পদার্থ নির্ণয়াংশে প্রত্যভিজ্ঞাদর্শনের সহিত রসেশ্বর দর্শনের প্রায় ঐক্যমত আছে। প্রত্যাভিজ্ঞাদর্শনে পারদ পদার্থের বিষয় কোন স্থানে উল্লেখিত হয় নাই, এই দর্শনে উহা বিশেষ রূপে নির্দিষ্ট হইয়াছে এই মাত্র বিশেষ। যেমত প্রত্যাভিজ্ঞাদর্শনাবলম্বীরা মহেশ্বরকে পরমেশ্বররূপে নির্দ্দেশ এবং জীবাত্মা ও পরমাত্মার অভিন্নরূপতা স্বীকার করিয়া থাকেন, সেইরূপ রসেশ্বরদর্শনাবলম্বীরাও, মহেশ্বরই পরমেশ্বর এবং জীবাত্মাই পরমাত্মা—এইরূপ স্বীকার করতে পরাঙ্মুখ নহেন। কিন্তু ইঁহারা প্রত্যাভিজ্ঞাদর্শনাবলম্বীদিগের স্বকপোলকল্পিত এক মাত্র প্রত্যাভিজ্ঞাই পরম পদ মুক্তির সাধন—এরূপ বিশ্বাস না করিয়া পরম মুক্তির প্রাপক অন্য এক পথ অবলম্বন করিয়া থাকেন। ইঁহারা কহেন যে, মুমুক্ষু ব্যক্তিদিগের প্রথমতঃ দেহের স্থৈর্য্যসম্পাদনে যত্ন করিতে হয়, তৎপরে ক্রমশঃ যোগাভ্যাস করিতে করিতে যখন জ্ঞানোদয় হয়, তৎকালে মুক্তিরসের আবির্ভাব হয়। যদিও অন্যান্য দর্শনেও মুক্তির সাধন এক এক পথ প্রদর্শিত হইয়াছে এবং তত্তৎপথাবলম্বনেও পরমপদ মুক্তি পাইবার সম্ভাবনা আছে, তথাপি তত্তৎ পথাবলম্বনে বিশিষ্ট জনগণের প্রবৃত্তি জন্মাইতে পারে না; যেহেতু তত্তৎ পথ অবলম্বন করিলেও দেহপতনের পর মুক্তি হয়, এইরূপ তত্তৎ দর্শনেই নির্দিষ্ট হইয়াছে; সুতরাং তত্তন্মতে মুক্তি, পিশাচের ন্যায়, অদৃষ্টচর হইল। অদৃশ্য বিষয়ে কখনই কোন ব্যক্তির বিশ্বাস জন্মে না; যাহার যে বিষয়ে বিশ্বাস না জন্মে, সে কখনই তজ্জন্য যত্নবান হয় না, বরং দূর হউক, সন্দেহ বিষয়ে প্রবৃত্ত হইবার আবশ্যকতা নাই এই বলিয়া নিবৃত্ত হইয়াই থাকে। না হইবেই বা কেন? দেখ কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি ফণিফণাস্থ মণির আশয়ে অমূল্য ধন জীবনের প্রতি দৃষ্টিপাত আ করিয়া ফণিফণায় হস্তার্পণ করিয়া থাকে এবং কাহারই বা, যে পরিচ্ছদের নিমিত্ত সুখ স্বচ্ছন্দতার অদ্বিতীয় উপায় স্বরূপ পূর্ব্বসঞ্চিত পরিচ্ছদ পরিত্যাগ করিতে হয়, তৎসংগ্রহে আগ্রহ জন্মে? অতএব, যদি সর্ব্ব কল্যাণকর সহজসুহৃৎস্বরূপ দেহ ত্যাগ না করিলে মুক্তি না হয়, তবে এমত মুক্তির প্রার্থনায় চির ক্লেশকর যোগাদি করিবার প্রয়োজন কি? কিন্তু যদি পারদ রসের দ্বারা দেহের স্থৈর্য্য সম্পাদন করিয়া ক্রমশঃ যোগাভ্যাসে ব্যাসক্ত হইতে পারা যায়, তাহা হইলে পরম কারুণিক পরমেশ্বর পরিতুষ্ট হইয়া পারিতোষিক স্বরূপ সর্ব্ব প্রধান মুক্তি পদ প্রদান করেন। এজন্য মুমুক্ষু ব্যক্তিদিগকে যে প্রথমতঃ দেহস্থৈর্য্য সম্পাদন করিতে হয় তাহা আর বলিবার অপেক্ষা কি। দেহের স্থৈর্য্যসাধনোপায় পারদরস ব্যতীত আর কোন পদার্থ নাই। ওই পারদ রস দ্বারা যেরূপে দেহের স্থৈর্য্য সম্পাদন করিতে হয়, অন্যান্য দর্শনে তাহার উল্লেখ মাত্রও নাই। কিন্তু যখন এই দর্শনে উহা সবিশেষ নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে, তখন এ দর্শন যে মুমুক্ষ ব্যক্তিদিগের অবশ্যাপেক্ষণীয় এবং শ্রেয়স্কর তাহার আর সন্দেহ কি।
পারদ রসের দ্বারা দেহের স্থৈর্য্যসম্পাদন করিলে দেহ সত্ত্বেই মুক্তি হয় বলিয়া এই মুক্তি জীবন্মুক্তি শব্দে নির্দ্দিষ্ট হইয়া থাকে। “যদি পারদ রসের দ্বারা দেহস্থৈর্য্য নিষ্পন্ন হইত এবং জীবদবস্থাতেই জীবের জীবন্মুক্তি হইত, তবে অবশ্যই কোন কালে না কোন কালে অন্ততঃ এক জনও স্থিরদেহ সম্পাদন করিয়া জীবন্মুক্ত হইত; কিন্তু যখন তাহা দৃষ্টিগোচর হইতেছে না এবং কোন শাস্ত্রেও অবগত হওয়া যাইতেছে না, তখন পারদরসদ্বারা যে স্থিরদেহ হয় এবং জীবদবস্থাতেই মুক্তি হয় ইহাতেই বা কি রূপে বিশ্বাস করা যাইতে পারে”—এই রূপ আপত্তি যাঁহারা উত্থাপন করিয়া থাকেন, বোধ করি, রসেশ্বরসিদ্ধান্তপ্রভৃতি প্রাচীন গ্রন্থ তাঁহাদিগের নয়ন পথে পতিত হয় নাই, হইলে কখনই এইরূপ আপত্তি উত্থাপন করিতেন না; যে হেতু ওই সমস্ত গ্রন্থে নির্দিষ্ট আছে, মহেশ্বরপ্রভৃতি দেবগণ, কাব্যপ্রভৃতি দৈত্যগণ, বালখিল্যপ্রভৃতি ঋষিগণ, সোমেশ্বরপ্রভৃতি ভূপতিগণ ও গোবিন্দভগবৎপাদাচার্য্য, গোবিন্দনায়ক, চর্ব্বটি, কপিল, ব্যালি, কাপালি, কন্দলায়ন প্রভৃতি সিদ্ধগণ, পারদরস দ্বারা দিব্য দেহ সম্পাদন পূর্ব্বক জীবন্মুক্ত হইয়া যথেচ্ছ বিচরণ করিতেছেন। এই রূপ্র যখন দেহের স্থৈর্য্য সম্পাদন দ্বারা জীবন্মুক্তি হয় জানা যাইতেছে এবং যে রূপে ঐ দেহের স্থৈর্য্য সম্পাদন করিতে হয় তাহাই এই শাস্ত্রে নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে, তখন জীবন্মুক্তিই এই শাস্ত্রের প্রধান উদ্দেশ্য ইহা স্পষ্ট রূপে প্রতীয়মান হইতেছে। এস্থলে কেহ কেহ এইরূপ আপত্তি করিয়া থাকেন যে, সচ্চিদানন্দস্বরূপ পরমতত্ত্বের স্ফূর্তি হইলেই ত মুক্তি হইতে পারে, সুতরাং মুক্তির নিমিত্ত এই শাস্ত্রাবলম্বনের আবশ্যকতা কি। কিন্তু এরূপ আপত্তি বিচারসহ হইতে পারে না, দেখ পরমতত্ত্বের স্ফূর্ত্তি হইলেই মুক্তি হয় এ কথা সত্য বটে, কিন্তু ঐ পরম তত্ত্বের স্ফূর্ত্তি বিনা সমাধিতে সম্পন্ন হয় না; সমাধিও বহু কাল সাধ্য—এই দেহে নিষ্পন্ন হওয়া সুকঠিন; তাহার কারণ—প্রথমতঃ এই দেহ শ্বাসকাশাদি নানা রোগের আশ্রয়, বিনশ্বর এবং সমাধিকরণক্লেশসহনে অশক্ত; দ্বিতীয়তঃ বাল্যাবস্থায় ধীশক্তি জন্মে না, যৌবনাবস্থায় বিষয়রসাস্বাদে ব্যগ্র হইয়া পরকালের নিমিত্ত ক্ষণ কালও চিন্তা করিতে প্রবৃত্তি হয় না এবং বৃদ্ধাবস্থায় বিবেক শক্তি থাকে না, তৎপরেই দেহ পতন হইয়া যায়; সুতরাং এই দেহে সমাধি নিষ্পন্ন হইতে পারে না। এজন্য প্রথমতঃ পারদরস দ্বারা দিব্য দেহ সম্পাদন করিতে হয়, তাহা হইলেই ক্রমশঃ যোগাভ্যাসাদি দ্বারা পরম তত্ত্বের স্ফূর্ত্তি হইতে পারে, নতুবা এই অস্থির দেহে কখনই পরম তত্ত্বের স্ফূর্ত্তি হইবার সম্ভাবনা নাই। তন্নিমিত্তই এই দর্শনে দেহ স্থৈর্য্যসাধনপথ প্রদর্শিত হইয়াছে।
এই পারদ রসকে সামান্য ধাতুর ন্যায় জ্ঞান করা উচিত নহে; যেহেতু স্বয়ং ভগবান মহাদেব ভগবতীকে কহিয়াছেন যে, পারদ রস আমার স্বরূপ, ইহা আমার অত্যঙ্গ হইতে উৎপন্ন হইয়াছে এবং আমারই দেহের রস; এই জন্য ইহাকে রস কহে। এই পারদ সংসার রূপ সমুদ্রের যন্ত্রণা নিবৃত্তি স্বরূপ পার প্রদান করে বলিয়া ইহাকে পারদ শব্দে নির্দ্দেশ করে। ঐ পারদ আমার বীজ এবং অভ্রক তোমার বীজ, এই দুই বীজের যথাবিধানে মিলন সম্পন্ন করিতে পারিলে মৃত্যু ও দারিদ্র্যযন্ত্রণা এককালে দূরীকৃত হয়। পারদ নানা প্রকার; তন্মধ্যে এক এক পারদের এক একটী অসাধারণ গুণ আছে। মূর্চ্ছিত পারদ দ্বারা ব্যধি বিনষ্ট হয়, মৃত মারদ দ্বারা জীবিত হওয়া যায়, এবং বদ্ধ পারদ দ্বারা শূন্যমার্গে গতিশক্তি জন্মে। যে পারদের নানা বর্ণ দৃষ্ট হয় এবং ঘনতা ও তরলতাদি ধর্ম্ম না থাকে তাহাকে মূর্চ্ছিত কহে, যে পারদে আর্দ্রত্ব, ঘনত্ব, তেজস্বিতা, গুরুতা ও চপলতাদি গুণ না থাকে তাহাকে মৃত কহে, এবং যে পারদ অক্ষত, নির্ম্মল, তেজস্বী ও গুরু এবং যাহার ত্বরায় দ্রবীভাব হয় তাহাকে বদ্ধ পারদ কহে।
পারদের গুণ অধিক কি লিখিব—পারদ দ্বারা ধর্ম্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ স্বরূপ চতুর্ব্বর্গের মূলীভূত এবং সকল বিদ্যার ও সুখস্বচ্ছন্দতার আধার স্বরূপ দেহ অজরাম্মর হয়, উহা ব্যতীত দেহের নিত্যাতাসম্পাদক উপায়ান্তর নাই এবং উহার দর্শন, স্পর্শন, ভক্ষণ, স্মরণ, পূজন ও দানে সকল অভীষ্ট সিদ্ধ হয়। পৃথিবীমধ্যে কেদারাদি যে সমস্ত শিবলিঙ্গ আছেন, তত্তাবতের দর্শন করিলে যে পুণ্যসঞ্চয় হয়, তাহা এক মাত্র পারদ দর্শনে জন্মে। কাশ্যাদিতীর্থস্থানস্থ যে যে শিবিলিঙ্গ আছেন, সে সকলের পূজা অপেক্ষা এক পারদনির্ম্মিত শিবলিঙ্গ পূজন শ্রেয়স্কর; যেহেতু তদ্দ্বারা সকল বিষয়ের ভোগসাধন আরোগ্য এবং অমৃত পদ পাওয়া যায়। দৈবাধীন যদি পারদ রসের নিন্দা কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হয়, তাহা হইলেও পাপ জন্মে; এজন্য পারদশনিন্দক ব্যক্তিদিগের সহবাস পরিত্যাগ করা বিধেয়। এই সকলগুণসদ্ভাববশতঃ পারদরস অন্যান্য রস অপেক্ষা উত্তম বলিয়া উহাকে রসেন্দ্র ও রসেস্বর বলিয়া নির্দেশ করা যাইতে পারে, ঐ রসেশ্বরের গুণ এই দর্শনে নির্দিষ্ট হইয়াছে বলিয়া এই দর্শনকে রসেশ্বর দর্শন কহে।