০৯. রেখে ঢেকে আর নয়

রেখে ঢেকে আর নয়, জাত যাক, সে তো দুবেলাই যায়
তবু এই সত্য মানি, আমি ছাড়া কেউ নেই আমাকে বাঁচায়

ভার্জিনিয়া উলফ লিখেছিলেন খুব জরুরি একটি বই, ‘অ্যা রুম অফ ওয়ানসয়োন।’ উনিশ’শ উনত্রিশ সালে। বাপের বাড়ি স্বামীর বাড়ি ভাইয়ের বাড়ি মামার বাড়ি ছেলের বাড়ি ইত্যাদি নানা রকম বাড়িতে মেয়েদের বাস। মেয়েদের নিজের বাড়ি নেই, অন্যের বাড়িতে তাদের বাস করতে হয়। মেয়েদের টাকা পয়সা নেই, নিজের রুচি মতো জীবনযাপন নেই, প্রাইভেসি নেই। একেবারে নিজের, একার, অন্য কারও বিরক্ত করা নেই, নাক গলানো নেই, এমন ঘরের প্রয়োজন মেয়েদের প্রচণ্ড, এ কথা ভার্জিনিয়া উলফ সেই কত আগে বলেছেন। আজ না হয় পশ্চিমে মেয়েরা একা বাস করার সুযোগ এবং পরিবেশ পাচ্ছে। মেয়েরা স্বনির্ভর এখন আগের চেয়েও অনেক, সংস্কারের ভূত অনেকটাই সমাজ থেকে সরেছে। কিন্তু পুবের হাল বড় করুণ। পুবের মেয়েদের এখনও পিতৃতন্ত্র, ধর্ম আর সাতশ’ রকম সংস্কারের যাঁতাকলে পিষে মারা হচ্ছে। সমাজ-সংস্কারকরা মেয়েদের শিক্ষার এমনকী স্বনির্ভরতারও ব্যবস্থা করেছেন, তাই বলে কি অবস্থা কিছু পাল্টেছে! ক’জন মেয়ে আজ নিজের ঘরে বা নিজের বাড়িতে সম্পূর্ণ নিজের মতো করে, একা এবং সম্পূর্ণই একা জীবন যাপন করছে! নিজের উপার্জনে নিজের বাড়ি, নিজের সংসার, নিজের উড়ে বেড়ানো ঘুরে বেড়ানো, নিজের যা ইচ্ছে তাই, নিজের স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচার ক’জন মেয়ের আছে! কেউ কেউ যারা যাপন করতে যায় এমন জীবন, তাদের কিন্তু ঝাঁক ঝাঁক পুরুষ অহর্নিশি পরামর্শ এবং উপদেশ বর্ষণ করে চলে। সুতরাং একা থাকার আনন্দ শেষ পর্যন্ত মেয়েরা সত্যিকার উপভোগ করতে পারে না।

এক যুগেরও বেশি সময় আমি একা থাকছি। আমার একা থাকাটা কিন্তু ঘটনাক্তমে একা থাকা নয়। একা থাকার স্বপ্ন ছিল আমার। এই স্বপ্ন আমি সত্য করেছি। কম ঝড় যায়নি আমার ওপর। আমি একা থাকবো, আজ থেকে কোনও পুরুষের সঙ্গে আমি বাস করবো না, এই সিদ্ধান্তটি নেবার পর শহর ঘুরে বাড়ি খুঁজছি ভাড়া নেবার জন্য, বাড়ি কী আর মেলে ! সব বাড়িওয়ালাই আমাকে দূর দূর করে তাড়িয়েছিল। তারা প্রথমে আঁতকে ওঠে আমাকে দেখে, ‘একা মেয়েমানুষ’ এসেছে বাড়ি ভাড়া নিতে! আমি ডাক্তার। শহরের বড় হাসপাতালে চাকরি করছি। ভাড়া মেটানোর ক্ষমতা আমার আছে জানার পরও কোনও লোকই আমাকে বাড়ি ভাড়া দিতে চায়নি। কারণ আমার সঙ্গে কোনও পুরুষ-অভিভাবক নেই। বাবা নেই, দাদা নেই, স্বামী নেই। আরও অনেক ঘুরে, আরও অনেক পরিশ্রমের পর আমি একটি বাড়ি পেয়েছিলাম। বাড়িওয়ালার হাতে পায়ে ধরতে হয়েছে পুরুষ ছাড়া আমাকে থাকতে দেবার জন্য। বাড়িওয়ালা শেষ অবধি নিমরাজি মতো হল, বললো, ঠিক আছে পুরুষ না থাকলেও চলবে, কিন্তু একা থাকা আমার চলবে না, কাউকে না কাউকে সঙ্গে থাকতেই হবে। থাকতেই হবে, কারণ আমি ‘মেয়েমানুষ’। মেয়েমানুষ হল শরীর। লোভের শরীর। শরীর ছাড়া তারা আর কিছু নয়। এই শরীরের দিকে লোভ করবে পুরুষেরা। পুরুষ-পাহারা না থাকলে মেয়েমানুষের কুমারীত্ব ঘুচে যাবে, সতীত্বের বারোটা বাজবে। ঘিনঘিনে মাছি এসে বসবে উঠোনে পড়ে থাকা আধখাওয়া আনারসের গায়ে। সংসারে কে চায় একলা মেয়েমানুষ! ভয় লজ্জা দুটোই কিলবিলিয়ে ওঠে মেয়েমানুষের নাম শুনলে। মেয়েদের একা থাকতে নেই। ‘ভদ্রমেয়েরা’ থাকে না একা। ‘অভদ্ররা’ থাকে, বেশ্যারা একা থাকে। আমি নামি হাসপাতালের ব্যস্ত ডাক্তার। কিন্তু একা থাকি বলে পাড়ার লোকেরা আমার দিকে বেশ্যার দিকে যেমন ছোট চোখে তাকিয়ে শয়তানি-হাসি হাসে, তেমন হাসে।

মাকে নিয়ে এসেছিলাম আমার বাড়িতে। একটি মেয়েমানুষ যা, দুটো মেয়েমানুষও তা। সে বাড়িতে খুব বেশিদিন থাকা সম্ভব হয়নি আমার। পাড়াপড়শির নাক সিঁটকানিতে বাড়িওয়ালা আমাকে একদিন তাড়ালো। একা মেয়েকে কেউ আশ্রয় দেয় না, প্রাণের বন্ধুও তখন দূরে সরে থাকে। মাসের পর মাস আমাকে হোটেলে বাস করতে হয়েছে, ‘একা থাকবো’ এই দৃঢ়তা ছিল বলেই পেরেছি। তখন দুর্গম কোনও অরণ্য ঘুরঘুঙ্গি কালো রাতেও পার হয়ে যেতে পারি এমন। বরফ-জলের সমুদ্র সাঁতরে পার হই এমন। সমাজের অসভ্য নিয়মগুলো আমাকে বারবার ভেঙে চৌচির করতে চেয়েছে, আমাকে মুচড়ে দুমড়ে, নিংড়ে নিঃস্ব করতে চেয়েছে। তারপরও আমি নিজেকে অনড় রেখেছি, ভয়ংকর এই নারী বিদ্বেষী সমাজে তাবৎ পুরুষকে অস্বীকার করে একটি মেয়ের একা থাকা যে কী ঝুঁকিপূর্ণ তা আমি নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছি। ওভাবে আরও ভুগে, আরও কিল চড় খেয়ে, নিজের জন্য ‘ভদ্রপাড়ায়’ একটি অ্যাপার্টমেন্ট কিনে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। আর কোনও ঝত্তাট, বিদ্রূপ, আর কোনও তামাশার শিকার আমাকে হতে হবে না ভেবেছিলাম। কিন্তু নিজের কেনা বাড়িতেও সমস্যা শুরু হল। শুরু হল যখন আমি প্রেম করতে শুরু করেছি এক যুবকের সঙ্গে। কে এই যুবক, কী সম্পর্ক? আমার উত্তর, ও আমার প্রেমিক। প্রেমিক শব্দটি যেন শব্দ নয়, বোমা। প্রেমিক নিয়ে আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি, মাঝে মাঝে প্রেমিক আমার বাড়িতে রাত কাটাচ্ছে, এটি কারও সহ্য হত না। আসলে আমি একা থাকতাম বলেই পাড়াপড়শির চোখ আমার ওপর একটু বেশি পরিমাণে ছিল। না, আমি কারও শ্লেষে, স্লোগানে, কারও আদেশে বিক্ষোভে হাঁটু ভাঙিনি। নিজের যা ভালো লাগে, তা দ্বিধাহীন করে গেছি। মেরুদণ্ড সোজা। টানটান। মাথা উঁচু। কারও আমি খাই না পড়ি না, আমি যা-ই করি, যার সঙ্গেই শুই, তাতে কার বাপের কী!

খুব বেশি পুরুষ না দেখলেও যথেষ্ট দেখেছি। একটিই কি যথেষ্ট নয়! একটি যথেষ্ট নয় বলে শখ করে দুটি দেখতে গিয়েছিলাম। দেখি জিনিস একই। হাতে গোনা ক’টা দিন প্রেম প্রেম। দুজনে দুজনার। তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না, না পেলে আত্মহত্যা ইত্যাদি। পরে যে কে সেই। বাপ ঠাকুরদা বেরিয়ে আসে মুখোশ ছিঁড়ে, ফেটে স্বরূপ বেরোয়। একসঙ্গে বাস করার আগে নারী পুরুষের সমানাধিকারে দুহাজার ভাগ বিশ্বাস, নারীর স্বাধীনতায় উনি বিশ্বের এক নম্বর সমর্থক, আর যেই না একত্রবাস শুরু, অমনি উনি শুয়ে বসে আরাম করবেন আর অর্ডার করবেন, বাঘের দুধ চাই, জিরাফের মাথা চাই। সব জোগাতে হবে, কারণ পুরুষ উনি, দুউরুর মাঝখানে তিন বা চারইঙ্গি একটি বস্তু আছে ওনার। ওনার নিজের জন্য ওনার অনেক ‘চাওয়া’, তার চেয়ে বেশি আমার জন্য ওনার ‘না চাওয়া’। উনি চাননা উনি ছাড়া অন্য কোনও পুরুষের সঙ্গে একটি বাঁধা সময়ের বেশি কথা বলি, ওনার অনুমতি ছাড়া আমি কোথাও যাই বা কিছু করি। আমাকে ওনার মুঠোর মধ্যে যে করেই হোক নিয়ে চমৎকার একটি জীবন উনি যাপন করতে চান। ওনার স্যাঁতসেঁতে মুঠোর মধ্যে পড়ে যে আমার শ্বাসকষ্ট হয়, তা উনি ঠিক ধরতে পারেন না, পারেন না ওনার ওই তিন বা চারইঙ্গি বস্তুর কারণে। ওই ক্ষুদ্র বস্তুটি মানুষের বোধবুদ্ধি ভয়ংকরভাবে ভোঁতা করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট কিনা।

যতদিন মস্তিষ্ক কাজ করে, ততদিন আমি একা থাকবো। বদ্ধ উন্মাদ না হলে পুরুষের সঙ্গে কোনও মেয়ে বাস করে! জেনে শুনে পুরুষের পুতুল সাজতে কারও কারও সাধ জাগে, জন্ম থেকে তাদের গড়েই তোলা হয়েছে অমন করে। আমাকেও গড়া হয়েছিল অমন করেই। কিন্তু এক সময় আমি ঘুরে দাঁড়িয়েছি। না আমি পুতুল হব না, পণ্য হব না। তাহলে হব কী? মানুষ হব। আমি ‘আমি’ হব। এই সংকল্পটি আমার সর্বত্র, সর্বাজ্ঞে। পুরুষকে আমার বাড়িতে বাস করতে দিই না বলে আমি যে পুরুষের সঙ্গে প্রেম করতে চাই না তা নয়। প্রেম ছাড়া আমি দুদণ্ড বাঁচি না। যেহেতু অসমকামী আমি, সুদর্শন পুরুষের প্রতি তীব্র আকর্ষণ আমি রোধ করতে পারি না। সুদর্শন যদি বিদ্যায় বুদ্ধিতে হৃদয়ে প্রতিভায় কৌতুকে কৌতূহলে অসাধারণ হয়, তবে তো প্রেমে না পড়ে আমার উপায় নেই। আমার প্রেম দিন রাতের প্রেম। এখানকার পুরুষেরা যেমন প্রেম বলতে এক দুঘণ্টার প্রেম বোঝে, সুযোগ সুবিধে বুঝে বউকে লুকিয়ে বাড়ির বাইরে কোনও মেয়ের ঠোঁট কামড়ে, বুক খামচে, ‘মেয়ের ওপর ফেলে আসা’কে প্রেম বোঝে, আমি তা বুঝি না। প্রেম বলতে প্রচণ্ড প্যাশন বুঝি। প্রেমিককে চাই সবচেয়ে বড় বন্ধু হিসেবে, যাকে জীবনের সব কষ্ট সুখ, দিন রাতের সবকিছু অবলীলায় বলা যায়। যে মিথ্যুক নয়, ঠগ নয়, প্রবঞ্চক নয়, লুম্পেন নয়। যার জন্য তৃষ্ণা কখনও মেটে না, যাকে পেলে জগত ভুলে যাই আবার যাকে নিয়েই জগত খুঁজে পাই। যে সঙ্গে থাকে, পাশে থাকে। যার সঙ্গে মুহূর্মুহূ সাত-আকাশে শীর্ষানন্দে উড়ে বেড়াই।

পাশে থাকা মানে কিন্তু এই নয় যে তার সঙ্গে পে্রতিরাতে আমার বিছানা ভাগ করতে হবে বা তার সঙ্গে এক ছাদের তলায় থাকতে হবে। হৃদয়ে যে থাকে, সে যোজন দূরে থাকলেও হৃদয়ে থাকে। তার সঙ্গে যখন আমার ইচ্ছে হবে, শরীর বিনিময় করবো। আমার বাড়িতে, অথবা তার, অথবা অন্য কোথাও। কিন্তু রাঙ্গির বারোটার মধ্যেই আমার বাড়ি থেকে তাকে বেরোতে হবে। তাকে অসম্মান করে বের করে দিচ্ছি না। ভালোবেসে চুমু খেতে খেতেই তাকে দরজা দেখিয়ে দিচ্ছি। কখনও রাতও কাটাতে পারে একসঙ্গে তবে আমার বাড়ির অতিথি হয়ে, সদস্য হয়ে নয়। এ আমার সিদ্ধান্ত, প্রেমিকের সঙ্গে ততদিন আমি একত্রবাস করবো না যতদিন না প্রেমিকের মাথা থেকে পুরুষতন্ত্রের শেষ কণাটুকুও নিশ্চিহ্ন হয়। বিয়েতে আমি বিশ্বাস করি না। লিভ টুগেদার বা একত্রবাসে বিশ্বাস অনেককাল করেছি, এখন তাও করি না। কারণ একত্রবাসে পুরুষের স্বরূপ অল্প কিছুদিনেই এমন বিকট আকারে বেরিয়ে আসে যে পুরুষটি নিজেকে স্বামী ভাবতে শুরু করে, এবং স্বামীরা যে ধরনের শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার মেয়েদের করে, ঠিক তাই তাই করতে শুরু করে দেয়। এই ঘোর পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একত্রবাসের বদলে আমি তাই গভীরভাবে পৃথকবাসে বিশ্বাসী। পশ্চিমের পুরুষের বেলায়ও আমার আদর্শ একই। পুব পশ্চিমের পুরুষের চেহারা শুরুতে একটু হেরফের থাকতে পারে, কিন্তু পুরুষ মূলত একই। ভেতরের মশলাটা এক।

একা থাকার আনন্দ আমি জানি। একা থাকলে আত্মবিশ্বাস বাড়ে, নিজের ওপর শ্রদ্ধা বাড়ে। একা থাকলে মনের জোর বাড়ে, নিজে কী এবং কে, সে সম্পর্কে ধারণা গাঢ় হয়। একা থাকলে অন্যকে তুষ্ট তৃপ্ত করে তোলার দাস-দায়িত্ব থাকে না ঘাড়ে। স্বাধীনতার সত্যিকার অর্থ অনুধাবন করা যায়। একা থাকলে জীবনকে আদ্যোপান্ত উপভোগ করা যায়। জীবন তো মানুষের একটিই এবং সব কিছুর পর, সব কোলাহলের শেষে মানুষ তো আসলে একাই।

আমি জাত গোত্র সম্প্রদায় ইত্যাদিতে বিশ্বাস করি না। যারা মানুষকে নানা সম্প্রদায়ে বিভক্ত করে, তারাই তো সাম্প্রদায়িক। লিঙ্গ-ধর্ম-গোত্র-বর্ণ-জাত-সম্প্রদায় নির্বিশেষে আমি মানুষকে মানুষ বলে বিচার করি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *