাংলো—ইণ্ডিয়ান তরুণী। তরুণীটিকে দেখলে বাইশ—তেইশ বছরের বেশী মনে হয় না। তার পরণে হালকা নীল রঙের গাউন। পায়ে গোলাপী রঙের রেশমী মোজা গায়ের রঙের সঙ্গে যেন মিশে গেছে। মুখখানা বেশ সুন্দর। তরুণীটির হাতে একটা এটাচি—কেস ছাড়া আর কিছুই ছিল না।

প্ল্যাটফর্ম্ম থেকে বাইরে আসবার সময় সে টিকিট—কালেক্টারকে ইংরেজীতে জিজ্ঞাসা করে—এখানে মিঃ টি. আর. রবিনসন কোথায় থাকেন বলতে পারেন? অ্যাসিষ্ট্যাণ্ট ফোরম্যান?

টিকিট—কালেক্টার বললো—নিশ্চয় পারি মিস্। তিনি রেলওয়ে বাংলোতে থাকেন। আপনি বাইরে গিয়ে যে—কোনো সাইকেল—রিক্সাওয়ালাকে ডেকে মিঃ রবিনসনের নাম বললেই সে আপনাকে নিয়ে যাবে।

তরুণীটি তখন টিকিট—কালেক্টারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাইরে এসে একখানা সাইকেল—রিক্সায় উঠে বসে ভাঙা ভাঙা হিন্দীতে বললো—রবিনসন সাবকো বাংলোমে লে চলো।

তরুণীটি যখন মিঃ রবিনসনের বাংলোর সামনে গিয়ে রিক্সা থেকে নামলো, মিঃ রবিনসন তখন বাংলোর সামনের বারান্দায় সিগারেট খেতে খেতে পায়চারী করছিলো।

একটি অচেনা তরুণীকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে সে আশ্চর্য্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলো—কাকে চান আপনি?

তরুণীটি বললো—আমি কি মিঃ রবিনসনের সঙ্গেই কথা বলছি?

—হ্যাঁ, আমিই মিঃ রবিনসন। কি দরকার আপনার বলুন?

তরুণীটি দরকারের কথা না বলে সোজা—বারান্দায় উঠে গিয়ে রবিনসনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে নিতান্ত অন্তরঙ্গভাবে বললো—কেমন আছ রবিন?

—ভাল আছি। কিন্তু আপনি কে, তা’ ঠিক বুঝতে পারলাম না তো?

এই বলে রবিন আর একবার তরুণীটির মুখের দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখলো। বোধ হয় চিনতে চেষ্টা করলো সে। কিন্তু কোথায় দেখেছে বা আদৌ দেখেছে কিনা, একথা একেবারেই স্মরণ করতে পারলো না।

তার এই দ্বিধাগ্রস্ত ভাব দেখে তরুণীটি হেসে বললো—আমাকে চিনতে পারছো না তো? অথচ আমি তোমার সঙ্গে নিতান্ত চেনাশুনা আত্মীয়ের মতো কথা বলছি, তাই না?

—কতকটা তাই বটে।

রবিনসনের এই কথায় তরুণীটি হেসে বললো—এখনই চিনতে পারবে, ভিতরে চলো, সবই বলছি।

 * * * *

ভিতরে গিয়ে তরুণীটির মুখে তার পরিচয় শুনে রবিনসন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বললো—তুমি মিস্ অগ্নিশিখা রায়! আরে বাবা! তোমাকে বাঙালী বলে চেনে কার সাধ্য! তা হঠাৎ এখানে? এ বেশে?

—সবই বলছি রবিন, আগে বলো তোমার খবর কি? তোমাদের বাড়ীতে যে আমি গিয়েছিলাম, তা তো আমার এখানে আসা দেখেই বুঝতে পেরেছো।

—তা পেরেছি। কিন্তু আমার আর কি খবর! বাবা মারা যাবার পর কিছুদিন খুবই দুঃখে—কষ্টে কেটেছিল আমাদের। তারপর এই চাকরীটা পেয়ে যাহোক একরকম চলে যাচ্ছে। কিন্তু তোমার ব্যাপার কি বলো তো?

—বলছি। আমি তোমার কাছে একটা তদন্তের ব্যাপারে এসেছি রবিন।

—তদন্তের ব্যাপারে! তুমি? আই সি! তাহলে তুমিই সেই স্বনামধন্যা মহিলা—গোয়েন্দা মিস্ রায়?

শিখা হেসে বললো—স্বনামধন্যা না ছাই। এই তো সবে হাতে খড়ি।

—হাতে খড়ি না হাতে রিভলভার? কোনটা? হেসে বললে রবিনসন।

শিখাও আর একবার হেসে উঠলো তার কথায়। বললো—দুটোই।

—কিন্তু আমার কাছে হঠাৎ বাঙলার অদ্বিতীয়া মহিলা—গোয়েন্দার আগমন, ব্যাপারটা যে বড়ই গোলমেলে লাগছে শিখা? আমি তো জ্ঞানতঃ এমন কোনো অপকর্ম্ম করেছি বলে মনে হয় না, যার জন্য ডিটেকটিভ—বিশেষ করে মহিলা—ডিটেকটিভ আসতে পারে আমার কাছে!

—গোয়েন্দারা কি কেবল অপরাধীদের বাড়ীতেই যায় নাকি রবিন? যাই হোক, এবারে শোনো কি জন্য আমি এসেছি তোমার কাছে।

রবিনসন বললো—দাঁড়াও। তার আগে তোমার চায়ের ব্যবস্থাটা করে দিই। এই বলেই সু—উচ্চ গম্ভীর স্বরে ডাকলো—খা—ন—সা—মা!

সাহেবের ডাক শুনে এক উর্দীপরা খানসামা সেই ঘরে প্রবেশ করে সেলাম দিয়ে বললো—হুজুর?

—দো পেয়ালা চা ঔর খানা লে আও।

চা খেতে খেতে কথা হচ্ছিলো দু’জনের মধ্যে।

শিখা বললো—তাহলে তুমি বলতে চাও যে মেয়েটি কলকাতায় থাকতো না?

—আমি তো তাই জানি। ওর বাবা পলাশগড় স্টেটে চাকরি নিয়ে চলে যায় চার বছর আগে। মেয়েটির নাম মিস্ রোজী।

—কিন্তু তুমি ওদের চিনলে কি করে?

—তোমার এ প্রশ্নের অর্থ?

—অর্থ এই যে তুমি চিনলে অথচ নেলা বা তোমার মা চিনলেন না মেয়েটিকে, এটা একটু আশ্চর্য্য মনে হচ্ছে আমার কাছে।

রবিনসন হেসে উঠে বললো—ও, এই ব্যাপার? তা ওরা কি করে চিনবে? রোজীর ভাই আমার সহপাঠী ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে, তাই মাঝে মাঝে আমি ওদের বাড়ীতে যেতাম আর সেই উপলক্ষেই রোজীর সঙ্গে আমার পরিচয়ও হয়েছিল।

—তার সেই ভাই এখন কোথায়?

—সঠিক বলতে পারি না, তবে সে যে মিলিটারিতে চাকরি করে তা আমি জানি।

—ওরা কলকাতায় কোথায় ছিল?

—একটা বাঙালী পাড়ায়। যুদ্ধের সময় সাহেব পাড়ায় বাড়ী না পেয়ে ওরা টালীগঞ্জে একখানা বাড়ী ভাড়া করে ছিল।

—যুদ্ধের সময়! তাহলে কি ওরা আগে থেকে কলকাতায় থাকতো না?

—না। তবে আগে ওরা কোথায় থাকতো তা আমি ঠিক জানি না।

—কিন্তু তুমি পুলিশের কাছে মেয়েটির পরিচয় জানিয়ে চিঠি লেখনি কেন?

—কারণ, প্রথমতঃ আমি খবরের কাগজে ফটোখানা দেখিনি, আর দ্বিতীয়তঃ কে ইচ্ছে করে পুলিশ—হাঙ্গামায় জড়িয়ে পড়তে চায় বলো? পুলিশের কাছে চিঠি লিখলেই তো নানান কৈফিয়ৎ—কে যায় অতো সব হাঙ্গামায়!

—কিন্তু এক্ষেত্রে তোমার কি নাগরিক কর্ত্তব্য পালনে অবহেলা করা হচ্ছে না রবিন?

—তা হয়তো হচ্ছে, কিন্তু সবদিক ভেবে দেখলে তুমি নিশ্চয়ই স্বীকার করবে যে, সব সময়ই মানুষ চায় শান্তিতে বাস করতে। অকারণে ঝঞ্ঝাট টেনে আনতে কেউই চায় না।

শিখা বললো—তা সত্যি। আচ্ছা, এখন তাহলে আমি উঠি রবিন! আমাকে আবার রাত্রের ট্রেনেই কলকাতায় ফিরতে হবে। ভাল কথা, হাওড়া যাবার পরবর্ত্তী ট্রেন ক’টায় বলতে পারো?

রবিনসন আশ্চর্য্য হয়ে বললো—সে কি শিখা! এতদিন পরে তোমার সঙ্গে দেখা, তাছাড়া আমার বাড়ীতে এসে ভাল করে না খেয়েই তুমি চলে যাবে, এ কিছুতেই হতে পারে না। আজ তোমাকে এখানেই থাকতে হবে। আশা করি, এখানে থাকতে তোমার আপত্তি হবে না।

শিখা হেসে বললো—বেশ তো, না হয় থেকেই যাবো আজ রাতটা, কিন্তু কাল সকালেই আমাকে চলে যেতে হবে, তা মনে থাকে যেন।

রবিনসন বললো—সত্যি শিখা, তোমাকে বাঙ্গালী বলে মনেই হচ্ছে না। কেবলই মনে হচ্ছে, তুমি আমাদেরই সম্প্রদায়ের একজন।

শিখা বললো—আমিও তোমাকে নিজের ভাইয়ের মতোই মনে করি রবিন।

ছয় – মিঃ পোর্টারের খোঁজে

—হ্যাল্লো নেল! কেমন চলছে কাজকর্ম্ম?

নেলা আশ্চর্য্য হয়ে বলে—তুমি কি আজই ফিরলে নাকি আসানসোল থেকে?

শিখা একটানা চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে বললো—আজই নয় নেলা, এইমাত্র। স্টেশন থেকেই সোজা আমি তোমার কাছে চলে এসেছি।

—খবর পেয়েছো?

—অনেক খবর পেয়েছি, আর সেই জন্যই তো তোমার কাছে এলাম। রবিন বললে যে মেয়েটির নাম ছিল রোজী। ওর বাবা মিঃ উইলিয়াম পোর্টার পলাশগড় স্টেটে চাকরি করেন।

—কিন্তু দাদা ওদের চিনলেন কি করে?

—সে কথাও আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম। মেয়েটির ভাই তোমার দাদার সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়তো, সেই সূত্রেই ওদের সঙ্গে তার জানাশুনা।

—তুমি এখন কি করতে চাও তাহলে?

—আমি এখন পলাশগড়ে যাবো ভাবছি।

নেলা বললো—পলাশগড়ে যাবে কেন?

—রোজীর বাবা মিঃ পোর্টারের উপর নজর রাখতে চাই আমি।

নেলা বললো—মাই গড, তুমি কি তাহলে তাঁকেই হত্যাকারী ভেবেছো নাকি?

শিখা বললো—না, তবে তাঁর ব্যবহারটা সুবিধাজনক বলে মনে হচ্ছে না।

—কেন?

—কারণ একমাত্র মেয়ে মারা গেল ভদ্রলোকের, অথচ তিনি পুলিশে খবর দিলেন না, বা পুলিশ থেকে যখন মেয়েটির ফটো কাগজে বের হ’ল তখনও কিছু জানালেন না, এটা সন্দেহজনক নয় কি?

নেলা ভেবে দেখলো যে শিখার কথাই সত্যি। মিঃ পোর্টারের এই ভাবে চুপ করে থাকবার কেনো অর্থই খুঁজে পাওয়া যায় না।

নেলা তখন জিজ্ঞাসা করলো—ওখানে যেয়ে কি ভাবে কাজ করবে বলে ঠিক করেছো?

—সে কথা আগে থেকে কি করে বলি! তবে ওখানে যেয়ে আমি যে সে—রাজ্যের ইনসপেক্টার—জেনারেল অব পুলিশ—এর সাহায্য নেব, একথা ঠিক!

—আমাকে তুমি সঙ্গে নেবে শিখা?

—এখন না। তবে তুমি তৈরী থেকো, আমার কাছ থেকে টেলিগ্রাম পেলে সেইভাবে কাজ করো তুমি। টেলিগ্রাম করবো, কিন্তু পুলিশ বিভাগের সাঙ্কেতিক ভাষায়।

—সাঙ্কেতিক টেলিগ্রাম আমি বুঝব কি করে?

—অতি সহজেই। লালবাজার ডিটেকটিভ ডিপার্টমেণ্টে গিয়ে ডেপুটি কমিশনার মিঃ মিত্রের সঙ্গে দেখা করে টেলিগ্রামখানা তাঁর হাতে দিলেই তিনি বুঝিয়ে দেবেন।

নেলা বললো—তুমি এই বেশেই যাবে নাকি?

শিখা বললো—হ্যাঁ। অবশ্য শাড়ি—ব্লাউজও থাকবে আমার সঙ্গে, কিন্তু বাঙালী বেশে আমি যেতে চাই না।

—কারণ?

—কারণ ওখানকার আই. জি. অব পুলিশ ইংরেজ। আমি সোজা তাঁর বাড়ীতে গিয়েই উঠবো। অবশ্য যাবার আগে কলকাতা পুলিশ থেকে তাঁর কাছে একখানা টেলিগ্রাম পাঠিয়ে যাবো।

—কবে যেতে চাও?

—আজই রাত্রের ট্রেনে। কিন্তু তার আগে বাড়ী থেকে আমার বিছানা আর বড় সুটকেসটা নিয়ে আসা দরকার। আমি রতনকে ফোন করছি যাতে সে এক ঘন্টার মধ্যেই বিছানা আর সুটকেস নিয়ে এখানে চলে আসে। তাকেও আমি সঙ্গে নিয়ে যাবো।

—রতন কে? জিজ্ঞাসা করলো নেলা।

শিখা হেসে বললো—রতন আমার চাকর, কিন্তু চাকর হলেও সে আমার ছোট ভাইয়ের চাইতেও বেশী। তাকে চট্টগ্রামে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম।

—কুড়িয়ে পেয়েছিলে?

—অনেকটা তাই। ছেলেটি আমাদের বাড়ীতে চাকরের কাজ করতো। ওখানে ও আমাকে একটা সাঙ্ঘাতিক বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে সাহায্য করে। সেই থেকেই ও আমার সঙ্গে আছে।*

নেলা বললো—আচ্ছা, ওসব কথা পরে শোনা যাবে। ‘ট্রেন জার্ণি’ করে এসেছো, খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই? তুমি একটু বসো, আমি তোমার খাওয়ার ব্যবস্থা করে আসছি।

নেলা উঠে যেতেই শিখা পাশের ঘরে গিয়ে রতনকে টেলিফোন করে বললো যে, সে যেন একঘণ্টার মধ্যেই তার বড় সুটকেসটা আর বিছানা নিয়ে নেলাদের বাড়ীতে আসে। নেলাদের বাড়ীর নম্বরটাও জানিয়ে দেয় শিখা।

সাত – পলাশগড় রাজ্যে

পলাশগড়।

উত্তর—ভারতের একটি দেশীয় রাজ্য।

এই পলাশগড়েই যাচ্ছিল শিখা। ট্রেনের ফার্ষ্ট—ক্লাশ কামরায় বার্থ রিজার্ভ করে চলেছিল সে। বার্থ রিজার্ভেশন—কার্ডে অবশ্য নাম লেখা ছিল—’মিস্ ইসাবেল ডি সুজা’। রতন চলেছিল চাকরদের জন্য নির্দ্দিষ্ট কামরায়।

অনেকগুলো জংশন স্টেশন পার হয়ে দু’বার গাড়ী বদল করে তেত্রিশ ঘণ্টা পরে পলাশগড় স্টেশনে পৌঁছুলো শিখা।

স্টেশনে গাড়ী থামতেই রতন নেমে এসে মেমসাহেবের বিছানা—সুটকেস গাড়ী থেকে নামিয়ে ফেললো।

স্টেশনটা খুবই ছোট। ওখান থেকে পলাশগড় স্টেটের রাজধানী প্রায় পাঁচ মাইল দূরে। ঐ স্টেশনে ফার্ষ্ট—ক্লাশের যাত্রী বড়—একটা নামে না কোনোদিন। অবশ্য মহারাজ বা রাজ—পরিবারের লোকেরা এবং উচ্চপদস্থ সরকারী কর্ম্মচারীরা যেদিন আসেন, সেদিনের কথা আলাদা।

তাই স্টেশন—মাস্টার যখন দেখলেন যে, একজন মেমসাহেব নামছেন ফার্ষ্ট—ক্লাশ থেকে, তখন তিনি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে শিখাকে অভিবাদন জানিয়ে বললেন—সুপ্রভাত মেমসাহেব, আমি এখানকার স্টেশন—মাস্টার। আপনি কোথায় যাবেন বলুন? আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

শিখা জিজ্ঞাসা করলো—রাজধানী এখান থেকে কতদূর?

স্টেশন—মাস্টার বললেন—রাজধানী এখান থেকে অনেক দূর! এ জায়গাটা বড্ড নির্জ্জন। যাত্রী বিশেষ হয় না। তাই গাড়ী—ঘোড়াও পাওয়া যায় না। তা—আপনি কোথায় যাবেন?

শিখা বললো—আমি এখানকার ইনসপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ মিঃ জোন্সের বাড়ীতে যাবো।

—ও, মিঃ জোন্সের বাড়ী! আমি এখুনি সমস্ত বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি। কাছাকাছিই একটা পুলিশ—স্টেশন আছে। আমি খবর পাঠাচ্ছি সেখানে, যাতে একখানা গাড়ী পাওয়া যায়। হাজার হোক আপনি মিঃ জোন্সের আত্মীয় তো বটে! আপনি ততক্ষণ ফার্ষ্ট—ক্লাশ ওয়েটিং—রুমে বিশ্রাম করুন।

শিখা হেসে বললো—আপনার ব্যস্ত হবার দরকার নেই। বেশ, আমি ওখানেই অপেক্ষা করছি।

এই বলেই রতনের দিকে তাকিয়ে সে হিন্দীতে বললো—তুমি যাও তো মাষ্টার—সাহেবের সঙ্গে। ওয়েটিং রুমটার চাবি নিয়ে এসো।

স্টেশন—মাস্টার বললেন—চাবি আমার সঙ্গেই আছে, এই নিন।

ওয়েটিং—রুমে বসে শিখা বললো—দ্যাখতো রতন, স্টেশন—মাস্টার গেছে কি না?

রতন বাইরে গিয়ে দেখে এসে বললো—গেছে দিদিমণি!

শিখা বললো—যাক, বাঁচা গেল! কিন্তু গাড়ীর ব্যবস্থা ও করতে পারবে কি?

—পারবে বলেই তো মনে হয়। দেখাই যাক না ঘণ্টাখানেক বসে। এই তো সবে সকাল! নইলে হেঁটেই যাওয়া যাবে।

হেঁটে যেতে অবশ্য হ’ল না ওদের। আধঘণ্টার মধ্যেই থানার দারোগাবাবু কোথা থেকে এক আধ—ভাঙা ‘সেভ্রোলেট’ গাড়ী জোগাড় করে নিয়ে এসে বললেন—আপনি আসুন মিস্! অনেক কষ্টে গাড়ী জোগাড় করে এনেছি আপনার জন্যে।

 * * *

কলকাতা পুলিশের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেণ্টের ডেপুটি—কমিশনারের কাছ থেকে মিঃ জোন্স আগেই জানতে পেরেছিলেন যে, মেয়ে—গোয়েন্দা মিস্ শিখা রায় তাঁর কাছে যাচ্ছেন। কিন্তু সে যে একেবারে মেমসাহেব সেজে এসে হাজির হবে, এতটা তিনি আশা করেননি।

শিখা নিজের পরিচয় দিতেই মিঃ জোন্স উৎফুল্ল হয়ে বললেন—প্রথমেই আমি প্রশংসা করছি আপনার নিখুঁত ছদ্মবেশের। আমি নিজে ইংরেজ হয়েও আপনাকে বাঙালী মেয়ে বলে ধরতে পারিনি।

এরপর থেকেই শুরু হয়ে গেল দু’জনের মধ্যে আলোচনা।

শিখা বললো—মিঃ পোর্টার বলে কোনো অ্যাংলো—ইণ্ডিয়ান ভদ্রলোক এখানে চাকরী করেন কি?

মিঃ জোন্স বললেন—আগে করতেন, এখন করেন না।

—তাই নাকি? এখন তিনি কোথায় আছেন, জানেন?

—জানি। তিনি বিলাসপুর স্টেটের চীফ সেক্রেটারী হয়ে চলে গেছেন।

—কতদিন আগে?

—তা প্রায় বছর দেড়েক হবে।

শিখা বললো—তাহলে দেখছি, আজই আবার বিলাসপুর স্টেটে রওনা হ’তে হচ্ছে। আপনি দয়া করে ওখানে কোনো ইংরেজ অফিসারের নামে আমার সম্বন্ধে একটু পরিচয়—পত্র যদি লিখে দেন, তাহলে বড়ই উপকার হয়। অ্যাংলো—ইণ্ডিয়ান মেয়ের ছদ্মবেশে আমাকে অবশ্যই কোনো অ্যাংলো—ইণ্ডিয়ান বা ইংরেজের বাড়ীতে উঠতে হবে।

মিঃ জোন্স বললেন—সে—ব্যবস্থা হবে, আপনি সেজন্য ব্যস্ত হবেন না। কিন্তু আমি ভাবছি এখানকার একটা গুরুতর অথচ অতি গোপনীয় তদন্তে আপনার সাহায্য নেবার কথা।

—এখানে আবার কি হয়েছে মিঃ জোন্স?

মিঃ জোন্স নিম্নস্বরে বললেন—এখানকার মহারাজার কোনো—খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না!

—তাই নাকি! কবে থেকে?

মিঃ জোন্স বললেন—তা প্রায় মাসখানেক আগে থেকে।

আট – নিরুদ্দিষ্ট মহারাজা

রতনকে শিখা ছুটি দিয়েছিল কয়েক ঘণ্টার জন্য। নতুন জায়গায় রাস্তাঘাট এবং আরও টুকিটাকি জ্ঞাতব্য বিষয় জেনে নিতে বলে দিয়েছিল শিখা রতনকে।

রতন চলে যাবার পর মিঃ জোন্স বললেন—আপনি যদি ইচ্ছা করেন তাহলে আমার সঙ্গে আমার অফিসেও যেতে পারেন। শিখাও তাতে রাজী হয়। সে তাড়াতাড়ি স্নান সেরে কিছু খেয়ে নিয়ে মিঃ জোন্সের গাড়ীতেই তাঁর অফিসে গেল।

সাহেবের সঙ্গে একজন তরুণী মেমসাহেবকে দেখে অফিসের অনেকেই মনে করলো যে, মেয়েটি হয়তো মিঃ জোন্সের কোনো আত্মীয়া।

আই. জি.—র অফিসটা ছিল যেমন সুরক্ষিত, তেমনই গোপনীয় কথা বলবার এবং শোনবার অতি উপযুক্ত স্থান।

মিঃ জোন্স আধঘণ্টার মধ্যে অফিসের কাজকর্ম্ম সম্বন্ধে একে—তাকে ডেকে কয়েকটা নির্দ্দেশ দিয়ে আর্দ্দালীকে বলে দিলেন যে, তিনি না ডাকা অবধি তাঁর কামরায় যেন কেউ না আসে।

এরপর পাইপ ধরিয়ে টানতে টানতে মিঃ জোন্স বলতে লাগলেন মহারাজার নিরুদ্দেশের কাহিনী :

আপনি হয়তো জানেন না মিস্ রায় যে, মহারাজা দেনায় একেবারে মাথা পর্যন্ত ডুবে আছেন। ব্যক্তিগত চরিত্রও তাঁর খুব ভাল ছিল না বলেই জানি। আমি যা খবর সংগ্রহ করতে পেরেছি, তাতে জানতে পারি যে, মহারাজ যেদিন নিরুদ্দেশ হন, তার আগের দিন বিকেলে একখানা টেলিগ্রাম আসে তাঁর নামে। টেলিগ্রামখানা কোথা থেকে এসেছিল বা কে করেছিল, কিছুই জানতে পারা যায়নি। টেলিগ্রাফ অফিসে খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম, কিন্তু সেখান থেকে শুনলাম যে, ওখানকার কোনো লোকই বলতে পারে না কি টেলিগ্রাম এসেছিল। টেলিগ্রামের কেরাণী বললো যে, মহারাজার নামে একটা টেলিগ্রাম এসেছিল বটে, তবে বোম্বে, কি কলকাতা, কি মাদ্রাজ থেকে, সে স্মরণ করতে পারছে না। সুতরাং ওদিক দিয়ে কিছুই করতে না পেরে খোঁজ করতে একজন ডিটেকটিভ ইনস্পেক্টারকে পাঠাই। সেও বিশেষ কিছু খবর আনতে পারে না। তবে সে একটা কথা জানায় যে, মহারাজা নাকি কিছুদিন আগে কলকাতার এক মাড়োয়ারী মহাজনের কাছ থেকে পঁচিশ লক্ষ টাকা ধার নেবার ব্যবস্থা করেছিলেন। এ ছাড়া আরও একটা খবর অবশ্য সে দেয়, তবে তার সঙ্গে মহারাজার নিরুদ্দেশ হবার ব্যাপারে কোনো সংস্রব থাকতে পারে না।

শিখা জিজ্ঞাসা করলো—কি বলুন তো?

—ও একটা বিয়ের ব্যাপার।

—বিয়ের ব্যাপার! সে আবার কি?

—ব্যাপারটা হচ্ছে এই যে, আমাদের মহারাজা যুবক এবং এখনও অবিবাহিত। তাই বিজয়পুর স্টেটের রাজকুমারীর সঙ্গে ওঁর বিয়ের একটা কথা হয়েছিল।

—তারপর?

—বিজয়পুরের মহারাজা নাকি জানতে পারেন যে, আমাদের মহারাজার অনেক দেনা। তাই তিনি বলেন যে, মহারাজা যদি তাঁর দেনা পরিশোধ করেছেন, এইরকম দলিলপত্র দেখাতে পারেন, তবেই তিনি তাঁর সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবেন, নইলে নয়।

—বিজয়পুর তো খুবই বড় স্টেট! তাই নয় কি?

—হ্যাঁ, তা বড় বৈকি! তাছাড়া রাজকুমারীর বিয়েতে যে যৌতুক দেওয়া হবে, তার মূল্যও তিন কোটি টাকার কম নয়।

—রাজকুমারী দেখতে কেমন?

—অপূর্ব্ব সুন্দরী!

—তাহলে তো এক লোভনীয় প্রস্তাব মহারাজার পক্ষে।

—তা লোভনীয় বৈকি! আর ঐ জন্যই তো তিনি গোপনে গোপনে ধার করতে চেষ্টা করছিলেন।

—কেন?

—উদ্দেশ্য ছিল যে, একটা জায়গা থেকে গোপনে ধার করে সেই টাকা দিয়ে খুচরো দেনাগুলো মিটিয়ে ফেলে তিনি দেনা শোধের দলিলপত্র বিজয়পুরের মহারাজকে দেখাবেন। আমি খবর পেয়েছি যে, এক মাড়োয়ারী মহাজনের সঙ্গে মহারাজার ব্যবস্থা হয়েছিল যে, তিনি যে টাকা ধার নেবেন, তার কোনো দলিল থাকবে না। এই দেখ, কি বলতে কি সব বলে চলেছি! যাই হোক, আমার ধারণা হয়েছিল যে, মহারাজা বোধ হয় সেই মাড়োয়ারী ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করে টাকার ব্যবস্থা করতেই কাউকে কিছু না বলে কলকাতা গেছেন। কিন্তু কলকাতার সেই মাড়োয়ারীর কাছে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি যে, মহারাজা নাকি তাঁর সঙ্গে দেখাই করেননি, যদিও তাঁর দেখা করবার কথা ছিল মাসখানেক আগে। এই খবরটা জানতে পেরেই আমরা ভয়ানক চিন্তিত হয়ে পড়ি। কিন্তু ব্যাপারটা এতই গোপনীয় যে, প্রকাশ করাও মুস্কিল! আজ যদি হঠাৎ খবরটা প্রকাশ হয়ে পড়ে যে মহারাজা নিরুদ্দেশ, তাহলে রাজ্যে একটা হুলুস্থুল পড়ে যাবে। তাছাড়া তিনি হয়তো ইচ্ছা করেই কোথাও আত্মগোপন করে আছেন। তাই আমিও ‘অফিসিয়্যালি’ তিনি যে ‘নিরুদ্দিষ্ট’, এ কথা বলতে পারছি না। কিন্তু আমার মন বলছে যে, তাঁর এই অনুপস্থিতির মধ্যে কোনো গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে।

শিখা বললো—আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন মিঃ জোন্স! আমারও মনে হয় ব্যাপারটা গভীর রহস্যে আবৃত। কিন্তু এখন আপনি কি করতে চান?

—আমার ইচ্ছা আপনি এই ব্যাপারটার তদন্তভার গ্রহণ করেন।

—কিন্তু আমি যে………..

—ওটা কিছুদিন পরে হলেও চলবে মিস্ রায়। তা ছাড়া কোথাকার কোন এক অ্যাংলো—ইণ্ডিয়ান মেয়ে মারা গেল, সে খবর বার করবার চাইতে এটা অনেক বেশী মূল্যবান মিস্ রায়!

শিখা বললো—কিন্তু সে মেয়েটিও কোথাকার কে এক অ্যাংলো—ইণ্ডিয়ান মেয়ে নয় মিঃ জোন্স। আপনি হয়তো শুনলে আশ্চর্য্য হবেন যে, মেয়েটির বাবার নাম মিঃ পোর্টার—যিনি এখন বিলাসপুর স্টেটের চীফ সেক্রেটারী।

শিখার মুখে এই কথা শুনে মিঃ জোন্স যেন আকাশ থেকে পড়লেন। তিনি বললেন—বলেন কি মিস্ রায়! তাহলে তো ব্যাপারটা বেশ ঘোরালো বলে মনে হচ্ছে!

—ঘোরালো মনে হচ্ছে কেন মিঃ জোন্স?

—কারণ, মিঃ পোর্টারের মেয়ের সঙ্গে আমাদের মহারাজ চন্দন সিংয়ের গোপন ভালবাসার কথা কারুরই অবিদিত নয়।

শিখা চেয়ারে সোজা হয়ে বসে বললো—তাই নাকি মিঃ জোন্স! তাহলে আপনি বরং একটা কাজ করুন।

—কি?

—মহারাজা কবে সেই টেলিগ্রামখানা পেয়েছিলেন, তার সঠিক তারিখটা জেনে আমাকে বলুন।

আই. জি. বললেন—সে আমি এখুনি বলে দিচ্ছি—এই বলে টেলিফোন তুলে কোনো এক অফিসারের সঙ্গে সংযোগ চাইলেন। সংযোগ পাওয়ামাত্র মিঃ জোন্স বললেন—মহারাজা কোন তারিখে টেলিগ্রামটা পেয়েছিলেন, বলুন তো?

টেলিফোনের অন্য প্রান্ত থেকে একটু পরেই উত্তর পান তিনি।

এরপর টেলিফোনটা রেখে দিয়ে তিনি শিখাকে বলেন—পেয়েছি! সেটা হচ্ছে তেরই আগষ্ট।

শিখা তখন তাড়াতাড়ি একখানা কাগজ টেনে নিয়ে মিঃ মিত্রকে লিখলো—

কলকাতার সি. টি. ও. এবং প্রত্যেক টেলিগ্রাফ—অফিসে খোঁজ নিন, গত ১২ই কি ১৩ই আগষ্ট তারিখে পলাশগড়ের মহারাজা চন্দন সিংয়ের নামে কেউ কোনো টেলিগ্রাম করেছেন কি না।

 —মিস্ রায়

কাগজখানা মিঃ জোন্সের সামনে এগিয়ে দিয়ে শিখা বললো—এই টেলিগ্রামখানা পুলিশের সাঙ্কেতিক ভাষায় এখনই পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করুন।

টেলিগ্রামের খসড়াটা পড়ে দেখে মিঃ জোন্স বললেন—আপনার কি তাহলে ধারণা যে, মিস্ রোজীর মৃত্যুর সঙ্গে মহারাজার নিরুদ্দেশ হওয়ার কোনোরকম সম্পর্ক আছে?

—আপনার এ প্রশ্নের উত্তর এখনই দিতে পারছি না মিঃ জোন্স! টেলিগ্রামের উত্তরটা না আসা পর্য্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

মিঃ জোন্স বললেন—বেশ, আমি তাহলে পাঠিয়ে দিচ্ছি টেলিগ্রামখানা। কিন্তু উত্তরটা কোন ঠিকানায় আসবে, লিখলেন না তো?

শিখা বললো—ওঃ! ভুল হয়ে গেছে। আমার নামের নীচে ‘কেয়ার অব আই. জি. অব পলাশগড়’ লিখে দিন। আর—হ্যাঁ—আরও একখানা টেলিগ্রাম ঐ সঙ্গে পাঠাতে চাই—সেটাকেও সাঙ্কেতিক ভাষায় পরিবর্ত্তিত করে দিতে হবে।

এই বলেই শিখা আরও একখানা টেলিগ্রামের মুশাবিদা করে মিঃ জোন্সের হাতে দিল। এই টেলিগ্রামটা করা হ’ল মিস্ নেলার নামে। তাকে নির্দ্দেশ দেওয়া হ’ল, টেলিগ্রাম পাওয়ামাত্রই সে যেন বিলাসপুর স্টেটে রওনা হয়ে যায় এবং তার দাদার পরিচয় দিয়ে মিঃ পোর্টারের বাড়ীতে ওঠে, আর ওখানে যে—কোনো খবর সে জোগাড় করবে, তা যেন শিখাকে জানিয়ে দিতে চেষ্টা করে।

টেলিগ্রাম দু’খানা আধঘণ্টার মধ্যেই চলে গেল পলাশপুর থেকে।

নয় – ৬৭ নং পার্ক এভিনিউ

পরদিন থেকেই ঘটনার গতি নাটকীয় ভাবে পরিবর্ত্তিত হতে থাকে। মিঃ মিত্রের কাছ থেকে এক গোপন টেলিগ্রামে শিখা জানতে পারে যে, মহারাজার নামে টেলিগ্রাম করেছিল মিস্ রোজী।

কলিকাতা, সি. টি. ও.—র টেলিগ্রামের ফাইলগুলো থেকেই এ—কথাটি জানতে পেরেছিলেন তিনি। টেলিগ্রামে কি লেখা হয়েছিল, সেই কথাগুলোও হুবহু টুকে নিয়েছিলেন তিনি।

টেলিগ্রামে লেখা হয়েছিল—

”আমি এখন এখানে চাকরী করছি। ৬৭ নং পার্ক এভিনিউতে দোতলার ৫ নং ফ্ল্যাটে একা আছি। আপনি কিছুদিন এখানে থেকে গেলে খুশি হবো। কাউকে না জানিয়ে গোপনে আসবেন।

—রোজী।”

শিখার বুদ্ধিতে টেলিগ্রামখানা এইভাবে উদ্ধার হওয়ায় ডেপুটি কমিশনার মিঃ মিত্র খুবই খুশী হলেন। শিখাকে অভিনন্দন ও যথাযোগ্য অনুরোধ জানিয়ে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে কলকাতায় তদন্ত—ভার তিনি নিজ হাতে গ্রহণ করলেন।

৬৭ নং পার্ক এভিনিউতে খোঁজ নিতে গিয়ে তিনি জানতে পারলেন যে, ঐ বাড়ীটার মালিক এক বাঙালী ভদ্রলোক। বৌবাজার ষ্ট্রীটে একটা জুয়েলারী দোকান আছে তার। বাড়ীটা সে কিনেছিল পাকিস্তানগামী এক ধনী মুসলমানের কাছ থেকে।

বাড়ীর মালিকের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা গেল যে, মিস্ রোজী নামে একটি তরুণীর পক্ষে মিঃ পোর্টার ঐ ফ্ল্যাটটা ভাড়া করেন। ছ’ মাসের ভাড়ার টাকা অগ্রিম জমা দেওয়ায় ওদের সম্বন্ধে আর কোনো খোঁজ—খবর নেওয়া দরকার বোধ করেনি সে। তাছাড়া ভাড়াটেদের সম্বন্ধে খোঁজ—খবর সে নিতেও চায় না, তার মাস গেলে ভাড়ার টাকাটা পেলেই হ’ল। ‘মেয়েটি যে ও—বাড়ীতে নেই, সে কথা সে জানে কি না?’—এই প্রশ্নের উত্তরে বাড়ীওয়ালা জানায় যে, সে তা জানে। কিন্তু জানলে কি হবে, ওরা যখন বাড়ী ছেড়ে দিয়ে গেছে, তখন আর ও নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ কি?

—বাড়ী ছেড়ে দিয়ে গেছে মানে? জিজ্ঞাসা করেন ডেপুটি কমিশনার।

—মানে, আজ থেকে প্রায় মাসখানেক আগে মেয়েটির সঙ্গের সেই প্রৌঢ় ভদ্রলোক—বোধ হয় মেয়েটির বাবা হবেন তিনি; হঠাৎ একদিন দারোয়ানকে বলেন যে, সেই রাত্রেই ওঁরা বাড়ী ছেড়ে চলে যাবেন।

—তারপর?

—তারপর থেকেই ওঁরা চলে গেছেন।

—কিন্তু আপনি কি জানেন যে, সেই মেয়েটি খুন হয়েছে?

ডেপুটি কমিশনারের এই কথায় বাড়ীওয়ালা দুই চোখ কপালে তুলে বললো—অ্যাঁ, খুন হয়েছে! কোথায়? আমার বাড়ীতে হলে তো জানতে পারতাম? যাক, বাড়ী থেকে বেরিয়ে গিয়ে খুন হয়েছে, এই আমার ভাগ্যি ভাল!

মিঃ মিত্র একটু কৌতুক করবার লোভ সামলাতে পারলেন না। তিনি বললেন—যদি বলি, সে—রাত্রে আপনার বাড়ী ছেড়ে দেবার পর তার টাকা আর গহনার লোভে আপনিই তাকে গড়ের মাঠে—খুন করেছেন?

—আ…আ…আ…মি? কই না তো!

লোকটির চোখ দুটো কপালে উঠেই ছিল, এবারে মুখখানাও হাঁ হয়ে গেল বিস্ময়ে আর ভয়ে।

তার পা দু’খানাও থর থর করে কাঁপতে শুরু করেছে তখন।

লোকটির অবস্থা দেখে মিঃ মিত্রের দয়া হ’ল। তিনি বুঝতে পারলেন আর বেশী কিছু জিজ্ঞাসা করলে লোকটা হয়তো মূর্চ্ছা যাবে।

তিনি তখন লোকটাকে সাহস দিয়ে বললেন—না মশাই, আপনি খুন করেননি তা আমি জানতে পেরেছি; কিন্তু কে খুন করেছে, এই ব্যাপারটা জানতে চেষ্টা করছি আপনার কাছে।

—আ—মা—র কাছে? লোকটা এবার নীচু হয়ে মিঃ মিত্রের পা ছুঁতে যায়। বললো—দোহাই আপনার, আমি কিছুই জানিনে এই খুনের ব্যাপারে!

ডেপুটি কমিশনার হেসে বললেন—অতো ভয় পাচ্ছেন কেন বলুন তো? আমি জানতে চাই, ওরা যেদিন বাড়ী ছেড়ে চলে যায়, সেই দিন বা তার আগের দিন কে কে ছিল ঐ ফ্ল্যাটে?

ডেপুটি কমিশনারের এই কথায় কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে বাড়ীওয়ালা বললো—ও, তাই বলুন। কিন্তু স্যর, সে—খবর তো আমি বলতে পারবো না। দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলে হয়তো জানা যেতে পারে সে—কথা।

ঐ দিনই বিকালে দারোয়ানকে অফিসে ডাকিয়ে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করতে আরম্ভ করেন ডেপুটি কমিশনার। দারোয়ান বলে যে, বুড়ো সাহেব যে—রাত্রে চলে যান, সেই দিনই দুপুরে একজন সুন্দর চেহারার ভদ্রলোক ঐ ফ্ল্যাটে এসেছিলেন।

—ভদ্রলোক গেলেন কোথায়?

—তা আমি বলতে পারবো না হুজুর! আমি তাঁকে চলে যেতে দেখিনি।

—কিন্তু সেই বুড়ো সাহেব আর মেমসাহেব যখন চলে যান, তখন তুমি দেখেছিলে কি?

—না হুজুর, আমি তখন ঘরে খাচ্ছিলাম।

—তখন রাত ক’টা?

—তা হুজুর, প্রায় বারোটা হবে।

—অতো রাত পর্যন্ত গেটের দরজা খোলা রেখেছিলে কেন?

—রোজই থাকে হুজুর। সাহেব—সুবোরা থাকেন। রাত একটার আগে দরজা বন্ধ হলে তাঁরা রাগ করেন যে!

ডেপুটি কমিশনার তখন তাকে বিদায় দিয়ে সেই দিনই সব কথা সাঙ্কেতিক ভাষায় টেলিগ্রাম করে জানিয়ে দিলেন শিখাকে।

দশ – বিলাসপুর স্টেটে

বিলাসপুর রাজ্যের চীফ সেক্রেটারী মিঃ পোর্টার অফিস থেকে বাড়ীতে ফিরেই আশ্চর্য্য হয়ে গেলেন। তিনি দেখতে পেলেন যে, একটি বিশ—বাইশ বছর বয়সের সুশ্রী অ্যাংলো—ইণ্ডিয়ান তরুণী তাঁর বসবার ঘরে বসে অপেক্ষা করছে।

মেয়েটিকে দেখে বিরক্ত হয়ে তিনি তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন—কে তুমি? কাকে চাও এখানে?

মেয়েটি বললো—আমার নাম নেলা। ট্রেনে বোম্বে যাচ্ছিলাম, কিন্তু গত রাত্রে আমার এ্যাটাচি—কেসটা ট্রেন থেকে চুরি হয়ে যাওয়ায় একেবারে নিঃস্ব অবস্থায় নেমে পড়ি এখানে। আমার হাতে এখন একটি পয়সাও নেই।

—তা এখানে এলে কেন?

—আপনি অ্যাংলো—ইণ্ডিয়ান জেনে। স্টেশনের লোকদের কাছে আমি জিজ্ঞাসা করি যে, এখানে কোনো অ্যাংলো—ইণ্ডিয়ান বা ইংরেজ পরিবার আছেন কি না; তাঁরাই আমাকে আপনার নাম বলেন। তাছাড়া আপনার নাম শুনে আমার মনে হয় যে, আপনি আমাদের চেনা। তাই সোজা চলে এসেছি আপনার কাছে।

—আমাকে চেনা মনে হ’ল কেন?

—কারণ আমার দাদার মুখে আপনার নাম অনেকবার শুনেছি।

—তোমার দাদা! কে তোমার দাদা?

—আমার দাদার নাম রবিনসন—টি. আর. রবিনসন। সে আপনার ছেলের সঙ্গে একই শ্রেণীতে পড়তো ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে।

নেলার পরিচয় শুনবার পর মিঃ পোর্টারের মুখের ভাব কিছুটা নরম হ’ল। তিনি বললেন—কিন্তু বাছা, এখানে তো বেশীদিন থাকতে পারবে না তুমি! আমাকে হয়তো দু’একদিনের মধ্যেই বাইরে যেতে হবে।

—তাতে কোন অসুবিধা হবে না মিঃ পোর্টার। আমি দু’একদিনের মধ্যেই কলকাতায় টেলিগ্রাম করে টাকা আনিয়ে এখান থেকে চলে যাবো।

মিঃ পোর্টার বললেন—টেলিগ্রাম করবার দরকার কি? তোমার যা টাকার দরকার, আমিই দিয়ে দিচ্ছি। ইচ্ছে করলে কালই তুমি চলে যেতে পারো।

নেলা যেন খুবই খুশী হয়েছে, এই রকম ভাব দেখিয়ে বললো—আপনার এ উপকার চিরদিন মনে থাকবে মিঃ পোর্টার। আপনি যদি বলেন, তাহলে আজই আমি চলে যেতে রাজী আছি। বোম্বে যাওয়া আমার বিশেষ দরকার।

মিঃ পোর্টার বললেন—থাক, আজ আর যেয়ে কি হবে, তাছাড়া বোম্বে যাবার কোনো ট্রেনও আজ আর নেই। তুমি বরং কাল দুপুরের ট্রেনেই যেয়ো। আজ এখানেই থাকো তুমি।

এই কথা বলেই একটা চাকরকে ডেকে নেলার জন্য ‘মিসি বাবা’র ঘরখানা খুলে দিতে বললেন তিনি।

নেলার দিতে তাকিয়ে তিনি আবার বললেন—তুমি তাহলে বিশ্রাম করো গিয়ে, তোমার যখন যা দরকার, কলিং—বেল টিপে চাকরদের বললেই তা’ পাবে।

চাকরটি তখন নেলার দিকে তাকিয়ে বললো—আইয়ে মেমসাব!

যে ঘরখানাতে থাকতে দেওয়া হ’ল নেলাকে, সেখানা যে মিস্ রোজীর ঘর ছিল, এটা সে বুঝতে পারলো মিঃ পোর্টারের মুখের সেই ‘মিসি বাবা’র ঘর কথাটা শুনে। সে মনে মনে ভাবলো যে—’কাজটা ভালই হ’ল।’

ঘরে গিয়ে নেলা দেখতে পেলো যে, ওখানে আরামে বাস করবার মতো সব রকম ব্যবস্থাই আছে। একখানা স্প্রিংয়ের খাট, একটা টিপয়, একখানা লেখাপড়া করবার টেবিল আর একটা আলমারী আছে সেই ঘরে। তাছাড়া এক কোণে দুটো ষ্টীলের ট্রাঙ্কও দেখতে পেলো সে।

ঐ ঘরের ভিতর দিয়েই আর একখানা ঘরে যাওয়া যায়। সেই ঘরে ঢুকে নেলা বুঝতে পারলো যে, ওটা ছিল মিস্ রোজীর ‘ড্রেসিং—রুম’। ঐ ঘরে একটা ড্রেসিং টেবিল, একটা আলনা, জুতো সাজিয়ে রাখবার ‘সু—স্ট্যাণ্ড’ এবং একটা কম্বিনেশন আলমারী ছিল। ড্রেসিং টেবিলের উপর মেয়েদের প্রসাধনের যাবতীয় টয়লেট সামগ্রীও দেখতে পেলো সে।

ড্রেসিং—রুমের একপাশে বাথরুম। বাথরুমটাও আধুনিক ফ্যাশানে তৈরী। বাথ—টব, গরম ও ঠাণ্ডা জলের ট্যাপ, স্নানের জন্য ঝরণা—কল, আয়না, চিরুণি, তোয়ালে, সাবান ইত্যাদি সবই ওখানে মজুত ছিল।

নেলা তখন শোবার ঘরে এসে পোষাক বদলে বাথরুমে গিয়ে মনের আনন্দে স্নান করে নিল।

সারাদিন ‘ট্রেন জার্ণি’ করে সে খুবই ক্লান্ত হয়েছিল। স্নান করে প্রসাধন করবার পর আবার সজীবতা ফিরে পেলো।

স্নান করে আসবার পরই ভয়ানক খিদে পেয়ে গেল তার। সে দেখলো যে, এখানে ভদ্রতা না করে নিজের ব্যবস্থা নিজেই করে নেওয়া ভাল। তাছাড়া, তার যখন যা দরকার হবে কলিং—বেল টিপে চাকরদের বললেই পাওয়া যাবে, একথা তখন বলেই দিয়েছিলেন মিঃ পোর্টার।

কাজেই সে শোবার ঘরে এসে কলিং—বেলটা টিপতেই একজন চাকর এসে সেলাম করে দাঁড়ালো।

সে বললো—এক পেয়ালা চা আর কিছু খাবার নিয়ে এসো!

চাকরটি সেলাম জানিয়ে চলে গেল এবং মিনিট দশেকের মধ্যেই একখানা ট্রেতে করে এক পট চা, কিছু দুধ—চিনি আর কয়েকখানা টাটকা—ভাজা ফাউল কাটলেট আর কাঁটা—চামচে এনে টিপয়ের উপর নামিয়ে রেখে একখানা চেয়ার টেনে দিল তার পাশে।

নেলা কাঁটা—চামচে হাতে তুলে নিয়ে তাকে বললো—তুমি এখন যেতে পারো।

লোকটি চলে যাবার উপক্রম করতেই নেলা আবার বললো—বড় সাহেব এখন কোথায়?

সে জানায় মিঃ পোর্টার বাড়ী নেই, সম্ভবতঃ তিনি মহারাজের কাছে গেছেন।

কথাটা শেষ করে সে সেলাম জানিয়ে চলে গেল।

রাত্রে নেলার মনে হ’ল যে, মিস্ রোজীর বাক্সগুলো খুলতে পারলে হয়তো কোন না কোনো খবর পাওয়া গেলেও যেতে পারে। সে তখন চেষ্টা করতে লাগলো কি করে বাক্স দুটো খোলা যায়। তার কাছে এমন কোনো জিনিস ছিল না, যা দিয়ে বাক্সের তালা খোলা যায়। সে তখন ঘরের দরজা ভাল করে বন্ধ করে দিয়ে ঘরময় খোঁজাখুঁজি করতে আরম্ভ করলো। উদ্দেশ্য, এমন কিছু পাওয়া যায় কিনা যা দিয়ে তালা খোলা যায়। ভাগ্যক্রমে মিলেও গেল একটা জিনিস। ড্রেসিং—টেবিলের মধ্যে উল বুনবার দুটো ইস্পাতের কাঁটা পেয়ে গেল সে।

সে তখন একটা কাঁটা নিয়ে বাক্সের তালার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তালা খুলতে চেষ্টা করতে লাগলো। একটুখানি চেষ্টা করতেই খুলে গেল তালাটা। নেলা তখন বাক্সটা খুলে তার ভিতরকার জিনিসপত্র পরীক্ষা করে দেখতে লাগলো, কিন্তু সারা বাক্স তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কিছু সে পেলো না।

তারপর সে দ্বিতীয় বাক্সটি খুলে ফেললো ঐ একই উপায়ে। এই বাক্সটা খুলতেই সে দেখতে পেলো যে, তার মধ্যে আর একটা ছোট বাক্স রয়েছে। ছোট বাক্সটা বের করে সেটা খুলতেই সে তার ভিতরে এক বাণ্ডিল চিঠি দেখতে পেলো।

চিঠিগুলো সে এক এক করে পড়তে আরম্ভ করলো। হঠাৎ একখানা চিঠি পড়ে সে খুবই আশ্চর্য্য হয়ে গেল! চিঠিখানা মিস্ রোজীকে লিখেছিলেন পলাশগড়ের মহারাজা চন্দন সিং।

নেলা তখন সেই চিঠিখানাকে আলাদা করে রেখে বাকি চিঠিগুলো পড়তে লাগলো।

সবগুলো চিঠি পড়া হয়ে গেলে ও—থেকে চারখানা চিঠি সে বার করে নিয়ে বাকিগুলো আবার ঠিক আগের মতো অবস্থায় বাণ্ডিল বেঁধে রেখে বাক্সটা যেভাবে ছিল, সেইভাবে বন্ধ করে রাখলো।

তারপর সেই চিঠি ক’খানাকে নিজের ভ্যানিটি ব্যাগের মধ্যে নিয়ে সেটাকে বালিশের তলায় রেখে শুয়ে পড়লো সে। শুয়ে শুয়ে স্থির করলো, কালকেই সে চলে যাবে শিখার কাছে।

এগারো – চন্দন সিংয়ের কি হ’ল?

ডেপুটি কমিশনারের কাছ থেকে বিস্তারিত টেলিগ্রাম পাবার পর থেকেই শিখার মনে হ’তে লাগলো যে, মহারাজ চন্দন সিংকে বোধ হয় হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু মহারাজার সঙ্গে মিস্ রোজীকে হত্যা করবার কি কারণ থাকতে পারে?

যদি মনে করা যায় যে রোজীর সঙ্গে মহারাজার অবৈধ প্রণয়ের কথা জানতে পেরেই ঐ চরম পন্থা অবলম্বন করেছিলেন মিঃ পোর্টার, কিন্তু তাও তো যুক্তিতে টেকে না।

আই. জি. মিঃ জোন্সের কথা যদি সত্য হয়, তাহলে তো মহারাজার সঙ্গে মিস্ রোজীর প্রণয়ের ব্যাপারটা মিঃ পোর্টারের অজানা ছিল না।

তাই সে কিছুতেই ভেবে ঠিক করতে পারে না হত্যার উদ্দেশ্য কি হ’তে পারে। উদ্দেশ্য ছাড়া কেউ কোনো হত্যা করে না—একমাত্র আকস্মিক উত্তেজনা ছাড়া। কিন্তু আকস্মিক উত্তেজনায় যে নরহত্যা হয়, তা কখনও বিষপ্রয়োগে হ’তে পারে না। বিষপ্রয়োগে হত্যা করার অর্থই হচ্ছে জেনে—শুনে এবং আগে থেকে প্ল্যান ঠিক করে হত্যা করা।

এখানেই শিখার যুক্তিবাদী মনে খটকা বাধছিল। যুক্তি কোথায়? কেন মিঃ পোর্টার তাঁর মেয়েকে হত্যা করবেন? তাছাড়া মহারাজ চন্দন সিংকেই বা কেন হত্যা করতে যাবেন তিনি?

এই দু’টি প্রশ্ন ছাড়া আরও কয়েকটা প্রশ্ন জাগে তার মনে। সেই প্রশ্নগুলোরও কোনো সমাধান খুঁজে পায় না সে।

প্রশ্নগুলো এই—

(ক) মহারাজ চন্দন সিংকে যদি হত্যাই করা হবে, তাহলে তাঁর মৃতদেহটা কোথায় গেল? কলকাতায় বা কলকাতার কাছাকাছি কোথাও মিস্ রোজীর মৃত্যুর পরে কোনো যুবকের মৃতদেহ পাওয়া যায়নি বলেই পুলিশ বলছে।

(খ) যদি হত্যা না করা হবে, তাহলে একটা জলজ্যান্ত মানুষকে কি করে গুম করা হ’ল কলকাতার ফ্ল্যাট বাড়ী থেকে? যদি ধরে নেওয়া যায় যে, মহারাজকে অচেতন অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তাহলেও প্রশ্ন থেকে যায় যে, অচেতন অবস্থায় একটা লোককে কলকাতার একখানা বাড়ী থেকে নিয়ে অন্য জায়গায় যাওয়া হ’ল, অথচ কেউ দেখলো না, কেউ সন্দেহ করলো না, এটা কি রকম? অবশ্য মহারাজাকে যদি কলকাতাতেই কয়েদ করে রাখা হয়, তাহলে আলাদা কথা।

এই সব প্রশ্নগুলো মনে মনে চিন্তা করে শিখার দুটো সন্দেহ মনে এলো। এক—মহারাজাকে হত্যা করে তাঁর মৃতদেহটা সুকৌশলে সরিয়ে ফেলা হয়েছে; দুই—তাঁকে কলকাতাতেই কোথাও কয়েদ করে রাখা হয়েছে।

তাছাড়া সত্যিই মহারাজা পার্ক এভিনিউয়ের সেই ফ্ল্যাট বাড়ীতে গিয়েছিলেন কি না, সেটাও জানা দরকার। শিখার মনে হয় মহারাজার একখানা ফটো ডেপুটি কমিশনারের কাছে পাঠানো উচিত, কারণ, তিনি তাহলে সেই ফটোখানা বাড়ীর দরোয়ানকে দেখিয়ে বুঝতে পারবেন মহারাজ ওখানে গিয়েছিলেন কি না।

শিখা যখন আই. জি. মিঃ জোন্সের বাড়ীতে তার জন্য নির্দ্দিষ্ট ঘরখানিতে বসে এই সব চিন্তায় ব্যস্ত, এই সময় রতন এসে প্রবেশ করল সেই ঘরে।

তাকে দেখে শিখা বললো—কি রে রতন? কিছু বলতে চাস?

রতন বললো—এটা কি রকম কাজ হচ্ছে দিদিমণি? এ রকম কাজ আমার ভাল লাগে না!

শিখা হেসে বললো—কেন বল তো?

রতন বললো—তা নয় তো কি? এবারকার কাজে একটুও মজা নেই। শত্রুর সঙ্গে দেখা নেই, বিপদ—আপদ কিছু নেই, এমন কি একটা যে গুলি ছুঁড়বো তারও উপায় নেই, এ কি আবার কাজ নাকি? তোমাকে তো দেখছি দিনরাত কেবল ভাবছো আর ভাবছোই, এত কি ভাবো বলো তো?

শিখা বললো—এক দিক দিয়ে তুই সত্যি কথাই বলেছিস রতন। এরকম কাজ আমার জীবনে এই প্রথম। এখানে শত্রুর সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে না, তাও ঠিক। কিন্তু এ বড় বুদ্ধির কাজ রে! একেই বলে সত্যিকারের গোয়েন্দাগিরি করা। শত্রুর দেখা বা খোঁজ পেলে তো অনেকেই তাদের পেছনে ধাওয়া করে যুদ্ধ করতে পারে, কিন্তু এ একেবারে আলাদা ব্যাপার।

রতন বললো—তা তুমি যাই বলো দিদিমণি, আমার কিন্তু ভাল লাগছে না এইভাবে চুপচাপ বসে থাকতে। আমাকেও একটা কিছু কাজটাজ দাও।

শিখা হেসে বললো—দেবো, তোকে আমি ঠিকই কাজ দেব, কিন্তু…আরে! নেলা! তুমি হঠাৎ এখানে?

নেলাকে দেখে শিখা একেবারে আশ্চর্য্য হয়ে যায়।

নেলা বলে—খুব দরকারি কথা আছে শিখা, আমি অনেক—কিছু জানতে পেরেছি।

 * * *

সেই রাত্রেই।

শিখা আর নেলা পাশাপাশি দু’খানা খাটে শুয়ে আলোচনা করছিল।

নেলা বললো—চিঠিগুলো পড়ে কি মনে হ’ল তোমার?

শিখা বললো—আমার সামনে থেকে অন্ধকারের পর্দ্দা খানিকটা সরে গেছে বলে মনে হচ্ছে চিঠিগুলো পড়ে। আমার এখন আর কোনোই সন্দেহ নেই যে, মহারাজ চন্দন সিংকে হত্যা করা হয়েছে, কিন্তু…

—কিন্তু কি শিখা?

—কিন্তু, আসল যে অপরাধী, তাকে আমরা কিছু করতে পারবো না।

—কেন?

—কারণ তার বিরুদ্ধে প্রমাণ করবার মতো কোনো কিছুই পাওয়া যাবে না। তবে, এ সবই আমার অনুমান! মহারাজ চন্দন সিংয়ের মৃতদেহ না পাওয়া গেলে কিছুতেই তাকে হত্যাকারী বলে সাব্যস্ত করতে পারছি না।

—এই চিঠিগুলোই কি যথেষ্ট প্রমাণ নয় শিখা?

—না নেলা, ওগুলো যথেষ্ট প্রমাণ নয়। ওগুলোর ওপর নির্ভর করে খানিকটা সূত্র পাওয়া যেতে পারে বটে, কিন্তু ঐ প্রমাণের বলে কোনো লোককে নরহত্যার অপরাধে অপরাধী বলে আদালত স্বীকার করবে না।

—তাহলে?

—সেই কথাটাই তো ভাবছি। আমি কালই এক্সপ্রেস ডাকে মহারাজার একখানা ফটো পাঠিয়ে দেব ডেপুটি কমিশনারের কাছে। আমি নিঃসন্দেহ হতে চাই যে, তিনি মিস্ রোজীর ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন।

বারো – পুলিশ তদন্তের ফলাফল

শিখার কাছ থেকে মহারাজার ফটোখানা পেয়েই ডেপুটি কমিশনার পার্ক এভিনিউয়ের সেই ফ্ল্যাট বাড়ীর দরোয়ানকে আবার ডেকে পাঠান এবং মহারাজার ফটোখানা তাকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করেন যে, ঐ লোককে সে চেনে কি না?

ফটোখানা দেখে দরোয়ান বলে যে, ঐ যুবকই মেমসাহেবের ফ্ল্যাটে এসেছিলেন সেদিন। যুবকটির কথা তার মনে আছে, কারণ তিনি এসেই তাকে একখানা দশ টাকার নোট বকশিস দিয়েছিলেন।

ডেপুটি কমিশনার জিজ্ঞাসা করলেন—ইনি কখন এসেছিলেন বলতে পারো?

—পারি হুজুর। বেলা দশটা সাড়ে দশটার সময় এসেছিলেন।

—ওঁর সঙ্গে তখন কোনো বিছানাপত্র বা সুটকেস ছিল কি?

—না হুজুর। ওঁর হাতে শুধু ছোট্ট একটা হ্যাণ্ডব্যাগ ছাড়া আর কিছু ছিল না।

—আচ্ছা, ওঁকে দেখে কি তোমার মনে হয়েছিল যে, উনি অনেক দূর থেকে এসেছেন?

—ঠিক বলেছেন হুজুর! আমার মনে হয়েছিল যে উনি বোধ হয় রেলগাড়ীতে করে অনেক দূর থেকে এসেছেন, কারণ রেলে এলে যেভাবে চোখ—মুখ শুকিয়ে যায়—চুল উস্কোখুস্কো হয়ে যায়, ওঁকেও সেই রকম দেখেছিলাম।

ডেপুটি কমিশনার তখন দরোয়ানকে বিদায় করে দিয়ে নানা কথা চিন্তা করতে লাগলেন!

প্রায় আধঘণ্টা চিন্তা করবার পর তিনি হঠাৎ সোজা হয়ে বসে কলিং—বেলটা টিপলেন।

সঙ্গে সঙ্গে একজন আর্দ্দালী এসে সেলাম করে দাঁড়াল তাঁর সামনে!

ডেপুটি কমিশনার বললেন—ইনসপেক্টার রজতবাবুকো সেলাম দো!

একটু পরেই রজতবাবু এসে নমস্কার করে দাঁড়াতেই ডেপুটি কমিশনার তাঁর টেবিলের উপরে রাখা মহারাজ চন্দন সিংয়ের ফটোখানা তাঁর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন—কোথায় কোনো অসনাক্ত মৃতদেহের ফটোর সঙ্গে এই লোকের চেহারার মিল খুঁজে পাওয়া যায় কিনা, দেখুন তো! ভারতের প্রত্যেক রাজ্যের পুলিশ—গেজেটগুলো ফাইল থেকে বার করে ১৩ই আগষ্টের পর থেকে আজ পর্য্যন্ত দেখে যান। খবরটা আমি আজই জানতে চাই।

 * * *

প্রায় ঘণ্টা দুই পরে রজতবাবু আবার এসে ঢুকলেন ডেপুটি কমিশনারের ঘরে। তাঁর হাতে একখানা পুলিশ—গেজেট আর কতকগুলো কাগজপত্র। ডেপুটি কমিশনার বললেন—কি খবর রজতবাবু?

—পেয়েছি স্যর! বোম্বের পুলিশ—গেজেটের ৭ই অক্টোবর তারিখের ‘পাবলিকেশন’—এ পাওয়া গেছে খবরটা—এই দেখুন!

এই বলেই রজতবাবু বোম্বের পুলিশ—গেজেটখানা খুলে ধরেন তাঁর সামনে।

ডেপুটি কমিশনার গেজেটখানা টেনে নিয়ে পড়তে পড়তে বললেন—কি ভয়ানক! কলকাতা থেকে প্যাকিং কেসে বন্ধ করে একটা মিথ্যা নাম—ঠিকানায় বোম্বে পাঠানো হয়েছিল মৃতদেহটাকে?

রজতবাবু বললেন—শুধু তাই নয় স্যর, বোম্বে—পুলিশ থেকে এই ব্যাপারে তদন্ত করবার অনুরোধ জানিয়ে যে রিপোর্ট পাঠিয়েছিল, সেই রিপোর্টও আমি নিয়ে এসেছি ফাইল থেকে। ও থেকে জানা যায় যে, লোকটিকে আর্সেনিক জাতীয় কোনো তীব্র বিষ ইনজেকশন করে হত্যা করা হয়েছিল। প্যাকিং বক্সের উপরে যে সব আঙুলের ছাপ পাওয়া যায়, সেগুলোর ফটোও ওখানকার পুলিশ পাঠিয়েছিল। তাছাড়া মৃতদেহের ফটো তো গেজেটেই ছেপে দিয়েছে ওরা।

রজতবাবুর কথা শুনে ডেপুটি কমিশনার খেঁকিয়ে উঠে বললেন—তা এতদিন ওটাকে ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল কেন, জানতে পারি কি?

রজতবাবু আমতা আমতা করে বললেন—না স্যর, মানে চাপা ঠিক দেওয়া হয়নি, তবে নরহত্যার এজাহার যেখানে নেই, তাছাড়া কোথাও থেকে কোনো উচ্চবাচ্য নেই, এমন কি উপরওয়ালা বা কোর্ট থেকেও কোনো নির্দ্দেশ নেই, সে অবস্থায় তদন্ত করতে একটু দেরীই হয়। তবে এই কেসের যে তদন্ত হয়নি, তা নয়। বোম্বে—পুলিশের সংবাদ থেকে জানা যায় যে প্যাকিং কেসটা বেণ্টিঙ্ক ষ্ট্রীট পার্শেল অফিস থেকে পাঠানো হয়। ওখানে খোঁজ নিয়ে জানা যায় যে, প্রেরক জনৈক হরিদাস পাল, ঠিকানা তেতাল্লিশ নম্বর ধর্ম্মতলা ষ্ট্রীট। কিন্তু ঐ ঠিকানায় খোঁজ নিয়ে জানা যায় যে, ওখানে ঐ নামের কোনো লোকই থাকে না।

ডেপুটি কমিশনার বললেন—আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি কাগজগুলো আমার কাছে রেখে যান।

রজতবাবু চলে যাবার পরই তিনি শিখার কাছে এক দীর্ঘ টেলিগ্রামে সব কিছু জানিয়ে তাকে অনুরোধ করেন বিলাসপুরে গিয়ে যে কোনো উপায়ে মিঃ পোর্টারের আঙুলের ছাপ জোগাড় করে পাঠাতে।

 * * * *

ডেপুটি কমিশনারের ঐ টেলিগ্রামখানা যখন শিখার কাছে আসে তখন নেলা তার পাশেই বসে ছিল। সাংকেতিক ভাষায় লেখা টেলিগ্রামটা পড়ে দেখে সে হঠাৎ বলে উঠলো—বিলাসপুর যাবার বোধ হয় প্রয়োজন হবে না শিখা।

—তার মানে?

—মানে, আমি ওখান থেকে আসবার সময় মিঃ পোর্টার আমাকে একখানা পরিচয়—পত্র লিখে দেন বোম্বে—প্রবাসী তাঁর এক বন্ধুর নামে। পরিচয়—পত্রখানা আমার সামনেই তিনি লিখেছিলেন তাঁর নিজস্ব চিঠির কাগজে। আমার মনে হয় ও থেকেই তাঁর আঙুলের ছাপ পাওয়া যাবে।

শিখা বললো,—তা হয়তো যাবে। তুমি তাহলে সেই চিঠিখানা বের করে নিয়ে এসো। আমরা এখনই যাবো মিঃ জোন্স—এর অফিসে। তাঁর সাহায্যে পুলিশ—অফিস থেকে আঙুলের ছাপের ফটো নিতে হবে ঐ চিঠির উপর থেকে।

তেরো – শিখার তৎপরতা

আধঘণ্টা পরের কথা।

শিখা আর নেলা মিঃ জোন্স—এর অফিসে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করলো।

শিখাকে দেখেই মিঃ জোন্স বলে উঠলেন—কি ব্যাপার মিস্ রায়? হঠাৎ এখানে! কোনো সূত্র আবিষ্কার করতে পেরেছেন না কি?

মিঃ জোন্স—এর এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শিখা ডেপুটি কমিশনারের সেই টেলিগ্রামখানা ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে বের করে তাঁর হাতে দিয়ে বললো—পড়ে দেখুন!

টেলিগ্রামখানা পড়ে দেখে মিঃ জোন্স বললেন—সাংঘাতিক ব্যাপার তো! কলকাতা থেকে মহারাজার মৃতদেহটা বাক্সবন্দী করে বোম্বে পাঠানো হয়েছিল! আশ্চর্য্য! আমাকে স্বীকার করতেই হচ্ছে যে হত্যাকারীর দূরদৃষ্টি অসাধারণ।

—ঠিকই বলেছেন মিঃ জোন্স। লোকটার দূরদৃষ্টি বেশী বলেই সেটা বোম্বে পর্য্যন্ত ধাওয়া করেছিল। কিন্তু সে যাই হোক, এখন আমার একটা কাজ যে করে দিতে হয়!

—কি কাজ মিস্ রায়?

—একটা আঙুলের ছাপের ফটো তুলে দিতে হবে।

—আঙুলের ছাপের ফটো! কার আঙুলের ছাপ?

—যাকে হত্যাকারী বলে সন্দেহ করছি।

—তার মানে! কে সেই মহাত্মা?

—মহাত্মাই বটে, তবে আঙুলের ছাপ মিলিয়ে না দেখা পর্য্যন্ত ও বিষয়ে সঠিকভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না।

—আঙুলের ছাপটা কি আপনার কাছেই আছে নাকি?

—তা আছে; তবে সেটা আছে অদৃশ্য অবস্থায়। একখানা চিঠির কাগজ থেকে সেই আঙুলের ছাপটাকে বের করে নিতে হবে। আশা করি এ কাজের জন্য বিশেষজ্ঞ ও যাবতীয় কেমিকেল আপনার ডিপার্টমেণ্টে আছে।

—তা আছে, তবে আঙুলের ছাপ মিলিয়ে দেখবার ব্যবস্থা আমাদের এখানে নেই। সারা ভারতে আঙুলের ছাপ মিলিয়ে অপরাধীর নামধাম জানবার ব্যবস্থা একমাত্র আপনাদের লালবাজার ছাড়া আর কোথাও নেই। লালবাজারের ‘ফিঙ্গার প্রিণ্ট ব্যুরো’তেই শুধু ও কাজ করা হয়।

—তা আমি জানি মিঃ জোন্স। ফটোটা নেওয়া হয়ে গেলে সেখানেই আমি পাঠিয়ে দেব।

—বেশ, কোথা থেকে আঙুলের ছাপের ফটো নেওয়া হবে বলুন!

”এই যে!” বলেই শিখা তার ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে নেলার জোগাড় করা মিঃ পোর্টারের সেই চিঠিখানা বের করে মিঃ জোন্স—এর হাতে দিল।

চিঠিখানা সন্তর্পণে শিখার হাত থেকে নিয়ে পড়ে দেখে মিঃ জোন্স আশ্চর্য্য হয়ে বললেন—এ যে দেখছি মিঃ পোর্টারের হাতের লেখা।

শিখা বললো—হ্যাঁ, মিঃ জোন্স। চিঠিখানা মিঃ পোর্টারই লিখেছিলেন।

—আপনি কি তাহলে মিঃ পোর্টারকেই সন্দেহ করেন?

—কার্য্য—কারণ সম্পর্ক যা, তাতে তাঁর উপরে একটু সন্দেহ হয় বৈকি!

—কি রকম?

মিঃ জোন্স—এর এই প্রশ্নে শিখা আগাগোড়া সব কথা তাঁর কাছে খুলে বললো। আরও বললো যে, বিজয়পুরের মহারাজার ঐ একমাত্র কন্যা ছাড়া আর কোনো উত্তরাধিকারী নেই। তাছাড়া বিজয়পুরের মহারাজা যে যৌতুক দিতে রাজী হন তার মূল্য প্রায় তিন কোটি টাকা। মহারাজ চন্দন সিং মনে করেছিলেন যে, বিজয়পুরের রাজকুমারীকে বিয়ে করে এক ঢিলে দুই পাখী মারবেন তিনি। বিয়েতে বিয়েও হবে আর যৌতুকের টাকায় দেনা শোধও হবে। এই সব ভেবে তিনি রীতিমতো উল্লসিত হয়ে ওঠেন। কিন্তু তাঁর এই আশায় ছাই পড়বার অবস্থা হয় বিলাসপুরের রাজার জন্য। বিলাসপুরের রাজাও এই রাজকুমারীকে বিয়ে করতে ইচ্ছা প্রকাশ করে বিজয়পুরের মহারাজার কাছে ব্যক্তিগত দূত পাঠান।

বিজয়পুরের মহারাজা কিন্তু বিলাসপুরের রাজার চাইতে পলাশগড়ের রাজা চন্দন সিংকেই বেশী পছন্দ করেন। কারণ বংশমর্যাদার দিক থেকে মহারাজ চন্দন সিং বিলাসপুরের রাজার চাইতে উঁচু। বিলাসপুরের দূতকে সে কথা তিনি জানিয়েও দেন। বিজয়পুরের মহারাজার কাছ থেকে এই—ভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়ে বিলাসপুরের মহারাজার জেদ চেপে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক।

এই পর্য্যন্ত শুনে মিঃ জোন্স বলেন—কিন্তু এর সঙ্গে মহারাজ চন্দন সিংয়ের হত্যাকাণ্ডের সম্বন্ধ কি থাকতে পারে? তাছাড়া মিঃ পোর্টারই বা ও কাজ করতে যাবেন কেন?

শিখা বললো—মিঃ পোর্টারই যে এ কাজ করেছেন, সে কথা এখনও জোর দিয়ে বলা যায় না; তবে আমার সন্দেহ এই যে, পদমর্যাদা ও প্রতিপত্তি স্থায়ী করবার জন্য তিনি হয়তো মহারাজাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন। তাঁর পক্ষে সুবিধাও কিছু ছিল কারণ তিনি জানতেন যে তাঁর মেয়ের সঙ্গে মহারাজ চন্দন সিংয়ের অবৈধ প্রণয় আছে। আমার মনে হয় মহারাজ চন্দন সিং যখন মিস্ রোজীর কাছে যান সেই সময় মিঃ পোর্টারও ওখানে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন এবং সুযোগমতো মহারাজকে হত্যা করেছিলেন।

—কিন্তু তাই যদি হবে তাহলে মিস্ রোজীকে হত্যা করলো কে?

—আমার সন্দেহ হয়, এটাও মিঃ পোর্টারেরই কাজ। যদিও বাপ হয়ে মেয়েকে হত্যা করার কথা সহজে সন্দেহ করা যায় না; তবুও মনে হয় যে মিস্ রোজী হয়তো তাঁকে বাধা দিতে গিয়েছিলেন, তাই মেয়েকেও তিনি হত্যা করেন।

শিখার কথা শুনে মিঃ জোন্স আশ্চর্য্য হয়ে বলেন—সত্যিই আপনার বিশ্লেষণ—ক্ষমতা অসাধারণ মিস্ রায়। আমারও এখন সন্দেহ হচ্ছে যে, এই রকম হওয়া অসম্ভব নয়। যাই হোক, আমি এখনই মিঃ পোর্টারের আঙুলের ছাপের ফটো নেবার ব্যবস্থা করছি।

চৌদ্দো – বিবাহ উৎসবের অন্তরালে

বিজয়পুর রাজ্যে সেদিন মহা ধুমধাম। বিজয়পুরের রাজকুমারী অনুলেখার সঙ্গে বিলাসপুরের মহারাজা অজয় সিং বাহাদুরের শুভ বিবাহ। রাজধানীর প্রতিটি রাস্তায় তৈরি করা হয়েছে মঙ্গল—তোরণ, বিরাট ভাবে অভ্যর্থনার আয়োজন করা হয়েছে মহারাজ অজয় সিংকে।

কথা আছে আজই বিকেলে দুটোর সময় একখানা স্পেশাল ট্রেনে করে তিনি আসবেন।

রাজপ্রাসাদ যখন উৎসবের আনন্দে মুখর সেই সময় তিনজন পুরুষ আর দু’টি মহিলা এসে মহারাজার সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। প্রাসাদ—রক্ষীরা বললো যে মহারাজা এখন ভয়ানক ব্যস্ত, এ সময় কারো সঙ্গে তিনি দেখা করবেন না।

ওঁরা তখন অন্য কোনো উপায় না দেখে কিছু প্রণামী দিয়ে কার্য্য উদ্ধার করাই সুবিধাজনক বলে মনে করলেন।

একজন তখন মণিব্যাগ খুলে পাঁচখানা দশ টাকার নোট বের করে গেটের শাস্ত্রীর হাতে দিয়ে বললেন—এই বকশিস নাও ভাই, তুমি যেমন করে হোক মহারাজার সঙ্গে আমাদের দেখা করবার ব্যবস্থা করে দাও।

শান্ত্রী তখন দরজা ছেড়ে দিয়ে বললো—সোজা ভিতরে গিয়ে ডাইনের দিকের সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে যান, দোতলায় উঠে সিঁড়ির ঠিক সামনেই যে বড় ঘরটা দেখতে পাবেন, মহারাজা সেখানেই আছেন।

সেই দলটি তখন শান্ত্রীর নির্দ্দিষ্ট পথে সোজা দোতলায় উঠে গিয়ে সামনের ঘরে ঢুকে পড়তেই দেখলেন যে মহারাজা এক মণিকারের সঙ্গে কথা বলছেন আর তার নিয়ে আসা হীরে—মুক্তার গহনাগুলো পরীক্ষা করছেন।

এই রকম পরিস্থিতিতে হঠাৎ পাঁচজন অপরিচিত নরনারীকে সেই ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়তে দেখে মহারাজা বিরক্ত হয়ে বললেন—কে আপনারা? কি চান এখানে?

ওঁদের মধ্যে যিনি বয়োজ্যেষ্ঠ সেই ভদ্রলোক এগিয়ে এসে মহারাজাকে অভিবাদন করে বললেন—আমার নাম উইলিয়াম জোন্স—আমি পলাশগড় রাজ্যের ইনসপেক্টার—জেনারেল অব পুলিশ, আর ইনি হচ্ছেন কলকাতা পুলিশের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেণ্টের সুযোগ্য ডেপুটি কমিশনার মিঃ পি. কে. মিটার, আই. পি, আর এই মেয়েটির নাম মিস্ অগ্নিশিখা রায়, ভারতের একমাত্র মহিলা ডিটেকটিভ, আর এঁরা হচ্ছেন এঁর সহকারী।

এতগুলি পুলিশ ও ডিটেকটিভের আমদানি দেখে মহারাজ ঘাবড়ে গিয়ে মণিকারকে বিদায় দিয়ে বললেন—আপনারা আগে সবাই বসুন, তারপর শুনছি আপনাদের কথা।

মহারাজার অনুরোধে রতন ছাড়া আর সবাই আসন গ্রহণ করলেন।

ওঁরা বসলে মহারাজা জিজ্ঞাসা করলেন—কি ব্যাপার বলুন তো মিঃ জোন্স! কোনো গোলমাল হয়েছে নাকি?

মিঃ জোন্স বললেন—তা একটু হয়েছে বৈকি মহারাজ! সব কথা আপনি এঁর কাছ থেকেই শুনতে পাবেন। এই বলে ডেপুটি কমিশনারের দিকে তাকান তিনি।

মহারাজা বললেন—আমি কাগজে আপনার কথা পড়েছি মিঃ মিত্র। আপনি যখন স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড থেকে সম্মানের সঙ্গে পাশ করে ফিরে আসেন তখনই আপনার কথা পড়েছিলাম আমি। যাই হোক, আপনি বলুন কি বলতে চান!

ডেপুটি কমিশনার প্রথমেই বললেন—আপনার মেয়ের বিয়ে কি বন্ধ করা যায় না মহারাজ?

মহারাজা আশ্চর্য্য হয়ে বললেন—বিয়ে…বন্ধ! সে কি কখনো সম্ভব! ব্যাপারটা কি হয়েছে বলুন তো।

—এ বিবাহ যদি হয় তাহলে আপনার মেয়ে কোনোদিনই সুখী হবেন না।

—কেন?

—কারণ, যাঁর সঙ্গে তাঁর বিয়ে দিতে যাচ্ছেন সে একটা সাংঘাতিক অপরাধী।

মহারাজ বললেন—একথা আপনি না বলে অন্য কেউ বললে আমি তাকে মিথ্যাবাদী বলতাম মিঃ মিত্র।

—সে কথা খুবই সত্যি। কিন্তু খুব ভালভাবে প্রমাণ পেয়েছি বলে একথা বলতে আমি বাধ্য হচ্ছি। নিজ হাতে খুন না করলেও তাঁরই আদেশে খুন হয়েছে। আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে যে পলাশগড়ের মহারাজা চন্দন সিং আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন?

—হ্যাঁ, সে কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে! আর এও মনে আছে যে মহারাজ চন্দন সিং দেনায় ডুবে আছেন। তাঁর মত দেউলে রাজার সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে দিতে চাই না।

—আমি সে কথা বলতে চাই না মহারাজ। আমি শুধু আপনাকে কতকগুলো ঘটনা বলতে এসেছি। আপনি হয়তো জানেন না যে, মহারাজ চন্দন সিং আর বেঁচে নেই!

—বেঁচে নেই! তার মানে? কবে মারা গেলেন তিনি?

—মারা যাননি, তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। এই দেখুন তাঁর মৃতদেহের ফটো যা পুলিশ—গেজেটে বেরিয়েছে।

এই বলে বোম্বের সেই পুলিশ—গেজেটখানা মহারাজার সামনে মেলে ধরলেন তিনি।

মহারাজা সেখানা হাতে নিয়ে পড়ে দেখে বললেন—কি ভয়ানক!

ডেপুটি কমিশনার বললেন—আরও ভয়ানক ব্যাপার আছে মহারাজ! এই চন্দন সিংকে হত্যা করা হয়েছে আপনার হবু জামাইয়েরই আদেশে। তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারী মিঃ পোর্টার নিজহাতে মহারাজ চন্দন সিংকে হত্যা করেছে।

—মিঃ পোর্টার তাঁকে হত্যা করেছে! বলেন কি?

ডেপুটি কমিশনার বললেন—ঠিকই বলছি মহারাজ! শুধু তাই নয়, নিজের মেয়ে—মিস্ রোজী পোর্টারকেও হত্যা করেছে সে। খুব সম্ভব রোজী বাধা দিয়েছিল মহারাজকে হত্যা করবার সময়, সেইজন্যই তাকেও হত্যা করা হয়েছে। মিস্ রোজীর কাছে মহারাজ চন্দন সিংয়ের লেখা এই চিঠিগুলো পড়ে দেখলেই সব কিছু জানতে পারবেন আপনি।

এই বলে নেলার জোগাড়—করা সেই চিঠিগুলো মহারাজার সামনে এগিয়ে দিলেন তিনি।

প্রথম চিঠিখানা পড়ে মহারাজা জানতে পারলেন যে, মহারাজ চন্দন সিং রোজীকে ভালবাসতেন কিন্তু তিনি দেনায় ডুবে আছেন বলে বিজয়পুরের রাজকুমারীকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছেন। চিঠিতে আরও জানা গেল যে, বিজয়পুরের রাজকুমারীকে যে যৌতুক দেওয়া হবে তার দাম প্রায় তিন কোটি টাকা, সুতরাং মহারাজা চেষ্টা করবেন ঐ রাজকুমারীর সঙ্গে যাতে তাঁর বিয়ে হয় সেই জন্য।

দ্বিতীয় পত্রে মহারাজ চন্দন সিং লিখেছেন যে, বিজয়পুরের মহারাজ কি করে জানতে পেরেছেন তাঁর দেনার কথা, তাই তিনি বলেছেন যে দেনা শোধের দলিল না দেখাতে পারলে তিনি তাঁর সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবেন না।

তৃতীয় পত্রে জানা যায় যে, মহারাজা চন্দন সিংয়ের সঙ্গে বিলাসপুরের মহারাজা গোপনে গোপনে শত্রুতা করছেন। তিনিও বিজয়পুরের রাজকুমারীকে হাত করতে চান। চন্দন সিং এই চিঠিতে আরও জানান যে তিনি গোপনে এক মাড়োয়ারীর কাছ থেকে পঁচিশ লক্ষ টাকা ধার নেবার ব্যবস্থা করছেন। টাকাটা পেয়ে গেলেই তিনি দেনা শোধ করে তার দলিলগুলো বিজয়পুরের মহারাজাকে দেখাতে পারবেন। তারপর বিজয়পুরের রাজকুমারীর সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেলে তাঁর কাছে তিনি অকপটে সব কথা খুলে বলে পঁচিশ লক্ষ টাকা চাইবেন। স্বামীর দেনার কথা শুনে তিনি নিশ্চয়ই টাকাটা দেবেন আর সেই টাকা দিয়েই মাড়োয়ারী মহাজনের দেনা শোধ করে দিতে পারবেন। মহারাজা আরও জানিয়েছিলেন যে, বিজয়পুরের রাজকুমারীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হলেও মিস্ রোজীকে তিনি ভুলবেন না। বাধ্য হয়ে রাজকুমারীকে বিয়ে করলেও মিস্ রোজীকেও তিনি বিয়ে করবেন। হিন্দু সমাজে দুই বিবাহ নিষিদ্ধ নয়।

চতুর্থ পত্রে জানা যায় যে বিজয়পুরের মহারাজা রাজী হয়েছেন, তিনি বলেছেন যে, দেনা শোধ করবার দলিল দেখাতে পারলেই তিনি তাঁর সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজী আছেন। বিলাসপুরের রাজা বংশমর্যাদায় নীচু বলে পলাশগড়ের মহারাজার সঙ্গেই তিনি মেয়ের বিয়ে দিতে রাজী হয়েছেন—অবশ্য সব কিছুই নির্ভর করছে দেনা শোধ করবার উপরে।

চিঠি ক’খানা পড়া হয়ে গেলে মহারাজা বললেন—আপনারা আমার সঙ্গে আমার প্রাইভেট চেম্বারে চলুন। এখানে এসব বিষয় আলোচনা করা ঠিক হবে না।

সবাই মিলে তখন মহারাজার প্রাইভেট চেম্বারের দিকে চললেন।

পনেরো – লীলা শেষ

প্রাইভেট চেম্বারে বসে মহারাজই প্রথমে কথা বললেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন—কিন্তু এ থেকে বিলাসপুরের মহারাজাই যে অপরাধী তা কি করে বোঝা যায়?

ডেপুটি কমিশনার বললেন—বলেছি তো, এযাবৎ প্রত্যক্ষ কোনো প্রমাণ তাঁর বিরুদ্ধে নেই। কিন্তু একটা ব্যাপার ভেবে দেখবেন যে, মহারাজ চন্দন সিংকে মিস্ রোজী যখন টেলিগ্রাম করে নিয়ে যায় তখন সেখানে মিঃ পোর্টার থাকেন কেন? তারপর আরও একটা কথা আছে ভাববার মতো। আপনি নিশ্চয়ই চন্দন সিংকে এমন একটা নির্দ্দিষ্ট সময়ের কথা বলে দিয়েছিলেন যার মধ্যে আপনাকে দেনা শোধের দলিলগুলো দেখাতে হবে, আর সে কথা বিলাসপুরের মহারাজাও জানতেন।

মহারাজা বললেন—হ্যাঁ। ব্যাপারটা অনেকটা সে রকমই বটে। কিন্তু বিলাসপুরের মহারাজাও কি আমার মেয়েকে টাকার জন্য বিয়ে করতে চাইছেন?

—নিশ্চয়ই! এই সব গোপনীয় দলিলপত্র দেখলেই আপনি বুঝতে পারবেন যে, বিলাসপুরের মহারাজার অবস্থাও চন্দন সিংয়ের চাইতে কোনো অংশে ভাল নয়। আজ আর স্টেটের টাকা ইচ্ছামত খরচ করবার সুবিধা এঁদের নেই, সুতরাং আপনার মেয়ের মত কয়েক কোটি টাকার উত্তরাধিকারিণী রাজকন্যাকে বিয়ে করতে তিনি যে, যে—কোনো পন্থা অবলম্বন করবেন এতে কোনোই ভুল নেই। এছাড়া বিলাসপুরে অনুসন্ধান করে আমরা জানতে পেরেছি, ঠিক খুনের সময় মহারাজ আর মিঃ পোর্টার ছিলেন কলকাতায়। নিছক কৌতূহলবশে নেলা মিঃ পোর্টারের ওয়েস্ট—পেপার—বাস্কেট থেকে যে দু’খানা কাগজ সংগ্রহ করেছে, তা থেকেই জানা যায়, চন্দন সিংকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবার জন্যে বিলাসপুরের মহারাজা মিঃ পোর্টারকে নিযুক্ত করেছিলেন এবং সেজন্যে তাঁকে প্রচুর পুরস্কারও দেন। মিঃ পোর্টারের একাউণ্টে যে চেক ভাঙানো হয়েছে, তার সাক্ষী তাঁর ব্যাঙ্কারই দেবে!

এই বলে ব্যাগ থেকে কতকগুলো দলিলপত্র বের করে মহারাজার হাতে দিলেন তিনি।

মহারাজা তখন সেই গোপনীয় কাগজপত্রগুলো পড়ে দেখে বুঝতে পারলেন যে, ডেপুটি কমিশনারের প্রত্যেকটা কথাই যুক্তিসঙ্গত। তিনি তখন বললেন—কিন্তু এই ব্যাপারে আপনারা হঠাৎ তদন্ত করতে গেলেন কেন?

ডেপুটি কমিশনার হেসে বললেন—ওটা একটা আকস্মিক দুর্ঘটনার মত আমাদের ঘাড়ে এসে চেপে গিয়েছিল। আমরা প্রথমে গড়ের মাঠে অ্যাংলো—ইণ্ডিয়ান তরুণীর মৃতদেহটা কোথা থেকে এলো বা কে তাকে হত্যা করলো ঐ ব্যাপারটার তদন্ত সুরু করি। অবশ্য এই তদন্তের যা কিছু কৃতিত্ব সবই এই মেয়ে দু’টির।

এই বলে শিখা আর নেলাকে দেখিয়ে তিনি আবার বললেন—এর নাম অগ্নিশিখা রায় আর এর নাম মিস্ নেলা পিটারসন। হয়তো মহিলা ডিটেকটিভ মিস্ রায়ের নাম আপনি শুনে থাকবেন মহারাজ!

মহারাজা শিখার দিকে তাকিয়ে বললেন—যদি আপত্তি না থাকে তাহলে কি ভাবে সমস্ত ব্যাপারটা আপনারা তদন্ত করলেন আমাকে বলুন।

শিখা তখন আনুপূর্ব্বিক সমস্ত ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মহারাজার কাছে বর্ণনা করলো।

ওদের কাছ থেকে সব খবর জেনে নেবার পর মহারাজা ডেপুটি কমিশনারকে বললেন—এখন তাহলে কি করতে চান মিঃ মিত্র?

—আমরা মিঃ পোর্টার আর মহারাজ অজয় সিংকে গ্রেপ্তার করতে চাই! কিন্তু আপনার রাজ্যে আপনার হুকুম ছাড়া এখানকার পুলিশ আমাদের সাহায্য করবে না। এই জন্য আমি প্রার্থনা করছি যে আপনি আমাকে ওঁদের গ্রেপ্তারের ব্যাপারে সাহায্য করুন।

মহারাজা বললেন—নিশ্চয়ই করবো মিঃ মিত্র। তাছাড়া এ বিয়েও আমি ভেঙে দেব। ঐ রকম সাংঘাতিক লোকের সঙ্গে আমি মেয়ের বিয়ে দিতে রাজী নই।

ঐ দিনই বেলা দুটোয়।

বিলাসপুরের মহারাজকে নিয়ে একখানি স্পেশাল ট্রেন স্টেশনে এসে দাঁড়াতেই একদল পুলিশ সঙ্গে নিয়ে শিখা, নেলা, ডেপুটি কমিশনার মিঃ মিত্র ও মিঃ জোন্স সরাসরি মহারাজের কামরায় ঢুকে পড়লেন। সেখানেই তাঁর চীফ সেক্রেটারী মিঃ পোর্টারকে পাওয়া যায়।

এতগুলি লোককে কামরায় ঢুকতে দেখে মহারাজ বিরক্ত হয়ে বললেন—কে আপনারা? কি চান এখানে? তাঁর কথার উত্তর না দিয়ে মিঃ মিত্র কি যেন ইঙ্গিত করলেন পুলিশের একজন জমাদারের দিকে তাকিয়ে। ইঙ্গিত পাওয়া মাত্র জমাদার আর দু’জন সিপাই ছুটে গিয়ে মহারাজ আর মিঃ পোর্টারকে ধরে ফেলে তাঁদের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিল।

মহারাজ গর্জ্জন করে বললেন—আমার হাতে হাতকড়া! এ রীতিমতো বেআইনী!

মিঃ মিত্র বললেন—বেআইনী কি না, সেটা কোর্টেই প্রমাণ হবে। ভেবেছিলেন, পুলিশ যদি জানতেই পারে, মিঃ পোর্টারকে ধরেই টানাটানি করবে। আপনি নির্ব্বিঘ্নে ভদ্রবেশে মানুষের সমাজে ঘুরে বেড়াবেন। কিন্তু আপনার হয়তো জানা নেই যে, আইনের আর একটা দিকও আছে। খুনের প্ররোচনা যে জোগায় সে খুনী অপেক্ষা কোনো অংশে কম দোষী নয়!

_____

* এই সিরিজের প্রথম বই ‘অগ্নিশিখা’ দেখুন।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *