শারদীয় ছুটি শেষ হওয়ার পরে কিছুদিন কাজ করেছি- কাজেই সাতদিনের ছুটি চাইলে আপত্তি উঠল না। দু’তিনটি ছাত্র সঙ্গে আসতে চেয়েছিল তাদের আনিনি। দলের চেয়ে দলের সমস্যাটিই যদি হয়ে যায় বড় তাহলে যেজন্য বেরুচ্ছি সে উদ্দেশ্যটাই যাবে পণ্ড হয়ে এবং সে আমাদের কারুরই কাম্য নয়।
আমি আর মুজতবা যেদিন চাটগাঁ গিয়ে পৌঁছলাম সে ছিল শুক্রবার। সারারাত প্রায় দাঁড়িয়ে থাকার মতো কাজেই একফোঁটা ঘুম হয়নি। এই শহরে বন্ধু-বান্ধব আছে, গিয়ে উঠলে অনাদর করবে না হয়তো; কিন্তু নষ্ট করার মতো সময় নেই। ঘর থেকে বেরিয়ে একেবারে মাঠে গিয়ে নামাই আমাদের সংকল্প এবং কষ্টের জন্য তৈরি হয়েই এসেছি। লটবহর অতি সংক্ষিপ্ত । জানদুটো আর আঁকার সরঞ্জাম। এ দুয়ের মাঝখানে একটা বড় চৌকোণো ধরনের ক্যানভাসের ব্যাগ। এতে যাবতীয় খাদ্য সামগ্রী। তিনটে বিস্কুটের প্যাকেট, জেলি, মাখন এবং পাউরুটি। ব্রাশ টুথপেস্ট সাবান তেল আরও যা দরকার এর ভেতরে ছোটো একটা থলির মধ্যে আছে। ফ্লাস্কটা বাইরে আমার কাঁধে ঝুলানো।
মুজতবা আরো এসেছে দুবার। তাছাড়াও, বাইরে ও যে সত্যিই চৌকস করিৎকর্মা লোক তা অস্বীকার করার উপায় নেই। এসব ব্যাপারে আমাকে ভাবতে হয়নি। জোগাড় যন্ত্র সমস্ত ওর। আমি যেন শুধু অনুগ্রহ করে এসেছি ওর সঙ্গে।
রেস্টুরেন্টে পেট পুরে পরোটা গোশত খেয়ে পথে বেরিয়ে পড়লাম। কোথায় যাচ্ছে জিজ্ঞেস করতে চাইছিলাম, মুজতবা বুঝতে পেয়ে আগেই বলে ফেলল, কিছু ভাবিসনে কেবল আমার সঙ্গে আয়!
রিকশা করে ও আমাকে যেখানে নিয়ে এলো সে জাহাজ ঘাট। একটু পরেই লঞ্চ ছাড়বে। লোকজন সব উঠে পড়েছে। যাত্রার আগে সারেং কষে ভেঁপু বাজাচ্ছিল, এটা লোক ছুটিয়ে আনার কায়দা। স্টিমে চললে কি হবে এও কেরায়া নৌকা বৈ তো নয়! খ্যাপ পোষানো চাই।
আমরা দু’জন পিছিয়ে পড়ার দলে কিন্তু মুজতবা তবু যাচ্ছে গদাই লস্করি চালে, কোনো তাড়া নেই। আমি বললাম, আর একটু তাড়াতাড়ি যাওনা। লঞ্চ ছেড়ে দেবে।
ছাড়বে না, ও নিরুদ্বিগ্নস্বরে বলল, আরো অন্তত আধঘণ্টা দেরি!
ও এ বিষয়ে অভিজ্ঞ, কাজেই আর উচ্চবাচ্য করা অনুচিত। আমি চুপ মেরে গেলাম।
সাম্পান ভাড়া, জাহাজ পর্যন্ত গেলে ও দুটি আনি বাতার ওপরে রেখে দিল। মাঝি পয়সাগুলো দেখেই কাইকাই করতে থাকে বলে আট আনার এক পয়সা কমও নেবে না। কিন্তু ও নির্বিকার। জিনিসপত্রগুলো রেখে আরেকটি দু’আনি ছুঁড়ে মারলো, বলল ওডা! এ তরে বখশিস দিলাম।
মাঝি রাগ চাপতে চাপতে সাম্পান ঘোরায়। মুজতবা বলল, এরা এমনি। দু’জনের একআনা হলো আসল ভাড়া। কিন্তু বাইরের লোক ভেবেছে ব্যস যত পারো আদায় করো। বড় বাজে!
লঞ্চ ছাড়ল আরো পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর। কড়া রোদ ছিল না। আমরা ছাদের ওপর গিয়ে বসে সিগারেট ধরাই। দূরে পাহাড়গুলো দেখা যাচ্ছে বেগুনি মেঘের মতো। আর নিচে দুই তীরে সবুজের পোচ নিয়ে ঘুরে বেঁকে চলে এসেছে নদীটি নাম যার কর্ণফুলী, পাহাড়ি মেয়েদেরই মতো পায়ে নূপুর।
প্রকৃতির পটে আঁকা বিধাতা শিল্পীর আশ্চর্য চিত্র, ওর তুলনা কোথায়? বাইরে ছবি, ভেতরে গান এবং এই তো জগৎ। মুজতবা একদৃষ্টে চেয়ে ছিল। সে বরাবর গম্ভীর হয়েই আছে। বলল, চেয়ে দ্যাখ জাহেদ! বেশ লাগছে, আঁকবি নাকি?
হ্যাঁ আঁকলে হয়, রং তুলি নিয়ে আসি। আমি উঠে নিচে নেমে এলাম। আর একটু দেরি না করে সমস্ত সরঞ্জাম নিয়ে আবার ওপরে উঠি।
রং গুলে নিয়ে দু জনেই কাজ করছি, ওয়াটারকালার। ও আঁকছে দিগন্তরেখা আর নদী, আমি একজোট নৌকা।
আঁকছি বটে তবে খুব একটা উৎসাহ নেই। ল্যান্ডস্কেপ আমার ভালোই হতো কয়েকটি কাজ বহুল প্রশংসিত হয়েছে কিন্তু সেগুলোও যেন আনাড়ির চিত্রচর্চা। কাঁচা রং নিয়ে খেলা! কেন জানি এসব আর ভালো লাগে না, ভালো লাগে না মোটেই। মানববিরহিত প্রকৃতি যেন অর্থহীন অনাবশ্যক। শিল্পের বিষয় হিসেবে আমি মানুষকে চাই, কেবল মানুষ। পাহাড়কে আমি পছন্দ করি! কিন্তু শুধু পাহাড়ের দৃশ্যচিত্র আঁকার কি সার্থকতা আছে বুঝিনা সেজন্য গোড়া থেকেই আমার লক্ষ্য পাহাড়ি মানুষ। গর্গার মতো পলায়ন নয় কিন্তু তাহিতি আমার চাই আদিম তাহিতি।
ব্রাশে তাড়াতাড়ি কাজটা শেষ করে জিনিস গুটিয়ে ফেলি। মুজতবা জিজ্ঞেস করল, কিরে শেষ হয়ে গেল?
হ্যাঁ। সংক্ষিপ্ত জবাবটুকুর পরে ধীরে সুস্থে একটা সিগারেট ধরালাম। রঙের হিজিবিজি রেখায় ভরে গেছে ওর কাগজটা, খুব একটা ইচ্ছা নিয়ে যেন আঁকছে না ও। আমি জিজ্ঞেস করলাম, চন্দ্রঘোনায় পৌঁছতে একটা বাজবে?
লঞ্চ এইভাবে চলতে থাকলে দেড়টা দুটোর মধ্যে নিশ্চয়ই।
আচ্ছা মগদের বাজার বসবে বলছিলে না তুমি? ঠিকই বসবে তো?
হ্যাঁ আজ শুক্রবার নিশ্চয়ই বসবে। তোর খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে বুঝি?
তা বৈকি। এজন্যই তো এলাম আমি, আবার ওকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা বাইরের লোকদের ওরা কি চোখে দেখে?
যা স্বাভাবিক ঠিক সেই চোখে। খুব অতিথিপরায়ণ ওরা যদিও মগের মুল্লুক বলে প্রবাদ আছে, কিছুকাল আগেও যে কেউ গেলে খুব খাতির করত। কিন্তু আজকাল এতটা করে না। বেশি মাখামাখি করতে গেলেই সন্দেহের চোখে দেখে। বাইরের লোক গিয়ে ওদের বহু মেয়েছেলে নষ্ট করেছে কিনা?
কথাটা বলার পর ওকি যেন ভাবে, আমিও চুপ হয়ে থাকি। তাহলে পাহাড়ে বাস করলেও আদিম ওরা নয়। সভ্যতার আলোও পাচ্ছে প্রতিনিয়তই, আর এখন যখন এলাকাটাই কলের হুহুস্ আর ক্যাটারপিলারের চিৎকারে মুখরিত তখন আরো আলো পাবে বৈকি! কিন্তু না, বিচার করলে দেখা যাবে বর্বরযুগের বাস করবার চেয়ে সেও ভালো।
লঞ্চ চন্দ্রঘোনায় এসে পৌঁছল ঠিক পৌনে দুটোয়। পাড়ের দিকে ভিড়লে কিছু লোক সাম্পানে উঠে নেমে গেল, কিন্তু রইল বেশির ভাগ। তারা কাপ্তাইয়ের যাত্রী। আমি চেয়েছিলাম পেপারমিলের দিকে; পাহাড়ের বুনো এলাকায় সিংহ ব্যাঘের বদলে আজ যন্ত্রের গর্জন। প্রচণ্ড শব্দে বাঁশ কাটা পড়ে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে এদিকে একটা পাইপ দিয়ে ব্যবহৃত ময়লা পানি পড়ছে সরসর ধারায় আর তারই রাসায়নিক অংশ সাদা ফেনা ভাসছে নদীর বুকে।
রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছি, মুজতবা জিজ্ঞেস করল, মিলে নামবি নাকি?
আমি আর কি বলবো। তুমি যা ভালো মনে করো।
দেখতে দেখতে কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে যাবে। বাজার ভাঙে তার আগেই। এক সপ্তাহের আগে আর দেখতে পাবি না।
আমি বললাম, তাহলে থাক্ বাজারটাই দেখি। অন্যদিন সুযোগ করে মিলটা দেখে নেব।
ঠিক আছে তবে তাই হোক। একটি সাম্পান ভিড়েছিল আমরা জিনিসপত্র নিয়ে তাতে উঠে পড়ি।
ওপারে নদীর ধারেই মগবাজার। সকাল থেকেই লক্ষ্য করছি মুজতবার মুখটাকে দেখাচ্ছে বেশ কালো আর বিমর্ষ, কথা বলছে ঠিকই কাজও করছে কিন্তু ভেতরে যেন অন্য চিন্তা! তিক্ত কিছু গভীর কিছু। সাম্পানের পেছনদিকে বসে এখনো সে মাথাটা নিচু করে আছে।
কাছাকাছিই বসেছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কি ব্যাপার হে! রাধারানির সঙ্গে ঝগড়া করে এলে নাকি?
আরে ছছাঃ রাধারানি! মুজতবা চরম তাচ্ছিল্যব্যঞ্জক একটা মুখভঙ্গি করে চুপ মেরে গেল। মাথা একটু তুলে বলল, জানিস্ জাহেদ জীবনটাকে আমার মনে হয় একেবারে অর্থহীন অ্যাবসার্ড। ইটস এ টেল টোল্ড বাই অ্যান ইডিয়ট ফুল অব সাউন্ড অ্যান্ড ফিউরি অ্যান্ড সিগনিফায়িং নাথিং!
হঠা–ৎ! আমি জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে তাকাই।
হঠাৎ নয়! এটাই আমার বরাবরের মনোভাব। গোটা জিনিসটাই যখন নিরর্থক তখন একে নিয়ে এতো ভাবনার কি আছে। যা হবার হবে। ভালোভাবেই হোক আর মন্দভাবেই হোক গন্তব্য সেই একই ধ্বংস মৃত্যু বিলুপ্তি!
এযে দেখছি অন্যরূপ, অথবা এই সর্বাত্মক আস্থাহীনতাই কি ওর উচ্ছল জীবনযাত্রার উৎস?
কিন্তু মাথায় রোদ, এখন কিছু চিন্তা করবার সময় নয়; সাম্পানটা পাড়ে এসে লাগলে আমরা উঠে পড়ি। আড়াইটে বাজছে, খাওয়া দাওয়া শেষ? এখন ছবি বিছানায় কাত হয়ে নিশ্চয়ই ভাবছে আমার কথা। আরে হ্যাঁ ও বারবার মিনতি করে বলেছিল পৌঁছেই একটা চিঠি দিতে, চট্টগ্রামে সেকথা মনেই হয়নি। এখান থেকে লিখতে হবে। ও আদর করতে করতে আরো বলেছিল ঠিক সময়ে খেয়ো ঠিক সময়ে ঘুমিও যেন। শরীরটা একটু এদিক-সেদিক হলে দেখা যাবে!
আমার শরীরটা ছবির সম্পত্তি এবং যতটুকু তার জৌলুস তা গত কয় মাসে ওরই হাতে গড়া। কাজেই বললাম তোমার জিনিস আমি নষ্ট করবো পাগল!
কিন্তু ওটা ছিল কথার কথামাত্র। কারণ শুধু আমি নয় ও নিজেও জানত যে-কাজে বেরুচ্ছি তাতে সমায়ানুবর্তিতা অসম্ভব।
ওপরে উঠতেই দেখি ছোট্ট বাজার। একধারে দাঁড়ালে অন্য প্রান্তটুকু পর্যন্ত দেখা যায়। বাঁশের চালাঘর আছে কয়েকটা, মাঝখানে একটি বটগাছ। পুরোপুরি বিকেল হয়নি তবু জায়গাটা লোকজনে ঠাসা। পরে জানতে পেরেছি সকাল থেকেই বাজার বসে এবং সন্ধ্যার ঘণ্টাখানেক আগে শেষ হয়ে যায়। এরপরে যারা থাকে তারা একান্ত কাছের বাসিন্দা। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখি। রোজকার দরকারি জিনিসপত্র। ধানচাল তরিতরকারি তাঁতেবোনা কাপড়চোপড় এলুমিনিয়ামের তৈরি সস্তা অলঙ্কার। পাইপ তামাক বাঁশের চোঙের দই চুরুট কিন্তু নতুন যা চোখ পড়লে সে হলো পুরুষের চাইতে মেয়ের সংখ্যা কম নয়। পরনে নকশি কাজ করা শাড়ি বুকে বাঁধা একখণ্ড চিত্রিত কাপড় গোলগাল স্বাস্থ্যবান চেহারার তরুণীরাও নিরুদ্বেগে জিনিস নিয়ে বসে আছে। কেউ কেউ কিনছে জিনিস। পাঁচ ছমাইল দূর থেকে যারা আসে তারা বেচাকেনা করার পর বাঁশের ঝাপিটা পিঠে বেঁধে ফিরে চলেছে।
বটগাছের একটা শিকড়ের কাছে তিনটে মেয়ে বসে ছিল। এদের একটি বেশ সুন্দরী। কাটা চেহারা। ওদের সামনে হাতের তৈরি চুরুট।
মুজতবা কাছে গিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে আধা চাঁটগাই আধা হিন্দি ভাষায় আলাপ শুরু করে। ওরা সব বুঝেছে এমন নয় তবু উত্তরও দিচ্ছে। প্রত্যেকের মুখেই নিরীহ সরল হাসি।
মুজতবা তুলি কাগজ দেখিয়ে ওর অদ্ভুত ভাষায় জিজ্ঞেস করল, ছবি আঁকলে ওদের আপত্তি আছে কিনা। সেজন্য রুপেয় বখশিস দিতেও সে রাজি।
তিনজনের মধ্যে সবার বড় গোলগাল মেয়েটি আভাস ইঙ্গিতে জবাব দিল, এখানে সম্ভব নয় বাড়িতে গেলে রাজি হতে পারে।
ওরা যখন আলাপ করছিল আমি মুখ তুলতেই দেখি লুঙিপরা গায়ে জামা মাঝবয়েসী একটা মগ কিছুদূরে দাঁড়িয়ে বুলডগের মতো তাকিয়ে আছে। সে কে? এমন ভাব কেন? ছোট ছোট চোখ যেন জ্বলছে একেকবার। ভাবি এমনভাবে আলাপ করছে বলেই হয়তো! মুজতবাকে ধাক্কা দিয়ে ডাকলাম, এই! আর কত ওঠ না?
কেন হয়েছে কি? বলে মুখটা তুলতেই ওর দৃষ্টিও পড়ল গিয়ে লোকটার দিকে। এবারে লোকটার ঠোঁটমুখ কাঁপছে যেন। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিয়েছে! মুজতবার চেহারা নিমেষে ছাইবর্ণ। সে তাড়াতাড়ি উঠে বলল, চল্।
সবজিবাহী তিনমাঝির একটি লম্বাটে নৌকো কাপ্তাই যাচ্ছিল, এক কথায় দু’টাকায় রফা করে উঠে পড়া গেল। নৌকো দুইদাঁড়ের টানে এগিয়ে চলেছে। নদীর দুই পাড়ে ঝোঁপঝাড় কিন্তু সেদিকে আমার খেয়াল নেই। আমি ভাবছিলাম অন্য বিষয়। ব্যাপারটা কেমন রহস্যময় ঠেকছে। যতক্ষণ না নৌকাটা ঝাঁপসা হয়ে আসে ততক্ষণ নড়েনি। মুজতবাকে একবার মাত্র জিজ্ঞেস করলাম, কিহে কি ব্যাপার!
সে অন্যমনস্কভাবে বলল, কিছু না, ছাইলাউংফা মগ!
আমি আরো কিছু জানতে চাইলাম কিন্তু ওর চেহারা দেখে দমে যাই। কেমন কঠিন আর কালো। সে আমার পরিচিত সঙ্গীটি যেন নয়।
কাপ্তাই খালের কাছাকাছি বনবিভাগের বাংলোতে যখন এসে পৌঁছি তখন সন্ধ্যে হওয়ার সামান্য বাকি। একটা ঘরে জিনিসপত্রগুলো রাখার পর মুজতবা চৌকিতে শুয়ে পড়ল। আমিও একটা ইজিচেয়ারে কাত হলাম। সকাল থেকে এতটুকু বিশ্রামের সুযোগ পাওয়া যায়নি।
কাছেই কোথায় ছিল নিম দাড়িওয়ালা বাবুর্চি মাজু মিঞা, এসেই অবাক হয়ে গেল, স্যার যে! কখন আইলেন?
মুজতবা মাথাটু একটু তুলে জিজ্ঞেস করল, এই তো এক্ষুণি! তোমার সায়েব কোথায়?
জঙ্গলে গেছেন! মাজু মিঞা বলল, আওনের সময় অইছে।
ভালো আছ তো সব? এবার সে উঠে বসে পকেট থেকে প্যাকেটা বার করে একটা সিগারেট ধরালো।
সিগারেটটা পুড়ে অর্ধেক না হতেই শাহাদাঁতের গলা শোনা গেল। তার পায়ে বুট পরনে হাফপ্যান্ট কাঁধে বন্দুক এবং সামনে পিওন পেছনে দারোয়ান। বেঁটে খাটো ছেলেটি কিন্তু নাকি দাপট প্রচণ্ড। সহকারী বন অফিসার হলেও কি হবে এই জবরদস্ত লোকগুলোও বড় অফিসারের চেয়ে তাকে ভয় করে বেশি, প্রায় যমের মতো।
শাহাদাৎ বাংলোতে ঢুকে মুজতবাকে দেখেই বলল, এলেই শেষ পর্যন্ত। বেশ, ইটস্ ওক্যা। আমার ঝক্কি একটু বাড়লো আর কি। তুমি আবার কিছু মনে করো না জাহেদ, একটা পার্সোনাল ব্যাপার আছে। মাজু! মাজু!
চিলের ডাকের মতো সাহেবের চিৎকার শুনে মাজু মিঞা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো। বলল, জি সাব।
তোমার বাজার-সওদা ঠিক আছে তো? দুই সাহেব এসেছেন।
সব আছে, স্যার। তবে কিছু হলদি গরম-মশলা আর পান সুপারি আনতে অইব। আজগা মুর্গিই ধইরা ফালাই।
মাজু মিঞাকে বিদায় দিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে শাহাদাৎ জিজ্ঞেস করল, তারপর? তোমার খবর কি, জাহেদ? শুনলাম বিয়ে করেছ!
আমার বিয়ের খবর এই জঙ্গলে পর্যন্ত এসে গেছে! আশ্চর্য।
আশ্চর্য কিছু নয়, তোমরা হলে গিয়ে এখন বিখ্যাত লোক।
ঢাকায় গিয়েছিলে নাকি?
আরে না গেলেও সব খবর পাই। এই শ্রীমানই লিখেছিল। বলে মুজতবার দিকে বা হাতের বুড়ো আঙুলটা নির্দেশ করল।
দু’বছর আগে মুজতবা একবার এসে এখানে মাসখানেক কাটিয়ে গেছে জানি; কিন্তুই তবু এমন বিমর্ষ হয়ে থাকার কোনো মানে বুঝতে পারছি না। সে চুপচাপ ধূমপান করছে।
গত রাতটা কেটেছে ট্রেনে কাজেই কিছু ঢুলেছি শুধু, ঘুমাতে পারিনি। দিনের বেলাতেও তা পুষিয়ে নেবার সুযোগ ছিলো না। রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার আগেই চোখ জড়িয়ে আসছিল; কিন্তু ক্ষিদের মার ভয়ানক। ভালো রান্না, গলা ইস্তক পুরে নেওয়া গেল। বারান্দায় ওদের সঙ্গে বসে একটা সিগারেট শেষ করার পর চলে এলাম। বিছানায়।
কিন্তু বসেই থাকে ওরা দু’জন। পাহাড়ি রাত, কৃষ্ণপক্ষের খণ্ডচাঁদ শালবনের ওপরে দেখা দেয় শেষরাত্রে; কিন্তু এখন অন্ধকার। বাংলোর আশপাশে পোকা-মাকড়ের রিঝি ঝিঁঝি একটানা সঙ্গীত এবং মগপল্লীতে মাঝে মাঝে কুকুরের ঘেউঘেউ। এছাড়া আর বিশেষ কোনো শব্দ নেই।
আমার চৌকিটা জানালার সঙ্গেই, কাজেই ওদের দুজনকেই দেখতে পাচ্ছি আবছা মতো। দু’টি সিগারেটের দুই বিন্দু আগুন। দু’জনেই নীরব রইল খানিকক্ষণ। এরপর শাহাদাৎ নিচুস্বরে বলল, এত করে মানা করলাম, তুই না এলেই পারতিস্ মুজতবা । এখানে তো তোর নতুন কিছু করার নেই। যা হবার হয়ে গেছে, আবার ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ কি।
আমি চোখ বুজে আছি কিন্তু কানখাড়া। মুজতবা বেতের চেয়ারে নড়েচড়ে বসল। পরে বলল, লাভ-লোকসান আমি বুঝি না। কেবল না এসে ভালো লাগছিল না একথা ঠিক। বিপদ আর কি হবে, মৃত্যুর ওপরে তো কিছু নেই? জীবন আর মৃত্যু আমার কাছে সমান। আর জীবনকে দেখার জন্য যে মৃত্যু তা’তো অভিনন্দনযোগ্য।
বড় কথা রাখ্। তুই যা করেছি তা কিন্তু কিছুতেই ক্ষমা করা যায় না। আমি হলে তো গুলী করে মারতাম। ছাইলাউংকা তোকে খুঁজছে নানা জায়গায়, এখানেও এসেছে কয়েকদিন। পেয়ে গেলে প্রতিশোধ নিতে ছাড়বে না। জংলি মানুষ, খুব সাংঘাতিক, ক্ষেপলে খতম না করে শান্ত হয় না। বিশেষ এখানে জীবন নিয়ে খেলা। ওর একমাত্র মেয়ে তিনা, তাকে তুই নষ্ট করেছি।
আমি তো নষ্ট করিনি? সে তো ইচ্ছে করেই ধরা দিয়েছিল।
হ্যাঁ। কিন্তু ওরা ইচ্ছে করে ধরা দেয় কখন? যখন একজনকে ভালোবাসে। তার মানে হলো, চুংমুংলে’র সুমুখে এক শুকর তিন মুর্গি বলি না দিলেও সে তাকে স্বামী হিসেবেই ভাবে। কিন্তু তুই তো পালিয়ে গেলি? এ নিছক ধাপ্পা। তিনা তোকে মনপ্রাণ দিয়েই ভালোবেসেছিল, তাই না পাগল হয়ে গেল। এ অঞ্চলের কে না জানে। মহা কেলেঙ্কারি। আধ পাগল অবস্থায় ছেলে হলো ওর এবং যে ক’দিন শিশুটি জীবিত ছিল একদম ভালো। ও যেন সব ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু একদিনের জ্বরে ছেলেটা মারা যাওয়ার পর থেকে এখন বদ্ধ পাগল। গুনগুন্ করে গান গায় আর পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ায়। কয়দিন রাত্রে এখানে এসেছে। চিলড়ে বড় উৎপাত করে।
আবার অনেকক্ষণ দুজনেই চুপ। এক সময় বহুদূর থেকে যেন মুজতবার ম্লানস্বর বেরিয়ে এলো, অনেক খারাপ কাজ করেছি; কিন্তু এভাবে কোথাও ধরা পড়িনি!
ধরা লোকে একবারই পড়ে তাই হয়তো! কি আছে, একটু সাবধানে থাকতে হবে আর কি! চল্, শুয়ে পড়া যাক! শাহাদাৎ উঠতেই শোনে গেটে কিকি করে একটা শব্দ হলো, ছায়ামূর্তির মতো একটা লোক ভেতরে এসে দাঁড়িয়েছে। সে তৎক্ষণাৎ তির্যকস্বরে প্রশ্ন করে উঠল, কে? কে ওখানে?
মুজতবা বলল, ব্যাপার কি!
সেদিকে কান না দিয়ে শাহাদাৎ ডাকল, সালামত! সালামত! আমার বন্দুকটা নিয়ে আয় জলদি!
আমি উঠে কখন বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছি বলতে পারবো না। বন্দুকের কথা শোনামাত্র আবার কিকি শব্দ। এবার দ্রুত। আমরা দেখি একটা লোক সত্যি বাইরে বেরিয়ে গেল। বন্দুক আর টর্চ নিয়ে এসে অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করেও আর পাত্তা মিললো না তার।
আমার হৃৎপিণ্ডটা ঢিবৃঢ়ি করছে! এই নির্জন এলাকায় সবকিছুই ঘটা সম্ভব।
মুজতবা আস্তে আস্তে বলল, আমার মনে হয় ছাইলাউংফা। আসবার সময় মগবাজারে আমাদের দেখছিল!
তাই নাকি? শাহাদাৎ বলল, তাহলে সত্যি বিপদ।
এত ভয় পাবার কি আছে! বেশি বাড়াবাড়ি করলে জানটা হারাবে। মুজতবার কণ্ঠস্বরে একটা অশ্লীল হিংস্র উল্লাসের রেশ। সবদিক ভেবেচিন্তেই সে এখানে এসেছে।
রাত্রে পাহারার ব্যবস্থা করা হল! খানিকটা নিশ্চিন্ত থাকায় আমরা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঈষৎ কুয়াশার আমেজ, সকালটা সত্যিই মধুর। সালামত বলল ছায়ামূর্তির মতো একটা লোক দুতিনবার প্রাঙ্গণে ঢুকবার চেষ্টা করেছে কিন্তু বন্দুকের নল দেখে সাহস পায়নি। চা খাওয়ার পর মুজতবা বলল, চল বেরিয়ে পড়ি!
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোথায়?
মগপল্লীর দিকে। কাজ করতে এসেছি বসে থাকার জন্য নয়। ওর চেহারায় এমন দৃঢ়তা আমি না গেলে একাই যাবে। অগত্যা তৈরি হলাম।
নদীর পাড়ে ঘেঁষে নতুন শালবন এরপরে জঙ্গল এবং তার কাছাকাছি দিয়ে ছোট পাহাড়মালা। সীতাপাহাড়ের শাখাপ্রশাখা। পাহাড়ের ঢালুতে একটা মগপল্লী। আশপাশে জমিজিরাত কিছু আছে। বাড়িতে লাউ মাচান কলাবাগান। জুমিয়া মগেরা থাকে পাহাড়ের ওপরে মাচানের মতো উঁচু করে বাঁধা বাঁশের ঘরে কিন্তু সমতলে এরা জুমিয়া নয় দেশি লোকদের মতোই তাদের গিরস্তি ও ঘরসংসার। কিন্তু কাছে গিয়ে দেখি এখানে কোনো কোনো ঘর মাচানের মতো বাঁধা।
প্রকৃতি ও মানুষ সবকিছু ভালো লাগলেও একটা বিষয়ে আমার কৌতূহল বিশেষ জাগ্রত ছিল। তাই জিজ্ঞেস করলাম, তিনাদের বাড়ি কোথায়?
মুজতবা অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে সংক্ষিপ্তভাবে জানাল, এখানে নয়।
আর কিছু বলল না যেন এ ব্যাপারে আর কিছু জানবার অধিকার আমার নেই।
একটা বাড়ির উঠানে পা দিতেই কুকুর ঘেউঘেউ করে ওঠে। একটা লোক বাইরে এল। তার পেছনে দুটি মেয়ে এবং ন্যাংটা বাচ্চা কয়েকটি। মুজতবা কাছে গিয়ে গেলাস ধরার ভঙ্গিতে হাতটা মুখের কাছে নিয়ে পানি চায়। লোকটা হাসল। এরপর দুটো পিঁড়ি পেতে দিল বারান্দায়। আমরা পরপর পানি খেলাম। কাছে ঠকর ঠকর আওয়াজ হচ্ছিল, গলা বাড়িয়ে দেখি কয়েকটি মেয়ে তাঁতে কাপড় বোনায় ব্যস্ত। উঠতে গেলে কলাবাগানের পথে কলসীকাঁখে এলো আরেকটি ডাগর কিশোরী।
এক বাড়িতে বসেই পাহাড়ের টিপিকাল জীবনের অনেকগুলো স্কেচ করে ফেললাম। ছবি দেখে ওদের কি স্ফূর্তি। চাইতেই নাপপি এনে দিল। নাকের কাছে নেওয়া যায় না-ওয়াক থো সে কি দুর্গন্ধ, ওদের প্রিয় খাবার!
কেউ বর্ণনা না করলেও ছবি আঁকতে আঁকতে আমার কল্পনায় ভাসছিল তিনার চেহারা। ঐ যে তাঁত বুনছে তারই মতো মিষ্টি মুখোনি। অষ্টাদশী যুবতী কিন্তু চোখমুখ এখন উদ্ভ্রান্ত, হাহা করে হাসছে শুধু।
রাত্রে খাওয়া দাওয়া শেষে বারান্দায় বসেছিলাম আমরা। আকাশে তারার ঝলক। নদীর ওপারে তেমনি অন্ধকার, আশপাশে তেমনি আবছায়া। সিগারেট টানছি কিন্তু কারো মুখে কথা নেই। হঠাৎ একটা ঢিল এসে পড়ল পাকার ওপর, ভাঙা ইটের টিল, বেশ বড়। আমরা চমকে উঠে দাঁড়াই। শাহাদৎ তীক্ষ্ণস্বরে জিজ্ঞেস করে উঠল, কে? কে ওখানে? সালামত! বন্দুক লে আও। জলদি!
সঙ্গে সঙ্গে কাঁচের ঝাড় সশব্দে ভেঙে পড়ার মতো নারীকণ্ঠের একটা অট্টহাস্য হা হা হা হা, হি হি হি হি। শাহাদৎ বলল, এই যে তিনা।
তিনা! বিকারগ্রস্তের মতো উচ্চারণ করল মুজতবা।
শাহাদাৎ জোর দিয়ে বলল, হ্যাঁ, তিনা নিশ্চয়ই তিনা!
এবং তৎক্ষণাৎ বারান্দা থেকে একলাফে নেমে পড়ল মুজতবা । তিনার অট্টহাস্য দূরে সরে যাচ্ছিল, দুপদুপ পায়ে সে ছুটছে। খটাস্ করে গেটটা খুলে বেরিয়ে গেল। কি ঘটে যাচ্ছে একমুহূর্ত আমরা বিভ্রান্ত হতবাক। পর মুহূর্তে ঘোর কাটলে আমি বলে উঠলাম, সর্বনাশ মুজতবা যাচ্ছে! ও বিপদে পড়বে! চলো আমরা যাই পিছু পিছু! দেরি করো না চলো!
উত্তেজনায় কাঁপছিলাম কিন্তু শাহাদৎ নির্বিকার আমাকে থামিয়ে দিয়ে শান্ত গম্ভীর স্বরে বলল, দরকার নেই। পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে দে! তখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনি নিঝঝুম আকাশের তলে রাতের অন্ধকারে অরণ্যে নদীতে পাহাড়ে পাহাড়ে একটা ডাক ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে যাচ্ছে, তি-না!