মুনিয়ার স্বামী আজহার সাহেব আমাকে একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেলেন। দীর্ঘ ভনিতার পর যা বললেন তা হচ্ছে–তিনি ভুল করেছেন। ভুল সংশোধন করতে চান। মুনিয়া এবং লাবণ্যকে নিয়ে আবার সংসার শুরু করতে চান। আমি বললাম, যে মেয়েটিকে বিয়ে করেছেন তার কি হবে? তিনি বিরক্ত মুখে বললেন–ও চুলোয় যাক। হুঁ কেয়ারস? আপনি ভাই একটা ব্যবস্থা করে দিন। আমি চির কৃতজ্ঞ থাকব। মানুষ ভুল করে না? আমি একটা ভুল করে ফেলেছি …
আমি হালকা গলায় বললাম, আপনি দেরি করে ফেলেছেন।
দেরি মানে?
মুনিয়ার বিয়ে ঠিকঠাক হয়ে গেছে।
সে কি?
সে কি বলছেন কেন? তার এমন কি বয়েস। সে বিয়ে করবে না? মোটামুটি বেশ ভাল একটা ছেলের সঙ্গেই বিয়ে ঠিক হয়েছে। ছেলেটিকে তার খুব পছন্দ।
আমি তো এইসব কিছু জানি না।
আপনার জানার কথাও না। ছেলেটিকে তার পছন্দ, কারণ প্রায়ই দেখি দুজন চায়নিজ টায়নিজ খেতে যায়।
কি বলেন এসব! মুনিয়া এটা করতে পারে না।
পারছে তো?
ঐ ছেলের ঠিকানা কি?
এখন আপনাকে ঠিকান্য দেব না। ঠিকানা দিলে ঝামেলা করতে পারেন। বিয়ে হোক, তারপর ঠিকানা পাবেন। আমি বরং মুনিয়াকে বলব সে যেন তার স্বামীকে নিয়ে আপনাদের বাসায় বেড়াতে যায়।
আজহার সাহেব অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে তাঁর ভুবন উলট পালট হয়ে গেছে। আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম–যাই? আমার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে হবে।
সফিককে দেখে চিনতে পারছি না।
ইয়া দাড়ি–ইয়া বাবরি চুল। গায়ে চক্রাবক্রা শার্ট, কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ এবং চোখে কালো চশমা। সফিক বলল, কি ব্যাপার বাক্যহারা হয়ে গেলি?
আমি বিস্মিত গলায় বললাম, দাড়ি কবে রাখলি?
দাড়ি কবে রাখলি মানে? এই দাড়ির বয়স চার মাস। গত চার মাসে খুব কনজারভেটিভ এস্টিমেট নিলেও তোর সঙ্গে তিনবার দেখা হয়েছে। এখন তুই জিজ্ঞেস করছিস দাড়ি কবে রাখলি?
সরি, আগে লক্ষ্য করিনি।
তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমার তো মনে হচ্ছে তুই আমাকে চিনতে পারছিস না। বলতো আমি কে? ঠাট্টা না। আই এ্যাম সিরিয়াস, বল,আমি কে?
সফিকের কথার জবাব দিলাম না। সে আমাকে তাদের বাসার সামনের চায়ের দোকানে নিয়ে গেল। হাসি মুখে বলল, তোকে বাসায় নেয়া যাবে না, আমার কোনবন্ধু বান্ধব বাসায় গেলেই বাবা প্রায় লাঠি নিয়ে মারতে আসে। মনে হচ্ছে উনার ব্রেইন শর্ট সার্কিট হয়ে গেছে।
সফিক পরপর দুকাপ চা খেল। সিগারেট ধরাল না। জানলাম সে সিগারেট ছেড়ে দিয়েছে। আজকাল না-কি আর সিগারেটের ধুয়া সহ্য করতে পারছে না।
আমি বললাম, চোখে সানগ্লাস কেন?
সে ক্লান্ত গলায় বলল, আমার প্যাঁচার স্বভাব হয়ে গেছে। চোখে আলো সহ্য হয় না। এজন্যেই চারদিক অন্ধকার করে রাখি। শুনলাম পরপর দুদিন তুই আমরা খোঁজে বাসায় গিয়েছিলি। কারণ কি?
কারণ নেই।
অকারণে তুই আমার খোঁজে যাবি, এটা বিশ্বাসযোগ্য না। কারণটা কি বল।
তোর বইটা পড়লাম। ভাবলাম কথা বলি।
তুই আমার বই পড়েছিস? এটাও বিশ্বাসযোগ্য না।
আজকাল অনেক অবিশ্বাস্য কান্ডকারখানা করছি। তোর বই সত্যি পড়েছি।
শেষ পর্যন্ত পড়েছিস?
না। প্রথম চৌদ্দ পাতা।
সফিক আহত চোখে তাকিয়ে রইল। তার অতি প্রিয় বন্ধু চৌদ্দ পাতার বেশি পড়েনি এই কঠিন সত্য সে মেনে নিতে পারছে না। আমার মনে হল সে খানিকটা রাগও করছে। বারবার জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাচ্ছে। প্রচন্ড রেগে গেলে সেই কাজটি করে। আমি তার রাগ কমানোর জন্যে বললাম, চৌদ্দ পাতা পড়লেও পড়েছি খুব মন দিয়ে।
মন দিয়ে পড়েছিস?
আমার মতো মন দিয়ে কেউ পড়েছে বলে মনে হয় না।
সফিক থমথমে গলায় বলল, ইচ্ছা করছে তোকে মেরে তক্তা বানিয়ে দেই। ফাজলামির একটা সীমা আছে।
আমি হাই তুলে বললাম, তুই শুধু শুধু রাগ করছিস। আমি সত্যি খুব মন দিয়ে পড়েছি। মুখস্ত বলতে পারবো।
ও আচ্ছা। মুখস্ত বলতে পারবি? ছোটলোক কোথাকার।
আগেই গালাগালি করছিস কেন? আগে দেখ পারি কিনা।
আমি চোখ বন্ধ করে বলা শুরু করলাম। যেহেতু চোখ বন্ধ করে আছি, সফিকের রিএ্যাকশন ধরতে পারছি না। তবে বেশ বুঝতে পারছি–তার আক্কেলগুড়ুম। তার নিজের বই সে নিজেও মুখস্ত বলতে পারবে না। বলতে পারার কোনো কারণ নেই।
দম নেবার জন্য থামতেই সফিক বলল, যথেষ্ট হয়েছে থাম তো। আমার গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেছে। তুই দেখি সত্যি সত্যি মুখস্ত করে বসে আছিস। অকল্পনীয়। ব্যাপার।
তুই খুশি হয়েছিস তো?
খুশি হবো কেন? এটা কি খুশি হবার কথা? এসব পাগলের লক্ষণ, তুই পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছিস। তোর চিকিৎসা হওয়া দরকার। কোনো সুস্থ মানুষ উপন্যাস মুখস্থ করে? রবীন্দ্রনাথের হৈমন্তী হলেও কথা ছিল। অবশ্যি হৈমন্তী মুখস্থ করাও এক ধরনের পাগলামী। পৃথিবীতে কেউ উপন্যাস মুখস্থ করে না।
করে না বুঝি?
না করে না। যারা মেন্টাল কেইস তারাই করে। তুই দেরি না করে ডাক্তারকে দিয়ে মাথাটা পরীক্ষা করা। ওষুধপত্র খা। রাতে ঘুম হয়?
না।
ঘুমের ওষুধ খা। দশ মিলিগ্রাম করে রিলাক্সেন। সকাল দশটার দিকে একবার, রাতে ঘুমতে যাবার সময় একবার।
আমি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললাম, তুই প্রেসক্রিপশন দিচ্ছিস যে? তুই কি ডাক্তার নাকি?
সফিক হতভম্ব হয়ে বলল, কি বলছিস তুই? আমি ডাক্তার না? মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করিনি? তোর কি হয়েছে বল তো?
মনে ছিল না।
সামথিং ইজ ভেরী রং। তুই কাল বাসায় থাকিস। এগারোটার দিকে এসে আমি তোকে নিয়ে যাবে। ভালো একজন সাইকিয়াট্রিস্ট তোকে দেখুক। রূপার সঙ্গে তোর সম্পর্ক কেমন যাচ্ছে?
ভালো।
তার সঙ্গেও কথা বলা দরকার। চল যাই রূপার সঙ্গে কথা বলি, ওর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়নি তো?
ছাড়াছাড়ি হবে কেন?
বাজারের অনেক ধরনের গুজব, এই জন্যেই জিজ্ঞেস করলাম। ওর নাকি তিনটা চয়েজ ছিল। তুই ছিলি দুনম্বার। সত্য নাকি?
জানি না–ওকে জিজ্ঞেস কর।
চক্ষুলজ্জায় জিজ্ঞেস করতে পারি না। মনে ক্ষীণ আশা যে আমার নাম এক নশ্বরে কিংবা তিন নম্বার ছিল। তুই আবার রাগ করছিস না তো?
না।
চল ওঠা যাক। কাল বাসায় থাকবি। কাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো।
রাত দশটার দিকে বাসায় ফিরতেই দেখি মা-বাবা দুজনেরই মুখে হাসি। আজহার সাহেব নাকি বাসায় এসেছিলেন। সব মিটমাট হয়ে গেছে। তিনি মুনিয়াকে ফিরিয়ে নিচ্ছেন। মা বললেন, রঞ্জু, তুই থাকলে মুনিয়ার কাণ্ড দেখতি। খুশিতে এই হাসছে, এই কাঁদছে।
আমি বললাম, যে মেয়েটাকে আজহার সাহেব বিয়ে করেছেন তার কি হবে?
মা রাগী গলায় বললেন, তার কি হবে তা নিয়ে আমাদের কিসের মাথাব্যথা? যা হবার হবে।
তোমরা সবাই খুশি?
খুশি হব না? তোর কি ধরনের কথাবার্তা? তার উপর জামাই বলল, তুই নাকি উল্টা পাল্টা কি সব বলেছিস। মুনিয়ার বিয়ে হচ্ছে এইসব।
ঠাট্টা করে বলেছি।
তোর মাথাটা খারাপ রঞ্জু। তুই একজন ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করা।
করাব। কাল সফিক আমাকে একজন পাগলের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। তাঁকে বলব ভালমত চিকিৎসা করাতে। মুনিয়া কোথায় মা?।
ও আজহারের সাথে বের হয়েছে। রাতে বোধ হয় বাইরে খাবে।
ভালই তো।
লাবণ্য সঙ্গে যাবার জন্যে ঘ্যান ঘ্যান করছিল। যেতে দেইনি। ওরা দুজন একা একা কথা বলুক। কি বলিস রঞ্জু?
ভাল কাজ করেছ মা। খুব ভাল করেছ। বেজোড় সংখ্যক এতিম খাওয়ানোর ফল হাতে হাতে পাওয়া গেছে।
আমি আমার ঘরে ঢুকে জানলাম রূপা চলে গেছে। আমি তেমন অবাক হলাম। সে চলে যাবে জানতাম। আজই যে যাবে তাও জানতাম।
লাবণ্য পা ঝুলিয়ে আমার খাটে বসে আছে। তার মুখ গম্ভীর। আমি অবিকল রূপার মত গলায় বললাম–কিটেমন ইটাছ?
লাবণ্যর বলা উচিত, ভিটাল ইটাছি। সে কিছু বলছে না।
মন খারাপ লাবণ্য?
না।
লুডু খেলবে? যাও লুডু নিয়ে আস, আমরা দুজন লুডু খেলব।
না।
রাতে ভাত খেতে বসলাম শুধু আমি আর বাবা। তাঁর মেজাজ খুব ভাল। তিনি কোমল গলায় বললেন, শুনলাম বৌমা নাকি রাগ করে বাবার বাড়িতে চলে গেছে?
আমি ভাত মাখতে মাখতে বললাম, চলে গেছে এইটুক জানি। রাগ করে গেছে কিনা তা তো জানি না।
চিঠিপত্র কিছু লিখে যায় নি?
না।
দুপুরবেলা তোর মা খানিকটা বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে।
আমি কিছু বললাম না। বাবা বললেন, ওদের বাসায় টেলিফোন করে দেখ। চিন্তা করিস না।
চিন্তা করছি না।
ও আচ্ছা, ভাল কথা তোর ঐ তিন হাজার টাকা এনে রেখেছি। নিয়ে যাস।
রূপাদের বাসায় টেলিফোন করলাম। রিং হচ্ছে, কেউ ধরছে না। তার বাবা নিশ্চয়ই দেশের বাইরে। রূপার চাচার বাসায় টেলিফোন করলাম। টেলিফোন ধরল। আমি সহজ গলায় বললাম, রূপা আছে?
না।
সে কি এসেছিল?
না। আপনি কে বলছেন?
আমি রূপার খুব পরিচিত একজন। ওকে কোথায় পাওয়া যাবে বলতে পারেন?
ওর শ্বশুর বাড়িতে খোঁজ করুন।
আচ্ছা।
নিজের ঘরে এসে সিগারেট টানছি। বাবু ঢুকল। তার চোখ মুখ শুকনো। দেখাচ্ছে খুব কাহিল। আমি হাসি মুখে বললাম, কি খবর?
বাবু কাঁপা গলায় বলল, সর্বনাশ হয়ে গেছে দাদা।
কি সর্বনাশ?
ভাবী কি একটা ধাঁধা দিয়ে গেছে। কিছুতেই মাথা থেকে তাড়াতে পারছি না। পড়তেও পারছি না। কাল পরীক্ষা। ভাবীর কাছ থেকে উত্তরটা জানতে এসেছি।
ও তো বাসায় নেই।
দাদা তুমি উত্তরটা জান? দুজন ছেলেকে তাদের বাবারা কিছু টাকা দিয়েছিলেন। একজন তাঁর ছেলেকে দিলেন ১৫০ টাকা …
আমি বাবুকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, এর উত্তর আমি জানি না।
এখন তাহলে কি করব?
বাবাকে জিজ্ঞেস করে দেখ। জ্ঞানী মানুষ, উনি পারবেন।
বাবু ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
অনেক রাতে ঘুমুবার আয়োজন করছি, মা লাবণ্যকে কোলে নিয়ে উপস্থিত। আমি বললাম, কি ব্যাপার? মা বললেন, লাবণ্য আজ তোর সঙ্গে থাক।
কেন?
ওর বাবা আজ থাকবে এ বাড়িতে। কোথায় আর ঘুমুবে? মুনিয়ার ঘরেই থাকবে। অসুবিধা তো কিছু নেই। স্বামী স্ত্রী ছিল–সাময়িক সমস্যা গেছে। আবার তো বিয়ে হচ্ছে, তাই না?
তা তো ঠিকই।
মা লাবণ্যকে আমার পাশে শুয়ে দিলেন। একবারও জানতে চাইলেন না রূপা কোখায়।