মুঘল ভারতের ইতিহাস
উপাদানের শ্রেণী-বিভাগ
মুঘল সাম্রাজ্যের শিল্প-কলা ও ধন-দৌলতের কথা আমরা সকলেই জানি; সে যুগের অট্টালিকা ও চিত্র আজিও জগতের চিত্ত বিমোহিত করিতেছে। কিন্তু আমার মনে হয় যে, ঐ যুগের সর্ব্বাপেক্ষা বেশী গৌরবের, আমাদের পক্ষে সর্ব্বাপেক্ষা কাজের দাম হইতেছে ঐতিহাসিক সাহিত্যের অজস্র ও বিচিত্র ধারা। এগুলির অনুগ্রহে মধ্যযুগের ভারতের অবস্থা, সমাজ ও সভ্যতা আমরা এখনও যেমন অতি সূক্ষ্ম, অতি স্পষ্ট রূপে দেখিতে পাই, অন্য যুগের পক্ষে তেমন সম্ভব নহে। এই সব ঐতিহাসিক উপাদান বিভিন্ন শ্রেণীর এবং সেগুলি একই ঘটনা বা রাজত্বকালের উপর নানা দিক হইতে আলোকপাত করে, একটি অপরটিকে সমালোচনা ও সংশোধন করিবার উপকরণ-স্বরূপ।
প্রথম শ্রেণী– আকবর হইতে বাহাদুর শাহ্ (অর্থাৎ প্রথম শাহ্ আলম) পর্যন্ত, ১৫৫৬ হইতে ১৭১০ পর্যন্ত, প্রত্যেক বাদশাহর দীর্ঘ ধারাবাহিক সরকারী ইতিহাস লিখিত হয়, যেমন আকবরনামা, পাদিশাহনামা, আলমগীরনামা এবং বাহাদুরশাহ্ নামা। এই সঙ্গে জাহাঙ্গীরের আত্মজীবনীকেও ধরিতে হইবে।
দ্বিতীয় শ্রেণী-বে-সরকারী ইতিহাস; এগুলি সরকারী কর্মচারীদের দ্বারা লিখিত হইলেও, অফিশিয়াল হিস্ট্রি অর্থাৎ সরকারী আজ্ঞায় দরবারে লিখিত এবং বাদশাহ বা উজীরের দ্বারা অনুমোদিত ইতিহাস হইতে ভিন্ন। এগুলির রচনা-প্রণালী স্বতন্ত্র এবং ঘটনা ও তারিখ অনেক কম। বড় কর্মচারীদের জীবনচরিতও এই শ্রেণীতে আসে।
তৃতীয় শ্রেণী- এগুলিকে রীতিমত ইতিহাস বলা চলে না, খণ্ড ইতিহাস অথবা ইতিহাসের উপকরণ বলিলে অধিক সত্য হয়, যেমন দিন-লিপি (ডায়েরী), কোন সমর-অভিযানের সম্পূর্ণ রিপোর্ট, ইত্যাদি। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণী-ইতিহাসের কাঁচা মসলা, অথচ সৰ্ব্বাপেক্ষা অধিক বিশ্বাসযোগ্য অমূল্য আধার, যেমন সমসাময়িক চিঠি এবং হাতে-লেখা খবরের কাগজ।
ষষ্ঠ শ্রেণী– শাসন সম্বন্ধে কাগজপত্র, চিঠি, আজ্ঞা, আয়ব্যয়ের বিবরণ, হিসাব ইত্যাদি।
এখন এই বিভিন্ন ধরনের ইতিহাসগুলির স্বরূপ আলোচনা করা যাউক। আকবরের আজ্ঞায় শেখ আবুল্-ফজল্ আকবরনামা লিখিয়া যে একটি সাহিত্যিক নমুনা শিক্ষিত সমাজের সম্মুখে দিয়া যান, তাহাই দেড় শত বৎসর পর্যন্ত পরবর্তী বাদশাহদের চরিতকারেরা অনুকরণ করেন। এই সরকারী ইতিহাসের এমন কয়েকটি চিহ্ন আছে, যাহা অন্য ধরনের ইতিহাসে নাই। (ক) এগুলি ঠিক বর্ষ ও তারিখ অনুসারে ঘটনা সাজাইয়া লিখিত, (খ) তারিখ, লোকের নাম ও স্থানের নাম এত বেশী দেওয়া হইয়াছে যে, অনেক স্থলে ঠিক আজকালকার পূজার ছুটির পূর্ব্বে কর্ম্মচারী-বদলের গেজেটের মত অপাঠ্য। (গ) কিন্তু প্রত্যেক ঘটনা অতি বিস্তৃত ভাবে বর্ণনা করায় আমরা অনেক বিষয়ে সংবাদ পাই, তাহা ইতিহাস ভিন্ন অন্য কাজেও লাগে, যেমন জাতিতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব, আর্থিক অবস্থা ইত্যাদি। (ঘ) এই শ্রেণীর বইগুলির সর্ব্বাপেক্ষা বেশী মূল্য এই কারণে যে, ইহাদের ঘটনাবর্ণন ও তারিখগুলি একেবারে সত্য, এবং মূল আধার হইতে অবিকল উদ্ধৃত করা, অর্থাৎ মৌলিক ও সংগৃহীত গ্রন্থের মধ্যে যে পার্থক্য থাকে, তাহাই আমার বর্ণিত প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর পারসিক ইতিহাসের মধ্যে বিদ্যমান। এটা সহজে বুঝাইবার জন্য এই সরকারী ইতিহাসগুলি কিরূপে রচিত হইত, তাহার বিবরণ দিতেছি–
বাদশাহ্ কোন একজন পারসিক ভাষায় সুলেখক বিখ্যাত পণ্ডিতকে বাছিয়া লইয়া তাঁহাকে সরকারী ঐতিহাসিক বা Historiographer Royal নিযুক্ত করিয়া আজ্ঞা দিতেন যে, আমার রাজ্যকালের একখানা চিরস্থায়ী ইতিহাস লেখ। সমস্ত সরকারী বিভাগের– বিশেষত: দপ্তরখানার কাগজপত্র তাঁহাকে দেখাইবার ও নকল করিবার অনুমতি দেওয়া হইত। প্রদেশে প্রদেশে আজ্ঞা যাইত যে, সেখানকার পুরাতন ইতিহাস, আর্থিক অবস্থা, প্রধান ঘটনা ইত্যাদি সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ করিয়া রাজধানীতে এই লেখকের নিকট পাঠাইতে হইবে। ঠিক যেমন স্যর উইলিয়ম হান্টার কর্তৃক Imperial Gazetteer of India রচনার সময় ব্রিটিশ গভর্ণমেন্ট বন্দোবস্ত করেন। এই নির্ব্বাচিত লেখক মহাশয়ের প্রধান সম্বল হইল সেনাপতি ও প্রাদেশিক শাসনকর্তা (সুবাদার)-দের প্রেরিত রিপোর্ট এবং তাঁহাদের শিবির ও করদ রাজাদের দরবার হইতে প্রেরিত সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক সংবাদপত্র। এই শেষোক্ত কাগজগুলি প্রথমে ‘ফর্দ্দ–এ-ওয়াকেয়া এবং পরে ‘পারচা-এ-আবার’ অথবা আারাৎ নামে পরিচিত। এগুলি বাদশাহী দপ্তরে (বস্তাখানা বা রেকর্ড অফিসে) যত্নে রক্ষিত হইত। এই মহাসমুদ্র মন্থন করিয়া লেখক মহাশয় মনোরম অথবা কাজের সংবাদগুলি তারিখসহ নকল করিয়া লইতেন। পরে তাহা হইতে ঘটনার কাঠামো বা অস্থিকঙ্কাল রচনা করিয়া অধ্যায়গুলি সাজাইয়া বই লিখিতে বসিতেন। বাদশাহ্ নিজ কর্ম্মচারীদের যে-পত্র (ফর্ম্মান) পাঠাইতেন, বাদশাহের আজ্ঞায় উজীর অন্য লোককে যে-সব হুকুম পাঠাইতেন (হর্-উল্-হুঁকম্, অর্থাৎ ঠিক আমাদের গেজেটে By order ইস্তিহারের মত, কিন্তু ব্যক্তি-বিশেষের নামে প্রেরিত)–এগুলির নকল ঐ কেন্দ্রীয় রেকর্ড অফিসে থাকিত; রাজ-ঐতিহাসিক এগুলির মধ্যে কোন কোন দলিল হুবহু নিজ গ্রন্থে বসাইয়া দিতেন। এটা আমাদের পক্ষে বড়ই সুবিধাজনক হইয়াছে; কারণ, আমরা ইতিহাসের প্রথম শ্রেণীর উপকরণ অর্থাৎ সরকারী দলিল বা document এইরূপে অবিকৃত আকারে পাইয়াছি, আসল দলিলখানা হয়ত অনেক দিন হইল লোপ পাইয়াছে, এই নকল মাত্র রক্ষা পাইয়াছে। রাজ্যশাসন-পদ্ধতি, ট্যাক্স, বিচার প্রভৃতি বিভাগ সম্বন্ধে অতি অমূল্য ফৰ্ম্মান এইরূপে বাদশাহী সরকারী ইতিহাসের– বিশেষত: গুজরাতের শেষ মুঘল দেওয়ান-রচিত মিরাৎ-ই-আহমদী নামক গ্রন্থের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে পাইয়া আমরা ধন্য হইয়াছি।
আবুল-ফজল এবং বাদাউনীর তুলনা
এই শ্রেণীর গ্রন্থের প্রবর্তক শেখ আবুল-ফজল, তাঁহাকে একজন পাদ্রী “আকবরের দ্বিতীয় আত্মা” নাম দিয়াছেন। আমরা আবুল-ফজলের ধর্মমত, রাজসরকারে প্রতিপত্তি প্রভৃতির আলোচনা না করিয়া তাঁহার ঐতিহাসিক কীৰ্ত্তি অকীৰ্ত্তি আজ বিচার করিব। তাঁহার গ্রন্থগুলির মূল্য সকলেই স্বীকার করেন, কিন্তু অনেক সাহেব তাঁহাকে মিথ্যাবাদী চাটুকার বলিয়া ঘৃণার চক্ষে দেখিয়াছেন। কিন্তু বিচার করিয়া দেখা যাউক, আবুল-ফজল যে আকবরকে ভক্তি করিতেন, তাহা কি তাঁহার ভণ্ডামি, অথবা অযোগ্য রাজার প্রতি সম্মান দেখান? তাঁহার গ্রন্থগুলি ভাল করিয়া পড়িলে তিনি যে আকবরকে সত্য সত্যই মহাপুরুষ, দেবতুল্য সৰ্ব্বগুণে ভূষিত লোকপিতা বলিয়া ভক্তি করিতেন, এ বিষয়ে কাহারও সন্দেহ হইতে পারে না। আর যাঁহারা ভারত-ইতিহাস জানেন, তাঁহারাই স্বীকার করিবেন যে, আকবর দেবতুল্য রাজা ছিলেন, তিনি ভারতে এমন দুইটি জিনিষ দান করিয়াছিলেন, যাহা আর কোন মুসলমান রাজার সময়ে পাওয়া যাইত না এবং যাহা বর্তমান সভ্য শাসন-প্রণালীর চিহ্ন। সে দুইটি হইতেছে, সর্ব্বধর্ম্মের নিরপেক্ষ প্রতিপালন (সুল্হ-ই-কুল্) এবং সরকারী কাজে জাতিনিৰ্ব্বিশেষে গুণীর নিয়োগ– অর্থাৎ ইংরাজীতে বলিতে গেলে universal toleration এবং career open to talent. তাহার উপর পাঠান-যুগের শত শত বর্ষব্যাপী মারামারি, বিদ্রোহ, খুন ও অরাজকতার পর আকবর উত্তর-ভারতময় যে শান্তি স্থাপন করিলেন, তাহা অশোক ও সমুদ্রগুপ্তের পরবর্তী হাজার বৎসরে দেখা যায় নাই। এই শান্তি ও সুশাসনের ফলে দেশময় ধন ও সুখ বাড়িতে লাগিল, সাহিত্য ও কলা, কি হিন্দুদের মধ্যে, কি মুসলমানদের সমাজে, দিন দিন বিকশিত হইতে থাকিল। যে রাজার এরূপ মহান কীর্তি, তাঁহাকে ‘নরদেব’ বলিলে কি প্রাচ্য-দেশীয় প্রস্তুতি হয়, না ইংরাজ জ্ঞানী কার্লাইলের প্রশংসিত হিরো-ওয়ার্শিপ হয়? আকবর কার্লাইলের বর্ণিত হিরোদের গুণে ভূষিত ছিলেন, সুতরাং তাঁহাকে ভক্তি করা স্বাভাবিক এবং উচিত। ইসলাম ধর্ম্ম অনুসারে পাদিশাহ একাধারে পোপ এবং সম্রাটের পদস্থ, তিনি জীবন্ত খলিফা অর্থাৎ ঈশ্বরের প্রেরিত পুরুষের উত্তরাধিকারী, সুতরাং প্রত্যেক মুসলমানের পূজার যোগ্য। তাঁহার উপাধি কিলা ও কাবা, ঈশ্বরের ছায়া, পীর ও মুর্শিদ। তবে স্বীকার করি যে, অলঙ্কারের ছটায় এবং অত্যুক্তির ফলে স্থানে স্থানে আবুল ফজলের লেখা পাঠকের বিতৃষ্ণা জন্মায়, এবং তিনি যে সব ভাল কাজই নিজ প্রভুর উপর আরোপ করিয়াছেন, তাহা কখন কখন অসত্য।
আবুল-ফজলের ইতিহাসের সর্ব্বাপেক্ষা গুরুতর দোষ তাঁহার ভাষার ভঙ্গিমা। একজন সাহেব রহস্য করিয়া বলিয়াছেন যে, মানবকে ভগবান ভাষা দিয়াছেন মনের ভাব গোপন করিবার জন্য। আবুল-ফজল এমন রচনা-পদ্ধতি ও শব্দবিন্যাস অবলম্বন করিয়াছেন, যাহাতে তাঁহার লেখার অর্থ বুঝা বিশেষ কষ্টকর৷ একটি মাত্র উপমা লইয়া তাহার শত বিভিন্ন আংশিক আকার ধরিয়া লম্বা লম্বা পৃষ্ঠা ভরিয়া একটি মাত্র বাক্য (sentence)। এই মুদ্রাদোষটি তিনি আমির খর রচনা হইতে পান; কিন্তু আমির খরু কবি ছিলেন, তাঁহার পক্ষে এটা তত দোষাবহ ছিল না। কিন্তু যখন এই অদ্ভুত অস্বাভাবিক লেখার ভঙ্গিমা শিয়াবুদ্দীন তালিশ মিরজুমলার কুচবিহার ও আসাম জয় নামক গ্রন্থে অনুকরণ করিলেন, তখন সেটা পাঠকের অসহ্য কষ্টকর হইল। যাহা হউক, আবুল-ফজলের গ্রন্থে আমরা অমূল্য ঐতিহাসিক তথ্য পাই, ইহার ঘটনাগুলি অতি সত্য ও বিচিত্র।
এই সংশ্রবে তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বী লেখক আবদুল কাদির বাদাউনীর আলোচনা করা আবশ্যক। সাহেবেরা এই ঐতিহাসিকের গ্রন্থকে অযথা মাথায় তুলিয়াছেন, বোধহয় আবুল ফজলের প্রতি বিরাগের ফলে। প্ৰথমত : ঐতিহাসিক তথ্যের দিক দিয়া দেখিলে, বাদাউনীর গ্রন্থে ঘটনা অনেক কম এবং তিনি সরকারী দপ্তরখানার সাহায্য না পাওয়াতে অনেক ঘটনার গুজব ও মিথ্যা বর্ণনা লিখিয়াছেন। তিনি রাজদরবারে বড় কম সময় ছিলেন, সুতরাং বড় বড় কর্ম্মচারীর মুখে তাহাদের দৃষ্ট ঘটনার কাহিনী শুনিবার সুবিধাও পান নাই। তাহার পর তাঁহার চরিত্র আলোচনা করা যাউক। তাঁহার গ্রন্থের ছত্রে ছত্রে আবুল-ফজলের এবং আবুল ফজলের পিতা (বাদাউনীর শিক্ষক!!!) শেখ মুবারকের প্রতি ঈর্ষা ও দ্বেষ প্রকাশ পাইয়াছে। উহারা এত টাকা ও উচ্চ পদ পাইল, আমি পাইলাম না, হা খোদা, এই তোমার ন্যায়বিচার? এইরূপ কাঁদুনি পড়িয়া হাসিও আসে, কান্নাও পায়। আবুল-ফজল-পরিবার এবং আকবর সম্বন্ধে যেখানে যত নিন্দার গল্প-গুজব শুনিয়াছেন, বাদাউনী তাহা নির্বিচারে নিজ গ্রন্থে স্থান দিয়াছেন। এইরূপ করিবার ফলে তাঁহার গ্রন্থ অনেক স্থলে আপনা হইতেই বিশ্বাসের অযোগ্য প্রতিপন্ন হয়। বইখানির উপর ধর্ম্মের নামাবলী চাপাইয়া দিবার চেষ্টা করা হইয়াছে; পদে পদে কোরান হইতে বচন তোলা, ইসলাম নষ্ট হইল বলিয়া চীৎকার, আমিই সাত্ত্বিক সুন্নী বলিয়া আস্ফালন, এই ভঙ্গিমাগুলি পড়িয়া বাদাউনীকে ধৰ্ম্মধ্বজী ভণ্ড বলিতে হয়। আর তিনি নিজেই স্বীকার করিয়াছেন যে, মকনপুর গ্রামে শাহ্ মদার নামক পীরের পবিত্র সমাধি-মন্দিরে একটি স্ত্রীলোক-যাত্রীর ধর্ম্মনাশ করিবার চেষ্টা করেন এবং তাহার ফলে প্রেয়সীর আত্মীয়গণ তাঁহাকে মারিয়া মাথা ফাটাইয়া দেয়! অথচ তখন তিনি সেই জেলার দেওয়ানী জজের পদে প্রতিষ্ঠিত। (মূল, ২ ভা, ১৩৬-১৩৭ পৃষ্ঠা)। সুতরাং বাদাউনীর কথাগুলি চোখ বুজিয়া গ্রহণ করা যায় না; ইতিহাসের তত্ত্ব যে “নিহিতং গুহায়াং” এ ক্ষেত্রে সে কথা খাটে।
এই সরকারী ইতিহাসগুলি প্রায় আড়াই-শ বৎসরের ধারাবাহিক কাহিনী দেয়, কেহ কম, কেহ বেশী বিস্তৃতভাবে। ইহার মধ্যে বাবর এবং জাহাঙ্গীর-লিখিত আত্মকাহিনী এবং হুমায়ুনের চাকর জৌহর-রচিত সেই বাদশাহের রাজত্ব-কাহিনীও ধরিতে হইবে। সুদীর্ঘ এবং রীতিমত সরকারী ইতিহাস আকবর হইতে আরম্ভ–
১. আকবরনামা, ৩ খণ্ডে, আবুল ফজল রচিত এবং তাঁহার খুনের পর সরহিন্দী কর্তৃক শেষ চারি বৎসরের বৃত্তান্ত লিখিয়া সম্পূর্ণ করা হয়। (2) জাহাঙ্গীরের আত্মকাহিনী ও তাঁহার জীবনের শেষ দুই বৎসরের জন্য হাদি কর্তৃক রচিত পরিশিষ্ট। (৩) শাহজাহানের ৩১ বৎসর রাজত্ব লিখিয়া গিয়াছেন, আবদুল হামিদ লাহোরী ১-২০ বৎসর, ওয়ারিস্ ২১-৩০ বৎসর এবং সালিহ্ কাম্বু ৩১ বৎসর ও কয়েক মাস। আওরংজীবের প্রথম দশ বৎসরের অতি বিস্তৃত ইতিহাস তাঁহার আজ্ঞায় কাজিম্ কর্তৃক লিখিত, ১১০০ পৃষ্ঠায় মুদ্রিত; এবং সমস্ত ৫১ বৎসরব্যাপী রাজত্বের সংক্ষিপ্ত, কিন্তু সরকারী কাগজ দেখিয়া লেখা মাসির-ই-আলমগীরী, ৫৪১ পৃষ্ঠা (সাকী মুস্তাদ খাঁ-রচিত)। তাহার পর প্রথম বাহাদুর শাহ্রম অতি দীর্ঘ ‘নামা” দুই বৎসরের মাত্র (ন্যামৎ খাঁ আলীর রচনা)- ফখসিয়রের অপেক্ষাকৃত সংক্ষিপ্ত ইতিহাস– মুহম্মদ শাহের (রাজত্ব ১৭১৯-১৭৪৮) ঐতিহাসিক তাঁহার “দুধ-ভাই” অর্থাৎ ধাতৃপুত্র মুহম্মদ বখ্শ্ (ছদ্মনাম আশোব), কিন্তু অনেক পরে, ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে, একজন সাহেবের জন্য রচিত। এই বাদশাহের ঠিক পরবর্ত্তী দুই উত্তরাধিকারী আহমদ এবং দ্বিতীয় আলমগীর (১৭৪৮-১৭৫৯) সম্বন্ধে মাস, তারিখ দেওয়া ধারাবাহিক দুখানি “নামা” স্যর হেনরি এলিয়ট্ সংগ্রহ করেন, তাহা এক্ষণে ব্রিটিশ মিউজিয়মে স্থান পাইয়াছে; আর কোথাও পাওয়া যায় না। তারপর দ্বিতীয় শাহ্ আলম পুত্তলিকা মাত্র ছিলেন, তাঁহার সাম্রাজ্য লোপ পাইয়াছিল, সুতরাং তাঁহার জন্য ঐরূপ ইতিহাস রচিত হয় নাই; তবে মুনালাল প্রভৃতি কেরাণীরা দুই তিনটি সংক্ষিপ্তসার লিখিয়া গিয়াছে, সেগুলি “নামা” নহে।
অপর সব শ্রেণীর ইতিহাস
দ্বিতীয় বিভাগের ইতিহাস। এই শ্রেণীতে তিনজন অতি উৎকৃষ্ট ঐতিহাসিক আছেন, বখশী নিজামুদ্দীন আহমদ, ফিরিশ্তা এবং খাফি খাঁ। ইহাদের যেমন বিষয় বিন্যাসে দক্ষতা, সরল অথচ মনোরম ভাষা, অত্যুক্তি এবং বাজে কথা পরিত্যাগ, তেমনি নানা গ্রন্থ খুঁজিয়া এবং নানা কর্মীকে জিজ্ঞাসা করিয়া ঘটনার সত্য মিথ্যা নির্দ্ধারণ করিবার অক্লান্ত চেষ্টা। আর এই তিনখানি গ্রন্থেই ভারতের মুসলমান-যুগের সমগ্র ইতিহাস দেওয়া হইয়াছে, দিল্লীর সুলতান ও বাদশাহদের কাহিনীর সহিত প্রাদেশিক মুসলমান রাজ্যগুলির ইতিহাস (সংক্ষেপে) লিখিত আছে। নিজামুদ্দীন এই দৃষ্টান্তটি দিয়া যান; পরবর্তী পারসিক লেখকেরা তাঁহার অনুসরণ করিয়াছেন মাত্র, এবং নেহাবন্দী, বাদাউনী ও ফিরিশ্তা স্বীকার করিয়া তাঁহার কাহিনী হুবহু চুরি করিয়াছেন। ফলত: এই গ্রন্থখানি অমূল্য। তেমনি দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলি সম্বন্ধে ফিরিশ্তার ইতিহাস অমূল্য; কারণ, তিনি তথাকার লোক এবং নিজামুদ্দীনের বিশ বৎসর পরে লেখেন, তিনি অনেক দক্ষিণী ঐতিহাসিক উপকরণ পান, যাহা নিজামুদ্দীনের হাতে আসে নাই। ফিরিতার ইতিহাস ১৬১৫ সালে শেষ হইয়াছে, খাফি খাঁর ১৭২৬ সালে (নামত: ১৭৩৪ এ)। খাফি খাঁর দাক্ষিণাত্য সম্বন্ধে অংশটি (৩য় ভল্যুম) কোন কাজের নহে; তাঁহার গ্রন্থের ২য় বালুম খুব মূল্যবান; কারণ, ইহাতে আওরংজীব এবং তাঁহার বংশধরদের বিবরণ আছে, যাঁহারা খাফি খাঁর অনেকটা সমসাময়িক ছিলেন, অর্থাৎ ১৬৮০ হইতে ১৭২৬ পর্যন্ত প্রায় সব ঘটনাই এই লেখকের দৃষ্ট অথবা জ্ঞাত। তবে এখানে সাবধান করিয়া দেওয়া উচিত যে, এই শেষ অংশেও খাফি খাঁর কথা চোখ বুজিয়া বিশ্বাস করিলে চলিবে না; কারণ তিনি সরকারী দলিল বা আারাৎ (সংবাদ-পত্র) একখানিও পান নাই, এমন কি, আওরংজীবের সরকারী সম্পূর্ণ ইতিহাস (‘মাসির’, ১৭১১ তে লিখিত) পর্যন্ত দেখেন নাই। খাফি খাঁকে প্রায় সৰ্ব্বত্রই সংশোধন করাই ঐ যুগের বর্তমান ঐতিহাসিক গবেষণার কর্তব্য কৰ্ম্ম হইয়া দাঁড়াইয়াছে এবং এই সংশোধনের জন্য অপর পারসিক ও মারাঠী ভাষার উপকরণও প্রচুর পাওয়া যাইতেছে। ছোট ছোট অথবা সঙ্কলন মাত্র গ্রন্থের নাম করিব না।
তৃতীয় বিভাগ-কর্মচারীদের জীবনীর অংশ অথবা দিন-লিপি (ডায়েরি)। এগুলি অমূল্য প্রাথমিক মসলা, যদিও ইহাদের দৌড় বড় কম। এই শ্রেণীতে নেহাবন্দী-রচিত খাঁ-খানান্ আবদুর রহিম্-এর (সেনাপতি ও হিন্দী-ফার্সী কবির) জীবনী, মির্জা নাখনের কীর্তি-কাহিনী বহারিস্তান-ই-ঘাইবী, কার্যত : বাঙ্গালা প্রদেশের জাহাঙ্গীরের রাজ্যকাল ব্যাপিয়া অতি বিস্তৃত মৌলিক এবং একমেবাদ্বিতীয়ম্ ইতিহাস, শিহাবুদ্দীন তালিশ-লিখিত মিরজুমলার কুচবিহার ও আসাম জয় এবং শায়েস্তা খাঁ কর্তৃক চাটগাঁ অধিকার প্রভৃতি। যাঁহারা এগুলির অনুবাদ এবং সংক্ষিপ্তসার পর্যন্ত পড়িয়াছেন, তাঁহারাই ইহার মূল্য বুঝেন, এগুলি বর্তমানের আবিষ্কার।
সমসাময়িক পারসিক চিঠি এবং সংবাদপত্র
চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণী– চিঠি এবং হস্তলিখিত সংবাদ-পত্র (আখারাৎ)। এগুলি তৃতীয় বিভাগের গ্রন্থগুলি অপেক্ষাও অধিকতর মৌলিক ও মূল্যবান উপকরণ, ফলত: আমি সৰ্ব্বদাই এগুলিকে ভারত-ইতিহাসের আদি মসলা (raw materials of Indian History) বলিয়া বর্ণনা করিয়া থাকি।
আকবরের রাজ্যকাল হইতে আরম্ভ করিয়া ব্রিটিশ অধিকার পর্যন্ত পারসিক ভাষায় অসংখ্য ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের চিঠি-রাজপুতানায় অতি কম হিন্দী বা রাজস্থানী ভাষায় পত্র, এবং মহারাষ্ট্রে মারাঠী ভাষায় লিখিত হাজার হাজার চিঠি ও রিপোর্ট (অধিকাংশ ১৭১৫ সালের পরবর্তী) রক্ষা পাইয়াছে, এবং বোধ হয় তাহার পাঁচ ছয় গুণ সামগ্রী কালের প্রকোপে ধ্বংস হইয়াছে। আজ শুধু মুঘল যুগের প্রথম দেড়-শ বৎসরের (অর্থাৎ আওরংজীবের মৃত্যু পর্যন্ত) রচিত পারসিক ভাষার পত্রগুলির কথা বলিব। প্রত্যেক বাদশাহ এবং ছোট বড় কর্মচারী ও রাজা-নবাব-জমিদারের পত্র লিখিবার জন্য মুনশী অর্থাৎ সেক্রেটারি থাকিত। পত্রগুলি পারসিক ভাষায় রচিত হইত, এবং এই মুন্শীরা অধিকাংশই হিন্দু (কায়েৎ অথবা ক্ষেত্রী)। এমনকি, ডি বয়ে, পেরোঁ প্রভৃতি ফরাসী সেনাপতিও পারসিক মুনশীর দ্বারা বাদশাহী দরবার ও দেশী রাজাদের সঙ্গে কথাবার্তা চালাইতেন। এই মুনশীগুলি সযত্নে পারসিক রচনা শিখিয়া, যথাসাধ্য উৎকৃষ্ট, উপযুক্ত এবং ‘ফুল্ল-কুসুমিত’ শব্দ প্রয়োগ করিতেন, আর সেইসব পত্র-রচনার নকল রাখিতেন, যেমন আজকাল সব অফিসে ও জমিদারীতে লেটার-বুক থাকে। এই পত্রগুলি মুনশী মহাশয়দের সাহিত্যিক রচনা হিসাবে গর্ব্বের বস্তু হইত; তাঁহারা (অথবা তাঁহাদের মৃত্যুর পর তাঁহাদের পুত্রগণ) ঐ পত্রগুলি একত্র গুছাইয়া সাজাইয়া, ভূমিকা যোগ করিয়া দিয়া শিক্ষিত জগতে প্রচারিত করিতেন, ইহা তাঁহাদের স্মৃতিচিহ্ন থাকিবে বলিয়া। এইরূপে অনেক সরকারী ও অন্য ঐতিহাসিক পত্র রক্ষা পাইয়াছে– নকলের দ্বারা; কারণ, আসল সীল-পাঞ্জা-মার্কা পত্রগুলি আলাহিদা থাকায় সব লোপ পাইয়াছে। পারসিক ভাষায় রচিত ঐতিহাসিক চিঠির ভাণ্ডার যে কত বিচিত্র ও বিপুল, তাহা আমার লিখিত Studies in Aurangzib’s Reign নামক গ্রন্থের এক অধ্যায়ে এবং Cambridge History of India, Vol IV Chapter 8 & 10-এর গ্রন্থপঞ্জী পড়িলে বুঝিতে পারিবেন।
আর, রাজদরবার, প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের কাছারী এবং সেনাপতিদের শিবির হইতে প্রতি সপ্তাহে বা মাসে হাতে-লেখা খবরের কাগজ প্রেরিত হইত; ইহার নাম ওয়াকেয়া, পরে আবারাৎ। ১৬৫৮ সাল হইতে ইহার অনেকগুলি পাওয়া গিয়াছে তাহার পূর্ব্বেকারগুলি সব ধ্বংস হইয়াছে। এগুলি অমূল্য এবং সর্ব্বোচ্চ শ্রেণীর মৌলিক উপাদান। ইহার সাহায্যে বড় বড় এবং প্রসিদ্ধ ইতিহাসও সংশোধন করা যায়, তাহার দৃষ্টান্ত আমার রচিত আওরংজীব, শিবাজী, মুঘল সাম্রাজ্যের পতন প্রভৃতি গ্রন্থে দেখিতে পাইবেন।
ইউরোপীয় ভ্রমণকারিগণ
এ পর্যন্ত পারসিক ঐতিহাসিক গ্রন্থের ও মসলার কথা বলিলাম। এখন সপ্তম বিভাগ অর্থাৎ ইউরোপীয় ভাষায় রচিত তৎকালীন বিবরণ ও রিপোর্টের কথা বলিয়া শেষ করিব। এই শ্রেণীর উপাদানগুলিকে সাহেবেরা অযথা মূল্য দিয়া থাকেন। আমি স্বীকার করি যে, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা, প্রজাদের সুখদুঃখ, রাস্তাঘাট, শিল্পবাণিজ্য প্রভৃতি সম্বন্ধে এবং ভারতীয় শাসন-পদ্ধতি ও সমাজের সমালোচনায় এই বিদেশী সাক্ষীগুলির কথা আমাদের জ্ঞানের ক্ষেত্রে এক মহা অভাব পূরণ করে। কিন্তু ঐতিহাসিক ঘটনা ধরিলে এই ভ্রমণ-কাহিনী ও রিপোর্ট অনেক সময় বিশ্বাসের অযোগ্য, গুজবের উপর নির্ম্মিত অথবা ভাসাভাসা মামুলী কথামাত্র। সে যুগে বিদেশী ভ্রমণকারী ও পাদ্রীগণ পারসিক ভাষায় লেখাপড়া করিতে জানিতেন না, কোন রকমে উর্দুর সাহায্যে কথাবাৰ্ত্তা চালাইতেন, সুতরাং তাঁহারা পারসিক ভাষায় লিখিত সরকারী কাগজ বা গ্রন্থ ও পত্রাদির জ্ঞান হইতে বঞ্চিত ছিলেন। এজন্য ফাদার মসেরাট্ এবং মানুচী পর্যন্ত হাস্যকর ভুল করিয়া গিয়াছেন, যাহাতে বুঝা যায় যে, তাঁহাদের পারসিক ভাষার জ্ঞান কর্ণের দ্বারা প্রাপ্ত, চক্ষুর দ্বারা নহে। আবার এই সব সাহেবদের মধ্যে অনেকে ভারতে অতি অল্পদিন মাত্র কাটাইয়াছিলেন, আর কেহ কেহ ছোট নগণ্য মফস্বল শহরে বাস করিতেন; কাজে কাজেই সত্য সংবাদের মূল কেন্দ্র অর্থাৎ রাজসভা ও সেনাপতির শিবির হইতে দূরে থাকায় প্রকৃত তথ্য শুনিতে পান নাই।*
[সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা, ৪৫ বর্ষ, সংখ্যা ২, ১৩৪৫।]
* বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষদে প্রদত্ত অধরচন্দ্র মুখোপাধ্যায় বক্তৃতামালার দ্বিতীয় বক্তৃতা ৷