মাহে নও ও আবদুল কাদির
শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানকে চেনা কঠিন। সে কোন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কোন রূপ ধারণ করবে, তা বিধাতার পক্ষেও বলা অসম্ভব। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাঙালি মুসলমান কবি-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এমন এক বুদ্ধিবিভ্রাট দেখা দেয়, যা কোনো কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন ও সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের কাছ থেকে প্রত্যাশিত নয়।
পাকিস্তান রাষ্ট্র ও ধর্ম ইসলামকে যদি মুসলিম লীগের শাসক ও নেতাই শুধু একাকার করে ফেলতেন, তা হতো এক কথা; কিন্তু কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের উৎসাহ ও তৎপরতা ছিল আরও বেশি। প্রায় সব খ্যাতিমান কবি লেখকই পাকিস্তানবাদে এবং ‘পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদে’ আপ্লুত হয়ে পড়েন। জাতীয়তায় তাঁরা যে বাঙালি, তা বেমালুম ভুলে যান বা অস্বীকার করেন। নাগরিকত্ব ও জাতীয়তা দুই জিনিস তা গুলিয়ে ফেলেন।
১৯৭২-এর জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশের মূলধারার কবি-সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীরা সমস্বরে বলতে থাকেন যে তাঁরা ‘৪৭ থেকে ‘৭১ পর্যন্ত একটি মারাত্মক অধ্যায় পেরিয়ে এসেছেন। জাতির জীবনে শুধু নয়, তাঁদের নিজেদের জীবনে তা ছিল এক ‘দুঃসময়’। সে এক দুঃস্বপ্নের কাল। কেউ কেউ ওই সময়কে তুলনা করেছেন ‘জাহান্নাম’-এর সঙ্গে। জাহান্নাম হলো সবচেয়ে ভয়ংকর নরক। কিন্তু পরিহাসের বিষয় এই যে, যাদের জন্ম ১৯৩০-এর দশকে, তারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরই শিক্ষাজীবন শেষ করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। সম্ভবপর সরকারি আনুকূল্য থেকে বঞ্চিত ছিলেন না। অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সরকারি বা আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। তাঁদের যথারীতি পদোন্নতি হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানের নগর-বন্দরে ঘুরে অপার আনন্দ পেয়েছেন। অর্থাৎ, জীবনের সব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন। এবং তা করেছেন প্রধানত সামরিক শাসনের মধ্যে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ঢাকাকেন্দ্রিক বাংলা সাহিত্য চর্চার একটি সুযোগ আসে। কিন্তু প্রধান কবি-সাহিত্যিকদের অনেকেই ঢাকার চেয়ে করাচি ও লাহোরের দিকে ছোটাকেই আত্ম-উন্নতির উপায় বলে মনে করেন। একটি প্রদেশের মানুষের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি যতটা আনুগত্য প্রদর্শন করা উচিত, তারা তার চেয়ে বহুগুণ বেশি আনুগত্য দেখান। অনেকের আচরণে প্রকাশ পায় দাস্য মনোভাবের।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ও উদ্যোগে যে মাসিক সাহিত্যপত্রিকাটি প্রকাশিত হয় তার নাম মাহে নও। সাময়িকীটির প্রথম সংখ্যা বের হয় এপ্রিল ১৯৪৯ সালে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দেড় বছর পর। প্রতিষ্ঠাকালে এর সম্পাদক ছিলেন আবদুর রশিদ নামের কেউ। মাহে নও-এর প্রধান কার্যালয় ছিল করাচি। মাহে নও নামে উর্দু মাসিকও ছিল। বাংলা মাহে নও-এর কার্যালয় ছিল ঢাকায়। সদ্য স্বাধীন একটি রাষ্ট্রে সরকারি অর্থে একটি সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশের উদ্যোগ ছিল প্রশংসনীয়।
মাহে নও-এর প্রথম সংখ্যায় ‘আমাদের কথা’ শীর্ষক সম্পাদকীয় থেকে জানা যায় :
‘… মামুলি প্রপাগাণ্ডা ইহার উদ্দেশ্য নহে। ইহার আদর্শ পাকিস্তানের তাহজীব তামাদুন। ইহার উদ্দেশ্য দেশের প্রধান সাহিত্যিকদিগকে কদর দেয়া ও নয়া আজাদীর আবহাওয়ায় পরিপুষ্ট নবীন লেখক-লেখিকা সৃষ্টি করা। …. মাশরেকী ও মাগরেবী পাকিস্তানের মধ্যে বিরাট ব্যবধান দূরত্বের মাপকাঠিতে। আদর্শ ও ভাবরাজ্যে কোনো ব্যবধান আছে বলিয়া আজ আর মনে করা যায় না। তাই একাংশের চিন্তাধারা অপর অংশে পরিবেশন করিতে হইবে।
সরকারি পত্রিকায় অবশ্যই সরকারি নীতিরই প্রতিফলন ঘটবে। দেশের দুই অংশের মধ্যে সংহতির সৃষ্টি হোক –সে কামনা থাকাও খুবই স্বাভাবিক। মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে মুসলিম সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য গুরুত্ব পাবে, সেটাও প্রত্যাশিত ও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু বাঙালির যে হাজার বছরের হিন্দু-মুসলমানের সমন্বিত সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রয়েছে, তাকে অবহেলা করা আত্মহত্যার শামিল। বাংলাদেশের শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই জানত পাকিস্তানের দুটি অংশ– পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। পূর্ব বাংলার কেউই পূর্ব পাকিস্তানকে ‘মাশরেকি’ পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানকে ‘মাগরেবি’ পাকিস্তান বলত না। এই শব্দ দুটি ছিল ৯৯ ভাগ বাঙালির কাছে অপরিচিত।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই অগণতান্ত্রিক মনোভাব থেকে শাসকেরা ঘোষণা দেন, দেশের ৫৬ ভাগ মানুষের ভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা হবে। ওই স্বৈরাচারী ঘোষণার বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার কবি-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা প্রতিবাদ করেননি, প্রতিবাদ প্রথমে করেছেন প্রাদেশিক সেক্রেটারিয়েটের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। প্রতিষ্ঠিত ও খ্যাতিমান কবি-লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা সরকারি সুবিধা ও নেকনজর হারানোর ঝুঁকি নেননি।
চল্লিশের দশক পর্যন্ত বাঙালি মুসলমান লেখকেরা মানসম্পন্ন বিশুদ্ধ বাংলায় সাহিত্যচর্চা করেছেন। কেউ কেউ আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করেছেন তাঁদের কবিতায়, কিন্তু তা সাধারণ মুসলমান পাঠকদেরও প্রশ্রয় পায়নি। মুসলমান লেখকদের গদ্যে– গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধে– আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার বিরল। কিন্তু সাতচল্লিশের পরে গায়ের জোরে আরবি-উর্দুশব্দ ব্যবহারের প্রবণতা দেখা দেয়। মাহে নও-এর সম্পাদকীয়তে ইংরেজি কালচার অর্থে সংস্কৃতি না লিখে লেখা হলো ‘তাহজিব তামান’। এই পদ দুটির অর্থ শিক্ষিত বাঙালির কাছেও পরিষ্কার নয়। পূর্ববঙ্গকে নতুন নাম পূর্ব পাকিস্তান’ বললেও (সরকারি কাগজপত্রেও পূর্ববঙ্গ সরকার বলা হতো) একজন মানুষও মাশরেকি পাকিস্তান বলত না। স্বাধীনতা অর্থে আজাদি মেনে নেওয়া যায়। যা হোক, একটি মানসম্মত সাহিত্যপত্রিকার প্রয়োজন ছিল। কারণ, তখন ঢাকায় কোনো উন্নতমানের নিয়মিত সাহিত্য পত্রিকা ছিল না। কলকাতার হিন্দুদের পত্রিকায় মুসলমান লেখকেরা স্থান পেতেন না। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবির প্রতি মুসলমান লেখক-বুদ্ধিজীবীদের সমর্থনের সেটাও ছিল একটি কারণ।
কেন্দ্রীয় সরকার মাহে নও নামে উর্দু ও বাংলা সাময়িকী প্রকাশ না করে, যা করতে পারত তা হলো, উর্দুটির নাম মাহে নও এবং ঢাকা থেকে প্রকাশিত বাংলা মাসিকটির বাংলা শব্দে নামকরণ। তা জাতীয় সংহতির পথে কোনো বাধা হতো না, মাহে নও-এর বাংলা নামকরণ হতে পারেনি দাস্যমনোবৃত্তিসম্পন্ন বাঙালি লেখকদের ব্যক্তিত্বহীনতার কারণে। তারা শুরুতে নিজের থেকেই পশ্চিমাদের প্রভুত্ব মেনে নেন।
মাহে নও-এর প্রথম সংখ্যায় যাদের যেসব লেখা ছিল, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য : শওকত ওসমানের গল্প (প্রথম প্রণতি), আশরাফ উজ্জামানের গল্প (আলেয়ার আলো), বেনজীর আহমদের কবিতা (দিগন্ত), আশরাফ সিদ্দিকীর কবিতা (সন্ধ্যার পাখি) এবং হাবীবুল্লাহ বাহারের প্রবন্ধ। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, উর্দুভাষী মুখ্যমন্ত্রী স্যার খাজা নাজিমুদ্দীনের একটি প্রবন্ধ ছিল, যার শিরোনাম ‘কায়েদে আজম রহমতুল্লাহ আলাইহে’। রহমতুল্লাহ আলাইহে কথাটির আক্ষরিক অর্থ আল্লাহর রহমত তাঁর ওপর বর্ষিত হোক। কিন্তু সাধারণ রেওয়াজ বা ভাবার্থ হলো এই সম্মান শুধু পয়গম্বর ও পীর-আউলিয়াদের সম্পর্কে প্রযোজ্য। রাজনৈতিক নেতা মুহম্মদ আলী জিন্নাহ সম্পর্কে এ অভিধা একেবারেই অপপ্রয়োেগ ও স্রেফ স্তাবকতা। জিন্নাহকে চল্লিশের দশকে কোনো কোনো লীগপন্থী পত্রিকা ‘আমিরে মিল্লাত’ অভিধায় আখ্যায়িত করেছে। উপমহাদেশের অধিকাংশ মুসলমানের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে জিন্নাহকে ‘কায়েদে আজম’ সম্বোধন করা হতো। মহাত্মা গান্ধীও তাঁকে কায়েদে আজম সম্বোধন করেছেন। তবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তাঁর স্তাবকের সংখ্যা পূর্ববঙ্গে সীমা ছাড়িয়ে যায়। তাঁর নিবেদিত প্রশস্তিমূলক কবিতা, প্রবন্ধ, নাটকের পরিমাণ বিপুল। লেখালেখির বিষয়বস্তু হিসেবে অবশ্যই তিনি গুরুত্বপূর্ণ, তা না হলে ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা যশোবন্ত সিনহা তাঁকে নিয়ে বড় বই লিখতেন না। সুকান্ত ভট্টাচার্যও জিন্নাহকে নিয়ে লিখেছেন কবিতা।
যা হোক, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রচার বিভাগের পত্রিকা হলেও মাহে নও-এর মান ছিল উঁচু। সে সময় আধুনিক লেখকের সংখ্যাও ছিল কম। অল্প কিছু প্রপাগান্ডামূলক প্রবন্ধ-নিবন্ধ থাকত বটে, মাহে নওর অধিকাংশ লেখাই ছিল উন্নত মানের। বিশেষ করে, ১৯৫২-তে যখন কবি ও প্রাবন্ধিক আবদুল কাদির মাহে নও-এর সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন থেকে মাহে নও বাংলা ভাষার একটি প্রথম শ্রেণির সাহিত্যপত্রিকা হিসেবেই প্রকাশিত হতে থাকে। উন্নতমানের কাগজে ছাপা হতো নির্ভুল। পত্রিকাটি ছিল সচিত্র। মুসলমান শিল্পীদের আঁকা পেইন্টিং থাকত দু-চারটি প্রতিটি সংখ্যায়। একেবারে মাসের প্রথম দিনই মাহে নও স্টলে পাওয়া যেত। মাহে। নও-এর অনেক বহুরঙা প্রচ্ছদ করেছেন জয়নুল আবেদিন। পাকিস্তান না হলে তিনি বা তাঁর মতো মুসলমান শিল্পীরা কলকাতায় এই সুযোগ পেতেন না।
দীর্ঘদিন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মাহে নও সম্পাদনা করেছেন আবদুল কাদির। কবি হিসেবেই ছিল তাঁর খ্যাতি। পরে খ্যাতি অর্জন করেন গবেষক হিসেবে।
আবদুল কাদির যখন ঢাকা কলেজের ছাত্র, তখন তিনি মুসলিম সাহিত্য সমাজ’র আবুল হুসেন, কাজী আবদুল অদুদ, কাজী আনোয়ারুল কাদির প্রমুখ প্রগতিশীল লেখকের সংস্পর্শে আসেন। বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে পরিচিতি পান। ওই সময় কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর পরিচয় এবং তার একজন প্রীতিভাজনে পরিণত হন। কবিতা লিখতেন এবং গদ্যচর্চাও করতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষ বিএ ক্লাসের ছাত্র থাকা অবস্থায় মুসলিম হলের ম্যাগাজিন সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তারপর পড়ালেখা অসমাপ্ত রেখে সাহিত্যচর্চার নেশায় কলকাতা যান এবং মুহম্মদ নাসিরউদ্দিনের সওগাত যোগ দেন সহ-সম্পাদক হিসেবে। সাহিত্য-সাময়িকী সম্পাদনায় তাঁর আগ্রহ ছিল তরুণ বয়স থেকেই। ১৯৩৭ সালে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সাহিত্যকাগজ জয়তী। সেটি ছিল একটি প্রগতিশীল সাহিত্য-সাময়িকী। প্রতিষ্ঠিত লেখকেরা তাতে লিখতেন। নজরুল ইসলাম ও আবুল মনসুর আহমদ সম্পাদিত দৈনিক নবযুগ এ তিনি সাময়িকী বিভাগে কিছুদিন কাজ করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন। কবি হিসেবে তখন তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত। তাঁর ছন্দজ্ঞান অতি প্রখর। এ জন্যে তাঁকে একসময় বলা হতো ‘ছান্দসিক কবি’। পত্রিকা সম্পাদনা ও গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে তাঁর কাব্যচর্চা ব্যাহত হয়েছে।
সম্পাদক হিসেবে আবদুল কাদিরের নিষ্ঠা ও দক্ষতা ছিল প্রশ্নাতীত। সাহিত্যপত্রিকা সম্পাদনার অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর দীর্ঘকালের। তিনি মুসলিম সাহিত্যসমাজের মুখপত্র, শিখা সম্পাদনা করেছেন বিশের দশকে। সম্পাদক হিসেবে তিনি ছিলেন খুবই কঠোর। আবদুল কাদিরের পর তারই সহকারী কবি তালিম হোসেন মাহে নও-এর সম্পাদক হন। তিনিও দক্ষ সম্পাদক ছিলেন। তাঁর। সহকারী ছিলেন প্রাবন্ধিক শাহাবুদ্দিন আহমদ।
শুধু সাহিত্যপত্রিকা সম্পাদনানয়, আবদুল কাদির গ্রন্থ সম্পাদনায়ও ছিলেন খুবই নিষ্ঠাবান। নজরুল রচনাবলী সম্পাদনা তাঁর হাত দিয়েই শুরু। তাঁর সহযোগিতা ছাড়া নজরুল রচনাবলী সংগ্রহ করা কঠিন হতে বাংলাভাগের পর। নজরুল ছাড়াও তিনি সম্পাদনা করেছেন বেগম রোকেয়া রচনাবলী, ইসমাইল হোসেন শিরাজী রচনাবলী, লুৎফর রহমান রচনাবলী, ইয়াকুব আলী চৌধুরী রচনাবলী এবং আবুল হুসেন রচনাবলী। এই সম্পাদনার কাজটি যে বাংলা সাহিত্যের কত উপকার করেছে, তা যে কেউ উপলব্ধি করবেন।
একটি কথা প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার। আজ নজরুলকে নিয়ে নানা রকম গবেষণা হচ্ছে। আবদুল কাদির নজরুলের লেখা সংগ্রহ ও সম্পাদনা না করলে নজরুল গবেষণা পরবর্তী গবেষকদের জন্য দুরূহ হতো। এই প্রসঙ্গে তালিম হোসেনের নামটি না নিলে ঘোরতর অন্যায় হবে। তাঁর সম্পাদিত নজরুল একাডেমী পত্রিকা নজরুল গবেষণার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। প্রত্যেক নজরুলগবেষক আবদুল কাদির এবং তালিম হোসেনের কাছে অপরিশোধ্য ঋণের দায়ে আবদ্ধ। নজরুলচর্চায় নজরুল একাডেমীর ভূমিকা তুলনাহীন।
ষাটের দশকে আবদুল কাদির কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের প্রকাশনা কর্মকর্তা ছিলেন, তাঁর পরিচালক ছিলেন মুহম্মদ এনামুল হক। তার অফিস ছিল গ্রিন রোডে (ঢাকা) এক বাড়িতে। আমরা যেতাম তার অফিসে, দেখতাম তিনি সারাক্ষণ কাজ করছেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকেই আমাদের সঙ্গে কথা বলতেন। তাঁর কাছে জানা যেত তিরিশ ও চল্লিশের দশকের বহুগুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
প্রচুর পড়াশোনা করতেন আবদুল কাদির। শেষ করলেও পড়াশোনা ছাড়া তিনি সময় নষ্ট করতেন না। স্বাধীনতার পর সত্তরের দশকে তিনি মাঝে মাঝে নিউ মার্কেটে আসতেন। বইপাড়ার কোনো বইয়ের দোকানে বসে আমাদের সঙ্গে কথা বলতেন। তার থেকে আমি ব্যক্তিগতভাবে শিখেছি প্রচুর। বহু পুরোনো সাহিত্যকর্ম তাঁর কাছে ছিল। সেগুলো দেখতে চাইলে বলতেন, টাকা ছাড়া এসব কাউকে আমি দেব না। এদিক থেকে আবদুল কাদির সঠিক ছিলেন।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তাঁর সম্পাদিত মাহে নও ছিল পূর্ববঙ্গের সবচেয়ে নিয়মিত বাংলা সাময়িকী। এটি পূর্ব বাংলার প্রথম পত্রিকা, যা লেখককে সম্মানী দিত। সেকালে ২০-২৫ টাকা সম্মানী কম নয়। দুই মণ চাল কিংবা চার আনা সোনা অথবা ১২-১৩ ভরি রুপার দাম।