০৯. রোযা (নবম খণ্ড)

নবম খণ্ড রোযা

রোযাএর গুরুত্ব

সাওম’ আরবী শব্দ। সাওম বা সিয়াম শব্দের আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা। শরীয়াতের পরিভাষায় সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়্যত সহকারে পানাহার এবং যৌনাচার থেকে বিরত থাকাকে সাওম বা রোযা বলা হয়।–(শামী, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৯২)।

বস্তুত রোযা রাখার নিয়ম সর্বযুগেই প্রচলিত ছিল। হযরত আদম (আঃ) থেকে আরম্ভ করে আখিরী নবী হযরত মুহাম্ম (ছঃ) পর্যন্ত নবী-রাসূলরা প্রত্যেকেই সিয়াম পালন করেছেন। আল্লামা ইমাদুদ্দীন ইবন কাসীর (রঃ) বলেন, ইসলামের প্রাথমিক যুগে তিন দিন রোযা রাখার বিধান ছিল। পরে রমযানের রোযা ফরয হলে তা রহিত হয়ে যায়।–(শামী, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৯২)।

হযরত ইবন আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী করীম (ছঃ) মদীনায় আগমন করে দেখলেন যে, ইয়াহুদীরা আশুরার দিন রোযা পালন করে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার? তোমরা এ দিনে রোযা পালন কর কেন? তারা বলল, এ অতি উত্তম দিন। এ দিনে আল্লাহ্ তা’আলা বনী ইসরাঈলকে শক্রর কবল হতে নাজাত দিয়েছেন। তাই হযরত মূসা (আঃ) এ দিনে রোযা পালন করেছেন। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বললেন, আমি তোমাদের অপেক্ষা মূসা (আঃ)-এর অধিক নিকটবর্তী। এরপর তিনি এ দিন রোযা পালন করেন এবং সকলকে রোযা পালনের নির্দেশ দেন।-(শামী, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৯৫)।

উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে এ কথা প্রমাণিত হয় যে, হযরত মূসা (আঃ), হযরত ঈসা (আঃ) এবং তাঁদের উম্মতরা সকলেই রোযা পালন করেছেন। যদিও ধরনও প্রক্রিয়াগতভাবে তাদের রোযা আমাদের থেকে কিছুটা ভিন্নতর ছিল।

নবীদের মধ্যে হযরত দাউদ (আঃ)-এর রোযা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আবদুল্লাহ্ ইবুন। আমর ইবনুল আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছঃ) আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি সব সময় রোযা রাখ এবং রাতভর নামায আদায় করে থাক? আমি বললাম, হা। তিনি বললেন, তুমি এরূপ করলে চোখ বসে যাবে এবং দুর্বল হয়ে পড়বে। যে সারা বছর রোযা রাখল সে যেন রোযাই রাখল না। যে মাসে তিনি দিন করে রোযা রাখে সে যেন সারা বছরই রোযা রাখল। আমি বললাম, আমি এর চেয়ে বেশি করার সামর্থ রাখি। তিনি বললেন, তাহলে তুমি সাওমে দাউদী’ পালন কর। তিনি একদিন রোযা রাখতেন আর একদিন ছেড়ে দিতেন। (ফলে তিনি দুর্বল হতেন না) এবং যখন তিনি শত্রুর সম্মুখীন হতেন তখন পলায়ন করতেন না।-(শামী, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৯৫)।

মাওলানা সৈয়দ সুলায়মান নদভী (রঃ) তাঁর সুবিখ্যাত সীরাত গ্রন্থের পঞ্চম খণ্ডে এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা’র বরাত দিয়ে লিখেছেন, প্রাচীন মিসরীয়দের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতেও রোযার প্রচলন পাওয়া যায়। গ্রীক ও পারসিক ধর্মেও রোযার উল্লেখ পাওয়া যায়।

সারকথা ইসলাম-পূর্ব ধর্মসমূহে রোযার প্রচলন ছিল। তবে কোন কোন ধর্মে রোযার ব্যাপারে বেশ স্বাধীনতা ছিল। এ অবাধ স্বাধীনতা রোযার ভাবমূর্তি ও প্রাণশক্তি সম্পূর্ণরূপে নষ্ট করে দিয়েছিল। চারিত্রিক মহত্ত্ব, নৈতিক পরিচ্ছন্নতা, চিন্তার বিশুদ্ধতা, আত্মিক পবিত্রতা এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম মাধ্যম এ রোযা কালক্রমে অন্তঃসারশূন্য নিছক এক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল।

অবস্থা হতে রোযাকে রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের দিকে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে এবং একে আত্মিক, নৈতিক ও চারিত্রিক কল্যাণের ধারক বানানোর নিমিত্তে মহান আল্লাহ্ রাব্দুল আলামীন রোযাকে এ উম্মাতের উপর ফরয করেন। এরশাদ হয়েছে :

ايها الذين آمنوا کتب عليكم الصيام ما كتب على الذين من

قبلكم لعلكم تتقون

অর্থ : হে ঈমানদারগণ! তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেয়া হল যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে দেয়া হয়েছিল। যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে সক্ষম হও। (সূরা বাকারা, ২ঃ ১৮৩)

আরো এরশাদ হয়েছে :

شهر رمضان الذى أثزل فيه القرآن هدى للناس وبيئت من الهدى

والفرقان فمن شهد منكم الشهر فليقة

অর্থ : রমযান মাস এতে মানুষের হেদায়াত এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্য ও অসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং তোমারেদ মধ্যে যারা এ মাস পাবে তারা যেন এ মাসে রোযা পালন করে।–(সূরা বাকারা, ২: ১৮৫)।

উপরোক্ত আয়াত নাযিল হওয়ার মাধ্যমে ইসলাম অন্যান্য এবাদতের ন্যায় রোযার মধ্যেও বেশকিছু মৌলিক সংস্কার সাধন করেছে। সমাজের সর্বস্তরে এর সুদূর প্রসারী সংস্কারের প্রবাব সুস্পষ্ট।

রোযার ব্যাপারে ইসলামের প্রধানতম সংস্কার হল, ধারণাগত পরিবর্তন। অর্থাৎ ইয়াহুদীদের দৃষ্টিতে রোযা ছিল বেদনা ও শোকের প্রতীক। পক্ষান্তরে ইসলামের দৃষ্টিতে রোযা হল, এমন এক সর্বজনীন ইবাদত যা রোযাদারকে দান করে সজীবতা, হৃদয়ের পবিত্রতা ও চিন্তাধারার বিশুদ্ধতা। এ রোযার মাধ্যমে বান্দা লাভ করে এক রূহানী তৃপ্তি, নতুন উদ্যম ও প্রেরণা। রোযার উপর আল্লাহ্ তা’আলা যে পুরস্কারের কথা ঘোষণা করেছেন তা এক মূহুর্তে মানুষকে করে তুলে ভোগে বিতৃষ্ণ, ত্যাগে উদ্বুদ্ধ এবং আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান। হাদীসে কুদসীতে আছে, আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেন।

রোযা আমার জন্য এবং আমি স্বয়ং এর পুরস্কার দান করবো।

অপর এক হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেছেন, রোযাদার ব্যক্তি দু’টি আনন্দ লাভ করবে। একটি আনন্দ হল ইফতারের মুহূর্তে আর অপরটি হবে তার রবের সাথে সাক্ষাতের মুহূর্তে।

রোযাদর ব্যক্তির যেন সাধ্যাতীত কোন কষ্ট না হয় এর জন্য নবী করীম (ছঃ) সেহরীকে সুন্নাত এবং বিলম্বে সেহরী গ্রহণ করাকে মুস্তাহাব ঘোষণা করেছেন। এমনিভাবে ইফতারের সময় অযথা বিলম্ব না করে সময় হওয়ার সাথে সাথেই ইফতার করার নির্দেশ দিয়েছেন।

কোন কোন প্রাচীন ধর্মমতে রোযা এক বিশেষ শ্রেণীর জন্য পালনীয় ছিল। কিন্তু ইসলাম। রোযাকে সকল সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করে এক সার্বজনীন রূপ দান করেছে। ইসলামী বিধান মতে, প্রত্যেক সক্ষম মুসলমানের জন্য রোযা রাখা ফরয। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে :

فمن شهد منكم الشهر فليصمة

অর্থ : সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পাবে, তারা যেন এ মাসে রোযা ব্রত পালন করে।–(সূরা বাকারা, ২ ঃ ১৮৫)।

প্রাচীন ধর্মসমূহে রোযার ব্যাপারে অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল, কিন্তু বিশেষ কোন ওযরবশত কাউকে রোযা রাখা থেকে অব্যাহতি দেয়ার নিয়ম ছিল না। ইসলাম এ ক্ষেত্রেও উদারতার পরিচয় দিয়েছে। মা’যূর ও অক্ষম ব্যক্তিদের রোযার বিষয়টি বিবেচনায় এনে ওযর দূর না হওয়া পর্যন্ত তাদেরকে রোযা না রাখার অনুমতি প্রদান করেছে। এরশাদ হয়েছে :

ومن كان مريضا أو على سفر فعدة بين أيام أخر

অর্থ : তোমাদের কেউ পীড়িত থাকলে কিংবা সফরে থাকলে অন্য সময় এ সংখ্যা পূর্ণ করতে হবে।–(সূরা বাকারা ২ : ১৮৫)।

রোযার ব্যাপারে অনেক ধর্মে এত বাড়াবাড়ি ছিল যে, একটানা চল্লিশ দিন পর্যন্ত খাদ্যগ্রহণ নিষিদ্ধ ছিল। আবার কোন কোন ধর্মে এমন শিথিলতা ছিল যে, কেবল গোত জাতীয় খাদ্য বর্জনকেই রোযার জন্য যথেষ্ট মনে করা হতো। এ ছাড়া অন্য যে কোন প্রকার খাদ্য কিংবা পানীয় গ্রহণের ব্যাপারে কোন নিষেধাজ্ঞা ছিল না। কিন্তু ইসলাম মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি এবং প্রয়োজনাতিরিক্ত উদারতা কোনটাকেই সমর্থন করেনি। এখানে যেমন আত্মাকে অমানবিক কষ্ট দেয়ার অধিকার নেই। তেমনি অবকাশ নেই অবাধ স্বেচ্ছাচারিতার।

ইয়াহূদী সম্প্রদায় ইক্তারের সময়ই শুধু খাদ্যগ্রহন করত। এরপর খাদ্য পানীয় কোন কিছু গ্রহন করাই তাদের ধর্মে অবৈধ ছিল। ফলে রাতভর পানাহারসহ যাবতীয় বৈধ কাজ থেকে বিরত থাকতে হত তাদের। এসব রীতি-নীতি রহিত করে পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা হয়েছে :

وكلوا واشربوا حتى يتبين لكم اليط الأبيض من الخيط الأسود

من الفجر۔

অর্থ : আর তোমরা পানাহার কর যতক্ষণ রাতের কালোরেখা হতে ভোরের সাধারেখা তোমাদের নিকট প্রতিভাত না হয়।–(সূরা বাকারা, ২ : ১৮)

সকল প্রাচীন ধর্মেই সৌরমাস হিসাবে রোযা রাখার বিধান ছিল। তাই দিন তারিখ এবং মাসের হিসাব রাখার জন্য সৌর বিষয়ে গভীর জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন ছিল। এছাড়াও সৌরবর্ষের কারণে প্রতি বছর একই সময় নির্দিষ্ট মাসে রোযা রাখতে হত। এতে কোন রদবদল হত না। এতে লোকেরা কিছুটা একঘেয়েমি অনুভব করত। কিন্তু সৌরমাসের পরিবর্তে চান্দ্রমাসের হিসাবে রোযা ফরয করা হয়েছে। নবী করীম (ছঃ) বলেন, চাঁদ দেখে রোযা আরম্ভ করবে এবং চাঁদ দেখে তা ভঙ্গ করবে।

রোযাকে চান্দ্র মাসের সাথে সম্পর্কিত করে দেয়ার সুফল হল, এর ফলে পৃথিবীর যে কোন জায়াগার যে কোন মানুষ খুব সহজেই রোযা রাখতে সক্ষম হয়। এমন কি গহীন বনে পর্বত-চূড়ায় অথবা জনমানবহীন কোন দ্বীপে আটকা পড়া ব্যক্তিও অনায়াসে রোযা রাখতে পারে। এর জন্য তাকে সৌর বিজ্ঞানের জ্ঞান অর্জনের প্রয়োজন হয় না। এর আরেকটি সুফল হলো, চান্দ্র মাসের কারণে ধীরে ধীরে রমযানের সময় বদল হয়ে থাকে। রমযান কখনও আসে গরমে আবার কখনো বা শীতে। সময়ের এ পরিবর্তনের ফলে নতুনত্বের একটা স্বাদ পাওয়া যায়। এতে শীত ও গরম মৌসুমের সংক্ষিপ্ত ও দীর্ঘ সময় কালীন রোযায় অভ্যস্ত হয়ে সর্বাবস্থায় ধৈর্যধারণ ও শুকর আদায়ের সুযোগ লাভ করা যায়।

রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেছেনঃ

صلوا مگم وضؤوا شهرم واثا كواة أموالكم وأطيعوا

آمرگم تثوا جثة ربما

অর্থ : তোমরা পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করবে, রমযান মাসের রোযা রাখবে, নিজেদের সম্পদের যাকাত দেবে এবং তোমাদের শাসকদের আনুগত্য করবে, তবেই তোমরা তোমাদের রবের জান্নাতে প্রবেশ করবে।-(আলমগীরী, ১ম খণ্ড)

রোযার ফরযিয়াতের ব্যাপারে উম্মাতের ইজুমা সংঘটিত হয়েছে। সুতরাং কেউ যদি এর ফরযিয়াত স্বীকার না করে তবে সে কাফের বলে গণ্য হবে।

কোন বালেগ ব্যক্তি যদি ওযর না থাকা সত্ত্বেও রোযা না রাখে তবে সে গুনাহগার হবে। হাদীসে এরূপ ব্যক্তিদের সম্বন্ধে কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে।

ب الله عليه وسلم

رسول الله

عن أبي هريرة رضي الله عنه أن رسو

قال من أفطر يوما من رمضان من غير رخصة ولا مژي لم يفضة صوم الدهر يو وإن صامه

هم لك و ۹

۰ و ۸

অর্থ : হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেছেন, কেউ শরয়ী কোন ওযর এবং অসুস্থতা না থাকা সত্ত্বেও রমযানের কোন একটি রোযা না রাখলে সারাজীবন রোযা রাখলেও তা পূরণ হবে না।-(কাযী খান, ১ম খণ্ড)

রোযার প্রকৃত গুরুত্ব এবং তাৎপর্য হচ্ছে তাকওয়া ও হৃদয়ের পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। পবিত্র কোরআনের এরশাদ হয়েছে : 355 <LIযাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।

তাকওয়া হচ্ছে হৃদয়ের এক বিশেষ অবস্থার নাম। ঐ অবস্থা অর্জিত হওয়ার পর মানুষের অন্তর আল্লাহর প্রতি আক্বষ্ট হয় এবং পাপাচারের প্রতি আকর্ষণ দিন দিন কমতে থাকে। এ কারণেই ইসলাম রোযার যাহিরি বিধি-বিধানের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করার পাশাপাশি নিম্নোক্ত বিষয়াদির প্রতিও বিশেষ তাকীদ করেছে।

রোযা যাতে নিচক আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত না হয় এবং তা যেন একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই পালন করা হয়। এ জন্য রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) রোযার সাথে ঈমান ও এহতিসাব তথা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং উত্তম বিনিময় লাভের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন :

من صام إيمانا واحتسابا غفر له ما تقدم من ذنبه

অর্থ : যে ব্যক্তি ইমানসহ নেকী হাসিলের আশায় রমযানের রোযা রাখবে তার অতীতের সমস্ত গুনাহ্ মাফ করে দেয়া হবে।-(কাযী খান, ১ম খণ্ড)

বস্তুত যে রোযা তাকওয়া তথা আল্লাহর ভয় ও হৃদয়ের পবিত্রতা শূন্য সে রোযা যেন প্রকৃত অর্থে কোন রোযাই নয়। আল্লাহর নিকট এরূপ রোযার গুরুত্ব নেই। হাদীসে আছে?

عن أبي هريرة رضي الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من لم يدع قول القير والعمل به قلي إلو حاجه فى أن يدع

 অর্থ : হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী করীম (ছঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও তদানুযায়ী আমল করা বন্ধ করেনি তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।–(আলমগীরী, প্রথম খণ্ড)

হযরত আবু উবায়দা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, নবী করীম বলেন, রোযা ঢালস্বরূপ, যদি সে নিজেই তা বিদীর্ণ করে দেয়। মিথ্যা কথা ও গীবত দ্বারা রোযার বরকত নষ্ট হয়ে যায়।

যেসব কাজ রোযার লক্ষ্য উদ্দেশ্যের পরিপন্থী, রোযা অবস্থায় সেসব কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য নবী করীম (ছঃ) জোর তাকীদ করেছেন। তিনি বলেন, রোযা থাকা অবস্থায় তোমাদের কেউ যেন অশ্লীলকাজে লিপ্ত না হয় এবং ঝগড়া বিবাদ না করে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয় তবে সে যেন বলে, আমি রোযাদার।–(কাযী খান)।

রোযাকে প্রাণবন্ত করতে হলে যেমনিভাবে জিহ্বার হিফাযত জরুরী অনুরূপভাবে চোখ, কান এবং অন্যান্য অঙ্গ-প্রতঙ্গের হিফাযতও তেমনি জরুরী। হারাম জিনিস দেখা, নিষিদ্ধ কথা শোনা এবং হারাম কাজ করা ইত্যাদি থেকে নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে অবশ্যই বিরত রাখতে হবে। তবেই রোযার স্বাদ অনুভূত হবে এবং রোযাও প্রাণবন্ত হবে।

রোযার কাঙ্ক্ষিত ফলাফল লাভ করার জন্য অন্যতম শর্তে হল, হালাল বস্তুত দিয়ে আহার করা। পক্ষান্তরে হারাম বস্তু খেয়ে রোযা রাখলে এতে নফসের পাশবিকতা অবদমিত হওয়ার পরিবর্তে তা আরো উত্তেজিত হয়ে উঠবে। রোযা অবস্থায় সেহরী ও ইফতারের সময় পরিমিত আহার করাও আবশ্যক। রোযার কাঙ্ক্ষিত ফায়দা অর্জন করতে হলে নিষিদ্ধ কাজসমূহ পরিত্যাগ করার সাথে সাথে অন্যান্য নেক আমলের প্রতিও বিশেষভাবে যত্নবান হতে হবে। তাই রোযাদার ব্যক্তিকে ইবাদত, তিলাওয়াত, যিকর ও তাসবীহে মগ্ন থেকে সহানুভূতি, সদয় আচরণ, দানশীলতা ও বদান্যতার মাধ্যমে পরকালীনু কল্যাণ ও উত্তীর্ণের পথ প্রশস্ত করে নেয়ার প্রতি বিশেষ তাকীদ দেয়া হয়েছে। নবী করীম (ছঃ) বলেন :

আল্লালা রমযানের সিয়াম পালন করাকে ফরয এবং রাতে তারাবীহ্ পড়াকে সুন্নাত সাব্যস্ত করেছেন। কোন ব্যক্তি আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য রমযানে কোন নফল আমল করলে সে রমযানের বাইরে একটি ফরয আদায় করার সমান নেক লাভ করবে। আর রমযানে কোন ফরয আদায় করলে রমযানের বাইরে সত্তরটি ফরয আদায়ের সমান ছাওয়াব লাভ করবে। বস্তুত রমযান হল ধৈর্যের মাস এবং এ ধৈর্য্যের বিনিময় হচ্ছে জান্নাত। আর এ মাস মানুষের প্রতি সমবেদনাও সহানুভূতি প্রকাশের মাস।–(আলমগীরী, ১ম খণ্ড)

এ জন্যই বলা হয় যে, রমযান হচ্ছে তিলাওয়াত, যিকর এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের এক বিশেষ মৌসুম। আত্মিক উৎকর্ষ ও পরকালীন মঙ্গল লাভের এক বেহেশতী সওগাত এই রমযান মাস। নবী করীম (ছঃ) রমযানকে রহমত, রবকত ও কল্যাণের মাস বলে আখ্যায়িত করেছেন।

.

রোযার ফযীলত ও উপকারিতা

রোযার উপকারিতা ও ফযীলত অনেক। হাদীসে এ সম্বন্ধে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। বুখারী শরীফে বর্ণিত এক হাদীসে আছে?

عليه وسلم

ن أبي هريرة رضي الله

قال اليام جئ فلا يرفث ولا يجهل وان امرؤ قاتله أوشاتمه فليقل تی ام مرتين والذي نفسي بيده للوف فم القائم أطيب عند الله تعالى من ريح المشك يترك طعامه وشرابه وشهوته من أجلي الصيام لي وانا أجزي به والحسنة بعشر أمثالها

অর্থ : হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেন, রোযা ঢালস্বরূপ। অতএব রোযা অবস্থায় যেন অশ্লীলতা তেকে বিরত থাকে এবং অজ্ঞ মূর্খের মত কোন কাজ না করে। কেউ তার সাথে ঝগড়া-ফ্যাসাদ করতে চাইলে, অথবা গালি দিলে সে যেন দু’বার বলে, আমি রোযাদার। ঐ সত্তার কসম যার নিয়ন্ত্রণে আমার প্রাণ, অবশ্যই রোযাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর নিকট মিশকের ঘ্রাণের চেয়েও অধিক উৎকৃষ্ট। সে আমারই জন্য পানাহার এবং কাম প্রবৃত্তি পরিত্যাগ করে। রোযা আমারই জন্য, তাই এর পুরস্কার আমি নিজেই দান করব। আর প্রত্যেক নেক কাজের বিনিময় দশগুণ।

অপর এক হাদীসে আছেঃ

من سهير رضى الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال إن لجنة بابا يقال له الريان يدخل بيثة الصائمون يوم القيامة لا يدخل منه أحد غيرهم يقال أين الشامون فيقومون لاين مته أحد غيرهم فإذا تخلوا أغلق فلم يدخل بيه أحد۔

হযরত সাহল (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী করীম (ছঃ) বলেন, জান্নাতের মধ্যে রায়্যান নামক একটি দরজা আছে। এ দরজা দিয়ে কেবলমাত্র কিয়ামতের দিন রোযাদার লোকেরাই প্রবেশ করবে। তাদের ছাড়া আর কেউ এ দরজা দিয়ে ঢুকতে পারবে না। ঘোষণা দেয়া হবে, রোযাদার লোকেরা কোথায় তখন তারা দাঁড়াবে। তাদের ছাড়া আর কেউ এ দরজা দিয়ে ঢুকবে না। তাঁদের প্রবেশের পরই দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে। যাতে এ দরজা দিয়ে আর কেউ প্রবেশ না করে।–(আলমগীরী, প্রথম খণ্ড, পৃঃ ২০৪)।

হযরত আবদুল্লাহ্ ইবন আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেন, রোযা এবং কূরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোযা বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আমি তাকে দিনের বেলা পানাহার ও যৌনক্রিয়া থেকে বিরত রেখেছি। তার সম্পর্কে আমার সুপারিশ কবুল করুন। কুরআন বলবে, আমি তাকে রাতে নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছি। তার সম্পর্কে আমার সুপারিশ ককূল করুন। তখন এদের সুপারিশ কবূল করা হবে।–(বেঃ জেঃ ৩য় খণ্ড)

রোযার মধ্যে অনেক উপকারিতা নিহিত আছে। এগুলো সম্বন্ধে মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রঃ)আহকামে ইসলাম আকল কী নযর মে নামক গ্রন্থে দীর্ঘ আলোকপাত করেছেন। এর মধ্য থেকে কতিপয় বিষয় নিম্নে উল্লেখ করা হলঃ

১. রোযার দ্বারা প্রবৃত্তির উপর আকলের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ এর দ্বারা মানুষের পাশবিক শক্তি দমিত হয় এবং রূহানী শক্তি বৃদ্ধি পায়। কেননা, ক্ষুধা ও পিপাসার কারণে মানুষের জৈবিক ও পাশবিক ইচ্ছা কমে যায়। এতে মনুষ্যত্ব জাগ্রত হয় এবং অন্তর বিগলিত হয়।

২. রোযার দ্বারা মানুষের অন্তরে আল্লাহর ভয়-ভীতি এবং তাকওয়ার গুণ সৃষ্টি হয়। এ কারণেই আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেন : ওঁ <tiযাতে তোমরা তাওয়ার গুণ অর্জন করতে সক্ষম হও।

৩. রোযার দ্বারা মানুষের স্বভাবে নম্রতা ও বিনয় সৃষ্টি হয় এবং মানব মনে আল্লাহর আযমত ও মহত্বের ধারণা জাগ্রত হয়।

৪. মানুষের দূরদর্শিতা প্রখর হয়।

৫. রোযার দ্বারা মানুষের মনে এমন এক নূরানী শক্তি পয়দা হয়, যার দ্বারা মানুষ সৃষ্টির এবং বস্তুর গুঢ় রহস্য সম্বন্ধে জানতে পারে।

৬. রোযার দ্বারা মানুষ ফিরিশতা চরিত্রের কাছাকাছি পৌঁছতে পারে।

৭. রোযার দ্বারা মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও মমত্ববোধ এবং পরস্পরের প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি হয়। কেননা, যে ব্যক্তি কোন দিনও ক্ষুধার্ত ও পিপাসিত থাকেনি সে কখনো ক্ষুধার্ত মানুষের দুখ, কষ্ট বুঝতে পারে না। অপর দিকে কোন ব্যক্তি যখন রোযা রাখে এবং উপবাস থাকে তখন সে যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পারে যে, যারা অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে, তারা যে কত দুঃখ-কষ্টে দিনগুজরান করছে। ফলে অনাহারক্লিষ্ট মানুষের প্রতি তার অন্তরে সহানুভূতির উদ্রেক হয়।

৮. রোযা পালন করা আল্লাহর প্রতি গভীর মহব্বতের অন্যতম নিদর্শন। কেননা, কারো প্রতি মহব্বত জন্মিলে, তাকে লাভ করার জন্য প্রয়োজনে প্রেমিক পানাহার বর্জন করে এবং সব কিছুকে ভুলে যায়। ঠিক তেমনিভাবে রোযাদার ব্যক্তিও আল্লাহ্ প্রেমে সবকিছু ছেড়ে দেয়। এমনকি পানাহার পর্যন্ত ভুলে যায়। তাই রোযা হল, আল্লাহর মহব্বতের অন্যতম নিদর্শন।

৯. রোযা মানুষের জন্য ঢালস্বরূপ। তাই রোযা মানুষকে শয়তানের আক্রমণ থেকে রক্ষা করে।

১০. রোযার দ্বারা মানুষের দৈহিক সুস্থতা অর্জিত হয়। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের মতে, প্রত্যেক মানুষের জন্য বছরে কয়েক দিন উপবাস থাকা আবশ্যক। তাঁদের মতে, স্বল্প খাদ্যগ্রহণ স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। সূফী সাধকদের মতে, হৃদয়ের স্বচ্ছতা অর্জনে স্বল্প খাদ্যগ্রহণের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। রোযা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। এর কারণে শরীরে চর্বি জমতে পারে না। পক্ষান্তরে মাত্রাতিরিক্ত পানাহারের ফলে শরীরে অধিকাংশ রোগব্যাধি সৃষ্টি হয়ে থাকে। এ ছাড়াও রোযার মধ্যে বহু উপকারিতা রয়েছে।

.

যাদের উপর রোযা ফরয

ওযরবিহীন বালেগ প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উপর রমযান মাসের রোযা রাখা ফরয। আল-কোরআনে এরশাদ হয়েছে :

فمن شهد منكم الشهر فليصمة

অর্থ : তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পাবে, তারা যেন এ মাসে সিয়াম সাধনা করে। (সূরা বাকারা, ২ঃ ১৮৫)।

এখানে মাস বলতে নির্দিষ্ট মাস অর্থাৎ রমযান মাস বুঝানো হয়েছে। এ আয়াত দ্বারা বুঝা যায় যে, রমযানের রোযা ফরয হওয়ার জন্য রমযান মাসের উপস্থিতি একটি শর্ত। এমতাবস্থায় যে ব্যক্তি পূর্ণ রমযান মাস পাবে, তার উপর রমযান মাসের রোযা ফরয হবে। যে ব্যক্তি এর থেকে কিছু কম সময় পাবে ততদিনের রোযাই ফরয হবে। (মা’আরিফুল কোরআন, [বঙ্গানুবাদ সংক্ষিপ্ত], পৃ. ৯৪)।

রমযানের রোযা ফরয হওয়ার শর্তাদি : ১. মুসলমান হওয়া, ২. সজ্ঞানে থাকা, উন্মাদ বা পাগল না হওয়া, ৩. বালিগ হওয়া।

রোযার আদায় ওয়াজিব হওয়ার শর্ত : ১. রোগমুক্ত থাকা, ২. মুকীম থাকা অর্থাৎ শরীয়াতের বিধান মতে সফরে না থাকা, ৩. হায়েয অবস্থায় না থাকা, ৪. নিফাস অবস্থায় না থাকা। তবে রোগ, সফর এবং হায়েয ও নেফাসের ওযরের কারণে তাৎক্ষণিকভাবে রোযা ফরয হবে না। কিন্তু পরে তার ক্বাযা করতে হবে।

.

রোযার নিয়াত

نويت أن أصوم غدا بين شهر رمضان المبارك قژضائك يا الله فتقتل

مني إنك أنت السميع العليم.

উচ্চারণ : নাওয়াইতু আন্ আছুমা গাদাম মিন শাহরি রমাদ্বোয়া-নাল মুবা-রাকি ফারদাল্লাকা ইয়া আল্লা-হু ফাতাকাব্বাল মিন্নী ইন্নাকা আনতাস্ সামীউল আলীম।

.

সেহরী খাওয়ার ফযীলত

হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, নবী করীম (ছঃ) বলেছেন, হে ঈমানদারগণ! তোমরা সেহরী খাও। কেননা, ছেহরীর প্রতি লোকমার পরিবর্তে আল্লাহ তা’আলা এক বৎসরের এবাদতের ছাওয়াব দান করবেন।

অন্য এক হাদীসে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেছেন, হে বিশ্বাসী বান্দাগণ! তোমরা (রমযানের শেষ রাতে) সেহরী খাও। যেহেতু এ পানাহারের কোন হিসাব হবে না।

অন্য এক হাদীসে বর্ণিত আছে, রাসূলে করীম (ছঃ) বলেছেন, তোমরা ইহুদীদের বিপরীত কাজ করতে সেহরী খাও। যেহেতু ইহুদীরা সেহরী খায়না, যদিও তারা রোযা রাখে। আর যে সেহরী খেয়ে রোযা রাখবে সে ইহুদীদের সংখ্যানুপাতে ছাওয়াব লাভ করবে।

আর এক রেওয়ায়েতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেছেন : তোমাদের মধ্য হতে যে ব্যক্তি সেহরী খাওয়া হতে বিরত থাকবে, তার স্বভাব-চরিত্র ইহুদীদের ন্যায় হয়ে যাবে। তবে কম করে হলেও দু এক লোকমা সেহরী খাবে। যেহেতু এতেও অসংখ্য ছাওয়াব লাভ হবে।

হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, শেষ রাতে সেহরী খাওয়ার উদ্দেশ্যে নিদ্রা হতে জাগ্রত হলে নিম্নের দোয়াটি বেশি পরিমাণে পাঠ করবে। এতে অশেষ ছাওয়াব পাওয়া যাবে। দোয়াটি এই :

–aajid (ইয়া–ওয়া-সিয়া’ল মাগফিরাতি)

.

ইফতারির ফযীলত

সারাদিন রোযা রাখার পরে সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করা অনেক ছাওয়াবের বিষয়। ইফতার দ্বারা যেভাবে সমস্ত দিবসের ক্ষুধা-তৃষ্ণা দূরীভূত হয়ে যায়। তদ্রূপ অসংখ্য ছাওয়াবও লাভ হয়।

হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে :

من أفتر صائما كان مغفرة لا توب وثق من التار برحمة من

উচ্চারণ : মান্ আফতারা ছোয়া-য়িমান কা-না মাগফিরাতা লিযযুনূবি ওয়া ই’ত্বক্বাম মিনান্না-রি বিরহমাতি মিনাল্লা-হি।

অর্থ :কোন ব্যক্তি যদি রমযানে কোন রোযাদার ব্যক্তিকে ইফতার করায়, তবে তার সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যায়। আর সে ব্যক্তি জাহান্নামের আগুন হতে আল্লাহর রহমতে নাজাত পাবে।

অন্য এক হাদীসে বর্ণিত আছে, রমযান মাসে কোন ব্যক্তি যদি কোন রোযাদারকে খেজুর কিংবা মিষ্টি, শরবত অথবা অল্প পরিমাণ দুধ দ্বারাও ইফতারী করায়, তবে তার জন্য রমযান মাসের প্রথম অংশে আল্লাহর রহমত ও করুণা, দ্বিতীয় অংশে ক্ষমা এবং তৃতীয় অংশে জাহান্নামের আজাব হতে নাজাতের সুসংবাদ রয়েছে।

.

ইফতারের দোয়া

افطرت برحمتك ياارحم

اللهم لك صمت وتوکا

 উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা লাকা ছুমতু ওয়া তাওয়াক্কালতু আলা–রিযক্বিকা ওয়া আফতোয়ারতু বিরহমাতিকা ইয়া–আরহামার রাহিমীন।

অর্থ :হে আল্লাহ! আমি তোমার জন্য রোজা রেখেছি এবং তোমার দেয়া রুজীর উপর ভরসা করছি এবং তোমার রহমতের উপর ইফতার করছি। হে সর্বোচ্চ দয়ালু ও দয়াময়।

.

তারাবীহ নামাযের বিবরণ

রমযান মাসে এশার নামাযের পরে বিতের নামাযের পূর্বে বিশ রাক’আত তারাবীর নামায একাকী অথবা জামায়াতের সাথে আদায় করতে হয়। এ নামায সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ্। এ নামায দু’ দু’ রাক’আতের নিয়্যতে আদায় করতে হয়।

.

তারাবীহ নামাযের নিয়ত

تويت أن أصلى لله تعالى ركعتى صلوت الترابيح شة رسول الله

تعالی متوجها إلى جهة الكعبة الشريفة الله اكبر

উচ্চারণ : নাওয়াইতু আন উছোয়াল্লিয়া লিল্লা-হি তা’আ-লা–রাআতাই ছলা-তিত্ তারাবীহি সুন্নাতু রাসূলিল্লা-হি তা’আলা মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কা’বাতিশ শারীফাতি আল্লা-হু আকবার।

বাংলা নিয়ত ও অমি ক্বেলামুখী হয়ে আল্লাহর উদ্দেশ্যে দু’ রাক’আত তারাবীহ্ সুন্নাত নামায আদায় করবার নিয়ত করলাম, আল্লাহু আকবার।

জামায়াতের সাথে আদায় করলে :এই ইমামের পিছনে একতেদা করলাম বলতে হবে। দু’ দু’ রাক’আতের পরে যে কোন একটি দুরূদ শরীফ পড়তে হয়। আর চার রাক’আতের পরে দোয়া পড়তে হয়।

.

তারাবীহর দোয়া

سبحان ډي المثير والملكوت–سبحان ذي العزة والعظمة والهيبة والقدرة والكبرياء والجبروت–سبحان المالي الحي الي ينام ويموت أبدا

ابدا–سبوح قدوس ربنا ورب الملا

উচ্চারণ : সুবহা-না যিল্ মুলকি ওয়াল মালাকূতি, সুবহা-না যিল্ ইজ্জাতি ওয়াল আযমাতি ওয়াল হাইবাতি ওয়াল্ কুদরাতি ওয়াল্ কিবরিয়া-য়ি ওয়াল্ জাবারূতি, সুবহা-নাল মালিকিল হাইয়্যিল্লাযী লা-ইয়ানামু ওয়া লা-ইয়ামূতু আবাদান অবাদা-। সুবুহুন কুদ্দুসুন রব্বুনা–ওয়া রব্বুল মালা-য়িকাতি ওয়ারুরূহ।

.

তারাবীহ নামাযের মুনাজাত

اللهم إنا نسئلك الجثة وتعوذبك من الار–ياخالق الجثة والار . برحمتك يا عزي ياغقا ياكريم ياستار يارحيم ياجبار ياخالق

یا باژ. اللهم أجرنا من الار–يا مجيريا مجيريا چيز برحمتك يا أرحم الرجمين

উচ্চারণ : আল্লা-হুম্মা ইন্না–নাসয়ালুকাল জান্নাতা ওয়া নাউযুবিকা মিনান্না-রি, ইয়া খা-লিক্বাল জান্নাতি ওয়ান্না-রি। বিরাহমাতিকা ইয়া–আযীযু ইয়া–গাফ্ফারু ইয়া–কারীমু ইয়া ছাত্তা-রু ইয়া–রহীমু ইয়া–জাব্বারু ইয়া–খা-লিকু ইয়া–বাররু। আল্লা-হুম্মা আজিরনা মিনান্না-রি। ইয়া–মুজীরু, ইয়া–মুজীরু, ইয়া–মুজীরু, বিরহমাতিকা ইয়া আরহামার রা-হিমীন।

.

শবে ক্বদরের ফযীলত ও নামাযের বিবরণ

পবিত্র রমযান মাসের মধ্যে সর্বোত্তম একটি রাত রয়েছে বিধায় এ মাসের ফযীলত অনেক বেশি। কিন্তু এই দিন কোন্ তারিখে এটা নিয়া মতভেদ রয়েছে। তবে অধিকাংশ মুহাক্বকিক ওলামা ও ইমামদের ধারণা হল, রমযান মাসের ২৭ তারিখের রাতটিই কদরের রাত। এই কদরের রাত সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা পাক কালামে একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা নাযিল করেছেন, যার নাম সূরা কদর। আল্লাহ বলেন।

اثا أثزلناه في ليلة القدر–وماأدرك ماليلة القدر–ليلة القدر خير من ألف شهر–تنژل المملكة والروح فيها باثن ربهم من كل أمر سلام هي حتى مطلع الفجر.

উচ্চারণ : ইন্না–আনযালনা-হু ফী লাইলাতিল কুদরি, ওয়ামা–আদরাকা মা-লাইলাতুল ক্বদরি। লাইলাতুল্ কদরি খাইরুম্ মিন্ আলফি শাহর, তানাযযালুল্ মালা-য়িকাতু ওয়াররূহু ফীহা–বিইযনি রব্বিহিম মিন্ কুল্লি আমরিন্ সালা-ম; হিয়া হাত্তা–মাত্বলাঈ’ল ফাজর।

অর্থ :নিশ্চয়ই আমি ক্বদরের রাতে কোরআনকে নাযিল করেছি। অপনি (হে রাসূল) জানেন কি কদরের রাতটি কি? কদরের রাতটি হাজার মাস হতেও উত্তম। এ রাতে ফেরেশতারা ও রূহ্ জিবরাঈল আল্লাহর হুকুমে দুনিয়ার সর্বত্র অবতীর্ণ হয়ে এবং প্রভাত হওয়া পর্যন্ত তাঁরা শান্তি ও সালামতির সাথে বিরাজিত থাকে।

কোন মু’মিন ব্যক্তি যদি ক্বদরের রাতে জাগ্রত থেকে নফল এবাদত করে, তবে সে হাজার মাস নফল ইবাদতের ছাওয়াব হতে বেশি ছাওয়াব লাভ করবে। আর আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতামণ্ডলী তাঁর অশেষ রহমত নিয়ে দুনিয়ায় অবতীর্ণ হয়ে এবাদতকারী নেক বান্দাদের মাঝে তা বিতরণ করে থাকেন এবং ঐ রাতে প্রভাত পর্যন্ত আল্লাহর রহমত ও শান্তি দুনিয়ার বুকে বিরাজিত থাকে আর এবাদতকারী মু’মিন বান্দারা জাহান্নামের আজাব হতে নাজাত পেয়ে থাকে। এই বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছঃ) ফরমায়েছেনঃ

إن الله تعالي زين اليالى بليلة القدر–

অর্থ : নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা দুনিয়ার রাতসমূহকে কদরের রাত দ্বারা সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছেন।

অন্য এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেছেনঃ

من أدرك ليلة القدر رفع الله قدره يوم القيمة

অর্থ : যে ব্যক্তি ক্বদরের রাত পাবে (এবং এবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে দেবে) মহান প্রতিপালক কেয়ামতের দিবসে তার মর্যাদা অত্যাধিক পরিমাণে বৃদ্ধি করে দেবেন। অন্য এক হাদীসে রাসূলে করীম (ছঃ) বলেছেনঃ

أفضل الليالى ليلة القدر–

যেহেতু এ রাতের ইবাদতের ছাওয়াব অন্য যে কোন রাতের এবাদত অপেক্ষা বেশি, তাই এ রাতটি সর্বশ্রেষ্ঠ রাত।

আর এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেছে : যে ব্যক্তি পূর্ণ বিশ্বাস ও এ’তেকাফের সাথে কদরের রাতে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে এবাদত করবে, আল্লাহ তা’আলা তার জীবনের সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।

অন্য এক হাদীসে রাসূলে করীম (ছঃ) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি ক্বদরের রাত পাওয়ার পর ঐ রাতে এবাদত বন্দেগী করবে, মহান আল্লাহ তা’আলা তার প্রতি জাহান্নামের আগুন হারাম করে দেবেন।

.

ক্বদরের নামায আদায়ের নিয়ম

হাদীসে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি চার রাক’আত নামায ক্বদরের রাতে আদায় করবে এবং উক্ত নামাযের প্রতি রাক’আতে সূরা ফাতিহার পরে ২১ বার সূরা ইখলাছ পাঠ করবে, আল্লাহ তা’আলা তাকে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর ন্যায় নিষ্পাপ করে দেবেন। এবং বেহেশতের মধ্যে এক সহস্র মনোমুগ্ধকর মহল তৈরি করে দেবেন।

আর এক হাদীসে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (ছ.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কদরের রাতে চার রাক’আত নামায আদায় করবে এবং তার প্রতি রাক’আতে সূরা ফাতিহার পরে সূরা ক্বদর ও সূরা ইখলাছ তিনবার করে পাঠ করবে। নামায শেষে সিজদায় গিয়ে নিম্নের দোয়াটি কিছু সময় পাঠ করে আল্লাহর দরবারে যাহাই প্রার্থনা করবে তিনি তাই কবুল করবেন এবং তার প্রতি অসংখ্য রহমত বর্ষণ করবেন।

দোয়াটি হল :

شبحان الله والحمد له ولا اله الا الله والله أكبر .

উচ্চারণ : সুবহা-নাল্লা-হি ওয়াল্ হামদু লিল্লা-হি ওয়া লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার।

রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি রমযান মাসের ২৭ তারিখের রজনীকে জীবিত রাখবে, (অর্থাৎ সমস্ত রজনী এবাদতে কাটিয়ে দেবে) তার আমলনামায় আল্লাহ তা’আলা ২৭ হাজার বৎসরের এবাদতের তুল্য ছাওয়াব প্রদান করবেন এবং বেহেশতের মধ্যে অসংখ্য মনোরম বালাখানা নির্মাণ করবেন যার সংখ্যা আল্লাহ ব্যতীত কেউই অবগত নন।

ক্বদরের রাতে নামায আদায়ের নিয়ম হল, এশার নামাযের পরে তারাবীহ নামায আদায় করতঃ বিতের নামায বাদ রেখে দু’ দু’ রাক’আতের নিয়তে যত বেশি সম্ভব নামায আদায় করবে। সেহরীর পূর্বে বিতের নামায আদায় করে সেহরী খেয়ে কিছু সময় তসবীহ-তাহলীল ও যিকির করবে। তৎপর ফজরের নামায আদায় করবে।

এই রাতে প্রতি চার রাক’আত অন্তর নিম্নের দোয়াটি ১০০ বার করে পাঠ করবে।

اللهم إنك عفو تحب العفو فاعف عني–

উচ্চারণ : আল্লা-হুম্মা ইন্নাকা আফুয়ুন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নী।

আর এক বর্ণনায় আছে যে, ক্বদরের রজনীতে প্রতি চার রাক’আত নামাযের পরে নিম্নের দোয়াটিও ১০০ বার পাঠ করলে অসংখ্য ছাওয়াব লাভ হবে।

اللهم أثت عفو تحب العفو–فاقوا عتی یاغفور یاغفور۔

উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা আন্তা আফুয়ুন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নী ইয়া–গাফুরু ইয়া–গাফুরু।

সমস্ত রাত নামায ব্যতীত অন্যান্য নফল এবাদতেও অসংখ্য ছাওয়াব লাভ হবে। যেমন কোরআন শরীফ তিলওয়াত করা, দুরূদ শরীফ পাঠ করা এবং যিকির-আযকার ও তাওবায়ে ইস্তিগফার করা।

.

ক্বদরের নামাযের নিয়ত

ى صلوۃ ليلة القدر–متوجها إلى جهة

ك

نويت أن أصلى لله تعالى الكعبة الشريفة الله أكبر.

উচ্চারণ : নাওয়াইতু আন উছোয়াল্লিয়া লিল্লা-হি তা’আ-লা–রাকআতাই ছলা-তি লাইলাতিল ক্বদরি, মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কা’বাতিশ শারীফাতি আল্লা-হু আকবার।

বাংলায় নিয়ত : আমি ক্বেবলামুখী হয়ে আল্লাহর উদ্দেশ্যে দু’ রাক’আত ক্বদরের নফল নামায আদায় করতেছি–আল্লাহু আকবার।

.

সন্দেহের দিন রোযা রাখা নিষেধ

৭। মাসয়ালা : ২৯শে শা’বান যদি চাঁদ দেখা যায়, তবে পরের দিন রোযা রাখতে হবে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে এবং চাঁদ দেখা না গেলে, তবে পরের দিন রোযা রাখবে না। হাদীস শরীফে ইয়াওমুশ শক অর্থাৎ এরূপ সন্দেহের দিনে রোযা রাখা নিষেধ করা হয়েছে। শাবান মাসের ত্রিশ দিন পূর্ণ হওয়ার পর রোযা রাখবে।

৮। মাসয়ালা : ২৯শে শাবান আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকার কারণে যদি চাঁদ দেখা না যায়, তবে পরের দিন নফল রোযা রাখাও নিষেধ। কিন্তু কারো যদি এমন অভ্যাস থাকে যে, সে সর্বদা বৃহস্পতিবার, শুক্রবার অথবা অন্য কোন নির্দিষ্ট দিনে নফল রোযা রাখে এবং ঘটনাক্রমে ওই তারিখ ওই দিন হয়, তবে নফলের নিয়্যতে রোযা রাখা ভাল। অবশ্য যদি পরে কোথাও থেকে খবর আসে যে, ওই দিন রমযান মাসের প্রথম দিনের প্রমাণ পাওয়া গেছে, তাহলে ওই নফল রোযা দ্বারাই ফরয আদায় হয়ে যাবে, ক্বাযা করতে হবে না।

৯। মাসয়ালা : আকাশে মেঘের কারণে যদি ২৯ তারিখে রমযানের চাঁদ দৃষ্টিগোচর না হয়, তবে দুপুরের ১ ঘন্টা পূর্ব পর্যন্ত কিছুই পানাহার করবে না। কোথাও থেকে যদি চাঁদের সংবাদ আসে, তাহলে তখনই রোযার নিয়্যত করবে। আর সংবাদ পাওয়া না গেলে পানাহার করবে।

১০। মাসয়ালা : ২৯শে শাবান সন্ধায় যদি চাঁদ দেখা না যায়, তবে পরের দিন ক্বাযা রোযা, মান্নত রোযা, কাফফারার রোযা ইত্যাদি কোন রোযাই জায়েয নয়, মাকরূহ। অবশ্য জায়েয না হওয়া সত্ত্বেও কেউ যদি রোযা রাখে এবং পরে ওই দিন রমযানের প্রথম তারিখ প্রমাণিত হয়, তবে ওই রোযাতেই রমযানের রোযা আদায় হবে। ক্বাযা, মান্নত, কাফফারা ইত্যাদি রোযা পরে রাখতে হবে। আর সংবাদ পাওয়া না গেলে যে রোযার নিয়্যত করেছে, তা আদায় হয়ে যাবে।

.

চাঁদ দেখা

১। মাসয়ালা : আকাশে মেঘ বা-ধুলি থাকলে মাত্র একজন সত্যবাদী, দ্বীনদার মহিলা বা একজন পুরুষ সাক্ষ্যতেই রমযানের চাঁদ প্রমাণিত ও সাব্যস্ত হবে।

২। মাসয়ালা : ২৯শে রমযান আকাশে মেঘ থাকলে ঈদের চাঁদ প্রমাণিত হওয়ার জন্য অন্তত দু’ জন বিশ্বস্ত দ্বীনদার পুরুষ অথবা একজন দ্বীনদার পুরুষ ও দু’জন দ্বীনদার নারীর সাক্ষ্য আবশ্যক, নতুবা ঈদের চাঁদ প্রমাণিত হবে না। যদি একজন অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও ধার্মীক পুরুষও সাক্ষ্য দেয় অথবা শুধু চারজন নারী সাক্ষ্য দেয়, কোন পুরুষই সাক্ষ্য না দেয়, তবে তাতে ঈদের চাঁদ প্রমাণিত হবে না এবং রোযা ভাঙ্গা যাবে না।

৩। মাসয়ালা : যে লোক শরীয়তের নির্দেশ মতো চলে না, সর্বদা শরীয়তের বরখেলাফ কাজে লিপ্ত থাকে; যেমনঃ হয়ত নামায পড়ে না, রোযা রাখে না, মিথ্যা কথা বলে অথবা এরূপ অন্য কোন পাপ কর্মে লিপ্ত থাকে, শরীয়তের পাবন্দী থাকে না। শরীয়তে এ ধরনের লোকের কথার কোন মূল্য নেই। এ ধরনের লোক যদি শত সহস্র কসম খেয়েও বলে, তথাপি তার কথা বিশ্বাস করা যাবে না। এমন কি, যদি এরূপ দু তিনজন লোকেও বর্ণনা দেয়, তবু তা দ্বারা কিছুই প্রমাণিত হবে না।

৪। মাসয়ালা : প্রচলিত আছে, যেদিন রজব মাসের চার তারিখ হবে, সেদিন রমযানের ১ম তারিখ হবে। শরীয়তে এর কোন মূল্য নেই। চাঁদ না দেখলে রোযা রাখবে না।

৫। মাসয়ালাঃ হাদীস শরীফে রেওয়ায়েত আছে, চাঁদ দেখে এরূপ বলা যে, চাঁদ অনেক বড়, এটা অদ্যকার চাঁদ নয়, কালকের চাঁদ, এরূপ বলা বড়ই খারাপ। এটা কেয়ামতের একটি আলামত। মোট কথা, চাঁদ বড়, ছোট হওয়ার কোন মূল্য নেই। হিন্দুদের কথা বিশ্বাস করো না যে, আজ দ্বিতীয়া, আজ অবশ্য চাঁদ ওঠবে। শরীয়তে এ ধরনের কথার কোন মূল্য নেই।

৬। মাসয়ালাঃ আকাশ সম্পূর্ণ পরিষ্কার থাকা সত্বেও যদি চাঁদ দেখা না যায়, তবে দু’ চারজনের সাক্ষ্যতে চাঁদ ওঠা প্রমাণিত হবে না। তা রমযানের চাঁদই হোক বা ঈদের। অবশ্য যদি এত লোকে চাঁদ দেখার প্রমাণ দেয়, যাতে মনে দৃঢ় ধারণা হয় যে, এত লোক কিছুতেই মিথ্যা কথা বলতে পারে না, তবে চাঁদ ওঠা প্রমাণিত হবে।

৭। মাসয়ালা : অনেক সময় দেশব্যপি এমন প্রচারিত হয়ে যায় যে, কাল চাঁদ দেখা গেছে, কিন্তু প্রকৃত পক্ষে একজনেও চাঁদ দেখেছে বলে সারা দেশে খুঁজে তার প্রমাণ পাওয়া গেল না, শরীয়তে এ ধরনের ভিত্তিহীন গুজবের কোন মূল্য নেই।

৮। মাসয়ালা : রমযান মাসের চাঁদ মাত্র একজনে দেখল, কিন্তু সে লোক যদি শরীয়তের পাবন্দ না হয় তবে অন্য কেউ রোযা রাখবে না। কিন্তু তার নিজের রোযা রাখতে হবে। অবশ্য যদি এই লোকের প্রমাণের হিসাবে ত্রিশ রোযা হয়ে যাওয়া সত্বেও ঈদের চাঁদ দেখা না যায় তাহলে তার একত্রিশ রোযা রাখা ওয়াজিব হবে, ঈদ তাকে সকলের সাথে একত্রেই করতে হবে।

৯। মাসয়ালা : ঈদের চাঁদ কেউ যদি একা একা দেখে, অপর কেউ না দেখে, তাহলে অন্যেরা তো তার কথা গ্রহণ করবেই না, তার নিজেরও একা ঈদ করা জায়েয নেই। পরদিন তাকেও রোযা রাখতে হবে, সে রোযা ভাঙ্গতে পারবে না।

১০। মাসয়ালা : ৩০শে রমযান দিনের বেলায় চাঁদ দেখা গেলে, তা দুপুরের পরে দেখা যাক বা পূর্বে দেখা যাক, কিছুতেই রোযা ভঙ্গ করা যাবে না, সূর্য অস্ত না যাওয়া পর্যন্ত রোযা রাখতে হবে। সূর্যাস্তের পর যথারীতি ইফতার করতে হবে, ওই চাঁদকে সামনের রাতের চাঁদ ধরতে হবে, গত রাতের ধরা যাবে না। কেউ যদি দিনের বেলায় চাঁদ দেখে রোযা ভঙ্গ করে তাহলে তার কাফফারা দিতে হবে।–(বেঃ গওহার)।

.

ক্বাযা রোযা

১। মাসয়ালা : কোন কারণে যদি কেউ রমযান মাসের সব রোযা বা কয়েকটা রোযা রাখতে না পারে, তবে রমযানের পর যত শীঘ্র সম্ভব ওই সব রোযার ক্বাযা আদায় করতে হবে, দেরী করবে না। অকারণে ক্বাযা রোযা রাখতে বিলম্ব করলে পাপ হয়।

২। মাসয়ালা : ক্বাযা রোযা আদায়ের সময় দিন তারিখ নির্দিষ্ট করে বলবে যে অমুক দিনের অমুক তারিখের রোযার ক্বাযা আদায় করতেছি। অবশ্য এরূপ নিয়্যত করা জুরুরী নয়, শুধু যে কয়টি রোযা ক্বাযা হয়েছে সেই কয়টি রাখলেই যথেষ্ট হবে। কিন্তু ঘটনাক্রমে যদি দু’ রমযানের ক্বাযা রোযা একসাথ হয়ে যায় তবে নির্দিষ্ট করে নিয়্যত করতে হবে যে, আজ অমুক বছরের রমযানের রোযা রাখছি।

৩। মাসয়ালা : ক্বাযা রোযার জন্য রাতেই নিয়ত করা প্রয়োজন। সুবহে সাদেকের পর ক্বাযা রোযার নিয়্যত করলে ক্বাযা রোযা শুদ্ধ হবে না। ক্বাযা রোযা দোহরাতে হবে।

৪। মাসয়ালাঃ কাফফারার রোযারও একই নির্দেশ। সুবহে সাদেকের আগে যদি কাফফারার রোযা বলে নির্দিষ্ট করে নিয়ত না করে, তাহলে কাফফারার রোযা শুদ্ধ হবে না।

৫। মাসয়ালা : যে কয়টি রোযা ভঙ্গ হয়েছে তা একাধারে বা বিভিন্ন সময় রাখাও জায়েয আছে।

৬। মাসয়ালা : গত রমযানের কয়েকটি রোযা ক্বাযা ছিল, তা আদায় না করতেই পুনরায় রমযান এসে গেল, এখন তাকে রমযানের রোযাই রাখতে হবে, ক্বাযা পরে আদায় করবে। এরূপ দেরী করা ভাল নয়।

৭। মাসয়ালাঃ রমযান মাসে দিনের বেলায় কেউ বেহুঁশ হয়ে পড়লে এবং কয়েকদিন যাবত ওই অবস্থায় থাকলে যদি কোন ঔষধ ইত্যাদি হলকুমের নীচে না গিয়ে থাকে, তবে হুঁশ হারা অবস্থায় প্রথম দিনের রোযা পাওয়া গেছে, সুতরাং প্রথম দিনের রোযা সহীহ্ হবে। পরে যে কয়দিন বেহুঁশ ছিল, সে কয়দিনের নিয়্যত পাওয়া যায়নি বিধায় কিছু পানাহার না করা সত্বেও সে কয়দিনের রোযা হবে না, সে কয়দিনের রোযা ক্বাযা করতে হবে।

৮। মাসয়ালা : এভাবে যদি রাতে হুঁশ হারায় তবু প্রথম দিনের রোযা তার ক্বাযা আদায় করতে হবে না। হুঁশহারা অবস্থায় অন্যান্য দিনের ক্বাযা আদায় করা ওয়াজিব হবে। কিন্তু যদি পরদিন রোযা আদায়ের নিয়্যত না করে থাকে অথবা কোন ঔষধাদি সকাল বেলায় হলকুমের নিচে গিয়ে থাকে, তাহলে ঐ দিনেরও ক্বাযা রাখতে হবে।

৯। মাসয়ালা–কেউ যদি পুরো রমযান মাস বেহুঁশ অবস্থায় থাকে, তবু সুস্থ হওয়ার পর সমস্ত রমযান মাসের রোযা ক্বাযা করতে হবে। এটা মনে করবে না যে, বেহুঁশ থাকায় একবারে মাফ হয়ে গেছে। অবশ্য যদি কেহ সমস্ত রমযান মাস পাগল থাকে, মাত্রই ভাল না হয়, তবে তার ক্বাযা করা লাগবে না, কিন্তু যদি রমযানের মধ্যে ভাল হয়, তবে যে দিন থেকে ভাল হয়েছে। সে দিন থেকে রোযা রাখবে।

.

মান্নতের রোযা

১। মাসয়ালা : কেউ নামায, রোযা, সদকা ইত্যাদির মান্নত করলে তা পূরণ করা ওয়াজিব হয়ে যায়। পালন না করলে গুনাহগার হতে হবে।

২। মাসয়ালা : মান্নত দু প্রকার। যথাঃ ১। দিন, তারিখ নির্দিষ্ট করে মান্নত করা। ২। অনির্দিষ্ট মান্নত করা। এর প্রতিটি আবার দু’ প্রকার। যথা : (১) শর্ত সাপেক্ষে মান্নত করা। যেমন : বলল, আমার অমুক কাজ সম্পন্ন হলে আমি পঞ্চাশ টাকা আল্লাহর ওয়াস্তে দান করব। (২) বিনা শর্তে কেবল আল্লাহর নামে মান্নত করা, যেমন : বলল, আমি আল্লাহর নামে পাঁচটি রোযা রাখব। মোট কথা, যেভাবে মান্নত করুক না কেন, নির্দিষ্ট হোক বা অনির্দিষ্ট হোক, শর্তসাপেক্ষ হোক বা শর্তহীন হোক আল্লাহর নামে মুখে মান্নত করলেই তা ওয়াজিব হয়ে যায়। কিন্তু শর্ত করে মান্নত করলে যদি সে শর্ত পূর্ণ হয়, তবে ওয়াজিব হবে, অন্যথায় ওয়াজিব হবে না।

যদি কেউ বলে যে, হে আল্লাহ্! আজ যদি আমার অমুক কাজ হয়ে যায়, তবে কালই আমি আপনার নামে একটি রোযা রাখব। অথবা যদি বলে যে, ওগো আল্লাহ্! আমার ওই আশা পূর্ণ হলে পরশু শুক্রবার আমি আপনার নামে একটি রোযা রাখব। এরূপ মান্নতে যদি রাতে রোযার নিয়ত করে তাও দুরস্ত আছে। আর নিয়্যত রাতে না করে দুপুরের এক ঘন্টা পূর্বে নিয়্যত করলেও জায়েয আছে এবং মান্নত আদায় হয়ে যাবে।

৩। মাসয়ালা : মান্নত করে যে জুমু’আর দিন নির্দিষ্ট করেছে, সে জুমু’আর দিন রোযা রাখলে যদি মান্নতের রোযা বলে নিয়্যত না করে, কেবল রোযা রাখার নিয়্যত করে অথবা নফল রোযা রাখার নিয়্যত করে তবুও নির্দিষ্ট মান্নতের রোযাই আদায় হবে। কিন্তু যদি ওমুক তারিখে ক্বাযা রোযা রাখার নিয়্যত করে এবং মান্নতের রোযার কথা স্মরণ না থাকে, অথবা মনে ছিল কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে ক্বাযা রোযা রেখেছে, তাহলে ক্বাযা রোযাই আদায় হবে, মান্নত আদায় হবে না। মান্নতের রোযা অন্য দিন ক্বাযা করতে হবে।

৪। মাসয়ালা : দ্বিতীয় মান্নত হল, যদি দিন, তারিখ নির্দিষ্ট করে মান্নত না করে কেবল বলে যে, আমার অমুক কাজ সম্পন্ন হলে, আমি আল্লাহর ওয়াস্তে পাঁচটি রোযা রাখব। অথবা শর্ত না করে কেবল বলে, আমি আল্লাহর ওয়াস্তে পাঁচটি রোযা রাখব, তথাপিও পাঁচটি রোযা রাখা ওয়াজিব হবে, কিন্তু দিন তারিখ নির্দিষ্ট না করায় যে কোন দিন আদায় করতে পারবে কিন্তু নিয়্যত রাতেই করা শর্ত। সুবহে সাদেকের পর মান্নতের রোযার নিয়্যত করলে এ ধরনের অনির্দিষ্ট মান্নতের রোযা আদায় হবে না এবং এ রোযা নফল হয়ে যাবে।

.

নফল রোযা

১। মাসয়ালা : নফল রোযার জন্য যদি এমন নিয়্যত করে যে, আল্লাহর ওয়াস্তে একটি নফল রোযা রাখব, তাও জায়েয আছে এবং যদি কেবল এমন নিয়্যত করে যে, আমি আল্লাহর ওয়াস্তে একটি রোযা রাখব, তাও জায়েয আছে।

২। মাসয়ালা : বেলা দ্বিপ্রহরের এক ঘন্টা পূর্ব পর্যন্ত নফল রোযার নিয়্যত করা জায়েয আছে। সুতরাং, কারো বেলা দশটা পর্যন্তও রোযা রাখার ইচ্ছা ছিল না কিন্তু এখন পর্যন্ত কিছু পানাহারও করেনি, এরপর তার রোযা রাখার ইচ্ছা হল, এ সময় যদি রোযার নিয়্যত করে তবে নফল রোযা আদায় হয়ে যাবে।

৩। মাসয়ালা : বছরে মাত্র পাঁচ দিন রোযা রাখা জায়েয নেই। দু ঈদের দু’ দিন এবং কোরবানী ঈদের পরের তিন দিন, এই মোট পাঁচদিন রোযা রাখা হারাম, এ ছাড়া যে কোন দিন নফল রোযা রাখা যায় এবং নফল রোযা যত বেশি রাখা হবে নেকী তত বেশি পাওয়া যাবে।

৪। মাসয়ালা : যদি কেউ ঈদের দিন রোযা রাখার মান্নত করে, তবুও ঈদের দিন রোযা রাখা জায়েয হবে না, তার পরিবর্তে অন্য দিন তাকে রোযা রেখে মান্নত পূর্ণ করতে হবে।

৫। মাসয়ালা : কেউ যদি এমন মান্নত করে যে, আমি সমস্ত বছর রোযা রাখব, এক দিনের রোযাও বাদ দেব না, তবু এ পাঁচ দিন রোযা রাখবে না। এ পাঁচ দিন রোযা না রেখে তার বদলে অন্য পাঁচ দিন রোযা রাখতে হবে।

৬। মাসয়ালা : যদি কেউ নফল রোযার নিয়্যত করে, তবে সেই রোযা পূর্ণ করা ওয়াজিব হয়ে যায়। সুতরাং কেউ সকালে নফল রোযার নিয়ত করে পরে ভেঙ্গে ফেলে তার ওই রোযার ক্বাযা আদায় করা ওয়াজিব হবে।

৭। মাসয়ালা : কেউ রাতে রোযা রাখার নিয়্যত করে বলেছিল, আমি আগামী কাল রোযা রাখব’ কিন্তু সুবহে সাদেকের পূর্বেই নিয়্যত পাল্টে গেল এবং রোযা রাখল না, তবে তার ক্বাযা ওয়াজিব হবে না।

৮। মাসয়ালাঃ স্ত্রীর জন্য স্বামী বাড়ীতে থাকলে স্বামীর অনুমতি ব্যতীত নফল রোযা রাখা জায়েয নয়। এমন কি, স্বামীর অনুমতি ছাড়া যদি নফল রোযার নিয়্যত কেউ করে এবং পরে স্বামী রোযা ভাঙ্গতে আদেশ করে, তাহলে রোযা ভাঙ্গা জায়েয আছে কিন্তু পরে স্বামীর অনুমতি নিয়ে ক্বাযা করতে হবে।

৯। মাসয়ালা : মেহমান অথবা মেযবান যদি একে অপরের সাথে না খাওয়াতে মনে কষ্ট পায়, তবে নফল রোযা ভেঙ্গে ফেলা জায়েয আছে কিন্তু ওই রোযার পরিবর্তে একটি রোযা রাখতে হবে।

১০। মাসয়ালা : কেউ ঈদের দিন নফল রোযা রাখল এবং নিয়্যতও করল, তবুও সেই রোযা ছেড়ে দেবে, তার ক্বাযা করাও ওয়াজিব হবে না।

১১। মাসয়ালাঃ মহরম মাসের দশ তারিখ রোযা রাখা মুস্তাহাব। হাদীস শরীফে রেওয়ায়েত আছে যে কেউ মহরম মাসের ১০ তারিখে একটি রোযা রাখলে তার বিগত এক বছরের (ছগীরা) গুনাহ্ মাফ হয়ে যাবে।

১২। মাসয়ালাঃ জিলহজ্জ মাসের ৯ তারিখ রোযা রাখাও বড় ছাওয়াবের কাজ। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি জিলহজ্জ মাসের ৯ তারিখে এ রোযা রাখবে বিগত এবং আগামী বছরের (ছগীরা) গুনাহ্ মাফ হয়ে যাবে।

১৩। মাসয়ালা : শাবানের চাঁদের পনর তারিখ রোযা রাখা এবং শাওয়ালের চাঁদের ঈদের দিন বাদ দিয়ে ছয়টি রোযা রাখা অন্য সব নফল রোযা অপেক্ষা বেশি ছাওয়াব।

১৪। মাসয়ালা : যে প্রত্যেক চাঁদের ১৩, ১৪, ১৫, তারিখে আইয়্যাম বীজের তিনটি রোযা রাখল, সে যেন সমস্ত বছরই রোযা রাখল। রাসূলুল্লাহ (ছঃ) এই তিনটি রোযা রাখতেন এবং প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবারও রোযা রাখতেন। কেউ যদি এসব রোযা রাখে তাহলে অনেক ছাওয়াব পাওয়া যায়।

.

যে যে কারণে রোযা ভঙ্গ হয় বা ভঙ্গ হয় না

১। মাসয়ালা : রোযা রেখে রোযার কথা ভুলে গিয়ে কিছু খেয়ে ফেললে কিংবা ভুলে স্বামী সহবাস করলে, রোযার কথা মোটেই মনে না আসলে তাতে রোযা ভঙ্গ হয় না। ভুলে যদি কেউ পেটভরে পানাহারও করে কিংবা ভুলে কয়েকবার পানাহার করে, তবুও রোযা ভঙ্গ হয় না।

২। মাসয়ালা : কোন রোযাদারকে ভুলে আহার করতে দেখলে যদি রোযাদার সবল হয় এবং রোযা রাখতে কষ্ট না হয়, তবে তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া ওয়াজিব। কিন্তু যদি রোযা রাখার মত শক্তি তার না থাকে, তবে স্মরণ করাবে না, তাকে খেতে দেবে।

৩। মাসয়ালা : রোযা রেখে নিদ্রা গেলে বা স্বপ্ন দোষ হলে রোযা ভঙ্গ হয় না।

৪। মাসয়ালা : রোযা রেখে সুরমা বা তৈল লাগানো অথবা সুগন্ধ নেয়া জায়েয আছে। এমন কি, চোখে সুরমা দিলে যদি থুথু কিংবা শ্লেষ্মায় সুরমার রং দেখা যায়, তবুও রোযা ভঙ্গ হয় না, মাকরূহও হয় না।

৫। মাসয়ালা : রোযা রেখে দিনের বেলায় স্বামী-স্ত্রী এক সাথে শুয়ে, হাত লাগানো বা আদর করা সবই জায়েয, কিন্তু কাম ভাব প্রবল হয়ে সহবাসের আশঙ্কা হলে, এরূপ করা মাকরূহ।

৬। মাসয়ালাঃ নিজে নিজে যদি হলকুমের মধ্যে মাছি, ধোয়া বা ধুলা চলে যায়, তবে তাতে রোযা ভঙ্গ হয় না, কিন্তু ইচ্ছা পূর্বক এরূপ করলে রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে।

৭। মাসয়ালা : লোবান বা আগরবাতি জ্বালিয়ে তার ধোয়া নিলে রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে। এমন কি কেউ যদি বিড়ি, সিগারেট অথবা হুক্কার ধোয়া পান করে তবে তার রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে, কিন্তু গোলাপ, কেওয়া ফুল, আতর ইত্যাদি যে সব ঘ্রাণে ধোয়া নেই, তার ঘ্রাণ নেয়া জায়েয আছে।

৮। মাসয়ালাঃ দাঁতের ফাঁকে কোন খাদ্যদ্রব্য আটকে থাকলে এবং খেলাল বা জিহ্বা দিয়ে তা বের করে মুখের বাইরে না এনে গিলে ফেললে, এবং ওই খাদ্য দ্রব্য একটি বুটের সমান অথবা তদপেক্ষা বেশি হলে রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে। কিন্তু একটি বুট অপেক্ষা কম হলে, তবে রোযা ভঙ্গ হবে না। কিন্তু মুখ হতে বের করে পুনরায় গিলে ফেললে, বুট অপেক্ষা কম হলেও রোযা ভেঙ্গে যাবে।

৯। মাসয়ালা : মুখের থু থু যত বেশীই হোক না কেন, তা গিলে ফেললে রোযার কোন ক্ষতি হয় না।

১০। মাসয়ালা : শেষ রাতে সেহরী খাওয়ার পর কেউ পান খেলে সুবহে সাদেকের আগেই উত্তমরূপে কুলি করে মুখ ছাফ করে নেয়া উচিত। ভালভাবে কুলি করার পর সকালে থু থু কিছু লাল দেখা গেলে তাতে রোযা ভঙ্গ হবে না।

১১। মাসয়ালাঃ রাতে গোসল করা ফরয হলে সুবহে সাদেকের পূর্বেই গোসল করে নেয়া উচিত, কিন্তু কেউ যদি গোসল করতে দেরী করে কিংবা সারা দিন গোসল নাও করে, তবে তাতে রোযা ভাঙ্গবে না। অবশ্য ফরয গোসল অযথা দেরীতে করলে তার জন্য পৃথক গুণাহ্ হবে।

১২। মাসয়ালা : নাকের শ্লেষ্মা জোরে টানার কারণে হলকুমে চলে গেলে তাতে রোযা নষ্ট হয় না। এমনকি মুখের লালা টেনে গিললেও রোযা ভাঙ্গবে না।

১৩। মাসয়ালা : কোন ব্যক্তি সেহরী খাবার পর পান খেয়ে চিবাতে চিবাতে ঘুমিয়ে পড়লে এবং পান মুখে থাকা অবস্থায় ভোর হয়ে গেলো তার রোযা শুদ্ধ হবে না। এ রোযা ভাঙ্গতে পারবে না বটে কিন্তু তার ক্বাযা আদায় করতে হবে। কাফফারা ওয়াজিব হবে না।

১৪। মাসয়ালা : কুলি করার সময় যদি অসতর্কতাবশতঃ পানি হলকুমের ভেতরে চলে যায়, তবে রোযা ভঙ্গ হবে। এ রোযার ক্বাযা করা ওয়াজিব, কাফফারা ওয়াজিব নয়।

১৫। মাসয়ালা : আপনা আপনি যদি বমি হলে বেশি হোক বা কম হোক, রোযা নষ্ট হয় না। কিন্তু যদি ইচ্ছাকৃতভাবে মুখ ভরে বমি করে, তবে রোযা নষ্ট হয়ে যায়, অল্প বমি করলে রোযা নষ্ট হয় না।

১৬। মাসয়ালা : আপনা আপনি বমি হলে এবং আপনা আপনি হলকুমের ভেতর চলে গেলে রোযা নষ্ট হবে না। কিন্তু যদি ইচ্ছাকৃতভাবে গিলে, তবে কম হলেও রোযা নষ্ট হয়ে যাবে।

১৭। মাসয়ালা : কেউ একটি কঙ্কর বা একটি লোহার গুলি বা একটি পয়সা গিলে ফেললে অর্থাৎ এমন কোন জিনিষ গিলে ফেললে যা লোকে সাধারণত খাদ্য হিসেবেও আহার করে না খায় না বা ঔষধ হিসাবেও সেবন করে না, তবে তাতে রোযা ভঙ্গ হবে বটে, কিন্তু কাফফারা দিতে হবে না, শুধু একটির বদলে একটি রোযা ক্বাযা আদায় করতে হবে। আর যদি এমন কোন জিনিস গিলে ফেলে, যা লোকে খাদ্য হিসেবে আহার করে অথবা পানীয় হিসেবে পান করে বা ঔষধ হিসেবে সেবন করে, তবে তাকে ক্বাযাও দিতে হবে এবং কাফফারাও করতে হবে।

১৮। মাসয়ালা : রোযা রেখে দিনের বেলায় সহবাস করলে, এমন কি পুরুষের খত্নার স্থান স্ত্রীর যোনী দ্বারে প্রবেশ করলে বীর্যপাত হোক বা না হোক, রোযা ভেঙ্গে যাবে এবং ক্বাযা কাফফারা উভয়ই ওয়াজিব হবে।

১৯। মাসয়ালা : স্বামী স্ত্রীর মলদ্বারের ভেতরে পায়খানার রাস্তায় পুরুষাঙ্গের খনার স্থান পরিমাণ পর্যন্ত প্রবেশ করালেও, উভয়ের রোযা ভেঙ্গে যাবে এবং ক্বাযা ও কাফফারা উভয়ই ওয়াজিব হবে।

২০। মাসয়ালা : রমযান শরীফের রোযা রেখে তা ভাঙ্গলে কাফফারা ওয়াজিব হয়। রমযান ছাড়া অন্য কোন রোযা ভঙ্গ করলে কাফফারা ওয়াজিব হয় না, যেভাবেই ভঙ্গ করুক, এমনকি রমযানের ক্বাযা রোযা রেখে ভাঙ্গলেও। অবশ্য যদি রাতে রোযার নিয়্যত না করে কিংবা রোযা ভাঙ্গার পর ওই দিনই ঋতুস্রাব শুরু হয়, তবে ওই ভাঙ্গার ফলে কাফফারা ওয়াজিব হবে না।

২১। মাসয়ালা : নাকে নস্যি টানলে বা কানে তৈল ঢাললে অথবা মল ত্যাগের জন্য ঢুস নিলে রোযা নষ্ট হয়ে যায় কিন্তু এরূপ করলে কাফফারা ওয়াজিব হবে না। কেবলমাত্র ক্বাযা করতে হবে। কানে পানি টপকালে রোযা ভঙ্গ হয় না।

২২। মাসয়ালা : রোযা অবস্থায় পেশাবের রাস্তায় কোন ঔষধ রাখা অথবা তৈল ইত্যাদি কিছু টপকানো জায়েয নেই। কেউ যদি ঔষধ রাখে, তবে রোযা ভাঙ্গবে এবং ক্বাযা ওয়াজিব হবে, কাফফারা ওয়াজিব হবে না।

২৩। মাসয়ালা : ধাত্রী যদি প্রসূতির যৌনাঙ্গে আঙ্গুল প্রবেশ করায় বা নিজেই নিজের যোনিতে আঙ্গুল প্রবেশ করায়, অতঃপর আঙ্গুল কিছুটা বের করে পুনরায় প্রবেশ করায় অথবা সম্পূর্ণ আঙ্গুল বের করে পুনরায় প্রবেশ করায় তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে, কিন্তু কাফফারা ওয়াজিব হবে না। আর যদি বের করার পর পুনরায় প্রবেশ না করায় তাহলে রোয়া ভঙ্গ হবে না। অবশ্য যদি পানি ইত্যাদির দ্বারা আঙ্গুল ভিজা থাকে, তবে প্রথমবার ঢুকালেই রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে।

২৪। মাসয়ালা : দাঁত দিয়ে রক্ত বের হলে তা থুথুর সাথে গিলে ফেললে রোযা ভঙ্গ হবে, কিন্তু থুথুর চেয়ে যদি রক্ত কম হয়-যাতে রক্তের স্বাদ পাওয়া না যায়, তবে রোযা নষ্ট হবে না।

২৫। মাসয়ালা : কোন জিনিস জিহ্বার আগা দিয়ে শুধু একটু স্বাদ নিয়ে থুথু ফেললে রোযা ভঙ্গ হয় না কিন্তু বিনা কারণে এরূপ করা মাকরূহ্। অবশ্য যদি কারো স্বামী জালিম ও পাষাণ হৃদয়ের অধিকারী হয়, তরকারীতে লবণ কম বা বেশি হওয়ায় যদি জুলুম করে, তার জন্য তরকারীর লবণ দেখে থুথু ফেলে দেয়া দুরস্ত আছে, মাকরূহ্ নয়।

২৬। মাসয়ালা : রোযাবস্থায় শিশুকে আহার করানোর জন্য কোন বস্তু চিবিয়ে দেয়া মাকরূহ্। অবশ্য শিশুর জীবন ওষ্ঠাগত হলে এবং কেউ চিবিয়ে দেয়ার না থাকলে এরূপ অবস্থায় চিবিয়ে দিয়ে মুখ পরিস্কার করে ফেলা দুরস্ত আছে।

২৭। মাসয়ালা : রোযা রেখে দিনের বেলায় কয়লা, মাজন ইত্যাদি দ্বারা দাঁত মাজা মাকরূহ্ এবং এর অংশ বিশেষ যদি হলকুমের নিচে চলে যায়, তবে রোযা ভেঙ্গে যাবে। কাঁচা বা শুকনা মেসওয়াক দ্বারা দাঁত মাজা জায়েয আছে। এমন কি, যদি নিমের কাঁচা ডালের মেসওয়াক দ্বারা দাঁত মাজে এবং তার তিক্ততার স্বাদ অনুভুত হয়, তবু রোযার কোন ক্ষতি হবে না, মাকরূহও হবে না।

২৮। মাসয়ালা : কোন মহিলা অসতর্কতা অবস্থায় নিদ্রিত রয়েছে কিংবা অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে, এমতাবস্থায় তার সাথে কেউ যৌন কাজ করলে তার রোযা ভঙ্গ হবে এবং ক্বাযা ওয়াজিব হবে, কিন্তু পুরুষের ক্বাযা ও কাফফারা উভয়ই ওয়াজিব হবে।

২৯। মাসয়ালা : ভুলবশতঃ পানাহার করলে রোযা ভঙ্গ হয় না, কিন্তু ভুলবশতঃ পানাহার করার পর রোযা ভেঙ্গে গেছে মনে করে কিছু খেলে রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে কিন্তু ক্বাযা করতে হবে, কাফফারা ওয়াজিব হবে না।

৩০। মাসয়ালা : কারো যদি আপনা আপনি বমি হয়, তাতে রোযা ভঙ্গ হয় না, অবশ্য রোযা ভেঙ্গে গেছে মনে করে পুনরায় কিছু খেলে রোযা ভঙ্গ হবে এবং শুধু ক্বাযা করতে হবে, কাফফারা দেয়া লাগবে না।

৩১। মাসয়ালা : কেউ সুরমা বা তৈল মেখে অজ্ঞতার কারণে তার রোযা ছুটে গেছে মনে করে ইচ্ছা করে কিছু খাওয়া-দাওয়া করে, তবে ক্বাযা ও কাফফারা উভয়ই ওয়াজিব হবে।

৩২। মাসয়ালা : রমযান মাসে কোন ওযরবশতঃ কারো রোযা ভেঙ্গে গেলে তার জন্য দিনের বেলা কিছু পানাহার করা জায়েয নয়। সারা দিন রোযাদারের ন্যায় না খেয়ে থাকা তার জন্য ওয়াজিব।

৩৩। মাসয়ালা : রমযানের রোযার নিয়ত করেনি বলে কেউ খাওয়া-দাওয়া করতে থাকলে তার ওপর কাফফারা ওয়াজিব হবে না, রোযার নিয়্যত করে ভাঙ্গলে কাফফারা ওয়াজিব হবে।

.

রোযার কাফফারা

১। মাসয়ালাঃ রমযান মাসে রোযা ভেঙ্গে ফেললে একাধারে দু’ মাস অর্থাৎ ৬০টি রোযা রাখতে হবে। ভেঙ্গে ভেঙ্গে রাখা জায়েয নেই। ধারাবাহিকভাবে ৬০টি রোযা রাখতে হবে। মাঝখানে যদি ঘটনাক্রমে দু’ একদিনও বাদ পড়ে, তবে তার পর থেকে পুনরায় গণনা করে ৬০টি কাজা পূর্ণ করতে হবে। পূর্বেরগুলো হিসাবের অন্তর্ভুক্ত হবে না। এমন কি, যদি এই ৬০ দিনের মধ্যে ঈদের দিন বা কোরবানীর দিনও আসে, কাফফারা আদায় হবে না। পূর্বেরগুলো বাদ দিয়ে তার পর হতে ৬০টি পূর্ণ করতে হবে। কিন্তু মেয়েদের যদি এ ৬০ দিনের মধ্যে হায়েজ হয়, তবে তা মাফ কিন্তু হায়েজ থেকে পাক হবার পরের দিন হতে আবার রোযা রাখতে হবে এবং ৬০ রোযা পূর্ণ করতে হবে।

২। মাসয়ালাঃ নেফাসের কারণে রোযা ভাঙ্গা পড়লে, কাফফারা আদায় হবে না। নেফাস থেকে পাক হওয়ার পর ৬০টি পূর্ণ করতে হবে। নেফাসের পূর্বে যদি কিছু রোযা রেখে থাকে, তবে তা গণনায় ধরা হবে না।

৩। মাসয়ালা : রোগের কারণে যদি মাঝে ভাঙ্গা পড়ে, তবে রোগ ভাল হওয়ার পর নতুন ভাবে ৬০টি রোযা রাখতে হবে।

৪। মাসয়ালা : কারো কাফফারার রোযা রাখার শক্তি না থাকলে রমযানের একটি রোযা ভাঙ্গলে তার পরিবর্তে ৬০ জন মিসকীনকে দু ওয়াক্ত ভালভাবে পেট পুরে আহার করাতে হবে।

৬। মাসয়ালা : যদি এ ৬০ জন মিসকীনের মধ্যে কয়েকজন এমন কম বয়সের হয় যে, তারা পূর্ণ আহার করতে পারে না, তবে তাদেরকে হিসাবের অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। তাদের পরিবর্তে অপর পূর্ণ খোরাক খাওয়ার উপযুক্ত মিসকীনকে আবার খাওয়াতে হবে।

৭। মাসয়ালা : যদি গমের রুটি হয়, তাহলে শুধু রুটি খাওয়ানোও জায়েয আছে, আর যব হলে বা বজরা, ভুট্টা ইত্যাদির রুটি বা ভাত হলে তার সাথে কিছু ভাল তরকারী দেয়া উচিত, যাতে রুটি, ভাত খেতে পারে।

৮। মাসয়ালাঃ রান্না করা খাদ্য না খাওয়ায়ে যদি ৬০ জন মিসকীনকে গম বা তার আটা দেয়, তাও দুরস্ত আছে। কিন্তু প্রত্যেক মিসকীনকে ছদকায়ে  ফিৎর পরিমাণ দিতে হবে। ছদকায়ে ফিৎরের বর্ণনা যাকাত অধ্যায় দেয়া আছে।

৯। মাসয়ালা : যদি এ পরিমাণ গমের মূল্য দিয়ে দেয়া হয়, তবে তাও দুরস্ত আছে।

১০। মাসয়ালা : কিন্তু কোন ব্যক্তি তার কাফফারা আদায় করার জন্য কাউকে অনুমতি দিলে বা আদেশ করলে এবং তারপর সে ব্যক্তি আদায় করে দিলে তার কাফফারা আদায় হয়ে যাবে। যার ওপর কাফফারা ওয়াজিব হয়েছে তার অনুমতি ছাড়া অন্য কেউ তার কাফফারা আদায় করে দিলে, তবে তাতে তার কাফফারা আদায় হবে না।

১১। মাসয়ালা : একজন মিসকীনকে ৬০ দিন সকাল-বিকাল পেট ভরে খানা দিলে বা একই জনকে ৬০ দিন ৬০ বার গম বা তার মূল্য দিলে, তাতে কাফফারা আদায় হয়ে।

১২। মাসয়ালা : ৬০ দিন পর্যন্ত খাওয়ানোর সময় বা মূল্য দেয়ার সময় মাঝে ২/১ দিন বাদ পড়লে তাতে কোন ক্ষতি নেই।

১৩। মাসয়ালা : ৬০ দিনের আটা বা গম অথবা তার মূল্য হিসাব করে একই দিন একজন মিসকীনকে দেয়া জায়েয নেই। এভাবে একদিনের কাফফারা আদায় হবে, বাকী ৫৯ দিনের কাফফারা পুনরায় আদায় করতে হবে। সার কথা হল, একদিন একজন মিসকীনকে একটি রোযার বিনিময় হতে বেশি দিলে তার হিসেব ধরা হবে না, মাত্র একদিনেরই ধরা হবে।

১৪। মাসয়ালা : কোন মিসকীনকে সদকায়ে  ফিৎর এর পরিমাণ অপেক্ষা কম দিলে কাফফারা আদায় হবে না।

.

যে সকল কারণে রোযা রাখার পরও ভাঙ্গা যায়

১। মাসয়ালা : রোযা রাখার পর হঠাৎ যদি এমন রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে যে, কিছু ওযূধ-পানি না খেলে জীবননাশের আশঙ্কা হতে পারে বা রোগ বৃদ্ধি পেতে পারে, তাহলে এমন অবস্থায় রোযা ছেড়ে দিয়ে ওযূধ সেবন করা দুরস্ত আছে। যেমনঃ হঠাৎ পেটের ব্যথায় এমন অস্থির হয়ে পড়ল অথবা সাপে দংশন করল যে, ঔষধ না খেলে জীবনের আশা ত্যাগ করতে হয়, এমন পিপাসা ধরেছে যে, প্রাণ নাশের আশঙ্কা হয়, এসব ক্ষেত্রে রোযা ভাঙ্গা দুরস্ত আছে।

২। মাসয়ালা : গর্ভবতী মহিলার যদি এমন অবস্থা হয় যে, নিজের বা পেটের সন্তানের জীবন নাশের আশঙ্কা হয়, তাহলে রোযা ভাঙ্গা দুরস্ত আছে।

৩। মাসয়ালা : রান্না করার কারণে যদি এমন পিপাসা ধরে যাতে প্রাণ নাশের আশঙ্কা হয়, তবে রোযা ছেড়ে দেয়া জায়েয আছে। কিন্তু কেউ যদি স্বেচ্ছায় এরূপ কাজ করে, যাতে এ ধরনের অবস্থা হয়, তাহলে গুনাহগার হবে।

.

রোযার ফিদইয়া

নামায বা রোযার বদলে যে ছদকা দেয়া হয় তাকে ফিদইয়া বলা হয় এবং রমযানের রহমত বরকত ও হুকুম পালনে সক্ষম হওয়ার আনন্দে বান্দা ঈদের দিন নিজের ও নিজের পরিবারবর্গের পক্ষ হতে যা কিছু ছদকা করে, তাকে ফিৎরা বলা হয়। ফিৎরার কথা পরে বর্ণনা করা হবে। নিম্নে ফিদইয়া সম্পর্কে বর্ণনা করা হচ্ছে।

১। মাসয়ালা : এমন বৃদ্ধ, যার রোযা রাখার আর শক্তি নেই বা এত রোগা বা দূর্বল হয়েছে। যে, তার ভাল হবার আর আশা নেই। এ ধরনের লোকের জন্য শরীয়তে এর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সে প্রতি রোযার জন্য হয় একজন মিসকীনকে দু বেলা পেট পুরে আহার করাবে অথবা একটি রোযার পরিবর্তে একজন মিসকীনকে ছদকায়ে  ফিৎর পরিমাণ গম বা তার মূল্যের চাল অথবা অর্থ দান করবে। একেই শরীয়তের পরিভাষায় ফিদইয়া বলা হয়।

২। মাসয়ালাঃ একটি রোযার ফিদইয়া একজন মিসকীনকে দেয়াই উত্তম। কিন্তু একটি রোযার ফিদইয়া কয়েকজন মিসকীনকে কিছু কিছু করে দেয়া হলে তাও জায়েয আছে।

৩। মাসয়ালা : কোন বৃদ্ধ যদি আবার কখনো রোযা রাখার শক্তি ফিরে পায় অথবা চির রোগা, নিরাশ ব্যক্তি আবার আরোগ্য লাভ করে এবং রোযা রাখার শক্তি ফিরে পায়, তাহলে যে সব রোযার ফিদইয়া দিয়েছে সে সব রোযার ক্বাযা করতে হবে এবং যা ফিদইয়া দেয়া হয়েছে। তার ছাওয়াব পৃথকভাবে পাবে।

৪। মাসয়ালা : যার রোযার ক্বাযা থাকে, মৃত্যুর পূর্বে তার অছিয়ত করে যেতে হবে যে, আমার এতগুলো রোযা ক্বাযা আছে, তোমরা এর ফিদইয়া আদায় করে দিও। এ ধরনের অছিয়ত করে গেলে তার স্থাবর-অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি থেকে (১) আগে তার কাফনের ব্যবস্থা করতে হবে। (২) তারপর ঋণ পরিশোধ করতে হবে। (৩) তারপর যা কিছু অবশিষ্ট থাকে, তার এক তৃতীয়াংশ দ্বারা সম্পূর্ণ অছিয়ত যদি পূর্ণ না হয়, তবে যে পরিমাণ আদায় হয়, সে পরিমাণ আদায় করা ওয়াজিব এবং যা অবশিষ্ট থাকে, তা যদি ওয়ারিশগণ নিজ খুশিতে আদায় করে দেয়, তাহলে তাদের জন্য এটা অতি উত্তম হবে এবং মৃতের জন্য নাজাতের উপায় হবে।

৫। মাসয়ালা : মৃত ব্যক্তি অছিয়ত করে না গেলেও যদি তার ওয়ালী-ওয়ারিশ থাকে তারা নিজের তরফ থেকে যদি তার রোযা, নামাযের ফিদইয়া দেয়, তবু আশা করা যায় যে, আল্লাহ পাক আপন দয়া গুণে তা কবুল করে নেবেন এবং মৃত ব্যক্তির অপরাধ ক্ষমা করে দেবেন। যদি অছিয়ত না করে থাকে, তবে মৃত ব্যক্তির মাল হতে ফিদইয়া দেয়া দুরস্ত নেই। এভাবে যদি ফিদইয়া তিন ভাগের এক ভাগ থেকে বেশি হয়, তবে অছিয়ত করা সত্ত্বেও সকল ওয়ারিশের অনুমতি ছাড়া বেশি দেয়া দুরস্ত নেই। অবশ্য সকলে যদি খুশি হয়ে অনুমতি দেয়, তাহলে উভয় অবস্থায় ফিদইয়া দেয়া জায়েয আছে। কিন্তু অপ্রাপ্তবয়স্ক ওয়ারিশের অনুমতির কোন মূল্য নেই। প্রাপ্তবয়স্ক ওয়ারিশগণ যদি নিজ নিজ অংশ পৃথক করে তা থেকে দেয়, তবে জায়েয আছে।

৬। মাসয়ালা : কারো যদি নামায ক্বাযা থাকে এবং অছিয়ত করে মারা যায় যে, আমার নামাযের বদলে ফিদইয়া দিয়ে দিও, তারও এই হুকুম।

৭। মাসয়ালা : প্রতি ওয়াক্ত নামাযের ফিদইয়া একটি রোযার ফিদইয়ার সমান। এ হিসেবে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত ফরয এবং বেতর এ ছয় ওয়াক্ত নামাযের ফিদইয়া আশি তোলা সেরের এক ছটাক কম পৌনে এগার সের গম দেবে। কিন্তু সাবধানতার জন্য পুরা বার সের দেবে।

৮। মাসয়ালা : কারো দায়িত্বে যাকাত থেকে গেল, কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে অছিয়ত করে গেল না যে, আমার দায়িত্বে এতটাকা যাকাত ফরয হয়ে আছে, তোমরা আদায় করে দিও, তাহলে ওই পরিমাণ যাকাত আদায় করা ওয়ারিশদের ওপর ওয়াজিব হবে। অছিয়ত না করে থাকলে যদি ওয়ারিশগণ নিজ খুশিতে দেয়, তবে যাকাত আদায় হবে না। আল্লামা শামী ছেরাকুল ওয়াহ্হাজ থেকে উদ্ধৃত করেছেন যে, যদি ওয়ারিশগণ অছিয়ত ব্যতীত আদায় করে তবে আদায় হয়ে যাবে।

৯। মাসয়ালা : ওয়ালী যদি মৃত ব্যক্তির পক্ষে ক্বাযা রোযা রাখে বা ক্বাযা নামায পড়ে, তবে তা জায়েয নেই। অর্থাৎ, তার যিম্মায় ক্বাযা আদায় হবে না।

১০। মাসয়ালা : অকারণে রমযানের রোযা ত্যাগ করা জায়েয নেই। এটা শক্ত গুনাহ্। এরূপ মনে করবে না যে, এর বদলে রোযা ক্বাযা করে নেবে। কেননা, হাদীসে আছে, রমযানের এক রোযার পরিবর্তে যদি পূর্ণ বছর রোযা রাখে, তবু এতটুকু নেকী পাবে না, যতটুকু রমযানের একটি রোযায় নেকী পাওয়া যায়।

১১। মাসয়ালা : দুর্ভাগ্যবশতঃ কেউ যদি রোযা না রাখতে পারে, তবে অন্যান্য লোকের সামনে পানাহার করবে না। এবং অন্যের নিকট প্রকাশ করবে না যে, আমি রোযা রাখিনি। কেননা, পাপ করে তা প্রকাশ করাও পাপ। প্রকাশ্যে বলে বেড়ানো দ্বিগুণ পাপ। একটি রোযা না রাখার এবং অপরটি পাপ প্রকাশ করার। কেউ আবার বলে থাকে, যখন আল্লাহর নিকট গোপন নেই, তখন মানুষের কাছে গোপন করা ঠিক না। এই ধারণা ভুল। বরং কোন কারণে রোযা না রাখতে পারলে মানুষের সামনে আহার করা অনুচিত।

১২। মাসয়ালা : ছেলে-মেয়েরা আট, নয় বছরের হলে আর রোযা রাখার মতো শক্তিসম্পন্ন। হলে, তখনই তাদেরকে রোযা রাখার অভ্যাস করানো উচিৎ। না রাখতে পারলেও কিছু অভ্যাস করানো উচিৎ। ছেলে-মেয়ে যখন দশ বছরের হয়ে যায় তখন শাস্তি দিয়ে হলেও তাদের দ্বারা রোযা-নামায করানো উচিত।

১৩। মাসয়ালা : অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে-মেয়েরা যদি রোযা রেখে শক্তিতে না কুলানোর কারণে রোযা ভাঙ্গতে চায়, তবে ভাঙ্গতে দেয়া ভাল নয় বটে, কিন্তু যদি ভেঙ্গে ফেলে তবে রোযা আর পুনরায় রাখার প্রয়োজন নেই। কিন্তু যদি নামায শুরু করে নিয়্যত ছেড়ে দেয়, তবে নামায পুনরায় পড়ানো উচিত।

.

এ’তেকাফের মাসয়ালা

রমযান মাসের ২০ তারিখে সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ পূর্ব থেকে ২৯/৩০ তারিখ অর্থাৎ যেদিন ঈদের চাঁদ দেখা যায় সে তারিখের সূর্যাস্ত পর্যন্ত পুরুষদের মসজিদে এবং মেয়েদের নিজ গৃহের যেখানে নামায পড়ার স্থান নির্ধারিত আছে সেখানে পাবন্দীর সাথে অবস্থান করাকে এ’তেকাফ বলে। এর নেকী অত্যধিক। এ’তেকাফ আরম্ভ করলে পেশাব-পায়খানা কিংবা পানাহারের প্রয়োজন হলে মসজিদের এ’তেকাফের স্থান থেকে অন্যত্র যাওয়া দুরস্ত আছে। আর যদি খাবার পৌঁছানোর লোক থাকে, তাহলে এর জন্য বাইরে বের হবে না সেখানেই থাকবে। বিনা কাজে বসে থাকা ভাল নয়। কোরআন শরীফ তেলাওয়াত, নফল নামায, সাধ্যমত তসবীহ্ পাঠ করতে থাকবে এবং ঘুমাবে। হায়েয বা নেফাস শুরু হলে এতেকাফ ছেড়ে দেবে। এ অবস্থায় এতেকাফ জায়েয নেই। এ’তেকাফের মধ্যে সহবাস আলিঙ্গন জায়েয নেই।

মাসয়ালা : এ’তেকাফের জন্য প্রয়োজনীয় তিনটি বিষয়।

১। যে মসজিদে নামাযের জামায়াত হয়, তাতে এ’তেকাফের নিয়্যতে অবস্থান করা। নিয়্যত ছাড়া অবস্থান করাকে এতেকাফ বলে না। যেহেতু নিয়্যত সহীহ্ হওয়ার জন্য নিয়্যতকারীর মুসলমান এবং কাণ্ড জ্ঞান সম্পন্ন হওয়া শর্ত, কাজেই এ উভয়টি নিয়্যতের অন্তর্ভুক্ত। হায়েয-নেফাস এবং গোসলের প্রয়োজন থেকে পবিত্র হওয়া।

২। মাসয়ালা : এ’তেকাফের জন্য সবচেয়ে উত্তম স্থান হল (কা’বা শরীফের) মসজিদে হারাম। এরপর মসজিদে নববী, অতঃপর বাইতুল মুকাদ্দাস। তারপর যে মসজিদে জামাআতের ব্যবস্থা আছে। অন্যথায় মহল্লার মসজিদ। এরপর যে মসজিদে বড় জামায়াত হয়।

৩। মাসয়ালা : এতেকাফ তিন প্রকার। যথা : (১) ওয়াজিব, (২) সুন্নাতে মুয়াক্বাদা, (৩) মুস্তাহাব। মান্নতের এতেকাফ ওয়াজিব, বিনাশর্তে হোক, যেমন–কেউ বিনাশর্তে এ’তেকাফের মান্নত করল। কিংবা শর্তসাপেক্ষে করল, যেমন–কেউ শর্ত করল যে, যদি আমার অমুক কাজ  হয় তবে আমি এ’তেকাফ করব। রমযান মাসের শেষ দশদিন এ’তেকাফ করা সুন্নাতে মুয়াক্বাদা। নবী (ছঃ) নিয়মিতভাবে প্রত্যেক রমযান মাসের শেষ দশ দিন এ’তেকাফ করেছেন বলে সহীহ হাদীসে প্রমাণ আছে। এ সুন্নাতে মুয়াক্বাদা কেউ কেউ আদায় করলে সকলেই দায়মুক্ত হবে। রমযান মাসের শেষ দশ দিন ব্যতীত, প্রথম দশদিন হোক কিংবা মাঝের দশ দিন হোক অথবা অন্য যে কোন মাসে হোক, তাকে মুস্তাহাব এ’তেকাফ বলা হয়।

৪। মাসয়ালা : ওয়াজিব এ’তেকাফের জন্য রোযা শর্ত, অর্থাৎ এ’তেকাফের, রোযাও রাখতে হবে। যদি এরূপ নিয়্যত করে যে, রোযা রাখবো না, তবুও রোযা রাখতে হবে। এজন্য কেউ কেউ রাতে এ’তেকাফের নিয়্যত করলে তা অনর্থক মনে করতে হবে। কারণ, রাতে রোযা। হয় না। কিন্তু যদি রাত দিন উভয়ের নিয়্যত করে অথবা কয়েক দিনের নিয়্যত করে, তবে তার সাথে রাত শামিল হবে। এবং রাতেও এতেকাফ করা আবশ্যক হবে। আর কেবল এক দিনের এ’তেকাফের মান্নত করলে তার সাথে রাত যুক্ত হবে না। এক্ষেত্রে এ’তেকাফের জন্য রোযা রাখার প্রয়োজন নেই। যে উদ্দেশেই রোযা রাখুক, এ’তেকাফের জন্য যথেষ্ট। যেমন কেউ রমযান মাসে এ’তেকাফের মান্নত করল। রমযানের রোযা এ’তেকাফের জন্য যথেষ্ট। অবশ্য এ রোযা ওয়াজিব রোযা হওয়া জরুরী। নফল রোযা এ’তেকাফের জন্য যথেষ্ট নয়। যেমন নফল রোযা রাখার পর এ’তেকাফের মান্নত করলে ছহীহ্ হবে না। কেউ পুরা রমযান মাস এ’তেকাফের মান্নত করল এবং ঘটনাক্রমে রমযানের এতেকাফ করতে পারল না, এক্ষেত্রে অন্য যে কোন মাসে এতেকাফ করলে মান্নত পূর্ণ হবে। কিন্তু একাধারে রোযাসহ এতেকাফ করা জরুরী হবে।

৫। মাসয়ালা : সুন্নাত এ’তেকাফে তো রোযায়ই হয়ে থাকে। কাজেই তার জন্য রোযা শর্ত করার প্রয়োজন নেই।

৬। মাসয়ালাঃ কারও মতে মুস্তাহাব এ’তেকাফেও রোযা শর্ত। নির্ভরযোগ্য মতে শর্ত নয়।

৭। মাসয়ালা : ওয়াজিব এতেকাফ অন্ততঃপক্ষে একদিন হতে হবে। আর বেশি যতদিনের নিয়্যত করবে। আর সুন্নাত এ’তেকাফ দশদিন। কেননা, সুন্নত এ’তেকাফ রমযানের শেষ দশ দিন। মুস্তাহাব এ’তেকাফের জন্য কোন সময়সীমা নির্ধারিত নেই। এক মিনিট বা তদপেক্ষাও কম হতে পারে।

৮। মাসয়ালা : এ’তেকাফে দু ধরনের কাজ হারাম। অর্থাৎ যে কাজ করলে ওয়াজিব ও সুন্নাত এতেকাফ বাতিল হবে এবং ক্বাযা করতে হবে। মুস্তাহাব এ’তেকাফ হলে তা শেষ হয়ে যায়। এর জন্য কোন সময় নির্ধারিত নেই। কাজেই তার ক্বাযাও নেই।

প্রথম প্রকার হারাম কাজ : এ’তেকাফের স্থান থেকে স্বাভাবিক বা শরয়ী জরুরত ব্যতীত বাইরে বের হওয়া। স্বাভাবিক প্রয়োজন যথা–মলমূত্র, জানাবাতের গোসল, খানা আনার লোক না থাকলে খেতে যাওয়া। শরয়ী প্রয়োজন যথা–জুমু’আর নামাযে যাওয়া।

দ্বিতীয় প্রকার হারাম কাজঃ ওই সব কাজ, যা এ’তেকাফে দুরস্ত নেই। যেমন : সহবাস ইত্যাদি করা। ইচ্ছা করে হোক বা ভুলে হোক। এ’তেকাফের কথা ভুলে মসজিদে করুক বা বাইরে, সর্বাবস্থায় এতেকাফ বাতিল হবে। সহবাসের আনুসঙ্গিক কাজ, যেমনঃ চুম্বন করা, আলিঙ্গন করা, এতেকাফ অবস্থায় দুরস্ত নেই। তবে এতে যদি বীর্যপাত না হয় তবে এতেকাফ বাতিল হবে না। বীর্যপাত হলে এতেকাফ বাতিল হবে। কিন্তু কেবল কল্পনা বা চিন্তার কারণে বীর্যপাত হলে এ’তেকাফ বাতিল হবে না।

৯। মাসয়ালা : যে প্রয়োজনের জন্য এ’তেকাফের মসজিদ থেকে বের হওয়া যাবে সে প্রয়োজন পূর্ণ হওয়ার পর আর সেখানে দেরী করবে না। এমন স্থানে প্রয়োজন পূরণ করবে যা যথা সম্ভব মসজিদ সংলগ্ন হয়। যেমন মল ত্যাগের জন্য গেলে যদি নিজ বাড়ি দূরে হয়, তাহলে নিকটবর্তী কোন বন্ধুর বাড়িতে যাবে। কিন্তু যদি নিজ বাড়িতে না গেলে প্রয়োজন পূরণ না হয়, তাহলে দূরে হলেও নিজ বাড়িতে যাওয়া দুরস্ত আছে। যদি জুমু’আর নামাযের জন্য অন্য কোন মসজিদে যায় এবং নামাযের পর সেখানে থেকে যায় এবং সেখানেই এতেকাফ পুরা করে, তাও দুরস্ত আছে। অবশ্য মাকরূহ্ তানযিহী।

১০। মাসয়ালা : নিজ এ’তেকাফের মসজিদ থেকে ভুলেও এক মিনিট বা তদপেক্ষা কম সময়ের জন্য বাইরে অবস্থান করতে পারবে না।

১১। মাসয়ালা : সাধারণতঃ যে সকল কারণের সম্মুখীন হতে হয় না, তার জন্য এ’তেকাফের স্থান ত্যাগ করা এ’তেকাফের পরিপন্থী। যেমন, কোন রোগী দেখা, কোন ডুবন্ত ব্যক্তিকে বাঁচাতে যাওয়া কিংবা আগুন নেভাতে যাওয়া, মসজিদ ভেঙ্গে পড়ার ভয়ে মসজিদ থেকে বের হয়ে যাওয়া। যদিও এ সকল জরুরতের জন্য এ’তেকাফের স্থান থেকে বের হলে গুনাহ হবে না বরং জান বাঁচানোর জন্য জরুরী। কিন্তু এতেকাফ থাকবে না। যদি কোন শরয়ী বা স্বাভাবিক প্রয়োজনে বের হয় এবং ওই সময় প্রয়োজন পূরণ হওয়ার আগে বা পরে কোন রোগী দেখে, অথবা জানাযার নামাযে শরীক হয়, তবে কোন দোষ নেই।

১২। মাসয়ালা : জুমু’আর নামাযের জন্য জামে মসজিদে যেতে হলে এমন সময় যাবে, যেন মসজিদে গিয়ে তাহিয়্যাতুল মসজিদ ও সুন্নাত পড়তে পারে। সময়ের অনুমান নিজেই করে নিতে হবে এবং ফরযের পর সুন্নাতের জন্য দেরী করা দুরস্ত আছে। অনুমানের ভুলে সামান্য আগে গেলে দোষ নেই।

১৩। মাসয়ালা : মু’তাকেফকে জোরপূর্বক কেউ বের করে নিয়ে গেলে এ’তেকাফ থাকবে না। যেমনঃ কোন অপরাধে কারো নামে ওয়ারেন্ট হলো এবং সিপাহী তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেল বা কোন মহাজন পাওনা টাকার জন্য তাকে বের করে নিয়ে গেল।

১৪। মাসয়ালা : এভাবে কোন শরয়ী বা স্বাভাবিক প্রয়োজনে বাইরে গেলে এবং পথে কোন মহাজন আটকালে বা রোগাক্রান্ত হয়ে পড়লে এ’তেকাফের স্থানে পৌঁছতে যদি বিলম্ব হয়, তবুও এতেকাফ থাকবে না।

১৫। মাসয়ালা : এতেকাফ অবস্থায় বিনা প্রয়োজনে পার্থিব কাজে জড়িত হওয়া মাকরূহ্ তাহরিমী। যেমনঃ প্রয়োজন ব্যতীত কেনাবেচা করা, ব্যবসা সংক্রান্ত কোন কাজ করা। অবশ্য যে কাজ খুবই প্রয়োজন, যেমনঃ ঘরে খাদ্য নেই, সে ছাড়া বিশ্বাসী কোন লোকও নেই, এমতাবস্থায় ক্রয়-বিক্রয় দুরস্ত আছে, কিন্তু মালপত্র মসজিদে আনা কোনভাবেই দুরস্ত নেই। যদি তা মসজিদে আনলে মসজিদ অপরিস্কার হওয়ার কিংবা জায়গা আবদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা হয়, অন্যথায় কেউ কেউ দুরস্ত বলেছেন।

১৬। মাসয়ালা : এ’তেকাফ অবস্থায় চুপচাপ বসে থাকা মাকরূহ্ তাহমিমী। অবশ্য খারাপ কথা, মিথ্যা কথা বলবে না বা গীবত করবে না বরং কোরআন তেলাওয়াত এবং দ্বীনী এম শিখা বা শিক্ষা দেয়া অথবা অন্য কোন এবাদতে কাটাবে। মোট কথা, চুপচাপ বসে থাকা কোন এবাদত নয়।

.

এ’তেকাফের বিবরণ

রমযান মাসের শেষ দশদিনে এ’তেকাফে বসা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ্। এ’তেকাফ তিন প্রকার, যথা : (১) ওয়াজিব এতেকাফ, (২) সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ্ এ’তেকাফ, এবং (৩) মুস্তাহাব এতেকাফ।

ওয়াজিব এ’তেকাফ হল, কোন ব্যক্তি এ’তেকাফে বসার জন্য মান্নত করলে, তা আদায় করা মান্নতকারীর উপর ওয়াজিব হয়ে যায়।

সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ্ এ’তেকাফ হল, ইবাদতের নিয়তে নির্জন স্থানে মসজিদের মধ্যে রমযানের শেষ দশ দিনে এ’তেকাফে বসা।

আর এ দু’ প্রকার এতেকাফ ব্যতীত (রমযান মাসের শেষ দশ দিন বাদে) বৎসরের অন্য যে কোন সময় এ’তেকাফে বসাকে মুস্তাহাব (নফল) এতেকাফ বলা হয়। এ’তেকাফের জন্য তিনটি বিষয়ের দরকার হয়, প্রথম মসজিদ হতে হবে, দ্বিতীয়–এ’তেকাফের নিয়ত করতে হবে, তৃতীয় জানাবাত ও হায়েজ নেফাস হতে পাক হতে হবে।

মহিলারা এ’তেকাফে বসতে ইচ্ছা করলে, তাদের মসজিদে যেতে হবে না, তারা নিজ নিজ গৃহের নির্জন স্থানে এ’তেকাফে বসবে। মহিলারা এতেকাফ করতে হলে স্বামীর এজাযত নিতে হবে। এ’তেকাফের কিছু মাসয়ালা নিম্নে উল্লেখ করা হল।

মাসয়ালা : এ’তেকাফে বসার জন্য ইফতারীর পূর্বে মসজিদে প্রবেশ করতে হবে এবং এ’তেকাফের দিন-ক্ষণ শেষে ইফতারীর পরে মসজিদ হতে বের হতে হবে।

মাসয়ালা : এ’তেকাফে বসার সময় হচ্ছে রমযানের শেষ দশ দিনে কমের পক্ষে একদিন এক রাত এবং বেশির পক্ষে দশ দিন দশ রাত। তবে ৩ দিন, ৫ দিন বা ৭ দিনও এ’তেকাফে বসা জায়েয আছে। কমের পক্ষে তিন দিন তিন রাত এ’তেকাফে বসা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ্।

মাসয়ালা : এ’তেকাফের সময় দুনিয়াবী কোন কথা-বার্তা বলতে পারবে না। একমাত্র আল্লাহ তা’আলার বিভিন্ন ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকতে হবে। এ’তেকাফের সময় চুপ করে বসে থাকা ঠিক নয়।

মাসয়ালা : এ’তেকাফের সময় নফল নামায আদায় করা, কোরআন শরীফ তেলাওয়াত করা, মাসলা মাসায়িল সম্পর্কে আলোচনা করা বা কিতাব পড়া, যিকির-আযকার করা, তসবীহ-তাহলীল পাঠ করা এবং দোয়া ও দুরূদ পাঠ করা ইত্যাদি এবাদতে সর্বদা রত থাকতে হবে।

মাসয়ালা : এতেকাফ হতে দুনিয়াবী কোন কাজের জন্য মসজিদ হতে বের হতে পারবে না, তবে প্রস্রাব-পায়খানা ও ওযূ গোসলের জন্য বের হওয়া দুরুস্ত আছে। দরকারী সময়টুকুর চাইতে অযথা বেশি সময় বাইরে থাকলে এতেকাফ নষ্ট হয়ে যাবে।

.

এ’তেকাফের ফজিলত

১। হাদীস : যে ব্যক্তি রমযান মাসে শেষ দশ দিন এতেকাফ করবে, তার জন্য দুই হজ্জ ও দুই ওমরার সমান ছাওয়াব তাকে দেয়া হবে।–(বায়হাকী)।

২। হাদীসঃ যে লোক খালেছ নিয়্যতে এবং খাঁটি ঈমানের সাথে নেকীর লক্ষ্যে এ’তেকাফ করবে, তার পূর্ববর্তী সকল (সগীরা) গুনাহ্ মার্জনা করে দেয়া হবে।-(দায়লামী)।

৩। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানা হেফাজত করার পূর্ণ ফজিলত নিয়মিতভাবে চল্লিশ দিন যাবৎ সীমানা হেফাজত করলে লাভ হয়। সুতরাং যে ব্যক্তি চল্লিশ দিন পর্যন্ত ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানা পূর্ণরূপে এমনভাবে রক্ষা করবে যে, ঐ সময়ের মধ্যে ক্রয়-বিক্রয় এবং শরীয়ত বিরোধী যাবতীয় কাজ ত্যাগ করবে, সে তার পাপ থেকে এমন পবিত্র হয়ে যাবে, যেমন ছিল তার জন্ম গ্রহণের দিন। অর্থাৎ সমস্ত গুনাহ থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র হয়ে যাবে। চল্লিশ দিন পর্যন্ত এ’তেকাফে থেকে যিকির, মুরাক্বাবা, নামায, রোযা ইত্যাদি যাহেরী ও বাতেনী ইবাদতের মধ্যে মশগুল থাকাকে এবং সম্পূর্ণ আল্লাহর হয়ে যাওয়াকে ইসলামী রাজত্বের সীমা বলা হয়েছে। কেননা, এ ধরনের কঠোর মুজাহাদা যে করবে, সে নিশ্চয়ই ইসলামের যাবতীয় হুকুম আহকাম, কষ্ট স্বীকার করেও পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পালন করবে এবং ইসলামের রাষ্ট্রের সীমানা রক্ষাকারী যেমনঃ খলিফাতুল মুসলিমীন, আমীরুল মুমীনিনের আদেশে নিজের জীবনকে বিপন্ন করে, হারাম ও ভোগবিলাস ত্যাগ করে কাফেরদের আক্রমণ থেকে মুসলমানের জীবন, দ্বীন ও ঈমান রক্ষা করার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে দেয়, তদ্রুপ এ ব্যক্তিও ন ও শয়তানের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার নিমিত্ত প্রতি মুহূর্তে সজাগ ও সতর্ক থাকে। এ জন্য এই এ’তেকাফ করাকে ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানা রক্ষাকারীর সাথে তুলনা করা হয়েছে। আর যে গুনাহ্ মাফের কথা বলা হয়েছে, তার অর্থ ছগীরা গুনাহ্। কেননা, কবীরা গুনাহ্ তওবা ছাড়া এবংহকুল এবাদ হকদারের নিকট ক্ষমা চেয়ে নেয়া বা পরিশোধ করা ছাড়া মাফ হয় না।–(তাবরানী)।

হাদীস অনুকরণে সুফিয়ায়ে কেরাম চিল্লাহর নিয়ম পালন করে থাকেন। তাছাড়া অন্য হাদীসেও আছে, যে ব্যক্তি চল্লিশদিন যাবৎ খালেছ নিয়্যতে দুনিয়া তরক করে খাঁটিভাবে আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থাকবে আল্লাহ্ পাক তার কলবে হেকমতের ফোয়ারা জারী করে দেবেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *