০৯. মুসলমানদের জুম্মাবার

গঙ্গায় জোয়ার-ভাঁটা খেলে। দিন আসে যায়।

শুক্রবার। মুসলমানদের জুম্মাবার। রমজানের মাস সেটা। সারা দিনমান উপোস, তারপর কিছু জলযোগ।

বেলা শেষে আজানে বসে গনি মিঞার মনটা কিছুতেই ভাল বসল না চোখের সামনে বার বার ভেসে উঠল গঙ্গার ধারের প্রার্থনাতে বিঘে জমির ছবি। ছবি তো নয়, যেন ননীমাখন। খাণের বোঝা এত বেড়ে উঠেছে যে, নিঃস্ব হওয়া ছাড়া কোনও গতি নেই। সেই জমি আজ বেহাত হতে বসেছে। এ লাহা ইল্লাল্লাহ মোহাম্মদের রসুলাল্লাহ্! এ কী দিন এল। কোন গোস্তাকিতে! কার গোস্তাকিতে।

সন্ধ্যাবেলা সামান্য দুটো কলাই ভেজানো গুড় দিয়ে খেয়ে বিবি লতিফাকে বলল, পিরানটা দে তো গোলামের মা, নগিন মহাজনের কাছে একবারটা ঘুরে আসি।

লতিফা গনির দ্বিতীয় পক্ষের বিবি। প্রথম বিবি একটা রুগ্ন বছর বাবোর ছেলে রেখে গত সনের ওলাউঠায় মারা যাওয়ার পর লতিফাকে সে নিকা করেছে। গোলাম লতিফার আগ পক্ষের সন্তান। সেই সন্তানসহই লতিফাকে ঘরে এনেছে সে। লতিফার বয়স অল্প তো বটেই, মুসলমানপাড়ায় তার সৌন্দর্যের খ্যাতিও আছে। সৌন্দর্যের জন্যই গনির জীবনে লতিফা যা বয়ে এনেছে তা হল, একদিকে আওরতের প্রতি তার অতিরিক্ত টান ও সাংঘাতিক মোহ, অন্যদিকে প্রচণ্ড অবিশ্বাস নিজের দারিদ্র্য ও কুলম্যাদাহীনতার জন্য। একমাত্র এই কারণেই মুসলমানপাড়ার অর্থবান ঐশ্বর্যবান শরাফত মিয়ার সঙ্গে তার একটা গোপন বিদ্বেষের অন্তঃস্রোত ক্রমাগত বেড়ে উঠেছে। ধনমদে মত্ত শুধু নয়, শরাফত সপ্তদশ শতাব্দীর বাংলার মোগল শাসনকর্তা ইসমাইল খাঁয়ের বংশধর বলে পরিচয় দেয়। বোধ করি বাদশা বংশের মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়েই সে একটি ছোটখাটো হারেম তৈরি করেছে বাড়িতে। গোটা সাতেক বিবি নিয়ে তার ঘর। মুসলমানপাড়ায় সামাজিক ও বৈষয়িক ক্ষমতার প্রাবল্যে সকলেই কিছুটা সন্ত্রস্ত বটেই, সমস্ত ব্যাপারেই সে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে অনেক সময় অনেকের সর্বনাশই ঘটিয়ে ছেড়েছে। সেনবাবুদের সঙ্গে তার মোহব্বত গভীর, কোম্পানির সাহেবদেরও সে খুব প্রিয়। গোরাদের পার্বণ উৎসবে তার নিমন্ত্রণ হয়, মুসলমানদের পালপার্বণে নিমন্ত্রিত হয় গোরারা।

লতিফাকে গনি নিয়ে আসার পর শরাফত স্পষ্টই বলেছিল, বেল দেখে কাকের নোলায় জল। গনির উচিত লতিফাকে আমার মোকামে তুলে দেওয়া। অন্যথায় লতিফা তাকে পরিত্যাগ করবে। একমাত্র শরাফতের বিবি হওয়া ছাড়া লতিফার গত্যন্তর নেই।

পিঁপড়ে-হাতি সম্পর্ক হলেও গনি বলেছিল, আমর হাঁসুয়ার যা ধার আছে তাতে অমন শরাফতের মতো এক গণ্ডাকে এক কোপে খতম করে দেওয়া যাবে।

শরাফতের মতো প্রতাপশালী লোক যে সেই মুহূর্তেই এর প্রতিশোধ গ্রহণ করেনি তার পেছনে কারণ ছিল। তার বিশ্বাস ছিল, গনিকে অবস্থার দায়ে তার কাছে আসতেই হবে। লতিফা আরও দশবছর যদি গনির ঘর করে, তারপরেও তাকে নিয়ে ভোগ করা এমন কিছু ঠকবার মতো হবে না। কারণ লতিফার রূপের আগুন নিভবার নয়।

গনির পূর্বপুরুষেরা সকলেই সুতা তৈরি করত। কোম্পানির দৌরাত্ম্যে যখন জোলারা অনেকেই জাতব্যবসা ছেড়ে মাঠে নামল তখন থেকে তারা মাঠের মানুষই হয়েছে। কিন্তু জমির পরিমাণটা চিরকালই কম ছিল। যাদের জমি এবং ফসল নিয়েই শুধু কারবার ছিল তারা প্রতিমুহূর্তে জমি বাড়াবার কথাই ভেবেছে। তাদের সে অবসর ছিল না। আজ দুর্দিন এতই গভীর যে, যাদের জমি ও বাগান বেশি ছিল, ঘোড়দৌড়ের দ্রুত খুরাঘাতের মতো অতিরিক্ত খাজনার চাপে তারাই দুমুর্শ হতে বসেছে। জোলা তাঁতির এ দুর্দশার সঙ্গে ছোটখাটো নিম্ন কৃষকেরাও তাদের সঙ্গে বসেছে ফতুর হতে। সুদিনে জোলা তাঁতির অন্তহীন কাজের ফাঁক ছিল না। জমি তাদের ভাগেই থাকত। সেই সমস্ত জমি আজ হয়েছে ছিন্নভিন্ন, হাজার টুকরো। এসব গ্রামের দিকে তাকালে আজকাল মনে হয়, দু-এক ঘর কুমোর ও ওস্তাগর ছাড়া কোনও শিল্পের কারিগর কেউ ছিল না, অধিবাসীরা জীবনভরই বুঝি চাষী। এমন কী, কাঁসা পেতলের কারিগরদের ভিড়ও হাটে কমে গেছে। নতুন রকমের বিলাতি হালকা রূপালি বাসনে বাজার ভরে উঠেছে। দেশি মহাজনেরা বিলাতি মালের কারবারি হয়েছে।

লতিফা বলল, রোজার দিনেও মাঠঘাট করে এসে এখন আবার নগিনের কাছে কেন?

কেন? সত্যিই শত বুদ্ধিসুদ্ধি থাকলেও অওরতের জাতটা ভারী বোকা। হুঁকায় একটা বিলম্বিত টান দিয়ে এমন আসন্ন বিপদের মুহূর্তেও হেসে বলল, কেন বল দেখি?

স্থির দৃষ্টিতে গনির দিকে তাকিয়ে লতিফা বলল, কর্জার ফিকিরে বোধ হয়?

হুঁকো টেনে ঘাড় নেড়ে তারিফ করল গনি লতিফার বুদ্ধির। আবার বলল, কেন বল তো?

 কিন্তু লতিফার মুখে তখন অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। বলল, ঈদের সওদা করতে লাগবে তাই।

এবার বিস্ময়ে চোখজোড়া কুঁচকে লতিফার দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে হঠাৎ হাসতে গিয়ে হাসতে পারল না গনি। একটা দুর্বোধ্য গোঙানি শোনা গেল তার গলায়। বলল, ধানটা উঠলে আবার দেনা শোধ করে দেব। উপায় তো নেই। পানু ঠাউর বলছিল পরশুঁকে আমাবস্যে, যা হোক করে পরবটা মানাতে লাগবে তো!

কিন্তু লতিফার মুখে যেন অন্ধকার আরও ভারী হয়ে এল। নিঃশব্দে এবং কোনও কথা না বলে পিরানটা গনির হাতে দিয়ে চলে গেল সে।

লতিফার এ নীরবতা, এই কী-যেন-কী-থাকা নৈঃশব্দ্য গনির মনটাকে সন্দেহে ভারী করে তোলে। মনে করে, লতিফা বুঝি প্রতিমুহূর্তে নিজের এ দুভাগ্যকে ধিক্কার দিয়ে চুপ করে থাকে। আফসোস নিয়ে ঘর করে সে গনির সঙ্গে। একথা মনে করলে তার রাগ হয়, বেদনার চেয়ে অপমানিত এবং সেজন্য এক অদ্ভুত জ্বালায় বুকটা জ্বলে তার। কারণ জিজ্ঞেস করলে লতিফা বলে, কী বলব বলল, কথা বললে আল্লা কি আমাদের কিছু দৌলত দেবে?

কিন্তু অভাবের কথা বিবির সঙ্গে আলোচনা করবে ততখানি উজবুক যেন কেউ গনিকে ঠাউরে না বসে। সে জবাব দেয়, আরে তুই মাগী আমার ঘরে গতর খাটিয়ে পেট ভরা না, দৌলতে তোর কী হবে?

সে হঠাৎ উঠে লতিফার কাছে গিয়ে বলল, গোমড়া মুখ করে চলে এলি যে?

কী কথা বলব?

বলবি আবার কী? তোর গোমড়া মুখ দেখব বলে বুঝি মহাজনের কাছে যাচ্ছি?

সে কী বড় সোখের কথা!

সুখের কথা নয় ঠিকই কিন্তু অমন আঁধার ভারীমুখ দেখতে ইচ্ছে করে না গনির। বলল, শরাফত মিয়ার মতো দৌলত যদি থাকত, তবে–

লতিফাও কাটা কাটা জবাব দেয়, তা হলে আরও কয়েক গণ্ডা লতিফাকে ঘরে এনে তুলতে।

গনি হো হো করে হেসে উঠল। আচমকা লতিফাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে টেনে নিল সে বুকের কাছে।

লতিফা বাধা দিয়ে বলল, যাও সাহেব, মনে আমার সোয়ান্তি নেই। আমি হলে কজা করে পরব করতুম না।

গনি ধমকে উঠল, অমন কথা বলিসনে লতাবিবি। আল্লার দেওয়া পরবের দিন, ফকিরেও চুপচাপ বসে থাকে না। তোর অমন খুবসুরত চেহারা, পরবের দিনেও তাকে ভূত করে রাখতে পারব না বাপু আমি।

বিবির সৌন্দর্যে অভিভূত মানুষটার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে লতিফা পরম উৎকণ্ঠিত গলায় বলল, মিয়াসাহেব, সংসার তোমার ছোট নাকি, কিন্তু কেমন করে বছর কাটবে আমি যে ঠাওর পাই না।

তাড়াতাড়ি লতিফাকে ছেড়ে দিয়ে একেবারে উঠোনে নেমে গেল গনি। তার উপর ভরসা নেই লতিফার। নিশ্চিন্তে মরদের উপর নির্ভর করে হাসতে পারে না সে। উঠান থেকেই চেঁচিয়ে বলে উঠল গনি, কিছু না হোক, শরীরে খেটে দিনমজুরি তো করতে পারব। কুম্পানির এলের নাইন পাতব, পরের জমিনে মজুর খাটব। তা বলে শরাফতের দৌলতখানায় তোকে আমি যেতে দেব না।

মনের এই আসল এবং মোক্ষম কথাটি বলে সে বিড়বিড় করতে করতে বেরিয়ে গেল।

লতিফাকে তৎক্ষণাৎ দেখলে মনে হয় না গনির এ কথায় সে রুষ্ট হয়েছে। সে চুপচাপ বাতি জ্বালল, গনির রেখে যাওয়া হুঁকোটা ঘরে এনে বারকয়েক গুড় গুড়ক করে টানল। আগুন নেই দেখে হুঁকো রেখে চাল ধুয়ে চেঁকিঘরের মাচান থেকে কাঠ পাড়তে গিয়ে হঠাৎ চোখে আঁচল চেপে ফোঁসফোঁস করে উঠল। বসে পড়ে বেঁকিতে মুখ রেখে বার বার বলল, খোদা, তুমি সাক্ষী থেকো, সাক্ষী থেকো। বিনা গোস্তাকিতে আমার ইজ্জত ছোট করল। বিনা গোস্তাকিতে….

গনি যাওয়ার পথে শ্যামের উঠোনে কয়েকজনকে দেখে থেমে জিজ্ঞেস করল, শ্যাম আছ নাকি?

উত্তর দিল শ্রীশ মণ্ডল।

শ্রীশের গলা শুনে গনি ঢুকল। দেখল প্রায় জনা দশেক লোক সেখানে বসে আছে। সকলেই প্রায় খীরপাড়ার লোক। রান্নাঘরের ছিটে বেড়ার জানালা দিয়ে খানিক আলো মানুষগুলোর গায়ে পড়ে কাঁপছে। সে আলোয় দেখা গেল সকলেই প্রায় মাথা নিচু করে বসে আছে। মাঝখানে কালো দুলে তার ছানিপড়া চোখে এ-দিক ওদিক দেখছে। দেখছে না, মনে হয় যেন গন্ধ শুকছে।

গনি বলল, কীসের মজলিস্ বসেছে গো সজেবেলতে?

শ্যাম বলল, মজলিস্ আর কী। অ্যাই সুখ দুঃখের কথা দুটো। বসো। বলে সে কো থেকে কলকেটি তুলে গনির হাতে দিল।

গনি কলকেটা হাতে নিয়ে বসে বলল, বসব না, যাব একবার নগিন ঘোষের কাছে।

সকলেই প্রায় তার দিকে একবার মুখ তুলে তাকাল।

শ্রীশ বলল, এর মধ্যেই? বছরের আদ্ধেকখানিকও তো যায়নি।

তা কী করব বল। কলকেতে কয়েকটা টান দিয়ে বলল, কাল বাদ পরশু পরব, যা হোক কিছু করতে লাগবে তো।

কালো দুলে বলে উঠল, তাই বলছিনু কী যে, আগের দিনে,…

তাকে ধমকে উঠল পবন চাঁড়াল, তোমার খালি ওই এক কথা। আগের কালে তো রাম যোধিষ্ঠীর ছেল, তাতে হয়েছে কী?

না, তাই– একটা বিলম্বিত শব্দ করে কালো দুলে। থেমে পাশের লোকটির সঙ্গে নিচু গলায় গল্প শুরু করল।

শ্ৰীশ আবার বলল, নগিন ঘোষের কাছে কেন? শুনছেলম, শরাফত মিয়ার কাছেই তোমরা ধার দেনা করছ?

গনি আরও গোটাকয়েক টান দিয়ে বলল, তাতে কী আর সুদে আসলে কিছু কম আদায় করবে। আর তুমি তো জানো, মরে গেলেও শালার কাছে হাত পাতবে না গনি জোলা কোনওদিন।

অন্ধকারের মধ্যে একটা ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে উৎকণ্ঠিত গলায় বলল শ্রীশ, তাই তো বলছেলম গো, মান-অপমান মহাজন বাছাবাছি য্যাতই করি, মরলেও কি বাঁধন ছাড়াতে পারবে? জমিদারের খাজনা আদায় নাকি কম পড়ে, তাই জমি নীলামে ডাকবে।

সকলে না হোক, কয়েকজন বিস্ময়ে চমকে উঠল। শুধু চমকানিও নয়, এর মধ্যে এমন এক সর্বনাশের ইঙ্গিত ছিল যে, আচমকা গায়ের উপর কেউটে পড়লে বোধ করি মানুষের এমন অবস্থা হয়।

পবন বলল, নীলামে ডাকবে, তার জমি কোথায়? অনাবাদী জমি তো একছিটেও দেখিনে।

শ্ৰীশ যেন জমিদারের আমিনের মতোই নির্লিপ্ত নিষ্ঠুর গলায় ঘোষণা করল, তা হলে আবাদী জমিই নীলামে ডাকবে।

কার জমি?

তোমার আমার।

 আমরা কি খাজনা দিইনে?

শ্রীশ বলল, আইনের কথা বলছিস্ পবন? তিক্ত এবং বিদ্রূপভরা রাজত্বে নাকি আইন বড় চড়া। কিন্তু প্যাচ করবি কার সঙ্গে। জমিদারের সঙ্গে? উচ্ছেদ করে ছেড়ে দেবে না তোকে?

পবনের চোখজোড়া অন্ধকারে ধকধক করে জ্বলে উঠল। বলল, তার বাড়া ভয় তো নেই? সে তোমার এমনিতেও হবে অমনিতেও হবে। একবার নয় পঁাচ কষেই দেখব।

কালো দুলে বলে উঠল, ও-সব অনাছিষ্টির কথা বলিসনে পবনা। দিনকাল বুঝে কাজ করতে নাগে, বুচলি। ইকে বাস বোলতার সঙ্গে, বিবাদ চলেনে। হাতে পায়ে ধরে পড়গে। দয়া ধম্মা কি আর উবে গেছে দেশ থেকে। আগের কালে…।

তোমার আগের কাল নে তুমি থাকগে, প্যাচাল পেড়োনে। জ্বলে উঠে অস্থির গলায় বলল ধ্বন। বলি দয়া ধম্মে যদি থাকবেন তবে নীলামে ডাকা কেন, আ?

লখাই কোনও কথা না বলে সেনবাড়ি যাওগার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। খেয়েদেয়ে, মাথায় পাগড়ি বেঁধে লাঠিগাছটি নিয়ে বেরুবার মুহূর্তে সে হঠাৎ পবনকে জিজ্ঞেস করল, কী করতে পারো তুমি জমিদারকে? কী ক্ষ্যামতা আছে তোমার।

তাকে দাঁড়াতে দেখে ও এ প্রসঙ্গে কথা বলতে শুনে, শ্যাম শঙ্কিত হল। কারণ এসব কথা বলতে গেলে লখাইয়ের ভালমন্দ জ্ঞান থাকে না। থাকে না মুখের রাখঢাক। তার কথা শুধু পবনের মতো প্যাচকষার দুঃসাহসিক অভিপ্রায়েই সীমাবদ্ধ থাকে না, তার চেয়েও চতুগুণ সর্বনাশ ও ভয়ের কথা বলে অপরের মনে শঙ্কা জাগিয়ে তোলে।

শ্যাম তাড়াতাড়ি বলল, তুমি বেইরে পড়ো, রাত হয়ে গেল। কোতোলবাবু লইলে আবার গণ্ডগোল করবেখনি।

লখাই পবনের পরম বন্ধু। লখাই পবনকে বিদ্রূপ করে বা রাগ করে বলেনি তার ক্ষমতার কথা। বলেছে বড় জ্বালায়, পবন সে কথা জানত। তাই বলল, কিছু না পারি, মরতেও তো পারি লখাই!

কানু তাঁতির কথা উল্লেখ করে বলল লখাই, সে তো কানুদাদাও পান দিল, তুমিও না হয় খুন হবে তাতে হবেটা কী? তোমার ঘরের বউ রাঁড়ি হয়ে ঘুরবে। সাধ করে কী আর সেজবাবু বলেন, আমরা হলুম নিধিরামের জাত।

শ্যামের আশঙ্কাকে লক্ষ করে লখাই সত্যিই উত্তেজিত হয়ে উঠল। শ্যাম উক্তষ্ঠিত গলায় বলল, লখাই, বেড়ারও কান আছে।

লখাই অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বলল, কান থাকলে সেই বেড়াকেই বলি, যত নষ্টের গোড়া তোমার ওই কোম্পানি, তার সাউকার বড় মানূষেরা। মহারানীর আইন।

বলতে বলতে ক্রোধে আত্মহারা লখাই মাটিতে লাঠি ঠুকে বলল, বলি, সে ফিরিঙ্গি মেম আমার

কে যে, তার আইন মেনে চলব? তার আইন নে তার দেশে থাকুক, এখেনে কেন আঁ, কেন?

শ্যাম উৎকণ্ঠায় তাড়াতাড়ি কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, লখাই, চুপ যাও, লখাই…

অন্ধকার দাওয়া থেকে কাঞ্চনের কালীকে উদ্দেশ্য করা কথা ভেসে এল, মোনসার গোঁ উঠলে আর রক্ষে নেই, কাজে যেতে বলো তোমার দেওরকে।

কিন্তু অন্যান্য মানুষগুলো এক বিচিত্র বিস্ময় অথচ নির্বোধের মতো হাঁ করে তাকিয়ে রইল সখাইয়ের দিকে। সে যা বলেছে কাজে তার সঠিক অর্থ এবং পরিণতি কী হতে পারে, সে কথা যেন মানুষগুলো আঁচ করতে গিয়ে আপন মনেই থমকে দাঁড়িয়েছে।  

রান্নাঘরের লম্প নিভে গিয়ে উঠোনটা অন্ধকার! লখাই সেখানে লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে যেন এক মস্ত দানব। আর অন্ধকারে মিশে যাওয়া কালো মানুষগুলোর ভয়ে বিস্ময়ে প্রগলিত জোড়া জোড়া চোখগুলো চকচকিয়ে উঠল। হা হা করে হাওয়া ছুটে এল দক্ষিণ থেকে। প্যাচা ডেকে উঠল হুম্ হুম। …সেনবাড়ির ভেরী বেজে উঠল। রাত্রির প্রথম ভেরি ছুটে গেল দিগদিগন্তে হাওয়ায় ভর করে।

গনি উঠে এসে লখাইয়ের হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলে উঠল, ঠিক বলেছে লখাই। আল্লার হুকুম আমরা কেউ মানিনি। আমরা কাফেরকে তোয়াজ করে বসতে দিইছি।

এমন সময় অন্ধকার কুঁড়ে পাঁচু দিগর হাজির হল বাঁক কাঁধে জালার মতো দুই মস্ত ভাঁড়ে তাড়ি নিয়ে। কালো দুলে নাকটা উঁচু করে খাস টেনে বলল, পাঁচু এল বুঝি।

কিন্তু কেউই জবাব দিল না। পাঁচু বাঁক নামিয়ে সবাইকে দেখে বিস্মিত হয়ে বলল, কী ব্যাপার গো, সব মৌনি তো লিয়েছ নাকি?

এ সন্ধ্যার তালরসের যেন কী এক দুরন্ত মাদকতা আছে। সেই সঙ্গে পাঁচুর গলার স্বরেরও বোধ হয়। থরা দলটা সকলেই গা ঝাড়া দিয়ে বসল। কালীবউ এসে ইতিপুর্বেই শ্যামের খানিক কাছে বসেছিল। দেখা গেল গন্ধে গন্ধে অধরাও এসেছে। এসময়ে সে ঝগড়ার কথা ভুলে যায় না শুধু নয়, গালি খেতেও রাজি আছে।

লখাই একটা দুর্বোধ্য শব্দ করে বেরিয়ে পড়ল। পবনও উঠে পড়ল তার সঙ্গে কয়েকজনের আপত্তি উপেক্ষা করে।

গনির রোজার দিন। সেও বেরিয়ে পড়ে বাইরে এসে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। নগিন ঘোষের বাড়ির দিকে মুখ করে এক মুহূর্ত কী যেন ভাবল, তারপর মুখ ফিরিয়ে সরাসরি বাড়ির পথ ধরল।

বাড়িতে এসে দেখল, সব অন্ধকার। ঘরে ঢুকে দেখল, সেখানেও বাতি জ্বলেনি। মেঝেতে ঘুমিয়ে আছে গোলাম, বাঁয়ে মাচাতে তার রুগ্ন ছেলে পাঁচু অঘোরে নিদ্রামগ্ন। নিশ্বাস পর্যন্ত শোনা যায় না। কালু হেকিমের যাবতীয় বড়ি খেয়েও ছেলেটা সারেনি। কিন্তু লতিফা কোথায়?

রান্নার চালাটাও অন্ধকার। পায়ের কাছে নিচু হয়ে মালসায় হাত দিয়ে দেখল ধোয়া চাল ভিজে ঢোল হয়ে উঠেছে। উনুনটা ফাঁকা। লতিফাবিবি কোথায়?

হঠাৎ যে কথা তার প্রথমেই মনে গেয়ে উঠল তাতে এক দারুণ ভয় ও যন্ত্রণায় যুগপৎ বুকটা আড়ষ্ট হয়ে গেল। সে ডাকল, গোলামের মা! লতিফা।

হাওয়ায় সরসর করে উঠল চালার গোলপাতার ছাউনি। বেড়ার বাঁশে শব্দ উঠল ক্যাঁ কোঁ। উঠোন থেকে বিলম্বিত শব্দ করে একটা বেড়াল ডেকে উঠল।

গনি ছুটে উঠোনে এসে ডাকল, লতিফাবিবি।

জবাব নেই।

ঘরের পেছনে জংলার দিকে গেল। নেই সেখানে। ঢেঁকিঘরটা হা হা করছে। সেখানে মানুষ দেখা যায় না।…কিন্তু চেঁকির উপরে ওটা কী?

সে কাছে এসে দেখল চেঁকিতে মুখ দিয়ে পড়ে আছে লতিফা। দুহাতে লতিফার মুখ তুলে সে বলল, কী হয়েছে তোর লতাবিবি?

লতিফার কান্নার বেগ তাতে বেড়ে গেল। কান্নার সেই বেগ দেখে গনির মনটা বড় আকুল হয়ে উঠল। সে কোনও বিপদের আশঙ্কা করে বলল, বল তোর কী হয়েছে, আমাকে বল্।

সে তার বলিষ্ঠ দুই হাতে লতিফাকে গায়ে টেনে নিল।

লতিফা কান্নার দমকে দমকে বলল, কী বলব, তুমি মিয়াসাহে শরাফতের দৌলতের খোঁটা দেয়ার চে আমাকে গলা টিপে শেষ করে দেও।

আচমকা বেদনায় গনির বুকটাতে মুচড়ে উঠে কী যেন ঠেলে এল গলার কাছে। ফিসফিস করে যেন কান্নায়রাধ করে সে বলল, ই আল্লা, আবাগীর কথা শোনো।

এই কথা, এই কথা তোর! আর বলব না, কোনও দিন না, কোনও দিন না।

বলে সে পরম সোহগে লতিফার রোজার উপপাসে ক্লিষ্ট চোখের জলে ভেজা মুখোনি তুলে ধরল। নিশ্বাসে রূপোর নোক নড়ছে একটু। মাথার চুলে তেল নেই। কুমারী মেয়ের মতো আঁট শরীরে লতিফা যেন এক কিশোরী বালিকা।

দুঃখ দহনে সে লতিফার চাঞ্চল্য নেই, হাসি নেই। প্রেমে উদ্ধত স্বামীর পেয়ার গ্রহণেও সে ছোট বুকখানি দুশ্চিন্তার ভার কাটিয়ে উঠতে পারে না।

গনি বলল, চাল যে ভিজে ঢোল হয়ে গেছে, ভাত পাক করা যাবে না।

লতিফা বলল, এখুনি বেঁধে ফেলব। জল দিয়ে রাখব ভাতে ভোর রাতে খাবে, নষ্ট হবে না।

নিভে যাওয়া বাতি জ্বালিয়ে লতিফা উনুন ধরাতে বসল। বলল, মহাজনের কাছে গেলে?

না।

গনির গলার স্বরে বিস্মিত হয়ে ফিরে লতিফা জিজ্ঞেস করল, কেন?

গনি বলল জমি নিলামে ডাকার সম্ভাবনার কথা। বলে তারপর বলল, তোর কথাই সাচ্চা, পরব এবার ঘরের দুধে পায়েস করেই হবে। ছোঁড়া দুটোর জামাটামা একটুকুন ধুয়ে সুয়ে সাফ করে দি।

তারপর একটু থেমে বলল, এবারকার মতো শরাফত আমার জমিটুকু বড়া খাজনাতে ডেকে নেবে নিশ্চয়। তারপর…

তারপরটুকু শোনবার জন্যই লতিফা রুদ্ধশ্বাসে গনির মুখের দিকে তাকিয়েছিল।

গনি তাড়াতাড়ি মাথাটা নিচু করে মাটিতে নখ দিয়ে আঁক কাটতে লাগল।

লতিফা বলল তার বালিকাসুলভ চোখে উল্কণ্ঠা নিয়ে, তাপরে কী?

ডোমিনীপাড়ার কলে খাটতে যাব।

কল? পাটের কল?

হাঁ।

তবে যে তুমি কসম খেয়েছেলে, মরি তো কোনওদিন কোম্পানির কলে হালাল হতে যাব না?

সত্যি বটে। ইতিপুর্বে যখন মুসলমানপাড়া থেকে কয়েকজন রিষড়ে এবং নতুন তেলেনিপাড়ার চটকলে কাজ করতে যায় তখন সে বলেছিল, পরের ঘরে জন খাটব তবু পাটকলে গোরার খোঁয়াড়ে যাব না।

সে বলল, এ আল্লার মার কি না জানি না, কিন্তু কী গোস্তাকিতে আমাকে মাটি ছাড়া হতে হল আল্লাই জানে।

লতিফার দিকে ফিরে বলল, যাদের কিছু নেই, তারা হালাল হয়, আমাদের কিছু নেই, তাই আমরা কলে যাব। ইজ্জত ঢিলা হবে মানি, কিন্তু তুই যেন সেদিনেও মুখটা গোমড়া করে রাখিসূনে লতাবিবি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *