মেয়েদের বিয়ে ঠিক হবার পর আইবুড়ো ভাত খাওয়ান হয় আত্মীয়স্বজন, বন্ধু ও প্রতিবেশীর ঘরে ঘরে। ইংরেজিতে যাকে বলে ফেয়ারওয়েল ডিনার আর কি! ডিপ্লোম্যাটদের আগমন ও নির্গমন উপলক্ষে অনেকটা আইবুড়ো ভাত অর্থাৎ নেমন্তন্ন খাওয়াবার প্রথা আছে। সহকর্মী ছাড়াও অন্যান্য মিশনের বন্ধুদের বাড়িতে খেতে হয় ও খাওয়াতে হয়। সমস্ত দেশের ফরেন। সার্ভিসেই এই প্রথা। ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসও কোনো ব্যতিক্রম নয়। সিনিয়র, জুনিয়র-কোনো লেভেলেই নয়।
আমাদের দেশের আই-এ-এস বা আই-পি-এস অফিসারদের মধ্যে এসব সৌজন্যের বালাই নেই। ম্যাজিস্ট্রেট বা পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্টরা বদলি হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ওঁদের সহকর্মীরা। খুশি হন। সুতরাং ফেয়ারওয়েল ডিনারের প্রশ্ন নেই। কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের বিতাড়িত বা পদত্যাগী মন্ত্রীকে বা কলকাতায় বিদায়ী পুলিশ কমিশনারকে কেউ ভালোবেসে ফেয়ারওয়েল ডিনার খাইয়েছেন বলে আজও শোনা যায়নি। আর যত ত্রুটি-বিচ্যুতিই থাক, ফরেন সার্ভিসে এই সৌজন্যের দৈন্য নেই। অ্যাম্বাসেডরকে রি-কল বা তার চাকরির মেয়াদ শেষ হলেও সৌজন্যমূলক ফেয়ারওয়েল ডিনারের ব্যবস্থা হয়।
শছয়েক টাকায় যারা ফরেন সার্ভিসে নতুন জীবন শুরু করেন, প্রথমে ফরেন পোস্টিং-এর সময় তো ফেয়ারওয়েল ডিনারের ঠেলায় তাদের প্রাণান্তকর অবস্থা হয়। কৈ বাত নেই! তবুও নিদেনপক্ষে শতখানেক নেমন্তন্ন খেতে হয়, খাওয়াতে হয়, ছমাসের মাইনে অ্যাডভান্স নিয়েও তাল সামলান যায় না। হাই স্ট্যান্ডার্ড ও এইসব সৌজন্য রক্ষা করতে অনেক তরুণ আই-এফ-এসকেই দেনায় ডুবে থাকতে হয়। পরে অবশ্য ক্যামেরা, বাইনোকুলার, ট্রানজিস্টার, টেপ-রেকর্ডার বিক্রি করে অবস্থা বেশ পাল্টে যায়।
নিউইয়র্ক ত্যাগের আগে তরুণকেও ফেয়ারওয়েল ডিনার খেতে হলো, খাওয়াতে হলো। আসা-যাওয়ার নিত্য খেলাঘর হচ্ছে ডিপ্লোম্যাটিক মিশনের চাকরি। এখানে যেন কিছুই নিত্য নয়, সবই অনিত্য। তবুও মানুষ তো। তরুণের মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল। একটু কষ্ট করেই মুখে হাসি ফুটিয়ে সবার সঙ্গে হ্যাঁন্ডশেক করে প্লেনে চড়ল।
প্লেনটা আকাশে উড়তেই তরুণের মন ভাসতে ভাসতে মুহূর্তের মধ্যে চলে গেল লন্ডনে। মনে পড়ল বন্দনার কথা, বিকাশের কথা।
ইচ্ছা ছিল নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বন্দনার বিয়ে দেবে। হয়নি। ইউনাইটেড নেশনস-এ তখন ঝড় বয়ে যাচ্ছে। ছুটি নেওয়া অসম্ভব ছিল। তবুও তরুণের অমতে কিছুই হয়নি। বন্দনা চিঠি লিখেছিল, দাদা, খবরের কাগজ দেখেই বুঝতে পারছি কি নিদারুণ ব্যস্ততার মধ্যে তোমার দিন কাটছে। সারা রাত্রি কিভাবে তোমরা মিটিং কর, কনফারেন্স কর, আমি ভেবে পাই না। এত ব্যস্ততার মধ্যেও তুমি ভুলতে পার না আমার কথা। তোমার চিঠিতে দুতিন রকমের বল-পেন ও কালি দেখেই বুঝি একসঙ্গে একটা চিঠি লেখারও সময় তোমার নেই।…তোমার কথামতো। এবার নিশ্চয়ই আমি বিয়ে করব। তবে টোপর মাথায় দিয়ে বিয়ে করার জন্য কয়েক হাজার টাকা ব্যয় করে কলকাতা যাওয়া কি সম্ভব? নাকি উচিত?
পরের চিঠিতে বন্দনা লিখল, বিকাশকে তো তুমি ভালোভাবেই চেন, জান। আমাদের হাই-কমিশনেই তো কাজ করে। সুতরাং তোমাকে আর কি বলব! সারাদিন অফিস করে রিজেন্ট স্ট্রিট পলিটেকনিকে অ্যাকাউন্টেন্সি পড়ে বেশ ভালোভাবে পাস করেছে। মনে হয় এবার একটা ভালো চাকরি পাবে।
বন্দনা জানত সব কথা খুলে না লিখলে দাদার অনুমতি পাওয়া সম্ভব নয়। তাই চিঠির শেষে লিখেছিল, ভগবানের নামে শপথ করে বলতে পারি লুকিয়ে-চুরিয়ে ভালোবাসার খেলা আমরা খেলিনি। যে অধিকার পাবার নয়, সে অধিকার ও চায়নি, আমিও নিইনি। তবে মনে হয় আমার মতো দুঃখী মেয়েকে ও প্রাণ দিয়ে সুখী করতে চেষ্টা করবে।
ওসব কথা ভাবতে ভাবতে আপন মনেই হেসে উঠল তরুণ। প্লেনের জানলা দিয়ে একবার নিচের দিকে তাকাল, দেখতে পেল না সীমাহারা অ্যাটলান্টিক। কিন্তু স্পষ্ট দেখতে পেল বন্দনা আর বিকাশকে। রান্নাবান্না শেষ করে সাজা-গোজা হয়ে গেছে। সিথিতে, কপালে টকটকে লাল সিঁদুর পরাও হয়ে গেছে। বিকাশকে বকাবকি করছে, তোমার নড়তে-চড়তে বছর কাবার হবার উপক্রম। গিয়ে হয়তো দেখব দাদা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিরক্ত হয়ে…।
বিকাশ মজা করার জন্যে বলছে, তোমার দাদা হলে কি হয়! আমার তো শালা। অত খাতির করার কি আছে?
বন্দনা নিশ্চয়ই চুপ করে সহ্য করছে না।…ভুলে যেও না–দাদার জন্যই আমাকে পেয়েছ। আর যত মাতব্বরী তো আমার সামনে। দাদাকে দেখলে তো ব্যস!
মহাকাশের কোলে ভাসতে ভাসতে কত কথাই মনে পড়ে।
নিউইয়র্ক থেকে বার্লিনে যাবার পথে সরকারিভাবে তিন দিন লন্ডনে স্টপ-ওভার করা যাবে। শপিং-এর জন্য। বিচিত্র ভারত সরকারের নিয়মাবলী। ইংরেজ চলে গেছে। লাল কেল্লায় তেরঙ্গা উড়ছে, কিন্তু লন্ডন আজও স্বর্গ! দিল্লি থেকে আলজিরিয়া, তিউনিসিয়া, ঘানা যেতে হলেও ভায়া লন্ডন! শপিং-এর জন্য লন্ডনে স্টপ-ওভারের কথা ভাবলে অনেকেই হাসবেন। বন্ড স্ট্রিট-অক্সফোর্ড স্ট্রিটে কিছু রেডিমেড জামা-কাপড় ছাড়া লন্ডনে আর কিছু কেনার নেই। আই-সি-এসদের পলিটিক্যাল বাইবেলে বোধ করি লন্ডন ছাড়া আর কোনো জায়গার উল্লেখ। নেই।
লন্ডনে শপিং করার মতলব নেই তরুণের। তিন দিন ছুটি নিয়ে লন্ডনে ছদিন কাটাবে বলে ঠিক করেছে। বন্দনা-বিকাশদের সঙ্গে কদিন কাটাবার পর বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে একটু দেখা-সাক্ষাৎ করবে। বন্ধু-বান্ধবদের জানিয়েছে, লন্ডন হয়ে বার্লিন যাচ্ছে; জানায়নি করে লন্ডন পৌঁছেছে। বন্দনাকেই শুধু একটা কেবল পাঠিয়েছে। রিচিং লন্ডন, এ-আই ফ্লাইট, ফাইভ-জিরো-ওয়ান, ফ্রাইডে।
এয়ার ইন্ডিয়ার বোয়িং প্রায় বিদ্যুৎগতিতে ছুটে চলেছে লন্ডনের দিকে তবুও, যেন তরুণের আর ধৈর্য ধরে না। ধৈর্যের সঙ্গে বোয়িং-এর প্রতিযোগিতা চলতে চলতেই হঠাৎ কানে এলো, মে আই হ্যাভ ইওর অ্যাটেনশন প্লীজ! উই উইল বী ল্যান্ডিং অ্যাট লন্ডন হিথরো এয়ারপোর্ট ইন এ ফিউ মিনিটস ফ্রম নাউ। কাইন্ডলি ফ্যাসেন ইওর সীট বেল্ট অ্যান্ড…!
প্লেন থেকে বেরিয়ে টার্মিনাল বিল্ডিং-এ ঢুকতে গিয়েই উপরের দিকে ভিজিটার্স গ্যালারি না দেখে পারল না তরুণ। হ্যাঁ, ঠিক যা আশা করেছিল! বন্দনা আর বিকাশ আনন্দে উচ্ছ্বাসে হাত নাড়ছিল। পরম পরিতৃপ্তির হাসি ছড়িয়ে পড়েছিল ওদের দুজনের সারা মুখে।
বেশ লাগল তরুণের। মনটা যেন মুহূর্তের জন্য উড়ে গেল। কাছের মানুষের ভালোবাসা পাওয়া সম্ভব হলো না জীবনে। রিক্ত নিঃস্ব হয়ে কর্মজীবন শুরু করেছিল। ইন্দ্রাণী-বিহীন জীবনে কোনোদিন মুহূর্তের জন্য শান্তি পাবে, ভাবতে পারেনি। ইন্দ্রাণীর ব্যথা আজও আছে, একই রকম আছে। বুড়ীগঙ্গার পাড়ে যাকে নিয়ে প্রথম যৌবনের দিনগুলিতে জীবনসূর্যের ইঙ্গিত দেখেছিল, আজও তাকে নিয়েই ভবিষ্যৎ জীবনের স্বপ্ন দেখে। জীবনের এত বড় ট্র্যাজেডির মধ্যেও তৃপ্তি আছে, আনন্দ আছে তরুণের জীবনে! আছে বন্দনা এবং আরো কত কে!
প্রথম দুটো দিন হোবনের ওদের ফ্ল্যাটের বাইরেই বেরুতে পারল না তরুণ। কতবার বলল, চলো বেড়িয়ে আসি। মার্বেল আর্চের পাশে বসে একটু গল্প-গুজব করে পিকাডিলিতে খাওয়া-দাওয়া করি।
বন্দনা বলল, মার্বেল আর্চ আর বন্ড স্ট্রিট দেখে কি হবে বল? তাছাড়া বাইরে যাবে কেন? আমার রান্না কি তোমার ভালো লাগছে না?
এ-কথার কি জবাব দেবে তরুণ। কিছু বলে না। শুধু মুখ টিপে টিপে হাসে।
বিকাশ দুদিন অফিসে যায়নি। অফিসে এখন ভীষণ কাজের চাপ। তাই আর ছুটি পায়নি। বন্দনা তো দশ দিনের ছুটি নিয়ে বসে আছে।
সেদিন দুপুরের লাঞ্চের পর তরুণ আর বন্দনা গল্প করছিল। আমেরিকার কথা, ইউনাইটেড নেশনস-এর কথা। কখনও আবার ব্যক্তিগত, পারিবারিক। সাধারণ, মামুলি কথাবার্তা বলতে বলতে হঠাৎ বন্দনা উত্তেজিত হয়ে বলল, আচ্ছা দাদা, তুমি মনসুর আলি বলে কাউকে চেন?
তরুণ একটু চিন্তিত হয়ে জানতে চাইল, কোন মনসুর আলি?
উনি বললেন, তুমি নাকি ঢাকাতে ওদেরই বাড়ির কাছে…।
এবার তরুণ নিজেই চঞ্চল হয়ে উঠল। জানতে চাইল, চোখ দুটো কটা-কটা?
হ্যাঁ, হ্যাঁ।
খুব হাসতে পারে?
ঠিক ধরেছ।
আর শুয়ে থাকতে পারে না। এবার উঠে বসে। কোথায় দেখা হলো হতচ্ছাড়ার সঙ্গে?
বন্দনা বড় খুশি হলো, একটু যেন আশার আলো দেখল। তরুণ কোনোদিন তাকে ইন্দ্রাণীর কথা বলেনি। বলবার সম্পর্ক নয়। তাছাড়া তরুণ জানে নিজের মান, মর্যাদা সম্রম রক্ষা করে অন্যের সঙ্গে মিশতে। প্রত্যক্ষভাবে কিছু না শুনলেও বন্দনা অনুমান করতে পেরেছিল। তাছাড়া ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করে বুঝতে পেরেছিল তরুণ এই দুনিয়ায় ওই একজনকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে। মনসুর আলির সঙ্গে আলাপ করার পর আরো অনেক কিছু জানতে পারল।
তরুণের কথায় বন্দনাও তাই একটু চঞ্চল না হয়ে পারে না। বলল, এবার আমাদের নববর্ষের ফাংশানে ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হলো। কথায় কথায় তোমার কথা উঠল।
হতচ্ছাড়া হঠাৎ আমার কথা জিজ্ঞাসা করল?
আমাদের পাশেই মিঃ সরকার বলে ঢাকার এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়েছিলেন। মিঃ আলি ওকে তোমার নাম করে বলেছিলেন যে তোমরা নাকি একই পাড়ায় থাকতে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ। শুধু এক পাড়ায় নয় একই স্কুলে একই সঙ্গে পড়তাম!
তাই নাকি?
তবে কি, ওকে তো আমরা কোনোদিন মনসুর আলি বলতাম না।
তবে?
বলতাম মুসুর। ভারি মজার ছেলে। ওকে মুসুর বললেই ও বলতো, কি বলছ শ্বশুর?
হঠাৎ হাসিতে তরুণের সারা মুখটা ভরে উঠল। জানলা দিয়ে দৃষ্টিটা লন্ডনের ঘোলাটে আকাশের কোলে নিয়ে গেল কিন্তু পরিষ্কার দেখতে পেল সেই ফেলে আসা অতীতের দিনগুলো।
পেটুক মনসুরকে নিয়ে কি মজাটাই না করত ওরা! তবে হ্যাঁ, যে কাজ আর কোনো ছেলেকে দিয়ে করানো সম্ভব হতো না, মনসুর হাসতে হাসতে সে কাজ করে দিতে পারত! তরুণের মা তাই তো মনসুরকে খুব ভালোবাসতেন। রমনার বিলাস উঁকিলের মেয়ের বিয়ের সময় মনসুর না থাকলে কি কাণ্ডটাই হতো! শেষ রাত্তিরে লগ্ন। বিলাসবাবুর সঙ্গে কি তর্কাতর্কি হওয়ায় নাপিত চলে গেল। লগ্ন বয়ে যায় অথচ নাপিতের পাত্তা নেই। হঠাৎ মনসুর ওই নাপিতেরই যোল-সতের বছরের ছেলেকে হাজির করে মহা অপমানের হাত থেকে রক্ষা করল সবাইকে। সেই মনসুর লন্ডনে এসেছিল?
উনি তো এখন রেডিও পাকিস্তানে আছেন। বি-বি-সি-তে কি একটা ট্রেনিং নিতে এসেছিলেন।
ও জানল কেমন করে আমি লন্ডনে ছিলাম?
তা তো জানি না। হয়তো কোনো পাকিস্তানী ডিপ্লোম্যাটের কাছে তোমার কথা শুনেছে।
কথাবার্তা চলতে থাকে। একটু দ্বিধা, একটু সঙ্কোচ বোধ করে বন্দনা। তবুও আর চুপ করে থাকতে পারে না।
আচ্ছা দাদা, তোমাদের ওখানে চিকাটোলা বলে কোনো…?
চিকাটোলা নয়, টিকাটুলি।
মিঃ আলি ওই টিকাটুলির এক রায়বাড়ির কথাও বলছিলেন।
টিকাটুলির রায়বাড়ি শুনতেই যেন তরুণের হৃৎপিণ্ডটা স্তব্ধ হয়ে থমকে দাঁড়াল। ঘাবড়ে গিয়ে সারা মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে শুধু জানতে চাইল, রায়বাড়ির কথা কি বলল!
বিশেষ কিছু না। তবে খুব দুঃখ করলেন দাঙ্গায় ওদের সর্বনাশ হবার জন্য। আর বললেন, ও বাড়ির মেয়ে ইন্দ্রাণী নাকি…!
ভ্রূ দুটো কুঁচকে উঠল, গলার স্বরটা কেঁপে উঠল তরুণের। কি? কি হয়েছিল ইন্দ্রাণীর? মারা গিয়েছে তো?
বন্দনা তরুণের হাত দুটো চেপে ধরে বলল, না না দাদা, উনি বেঁচে আছেন।
কি বললে বন্দনা?
উনি মারা যাননি।
তরুণ আপন মনে বার বার আবৃত্তি করল, ইন্দ্রাণী বেঁচে আছে–?
মাথাটা নিচু করে কত কি ভাবতে ভাবতে কোথায় যেন তলিয়ে গেল তরুণ। হয়তো মহা দুর্যোগের রাত্রে মহাসাগরের মাঝে দিগভ্রান্ত নাবিকের মতো কোথায় যেন দূরে একটু আলোর ইঙ্গিত পেল।
কয়েকটা মিনিট কেউই কথা বলতে পারল না। শেষে বন্দনাই বলল, হ্যাঁ দাদা, উনি বেঁচে আছেন। তুমি একবার ঢাকায় বদলি হয়ে যাও না!
মুখটা তুলে মাথাটা নাড়াতে নাড়াতে তরুণ বলল, না না, বন্দনা, ঢাকায় আমি যাব না। ওখানে গিয়ে আমি টিকতে পারব না।
তুমি একটু চেষ্টা করলে ওকে খুঁজে বার করতে পারবে।
তরুণ একটা বিরাট দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ল। ওর খোঁজ করা বড় কঠিন।
তুমি মনসুর আলি সাহেবকে একটা চিঠি দাও না।
না না, তা হয় না।
কেন হয় না?
ফরেন সার্ভিসের লোক হয়ে পাকিস্তান গভর্নমেন্ট অফিসারকে চিঠিপত্র দেওয়া ঠিক নয়!
খবরটা এত অপ্রত্যাশিত যে স্থিরভাবে চিন্তা-ভাবনা করার ক্ষমতা ছিল না তরুণের। বন্দনাই কি যেন ভেবে বলল, এক কাজ কর না দাদা। করাচিতে তোমাদের হাইকমিশনে কাউকে বলল মনসুর আলি সাহেবের সঙ্গে একটু যোগাযোগ করতে।
বন্দনার প্রস্তাবে তরুণ যেন বাস্তব জ্ঞান ফিরে পায়। হ্যাঁ, ঠিক বলেছ! মনসুর কি করাচিতেই পোস্টেড?
তাই তো বলেছিলেন।
একটু চুপচাপ থাকে দুজনে। বন্দনাই আবার বলে, আচ্ছা দাদা, তুমি একবার ঢাকায় তোমাদের ডেপুটি হাই-কমিশনের কাউকে বলো না ওই টিকাটুলিতে খোঁজ-খবর নিতে। হয়তো কেউ না কেউ খবরটা জানতেও পারেন!
চাপা গলায় তরুণ বলে, হ্যাঁ, তাও নিতে পারি।
বন্দনার কিছু কেনাকাটার ছিল। তাই এবার উঠে পড়ল।
কোথায় চললে?
এই একটু দোকানে যাব।
কেন?
আজ তিনদিন তো বাড়ির বাইরে যাইনি। কিছু কেনাকাটা…!
হাসি-খুশিভরা তরুণ বলল, আর দোকানে যেতে হবে না। বিকাশ এলে আমরা তিনজনেই বেরিয়ে পড়ব, বাইরেই খাওয়া-দাওয়া করব!
অনেকদিন পর হঠাৎ একটু আশার আলো দেখতে পাবার পর তরুণের মনটা খুশিতে ঝলমল করে উঠেছিল। বন্দনা তাই আর বাধ্য দিতে পারল না। ঠিক আছে। আজ খুব মজা করা যাবে। তুমি একটু বসো, আমি এক্ষুনি আসছি।
কিছু আনতে হবে?
হ্যাঁ দাদা, একটু কফি আনতে হবে। না না, আর দোকানে যেতে হবে না। তার চাইতে আমি বিকাশকে ফোন করে দিচ্ছি যে আমরাই আসছি, ও যেন ওয়েট করে।
একটু কফি খেয়ে বেরুব না?
কি দরকার? বেরিয়ে পড়ি। তারপর তিনজনে একসঙ্গে কোথাও কফি খেয়ে নেব।
গুরুগম্ভীর ধীর-নম্ন তরুণ হঠাৎ যেন একটু চঞ্চল হয়ে উঠল। অনেক দিনের জমাট বাঁধা বরফ যেন প্রভাতী সূর্যের রাঙা আলোয় একটু একটু করে নরম হতে শুরু করল।
রাত্রে শোবার পর বন্দনা বিকাশকে বলল, খবরটা শোনার পর থেকে দাদা কেমন পাল্টে গেছেন দেখেছ?
হ্যাঁ। দুনিয়ায় তো আর কেউ নেই। সুতরাং খবরটা শোনার পর আনন্দ হওয়া তো স্বাভাবিক।
ওরা দুজনে যেদিন মিলতে পারবে, সেদিন কি হবে বলো তো?
বিকাশ মজা করে বলে, আমরা যেদিন প্রথম মিলেছিলাম, সেদিনকার আনন্দের চাইতে বেশি কিছু হবে কি?
বিকাশকে ছোট্ট একটা চড় মেরে বন্দনা বলল, তোমার মতো অসভ্য ছাড়া একথা আর কে বলবে?
আর মাত্র একটা দিন। তরুণ সারাদিন ঘোরাঘুরি করে পুরনো সহকর্মী বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করে এলো। টুকটাক কিছু কাজকর্ম ছিল, তাও সেরে ফেলল।
রাত্রে বন্দনা নিজে হাতে রান্না করে খাওয়াল। তারপর বেশ খানিকটা গল্প-গুজব করে সবাই শুয়ে পড়ল।
পরের দিন সকালে ব্রেকফাস্ট খেয়েই এয়ারপোর্ট রওনা দিল। যথারীতি বন্দনার চোখ দুটো ছলছল করছিল। তরুণ সান্ত্বনা দিয়ে বলল, এবার আর দুঃখ কি? বছরে একবার তোমরাও যেতে পারবে, আমিও আসতে পারব।
বি-ই-এ-র প্লেনে তরুণ রওনা হলো বার্লিন।
কলকাতার বৌবাজারে-বৈঠকখানার সঙ্গে রাসবিহারী-সাদার্ন অ্যাভিনিউর আশ্চর্য পার্থক্য থাকলেও তুলনা হতে পারে, কিন্তু লন্ডনের সঙ্গে বার্লিনের তুলনা? অসম্ভব, অবাস্তব, অকল্পনীয়। বরানগর-কাশীপুরের পুরনো জমিদার বাড়ির গেটে সিমেন্টের সিংহমূর্তি দেখে শিশুদের কৌতূহল জাগতে পারে, সহায়-সম্বলহীন অধস্তন কর্মচারীদের ভক্তি বা ভয় হতে পারে, কিন্তু বৃহত্তর সমাজের কাছে আজ সেটা কৌতুকের উপকরণ মাত্র। ওইসব জমিদারবাড়ির ঐতিহ্য থাকলেও ওদের দারিদ্র্য কারুর দৃষ্টি এড়াবে না। লন্ডন যেন ওই কাশীপুর-বরানগরের
জমিদারবাড়িগুলির বৃহত্তর সংস্করণ মাত্র। তাই তো লন্ডনের সঙ্গে বার্লিনের কোনো তুলনাই হয় না।
লন্ডন কেন, নিউইয়র্কের সঙ্গেও বার্লিনের কোনো তুলনা হয় না। পৃথিবীর সব চাইতে ধনীর দেশ আমেরিকা। নিউইয়র্ক তার মাথার মণি-শো উইন্ডো। তবুও সেখানকার ডাউন টাউনের মানুষের দারিদ্র্য, জৌলুসভরা টাইমস স্কোয়ারে ভিখারি দেখলে চমকে উঠতে হয়। কেন বেকারি? আমেরিকার কত অজস্র নাগরিক আজও অন্ন-বস্ত্রের জন্য হাহাকার করছে।
তাই তো বার্লিনের সঙ্গে নিউইয়র্কেরও তুলনা হয় না, হতে পারে না; বার্লিনে বেকার? ভিখারি? নিশ্চয়ই মানুষটা উন্মাদ। তা না হলে ওখানে কেউ বেকার থাকে না, ভিখারি হয় না।
এসব তরুণ আগেই জানত। পোস্টিং না হলেও আসা-যাওয়া করতে হয়েছে কয়েকবার। সেই বার্লিনে চলেছে তরুণ।