০৯. মূৰ্ছা খেয়েও হুঁশ ফিরে পায়

মূৰ্ছা খেয়েও হুঁশ ফিরে পায়। পড়ে গিয়েও উঠে দাঁড়ায়। কামে যায় চৌধুরীবাড়ি। শেষ করে ফেলে মিজিদের ফরমাশি জাল বোনার কাজটাও। সে জাল হাতে তুলে দিয়ে নিয়ে আসে নগদ টাকা। সে টাকায় শাড়ি কিনে হাসি ফোঁটায় আককির মুখে।

কিন্তু চৌধুরী বাড়ির কাজে লানত। দিকদারি। যতক্ষণ কাজ করে নবিতুন দাওয়ায় বসা ছোট চৌধুরীর চোখ দুটো ওকে লেহন করে চলে। ছোট চৌধুরীকে বুঝি লুন্দর শেখের চাইতেও বেশি ভয় নবিতুনের। শয়তান লুন্দর শেখের মোকাবিলা করেছে নবিতুন। প্রাণ হাতে নিয়ে পালিয়েছে লুন্দর শেখ। নবিতুনের ভয় গেছে কেটে। নবিতুন জানে দ্বিতীয়বার দুঃসাহস দেখাবার আগে হাজারবার ভাবতে হবে লুন্দর শেখকে।

কিন্তু যে ভীতির সাথে সামনাসামনি পরিচয় হয়নি তাকেই তো বেশি ভয় মানুষের।

অন্য জায়গায় কাজ খোঁজে নবিতুন।

কোথাও যাসনে। আককিকে সাবধানী দিয়ে বেরিয়ে পড়ে নবিতুন।

পেছন থেকে শুনতে পায় বড় হিস্যার দাওয়ায় বসা কামিজ বুড়োর গলা– ছোট চৌধুরীর নজর খারাপ। ও কাজটা ছেড়ে দাও তুমি।

ইদানীং কথাটা হামেশাই বলছে কামিজ বুড়ো।

দূর থেকে কামিজ বুড়োর দিকে একটা তির্যক কঠোর দৃষ্টি হেনে গাছগাছালির আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যায় নবিতুন। নবিতুন বুঝতে পারে না ছোট চৌধুরীর বদ নজরটা চোখে পড়ে কামিজ বুড়োর, কিন্তু লুন্দর শেখের বদখেয়ালটা কেন চোখে পড়ে না তার।

চৌধুরীবাড়ির পেছনে সীমানায় গাঙ। গায়ের পর ধানক্ষেত। ক্ষেত পেরিয়ে হাট। হাটের ধার ঘেঁষে মাটির মস্ত মস্ত চাঙড় ফেলে দৌড়ে চলেছে ভয়াল নদী কয়ালের খরস্রোত।

কয়ালের তীর ধরে জেলে বসতি। ওরা মাছ ধরে, সঙ্গে সঙ্গেই বিক্রি করে দেয়।

বছরখানিক হলো হাটের পাশে জেলে বসতিকে ঘিরে রীতিমতো গঞ্জ গড়ে উঠেছে একটা। মহাজন আর ফড়ে ব্যাপারীতে ভরে গেছে গঞ্জ। ওরা মাছ কেনে। সে মাছ লঞ্চ বোঝাই করে চালান দেয় শহরে।

ইদানীং শহরের লোকসংখ্যা নাকি ফেঁপে উঠেছে। সেই লোকেরা মাছ খায়। আর তাই দিন দিন ফেঁপে উঠছে ফড়ে ব্যাপারীর কারবার।

নবিতুন শুনেছে এখানে মেয়েরাও আজকাল কাজ করছে। কাজের সন্ধানেই এসেছে ও।

কিন্তু হাটের উপর পা রেখেই খচ করে ওঠে ওর বুকটা। নবিতুনের মনে সেই সিঙ্গি মাছের কাঁটার খোঁচা। কাঁটার খোঁচায় জর্জর হয়ে চলেছে বুকটা।

কয়াল।

ভীষণ ভয়াল সেই জলরাশি। তুফানী প্রলয়ের মতো ছুটে চলেছে। ছুটে চলেছে কোন অন্ধ উন্মত্ততায়। এরি মাঝে তার সমস্ত হিংস্রতা অগ্রাহ্য করে ভেসে বেড়াচ্ছে জেলে ডিংগিগুলো।

ভাটির টানে ভেসে চলেছে সারি সারি নৌকো। নৌকোর উপর জালের কাছি ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে জেলের দল।

দূর স্রোতের উলটোমুখী চলে গেল একটা জাহাজ। সেই জাহাজের চাকার আঘাত খেয়ে ঢেউগুলো ছলাৎ ছলাৎ আছড়ে পড়ছে কূলে।

পা সরে না নবিতুনের।

কয়ালের দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকে নবিতুন। দূরে কয়াল যেখানে গিয়ে মিশেছে সমুদ্রের সাথে সেখানে রুপালি ঝিকিমিকি আর কি এক ধূসব শূন্যতা! সেখানে সেই অসীম দরিয়ার কোন্ অজানায় হারিয়ে গেছে ওর সারেংটি।

সেখানে সেই রুপালি ঝিকিমিকি আর দিগন্তহীন ধূসর শূন্যতা নবিতুন কি কোন দিন ফিরে পাবে, খুঁজে পাবে ওর সারেংকে?

না। কয়ালের দিকে, সমুদ্র-মোহনায় ওই উন্মত্ত জলরাশির দিকে তাকাতে পারে না নবিতুন। চোখ ওর ঝাপসা হয়ে আসে। চোখ ফিরিয়ে নেয় নবিতুন।

এই দরিয়ার পানি, দূর সাগরের ওই চিকিমিকি আভা– নবিতুনের চিরকালের দুশমন। কদম সারেং কি সে কথাটি বুঝল কোন দিন?

বুঝেছিল নবিতুনের বাপজান। যেদিন নবিতুনকে কোলে নিয়ে অবাক হয়েছিল। অবাক হয়ে বলেছিল, আরে তুই যে ডাংগর হয়ে গেলি! সেদিন কী চোখে বাপজানের দিকে তাকিয়েছিল নবিতুন!

হ্যাঁ। ডাংগর অর্থাৎ বড় হয়ে উঠেছিল নবিতুন।

তাই অনেক অভাব, অনেক চাওয়া বুঝি ভাষা খুঁজছিল ওর চোখের তারায়। মেয়ের চোখের সেই অস্ফুট ভাষা বুঝতে পেরেছিল বাপজান। নবিতুনের বাপজান। তাই আর যায়নি জাহাজের কাজে।

জেলে বসতির ধার ঘেঁষে নারিকেল বীথি। জেলে বসতি ছাড়িয়ে কয়ালের পার ধরে ধরে দূর, অনেক দূর অবধি চলে গেছে নারকেল সারি। মাথায় তার চিরল চিরল পাতা।

পাতায় পাতায় সাগর বাতাসের গুঞ্জন।

সাগর হাওয়ার দোল খায় নারকেল বীথি। ঋজু বঙ্কিম সুন্দর। নবিতুনের ভালো লাগে। তার চেয়েও ভালো লাগে নারকেল সারির ডানে জেলেদের হোগলা ছাওয়া ঘরের পেছনে যে উঁকি মারে সবুজ ক্ষেত। তারই এক টুকরো সবুজ কি কখনো একান্ত নিজের বলে দাবি করতে পারবে না নবিতুন? উলটোমুখী হয়ে তাড়াতাড়ি পা ফেলে নবিতুন।

না।

কয়ালের পাশে যেখানে দরিয়ার থই থই ভয়, যেখানে সাগরের ঝিকিমিকি সেখানে কাজ করতে পারবে না নবিতুন।

সহসা যেন ভয় পেয়েই বাড়ির দিকে ছুট দেয় নবিতুন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *