০৯. শাহজাহানাবাদে আমি ঢুকেছিলুম

শিকবহ্-এ আব্লহ অভী সে মীর?
হ্যায় পেয়ারে হুনুজ দিল্লি দূর।।
(ফোসকা পড়ার কান্না এখন থেকেই মীর?
বন্ধু, দিল্লি এখনও যে অনেক দূর।।)

মান্টোভাই, শাহজাহানাবাদে আমি ঢুকেছিলুম বদনসিব আত্মাদের বলা কথা শুনতে শুনতে। সবার মুখে মুখে তো দিল্লিই, কিন্তু শাহজাহানাবাদ নামটা উচ্চারণ করতে আমার ভাল লাগত; এক একটা নামে কেমন খুশবু জড়িয়ে থাকে না? জাহাঙ্গিরী আতরের মতো খুশবু। নাম। শোনেননি বুঝি? এসব আর কজনই বা জানে, বলুন? জাঁহাপনা জাহাঙ্গির দাবি করতেন, তাঁর রাজত্বেই আতরের জন্ম। এসব হচ্ছে রাজা-বাদশাদের খেয়াল। তবে সে আতর কে বানিয়েছিল জানেন? বেগম নূরজাহানের মা অসমত বেগম। জাহাঙ্গিরের খুব আফসোস ছিল যে তাঁর ওয়ালিদ জাঁহাপনা আকবর এই জাহাঙ্গিরী আতরের সুবাস নিয়ে কবরে যেতে পারেননি। জাঁহাপনা আকবর। মান্টোসাব, তিনি যেন জন্নতের খাস দরওয়াজা। কত দূর সত্যি জানি না, দিল্লির খাস আদমিদের কাছেই শুনেছি, অসমত বেগম গোলাপজল বানানোর সময় জলের ওপর যে ফেনা তৈরি হত, তার ওপর ঢালা হত গরম গোলাপ জল; এরপর সেই ফেনা একটি একটু করে জমানো হত আতরদানে; আর এভাবেই জন্ম জাহাঙ্গিরী আতরের। এই আতরের এক ফোঁটা হাতে লাগালে নাকি হাজারো মানুষের মজলিসে জেগে উঠত গুলবাগ। এমন সে সুগন্ধ, যার টানে নাকি হারিয়ে যাওয়া আত্মারাও ফিরে আসত।

আমিও যেন এক হারানো আত্মার মতো দিল্লি এসেছিলুম। নাকি একটা খোয়াবের মতো, কি মনে হয় আপনাদের? আমার জীবনটা কী, বলুন? একটা খোয়াবই, তবু আমি তো গায়েগতরে একটা মানুষই ছিলাম। না কী? আমি আল্লার খোয়ব-বদখোয়াব। কিন্তু আল্লা কেন এই বদখোয়াব দেখেছিলেন জানেন? তিনি জানতেন, আমি এই দুনিয়াতে সেই কবিতা নিয়ে আসব, তার ভেতর দিয়ে একের পর এক আয়নামহল পেরিয়ে যাবেন আপনারা। আর দেখবেন, কীভাবে বদলে বদলে যাচ্ছে আপনাদের হকিকত। আমার অস্তিত্ব ধুলোর মত আয়নামহলের মেঝেতে ছড়িয়ে থাকবে। সেই ধুলো, যা দিয়ে আল্লা প্রথম মানুষ তৈরী করেছিলেন।

কোন্ কথা থেকে কোন্ কথা এসে গেল। আচ্ছা মান্টোভাই, আমি তো আপনাদের শাহজাহানাবাদে আসার কথা বলছিলুম? হ্যাঁ, তাই তো বলছিলুম, না হলে আর খুশবুর কথা আসবে কেন? শব্দের জগৎ বড় মজার জানেন তো? এই যে বলেছিলুম না, যে, বদনসিব আত্মাদের বলা কথা শুনতে শুনতে আমি শাহজাহানাবাদে এসেছিলুম, তাই তো এসে গেল খুশবুর কথা। আত্মারা হল গিয়ে এক-একটা খুশবু। কিন্তু এই খুশবু আপনি কোন মুঘল জাঁহাপনার খুশবুখানায় পাবেন না। এ হল গিয়ে আল্লার তৈরি খুশবু। প্রতিটি আত্মাকে। খোদাতালা নতুন নতুন খুশবু দেন। কোনও কোনও খুশবু এই দুনিয়ার তৈরি আতরের সঙ্গে মিলে যায়। তাই সেই খুশবু এই দুনিয়াতেও থাকে আবার জন্নতেও থাকে। কী হল বলুন তো মান্টোভাই, শাহজাহানাবাদে আসার কথা বলতে গিয়ে কেন বার বার আগ্রার দিনগুলোর কথা। মনে পড়ছে এই কবরে? মীরসাব তো কবেই বলে গেছেন:

 বসীয়ৎ মীরনে মুঝকো য়হী কী
কেহ্ সব কুছ হোনা তু, আশিক নহ্ হোনা।।

প্রেমের কথা যখন উঠলই, আর মীরসাব যখন বলে গেছেন, আর যা কিছু হতে চাও হও, কিন্তু প্রেমিক কিছুতেই নয়, মীরসাবের দিবানা হওয়ার কথাটাই না হয় বলে নিই। হয়তো ভুলে যাব, আর কখনও বলাই হবে না, তাই গোস্তাকি মাফ করবেন,আমি মীরসাবের যন্ত্রণার কথাটা এই ফুরসতে বলে নিতে চাই। দোজখের আত্মবন্ধুরা আমার, এভাবেই চলুক না আমাদের কথাবার্তা; এগিয়ে পিছিয়ে-হারিয়ে গিয়ে, যেন কোনও ঢেউয়ের পর আর এক ঢেউ আসছে, বুঝতেই পারা যায় না। কী হল, আপনারা সবাই উঠে বসলেন কেন? কেমন এক অন্ধকার ছায়া নেমে এসেছে আপনাদের মুখে। কী হয়েছে মান্টোভাই? আমি কি কোনও ভুল করলুম? একের পর এক ভুল করতে করতেই তো কেটে গেল আমার জীবন। উমরাও বেগম একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, মির্জাসাব, আপ কওন হ্যায়?

-মতলব?

-আপনি কে?

আমি হা হা করে হেসে উঠেছিলুম।-নোক্তা, বেগম, ম্যায় তো এক নোক্তা হুঁ।

-নোক্তা?

নোক্তা-বিন্দু-কখন, কোথায় বসবে, কখন কোনদিকে সেই বিন্দু থেকে রেখা টানা হবে, তা কে জানে বলুন, মান্টোভাই? কিন্তু আপনারা এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন সবাই? কী ভুল করেছি আমি? আচ্ছা, আমাকে একটু থামতে দিন, ভেবে দেখি, আমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারব, কোথায় আমার ভুল, একটু সময় দিন..

.

হ্যাঁ, শাহজাহানাবাদে আসার কথাই আমাকে আগে বলে নিতে হবে। ওরা সবাই আমার সঙ্গে কথা বলে গেল এখনই, সে আত্মারা, দিল্লিতে আসবার দিন ওরাই তো আমার সঙ্গে কথা বলেছিল। ওরা বলল, বুরবাক, আমাদের কথা আগে না বললে, তোমার কথা কেউ শুনবে না।

-কেন?

-মাটির গভীরের কথাই তো মানুষ আগে শুনতে চায়। আর আমরা সেই গভীরে-

-তোমরা কোথায় শুয়ে আছ?

-দিল্লির মাটির নীচে। আমদের কথা আগে বলো। এই শহরটা তো আমাদের রক্তমাংসের। ভিতের ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে। মীরসাবের কথা কে না জানে? আমরা তো বেখবর, আমাদের কথা তুমি না বললে, কে বলবে? শাহজানাবাদে তুমি যেদিন এলে, সেদিন কারা কথা বলেছিল তোমার সঙ্গে? কে চিনত তোমাকে আসাদ? আমরাই তো কথা বলেছিলাম। আমি এখন তাদের কথা বলছি, আপনারা দিমাক জাগিয়ে রেখে শুনুন। এ এক শহর আফশোসের কিস্সা-দুঃখে তার জন্ম, দুঃখেই তার মৃত্যু। সেই মৃত্যু আমি দেখেছি, মান্টোভাই, সেসব কথা আমি বুদ বুদ বলে যাব। বলে যেতেই হবে। এই শহরই তো আমার শরীর। আমি একটুও বাড়িয়ে বলছি না, চাঁদনি চক ছিল আমার মেরুদণ্ড, কিলা-ই-মুয়াল্লা আমার এই বেঢপ মাথাটা, আর দিল? সে তো জামা মসজিদ, এটুকু তো বোঝেন? কিলা-ই-মুয়াল্লার মুখ পশ্চিমে, মক্কার দিকে। চাদনি চক পশ্চিমে, আবার জামা মসজিদের মুখও পশ্চিমে। শহরের দরজাগুলো হল বিশ্বরুপ। চারদিকের দরজাগুলো তো আসলে জন্নতের চার দরওয়াজা। জামা মসজিদের সামনে বসেই আমি প্রথম খাজা মইনুদ্দিন চিস্তির কিস্সা শুনেছিলাম। খাজা কী বলেছিলেন জানেন? আয়নায় কার মুখ? আমার আত্মার পটে কোন সৌন্দর্য এসে ধরা দিল? এই মহাবিশ্বকে কে সাজিয়েছে। প্রতিটি অনুতে প্রতিবিম্বিত কে? প্রতিটি বালুকণাকে আলোয় ভরিয়ে দেয় কে? আমি তো মাংস দেখি, মজ্জার মধ্যে লুকিয়ে আছে কে? আত্মার শান্তির গান গায় কে? সে নিজেকেই দেখে নিজেকেই ভালবাসে। কে সে? কে সে? তিনি গরিব নওয়াজ। ভুখা মানুষের বন্ধু।

শাহজানাবাদে যেদিন এলুম, তারাই এসে আমার সঙ্গে কথা বলল, যাদের কথা ইতিহাসে লেখা হয় না, মান্টোভাই। শাহজাহানাবাদে গড়ার জন্য তাদের জীবন্ত কবর দেওয়া হয়েছিল। তা হলে কিস্সাটা একটু গোড়া থেকেই বলি। তবে কোনটা গোড়া, আর কোনটা আগা, তা আমি আজও বুঝতে পারি না। আমি সেই বুড়ো গাছটা, জানেন তো, হাজার হাজার বছর ধরে বেঁচে আছে, যার গায়ে কেউ কুঠার দিয়েও আঘাত করে না, আসলে গাছটা যে কারুর কোনও কাজে আসে না। দাঁড়িয়ে আছি তো আছেই। মনে হয়, আমার মাথাটাই শিকড়, আকাশ ছুঁড়ে কোথায় চলে গেছে, না, না, জন্নতের দিকে তো নয়ই, আর আমার পা ডুবে আছে নরকের আগুনে। তবু আল্লাকে তো আমি বলেছিলুম :

অব জফা-সে-ভী হৈ মহরূম, আল্লাহ আল্লাহ;
ইসঁ কদ দুশমন্-এ-অর্বাব-এ-বফা হো জানা।।
(এখন নিষ্ঠুরতা থেকেও বঞ্চিত আমি-হায় ঈশ্বর
একনিষ্ঠ প্রেমিকের সঙ্গে এতখনি শত্রুতা )

যে কথা হচ্ছিল। আপনারা তো জানেন, শাহজাহানাবাদের আগে মুঘলদের রাজধানী ছিল আকবরাবাদ, মানে আগ্রায়। জাঁহাপনা আকবর আগ্রায় এসেছিলেন ১৫৫৮ সালে। এসব ইতিহাসের কথা শুনতে কি আপনাদের ভাল লাগবে? সেজন্য ইতিহাসের কত কিতাব রয়েছে। সম্রাট বাহাদুর শাহ আমাকে তো মুঘলদের ইতিহাস লেখবার বরাত দিয়েছিলেন; প্রথম খণ্ডের পর আমি আর লিখতে পারিনি। আমি কিস্সা শুনতে শুনতে বড় হয়েছি মান্টোভাই, ইতিহাস কি আমাকে জন্নতের পথ দেখাতে পারবে? বরং ১৮৫৭ থেকে ইতিহাসের জাহান্নমের আগুনে পুড়ে পুড়েই আমরা শেষ হয়ে গেলুম।

তবু আগ্রা নিয়ে দুএকটা কথা আমাকে বলতেই হবে। তার পথের ধুলোয় মিশে আছে আমার প্রথম জীবনের প্রেম। যমুনার স্রোত আমার সঙ্গে কথা বলত। আমি ঘুরে বেড়াতুম চহরবাগে, মোতি মহলে। জাফর খানের সমাধিসৌধের পাশেই ছিল বুলন্দবাগ; সে এক আশ্চর্য বাগান। সত্যি বলতে কী মান্টোভাই, আগ্রা ছিল আসলে বাগানের শহর। আর কত যে সরাই ছিল। তাজমহলের পাশের সরাইয়ের নাম ছিল তাজ-ই-মোকাম আমাদের আড্ডাবাজির ঠেক। বলতে পারেন তাজ-ই-মোকাম ছিল আমাদের কিস্সবাগ। একজন এই গল্প বলেছে তো আরেকজন। অন্য গল্প; আর আকাশ জুড়ে পতঙ্গবাজির মত হাসির হল্লা। মীর সওদার কিস্যাটা আমি ওখানেই প্রথম শুনেছিলাম, সওদাকে আমি কখনও বড় কবি মনে করিনি, তবে কসীদা লেখায় তাঁর আবদারির কথা স্বীকার করতেই হয়। বড় মজার একটা কথা বলতেন সওদা, এসব লোকমুখেই শোনা, আমি তো তাঁকে দেখিনি, তিনি নাকি বলতেন, আমি বাগানের সুন্দর ফুল নই ঠিকই, তবে কারুর পথের কাঁটাও নই। কিস্পটাই বলা যাক। মীর হাসানের ওয়ালিদ মীর জাহিদকে নিয়েই মজার কসীদাটা লিখেছিলেন সওদা। মীর জাহিদ খাবার পেলে আর কিছু চাইতেন না। জগৎ-সংসারে সব কিছুর মধ্যেই তিনি কিছু না কিছু খাবার খুঁজে পেতেন। সওদার কসীদাটা শুনলে আপনি হেসে গড়িয়ে পড়বেন মান্টোভাই। মীর জাহিদ একদিন হাঁ। করে তাঁর বেগমের আঙ্গিয়াঁর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আরে, আঙ্গিয়াঁ, আঙ্গিয়াঁ বোঝেন তো? যা দিয়ে মেয়েরা বুক দুটোকে ঢাকে। বেগম তো অবাক, এ কী বেশরম বাত, মরদ এভাবে আঙ্গিয়াঁর দিকে তাকিয়ে আছে কেন?

বেগম লজ্জা পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কোই গলদ কিয়া জনাব?

-নেহি।

-তো আপ কিউ

-দেখ রহি হু বেগম।

-কেয়া।

-আঙ্গিয়াঁকা অন্দর কেয়া হ্যায় বেগম?

-কেয়া হ্যায় জি? মীর জাহিদ লাফিয়ে পড়ে বেগমের দুই বুক চেপে ধরে চেঁচিয়ে উঠলেন, রোটি হ্যায় বেগম, রোটি হ্যায়, য্যায়সে মখমল।

-ইয়া আল্লা। বলে তো বেগমের মুছা যাবার অবস্থা। আবার এক-একদিন বেগমের পেটিকোটের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে বলতেন, ইয়ে কেয়া হ্যায় বেগম? ইতনা নরম, ফির ভি ইতনা গরম। এ তো তাওয়ায় ভেজে আনা রোটি বেগম। কেন আমার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছ? দাও-দাও-বেগম, এ রোটির স্বাদই আলাদা। হাঃ হাঃ হাঃ-ভেবে দেখুন মান্টোভাই, সরাইখানায় বসে কী চলত? দিনে কত লোক আসছে, যাচ্ছে-চেনা-অচেনা-কত বিদেশী-আপনি জানেন, সেই আকবরাবাদে তখন যত লোক ছিল, তত লোক লন্ডনেও ছিল না। এই ছিল। আকবরাবাদ, রঙিন সুতোয় বোনা একটা তসবির, তাই বা বলি কেন, সে যেন ছিল এক তসবিরমহল, আর সেখানে খোদার কলম যেন আমাদের এঁকে দিয়ে গিয়েছিল। হাফিজ সাবের সেই শের মনে পড়ে যায়, মান্টোভাই :

রোষে বক্সে দোস্ত দারাঁ যাদবাদ
য়াদ বাদ আঁ রোষগারাঁ যাদবাদ।
(আজও মনে পড়ে সেইসব দিন
এসেছি যে একে অন্যের কাছে
বন্ধুত্বের টানে বাঁধা পড়ে–
সেসব দিন কি আজও মনে আছে?)

১৬৩৭ সালে জাঁহাপনা শাহজাহান দিল্লি চলে গেলেন। আগ্রার তাসবিরমহলও ভেঙে পড়ল। মীরসাব যেমন লিখেছিলেন :

বু-এ গুল যা নবা বুলবুল কী :
উম্র, অক্সোস কেয়া শিতাব গয়া।।
(গোলাপ ফুলের সৌরভ, বুলবুলের করুণ গান
এবং আমার জীবন, হায় কী দ্রুত শেষ হয়ে গেল।)

 এবার শুরু হল শাহজাহানাবাদ তৈরীর কাজ। আগ্রা আর লাহোররের মধ্যে কোন জায়গায় রাজধানীর জন্য জায়গা দেখতে বলেছিলেন জাঁহাপনা শাহজাহান। যমুনা নদীর পারে ঠিক করা হল সেই জায়গা। শহরের কুণ্ডলিনী তৈরি করা হয়েছিল জানেন তো? জ্যোতিষীরা দিনক্ষণ ঠিক করেছিলেন। ১৬৩৯-এর ১২মের মধ্যে শুরু হয়ে গেল কাজকর্ম। এই শুরুর আগে যে শুরু, সে কিস্সাটাই আমি আপনাদের বলতে চলেছি, মান্টোভাই। একটা শহর কীভাবে মৃতের স্তূপের ওপর ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে, সেই মৃতরা, যাদের আত্মারা আমাকে ঘিরে এসে দাঁড়িয়েছিল।

দিল্লিতে এসে আমি যেদিন কিলা-ই-মুয়াল্লার সামনে দাঁড়িয়েছিলুম। সেদিন আকাশে চাঁদ ছিল না; কিলা-ই-মুয়াল্লাকে একটা বিরাট প্রেতের মতো মনে হয়েছিল আমার। আর আমি অনুভব করেছিলাম কারা যেন আমার চারপাশে ঘিরে এসে দাঁড়াচ্ছে, তাদের নিশ্বাসে পচা মাংসের গন্ধ।

-আসাদ-কে যেন আমাকে ডাকল।

আমি চারপাশে তাকিয়েও কাউকে দেখতে পেলাম না। সবে তো দিল্লি এসেছি, কেই-বা আমাকে চিনবে? -কে আপনি? আমি ভয়ে ভয়ে বললুম।

কুতুব।

-আপনাকে তো চিনি না। আপনি কোথায়? আপনাকে তো দেখতে পাচ্ছি না কেন?

-আমাদের দেখা যায় না আসাদ।

-কেন?

-ওরা আমাদের মুছে ফেলেছে।

-কারা?

-শাহজাহানাবাদ যারা তৈরী করেছে। ওরা বেছে বেছে আমাদের ধরে এনেছিল।

-তারপর?

-সবাইকে মেরে কবর দিয়েছিল। সেই মাটির ওপরই তো এই শাহজাহানাবাদ দাঁড়িয়ে আছে।

-কেন তোমাকে মারা হয়েছিল?

-আমি ওদের সামান্য জমিটুকু দিতে চাই নি। তাই আমাকে খাল্লাস করে দিল। বলল, জাঁহাপনার বিরুদ্ধে এর চেয়ে বড় অপরাধ আর হয় না। আমাকে ওরা দাগী আসামী বানিয়ে দিল। অন্ধকার কারাগারে আটকে রাখল দিনের পর দিন।

-আসাদ ভাই

-তুমি কে?

-আমি ইউসুফ।

-তুমি কী করেছিলে?

-শুধু তাকে দেখেছিলাম।

-কাকে?

-তার নামও আমি জানি না। হাভেলির বারান্দায় সে দাঁড়িয়েছিল। শুধু বোরখার ভেতর দিয়ে তার চোখ দুটো দেখেছিলাম। আসাদ ভাই, কেমন সেই চোখ জান? যেন দুটো বুলবুল। আমি সেই বুলবুল দেখতে রোজ হাভেলির সামনে যেতাম। কিন্তু আর কখনও দেখিনি। তবু ওরা। আমাকে শিকল দিয়ে বেঁধে ধরে নিয়ে গেল, একটা অন্ধকূপে ঢুকিয়ে দিল। তারপর একদিন

-তুমিও কবরে চলে গেলে ইউসুফ?

-জি।

-কেউ কিছু বলল না?

– কে কী বলবে? মহব্বত হারাম, মহব্বত দোজখ। কে কী বলবে আসাদ ভাই? আমাদের

জীবনে মহব্বত কোথায়?

-আর আমি শুধু রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতাম।

-তুমি কে?

-হাসান। কেন ঘুরে বেড়াতাম আসাদ?

-কেন?

-ধুলো খুঁজব বলে।

-ধুলো? কেন? কার ধুলো।

-সেই ধুলো দিয়েই তো আদমকে বানিয়েছিলেন আল্লা। বলো, কাউকে না কাউকে তো সেই ধুলো খুঁজতেই হবে।

-তাই ওরা তোমাকে ধরে নিয়ে গেল?

-বলল, ধুলো খুঁজিস? ধুলো দিয়ে আদম বানাবি? আল্লা হবি? মৌলবিরা আমার জামাকাপড় ছিঁড়ে দিল। শধু পাথর ছুঁড়ে ছুঁড়ে আমাকে মেরে ফেলল। আসাদ ভাই, আমি ওদের কিছু বলিনি। সিনা চিতিয়ে দাঁড়িয়েছি। মার তোরা, কত মারবি মার, আমার চোখ খুবলে নে, মাংস কেটে কেটে নিয়ে যা। জন্নতেও তো আমি ধুলোই খুঁজব। তখন তোরা আমার কী করবি? আমি ওদের চিৎকার করে বলেছিস মার, কত পাথর ছুঁড়ে মারবি, আমি আল হাল্লাজ। আল হাল্লাজকেও তো ওরা পাথর ছুঁড়েই মেরেছিল, না? আল হাল্লাজই তো বলেছিল, আমি আল্লা। আমিই আল্লা। আমি শুধু ধুলো দিয়ে আদম বানাতে চেয়েছিলাম আসাদ ভাই। শধু এই জন্য আমি মুনাফেক?

মান্টোভাই, সেদিন সারা রাত আমি সেই আত্মাদের কথা শুনছি, যাদের কোনও না কোনওভাবে অপরাধী বানানো হয়েছিল, তারপর হত্যা করে কবর দেওয়া হয়েছিল। আর সেই কবরের মাটির ওপর গাঁথা হয়েছিল শাহজাহানাবাদের ভিত। আমি দিল্লি এসেছিলুম অনেক স্বপ্ন চোখে নিয়ে, বড় শায়ের হব, মুশায়েরার পর মুশায়ারায় আমার গজল শুনে রিস আদমিরা কেয়া বাত কেয়া বাত, মারহাব্বা মারহাব্বা বলে উঠবেন। কিন্তু এ-কোন ভটকতা হুয়া আত্মাদের শহরে এসে আমি পৌঁছলুম? সারা রাত ধরে আমি তাদের জীবনের কথা শুনেছি। তারা কেউ মুজরিম ছিল না, কিন্তু অপরাধীর ছাপ্পা মেরে দেওয়া হয়েছিল তাদের শরীরে। কেননা একটা শহর তৈরীর জন্য এইরকম অপরাধীদের দরকার, যাদের বিনা কারণে হত্যা করে কবর দেওয়া হবে। সাদিক মিঞার আত্মা আমাকে বলেছিল, আপনি গজল লিখবেন আসাদ সাব?

-আমি তো আর কিছু পারি না মিঞা।

-আমাদের মতো আত্মাদের কথা লিখবেন না?

-লিখব।

-তা হলে আপনার গজল কেউ বুঝবে না আসাদ সাব। কুতুব হেসেছিল।

-কেন?

-শুধু তো মৃত্যুর গন্ধ পাবে সবাই।

-তারপর কী হবে জানেন? সাদিক মিঞা হাসতে হাসতে বলে।

-কী?

-আপনি একটা বেওয়ারিশ কুকুরের মত মরবেন।

আত্মারা ঠিকই বলেছিল, মান্টোভাই। তবু রাস্তার কুকুর হলেও, একসময় দেখতে তো আমি সুন্দরই ছিলুম। কেউ কেউ আমাকে আদরও করত। মুঘলজান, মুনিরাবাইরাও আমাকে ভালবাসত। তারপর একদিন দেখলুম, ললামগুলো উঠতে শুরু করেছে, সারা শরীরে পোকা কিলবিল করছে। সব লোমও একদিন উঠে গেল, ঝলসানো চামড়ার নীচে কয়েকটা হাড়। দিবানখানায় বসে আমি সেই হাড় কখানার দিকে তাকিয়ে থাকতুম, তারপর ক্লান্ত হয়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়তুম। আর খোয়াবে দেখতুম দিল্লি ভেঙে পড়ছে, বালি ঝরছে, শুধু বালি; মরুভূমির ভেতরে আমি তলিয়ে যাচ্ছি। কত পুরানো আত্মাদের হাত ধরে আমি দিল্লি এসে পৌঁছেছিলুম ভাবুন, মান্টোভাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *