০৯. রকিব জেগে আছে

রকিব জেগে আছে। সে উবু হয়ে খাটের উপর বসে আছে। তার পাশেই পল্টু। মেঝেতে সারা গায়ে চাদর জড়িয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে পুষ্প শুয়ে আছে। ঘর পুরোপুরি অন্ধকার। পুষ্প ঘুমিয়ে আছে কি না বুঝতে পারছে না। ডাকলে সাড়া দিচ্ছে না। কিন্তু মাঝে মাঝে নড়াচড়া করছে। যেভাবে সারা গায়ে চাদর জড়িয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে জ্বর এসেছে।

পুষ্প। এই পুষ্প।

পুষ্প একটু নড়ল, কোনো রকম শব্দ করলো না। রাতে তাদের কারোরই খাওয়া হয় নি। রকিবের প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। কিন্তু এই মুহুর্তে খাওয়ার কথা কী করে পুষ্পকে বলবে বুঝতে পারছে না। রাতে রান্না হয় নি। খাবারদাবার কিছু বাইরে থেকে আনিয়ে নেওয়া উচিত ছিল। রাত জাগলেই খিদে পায়।

পুষ্প। এই পুষ্প।

কি?

থানায় কী হল?

পুষ্প জবাব দিল না। চাদরে মুখ ঢেকে দিল। অত্যন্ত অবাক হয়ে রকিব লক্ষ করল, এই মুহূর্তে তার শুধু খিদের কথাটাই বারবার মনে হচ্ছে। অন্য কিছু মনে আসছে না। সে মশারির ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। পুষ্পের মাথার কাছে চেয়ারটায় খানিকক্ষণ বসে রইল। ভোর হতে কত দেরি কে জানে। ঘড়ি দেখতে ইচ্ছে করছে না। তবে মনে হচ্ছে খুব দেরি নেই। ভোর হলে সে কী করবে? তার কী করা উচিত? এই বাড়িতে থাকা যাবে না। তার কেন জানি মনে হচ্ছে আশপাশের সবাই ব্যাপারটা জেনে গেছে। পুলিশ যাওয়া-আসা করেছে। জানাই তো উচিত। বাড়িওয়ালার ভাগ্নে এসে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? সে শুকনো গলায় বলল, কিছু না।

পুলিশ কী জন্যে?

এই মামুলি ব্যাপার। কিছু জিনিসপত্র চুরি গেছে।

ছেলেটা এই কথা বিশ্বাস করল না। কীরকম অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে রইল। সবই হচ্ছে কপালের খেলা। এত মেয়ে থাকতে সে কি না বিয়ে করল পরীর মতো একটা মেয়েকে কালো, নাক বোঁচা, বেঁটে একটা মেয়েকে বিয়ে করলে কি আর এই সমস্যা হত? সুখে থাকত সে। মহা সুখে থাকত। কথায় আছে না, পয়লা নম্বরী সুন্দরীর সঙ্গে করতে হয় ফষ্টিনষ্টি, দু নম্বরী সুন্দরীর সঙ্গে করতে হয় প্রেম। বিয়ে করতে হয় তিন নম্বর সুন্দরীকে।

সে করেছে বিরাট আহাম্মুকি। সুন্দরী বিয়ে করেছে। সুন্দর ধুয়ে এখন কি সে পানি খাবে? দেখতে সুন্দর হলেই হল না, বুদ্ধিও থাকতে হয়। বুদ্ধি থাকলে কখনো এই কাণ্ড ঘটে? একটা চিৎকার দিলে পঞ্চাশটা মানুষ আসে। সাহায্যের জন্যে আসে না, মজা দেখার জন্যে আসে। তাতে তো অসুবিধার কিছু নেই। লোক তো জড়ো হয়।

এই কেলেঙ্কারির কথা নিশ্চয়ই পত্রিকায় উঠবে। পত্রিকাওয়ালারা এইসব জিনিসই খোঁজ। বক্স করে ছাপায়। এই খবরগুলি লোজন পড়েও আগে। কালকের খবরের কাগজ খুললেই হয়তো দেখা যাবে, গৃহবধূ পুষ্প ধৰ্ষিতা। আত্মীয়স্বজনেরা ব্যাপারটা কীভাবে নেবে কে জানে। জনে-জনে চিঠি লিখতে হবে, বাদ সমাচার এই যে খবরের কাগজে যে সংবাদ ছাপা হইয়াছে ইহার সহিত আমাদের কোনো সম্পর্ক নাই। নাম ও জায়গা এক হওয়ায় কিছুটা বিভ্ৰাট সৃষ্টি হইয়াছে। আমি পড়িয়াছি যন্ত্রণায়। জনে-জনে পত্রপাঠ উত্তর দিবেন। শ্রেণীমতে সালাম ও দোয়া দিবেন। আরজ ইতি।

কিছুতেই ব্যাপারটা জানাজানি করতে দেওয়া যাবে না। কেইসের তো প্রশ্নই আসে না। পুষ্পকে বুঝিয়ে বলতে হবে। মাথা খারাপ করলে তো চলবে না। মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে।

রকিব শেষ সিগারেটটা ধরাল। পল্টু জেগে উঠেছে। রাতে এক বার উঠে দুধ খায়। এটা কি সেই ওঠা কি না কে জানে! পল্টু কাঁদতে শুরু করেছে। পুষ্প নড়ছে না। যেন। পল্টুর কান্নার শব্দ তার কানে যাচ্ছে না। রকিব বলল, এই পুষ্প, ওকে দেখ না! একটু দুধটুধ খাবে বোধহয়। পুষ্প উঠল, কিন্তু তার বাবুর কাছে গেল না। বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যে হাউমাউ শব্দে কাঁদতে শুরু করল। শব্দ যাতে বাইরে না আসে তার জন্যে দরজা বন্ধ করে রেখেছে। কিন্তু শব্দ আসছে। রকিব স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। এই প্রথম বারের মতো মনে হল, পুষ্পকে কিছু সান্ত্বনার কথা বলার দরকার ছিল। সে বলে নি।

রকিব বাথরুমের দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলল, এই পুষ্প, কী করছ? দরজা খোল। পুষ্প দরজা খুলে বেরিয়ে এল। সহজ ভঙ্গিতে বাবুকে কোলে নিয়ে দুধ খেতে দিল। ছেলেটা এত বড় হয়েছে, এখনন মার দুধ খায়! রকিব নিচু গলায় বলল, কান্নাকাটি করে এখন আর কী হবে। মানে…… সে তার কথা শেষ করল না। কারণ, কী বলবে বুঝতে পারল না।

পুষ্প থেমে-থেমে বলল, তুমি কি এখন আমাকে ঘেন্না করছ?

ঘেন্না করব কেন?

শরীরটা নোংরা হয়ে আছে এই জন্যে।

কী যে বল!

তুমি আমাকে ঘেন্না করছ। আমি তোমার চোখ দেখেই বুঝেছি। এইসব বোঝা যায়।

বাথরুমের আলোর খানিকটা এসে পড়েছে পুষ্পের গায়ে। কী অদ্ভুত সুন্দরই না তাকে লাগছে। রকিব এগিয়ে এসে পুষ্পের পিঠে হাত রাখল। পুষ্প শান্ত স্বরে বলল, আমাদের বাসার পাশে একজন মোক্তার সাহেব থাকতেন। কতগুলি গুণ্ডা ছেলে তাঁর স্ত্রীকে ধরে নিয়ে এক রাত একটা দোকানে আটকে রেখেছিল। তাঁর স্ত্রী পরদিন ফিরে এসেছিলেন, কিন্তু মোক্তার সাহেব তাঁর স্ত্রীকে ঘরে নেন নি। পরের বছর তিনি আরেকটা বিয়ে করেছিলেন।

রকিব বলল, আজেবাজে কথা বলার কোনো দরকার নেই। এস কিছুক্ষণ শুয়ে থাকি। ভোরবেলায় আমরা এইখানে তালা দিয়ে অন্য কোথাও চলে যাব। কল্যাণপুরে তোমার ভাইয়ের বাসায় কিংবা অন্য কোথাও।

কেন? কল্যাণপুরে যাব কেন?

এইখানে জানাজানি হয়ে গেছে। নানান জনে নানান কথা বলবে।

বলুক। আর জানাজানি তো হবেই। কোর্টে কেইস উঠবে না? তুমি কী ভাবছিলে? আমি মুখ বন্ধ করে বসে থাকব?

রকিব অবাক হয়ে লক্ষ করল, এই পুস্প দিনের বেলা ভেঙে পড়া পুষ্প নয়। অন্য পুষ্প, তাকে সে ঠিক চেনে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *