যে জার্মানিকে মনে করা হয়েছিল দুর্জয় শক্তিমান, সেই জার্মানির বিরুদ্ধে ব্রিটিশ, ফরাসি, ইতালিয়ান, বেলজিয়ান ও আমেরিকান বাহিনী একতাবদ্ধ হয়ে আক্রমণ চালালে যুদ্ধের গতি পরিবর্তিত হয়ে গেল। এর মধ্যে জার্মানদের খাদ্য ও রসদে টান পড়েছে, শুরু হল পশ্চাৎ অপসরণ। কিছু দিনের মধ্যেই জার্মান সম্রাট কাইজার দেশ ছেড়ে পালিয়ে আশ্রয় নিলেন হল্যান্ডে।
রাশিয়ায় অক্টোবর বিপ্লবের পর রাজতন্ত্র মুছে গেছে, জাররা নিহত হয়েছেন সবংশে, লেনিনের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। গৃহযুদ্ধ ও বহিঃশত্রুর আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য ট্রটস্কি গড়ে তুলেছেন লাল ফৌজ। অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যও তছনছ হয়ে গেছে। গণ-অভ্যুত্থানে অষ্ট্রিয়ার সম্রাটকে বিদায় নিতে হয়, হাঙ্গেরি টুকরো টুকরো হয়ে যায়। তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যেরও আর অস্তিত্ব রইল না, মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক গড়ে তুললেন প্রজাতন্ত্র। নিরপেক্ষ দেশ সুইজারল্যান্ডের জেনিভায় প্রতিষ্ঠিত হল রাষ্ট্রসঙ্ঘ।
প্রথম মহাযুদ্ধের অবসানের পর সারা পৃথিবী জুড়ে এরকম অভূতপূর্ব অদল বদল ঘটছে, কিন্তু পরাধীন ভারতের রাজশক্তির কোনও লয়-ক্ষয় নেই।
যুদ্ধ চলাকালীন ভারতের সম্পদ ও সৈন্যবাহিনীর সাহায্য নেবার বিশেষ প্রয়োজন ছিল ইংরেজদের, তাই বারবার দেশীয় নেতাদের মিথ্যে আশ্বাসবাক্য ও টোপ ছুড়ে দিয়েছে তারা। যুদ্ধের পর সেই শাসকবর্গের নখ ও দাত আরও ধারালো হয়ে দেখা দিল।
যুদ্ধের সময় এক লক্ষ একট্টি হাজারের কিছু বেশি ভারতীয়কে নিযুক্ত করা হয়েছিল সেনাবাহিনীতে, তাদের মধ্যে এক লক্ষ সাড়ে একুশ হাজার সৈন্যকে পাঠানো হয় বিদেশের রণাঙ্গনে এবং এক লক্ষেরও বেশি ভারতীয় সৈন্য আর ফিরে আসেনি। আর ভারতের কত সম্পদ ব্যয়িত হয়েছে তার কোনও হিসেব নেই।
এই রক্তদান ও সম্পদের বিনিময়ে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেওয়া তো দূরের কথা, বরং দমন নিপীড়ন আরও কঠোর হল, নাগরিক অধিকার খর্ব করে পাশ হয়ে গেল রাওলাট আইন। ভারতের সর্বমান্য নেতা সশস্ত্র বিপ্লবপন্থী লেনিনের মতন কেউ নন, অহিংসপন্থী মোহনদাস গান্ধী।
যুদ্ধের সময় ইংরেজদের বিব্রত করতে না চেয়ে তাদের সঙ্গে সহযোগিতার নীতি নিয়েছিলেন গান্ধীজি, এবার বাধ্য হলেন সত্যাগ্রহ আন্দোলন ঘোষণা করতে। ধর্মঘটের ডাক দিয়ে গান্ধীজি দেশবাসীর কাছে আবেদন জানালেন যে এই আন্দোলন যেন অহিংস ও শান্তিপূর্ণ হয়।
কিন্তু তা হল না। বিভিন্ন জায়গায় খণ্ড যুদ্ধ হল জনসাধারণ ও পুলিশের মধ্যে। শুধু গুজরাটেই জনতার আক্রমণে দুজন পুলিশ নিহত হলে পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় আঠাশ জনের। জনতা ট্রেন অবরোধ, সরকারি সম্পত্তি আক্রমণ কিংবা টেলিগ্রাফের তার কেটে দিলে সরকারের পক্ষ থেকে গ্রামে গ্রামে মেশিনগানের গুলি ও বিমান থেকে বোমাবর্ষণও হতে লাগল।
এইসব হিংসাত্মক ঘটনায় খুবই ব্যথিত হলেন গান্ধীজি। দেশের মানুষ তাঁর নির্দেশ মানেনি বলে অনশনে বসলেন তিনদিনের জন্য।
জনসাধারণ সত্যাগ্রহের প্রকৃত মর্ম বোঝেনি। তাদের সঠিক শিক্ষাও দেওয়া হয়নি। তার আগেই আন্দোলন শুরু করা ভুল হয়েছে। বিভিন্ন জনসভায় তিনি বলতে লাগলেন, আপাতত আন্দোলন বন্ধ, কিন্তু দেশের মানুষ যদি নিষ্ঠার সঙ্গে, দৃঢ় চিত্তে, অহিংসার পথে সত্যাগ্রহের জন্য প্রস্তুত হয়, তবে তিনি আবার শুরু করবেন তিন মাস পরে।
এই সময় বম্বের গভর্নর ডেকে পাঠালেন গান্ধীজিকে। স্বয়ং বড়লাট লর্ড চেমসফোর্ডের নির্দেশ তিনি জানিয়ে দিলেন চাঁচাছোলা ভাষায়। মিঃ গান্ধী যদি আবার আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করেন, তা হলে এবারে দমন করা হবে আরও কঠোরভাবে। সামরিক আইন জারি করা হবে, দেশে রক্ত গঙ্গা বয়ে যাবে।
এর পরেও ঝুঁকি নিতে গান্ধীজির বিবেক সায় দিল না। কিছু সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়ে সারা দেশ থেকে সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করে নিলেন সত্যাগ্রহ।
এর মধ্যে একটি সাঙ্ঘাতিক অকল্পনীয়, নিষ্ঠুর কাণ্ড ঘটে গেছে।
সংবাদপত্রের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, অনেক খবরই প্রকাশিত হয় না। দেশের কোথায় কী ঘটছে, তা জানার উপায় নেই। পঞ্জাবে সামরিক শাসন জারি আছে। সেখানকার একটি বীভৎস ঘটনার একটু একটু উড়ো খবর কানে আসছে। অ্যান্ড্রুজ সাহেব চরকি বাজির মতন সারা ভারত ঘুরে বেড়ান, তিনিও কিছু জেনে এসেছেন। বানোয়ারিলাল চৌধুরী নামে একজন শান্তিনিকেতনে এসে কবিকে শোনালেন জালিয়ানওয়ালাবাগের মর্মান্তিক সংবাদ।
পঞ্জাবিরা যোচূজাতি। মহাযুদ্ধের সময় পঞ্জাবের গভর্নর মাইকেল ও ডায়ার এই রাজ্য থেকেই জোর জবরদস্তি করে বেশির ভাগ সৈন্য সংগ্রহ করেছে। তার মধ্যে অনেকেই প্রাণ দিয়েছে। সেই প্রাণদান কীসের জন্য? যুদ্ধ থেকে যারা ফিরে এসেছে, তারাও অবরুদ্ধ ক্রোধে ফুঁসছে, অসহযোগ আন্দোলন শুরু হতেই পঞ্জাবে নানা জায়গায় সরকারের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। যত প্রতিবাদ, তত অত্যাচার। সরকার মিলিটারি ডেকে অমৃতসর শহরের ভার দিয়েছে জেনারাল ডায়ার-এর হাতে। ডায়ার নিষিদ্ধ করেছে সবরকম সভা-সমিতি।
প্রতি বছরই তিরিশে চৈত্র অমৃতসর শহরে খুব বড় আকারের বৈশাখী উৎসব হয়। কাছাকাছি গ্রাম থেকে হাজার হাজার মানুষ আসে। এ বছরেও সে রকম গ্রামবাসীরা এসেছে উৎসবে যোগ দিতে, তারা নিষেধাজ্ঞার কথা জানেই না। প্রায় হাজার দশেক মানুষ সমবেত হয়েছে জালিয়ানওয়ালাবাগ নামে একটি পার্কে, সেটি চতুর্দিকে দেয়াল দিয়ে ঘেরা, একটি মাত্র প্রবেশের রাস্তা। জেনারাল ডায়ার তার সেনাবাহিনী নিয়ে এসে সেই প্রবেশপথ আটকে দিল। সাধারণ মানুষকে ছত্রভঙ্গ হতে বলা হল না, কোনও সাবধানবাণী উচ্চারণ করা হল না, জেনারাল ডায়ার বীরদর্পে হুকুম দিল গুলি চালাতে। অস্ত্রহীন, শান্ত, নিরীহ মানুষের দল, তাদের মধ্যে নারী-শিশু বৃদ্ধও আছে, গুলি খেয়ে মরতে লাগল পোকা-মাকড়ের মতন। শত শত নিহত ও আহতের আর্তনাদও ছাপিয়ে গেল গুলির শব্দ। রাস্তাটা সরু বলে মেশিনগান আনা যায়নি, বন্দুকের টোটা একসময় ফুরিয়ে গেল বলেই সকলকেই শেষ করা গেল না।
রবীন্দ্রনাথ হিংসাত্মক প্রতিরোধ পন্থা সমর্থন করেন না। গান্ধীজি যখন আইন অমান্য ও সত্যাগ্রহের সমর্থনে রবীন্দ্রনাথকে একটি বিবৃতি দেবার অনুরোধ জানিয়েছিলেন তখন রবীন্দ্রনাথ তাঁকে সাবধান করে লিখেছিলেন, এই ধরনের আন্দোলন হঠাৎ লাগামছাড়া হয়ে আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে পারে, তাতে ক্ষতিই হবে বেশি।
তা বলে এত বড় অত্যাচার, এরকম একটা কুৎসিত ঘটনার প্রতিবাদ হবেনা? ইংরেজের এই বর্বরতার খবর বিশ্ববাসী জানবে না? গান্ধীজি নীরব কেন? কংগ্রেসের কোনও নেতাই বলছেন না কিছু।
রবীন্দ্রনাথ ক্ষুব্ধ, উত্তেজিত। কিছু একটা অবশ্যই করা দরকার। অ্যান্ড্রুজকে তিনি দিল্লিতে গান্ধীজির কাছে পাঠালেন একটা প্রস্তাব দিয়ে। গান্ধীজি রাজি থাকলে তিনিও দিল্লি চলে যাবেন। তারপর ওঁরা দুজনে একসঙ্গে পঞ্জাবে প্রবেশ করার চেষ্টা করবেন। পঞ্জাবে বাইরের লোকের প্রবেশ এখন নিষিদ্ধ। রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীজিকে নিশ্চিত গ্রেফতার করা হবে, সে সংবাদ গোপন রাখা যাবে না, প্রচারিত হবে বিশ্বের সর্বত্র। এটাই হবে প্রতিবাদ।
অ্যান্ড্রুজ দিল্লি গিয়ে তখনই ফিরলেন না। খবরও পাঠাচ্ছেন না কিছু। কবি মনমরা হয়ে শুয়ে থাকেন, লিখতে ইচ্ছে করে না কিছু। প্রশান্ত মহলানবীশ কিংবা কালিদাস নাগ এলেই জিজ্ঞেস করেন, অ্যান্ড্রুজ বা গান্ধীজির কোনও খবর পেলে?
অ্যান্ড্রুজ ফিরলেন বেশ কয়েকদিন পর, ভগ্নদূতের মতন। তাঁর তখন এ কুল রাখি না ও কুল রাখি অবস্থা। রবীন্দ্রনাথকে তিনি ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতন মনে করেন, আবার তিনি গান্ধীজিরও বিশেষ অনুরাগী। আমতা আমতা করে জানালেন, গান্ধীজি কবির প্রস্তাবে রাজি হননি। সরকারের সঙ্গে এখন তিনি প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে যেতে চান না, এটা উপযুক্ত সময় নয়।
কবি অনেকক্ষণ গুম হয়ে বসে রইলেন। গান্ধীজি সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করলেন না। কবিকে শান্ত, নিঃশব্দ, সমাহিতের মতন এক এক সময় বসে থাকতে দেখেছে অনেকে, কিন্তু এ যেন নিস্তব্ধতার মধ্যেও রয়েছে চরম অস্থিরতা।
বিকেলের দিকে তিনি রথীকে বললেন, একটা ঠিকে গাড়ি ডাক তো!
কারুকে সঙ্গে নিলেন না। একাই চলে গেলেন ভবানীপুরে চিত্তরঞ্জন দাশের বাড়িতে।
চিত্তরঞ্জন আপ্যায়ন করে বসালেন বটে, কিন্তু কথাবার্তা বললেন না বেশিক্ষণ। কবি প্রথমেই সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন, পঞ্জাবের ঘটনায় বাঙালিরা কেউ প্রতিবাদ করবে না? তোমাদের মতন কংগ্রেসের নেতারাও মৌনী হয়ে থাকবে? একটা সভা ডাকো, আমি নিজে তার সভাপতি হতে রাজি আছি।
চিত্তরঞ্জন বললেন, নিশ্চয়ই ডাকব। আপনি সভাপতি হলে তো কোনও কথাই নেই। সবাই যোগ দেবে। আর কাকে বক্তা হিসেবে রাখা উচিত?
কবি বললেন, তা তোমরাই ঠিক করো।
চিত্তরঞ্জন বললেন, অবশ্য আপনি যখন বক্তৃতা দেবেন, তখন আর অন্য বক্তা রেখে কাজ কী? কাকেই বা ধরতে যাব। আপনিই আমাদের সবার হয়ে বলবেন।
কবি বললেন, বেশ তাই-ই হবে। কবে সভা ডাকবে, কোথায়, এখনি ঠিক করো। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে।
চিত্তরঞ্জন ইতস্তত করতে লাগলেন। অন্যান্য নেতাদের সঙ্গেও পরামর্শ করা দরকার। কে কী মতামত দেবে ঠিক নেই। সুরেন বাঁড়ুজ্যে নিশ্চিত বাগড়া দেবেন। বিপিন পাল, ফজলুল হক এঁরাও…। হুট করে কি মিটিং ডাকা যায়?
তিনি কবিকে বললেন, আপনিই সভাপতি ও একমাত্র বক্তা যখন, তখন মিটিংটা আপনার নামেই ডাকলে হয় না?
কবি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন, একদৃষ্টিতে চিত্তরঞ্জনের দিকে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। চিত্তরঞ্জনও দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চাইছেন। কীসের ভয়? কিংবা এরই নাম রাজনীতি! অন্য সময় চরমপন্থী, এখন রক্ষণশীল।
আর বাক্যব্যয় না করে ফিরে এলেন জোড়াসাঁকোয়।
সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে বৈঠকখানা ঘরে প্রশান্তচন্দ্র আর কালিদাসদের দেখে বললেন, তোমরা এখন যাও। আজ আর আমাকে পাবে না।
কালিদাস বলল, কয়েকখানা নতুন গান লেখাবেন বলেছিলেন। কাল।
কবি নীরস গলায় বললেন, বললুম তো, আজ আর কিছু হবে না। এখন যেন কেউ আমাকে বিরক্ত না করে।
কালিদাস আর প্রশান্তচন্দ্র মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। কবি এমন ভাবে তো কথা বলেন না তাদের সঙ্গে। তারা গুটিগুটি প্রস্থান করল বাড়ির দিকে।
কিছুদিন ধরে কবির শরীর খারাপ চলছে, মাঝে মাঝেই জ্বর হয়। ডাক্তার নীলরতন সরকার এসে দেখে গেছেন। অসুস্থ হলেও কবি তো দিনের পর দিন বিষণ্ণ হয়ে থাকেন না। কিছু না কিছু লেখেন, গান শেখাতেও ক্লান্তি নেই। আজ হঠাৎ এ রকম রুক্ষ স্বরে কথা বললেন কেন? এই সব ভেবে ভেবে প্রশান্তচন্দ্রের সারা রাত ঘুমই এল না। বিছানায় ছটফট করে, ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে বেরিয়ে পড়ল বাড়ি থেকে। রাস্তায় টিমটিম করছে গ্যাসের আলো, এমনকী দুধের গোয়ালারাও এখনও বেরোয়নি।
জোড়াসাঁকোর বিশাল বাড়িটি ঊষালগ্নে অস্পষ্ট হয়ে আছে।
খাটিয়া পেতে দারোয়ানরা ঘুমোচ্ছে সামনের প্রাঙ্গণে। প্রশান্তচন্দ্র দেখল, দোতলায় একটি ঘরে শুধু আলো জ্বলছে। দারোয়ানদের জাগিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল, আলো-জ্বলা ঘরটির দরজা খোলা, সেদিকে পেছন ফিরে টেবিলে বসে লিখছেন কবি। প্রশান্তচন্দ্র দাঁড়িয়ে রইল নিঃশব্দে।
একটু পরে মুখ ফিরিয়ে প্রশান্তচন্দ্রকে দেখে কবি অন্যমনস্ক ভাবে বললেন, এসেছ? বসো।
আবার লিখতে লাগলেন। লেখার সময় অন্য কারুর উপস্থিতি তিনি পছন্দ করেন না, প্রশান্তচন্দ্রের এখন কী করা উচিত বুঝতে পারছে না, অন্য ঘরে গিয়ে অপেক্ষা করাই হয়তো উচিত, কিন্তু কবি যে বসতে বললেন!
খানিক পরেই কবি বলে উঠলেন, থাক, এই যথেষ্ট হয়েছে। নাও, প্রশান্ত পড়ে দেখো!
প্রশান্তচন্দ্র কাগজগুলি হাতে নিয়ে দেখল। সেটা একটা ইংরেজিতে লেখা চিঠি, ভারতের বড়লাটকে সম্বোধন করে লেখা।
ক্লান্ত ভাবে চেয়ারে মাথা হেলান দিলেন কবি। দু’চোখের কোণে কালি, কিন্তু ওষ্ঠে তৃপ্তির রেখা।
তিনি বললেন, সারা রাত বিছানায় যাইনি। সারা গা জ্বলছিল। পঞ্জাবের ঘটনার কেউ কোনও প্রতিবাদ করবে না, এ আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। গান্ধী আমার প্রস্তাবে রাজি হলেন না, চিত্তকে গিয়ে বললাম, কিছু একটা করো, সেও দেখি গা বাঁচিয়ে থাকতে চায়। আমাকেই যদি সব দায়িত্ব নিতে হয়, তা হলে আর সভা ডেকে লোক জড়ো করার দরকার কী, নিজের কথা লিখেই জানাব। ইংরেজ সরকার আমাকে খাতির করে নাইটহুড দিয়েছিল। যে-সরকার আমার দেশের মানুষের ওপর এমন নৃশংস অত্যাচার করে, সেই সরকারের দেওয়া খেতাবে আমার দরকার নেই। জালিয়ানওয়ালাবাগের প্রতিবাদে আমি নাইটহুড ফিরিয়ে দিচ্ছি।
এর মধ্যে ভোরের আলো পুরোপুরি ফুটেছে, নিভিয়ে দিতে হল ঘরের আলো।
স্বয়ং ব্রিটিশ সম্রাট প্রদত্ত খেতাব পরিত্যাগ করা রাজদ্রোহের প্রায় সমতুল্য। এ চিঠি প্রচারিত হলে সম্রাটকেই অপমান করা হবে। প্রশান্তচন্দ্র কম্পিত বক্ষে চিঠিখানি পড়তে লাগল। অনেক কাটাকুটি করে লেখা হয়েছে, কী জ্বলন্ত ভাষা, The time has come when badges of honour make our shame glaring in their incongruous content of humiliation, and I for my part wish to stand, shorn of all special distinctions, by the side of my country-men…
তখুনি ডেকে পাঠানো হল অ্যান্ড্রুজকে।
কবি বললেন, দেখো সাহেব, ঠিক আছে কি না।
অ্যান্ড্রুজ পড়তে পড়তে বললেন, হ্যাঁ, প্রতিবাদ হিসেবে এটা উচিত কাজই হয়েছে, কিন্তু, কিন্তু, গুরুদেব, ভাষা একটু নরম করে দিলে হয় না?
কবি এর উত্তর না দিয়ে তাকিয়ে রইলেন অ্যান্ড্রুজের দিকে।
প্রায় কেঁপে উঠলেন অ্যান্ড্রুজ। কবির এমন হিমশীতল দৃষ্টি তিনি আগে কখনও দেখেননি। তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, না, না, ঠিক আছে, এ ভাষা বদল করার দরকার নেই।
অ্যান্ড্রুজকে দায়িত্ব দেওয়া হল, চিঠিখানি বড়লাটকে তারবার্তা হিসেবে পাঠানোর। প্রশান্তচন্দ্র কয়েকখানা অনুলিপি করতে লাগল, রামানন্দবাবুকে ও অন্যান্য সংবাদপত্রে পাঠাতে হবে।
কবি উঠে গেলেন তিনতলায়। এখন বিশ্রামের প্রয়োজন। এখন বিছানায় শুলেও বিগত রাত্রির ঘুম না-হওয়া পূরণ করা যাবে না, দিনের বেলা তিনি কিছুতেই ঘুমোতে পারেন না।
প্রকৃত বিশ্রাম হতে পারে বিশ্রম্ভালাপে। এখন ওইসব গুরুতর চিন্তা মন থেকে একেবারে সরিয়ে ফেলে যদি কৌতুক হাস্য-পরিহাস করা যেত! যদি কেউ তাঁর উত্তপ্ত মস্তিষ্কে হাত বুলিয়ে দিত।
সে রকম কেউ কাছে নেই।
চোখের সামনে ভেসে উঠল লাবণ্যময়ী এক কিশোরীর মুখ। রাণুর বাবা শান্তিনিকেতনে আসেননি, সপরিবারে বেড়াতে গেছেন আলমোড়া পাহাড়ে। এই সময়ে রাণুর সঙ্গে কথা বলতে পারলে তাঁর মন পরিশুদ্ধ হতে পারত।
বেশ কয়েকদিন চিঠি লেখা হয়নি রাণুকে। চিঠি লেখাও তো এক রকম কথা বলা। রাণুর দুটো চিঠি জমে গেছে, তাঁর পাহাড়ের ভ্রমণ বিবরণে ভরা!
কবি স্নান-প্রাতরাশের কথা ভুলে চিঠি লিখতে বসলেন:
তোমার চিঠিতে যে-রকম ঠাণ্ডা এবং মেঘলা দিনের বর্ণনা করেছ, তাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, তুমি তোমার ভানুদাদার এলাকার অনেক তফাতে চলে গেছ। বেশি না হোক, অন্তত দুতিন ডিগ্রির মতোও ঠাণ্ডা যদি ডাকযোগে এখানে পাঠাতে পারে তা হলে তোমাদেরও আরাম, আমাদেরও আরাম।…এখানে গরমের ঝাঁজে আকাশ ঝাপসা হয়ে আছে—কেমন যেন ঘোলা নীল—ঠিক যেন মূৰ্ছিত মানুষের ঘোলা চোখটার মতো।…যাই হোক, আকাশের এই প্রতাপ আমি একরকম করে সইতে পারি, কিন্তু মর্তের প্রতাপ আর সহ্য হয় না। তোমরা তো পঞ্জাবে আছ, পঞ্জাবের দুঃখের খবর বোধহয় পাও। এই দুঃখের তাপ আমার বুকের পাঁজরা পুড়িয়ে দিলে। ভারতবর্ষে অনেক পাপ জমেছিল, তাই অনেক মার খেতে হচ্ছে। মানুষের অপমান ভারতবর্ষে অভ্রভেদী হয়ে উঠেছে। তাই কত শত বৎসর ধরে মানুষের কাছ থেকে ভারতবর্ষ এত অপমান সইছে, কিন্তু আজও শিক্ষা শেষ হয়নি। আমাদের অনেক ভাল হতে হবে, আমাদের প্রেম পৃথিবীর সবাইকে ছাড়িয়ে যাবে, তবে আমাদের প্রায়শ্চিত্ত হবে।
চিঠিখানা সঙ্গে সঙ্গে লেফাফায় ভরে, ঠিকানা লিখে তক্ষুনি ভৃত্যকে ডেকে ডাকবাক্সে ফেলতে পাঠিয়ে দিলেন।
কিন্তু তৃপ্তি হল না। এ চিঠি যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের, রাণুর ভানুদাদার নয়। শেষের দিকে বক্তৃতার ভাব এসে গেছে, রাণুর সঙ্গে কথা বলা তো হয়নি।
আবার একটা চিঠি লিখতে বসলেন:
মাঝে তোমার একটা চিঠির জবাব দিতে পারিনি। কলকাতায় এসেছি। কেন এসেছি হয়তো খবরের কাগজ থেকে ইতিমধ্যে কতকটা জানতে পারবে। তবু একটু খোলসা করে বলি। তোমার লেফাফায় তুমি যখন আমার ঠিকানা লেখ—তখন বরাবরই আমার সার পদবি বাদ দিয়ে লেখ! আমি ভাবলুম, ওই পদবিটা তোমার পছন্দ নয়। তাই কলকাতায় এসে বড়লাটকে চিঠি লিখেছি যে, আমার ওই ছার পদবিটা ফিরিয়ে নিতে। কিন্তু চিঠিতে আসল কারণটা লিখিনি, বানিয়ে বানিয়ে অন্য কথা লিখেছি। আমি বলেছি, বুকের মধ্যে অনেক ব্যথা জমে উঠেছিল, তারই ভার আমার পক্ষে অসহ্য হয়ে উঠেছে—সেই ভারের ওপরে আমার ওই উপাধির ভার আর বহন করতে পারছি নে, তাই ওটা মাথার ওপর থেকে নামিয়ে দেবার চেষ্টা করছি। যাক এ সব কথা আর বলতে ইচ্ছে করে না—অথচ অন্য কথাও ভাবতে পারি নে। এত লোক এত অন্যায় দুঃখ পাচ্ছে যে, দূরে বসে বসে আরামে থাকতে লজ্জা হয়–তাদের দুঃখের অংশ যদি আমি নিতে পারি তা হলেও দুঃখ অনেকটা লাঘব হয়। ওই দেখ, আবার ফের ঘুরে ফিরে সেই একই কথা!
চিঠি শেষ করে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। রেলগাড়ি চেপে এই চিঠি যাবে আলমোড়ায়, এক গাড়িতে তো হবে না, বদল করতে হবে, পোঁছোতে কদিন লাগবে কে জানে? তারপর ডাকপিওন যখন বিলি করতে ওদের দরজায় যাবে, তখন চিঠিখানা পড়ে রাণুর মুখের অবস্থা কী রকম হবে? বিশ্ব জানবে, কেন তিনি নাইটহুড পরিত্যাগ করেছেন। আর রাণু জানবে, শুধু তার জন্যই তার ভানুদাদা স্যার পদবিটা ছার করে দিয়েছেন।
সেই কিশোরীর আনন্দটুকু তাঁর নিজের গায়ে মেখে নিতে ইচ্ছে হল।
আর ক্লান্তিবোধ নেই।
রাণু বারবার অনুযোগ করে, তিনি কেন আর গল্প লিখছেন না। এবারে রাণু এলে আর তাকে বিমুখ করা যাবে না। একটা কিছু লিখতেই হবে রাণুর জন্য।
তিনি আবার লিখতে বসে গেলেন।