০৯. শল্যপর্ব

শল্যপর্ব

॥ শল্যবধপর্বাধ্যায়॥

১। কৃপ-দুর্যোধন-সংবাদ

কৌরবপক্ষের দুরবস্থা দেখে সৎস্বভাব তেজস্বী বৃদ্ধ কৃপাচার্য কৃপাবিষ্ট হয়ে দুর্যোধনকে বললেন, মহারাজ, ক্ষত্রিয়ের পক্ষে যুদ্ধধর্মই শ্রেষ্ঠ, পিতা পুত্র ভ্রাতা মাতুল ভাগিনেয় সম্বন্ধী ও বান্ধবের সঙ্গেও ক্ষত্রিয়কে যুদ্ধ করতে হয়। যুদ্ধে মৃত্যুই ক্ষত্রিয়ের পরমধর্ম এবং পলায়নই অধর্ম। কিন্তু ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ জয়দ্ৰথ, তোমার ভ্রাতারা, এবং তোমার পুত্র লক্ষ্মণ, সকলেই গত হয়েছেন, আমরা কাকে আশ্রয় করব? সাধুস্বভাব পাণ্ডবদের প্রতি তোমরা অকারণে অসদ্ব্যবহার করেছ, তারই ফল এখন উপস্থিত হয়েছে। বৎস, যুদ্ধে সাহায্যের জন্য তুমি যেসকল যোদ্ধাকে আনিয়েছ তাদের এবং তোমার নিজেরও প্রাণসংশয় হয়েছে, এখন তুমি আত্মরক্ষা কর। বৃহস্পতির নীতি এই-বিপক্ষের চেয়ে ক্ষীণ হলে অথবা তার হলে সন্ধি করবে, বলবান হলে যুদ্ধ করবে। আমরা এখন হীনবল, অতএব পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি করাই উচিত। ধৃতরাষ্ট্র ও কৃষ্ণ অনুরোধ করলে দয়ালু যুধিষ্ঠির নিশ্চয় তোমাকে রাজপদ দেবেন, ভীম অর্জুন প্রভৃতিও সম্মত হবেন।

শোকাতুর দুর্যোধন কিছুকাল চিন্তা করে বললেন, সুহৃদের যা বলা উচিত আপনি তাই বলেছেন, প্রাণের মায়া ত্যাগ করে আপনি পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধও করেছেন। ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ, মুমূর্ষুর যেমন ঔষধে রুচি হয় না সেইরূপ আপনার যুক্তিসম্মত হিতবাক্য আমার ভাল লাগছে না। আমরা যুধিষ্ঠিরকে রাজ্য থেকে নির্বাসিত করেছিলাম, তার প্রেরিত দূত কৃষ্ণকেও প্রতারিত করেছিলাম; এখন তিনি আমার অনুরোধ শুনবেন কেন? আমরা অভিমন্যুকে বিনষ্ট করেছি, কৃষ্ণ ও অর্জুন আমাদের হিতাচরণ করবেন কেন? কোপনস্বভাব ভীম উগ্র প্রতিজ্ঞা করেছে, সে মরবে তবু নত হবে না। যমতুল্য নকুল-সহদেব অসি ও চর্ম ধারণ করেই আছে; ধৃষ্টদ্যুম্ন ও শিখণ্ডীর সঙ্গেও আমার শত্রুতা আছে। দূতসভায় সকলের সমক্ষে যিনি নির্যাতিত হয়েছিলেন সেই দ্রৌপদী আমার বিনাশ ও ভর্তৃগণের স্বার্থসিদ্ধির জন্য উগ্র তপস্যা করছেন, তিনি প্রত্যহ হোমস্থানে শয়ন করেন; কৃষ্ণভগিনী সুভদ্রা অভিমান ও দর্প ত্যাগ করে সর্বদা দাসীর ন্যায় দ্রৌপদীর সেবা করেন। এইসকল কারণে এবং বিশেষত অভিমন্যুবধের ফলে যে বৈরানল প্রজ্বলিত হয়েছে তা নির্বাপিত হয়নি, অতএব কি করে পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি হবে? সাগরাম্বরা পৃথিবীর রাজা হয়ে আমি কি করে পাণ্ডবদের প্রসাদে রাজ্য ভোগ করব, দাসের ন্যায় যুধিষ্ঠিরের পিছনে যাব, আত্মীয়দের সঙ্গে দীনভাবে জীবিকানির্বাহ করব? এখন ক্লীবের ন্যায় আচরণের সময় নয়, আমাদের যুদ্ধ করাই উচিত। যে বীরগণ আমার জন্য নিহত হয়েছেন তাদের উপকার স্মরণ করে এবং তাদের ঋণ শোধের বাসনায় আমার রাজ্যের প্রতিও আর রুচি নেই। পিতামহ ভ্রাতা ও বয়স্যগণকে নিপাতিত করে যদি আমি নিজের জীবন রক্ষা করি তবে লোকে নিশ্চয় আমার নিন্দা করবে। আমি যুধিষ্ঠিরকে প্রণিপাত করে রাজ্যলাভ করতে চাই না, বরং ন্যায়যুদ্ধে হত হয়ে স্বর্গলাভ করব।

দুর্যোধনের কথা শুনে ক্ষত্রিয়গণ প্রশংসা করে সাধু সাধু বলতে লাগলেন এবং পরাজয়ের জন্য শোক না করে যুদ্ধের নিমিত্ত ব্যগ্র হলেন। তারপর তারা বাহনদের পরিচর্যা করে হিমালয়ের নিকটবর্তী বৃক্ষহীন সমতল প্রদেশে গেলেন এবং অরুণবর্ণ সরস্বতী নদীতে স্নান ও তার জল পান করলেন। সেখানে কিছুকাল থেকে তারা দুর্যোধন কর্তৃক উৎসাহিত হয়ে রাত্রিবাসের জন্য শিবিরে ফিরে এলেন।

২। শল্যের সেনাপতিত্বে অভিষেক

কৌরবপক্ষীয় বীরগণ দুর্যোধনকে বললেন, মহারাজ, আপনি সেনাপতি নিযুক্ত করে যুদ্ধ করুন, আমরা তৎকর্তৃক রক্ষিত হয়ে শত্রু জয় করব। দুর্যোধন রথারোহণে অশ্বত্থামার কাছে গেলেন—যিনি তেজে সূর্যতুল্য, বুদ্ধিতে বৃহস্পতিতুল্য, যাঁর পিতা অযোনিজ এবং মাতাও অযোনিজা, যিনি রূপে অনুপম, সর্ববিদ্যার পারগামী এবং গুণের সাগর। দুর্যোধন তাকে বললেন, গুরুপুত্র, এখন আপনিই আমাদের পরমগতি, আদেশ করুন কে আমাদের সেনাপতি হবেন।

অশ্বত্থামা বললেন, শল্যের কুল রূপ তেজ যশ শ্রী ও সর্বপ্রকার গুণই আছে, ইনিই আমাদের সেনাপতি হন। এই কৃতজ্ঞ নরপতি নিজের ভাগিনয়েদের ত্যাগ করে আমাদের পক্ষে এসেছেন। ইনি মহাসেনার অধীশ্বর এবং দ্বিতীয় কার্তিকের ন্যায় মহাবাহু। দুর্যোধন ভূমিতে দাঁড়িয়ে কৃতাঞ্জলি হয়ে রথস্থ শল্যকে বললেন, মিত্রবৎসল, মিত্র ও শত্ৰু পরীক্ষা করবার সময় উপস্থিত হয়েছে, আপনি আমাদের সেনার অগ্রে থেকে নেতৃত্ব করুন, আপনি রণস্থলে গেলে মন্দমতি পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণ এবং তাদের অমাত্যবর্গ নিরুদ্যম হবে। মদ্রাধিপ শল্য উত্তর দিলেন, কুরুরাজ, তুমি আমাকে দিয়ে যা করাতে চাও আমি তাই করব, আমার রাজ্য ধন প্রাণ সবই তোমার প্রিয়সাধনের জন্য। দুর্যোধন বললেন, বীরশ্রেষ্ঠ অতুলনীয় মাতুল, আপনাকে সেনাপতিত্বে বরণ করছি, কার্তিক যেমন দেবগণকে রক্ষা করেছিলেন সেইরূপ আপনি আমাদের রক্ষা করুন। শল্য বললেন, দুর্যোধন, শোন-কৃষ্ণ আর অর্জুনকে তুমি রথিশ্রেষ্ঠ মনে কর, কিন্তু তারা বাহুবলে কিছুতেই আমার তুল্য নন। আমি ক্রুদ্ধ হলে সুরাসুর ও মানব সমেত সমস্ত পৃথিবীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারি, পাণ্ডবরা তো দূরের কথা। আমি সেনাপতি হয়ে জয়লাভ করব এতে সন্দেহ নেই।

দুর্যোধন শল্যকে যথাবিধি সেনাপতির পদে অভিষিক্ত করলেন। সৈন্যেরা সিংহনাদ করে উঠল, নানাপ্রকার বাদ্যধ্বনি হল কৌরব ও মদ্রদেশীয় যোদ্ধারা হৃষ্ট হয়ে শল্যের স্তুতি করতে লাগলেন। সকলে সেই রাত্রিতে সুখে নিদ্রা গেলেন।

পাণ্ডবশিবিরে যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে বললেন, মাধব, দুর্যোধন মহাধনুর্ধর শল্যকে সেনাপতি করেছেন। তুমিই আমাদের নেতা ও রক্ষক, অতএব এখন যা কর্তব্য তার ব্যবস্থা কর। কৃষ্ণ বললেন, ভরতনন্দন, আমি শল্যকে জানি, তিনি ভীষ্ম দ্রোণ ও কর্ণের সমান অথবা তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। শল্যের বল ভীম অর্জুন সাত্যকি ধৃষ্টদ্যুম্ন ও শিখণ্ডীর অপেক্ষা অধিক। পুরুষশ্রেষ্ঠ, আপনি বিক্রমে শার্দুলতুল্য, আপনি ভিন্ন অন্য পুরুষ পৃথিবীতে নেই যিনি যুদ্ধে মদ্ররাজকে বধ করতে পারেন। তিনি সম্পর্কে মাতুল এই ভেবে দয়া করবেন না, ক্ষত্ৰধর্মকে অগ্রগণ্য করে শল্যকে বধ করুন। ভীষ্ম-দ্রোণ-কৰ্ণরূপ সাগর উত্তীর্ণ হয়ে এখন শল্য-রূপ গোস্পদে নিমজ্জিত হবেন না। এইপ্রকার উপদেশ দিয়ে কৃষ্ণ সায়ংকালে তার শিবিরে প্রস্থান করলেন। কর্ণবধে আনন্দিত পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণ সেই রাত্রিতে সুখে নিদ্রা গেলেন।

৩। শল্যবধ (অষ্টাদশ দিনের যুদ্ধ)

পরদিন প্রভাতে কৃপ কৃতবর্মা অশ্বত্থামা শল্য শকুনি প্রভৃতি দুর্যোধনের সঙ্গে মিলিত হয়ে এই নিয়ম করলেন যে তারা কেউ একাকী পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন না, পরস্পরকে রক্ষা করে মিলিত হয়েই যুদ্ধ করবেন। শল্য সর্বতোভদ্র নামক ব্যূহ রচনা করলেন এবং মদ্রদেশীয় বীরগণ ও কর্ণপুত্রদের সঙ্গে ব্যূহের সম্মুখে রইলেন। ত্রিগর্তসৈন্য সহ কৃতবর্মা ব্যূহের বামে, শক ও যবন সৈন্য সহ কৃপাচার্য দক্ষিণে, কাম্বােজ সৈন্য সহ অশ্বত্থামা পৃষ্ঠদেশে, এবং কুরুবীরগণ সহ দুর্যোধন ব্যূহের মধ্যদেশে অবস্থান করলেন। পাণ্ডবগণও নিজেদের সৈন্য বৃহবদ্ধ ও দ্বিধা বিভক্ত করে অগ্রসর হলেন। কৌরবপক্ষে এগার হাজার রথী, দশ হাজার সাত শ গজারোহী, দু লক্ষ অশ্বারোহী ও তিন কোটি পদাতি, এবং পাণ্ডবপক্ষে ছ হাজার রথী, ছ হাজার গজারোহী, দশ হাজার অশ্বারোহী ও দু কোটি পদাতি অবশিষ্ট ছিল।

দুই পক্ষের তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ হল। কর্ণপুত্র চিত্রসেন সত্যসেন ও সুশৰ্মা নকুলের হাতে নিহত হলেন। পাণ্ডবপক্ষের গজ অশ্ব রথী ও পদাতি সৈন্য শল্যের বাণে নিপীড়িত ও বিচলিত হল। সহদেব শল্যের পুত্রকে বধ করলেন। ভীমের গদাঘাতে শল্যের চার অশ্ব নিহত হল , শল্যও তোমর নিক্ষেপ করে ভীমের বক্ষ বিদ্ধ করলেন। বৃকোদর অবিচলিত থেকে সেই নোমর টেনে নিলেন এবং তারই আঘাতে শল্যের সারথির হৃদয় বিদীর্ণ করলেন। পরস্পরের প্রহারে দুজনেই আহত ও বিহ্বল হলেন, তখন কৃপাচার্য শল্যকে নিজের রথে তুলে নিয়ে চ’লে গেলেন। ক্ষণকাল পরে ভীমসেন উঠে দাঁড়ালেন এবং মত্তের ন্যায় বিহ্বল হয়ে মদ্ররাজকে আবার যুদ্ধে আহ্বান করলেন।

দুর্যোধনের প্রাসের আঘাতে যাদববীর চেকিতান নিহত হলেন। শল্যকে অগ্রবর্তী করে কৃপাচার্য কৃতবর্মা ও শকুনি যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে এবং তিন হাজার রথী সহ অশ্বত্থামা অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। যুধিষ্ঠির তার ভ্রাতাদের এবং কৃষ্ণকে ডেকে বললেন, ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ ও অন্যান্য পরাক্রান্ত বহু রাজা কৌরবদের জন্য যুদ্ধ করে নিহত হয়েছেন, তোমরাও উৎসাহের সহিত নিজ নিজ কর্তব্যে পুরুষকার দেখিয়েছ। এখন আমার ভাগে কেবল মহারথ শল্য অবশিষ্ট আছেন, আজ আমি তাকে যুদ্ধে জয় করতে ইচ্ছা করি। বীরগণ, আমার সত্য বাক্য শোন—আজ শল্য আমাকে বধ করবেন অথবা আমি তাকে বধ করব, আজ আমি বিজয়লাভ বা মৃত্যুর জন্য ক্ষত্রধর্মানুসারে মাতুলের সঙ্গে যুদ্ধ করব। রথযোজকগণ (১) আমার রথে প্রচুর অস্ত্র ও অন্যান্য উপকরণ রাখুক; সাত্যকি দক্ষিণচক্র, ধৃষ্টদ্যুম্ন বামচক্র, এবং অর্জুন আমার পৃষ্ঠ রক্ষা করুন, ভীম আমার অগ্রে থাকুন; এতে আমার শক্তি শল্য অপেক্ষা অধিক হবে। যুধিষ্ঠিরের প্রিয়কামিগণ তার আদেশ পালন করলেন।

আমিষলোভী দুই শার্দুলের ন্যায় যুধিষ্ঠির ও শল্য বিবিধ বাণ দ্বারা পরস্পর প্রহার করতে লাগলেন, ভীম ধৃষ্টদ্যুম্ন সাত্যকি এবং নকুল-সহদেবও শকুনি প্রভৃতির সঙ্গে যুদ্ধে রত হলেন। কৌরবগণ আশ্চর্য হয়ে দেখলেন, কুন্তীপুত্র যুধিষ্ঠির যিনি পূর্বে মৃদু ও শান্ত ছিলেন, এখন তিনি দারুণ হয়েছেন, এবং ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে ভল্লের আঘাতে শতসহস্র যোদ্ধাকে বধ করছেন। যুধিষ্ঠির শল্যের চার অশ্ব ও দুই পৃষ্ঠসারথিকে বিনষ্ট করলেন, তখন অশ্বত্থামা বেগে এসে শল্যকে নিজের রথে তুলে নিয়ে চ’লে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে শল্য অন্য রথে চড়ে পুনর্বার যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে যুদ্ধে রত হলেন।

শল্যের চার বাণে যুধিষ্ঠিরের চার অশ্ব নিহত হল , তখন ভীমসেনও শস্যের চার অশ্ব ও সারথিকে বিনষ্ট করলেন। শল্য রথ থেকে নেমে খড়্গ ও চর্ম নিয়ে যুধিষ্ঠিরের প্রতি ধাবিত হলেন, কিন্তু ভীমসেন শরাঘাতে শল্যের চর্ম এবং ভল্ল দ্বারা তার খড়গের মুষ্টি ছেদন করলেন। যুধিষ্ঠির তখন গোবিন্দের বাক্য স্মরণ করে শল্যবধে যত্নবান হলেন। তিনি অশ্বসারথিহীন রথে আরূঢ় থেকেই একটি স্বর্ণের ন্যায় উজ্জ্বল মন্ত্রসিদ্ধ শক্তি অস্ত্র নিলেন, এবং পাপী, তুমি হত হলে’–এই বলে বিস্ফারিত দীপ্তনয়নে মদ্ররাজকে লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করলেন। প্রলয়কালে আকাশ থেকে পতিত মহতী উল্কার ন্যায় সেই শক্তি অস্ত্র স্ফুলিঙ্গ ছড়াতে ছড়াতে মহাবেগে শল্যের অভিমুখে গেল, এবং তাঁর শুভ্র বর্ম ও বিশাল বক্ষ বিদীর্ণ করে জলের ন্যায় ভূমিতে প্রবিষ্ট হল। বজ্রাহত পর্বতশৃঙ্গের ন্যায় শল্য বাহু প্রসারিত করে ভূমিতে পড়ে গেলেন।

শল্য নিপতিত হলে তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা রথারোহণে যুধিষ্ঠিরের দিকে ধাবিত হলেন এবং বহু নারাচ নিক্ষেপ করে তাকে বিদ্ধ করতে লাগলেন। যুধিষ্ঠির শল্যভ্রাতার ধনু ও ধ্বজ ছেদন করে ভল্লের আঘাতে তার মস্তক দেহচ্যুত করলেন। কৌরবসৈন্য ভগ্ন হয়ে হাহাকার করে পালাতে লাগল।

শল্য নিহত হলে তার অনুচর সাত শ রথী কৌরবসেনা থেকে বেরিয়ে এলেন। সেই সময়ে একটি পর্বতাকার হস্তীতে চড়ে দুর্যোধন সেখানে এলেন; একজন তার মস্তকের উপর ছত্র ধরেছিল, আর একজন তাকে চামর বীজন করছিল। দুর্যোধন বার বার মদ্ৰযোদ্ধাদের বললেন, যাবেন না, যাবেন না। অবশেষে তারা দুর্যোধনের অনুরোধে পুনর্বার পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেন। শল্য হত হয়েছেন এবং মদ্রদেশীয় মহারথগণ ধর্মরাজকে পীড়িত করছেন শুনে অর্জুন সত্বর সেখানে এলেন, ভীম নকুল সহদেব সাত্যকি প্রভৃতিও যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করবার জন্য বেষ্টন করলেন। পাণ্ডবগণের আক্রমণে মদ্রবীরগণ বিনষ্ট হলেন, তখন দুর্যোধনের সমস্ত সৈন্য ভীত ও চঞ্চল হয়ে পালাতে লাগল। বিজয়ী পাণ্ডবগণ শঙ্খধ্বনি ও সিংহনাদ করতে লাগলেন।

** (১) যারা রথে যুদ্ধোপকরণ যোগান দেয়।

৪। শাল্ববধ (অষ্টাদশ দিনের আরও যুদ্ধ)

ভারতের মধ্যাহ্নকালে যুধিষ্ঠির শল্যকে বধ করলেন, কৌরবসেনাও পরাজিত হয়ে যুদ্ধে। পরাঙ্মুখ হল। পাণ্ডব ও পাঞ্চাল সৈন্যগণ বলতে লাগল, আজ ধৈর্যশালী যুধিষ্ঠির জয়ী হলেন, দুর্যোধন রাজশ্রীহীন হলেন। আজ ধৃতরাষ্ট্র পুত্রের মৃত্যুসংবাদ শুনবেন। এবং শোকাকুল হয়ে ভূমিতে পড়ে নিজের পাপ স্বীকার করবেন। আজ থেকে দুর্যোধন দাস হয়ে পাণ্ডবদের সেবা করবেন এবং তারা যে দুঃখ পেয়েছেন তা বুঝবেন। যুধিষ্ঠির ভীমার্জুন নকুল-সহদেব, ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী ও দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র যে পক্ষের যোদ্ধা সে পক্ষের জয় হবে না কেন? জগন্নাথ জনার্দন কৃষ্ণ যাঁদের প্রভু, যাঁরা ধর্মকে আশ্রয় করেছেন, সেই পাণ্ডবদের জয় হবে না কেন?

ভীমসেনের ভয়ে ব্যাকুল হয়ে কৌরবসৈন্য পালাচ্ছে দেখে দুর্যোধন তার সারথিকে বললেন, তুমি ওই সৈন্যদের পশ্চাতে ধীরে ধীরে রথ নিয়ে চল, আমি রণস্থলে থেকে যুদ্ধ করলে আমার সৈন্যেরা সাহস পেয়ে ফিরে আসবে। সারথি রথ নিয়ে চলল, তখন হস্তী অশ্ব ও রথবিহীন একুশ হাজার পদাতি এবং নানাদেশজাত বহু যোদ্ধা প্রাণের মায়া ত্যাগ করে পুনর্বার যুদ্ধে প্রবৃত্ত হল। ভীমসেন তার স্বর্ণমণ্ডিত বৃহৎ গদার আঘাতে সকলকেই নিষ্পেষিত করলেন। দুর্যোধন তার পক্ষের অবশিষ্ট সৈন্যদের উৎসাহ দিতে লাগলেন, তারা বার বার ফিরে এসে যুদ্ধে রত হল , কিন্তু প্রতি বারেই বিধ্বস্ত হয়ে পালাল।

দুর্যোধনের একটি মহাবংশজাত প্রিয় হস্তী ছিল, গজশাস্ত্রজ্ঞ লোকে তার পরিচর্যা করত। ম্লেচ্ছাধিপতি শান্তু সেই পর্বতাকার হস্তীতে চ’ড়ে যুদ্ধ করতে এলেন এবং প্রচণ্ড বাণবর্ষণ করে পাণ্ডবসৈন্যদের যমালয়ে পাঠাতে লাগলেন। সকলে দেখলে, সেই বিশাল হস্তী একাই যেন বহু সহস্র হয়ে সর্বত্র বিচরণ করছে। পাণ্ডব-সেনা বিমর্দিত হয়ে পালাতে লাগল। তখন ধৃষ্টদ্যুম্ন বেগে ধাবিত হয়ে বহু নারাচ নিক্ষেপ করে সেই হস্তীকে বিদ্ধ করলেন। শাল্ব অঙ্কুশ প্রহার করে হস্তীকে ধৃষ্টদ্যুম্নের রথের দিকে চালিয়ে দিলেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন ভয় পেয়ে রথ থেকে নেমে পড়লেন, তখন সেই হস্তী শুণ্ড দ্বারা অশ্ব ও সারথি সমেত রথ তুলে নিয়ে ভূতলে ফেলে নিষ্পেষিত করলে। ভীম শিখণ্ডী ও সাত্যকি শরাঘাতে হস্তীকে বাধা দেবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু তাকে থামাতে পারলেন না। বীর ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁর পর্বতশৃঙ্গাকার গদা দিয়ে হস্তীর কুম্ভদেশে (মস্তকপার্শ্বস্থ দুই মাংসপিণ্ডে) প্রচণ্ড আঘাত করলেন। আর্তনাদ ও রক্তবমন করে সেই গজেন্দ্র ভূপতিত হল তখন ধৃষ্টদ্যুম্ন ভল্লের আঘাতে শাল্বের শিরচ্ছেদ করলেন।

৫। উলূক-শকুনি-বধ (অষ্টাদশ দিনের আরও যুদ্ধ)

মহাবীর শাল্ব নিহত হলে কৌরবসৈন্য আবার ভগ্ন হল। রুদ্রের ন্যায় প্রতাপবান দুর্যোধন তথাপি অদম্য উৎসাহে বাণবর্ষণ করতে লাগলেন, পাণ্ডবগণ মিলিত হয়েও তার সম্মুখে দাঁড়াতে পারলেন না। অশ্বত্থামা শকুনি উলূক এবং কৃপাচার্যও পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। দুর্যোধনের আদেশে সাত শ রথী যুধিষ্ঠিরকে আক্রমণ করলেন, কিন্তু পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণের হস্তে তারা নিহত হলেন। তারপর নানা দিকে বিশৃঙ্খল ভাবে যুদ্ধ হতে লাগল। গান্ধাররাজ শকুনি দশ হাজার প্রাসধারী অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে এলেন, কিন্তু তার বহু সৈন্য নিহত হল। ধৃষ্টদ্যুম্ন দুর্যোধনের অশ্ব ও সারথি বিনষ্ট করলেন, তখন দুর্যোধন একটি অশ্বের পৃষ্ঠে চড়ে শকুনির কাছে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে অশ্বত্থামা কৃপাচার্য ও কৃতবর্মা তাঁদের রথারোহী যোদ্ধাদের ত্যাগ করে শকুনি-দুর্যোধনের সঙ্গে মিলিত হলেন।

ব্যাসদেবের বরে সঞ্জয় দিব্যচক্ষু লাভ করে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে উপস্থিত থাকতেন এবং প্রতিদিন যুদ্ধশেষে ধৃতরাষ্ট্রকে যুদ্ধবৃত্তান্ত জানাতেন (১)। কৌরবসৈন্য ক্ষীণ এবং শত্রুসৈন্য বেষ্টিত হয়েছে দেখে সঞ্জয় ও চার জন যোদ্ধা প্রাণের মায়া ত্যাগ করে ধৃষ্টদ্যুম্নের সৈন্যদের সঙ্গে কিছুক্ষণ যুদ্ধ করলেন, কিন্তু অর্জুনের বাণে নিপীড়িত হয়ে অবশেষে যুদ্ধে বিরত হলেন। সাত্যকির প্রহারে সঞ্জয়ের বর্ম বিদীর্ণ হল , তিনি মূৰ্ছিত হলেন, তখন সাত্যকি তাকে বন্দী করলেন।

দুর্মর্ষণ শুতান্ত জৈত্র প্রভৃতি ধৃতরাষ্ট্রের দ্বাদশ পুত্র ভীমসেনের সঙ্গে প্রচণ্ড যুদ্ধ করলেন, কিন্তু সকলেই নিহত হলেন। অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন, ভীমসেন ধৃতরাষ্ট্রের সকল পুত্রকেই বধ করেছেন, যে দুজন (দুর্যোধন ও সুদর্শন) অবশিষ্ট আছে তারাও আজ নিহত হবে। শকুনির পাঁচ শত অশ্ব, দুই শত রথ, এক শত গজ ও এক সহস্র পদাতি, এবং কৌরবপক্ষে অশ্বত্থামা কৃপ সুশর্মা শকুনি উলূক ও কৃতবর্মা এই ছ’জন বীর অবশিষ্ট আছেন; দুর্যোধনের এর অধিক বল নেই। মূঢ় দুর্যোধন যদি যুদ্ধ থেকে না গালায় তবে তাকে নিহত বলেই জানবে।

তারপর অর্জুন ত্রিগর্তদেশীয় সত্যকর্মা সত্যেষু সুশর্মা, সুশর্মার পঁয়তাল্লিশ জন পুত্র, এবং তাঁদের অনুচরদের বিনষ্ট করলেন। দুর্যোধনভ্রাতা সুদর্শন ভীমসেন কর্তৃক নিহত হলেন। শকুনি, তাঁর পুত্র উলূক, এবং তাঁদের অনুচরগণ মৃত্যুপণ করে পাণ্ডবদের প্রতি ধাবিত হলেন। সহদেব ভল্লের আঘাতে উনূকের শিরচ্ছেদ করলেন। শকুনি সাশ্চকণ্ঠে সাশ্রনয়নে যুদ্ধ করতে লাগলেন এবং একটি ভীষণ শক্তি অস্ত্র সহদেবের প্রতি নিক্ষেপ করলেন। সহদেব বাণদ্বারা সেই শক্তি ছেদন করে ভল্লের আঘাতে শকুনির মস্তক দেহচ্যুত করলেন। শকুনির অনুচরগণও অর্জুনের হস্তে নিহত হল।

** (১) ভীষ্মপর্ব ২-পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।

॥ হ্রদপ্রবেশপর্বাধ্যায়॥

৬। দুর্যোধনের হ্রদপ্রবেশ

হতাবশিষ্ট কৌরবসৈন্য দুর্যোধনের বাক্যে উৎসাহিত হয়ে পুনর্বার যুদ্ধে রত হল কিন্তু পাণ্ডবসৈন্যের আক্রমণে তারা একবারে নিঃশেষ হয়ে গেল। দুর্যোধনের একাদশ অক্ষৌহিণী সেনা ধ্বংস হল। পাণ্ডবসেনার দু হাজার রথ, শাত শ হস্তী, পাঁচ হাজার অশ্ব ও দশ হাজার পদাতি অবশিষ্ট রইল। দুর্যোধন যখন দেখলেন যে তার সহায় কেউ নেই তখন তিনি তার নিহত অশ্ব পরিত্যাগ করে একাকী গদাহস্তে দ্রুতবেগে পূর্বমুখে প্রস্থান করলেন।

সঞ্জয়কে দেখে ধৃষ্টদ্যুম্ন সহাস্যে সাত্যকিকে বললেন, একে বন্দী করে কি হবে, এর জীবনে কোনও প্রয়োজন নেই। সাত্যকি তখন খুরধার খড়্গ তুলে সঞ্জয়কে বধ করতে উদ্যত হলেন। সেই সময়ে মহাপ্রাজ্ঞ কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস উপস্থিত হয়ে। বললেন, সঞ্জয়কে মুক্তি দাও, একে বধ করা কখনও উচিত নয়। সাত্যকি কৃতাঞ্জলি হয়ে ব্যাসদেবের আদেশ মেনে নিয়ে বললেন, সঞ্জয়, যাও, তোমার মঙ্গল হ’ক। বর্মহীন ও নিরস্ত্র সঞ্জয় মুক্তি পেয়ে সায়াহ্নকালে রুধিরাক্তদেহে হস্তিনাপুরের দিকে প্রস্থান করলেন।

রণস্থল থেকে এক ক্রোশ দূরে গিয়ে সঞ্জয় দেখলেন, দুর্যোধন ক্ষত-বিক্ষতদেহে গদাহস্তে একাকী রয়েছেন। দুজনে অপূর্ণনয়নে কাতরভাবে কিছুক্ষণ পরস্পরের দিকে চেয়ে রইলেন, তারপর সঞ্জয় তার বন্ধন ও মুক্তির বিষয় জানালেন। ক্ষণকাল পরে দুর্যোধন প্রকৃতিস্থ হয়ে তার ভ্রাতৃগণ ও সৈন্যদের বিষয় জিজ্ঞাসা করলেন। সঞ্জয় বললেন, আপনার সকল ভ্রাতাই নিহত হয়েছেন, সৈন্যও নষ্ট হয়েছে, কেবল তিন জন রথী (কৃপ, অশ্বত্থামা ও কৃতবর্মা) অবশিষ্ট আছেন; প্রস্থানকালে ব্যাসদেব আমাকে এই কথা বলেছেন। দুর্যোধন দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সঞ্জয়কে স্পর্শ করে বললেন, এই সংগ্রামে আমার পক্ষে তুমি ভিন্ন দ্বিতীয় কেউ জীবিত নেই, কিন্তু পাণ্ডবরা সহায়সম্পন্নই রয়েছে। সঞ্জয়, তুমি প্রজ্ঞাচক্ষু রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে বলবে, আপনার পুত্র দুর্যোধন দ্বৈপায়ন হ্রদে আশ্রয় নিয়েছে। আমার সুহৃৎ ভ্রাতা ও পুত্রেরা গত হয়েছে, রাজ্য পাণ্ডবরা নিয়েছে, এ অবস্থায় কে বেঁচে থাকে? তুমি আরও বলবে, আমি মহাযুদ্ধ থেকে মুক্ত হয়ে ক্ষতবিক্ষতদেহে এই হ্রদে সুপ্তের ন্যায় নিশ্চেষ্ট হয়ে জীবিত রয়েছি।

এই কথা বলে রাজা দুর্যোধন দ্বৈপায়ন হ্রদের মধ্যে প্রবেশ করলেন এবং মায়া দ্বারা তার জল স্তম্ভিত করে রইলেন। এই সময়ে কৃপাচার্য অশ্বত্থামা ও কৃতবর্মা রথারোহণে সেখানে উপস্থিত হলেন। সঞ্জয় সকল সংবাদ জানালে অশ্বত্থামা বললেন, হা ধিক, রাজা দুর্যোধন জানেন না যে আমরা জীবিত আছি এবং তার সঙ্গে মিলিত হয়ে শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করতেও সমর্থ আছি। সেই তিন মহারথ বহুক্ষণ বিলাপ করলেন, তার পর পাণ্ডবদের দেখতে পেয়ে বেগে শিবিরে চ’লে গেলেন।

সূর্যাস্ত হলে কৌরবশিবিরের সকলেই দুর্যোধনভ্রাতাদের বিনাশের সংবাদ পেয়ে অত্যন্ত ভীত হল। দুর্যোধনের অমাত্যগণ এবং বেত্রধারী নারীরক্ষকগণ রাজভার্যাদের নিয়ে হস্তিনাপুরে যাত্রা করলেন। শয্যা আস্তরণ প্রভৃতিও পাঠানো হল। অন্যান্য সকলে অশ্বতরীযুক্ত রথে চড়ে নিজ নিজ পত্নীসহ প্রস্থান করলেন। পূর্বে রাজপুরীতে যেসকল সূর্যও দেখতে পেতেন না, তাদের এখন সকলেই দেখতে লাগল।

বৈশ্যাগৰ্ভজাত ধৃতরাষ্ট্রপুত্র যুযুৎসু যিনি পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিয়েছিলেন, তিনিও যুধিষ্ঠিরের অনুমতি নিয়ে রাজভার্যাদের সঙ্গে প্রস্থান করলেন। হস্তিনাপুরে এসে যুযুৎসু বিদুরকে সকল বৃত্তান্ত জানালেন। বিদুর বললেন, বৎস, কৌরবকুলের এই ক্ষয়কালে তুমি এখানে এসে উপযুক্ত কার্যই করেছ। হতভাগ্য অন্ধরাজের তুমিই এখন একমাত্র অবলম্বন। আজ বিশ্রাম করে কাল তুমি যুধিষ্ঠিরের কাছে ফিরে যেয়ো।

৭। যুধিষ্ঠিরের তর্জন

পাণ্ডবগণ অনেক অন্বেষণ করেও দুর্যোধনকে কোথাও দেখতে পেলেন না। তাঁদের বাহনসকল পরিশ্রান্ত হলে তারা সৈন্য সহ শিবিরে চ’লে গেলেন। তখন কৃপ অশ্বত্থামা ও কৃতবর্মা ধীরে ধীরে হ্রদের কাছে গিয়ে বললেন, রাজা, ওঠ, আমাদের সহিত মিলিত হয়ে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে যুদ্ধ কর। জয়ী হয়ে পৃথিবী ভোগ কর অথবা হত হয়ে স্বর্গলাভ কর। দুর্যোধন বললেন, ভাগ্যক্রমে আপনাদের জীবিত দেখছি। আপনারা পরিশ্রান্ত হয়েছেন, আমিও ক্ষতবিক্ষত হয়েছি; এখন যুদ্ধ করতে ইচ্ছা করি না, বিশ্রাম করে ক্লান্তিহীন হয়ে শত্রুজয় করব। বীরগণ, আপনাদের মহৎ অন্তঃকরণ এবং আমার প্রতি পরম অনুরাগ আশ্চর্য নয়। আজ রাত্রে বিশ্রাম করে কাল আমি নিশ্চয় আপনাদের সহিত মিলিত হয়ে যুদ্ধ করব। অশ্বত্থামা বললেন, রাজা, ওঠ, আমি শপথ করছি আজই সোমক ও পাঞ্চালগণকে বধ করব।

এই সময়ে কয়েকজন ব্যাধ মাংসভারবহনে শ্রান্ত হয়ে জলপানের জন্য হ্রদের নিকটে উপস্থিত হল। এরা প্রত্যহ ভীমসেনকে মাংস এনে দিত। ব্যাধরা অন্তরাল থেকে দুর্যোধন অশ্বত্থামা প্রভৃতির সমস্ত কথা শুনলে। পূর্বে যুধিষ্ঠির এদের কাছে দুর্যোধন সম্বন্ধে খোঁজ নিয়েছিলেন। দুর্যোধন হ্রদের মধ্যে লুকিয়ে আছেন জানতে পেরে তারা পাণ্ডবশিবিরে গেল। দ্বাররক্ষীরা তাদের বাধা দিলে, কিন্তু ভীমের আদেশে তারা শিবিরে প্রবেশ করে তাকে সব কথা বললে। ভীম তাদের প্রচুর অর্থ দিলেন এবং যুধিষ্ঠির প্রভৃতিকে দুর্যোধনের সংবাদ জানালেন। তখন পাণ্ডবগণ রথারোহণে সদলে সাগরতুল্য বিশাল দ্বৈপায়ন হ্রদের নিকট উপস্থিত হলেন। শঙ্খনাদ, রথের ঘর্ঘর ও সৈন্যদের কোলাহল শুনে কৃপাচার্য অশ্বত্থামা ও কৃতবর্মা দুর্যোধনকে বললেন, রাজা, পাণ্ডবরা আসছে, অনুমতি দাও আমরা এখন চ’লে যাই। তারা বিদায় নিয়ে দূরে গিয়ে এক বটবৃক্ষের নীচে বসে দুর্যোধনের বিষয় ভাবতে লাগলেন।

হ্রদের তীরে এসে যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে বললেন, দেখ, দুর্যোধন দৈবী মায়ায় জল স্তম্ভিত করে ভিতরে রয়েছে, এখন মানুষ হতে তার ভয় নেই; কিন্তু এই শঠ আমার কাছ থেকে জীবিত অবস্থায় মুক্তি পাবে না। কৃষ্ণ বললেন, ভরতনন্দন, মায়ার দ্বারাই মায়াবীকে নষ্ট করতে হয়। আপনি কূট উপায়ে দুর্যোধনকে বধ করুন, এইরূপ উপায়েই দানবরাজ বলি বদ্ধ হয়েছিলেন এবং হিরণ্যকশিপু বৃত্র রাবণ তারকাসুর সুন্দ-উপসুন্দ প্রভৃতি নিহত হয়েছিলেন।

যুধিষ্ঠির সহাস্যে জলস্থ দুর্যোধনকে বললেন, সুযোধন, ওঠ, আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ কর। তোমার দর্প আর মান কোথায় গেল? যুদ্ধ থেকে পালিয়ে আসা সজ্জনের ধর্ম নয়, স্বর্গপ্রদও নয়। তুমি পুত্র ভ্রাতা ও পিতৃগণকে নিপাতিত দেখেও যুদ্ধ শেষ না করে নিজে বাঁচতে চাও কেন? বৎস, তুমি আত্মীয় বয়স্য ও বান্ধবগণকে বিনষ্ট করিয়ে হ্রদের মধ্যে লুকিয়ে আছ কেন? দ্বুদ্ধি, তুমি বীর নও তথাপি মিথ্যা বীরত্বের অভিমান কর। ওঠ, ভয় ত্যাগ করে যুদ্ধ কর; আমাদের পরাজিত করে পৃথিবী শাসন কর, অথবা নিহত হয়ে ভূমিতে শয়ন কর।

দুর্যোধন জলের মধ্যে থেকে উত্তর দিলেন, মহারাজ, প্রাণিগণ ভয়ে অভিভূত হয় তা বিচিত্র নয়, কিন্তু আমি প্রাণের ভয়ে পালিয়ে আসি নি। আমার রথ নেই, তৃণ নেই, আমার পার্শ্বরক্ষী সারথি নিহত হয়েছে, আমি সহায়হীন একাকী, অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে বিশ্রামের জন্য জলমধ্যে আশ্রয় নিয়েছি। কুন্তীপুত্র, আপনারা আশ্বস্ত হ’ন, আমি উঠে আপনাদের সকলের সঙ্গেই যুদ্ধ করব।

যুধিষ্ঠির বললেন, সুযোধন, আমরা আশ্বস্তই আছি। বহুক্ষণ তোমার অন্বেষণ করেছি, এখন জল থেকে উঠে যুদ্ধ কর। দুর্যোধন বললেন, মহারাজ, যাঁদের জন্য কুরুরাজ্য আমার কাম্য, আমার সেই ভ্রাতারা সকলেই পরলোকে গেছেন; আমাদের ধনরত্নের ক্ষয় হয়েছে, ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠগণ নিহত হয়েছেন, আমি বিধবা নারীর তুল্য এই পৃথিবী ভোগ করতে ইচ্ছা করি না। তথাপি আমি পাণ্ডব ও পাঞ্চালদের উৎসাহ ভঙ্গ করে আপনাকে জয় করবার আশা করি। কিন্তু পিতামহ ভীষ্মের পতন ও দ্রোণ-কর্ণের নিধনের পর আর যুদ্ধের প্রয়োজন দেখি না। আমার পক্ষের সকলেই বিনষ্ট হয়েছে, আমার আর রাজ্যের স্পৃহা নেই, আমি দুই খণ্ড মৃগচর্ম পরে বনে যাব। মহারাজ, আপনি এই রিক্ত পৃথিবী যথাসুখে ভোগ করুন।

দুর্যোধনের করুণ বাক্য শুনে যুধিষ্ঠির বললেন, বৎস, মাংসাশী পক্ষীর রবের ন্যায় তোমার এই আর্তপ্রলাপ আমার ভাল লাগছে না। তুমি সমস্ত পৃথিবী দান করলেও আমি নিতে চাই না, তোমাকে যুদ্ধে পরাজিত করেই আমি এই বসুধা ভোগ করতে ইচ্ছা করি। তুমি এখন রাজ্যের অধীশ্বর নও, তবে দান করতে চাচ্ছ কেন? যখন আমরা ধর্মানুসারে শান্তিকামনায় রাজ্য চেয়েছিলাম তখন দাওনি কেন? মহাবল কৃষ্ণ যখন সন্ধির প্রার্থনা করেছিলেন তখন তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলে, এখন তোমার চিত্তবিভ্রম হল কেন? সূচীর অগ্রে যেটুকু ভূমি ধরে তাও তুমি দিতে চাওনি, এখন সমস্ত পৃথিবী ছেড়ে দিচ্ছ কেন? পাপী, তোমার জীবন এখন আমার হাতে। তুমি আমাদের বহু অনিষ্ট করেছ, তুমি জীবনধারণের যোগ্য নও; এখন উঠে যুদ্ধ কর।

॥ গদাযুদ্ধপর্বাধ্যায়॥

৮। গদাযুদ্ধের উপক্রম

দুর্যোধন পূর্বে কখনও ভর্ৎসনা শোনেননি, সকলের কাছেই তিনি রাজসম্মান পেতেন। ছত্রের ছায়া এবং সূর্যের অল্প কিরণেও যাঁর কষ্ট হত, সমস্ত লোক যাঁর প্রসাদের উপর নির্ভর করত, এখন অসহায় সংকটাপন্ন অবস্থায় তাঁকে যুধিষ্ঠিরের কটুবাক্য শুনতে হল। দুর্যোধন দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে হাত নেড়ে বললেন, রাজা, আপনাদের সুহৃৎ রথ বাহন সবই আছে; আমি একাকী, শোকার্ত, রথবাহনহীন। আপনারা সশস্ত্র, রথারোহী এবং বহু; যদি আপনারা সকলে আমাকে বেষ্টন করেন। তবে নিরস্ত্র পাচারী একাকী আমি কি করে যুদ্ধ করব? আপনারা একে একে আমার সঙ্গে যুদ্ধ করুন। রাত্রিশেষে সূর্য যেমন সমস্ত নক্ষত্র বিনষ্ট করেন, আমিও সেইরূপ নিরস্ত্র ও রথহীন হয়েও নিজের তেজে রথ ও অশ্বসমেত আপনাদের সকলকেই বিনষ্ট করব।

যুধিষ্ঠির বললেন, মহাবাহু সুযোধন, ভাগ্যক্রমে তুমি ক্ষত্রধর্ম বুঝেছ এবং তোমার যুদ্ধে মতি হয়েছে। তুমি বীর এবং যুদ্ধ করতেও জান। মনোমত অস্ত্র নিয়ে তুমি আমাদের এক এক জনের সঙ্গেই যুদ্ধ কর, আমরা আর সকলে দর্শক হয়ে থাকব। আমি তোমার ইষ্টের জন্য আরও বলছি, তুমি আমাদের মধ্যে কেবল একজনকে বধ করলেই কুরুরাজ্য লাভ করবে; আর যদি নিহত হও তবে স্বর্গে যাবে। দুর্যোধন বললেন, একজন বীরই আমাকে দিন; আমি এই গদা নিলাম, আমার প্রতিদ্বন্দ্বীও গদা নিয়ে পাদচারী হয়ে আমার সঙ্গে যুদ্ধ করুন।

উত্তম অশ্ব যেমন কশাঘাত সইতে পারে না দুর্যোধন সেইরূপ যুধিষ্ঠিরের বাক্যে বারবার আহত হয়ে অসহিষ্ণু হলেন। তিনি জল আলোড়িত করে নাগরাজের ন্যায় নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে কাঞ্চনবলয়মণ্ডিত বৃহৎ লৌহগদ্য নিয়ে হ্রদ থেকে উঠলেন। বজ্ৰধর ইন্দ্রের ন্যায় এবং শূলপাণি মহাদেবের ন্যায় দুর্যোধনকে দেখে পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণ হৃষ্ট হয়ে করতালি দিতে লাগলেন। উপহাস মনে করে দুর্যোধন সক্রোধে ওষ্ঠদংশন করে বললেন, পাণ্ডবগণ, তোমরা শীঘ্রই এই উপহাসের প্রতিফল পাবে, পাঞ্চালদের সঙ্গে সদ্য যমালয়ে যাবে।

তারপর রক্তাক্তদেহ দুর্যোধন মেঘমন্দ্রস্বরে বললেন, যুধিষ্ঠির, আমি অবশ্যই আপনাদের সকলের সঙ্গে যুদ্ধ করব, কিন্তু আপনি জানেন যে একজনের সঙ্গে এককালে বহুলোকের যুদ্ধ উচিত নয়। যুধিষ্ঠির বললেন, সুযোধন, যখন অনেক মহারথ মিলে অভিমন্যুকে বধ করেছিলে তখন তোমার এই বুদ্ধি হয়নি কেন? লোকে বিপদে পড়লেই ধর্মের সন্ধান করে, কিন্তু সম্পদের সময় তারা পরলোকের দ্বার রুদ্ধ দেখে। বীর, তুমি বর্ম ধারণ কর, কেশ বন্ধন কর, যুদ্ধের যে উপকরণ তোমার নেই তাও নাও। আমি পুনর্বার বলছি, পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে যাঁর সঙ্গে তোমার ইচ্ছা তারই সঙ্গে যুদ্ধ কর; তাকে বধ করে কুরুরাজ্যের অধিপতি হও, অথবা নিহত হয়ে স্বর্গে যাও। তোমার জীবনরক্ষা ভিন্ন আর কি প্রিয়কার্য করব বল।

দুর্যোধন স্বর্ণময় বর্ম ও বিচিত্র শিরস্ত্রাণ ধারণ করে গদাহস্তে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। কৃষ্ণ ক্রুদ্ধ হয়ে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, মহারাজ, দুর্যোধন যদি আপনার সঙ্গে অথবা অর্জুন নকুল বা সহদেবের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চান তবে কি হবে? আপনি কেন এই দুঃসাহসের কথা বললেন-“আমাদের মধ্যে একজনকে বধ করেই কুরুরাজ্যের অধিপতি হও’? ভীমসেনকে বধ করবার ইচ্ছায় দুর্যোধন তের বৎসর একটা লৌহমূর্তির উপর গদাপ্রহার অভ্যাস করেছেন। ভীমসেন ভিন্ন দুর্যোধনের প্রতিযোদ্ধা দেখছি না, কিন্তু ভীমও গদাযুদ্ধশিক্ষায় অধিক পরিশ্রম করেন নি। আপনি শকুনির সঙ্গে ন্যূতক্রীড়া করে যেমন কার্য করেছিলেন, আজও সেইরূপ করছেন। ভীম অধিকতর বলবান ও সহিষ্ণু, কিন্তু দুর্যোধন অধিকতর কৃতী; বলবান অপেক্ষা কৃতীই শ্রেষ্ঠ। মহারাজ, আপনি শত্রুকে সুবিধা দিয়েছেন, আমাদের বিপদে ফেলেছেন। গদাহস্ত দুর্যোধনকে জয় করতে পারেন এমন মানুষ বা দেবতা আমি দেখি না। আপনারা কেউ ন্যায়যুদ্ধে দুর্যোধনকে জয় করতে পারবেন না। পাণ্ডু ও কুন্তীর পুত্রগণ। নিশ্চয়ই রাজ্যভোগের জন্য সৃষ্ট হননি, দীর্ঘকাল বনবাস ও ভিক্ষার জন্যই সৃষ্ট হয়েছেন।

ভীম বললেন, মধুসূদন, তুমি বিষগ্ন হয়ো না, আজ আমি দুর্যোধনকে বধ করব তাতে সন্দেহ নেই। আমার গদা দুর্যোধনের গদার চেয়ে দেড় গুণ ভারী, অতএব তুমি দুঃখ করো না। দুর্যোধনের কথা দূরে থাক, আমি দেবগণ এবং ত্রিলোকের সকলের সঙ্গেই যুদ্ধ করতে পারি। বাসুদেব হৃষ্ট হয়ে বললেন, মহাবাহু, আপনাকে আশ্রয় করেই ধর্মরাজ শত্রুহীন হয়ে রাজলক্ষ্মী লাভ করবেন তাতে সন্দেহ নেই। বিষ্ণু যেমন দানবসংহার করে শচীপতি ইন্দ্রকে স্বর্গরাজ্য দিয়েছিলেন, আপনিও সেইরূপ দুর্যোধনকে বধ করে ধর্মরাজকে সসাগরা পৃথিবী দিন।

ভীম গদাহস্তে দণ্ডায়মান হয়ে দুর্যোধনকে যুদ্ধে আহ্বান করলেন। মত্ত হস্তী যেমন মত্ত হস্তীর অভিমুখে যায়, দুর্যোধন সেইরূপ ভীমের কাছে গেলেন। ভীম তাকে বললেন, রাজা ধৃতরাষ্ট্র আর তুমি যেসব সংস্কৃত করেছ তা এখন স্মরণ কর। দুরাত্মা, তুমি সভামধ্যে রজস্বলা দ্রৌপদীকে কষ্ট দিয়েছিলে, শকুনির বুদ্ধিতে যুধিষ্ঠিরকে দ্যূতক্রীড়ায় জয় করেছিলে, নিরপরাধ পাণ্ডবদের প্রতি বহু দুর্ব্যবহার করেছিলে, তার মহৎ ফল এখন দেখ। তোমার জন্যই আমাদের পিতামহ ভীষ্ম শরশয্যায় পড়ে আছেন, দ্রোণ কর্ণ শল্য শকুনি, তোমার বীর ভ্রাতা ও পুত্রেরা, এবং তোমার পক্ষের রাজারা সসৈন্যে নিহত হয়েছেন। কুলঘু পুরুষাধম একমাত্র তুমিই এখন অবশিষ্ট আছ, আজ তোমাকে গদাঘাতে বধ করব তাতে সন্দেহ নেই।

দুর্যোধন বললেন, বৃকোদর, আত্মশ্লাঘা করে কি হবে, আমার সঙ্গে যুদ্ধ কর, তোমার যুদ্ধপ্রীতি আজ দূর করব। পাপী, কোন্ শত্রু আজ ন্যায়যুদ্ধে আমাকে জয় করতে পারবে? ইন্দ্রও পারবেন না। কুন্তীপুত্র, শরৎকালীন মেঘের ন্যায় বৃথা গর্জন করো না, তোমার যত বল আছে তা আজ যুদ্ধে দেখাও।

এই সময়ে হলায়ুধ বলরাম সেখানে উপস্থিত হলেন; তিনি সংবাদ পেয়েছিলেন যে দুর্যোধন ও ভীম যুদ্ধে উদ্যত হয়েছেন। কৃষ্ণ ও পাণ্ডবগণ তাকে যথাবিধি অর্চনা করে বললেন, আপনি আপনার দুই শিষ্যের যুদ্ধকৌশল দেখুন। বলরাম বললেন, কৃষ্ণ, আমি পুষ্যা নক্ষত্রে দ্বারক্য ত্যাগ করেছি, তার পর বিয়াল্লিশ দিন গত হয়েছে, এখন শ্রবণা নক্ষত্রে এখানে এসেছি। এই বলে নীলবসন শুভ্রকান্তি বলরাম সকলকে যথাযোগ্য সম্মাননা আলিঙ্গন ও কুশল প্রশ্ন করে যুদ্ধ দেখবার জন্য উপবিষ্ট হলেন।

৯। বলরামের তীর্থভ্রমণ-চন্দ্রের যক্ষ্মা—একত দ্বিত ত্রিত

জনমেজয় বৈশম্পায়নকে বললেন, বলরাম পূর্বে কৃষ্ণকে বলেছিলেন যে তিনি ধূরাষ্ট্রপুত্র বা পাণ্ডুপুত্র কাকেও সাহায্য করবেন না, ইচ্ছানুসারে দেশভ্রমণ করবেন; তবে আবার তিনি কুরুক্ষেত্রে কেন এলেন? বৈশম্পায়ন বললেন, কৃতবর্মা যখন যাদবসৈন্য নিয়ে দুর্যোধনের পক্ষে গেলেন এবং কৃষ্ণ ও সাত্যকি পাণ্ডবপক্ষে গেলেন, তখন বলরাম ক্রুদ্ধ হয়ে তীর্থযাত্রায় নির্গত হলেন। তিনি বহু সুবর্ণ রজত বস্ত্র অশ্ব হস্তী রথ গর্দভ উষ্ট্র প্রভৃতি সঙ্গে নিলেন, ঋত্বিক ও ব্রাহ্মণগণও তার সঙ্গে যাত্রা করলেন। বলরাম সমুদ্র থেকে সরস্বতী নদীর স্রোতের বিপরীত দিকে যেতে লাগলেন এবং দেশে দেশে শ্রান্ত ও ক্লান্ত, শিশু ও বৃদ্ধ বহু লোককে এবং ব্রাহ্মণগণকে খাদ্য পানীয় ধনরত্ন ধেনু যানবাহন প্রভৃতি দান করলেন।

বলরাম প্রথমে পবিত্র প্রভাসতীর্থে গেলেন। পুরাকালে প্রজাপতি দক্ষ চন্দ্রকে তাঁর সাতাশ কন্যা (নক্ষত্র) দান করেছিলেন। এই কন্যারা সকলেই অতুলনীয় রূপবতী ছিলেন, কিন্তু চন্দ্র সর্বদা রোহিণীর সঙ্গেই বাস করতেন। দক্ষের অন্য কন্যারা রুষ্ট হয়ে দক্ষের কাছে অভিযোগ করলেন। দক্ষ বহু বার চন্দ্রকে বললেন, তুমি সকল ভাষার সহিত সমান ব্যবহার করবে; কিন্তু চন্দ্র তা শুনলেন না। তখন দক্ষের অভিশাপে চন্দ্র যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হলেন। চন্দ্রের ক্ষয় দেখে দেবতারা দক্ষকে বললেন, ভগবান, প্রসন্ন হন, আপনার শাপে চন্দ্র ক্ষীণ হচ্ছেন, তার ফলে লতা ওষধি বীজ এবং প্রজাগণও ক্ষীণ হচ্ছে, আমরাও ক্ষীণ হচ্ছি। দক্ষ বললেন, আমার বাক্যের প্রত্যাহার হবে না। চন্দ্র সকল ভাষার সঙ্গে সমান ব্যবহার করুন, সরস্বতী নদীর প্রধান তীর্থ প্রভাসে অবগাহন করুন, তারপর পুনর্বার বৃদ্ধিলাভ করবেন; কিন্তু মাসার্ধকাল তার নিত্য ক্ষয় হবে এবং মাসার্ধকাল নিত্য বৃদ্ধি হবে। চন্দ্র পশ্চিম সমুদ্রে সরস্বতীর সংগমস্থলে গিয়ে বিষ্ণুর আরাধনা করুন তা হলে কান্তি ফিরে পাবেন। চন্দ্র প্রভাসতীর্থে গেলেন এবং অমাবশ্যায় অবগাহন করে ক্রমশ তার শীতল কিরণ ফিরে পেলেন। তদবধি তিনি প্রতি অমাবস্যায় প্রভাসতীর্থে স্নান করে বর্ধিত হন। চন্দ্র সেখানে প্রভা লাভ করেছিলেন এজন্যই ‘প্রভাস’ নাম।

তারপর বলরাম ক্রমশ উদপানতীর্থে গেলেন। সত্যযুগে সেখানে গৌতমের তিন পুত্ৰ একত দ্বিত ও ত্রিত বাস করতেন। তারা স্থির করলেন যে তাদের যজমানদের কাছ থেকে বহু পশু সংগ্রহ করবেন এবং মহাফলপ্রদ যজ্ঞ করে আনন্দে সোমরস পান করবেন। তিন ভ্রাতা বহু পশু লাভ করে ফিরলেন, ত্ৰিত আগে আগে এবং একত ও দ্বিত পশুর দল নিয়ে পিছনে চললেন। দুষ্টবুদ্ধি একত ও দ্বিত পরামর্শ করলেন, ত্রিত যজ্ঞনিপুণ ও বেদজ্ঞ, সে বহু পশু লাভ করতে পারবে; আমরা দুজনে এইসকল পশু নিয়ে চ’লে যাই, ত্রিত একাকী যেখানে ইচ্ছা হয় যাক। রাত্রিকালে চলতে চলতে ত্ৰিত এক বৃক (নেকড়ে) দেখতে পেলেন এবং ভীত হয়ে পালাতে গিয়ে সরস্বতীতীরবর্তী এক অগাধ কূপে পড়ে গেলেন। তিনি আর্তনাদ করতে লাগলেন, একত ও দ্বিত শুনতে পেয়েও এলেন না, বৃকের ভয়ে এবং লোভের বশে পশু নিয়ে চ’লে গেলেন। ত্ৰিত দেখলেন, কূপের মধ্যে একটি লতা ঝুলছে। তিনি সেই লতাকে সোম, কূপের জলকে ঘৃত এবং কাকরকে শর্করা কল্পনা করে যজ্ঞ করলেন। তার উচ্চ কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে বৃহস্পতি দেবগণকে সঙ্গে নিয়ে কূপের নিকটে এলেন। দেবতারা বললেন, আমরা যজ্ঞের ভাগ নিতে এসেছি। ত্রিত যথাবিধি মন্ত্রপাঠ করে যজ্ঞভাগ দিলেন। দেবগণ প্রীত হয়ে বর দিতে চাইলেন। ত্রিত বললেন, আপনারা আমাকে উদ্ধার করুন এবং এই বর দিন-যে এই কূপের জল স্বৰ্শ করবে সে সোমপায়ীদের গতি লাভ করবে। তখন কূপ থেকে ঊর্মিমতী। সরস্বতী নদী উত্থিত হলেন, ত্রিত উৎক্ষিপ্ত হয়ে তীরে উঠে দেবগণের পূজা করলেন। তার পর তিনি তার দুই লোভী ভ্রাতাকে শাপ দিলেন—তোমরা বৃকের ন্যায় দংষ্ট্রাযুক্ত ভীষণ পশু হবে, তোমাদের সন্তানগণ ভল্লুক ও বানর হবে।

১০। অসিতদেবল ও জৈগীষব্য-সারস্বত

বলরাম সপ্তসারস্বত কপালমোচন প্রভৃতি সরস্বতীতীরস্থ বহু তীর্থ দর্শন করে আদিত্যতীর্থে উপস্থিত হলেন। পুরাকালে তপস্বী অসিতদেবল গার্হস্থ্য ধর্ম আশ্রয় করে সেখানে বাস করতেন। তিনি সর্ববিষয়ে সমদর্শী ছিলেন, নিত্য দেবতা ব্রাহ্মণ ও অতিথির পূজা করতেন এবং সর্বদা ব্রহ্মচর্যে ও ধর্মকার্যে রত থাকতেন। একদা ভিক্ষু জৈগীষব্য মুনি দেবলের আশ্রমে এলেন এবং যোগনিরত হয়ে সেখানেই বাস করতে লাগলেন। তিনি কেবল ভোজনকালে দেবলের নিকট উপস্থিত হতেন। দীর্ঘকাল পরে একদিন দেবল জৈগীষব্যকে দেখতে পেলেন না। দেবল ভাবলেন, আমি বহু বৎসর এই অলস ভিক্ষুর সেবা করেছি, কিন্তু তিনি আমার সঙ্গে কোনও আলাপ করেন নি। আকাশচারী দেবল একটি কলস নিয়ে মহাসমুদ্রে গেলেন এবং দেখলেন, জৈগীষব্য পূর্বেই সেখানে উপস্থিত হয়েছেন। দেবল বিস্মিত হলেন এবং স্নানাদির পর জলপূর্ণ কলস নিয়ে আশ্রমে ফিরে এসে দেখলেন, জৈগীষব্য নীরবে কাষ্ঠের ন্যায় বসে আছেন। মন্ত্রজ্ঞ দেবল ভিক্ষু জৈগীষব্যের শক্তি পরীক্ষার জন্য আকাশে উঠলেন এবং দেখলেন, অন্তরীক্ষচারী সিদ্ধগণ জৈগীষব্যের পূজা করছেন। তার পর তিনি দেখলেন, জৈগীষব্য স্বর্গলোক পিতৃলোক যমলোক চন্দ্রলোক প্রভৃতি স্থানে এবং বহুবিধ যজ্ঞকারীদের লোকে গেলেন এবং অবশেষে অন্তর্হিত হলেন। দেবল জিজ্ঞাসা করলে সিদ্ধ যাক্তিকগণ বললেন, জৈগীষব্য শাশ্বত ব্রহ্মলোকে গেছেন, সেখানে তোমার যাবার শক্তি নেই। দেবল বিনয়ে অবনত হয়ে সেই মহামুনিকে বললেন, ভগবান, আমি মোক্ষধর্ম শিখতে ইচ্ছা করি। জৈগীষব্য যোগের বিধি এবং শাস্ত্রানুযায়ী কার্যাকার্য সম্বন্ধে উপদেশ দিলেন। দেবল সন্ন্যাসগ্রহণের সংকল্প করলেন, তখন আশ্রমের সমস্ত প্রাণী, পিতৃগণ, এবং ফলমূল লতা প্রভৃতি সরোদনে বলতে লাগল, ক্ষুদ্র দুর্মতি দেবল সর্বভূতকে অভয় দিয়েছিল তা ভুলে গেছে, সে নিশ্চয় আমাদের ছেদন করবে। মুনিসত্তম দেবল ভাবতে লাগলেন, মোক্ষধর্ম আর গার্হস্থ্যধর্মের মধ্যে কোটি শ্রেয়স্কর; অবশেষে তিনি মোক্ষধর্মই গ্রহণ করে সিদ্ধিলাভ করলেন।

বৃহস্পতিকে পুরোবর্তী করে দেবগণ ও তপস্বিগণ উপস্থিত হলেন এবং জৈগীষব্য ও দেবলের তপস্যার প্রশংসা করলেন। কিন্তু নারদ বললেন, জৈগীষব্যের তপস্যা বৃথা, কারণ তিনি তার শক্তি দেখিয়ে দেবলকে বিস্মিত করেছেন। দেবতারা বললেন, দেবর্ষি, এমন কথা বলবেন না, মহাত্মা জৈগীষব্যের তুল্য প্রভাব তপস্যা ও যোগসিদ্ধি আর কারও নেই।

তারপর বলরাম সোমতীর্থ দেখে সারস্বত মুনির তীর্থে গেলেন। পুরাকালে সরস্বতীতীরে তপস্যারত দধীচি মুনি অলম্বু অপ্সরাকে দেখে বিচলিত হন, তার ফলে সরস্বতী নদীর গর্ভে তার একটি পুত্র উৎপন্ন হয়। প্রসবের পর সরস্বতী দধীচিকে সেই পুত্র দান করলেন। দধীচি তুষ্ট হয়ে সরস্বতীকে বর দিলেন, তোমার জলে তর্পণ করলে দেবগণ পিতৃগণ গন্ধর্বগণ ও অম্লরোগণ তৃপ্ত হবেন এবং সমস্ত পুণ্যনদীর মধ্যে তুমি পুণ্যতমা হবে। দধীচি তার পুত্রের নাম রাখলেন সারস্বত। এই সময়ে দেবদানবের বিরোধ চলছিল। দধীচি দেবগণের হিতার্থে প্রাণত্যাগ করে তাঁর অস্থি দান করলেন, তাতে বজ্র চক্র গদা প্রভৃতি দিব্যাস্ত্র নির্মিত হল এবং ইন্দ্র বজ্রাঘাতে দানবগণকে জয় করলেন।

কিছুকাল পরে দ্বাদশবর্ষব্যাপী ভয়ংকর অনাবৃষ্টি হল , মহর্ষিগণ ক্ষুধার্ত হয়ে প্রাণরক্ষার জন্য নানাদিকে ধাবিত হলেন। সারস্বত মুনিও যাবার ইচ্ছা করলেন, কিন্তু সরস্বতী তাকে বললেন, পুত্র, যেয়ো না, তোমার আহারের জন্য আমি উত্তম মৎস্য দেব। সারস্বত তার আশ্রমেই রইলেন এবং মৎস্যভোজনে প্রাণধারণ করে দেবতা ও পিতৃগণের তর্পণ এবং বেদচর্চা করতে লাগলেন। অনাবৃষ্টি অতীত হলে মহর্ষিগণ দেখলেন তারা বেদবিদ্যা ভুলে গেছেন। তারা সারস্বত মুনির কাছে গিয়ে বললেন, আমাদের বেদ পড়াও। সারস্বত বললেন, আপনারা যথাবিধি আমার শিষ্য হন। মহর্ষিরা বললেন, পুত্র, তুমি তো বালক। সারস্বত বললেন, যাঁরা অবিধিপূর্বক অধ্যয়ন ও অধ্যাপন করেন তারা উভয়েই পতিত এবং পরস্পরের শত্রু হন। বয়স পক্ককেশ বিত্ত বা বন্ধুবাহুল্য থাকলেই লোকে বড় হয় না, যিনি বেদজ্ঞ তিনিই গুরু হবার যোগ্য। তখন ষাট হাজার মুনি সারস্বতের শিষ্যত্ব স্বীকার করলেন।

১১। বৃদ্ধকন্যা সু-কুরুক্ষেত্র ও স্যমন্তপঞ্চক

তারপর বলরাম বৃদ্ধকন্যাশ্রম তীর্থে এলেন। কুণিগর্গ নামে এক মহাতপা ঋষি ছিলেন, তিনি সুভ্র নামে এক মানসী কন্যা উৎপন্ন করেছিলেন। কুণিগর্গ দেহত্যাগ করলে অনিন্দিতা সুন্দরী সুব্ধ আশ্রম নির্মাণ করে কঠোর তপস্যা করতে লাগলেন। বহুকাল পরে তিনি নিজেকে কৃতার্থ মনে করলেন, কিন্তু বার্ধক্য ও তপস্যার জন্য তিনি এমন কৃশ হয়ে গিয়েছিলেন যে এক পাও চলতে পারতেন না। তখন তিনি পরলোকগমনের ইচ্ছা করলেন। নারদ তার কাছে এসে বললেন, অবিবাহিতা কন্যার স্বর্গলাভ কি করে হবে? তুমি কঠোর তপস্যা করেছ কিন্তু স্বর্গলোকের অধিকার পাওনি। সুভ্র ঋষিগণের কাছে গিয়ে বললেন, যিনি আমার পাণিগ্রহণ করবেন তাকে আমার তপস্যার অধভাগ দান করব। গালবের পুত্র প্রাঙ্গবান বললেন, সুন্দরী, তুমি যদি আমার সঙ্গে এক রাত্রি বাস কর তবে তোমার পাণিগ্রহণ করব। সুভ্র সম্মত হলে গালবপুত্র যথাবিধি হোম করে তাকে বিবাহ করলেন। সুভ্র দিব্যাভরণভূষিতা দিব্যমাল্যধারিণী বরবর্ণিনী তরুণী হয়ে পতির সহিত মৃত্তিবাস করলেন। প্রভাতকালে তিনি বললেন, ব্রাহ্মণ, তুমি যে নিয়ম (শর্ত) করেছিলে তা আমি পালন করেছি; তোমার মঙ্গল হ’ক, এখন আমি যাব। গালবপুত্র সম্মতি দিলে সুভ্র আবার বললেন, এই তীর্থে যে দেবগণের তর্পণ করে একরাত্রি বাস করবে সে আটান্ন বৎসর ব্রহ্মচর্য পালনের ফল লাভ করবে। এই বলে সাধ্বী সুভ্র দেহত্যাগ করে স্বর্গে চ’লে গেলেন। গালবপুত্র তাঁর ভাষার তপস্যার অর্ধভাগ পেয়েছিলেন; শোকে কাতর হয়ে তিনিও রূপবর্তী সুভ্রর অনুসরণ করলেন।

তারপর বলরাম স্যমন্তপঞ্চকে এলেন। ঋষিরা তাকে কুরুক্ষেত্রের এই ইতিহাস বললেন।পুরাকালে রাজর্ষি কুরু সেই স্থান সর্বদা কর্ষণ করেন দেখে ইন্দ্র তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, রাজা, একি করছ? কুরু বললেন, এই ক্ষেত্রে যে মরবে সে পাপশূন্য পুণ্যময় লোকে যাবে। ইন্দ্র উপহাস করে চ’লে গেলেন এবং তারপর বহুবার এসে পূর্বের ন্যায় প্রশ্ন ও উপহাস করতে লাগলেন। দেবতারা ইন্দ্রকে বললেন, রাজর্ষি কুরুকে বর দিয়ে নিবৃত্ত করুন; মানুষ যদি কুরুক্ষেত্রে মরলেই স্বর্গে যেতে পারে তবে আমরা আর যজ্ঞভাগ পাব না। ইন্দ্র কুরুর কাছে এসে বললেন, রাজা, আর পরিশ্রম করো না, আমার কথা শোন। যে লোক এখানে উপবাস করে প্রাণত্যাগ করবে অথবা যুদ্ধে নিহত হবে সে স্বর্গে যাবে। কুরু বললেন, তাই হ’ক।

ঋষিরা বলরামকে আরও বললেন, ব্রহ্মাদি সুরশ্রেষ্ঠগণ এবং পুণ্যবান রাজর্ষিগণের মতে কুরুক্ষেত্র অপেক্ষা পুণ্যস্থান পৃথিবীতে নেই। দেবরাজ ইন্দ্র এই গাথা গান করেছিলেন-কুরুক্ষেত্রে যে ধূলি ওড়ে তার স্পর্শেও পাপীরা পরমগতি পায়। তারন্তুক অরন্তুক রামহ্রদ ও মচকের মধ্যস্থানকেই কুরুক্ষেত্রের স্যমন্তপঞ্চক ও প্রজাপতির উত্তরবেদী বলা হয়।

তারপর বলরাম হিমালয়ের নিকটস্থ তীর্থসকল দেখে মিত্রাবরুণের পুণ্য আশ্রমে এলেন এবং সেখানে ঋষি ও সিদ্ধগণের নিকট বিবিধ পবিত্র উপাখ্যান শুনলেন। সেই সময়ে জটামণ্ডলে আবৃত স্বর্ণকৌপীনধারী নৃত্যগীতকুশল কলহপ্রিয় দেবর্ষি নরাদ কচ্ছপী বীণা নিয়ে উপস্থিত হলেন। বলরাম নারদের মুখে কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধের বৃত্তান্ত এবং দুর্যোধন ও ভীমের আসন্ন যুদ্ধের সংবাদ শুনলেন। তখন তিনি তাঁর অনুচরবর্গকে বিদায় দিয়ে বার বার পবিত্র সরস্বতী নদীর দিকে দৃষ্টিপাত করলেন এবং দুই শিষ্যের যুদ্ধ দেখবার জন্য সত্বর রথারোহণে দ্বৈপায়ন হ্রদের নিকট উপস্থিত হলেন।

১২। দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ (অষ্টাদশ দিনের যুদ্ধান্ত)

বলরাম যুধিষ্ঠিরকে বললেন, নৃপশ্রেষ্ঠ, আমি ঋষিদের কাছে শুনেছি যে কুরুক্ষেত্র অতি পুণ্যময় স্বর্গপ্রদ স্থান, সেখানে যাঁরা যুদ্ধে নিহত হন তারা ইন্দ্রের সহিত স্বর্গে বাস করেন। অতএব এখান থেকে স্যমন্তপঞ্চকে (১) চলুন, সেই স্থান প্রজাপতির উত্তরবেদী বলে প্রসিদ্ধ। তখন যুধিষ্ঠিরাদি ও দুর্যোধন পদব্রজে গিয়ে সরস্বতীর দক্ষিণ তীরে একটি পবিত্র উন্মুক্ত স্থানে উপস্থিত হলেন।

অনন্তর দুর্যোধন ও ভীম পরস্পরকে যুদ্ধে আহ্বান করলেন এবং দুই বৃষের ন্যায় গর্জন করে উন্মত্তবৎ আস্ফালন করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ বাগযুদ্ধের পর তুমুল গদাযুদ্ধ আরম্ভ হল। দুই বীর পরসএরর ছিদ্রানুসন্ধান করে প্রহার করতে লাগলেন। বিচিত্র গতিতে মণ্ডলাকারে ভ্রমণ করে, এগিয়ে গিয়ে, পিছনে হ’টে, একবার নীচু হয়ে, একবার লাফিয়ে উঠে তারা নানাপ্রকার যুদ্ধকৌশলে দেখালেন। দুর্যোধন তার গদা ঘুরিয়ে ভীমের মাথায় আঘাত করলেন; ভীম অবিচলিত থেকে প্রত্যাঘাত করলেন, কিন্তু দুর্যোধন ক্ষিপ্রগতিতে সরে গিয়ে ভীমের প্রহার ব্যর্থ করে দিলেন। তার পর ভীম বক্ষে আহত হয়ে মূৰ্ছিতপ্রায় হলেন এবং কিছুক্ষণ পরে প্রকৃতিস্থ হয়ে দুর্যোধনের পার্শ্বে প্রহার করলেন। দুর্যোধন বিহ্বল হয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন এবং আবার উঠে গদাঘাতে ভীমকে ভূপাতিত করলেন। ভীমের বর্ম বিদীর্ণ হল ; মুহূর্তকাল পরে তিনি দাঁড়িয়ে উঠে তার রক্তাক্ত মুখ মুছলেন। তখন নকুল সহদেব ধৃষ্টদ্যুম্ন ও সাত্যকি দুর্যোধনের দিকে ধাবিত হলেন। ভীম তাদের নিবৃত্ত করে পুনর্বার দুর্যোধনকে আক্রমণ করলেন।

যুদ্ধ ক্রমশ দারুণ হচ্ছে দেখে অর্জুন বললেন, জনার্দন, এই দুই বীরের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ? কৃষ্ণ বললেন, এঁরা দুজনেই সমান শিক্ষা পেয়েছেন, কিন্তু ভীমসেন অধিক বলশালী এবং দুর্যোধন দক্ষতায় ও যত্নে শ্রেষ্ঠ। ভীম ন্যায়যুদ্ধে জয়লাভ করবেন না, অন্যায় যুদ্ধেই দুর্যোধনকে বধ করতে পারবেন। দূতসভায় ভীম প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে যুদ্ধে গদাঘাতে দুর্যোধনের উরুভঙ্গ করবেন; এখন সেই প্রতিজ্ঞা পালন করুন, মায়াবী দুর্যোধনকে মায়া (কপটতা) দ্বারাই বিনষ্ট করুন। ভীম যদি কেবল নিজের বলের উপর নির্ভর করে ন্যায়যুদ্ধ করেন তবে যুধিষ্ঠির বিপদে পড়বেন। ধর্মরাজের দোষে আবার আমরা সংকটে পড়েছি, বিজয়লাভ আসন্ন হয়েও সংশয়ের বিষয় হয়েছে। যুধিষ্ঠির নির্বোধের ন্যায় এই পণ করেছেন যে দুর্যোধন একজনকে বধ করতে পারলেই জয়ী হবেন। শুক্রাচার্যের রচিত একটি পুরাতন শ্লোক আছে—পরাজিত হতাবশিষ্ট যোদ্ধা যদি ফিরে আসে তবে তাকে ভয় করতে হবে, কারণ সে মরণ পণ করে যুদ্ধ করবে।

অর্জুন তখন ভীমকে দেখিয়ে নিজের বাম ঊরুতে চপেটাঘাত করলেন। এই সময়ে ভীম ও দুর্যোধন দুজনেই পরিশ্রান্ত হয়েছিলেন। সহসা দুর্যোধনকে নিকটে পেয়ে ভীম মহাবেগে তার গদা নিক্ষেপ করলেন, দুর্যোধন সত্বর সরে গিয়ে ভীমকে প্রহার করলেন। ভীম রুধিরাক্তদেহে কিছুক্ষণ মূৰ্ছিতের ন্যায় রইলেন, তার পর আবার দুর্যোধনের প্রতি ধাবিত হলেন। ভীমের প্রহার ব্যর্থ করবার ইচ্ছায় দুর্যোধন লাফিয়ে উঠলেন, সেই অবসরে ভীম সিংহের ন্যায় গর্জন করে গদাঘাতে দুর্যোধনের দুই ঊরু ভগ্ন করলেন।

দুর্যোধন সশব্দে ভূতলে নিপতিত হলেন। তখন ধূলিবৃষ্টি রক্তবৃষ্টি ও উল্কাপাত হল , যক্ষরাক্ষস ও পিশাচগণ অন্তরীক্ষে কোলাহল করে উঠল, ঘোরদর্শন কবন্ধসকল নৃত্য করতে লাগল। ভূপতিত শত্রুকে ভর্ৎসনা করে ভীম বললেন, আমাদের শঠতা দ্যূতক্রীড়া বা বঞ্চনা নেই, আমরা আগুন লাগাই না, নিজের বাহুবলেই শক্রবধ করি। তার পর ভীম তার বাঁ পা দিয়ে দুর্যোধনের মাথা মাড়িয়ে তাকে শঠ বলে তিরস্কার করলেন।

ক্ষুদ্রচেতা ভীমের আচরণে সোমকবীরগণ অসন্তুষ্ট হলেন। যুধিষ্ঠির বললেন, ভীম, তুমি সৎ বা অসৎ উপায়ে শত্রুতার প্রতিশোধ নিয়েছ, প্রতিজ্ঞাও পূর্ণ করেছ, এখন ক্ষান্ত হও। রাজা দুর্যোধন এখন হতপ্রায়, ইনি একাদশ অক্ষৌহিণী সেনা ও কৌরবগণের অধিপতি, তোমার জ্ঞাতি, তুমি চরণ দিয়ে এঁকে স্পর্শ করো না। এঁর জন্য শোক করাই উচিত, উপহাস উচিত নয়। এঁর অমাত্য ভ্রাতা ও পুত্রগণ নিহত হয়েছেন, পিণ্ডলোপ হয়েছে; ইনি তোমার ভ্রাতা, এঁকে পদাঘাত করে তুমি অন্যায় করেছ। তার পর যুধিষ্ঠির দুর্যোধনের কাছে গিয়ে সাকণ্ঠে বললেন, বৎস, দুঃখ ক’রো না, তুমি পূর্বকৃত কর্মের বধ করেছি। তুমি নিজের জন্য শোক ক’রো না, তুমি শ্লাঘ্য মৃত্যু লাভ করেছ; আমাদের অবস্থাই এখন শোচনীয় হয়েছে, কারণ প্রিয় বন্ধুদের হারিয়ে দীনভাবে জীবনযাপন করতে হবে। শোকাকুলা বিধবা বন্ধুদের আমি কি করে দেখব? রাজা, তুমি নিশ্চয় স্বর্গে বাস করবে, কিন্তু আমরা নারকী আখ্যা পেয়ে দারুণ দুঃখ ভোগ করব।

** (১) দ্বৈপায়ন হ্রদ কুরুক্ষেত্রের অন্তর্গত নয়; স্যমন্তপঞ্চক কুরুক্ষেত্রেই অংশ।

১৩। বলরামের ক্রোধ-যুধিষ্ঠিরাদির ক্ষোভ

বলরাম ক্রোধে উর্ধ্ববাহু হয়ে আর্তকণ্ঠে বললেন, ধিক ধিক ভীম! ধর্মযুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়ে বৃকোদর নাভির নিম্নে গদাপ্রহার করেছে! এমন যুদ্ধ আমি দেখিনি, মূঢ় ভীম নিজের ইচ্ছাতেই এই শাস্ত্রবিরুদ্ধ যুদ্ধ করেছে। এই বলে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে বলরাম তার লাঙ্গল উদ্যত করে ভীমের প্রতি ধাবিত হলেন। তখন কৃষ্ণ বিনয়ে অবনত হয়ে তার সুগোল বাহু দিয়ে বলরামকে জড়িয়ে ধরলেন। দিবাবসানে চন্দ্র ও সূর্য যেমন আকাশে শোভা পান, কৃষ্ণ ও শুভ্র দুই যাদবশ্রেষ্ঠ সেইরূপ শোভা পেলেন। কৃষ্ণ বললেন, নিজের উন্নতি, মিত্রের উন্নতি, মিত্রের মিত্রের উন্নতি; এবং শত্রুর অবনতি, তার মিত্রের অবনতি, তার মিত্রের মিত্রের অবনতি—এই ছয় প্রকারই নিজের উন্নতি। পাণ্ডবরা আমাদের স্বাভাবিক মিত্র, আমাদের পিতৃম্বসার পুত্র, শত্রুরা এঁদের উপর অত্যন্ত পীড়ন করেছে। আপনি জানেন, প্রতিজ্ঞারক্ষাই ক্ষত্রিয়ের ধর্ম। ভীম দ্যুতসভায় প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে যুদ্ধে দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ করবেন, মহর্ষি মৈত্রেয়ও দুর্যোধনকে এইরূপ অভিশাপ দিয়েছিলেন, কলিযুগও আরম্ভ হয়েছে। অতএব আমি ভীমসেনের দোষ দেখি না। পুরুষশ্রেষ্ঠ, পাণ্ডবদের বৃদ্ধিতেই আমাদের বৃদ্ধি, অতএব আপনি ক্রুদ্ধ হবেন না।

কৃষ্ণের মুখে ধর্মের ছলনা শুনে বলরাম অপ্রসন্নমনে বললেন, গোবিন্দ, ভীম ধর্মের পীড়ন করে সকলকেই ব্যাকুল করেছে। ন্যায়যোদ্ধা রাজা দুর্যোধনকে অন্যায়ভাবে বধ করে ভীম কূটযোদ্ধা বলে খ্যাত হবে। সরলভাবে যুদ্ধ করার জন্য দুর্যোধন শাশ্বত স্বর্গ লাভ করবেন। ইনি রণযজ্ঞে নিজেকে আহুতি দিয়ে যজ্ঞান্ত-স্নানের যশ লাভ করেছেন। এই কথা বলে বলরাম তার রথে উঠে দ্বারকার অভিমুখে যাত্রা করলেন।

বলরাম চ’লে গেলে পাণ্ডব পাঞ্চাল ও যাদবগণ নিরানন্দ হয়ে রইলেন। যুধিষ্ঠির বিষগ্ন হয়ে কৃষ্ণকে বললেন, বৃকোদর দুর্যোধনের মাথায় পা দিয়েছেন তাতে আমি প্রীত হইনি, কুলক্ষয়েও আমি হৃষ্ট হইনি। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা আমাদের উপর বহু অত্যাচার করেছে, সেই দারুণ দুঃখ ভীমের হৃদয়ে রয়েছে, এই চিন্তা করে আমি ভীমের আচরণ উপেক্ষা করলাম। ভীমের কার্য ধর্মসংগত বা ধর্মবিরুদ্ধ যাই হ’ক, তিনি অমার্জিতবুদ্ধি লোভী কামনার দাস দুর্যোধনকে বধ করে অভীষ্টলাভ করুন।

ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে বাসুদেব সদুঃখে বললেন, তাই হ’ক। তিনি ভীমকে প্রীত করবার ইচ্ছায় তার সকল কার্যের অনুমোদন করলেন। অসন্তুষ্ট অর্জুন ভীমকে ভাল মন্দ কিছুই বললেন না। ভীম হৃষ্টচিত্তে উৎফুল্লনেত্রে কৃতাঞ্জলি হয়ে যুধিষ্ঠিরকে অভিবাদন করে বললেন, মহারাজ, আজ পৃথিবী মঙ্গলময় ও নিষ্কণ্টক হল , আপনি রাজ্যশাসন ও স্বধর্মপালন করুন। যুধিষ্ঠির বললেন, আমরা কৃষ্ণের মতে চ’লেই পৃথিবী জয় করেছি। দুর্ধর্ষ ভীম, ভাগ্যক্রমে তুমি মাতার নিকট এবং নিজের ক্রোধের নিকট ঋণমুক্ত হয়েছ, শত্ৰুনিপাত করে জয়ী হয়েছ।

১৪। দুর্যোধনের ভর্ৎসনা

দুর্যোধনের পতনে পাণ্ডব পাঞ্চাল ও সৃঞ্জয় যোদ্ধারা হৃষ্ট হয়ে সিংহনাদ করে উত্তরীয় নাড়তে লাগলেন। তাদের অনেকে ভীমকে বললেন, বীর, ভাগ্যবশে আপনি মত্ত হস্তীর ন্যায় পদ দ্বারা দুর্যোধনের মস্তক মর্দন করেছেন, সিংহ যেমন মহিষের। রক্ত পান করে সেইরূপ আপনি দুঃশাসনের রক্ত পান করেছেন। এই দেখুন, দুর্যোধন। পতিত হলে আমাদের যে রোমহর্ষ হয়েছিল তা এখনও যায়নি।

এইপ্রকার অশোভন উক্তি শুনে কৃষ্ণ বললেন, বিনষ্ট শত্রুকে উগ্রবাক্যে আঘাত করা উচিত নয়। এই নির্লজ্জ লোভী পাপী দুর্যোধন যখন সুহৃদ্গণের উপদেশ লঙ্ঘন করেছিল তখনই এর মৃত্যু হয়েছে। এই নরাধম এখন অক্ষম হয়ে কাষ্ঠের ন্যায় পড়ে আছে, একে বাক্য দ্বারা পীড়িত করে কি হবে?

দুর্যোধন দুই হাতে ভর দিয়ে উঠে বসলেন এবং প্রাণান্তকর যন্ত্রণা অগ্রাহ্য করে কৃষ্ণকে বললেন, কংসদাসের পুত্র, অন্যায় যুদ্ধে আমাকে নিপাতিত করে তোমার লজ্জা হচ্ছে না? তুমিই ভীমকে ঊরুভঙ্গের প্রতিজ্ঞা মনে করিয়ে দিয়েছিলে, তুমি অর্জুনকে যা বলেছিলে তা কি আমি জানি না? তোমারই কূটনীতিতে আমাদের বহু সহস্র যোদ্ধা নিহত হয়েছেন। তুমিই শিখণ্ডীকে সম্মুখে রাখিয়ে অর্জুনের বাণে ভীষ্মকে নিপাতিত করেছ, অশ্বত্থামার মরণের মিথ্যা সংবাদ দিয়ে দ্রোণাচার্যকে বধ করিয়েছ, কর্ণ যখন ভূমি থেকে রথচক্র তুলছিলেন তখন তুমিই অর্জুনকে দিয়ে তাঁকে হত্যা করেছ। আমাদের সঙ্গে ন্যায়যুদ্ধ করলে তোমরা কখনও জয়ী হতে না।

কৃষ্ণ উত্তর দিলেন, গান্ধারীর পুত্র, তুমি পাপের পথে গিয়েই আত্মীয়বান্ধবসহ হত হয়েছ। ভীষ্ম পাণ্ডবদের অনিষ্টকামনায় যুদ্ধ করছিলেন সেজন্যই শিখণ্ডী কর্তৃক নিহত হয়েছেন। দ্রোণ স্বধর্ম ত্যাগ করে তোমার প্রীতির জন্য যুদ্ধ করছিলেন, তাই ধৃষ্টদ্যুম্ন তাকে বধ করেছেন। বহু ছিদ্র পেয়েও অর্জুন কর্ণকে মারেন নি, বীরোচিত উপায়েই তাকে মেরেছেন। অর্জুন নিন্দিত কার্য করেন না, তাঁর দয়াতেই তুমি এবং ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ অশ্বত্থামা প্রভৃতি বিরাটনগরে নিহত হও নি। তুমি আমাদের যেসব অকার্যের কথা বলেছ তা তোমার অপরাধের জন্যই আমরা করেছি। লোভের বশে এবং অতিরিক্ত শক্তিলাভের বাসনায় তুমি যেসব দুষ্কর্ম করেছ এখন তারই ফল ভোগ কর।

দুর্যোধন বললেন, আমি যথাবিধি অধ্যয়ন দান ও সসাগরা পৃথিবী শাসন করেছি, শত্রুদের মস্তকে অধিষ্ঠান করেছি, ক্ষত্রিয়ের অভীষ্ট মরণ লাভ করেছি, দেবগণের যোগ্য এবং নৃপগণের দুর্লভ রাজ্য ভোগ করেছি, শ্রেষ্ঠ ঐশ্বর্য লাভ করেছি; আমার তুল্য আর কে আছে? কৃষ্ণ, সুহৃৎ ও ভ্রাতাদের সঙ্গে আমি স্বর্গে যাব। তোমাদের সংকল্প পূর্ণ হল না, তোমরা শোকসন্তপ্ত হয়ে জীবনধারণ কর।

দুর্যোধনের উপর আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি হল , অপ্সরা ও গন্ধর্বগণ গীতবাদ্য করতে লাগল, সিদ্ধগণ সাধু সাধু বললেন। দুর্যোধনের এইপ্রকার সম্মান দেখে কৃষ্ণ ও পাণ্ডব প্রভৃতি লজ্জিত হলেন। বিষগ্ন পাণ্ডবগণকে কৃষ্ণ বললেন, দুর্যোধন ও ভীষ্মদি বীরগণকে আপনারা ন্যায়যুদ্ধে বধ করতে পারতেন না। আপনাদের হিতসাধনের জন্যই আমি কূট উপায়ে এঁদের নিধন ঘটিয়েছি। শত্ৰু বহু বা প্রবল হলে বিবিধ কূট উপায়ে তাদের বধ করতে হয়, দেবতারা এবং অনেক সৎপুরুষ এইরূপ করেছেন। আমরা কৃতকার্য হয়েছি, এখন সায়াহ্নকালে বিশ্রাম করতে ইচ্ছা করি, আপনারাও সকলে বিশ্রাম করুন। তখন পাঞ্চালগণ হৃষ্ট হয়ে শঙ্খধ্বনি করলেন, কৃষ্ণও পাঞ্চজন্য বাজালেন।

১৫। ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারী-সকাশে কৃষ্ণ

সকলে নিজ নিজ আবাসে প্রস্থান করলে পাণ্ডবগণ দুর্যোধনের শিবিরে গেলেন। স্ত্রীলোক, নপুংসক ও বৃদ্ধ অমাত্যগণ সেখানে ছিলেন। দুর্যোধনের পরিচরগণ কৃতাঞ্জলি হয়ে তাদের সম্মুখে এল। পাণ্ডবগণ রথ থেকে নামলে কৃষ্ণের উপদেশে অর্জুন তার গাণ্ডীব ও দুই অক্ষয় তৃণ নামিয়ে নিলেন, তার পর কৃষ্ণ নামলেন। তখনই রথের ধ্বজাস্থিত দিব্যবানর অন্তর্হিত হল , রথ ও অস্ত্রসকলও ভস্ম হয়ে গেল। বিস্মিত অর্জুনকে কৃষ্ণ বললেন, বহুবিধ অস্ত্রের প্রভাবে তোমার রথে পূর্বেই অগ্নিসংযোগ হয়েছিল, আমি উপরে থাকায় এত কাল দগ্ধ হয়নি। এখন তুমি কৃতকার্য হয়েছ, আমিও নেমেছি, সেজন্য রথ ভস্ম হয়ে গেল।

পাণ্ডবপক্ষের যোদ্ধারা দুর্যোধনের শিবিরে অসংখ্য ধনরত্ন ও দাসদাসী পেয়ে কোলাহল করতে লাগলেন। কৃষ্ণের উপদেশে পঞ্চপাণ্ডব ও সাত্যকি শিবিরের বহির্দেশে নদীতীরে রাত্রিযাপনের আয়োজন করলেন। যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে বললেন, জনার্দন, ধৃতরাষ্ট্রমহিষী তপস্বিনী গান্ধারী পুত্রপৌত্রগণের নিধন শুনে নিশ্চয় আমাদের ভস্মসাৎ করবেন। তোমার অনুগ্রহেই আমাদের রাজ্য নিষ্কণ্টক হয়েছে, তুমি আমাদের জন্য বার বার অস্ত্রাঘাত ও কঠোর বাক্যযন্ত্রণা সয়েছ, এখন পুত্রশোকার্তা গান্ধারীর ক্রোধ শান্ত করে আমাদের রক্ষা কর।

দারুকের রথে চড়ে কৃষ্ণ তখনই হস্তিনাপুরে গেলেন। সেখানে ব্যাসদেবকে দেখে তার চরণবন্দনা করে কৃষ্ণ ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীকে অভিবাদন করলেন। ধৃতরাষ্ট্রের হাত ধরে কৃষ্ণ সরোদনে বললেন, মহারাজ, কুলক্ষয় ও যুদ্ধ নিবারণের জন্য পাণ্ডবরা অনেক চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কৃতকার্য হননি। তারা বহু কষ্ট ভোগ করেছেন। যুদ্ধের পূর্বে আমি আপনার কাছে এসে পাণ্ডদের জন্য পাঁচটি গ্রাম চেয়েছিলাম, কিন্তু লোভের বশে তাতেও আপনি সম্মত হননি। ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ বিদুর প্রভৃতি সন্ধির জন্য বারবার আপনাকে অনুরোধ করেছিলেন, তাতেও ফল হয়নি। আপনি পাণ্ডবদের দোষী মনে করবেন না, এই কুলক্ষয় আপনার দোষেই ঘটেছে। এখন আপনার কুলরক্ষা পিণ্ডদান এবং পুত্রের করণীয় যা কিছু আছে তার ভার পাণ্ডবদের উপরেই পড়েছে। অতএব আপনি এবং গান্ধারী ক্রোধ ও শোক ত্যাগ করে তাদের প্রতিপালন করুন। আপনার প্রতি যুধিষ্ঠিরের যে প্রীতি ও ভক্তি আছে তা আপনি জানেন। এখন তিনি শোকানলে দিবারাত্র দগ্ধ হচ্ছেন। আপনি পুত্রশোকে কাতর হয়ে আছেন সেজন্য তিনি লজ্জায় আপনার কাছে আসতে পারছেন না।

তারপর বাসুদেব গান্ধারীকে বললেন, সুবলনন্দিনী, আপনার তুল্য নারী পৃথিবীতে দেখা যায় না। দুই পক্ষের হিতের জন্য আপনি যে উপদেশ দিয়েছিলেন তা আপনার পুত্রেরা পালন করেননি। আপনি দুর্যোধনকে ভৎর্সনা করে বলেছিলেন, মূঢ়, যেখানে ধর্ম সেখানেই জয়। কল্যাণী, আপনার সেই বাক্য এখন সফল হয়েছে, অতএব শোক করবেন না, পাণ্ডবদের বিনাশকামনাও করবেন না। আপনি তপস্যার প্রভাবে ক্রোধদীপ্ত নয়ন দ্বারা চরাচর সহ সমস্ত পৃথিবী দগ্ধ করতে পারেন।

গান্ধারী বললেন, কেশব, তুমি যা বললে তা সত্য। দুঃখে আমার মন অস্থির হয়েছিল, তোমার কথায় শান্ত হল। এখন তুমি আর পাণ্ডবরাই এই পুত্রহীন বৃদ্ধ অন্ধ রাজার অবলম্বন। এই বলে গান্ধারী বস্ত্রে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগলেন। ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীকে সান্ত্বনা দিতে দিতে কৃষ্ণের জ্ঞান হল যে অশ্বত্থামা এক দুষ্ট সংকল্প করেছেন। তিনি তখনই গাত্রোত্তান করলেন এবং ব্যাসদেবকে প্রণাম করে ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, মহারাজ, আর শোক করবেন না। আমার এখন স্মরণ হল যে অশ্বত্থামা পাণ্ডবদের বিনাশের সংকল্প করেছেন, সেকারণে আমি এখন যাচ্ছি। ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারী বললেন, কৃষ্ণ, তুমি শীঘ্র গিয়ে পাণ্ডবদের রক্ষার ব্যবস্থা কর; আবার যেন তোমার সঙ্গে আমাদের দেখা হয়।

১৬। অশ্বত্থামার অভিষেক

কৃপাচার্য অশ্বত্থামা ও কৃতবর্মা দূতমুখে দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গের সংবাদ শুনে রথে। চ’ড়ে সত্বর তার কাছে এলেন। অশ্বত্থামা শোকার্ত হয়ে বললেন, হা মহারাজ, সসাগরা পৃথিবীর অধীশ্বর হয়ে এই নির্জন বনে একাকী পড়ে আছ কেন? দুর্যোধন সাশ্রু নয়নে বললেন, বীরগণ, কালধর্মে সমস্তই বিনষ্ট হয়। আমি কখনও যুদ্ধে বিমুখ হইনি, পাপী পাণ্ডবগণ কপট উপায়ে আমাকে নিপাতিত করেছে। ভাগ্যক্রমে আপনারা তিন জন জীবিত আছেন, আপনারা আমার জন্য দুঃখ করবেন না। যদি বেদবাক্য সত্য হয় তবে আমি নিশ্চয় স্বর্গলোকে যাব। আপনারা জয়লাভের জন্য যথাসম্ভব চেষ্টা করেছেন, কিন্তু দৈবকে অতিক্রম করা অসাধ্য।

অশ্বত্থামা বললেন, মহারাজ, পাণ্ডবরা নিষ্ঠুর উপায়ে আমার পিতাকে বধ করেছে, কিন্তু তাঁর জন্য আমার তত শোক হয় নি যত তোমার জন্য হচ্ছে। আমি শপথ করছি, কৃষ্ণের সমক্ষেই আজ সমস্ত পাঞ্চালদের যমালয়ে পাঠাব, তুমি আমাকে অনুমতি দাও।

দুর্যোধন প্রীত হয়ে কৃপকে বললেন, আচার্য, শীঘ্র জলপূর্ণ কলস আনুন। কৃপাচার্য কলস আনলে দুর্যোধন বললেন, দ্বিজশ্রেষ্ঠ, দ্রোণপুত্রকে সেনাপতির পদে অভিষিক্ত করুন। অভিষেক সম্পন্ন হলে অশ্বত্থামা দুর্যোধনকে আলিঙ্গন করলেন এবং সিংহনাদে সর্বদিক ধ্বনিত করে কৃপ ও কৃতবর্মার সঙ্গে প্রস্থান করলেন। দুর্যোধন রক্তাক্ত দেহে সেখানে শুয়ে সেই ঘোর রজনী যাপন করতে লাগলেন। (১)

**

(১) দুর্যোধনকে রক্ষার ব্যবস্থা কেউ করলেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *