০৯. মা’বার যাবার পথে

নয়

আমাদের মা’বার যাবার পথে হঠাৎ সমুদ্রে ঝড় উঠলো এবং পানিতে জাহাজ প্রায় ভর্তি হয়ে গেলো। অথচ জাহাজে আমাদের কোনো অভিজ্ঞ পদপ্রদর্শক ছিলো না। অল্পের জন্য আমাদের জাহাজ পাহাড়ের ধাক্কায় ভেঙ্গে চুরমার হবার হাত থেকে রেহাই পেলো। তারপরে জাহাজ এসে এক চড়ায় ঠেকে গেলো। আমরা প্রায় মৃত্যুর মুখোমুখি এসে পড়েছিলাম। জাহাজ হালকা করার জন্য যাত্রীরা নিজেদের মালপত্র সবই সমুদ্রে নিক্ষেপ করে একে-অপরের কাছে শেষ বিদায় নিয়ে রেখেছিলো। আমরা জাহাজের মাস্তুলটি কেটে সমুদ্রে ফেলে দিলাম। নাবিকরা তাই দিয়ে তৈরী করলো একটি কাঠের ভেলা। তখন আমরা তীর থেকে প্রায় ছ’মাইল দূরে। আমি ভেলায় উঠতে যাচ্ছি, এমন সময় আমার সঙ্গীরা (দু’জন বাদী ও অপর দু’জন সঙ্গী) আমাকে ডেকে বললো, আমাদের ফেলে আপনি ভেলায় চড়তে যাচ্ছেন। কাজেই আমার আগে তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে বললাম, তোমরা দু’জন যাও এবং যে বালিকাটিকে আমি পছন্দ করি তাকেও সঙ্গে নাও।

এই বালিকাটি তখন বলে উঠলো, আমি খুব ভাল সাঁতার কাটতে জানি। ভেলার একটা দড়ি ধরে আমি সাঁতার কেটেই ওদের সঙ্গে যেতে পারব।

কাজেই আমার সঙ্গীদের দুজন, একজন বালিকা গেলো ভেলায় চড়ে আর অপর বালিকাটি গেলো সাঁতার কেটে। নাবিকরাও ভেলার সঙ্গে দড়ি বেঁধে তাই ধরে সাঁতার কেটে চলে গেলো। আমি আমার দরকারী জিনিসপত্র, অলঙ্কারাদি এবং সুগন্ধ দ্রব্যাদি তাদের সঙ্গে পাঠিয়েছিলাম এবং তারা নিরাপদেই তীরে পৌঁছেছিল কারণ হাওয়া তাদের অনুকুলে ছিলো। আমি নিজে জাহাজেই থেকে গেলাম। ক্যাপ্টেন হালের সাহায্যে তীরে যাবার ব্যবস্থা করলেন। নাবিকরা চারখানা ভেলা তৈরী করতে আরম্ভ করলো কিন্তু সেগুলো তৈরী হবার আগেই রাত হয়ে গেলো এবং জাহাজও বোঝাই হয়ে গেলো পানিতে। আমি জাহাজের পেছনের সবচেয়ে উঁচু পাটাতনটির উপরে গিয়ে উঠলাম। ভোর না-হাওয়া অবধি সেখানেই কাটলো। ভোরে একদল বিধর্মী একটি নৌকায় আমাদের কাছে এলে আমরা তাদের মা’বারের মাটিতে এসে পা ফেললাম। আমরা তাদের জানালাম যে, তারা যে সুলতানের প্রজা, আমরা তার বন্ধু। তখন একথা তারা। সুলতানকে লিখে জানালো। ঘটনার বিবরণ আমিও তাকে লিখে জানালাম।

আমরা সেখানে তিন দিন কাটালাম। তিন দিন পরে সুলতানের পাঠানো কয়েকটি ঘোড়া ও কয়েকজন লোক নিয়ে একজন আমীর এলেন। তাদের সঙ্গে একখানা পালকী ও দশটি ঘোড়া ছিলো। আমি আমার সঙ্গীরা, ক্যাপ্টেন এবং একটি বালিকা ঘোড়ায় এবং অপর বালিকাটি পালকীতে আরোহণ করলো। অতঃপর হারকাটু ১ কেল্লায় পৌঁছে আমরা রাত কাটালাম। বাদী বালিকা, দু’জন বালিকা, গোলাম এবং আমার সঙ্গীরা এখানেই থেকে গেলো।

পরের দিন আমরা সুলতানের তাবুতে পৌঁছলাম। সুলতানের নাম গিয়াসউদ্দিন দামাখান। তিনি মরহুম সুলতান জালালউদ্দিনের এক কন্যাকে বিবাহ করেছেন। আমি দিল্লীতে থাকাকালে তার অপর কন্যাকে বিবাহ করি। সারা ভারতে প্রচলিত রীতি এই। যে, সুলতানের সাক্ষাতে যেতে হলে পায়ে বুট (Boots)পরে যেতে হবে। আমার বুট ছিলো না বলে একজন বিধর্মী আমাকে এক জোড়া বুট দিলো। সেখানে অনেক মুসলিমও ছিলো; কিন্তু আমি দেখে অবাক হলাম যে, একজন বিধর্মী আমার প্রতি বেশী ভদ্রতা দেখালো।

সুলতানের কাছে যেতে তিনি আমাকে বসতে বললেন এবং নিকটেই তিনখানা তাবুর ব্যবস্থা করে দিলেন। তাবুতে কাপের্ট এলো, খাবার জিনিসও এলো। পরে আমি সুলতানের সঙ্গে দেখা করে মালদ্বীপে অভিযান করবার প্রস্তাবটি উত্থাপন করলাম। সে। প্রস্তাব মঞ্জুর করে তিনি কোন্ কোন্ জাহাজ পাঠানো হবে তা স্থির করলেন। তাছাড়া সুলতানের জন্য উপঢৌকন ঠিক করে দিলেন এবং আমীর ও উজিরদের জন্যও পোশাক ও অন্যান্য উপহার পাঠাবার ব্যবস্থা করলেন। তিনি সুলতানের ভগ্নীর সঙ্গে তার। বিবাহের চুক্তিপত্রের একটি খসড়া তৈরী করবার ভারও আমার উপর দিলেন। সে দ্বীপপুঞ্জের গরীবদের জন্য তিনখানা জাহাজ বোঝাই করে খয়রাতি মাল পাঠাবার হকুম হলো। অতঃপর তিনি আমাকে বললেন, “পাঁচ দিনের মধ্যে তোমাকে ফিরে আসতে হবে।”

তখন নৌ-সেনাপতি তাঁকে বললেন, আগামী তিন মাসের ভেতর সে-দ্বীপে জাহাজ নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

সে-কথা শুনে সুলতান আমাকে বললেন, বেশ, অবস্থা যদি তাই হয় তবে বর্তমান কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ফাত্তানে চলুন। সেখান থেকে মুত্রা (মাদুরা) যাবেন এবং সেখান থেকেই অভিযান করা হবে।

যে-অঞ্চলের ভেতর দিয়ে আমাদের যেতে হলো সে-অঞ্চলটি ছিলো গাছগাছাড়ায় ও নলখাগড়ায় পূর্ণ। নিরবচ্ছিন্ন সে-বন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পথ করে যাওয়া সাধ্যাতীত ব্যাপার। সুলতান হুমকি দিলেন, সেনাদলের প্রতিটি লোক, ছোট বড় নির্বিশেষে একটি করে কুঠার হাতে নিয়ে যাবে গাছ ও আগাছা কেটে পথ করবার জন্য। অতঃপর শিবির সন্নিবেশ করা হলে অশ্বারোহী সুলতান তার সেনাদলসহ অগ্রসর হলেন এবং সৈন্যগণ ভোর হতে দ্বিপ্রহর অবধি গাছ কেটে চললো। দ্বিপ্রহরে খাবার দেওয়া হয়, দলের পর দল এসে সৈন্যরা তখন আহার শেষ করে। আবার সন্ধ্যাবধি গাছ কাটার কাজ। জঙ্গলে যে সব বিধর্মীদের সঙ্গে তাদের দেখা হতো তাদের সবাইকে স্ত্রীপুত্রসহ তারা বন্দী করে শিবিরে নিয়ে আসততা। সৈন্যরা চতুর্দিকে কাঠের বেষ্টনী দিয়ে তাদের শিবির সুরক্ষিত করতো। বেষ্টনীর চারটি দরজা থাকতো। বেষ্টনীর বাইরে থাকতো তিন ফিট উঁচু কয়েকটি মঞ্চ। সে সব মঞ্চে রাত্রে আগুন জ্বালিয়ে রাখার নিয়ম। সেই অগ্নিকুণ্ডের পাশে গোলামদের বা পদাতিকদের একজন পাহারাদার থাকে। তার হাতে থাকে সরু বেতের একটি আঁটি। যদি রাত্রে কোনো বিধর্মীদল শিবির আক্রমণের চেষ্টা করে তবে পাহারাদাররা সবাই নিজ নিজ বেতের আঁটি আগুনে জ্বালায় এবং সে আলোতে রাত্রি দিনের মতো আলোকিত হয়ে ওঠে। তখন ঘোড়সওয়ার ছুটে যায় বিধর্মীদের উদ্দেশ্যে।

আগের দিন যে সব বিধর্মীদের ধরা হয়েছিলো পর দিন ভোরে তাদের চারভাগ করে কাঠের বেষ্টনীর চার দরজায় শুলে চড়ানো হলো। তাদের মেয়েদের এবং ছোট ছোট শিশুদেরও কেটে ফেলা হলো এবং মেয়েদের চুল খোটার সঙ্গে বেঁধে রাখা হলো। তারপর আবার শিবির সন্নিবেশ করে যথারীতি জঙ্গল কেটে পথ করা শুরু হলো। সেখানে যেসব বিধর্মী পাওয়া গেল তাদের প্রতিও পূর্বের মতোই ব্যবহার চললো। নারী। ও শিশুহত্যার এ রীতি অত্যন্ত কাপুরুষোচিত কাজ। এ ধরণের কাজ অন্য কোনো রাজা করেছেন বলে আমার জানা নেই। এ অপরাধের জন্যই খোদ এ রাজার ধ্বংস ত্বরান্বিত করেন।

আমি শিবির ছেড়ে ফাত্তানে গিয়ে পৌঁছলাম। ফাত্তান নামক উপকুলবর্তী বড় শহরে চমৎকার একটি পোতাশ্রয় আছে। পোতাশ্রয়ের বড় বড় স্তম্ভের উপরে স্থাপিত একটি মঞ্চ আছে। কাঠের নির্মিত একটি আবৃত সিঁড়ি মঞ্চ অবধি উঠে গেছে। স্থানটি শক্ৰদ্বারা কখনো আক্রান্ত হলে এরা তাদের সমস্ত জাহাজ এনে এ মঞ্চের সঙ্গে বাঁধে এবং তাতে। সৈনিক এবং তীরন্দাজদের এনে রাখে, ফলে শত্রুরা আক্রমণের কোনো সুযোগ পায় না। এ শহরে পাথরে নির্মিত সুন্দর একটি মসজিদ আছে। প্রচুর আঙ্গুর ও চমৎকার বেদানা এখানে পাওয়া যায়। আমি এখানে ধর্মপ্রাণ শেখ মোহাম্মদ নিশাপুরীর সাক্ষালাভ করি। যেসব পাগলা দরবেশ কাঁধে অবধি লম্বা বাবরী চুল রাখেন তিনি ছিলেন তাঁদেরই একজন। তাঁর সঙ্গে একটি সিংহ ছিলো, তিনি সিংহটিকে পোষ মানিয়েছেন। পোষমানা এ সিংহ দরবেশদের সঙ্গেই উঠাবসা ও আহার করতো। তার। সঙ্গে আরও প্রায় ত্রিশ জন দরবেশ থাকতেন। তাঁদের একজনের ছিলো একটি সুদৃশ্য হরিণ। যদিও সিংহ হরিণ একই জায়গায় বসবাস করতো তবু সিংহ কখনোও হরিণের অনিষ্ট করতো না। আমি যখন ফাত্তানে তখন সুলতান অসুস্থ হয়ে শহরে এলেন। আমি তার সঙ্গে দেখা করে একটি উপহার দিয়ে এলাম। তিনি সেখানে বাস করতে এসে নৌসেনাপতিকে ডেকে বললেন, দ্বীপপুঞ্জে অভিযানের জন্য জাহাজগুলোকে সাজসজ্জায় তৈরী করা ছাড়া অন্য কোনো কাজ করবেন না। তিনি উপহারের মূল্য ফেরৎ দিবার ইচ্ছাও প্রকাশ করলেন; কিন্তু আমি তাতে রাজী হইনি। পরে অবশ্য এজন্য আমি দুঃখিত হয়েছিলাম, কারণ, তিনি এন্তেকাল করেন এবং আমি কিছুই পেলাম না। তিনি এক পক্ষকাল ফাত্তানে কাটিয়ে রাজধানীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন; কিন্তু আমি সেখানে আরও পক্ষকাল কাটালাম।

অতঃপর আমিও তার রাজধানী মুত্রা (মাদুরা) শহরে এলাম। মুত্রা প্রশস্ত রাস্তাঘাটযুক্ত একটি বড় শহর। আমি এসেই দেখলাম শহরটি প্লেগের কবলে পড়েছে। এ রোগে যে আক্রান্ত হয় দ্বিতীয় বা তৃতীয় অথচ বড়জোড় চতুর্থ দিনে মৃত্যুবরণ করে। ঘরের বাইরে যখন গিয়েছি তখন রোগাক্রান্ত ও মৃত ছাড়া আর কাউকে দেখিনি। মুত্রায় পৌঁছে সুলতান ও তাঁর মাতা, স্ত্রী ও পুত্রকে রোগাক্রান্ত অবস্থায় পেলেন। তিনদিন শহরে কাটিয়ে তিনি তিন মাইল দূরে এক নদীতে গিয়ে বাস করতে লাগলেন। আমি সেখানে তাঁর সঙ্গে গিয়ে মিলিত হলে তিনি কাজীর গৃহের পাশে আমাকে বাস করতে হুকুম করলেন। এর ঠিক পনরো দিন পরেই সুলতান এন্তেকাল করলেন। এবং তার ভাইপো নাসিরউদ্দিন তার স্থলাভিষিক্ত হলেন। নতুন সুলতান হুকুম করলেন তাঁর পিতৃব্যের ইচ্ছানুসারে দ্বীপে অভিযানের জন্য নিযুক্ত সমস্ত জাহাজ আমার হেফাজতে। দিতে হবে। পরে আমিও সাংঘাতিক এক প্রকার জ্বরে আক্রান্ত হলাম। এ অঞ্চলে এ রকম জ্বর অত্যন্ত মারাত্মক বলে আমার মনে হয়েছিলো যে, আমার শেষ দিন ঘনিয়ে এসেছে। তখন আল্লাহ আমাকে তেঁতুলের সন্ধান দিলেন। তেঁতুল এ অঞ্চলে প্রচুর জন্মে। আমি প্রায় আধসের পরিমাণ তেঁতুল পানিতে গুলে তাই পান করলাম। তার ফলে তিন দিন শিথিল অবস্থায় কাটানোর পর খোদা আমাকে আরোগ্য করলেন। এ ঘটনার পরে এ শহরের উপর আমি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠলাম এবং সুলতানের কাছে বিদায়ের প্রার্থনা জানালাম। তিনি আমাকে বললেন, আপনি যাবেন কেননা? দ্বীপে অভিযানের মাত্র এক মাস বাকি। জাহাপনার (মৃত সুলতান) ইচ্ছানুযায়ী আপনাকে সব কিছু না-দেওয়া পর্যন্ত আপনি অপেক্ষা করুণ। আমি অসম্মতি জানালাম। তখন তিনি আমার ইচ্ছামতো যে কোনো জাহাজে রওয়ানা হবার সুযোগ দিলেন এবং সেভাবে ফাত্তানে চিঠি লিখে দিলেন।

আমি ফাত্তানে ফিরে এসে দেখলাম, আটখানা জাহাজ ইয়েমেনে রওয়ানা হয়েছে। তার একটিতে আমি আরোহণ করলাম। পথে চারটি যুদ্ধ জাহাজের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়। জাহাজগুলো কিছু সময়ের জন্য আমাদেরও কাজে নিযুক্ত করে। পরে তারা। প্রত্যাবর্তন করলে আমরা কালাম (কুইন), চলে আসি। তখন অবধি আমি রোগের প্রকোপ কাটিয়ে উঠতে পারিনি বলে সেখানে তিন মাস কাটালাম। তারপর হিনাওরে সুলতান জামালউদ্দিনের কাজে যাওয়ার জন্য জাহাজে উঠলাম। হিনাওর ফাঁকানুর দ্বীপের মধ্যবর্তী ছোট একটি দ্বীপে আমরা যখন পোঁছেছি তখন বিধর্মীদের বারোখানা যুদ্ধজাহাজ আমাদের আক্রমণ করে। প্রচণ্ড যুদ্ধের পরে তারা আমাদের পরাজিত করলো এবং প্রয়োজনের জন্য রক্ষিত আমার সব কিছু সম্বল তারা নিয়ে গেলো। সেই সঙ্গে ছিলো অলঙ্কারাদি, সিংহলের রাজার দেওয়া জহরত, কাপড়-চোপড়, সফরের প্রয়োজনীয় খাদ্য ও অন্যান্য জিনিস যা ধর্মপ্রাণ লোক ও দরবেশের কাছে পেয়েছিলাম। সবকিছু গিয়ে তখন বাকী ছিলো আমার পরিধানের পায়জামা। সে জাহাজে যারা ছিলো। তাদের সবারই জিনিসপত্র রেখে নামিয়ে দেওয়া হলো তীরে। আমি ফিরে এলাম কালিকটে। সেখানে এসে একটি মসজিদে উঠলাম। একজন মৌলভী আমাকে একটি জামা দিলেন; সেখানকার কাজী দিলেন একটি পাগড়ী। একজন ব্যবসায়ী আরও একটি জামা দিলেন।

কালিকটে থাকতেই আমি জানতে পারি উজির জামালউদ্দিনের মৃত্যুর পরে সুলতানা খাদিজার (মালদ্বীপের) সঙ্গে উজির আবদুল্লার বিয়ে হয়েছে এবং আমার যে স্ত্রীকে গর্ভবতী অবস্থায় ছেড়ে এসেছিলাম সে একটি পুত্র সন্তান প্রসব করেছে। কাজেই আমি সেই দ্বীপপুঞ্জে যাবার বিষয় চিন্তা করতে লাগলাম। কিন্তু উজির আবদুল্লার সঙ্গে শক্রতার কথা মনে পড়ায় (দৈববানী লাভের আশায়) আমি কোরান খুলে একটি পৃষ্ঠায় পেলাম–ফেরেস্তাগণ নেমে এসে বলবে, ‘ভয় করোনা, দুঃখ করোনা। কাজেই নিজকে খোদার উপর সোপর্দ করে আমি যাত্রা করলাম। দশদিন পর কান্নালুস অবতরন করলে সেখানকার শাসনকর্তা এসে আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন এবং মেহমান হিসাবে রেখে। আমার জন্য নৌকার বন্দোবস্ত করে দিলেন। দ্বীপের কয়েকজন তখন উজির আবদুল্লাহর কাছে গিয়ে আমার আগমনের সংবাদ দিলো। তিনি আমার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং কে আমার সঙ্গে এসেছেন জানতে চান। তাঁকে জানানো হয় যে, আমি আমার দুই বছর বয়স্ক পুত্রকে নেবার জন্য এসেছি। এ খবর পেয়ে ছেলের মা এসে উজিরের কাছে নালিশ করে। উজির তাকে বলেন, আমার পক্ষ থেকে তার ছেলে নিয়ে যেতে আমি বাধা দেবো না। উজির আমাকে মহল দ্বীপে যাবার জন্য পীড়াপীড়ি করেন এবং যাতে সহজেই আমার গতিবিধি লক্ষ্য করা যায় তজ্জন্য তার প্রাসাদের মিনারের সামনে একটি গৃহে আমাকে থাকতে দেন। আমার পুত্রকে আমার সামনে আনা হলে আমার মনে হলো, সেখানে রেখে আসাই সমীচীন। কাজেই তাকে তাদের কাছেই রেখে এলাম। পাঁচদিন সেখানে অবস্থানের পরে সেখান থেকে তাড়াতাড়ি চলে আসাই সঙ্গত মনে হলো। কাজেই আমি চলে আসবার জন্য সুলতানের অনুমতি চাইলাম। উজির আমাকে ডেকে পাঠালেন। তাঁর কাছে যেতেই পাশে বসিয়ে তিনি আমার কুশলাদি জিজ্ঞাসা করলেন। তার সঙ্গেই আমি আহার করলাম এবং যে চিলচীতে হাত ধোন একই সঙ্গে সে চিলমূচীতে হাত ধূলাম। তিনি অন্য কারো সঙ্গে একাজ করেন না। পান আনা হলে আমি বিদায় নিয়ে এলাম। তিনি আমাকে একটি পোশাক ও অনেক কড়ি উপহার পাঠালেন। আমার প্রতিও তিনি সহৃদয় ব্যবহার করেছিলেন।

অতঃপর পুনরায় যাত্রা করলাম। দীর্ঘ তেতাল্লিশ রাত্রি সমুদ্রের বুকে কাটিয়ে আমরা বাঙ্গালা (বাংলা) দেশে পৌঁছলাম। এ বিশাল দেশে প্রচুর চাউল উৎপন্ন হয়। সারা। পৃথিবীতে আমি এমন কোনো দেশ দেখিনি যেখানে জিনিসপত্রের মূল্য বাংলার চেয়ে কম। পক্ষান্তরে এ একটি অন্ধকার (gloomy) দেশ। খোরাসানের লোকেরা বলে বাংলা ভাল জিনিসে পরিপূর্ণ একটি নরক। (A hell full of good things) এক দেরহামে আটটি মোটাতাজা মুরগী, দু’দেরহামে একটি মোটাতাজা ভেড়া এখানে বিক্রি হতে আমি দেখেছি। তাছাড়া ত্রিশ হাত লম্বা উৎকৃষ্ট ধরনের সূতী কাপড় মাত্র দু’দীনারে এখানে বিক্রি হতে দেখেছি। এক স্বর্ণ দীনারে অর্থাৎ মরক্কোর আড়াই স্বর্ণদীনারে এখানে একজন সুন্দরী ক্রীতদাসী বালিকা বিক্রি হয়। সমুদ্রোপকুলে বাংলার যে বৃহৎ শহরে আমরা প্রবেশ করি তার নাম সাদকাওয়ান। এ শহরের কাছেই গঙ্গা ও জুন নদী একত্র মিলিত হয়ে সাগরে পড়েছে। গঙ্গা নদীতে হিন্দুরা তীর্থ করতে আসে। এখানে নদীতে প্রকাও একটি নৌবহর আছে। তার সাহায্যে এরা লক্ষ্মণাবতীর অধিবাসীদের সঙ্গে যুদ্ধ করে।

বাংলার সুলতান তখন ফখরউদ্দিন। শাসনকর্তা হিসাবে তিনি উৎকৃষ্ট ছিলেন। মুসাফেরদের বিশেষতঃ দরবেশ ও সূফীদের প্রতি তিনি বিশেষ অনুরাগ প্রদর্শন করতেন। এ প্রদেশের অধিপতি ছিলেন সুলতান নাসিরউদ্দিন। দিল্লীর সুলতান তার এক পৌত্রকে কারারুদ্ধ করেন। সুলতান মোহাম্মদ সিংহাসন আরোহণের পর তাকে মুক্ত করে দেন। শর্ত ছিলো নাসিরউদ্দিন তার রাজত্বের অর্ধেক তাকে দান করবেন। কিন্তু পরে তিনি সে শর্ত ভঙ্গ করলে সুলতান মোহাম্মদ তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করেন ও তাঁকে হত্যা করে নিজের বেগমের কোনো আত্নীয়ের উপর এ দেশের শাসনভার অর্পণ করেন। এ ব্যক্তিও সৈন্যদের দ্বারা নিহত হন। তখন লক্ষ্মণাবতী থেকে এসে এ-রাজ্য দখল করেন। আলী শাহ্। ফখরউদ্দিন যখন দেখলেন রাজত্ব সুলতান নাসিরউদ্দিনের বংশধরদের হস্তচ্যুত হয়ে গেছে (তিনি তাঁদেরই অনুগত ছিলেন) তখন সাদকাওয়ানে ও বাংলায় বিদ্রোহ করে তিনি নিজকে স্বাধীন নবাব বলে ঘোষণা করেন। তাঁর সঙ্গে আলী-শার। ঘোরতর যুদ্ধ হয়। শীত ও বর্ষায় ফখরউদ্দিন নদীপথে লক্ষ্মণাবতীর উদ্দেশে অভিযান করতেন। কারণ তিনি নৌবলে বিশেষ বলীয়ান ছিলেন। কিন্তু আলী শাহর স্থল-সৈন্য কম ছিলেন বলে তিনি শীত-বর্ষা ছাড়া অন্য সময়ে স্থলপথে অভিযান চালাতেন। আমি সাদকাওয়ানে এসে সুলতানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিনি, কারণ তিনি ভারত সুলতানের বিরোধী ছিলেন বলে আমার সাক্ষাতের ফলাফল সম্বন্ধে আমি সন্দিহান ছিলাম।

সাদকাওয়ান থেকে আমি কামারু পর্বতের দিকে রওয়ানা হই। সেখান থেকে কামারু এক মাসের পথ। বিশাল এ পর্তমালা চীন ও মৃগনাভির দেশ ঘুরবাত (তিব্বত) পর্যন্ত বিস্তৃত। এ পাবর্ত্য অঞ্চলের অধিবাসীরা দেখতে তুর্কীদের মতো। তারা অত্যন্ত কষ্টসহি। ক্রীতদাস হিসাবে তাদের মূল্য অন্য যে কোনো জাতীয় ক্রীতদাসের। চেয়ে বহুগুণ বেশী। এখানকার লোকেরা তাদের যাদবিদ্যা প্রদর্শনের জন্য বিখ্যাত। আমার এ পার্বত্য অঞ্চলে ভ্রমণের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তাব্রিজের শেখ জালালুদ্দিন নামক একজন প্রসিদ্ধ ধর্মপ্রাণ সাধু ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করা। তার বাসস্থান থেকে দুদিনের পথ দুরে থাকতেই আমি তাঁর চারজন শিষ্যের দেখা পেলাম। তারা আমাকে জানালেন শেখ তার সঙ্গী দরবেশদের বলেছেন, “পশ্চিম দেশের একজন সফরকারী তোমাদের কাছে এসেছেন, তোমরা গিয়ে তাকে অভ্যর্থনা করো।” আমার সম্বন্ধে তিনি কিছুই জ্ঞাত। ছিলেন না। তার উপর এ ব্যাপার নাজেল হয়েছে। আমি তাদের সঙ্গে গুহার বাইরে। অবস্থিত তার আস্তানায় গিয়ে হাজির হলাম। সেখানে কোনো রকম আবাদী জমি নেই। কিন্তু মুসলমান ও অ-মুসলমান নির্বিশেষে সেখানকার অধিবাসীরা নানারকম উপহার। দ্রব্য নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে আসে। সে-সব উপহার ও মানতের জিনিসপত্রেই। মুসাফের ও দরবেশদের ব্যয় নির্বাহ হয়। শেথের নিজের প্রয়োজন মিটানোর জন্য রয়েছে এক মাত্র গরু। প্রতি দশদিন অন্তর তিনি গরুর দুধ খেয়ে ইফতার করেন। একমাত্র তার চেষ্টায়ই এ পার্বত্যাঞ্চলের অধিবাসীরা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে। এ উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি এদের ভেতর বাস করছেন। আমি তার সামনে গিয়ে হাজির হলে তিনি দাঁড়িয়ে আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন এবং কোলাকুলি করলেন। আমার দেশ ও সফর সম্বন্ধে তিনি জিজ্ঞাসাবাদ করলে আমি যথাযথ উত্তর দিলাম। তিনি তখন বললেন, আপনি আরবদের সফরকারী।

তাঁর শিষ্যদের যারা উপস্থিত ছিলো তারা বললো, মওলানা, ইনি আরবদের ছাড়া অন্যদেরও সফরকারী।

তখন শেখ তাদের কথার পুনরাবৃত্তি করে বললেন, হাঁ অন্যদেরও সফরকারী। কাজেই একে সম্মান করো।

তারা আমাকে আস্তানার ভেতর নিয়ে গেলো। আমি তিনদিন তাদের আতিথ্যে কাটালাম।

শেখের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দেখলাম, তিনি ছাগলের লোমে তৈরী একটি আলখেল্প পরিধান করে আছেন। আলখেল্লাটি দেখে আমার পছন্দ হলে মনে-মনে বললাম, আহা, শেখ যদি এটি আমাকে দান করতেন। পরে তার কাছে যখন বিদায় নিতে গেলাম, তিনি উঠে গুহার এক কোণে গিয়ে আলখেল্পটি খুলে এসে আমার গায়ে পরিয়ে দিলেন এবং নিজের মাথার গোলটুপিটিও আমার মাথায় দিলেন। নিজে এলেন তালি লাগানো একটি পোশাকে। দরবো আমাকে বললেন, শেখ সচরাচর এ আলখেল্লাটি পরিধান করেন না। শুধু আমি এখানে এলেই এটি পরিধান করে তিনি বলেছেন, “মরক্কোর অধিবাসী এ আলখেল্লাটি চেয়ে নেবেন। তার থেকে এটি নেবেন একজন বিধর্মী সুলতান। এটি আমার ভাই সাঘার্জের বোরহানউদ্দিনকে দেবেন। তাঁর জন্যই এটি তৈরী হয়েছে।”

তাঁদের মুখে একথা শুনার পর আমি বললাম, এ পোশাকের ভেতর দিয়ে আমি শেখের দোয়া লাভ করেছি। এটি পরে মুসলমান বা বিধর্মী কোনো সুলতানের সাক্ষাতেই আমি যাবো না।

একথা বলে আমি শেখের কাছে বিদায় নিয়ে এলাম। তারপর চীন সফরে গিয়ে বহুদিন পরে থানসা (হ্যাং-চৌ-ফু) শহরে এসে হাজির হলাম। এখানে এসে লোকের ভিড়ে আমি সঙ্গীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম। তখন আমার পরিধানে ছিলো সেই আলখেল্লাটি। সেখানে ঘটনাক্রমে এক রাস্তায় দেখা হলো সেখানকার উজির ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের সঙ্গে। আমার উপর নজর পড়তেই তিনি আমাকে কাছে ডেকে হাত ধরে আমার আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন এবং কথা বলতে-বলতে সুলতানের প্রাসাদে নিয়ে হাজির করলেন। এখানে পৌঁছে আমি বিদায় নিতে চাইলাম, কিন্তু তিনি আমার কথায় আদৌ কান দিলেন না। তিনি আমাকে সুলতানের কাছে নিয়ে হাজির করলেন। সুলতান আমাকে সুলতানদের সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। আমি তার কথার জবাব দেবার সময় তিনি আলখেল্লাটির দিকে নজর দিলেন এবং এটি তার পছন্দ হলো। উজির তখন আমাকে বললেন, এটি খুলে ফেলুন।

আমি তার কথা অমান্য করতে পারলাম না। কাজেই সুলতান সে আলখেল্লাটি নিয়ে আমাকে দশটি জামা, একটি ঘোড়া ও জিন এবং কিছু অর্থ দিতে হকুম করলেন। এ ঘটনায় আমি রাগান্বিত হয়েছিলাম কিন্তু পরে মনে পড়লো শেখের কথা। তিনি বলেছিলেন, একজন বিধর্মী সুলতান একদিন এ আলখেল্লাটি নিয়ে নেবেন। তার সে ভবিষ্যদ্বাণী এভাবে পূর্ণ হওয়ায় আমার বিস্ময়বোধ করতে লাগল।

পরের বছর খান-বালিক (পিকিং) শহরে আমি সম্রাটের প্রাসাদে প্রবেশ করলাম এবং শেখ বোরহানউদ্দিনের দরগা খুঁজে বের করলাম। দেখলাম, সেই আলখেল্লাটি গায়ে দিয়ে তিনি তখন পড়তে বসেছেন। বিস্মিত হয়ে সেটি হাতে নিয়ে আমি পরীক্ষা করতে লাগলাম। তাই দেখে তিনি বললেন, আগে থেকেই সব জানেন তবে আর পরীক্ষা করছেন কি? আমি বললাম, সত্যই। এ আলখেল্লাটি খান্সার সুলতান আমার কাছ থেকে নিয়েছিলেন।

“এটি খাস করে আমার ভাই জালালউদ্দিন আমার জন্যই তৈরী করেছিলেন। তিনি আমাকে লিখে জানিয়েছিলেন অমুক অমুকের হাত দিয়ে আলখেল্পটি তোমার কাছে গিয়ে পৌঁছবে।”

অতঃপর বোরহানউদ্দিন সে পত্ৰখানা বের করলেন। সেটি পাঠ করে ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে শেখ জালালউদ্দিনের এ নিখুঁত জ্ঞানের পরিচয় পেয়ে আমি বিস্ময় বোধ করলাম। এ ব্যাপারে যা-কিছু ঘটেছে সবই আমি শেখ বোরহানউদ্দিনকে খুলে বললাম। তিনি বললেন আমার ভাই জালালউদ্দিন এসবের চেয়েও অনেক বেশী কিছু করতে পারেন। …আমি শুনেছি, প্রতিদিন তিনি মক্কায় ফজরের নামাজ আদায় করেন এবং প্রতি বছর হজ করেন। কারণ আরফা এবং হজের সময় তিনি কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে যান কেউ তা বলতে পারেন না।

শেখ জালালউদ্দিনের কাছে বিদায় নিয়ে আমি হাজং পৌঁছি। কামারু পর্বত থেকে উৎপন্ন একটি নদীর দু’পাড়ে বিস্তীর্ণ এ সুন্দর শহরটি। নদীটির নাম নীল নদী।১০ এ নদী পথেই বাংলা ও লক্ষ্মণাবতী যেতে হয়। মিশরের নীল নদের মতো এই নদীটির দু’পাশে অনেক স্রোতচালিত কল, ফলের বাগান ও গ্রাম রয়েছে। মুসলমান সুলতানদের শাসনাধীনে এখানে বিধর্মীরা বাস করে। তাদের উৎপন্ন অর্ধেক শষ্য জরিমানা স্বরূপ কর্তন করা হয়। তাছাড়া তাদের ট্যাক্স আদায় দিতে হয়। আমরা পনেরো দিন অবধি এ নদী দিয়ে ভাটির দিকে এগিয়ে গেলাম; নদীর দু’পাশে গ্রাম ও ফলের বাগান দেখে মনে হচ্ছিল আমরা যেন একটি বাজারের ভেতর দিয়ে চলেছি। অসংখ্যা নৌকা চলাচল করছে এ নদীতে। প্রত্যেক নৌকায় একটি করে ঢাক। এক নৌকার সঙ্গে অপর একটি নৌকার দেখা হলেই উভয়ে নিজ নিজ ঢাক পিটায় এবং একে অপরকে অভিবাদন। জানায়। সুলতান ফখরউদ্দিনের হুকুম, দরবেশদের কাছ থেকে এ নদীতে চলাচলের জন্য কোনো কর আদায় করা হবে না। তাদের কারো খাদ্যের সংস্থান না থাকলে খাদ্যও দিতে হবে। কোনো দরবেশ শহরে এলে তাকে অর্ধ দীনার দেওয়া হয়। পূর্ব বর্ণিত মতে পনেরো দিন নদীপথে চলে আমরা সোনারকাওয়ান১১ এসে পৌঁছলাম। এখানে এসে একটি নৌকা পেলাম যেটা যাভা (সুমাত্রা) যাত্রার জন্য তৈরী। এখান থেকে সুমাত্রা চল্লিশ দিনের পথ। আমরা সেই নৌকায় আরোহণ করলাম।

***

পরিচ্ছেদ ৯

১। হরকাতু আরকটের আধুনিক শহর হতে পারে না। এটা অনেক উত্তরে অবস্থিত। এ ছিল কেবল একটি দূর্গ। কাজেই এর অবস্থান জায়গা সন্দেহজনক। যদিও এর নাম আরকট জেলার সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত (তামিল আৰু-কাদু’ ছয়টি অরণ্য)।

২। জালাল উদ্দীনকে দিল্লীর সুলতান মুহাম্মদ মাবারের সামরিক শাসক পদে নিযুক্ত করেন (মুসলিমগণ এ দেশটি ১৩১১ সালে অধিকার করেছিলেন)। ১৩৩৮ সালে ইনি নিজকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করেন এবং এর পাঁচ বছর পরে নিহত হন। অতঃপর পর্যায়ক্রমে কয়েকজন সেনাপতি সিংহাসনে বসেন। এদের মধ্যে গিয়াসুদ্দীন ছিলেন তৃতীয়।

৩। কারোম্যাণ্ডেল সমুদ্র উপকুলের অনেক প্যাটাস এবং প্যাটাসের মধ্যে ফ্যাটানকে সঠিকভাবে নির্ধারণ করা কঠিন। মধ্য যুগীয় মাবারের প্রধান বন্দর ছিল কাবেরি, পাটুআনাম কাবেরির একটি মুখে–১৩০০ খ্রীষ্টাব্দের এক জলপ্লাবনে স্থানটি বিনষ্ট হয়েছে বলে বলা হয়।

এটাই যদি ইব্‌নে বতুতার ফ্যাটান হয়ে থাকে তবে এর ধ্বংসকালের তারিখ হবে ১৩৫০ সালের। কাছাকাছি (মার্কোপলো, ২য় খণ্ড, ৩৩৫-৩৬)। ফ্যাটান হয়তো নাগাপইম। পরবর্তী শতাব্দীগুলিতে এটা এক গুরুত্বপূর্ণ পোতাশ্রয় ছিল। ইউনূসের মতে স্থানটি আরো অনেক দক্ষিণে রামনাদের কাছাকাছি-এটা অসম্ভব হবে যদি আরুকটের সঙ্গে হারকাতু নামের কোনো সম্বন্ধ বিবেচনা করা হয়। (টীকা ১ দ্রষ্টব্য)। মাবার পরিভ্রমণের কোনো এক সময়ে কিম্বা ফ্যাটান থেকে কালামের পানে সফরের সময় মনে হয় ইব্‌নে বতুতা কেলুকারির ক্ষুদ্র বন্দরে উপনীত হয়েছে। এটা রামনাদের ১০ মাইল দক্ষিণে। পরে এটাকে তিনি লাগিয়েছেন চীন সমুদ্রের কোনো এক স্থানে (পরিচ্ছেদ ১০ টীকা দ্রষ্টব্য)। এটা আশ্চর্য যে ইব্‌নে বতুতা কেয়াল বা মার্কোপলোর কেইল বন্দরের কথা উল্লেখ করেননি। এটা তামনাপারনি নদীর ডেলটার তুতিকরিনের দক্ষিণে সে সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য বন্দর ছিল (মার্কোপলো, ২য় খণ্ড, ৩৭০-৪ দ্রষ্টব্য)।

৪। ইউলের বর্ণনা অনুসারে এটাকে পিজন আইল্যাণ্ড’ বলে স্থির করা হয়েছে, অনুরের (হিনাওর) ২৫ মাইল দক্ষিণে।

৫। সুদূর পূর্বাঞ্চলে ইব্‌নে বতুতার যে কোনো ভ্রমণ ইতিহাসের সঙ্গে এ উক্তির সামঞ্জস্য সাধন করা কঠিন। বর্ণনার গতিধারার দিক দিয়ে বিচার করে দেখলে এই দ্বিতীয় সফর তার মালদ্বীপ থেকে যাত্রার এক বছর পরবর্তী কালের পরে ছাড়া হতে পারে নাই।

৬। সুদকাওয়ান স্থানটিকে অনেক সাতগাঁও বলে স্থির করেছেন। এটা হুগলী শহরের উত্তর পশ্চিমে হুগলী নদীর তীরে অবস্থিত একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত শহর। হিন্দু শাসনের যুগ থেকে পর্তুগীজগণ কর্তৃক হুগলীর প্রতিষ্ঠা কাল পর্যন্ত এটা ছিল বাংলাদেশের ব্যবসায়ী রাজধানী। ইউল এটাকে চিটাগং বলে স্থির করেছেন। এটা সাতগাঁও অপেক্ষা সুবিধাজনক বন্দর ছিল। এবং ইব্‌নে বতুতা একে “মহাসমুদ্রের তীরবর্তী” বন্দর বলে বর্ণনা করেছেন। সুলতান ফকরুদ্দীনের সঙ্গে চিঠাগাংয়ের কোনো সম্পর্ক ছিল কি না সেটা অনিশ্চিত (cf, Book of Duarte Barbosa; ২য় খণ্ড, ১৩৯)।

৭। জুন হচ্ছে ইব্‌নে বতুতার যমুনা নামের লিপ্যান্তর। এখানে এটা ব্ৰহ্মপুত্রকে বোঝাচ্ছে (৫২ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)।

৮। লখিনাওতি (লক্ষমনওয়াতি) মানে লক্ষনাবতী হচ্ছে গৌড়ের পুরাতন নাম। এটা অনেক দিন বাংলার মুসলিম শাসকদের রাজধানী ছিল। এ শহর তারা জয় করেছিলেন ১২০৪ খ্রীষ্টাব্দে। মালদহের নিকটে এর ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। বাংলাদেশের তিনটি জেলা এ নাম গ্রহণ করেছিল (টীকা ১৩ দ্রষ্টব্য)। এ জেলা তিনটি ছিল গঙ্গা এবং ব্রহ্মপুত্রের মাঝখানে।

৯। এ কথা ইউল সম্পূর্ণভাবে স্থির করেছেন যে (ক্যাথে, ৪র্থ খণ্ড, ১৫১-৫) ইব্‌নে বতুতা যে জেলাটি ভ্রমণ করেছিলেন সেটা সিলেট। সেখানে শাজালালের সমাধি এখনো সম্মানিত হয়ে থাকে (শেখ জালালউদ্দীন) কামরু বলে যে স্থানটির নাম করা হয়েছে সেটা শুদ্ধভাবে কামরূপ। এটা আসামে যুক্ত একটি জেলার নাম। এ স্থানের ইন্দোচীনে জনসাধারণ মোঙ্গলিয়ান চরিত্রের পরিবাহক।

১০। নীল নদী হচ্ছে মেঘনা। বারাকের বাম তীরে অবস্থিত। বারাক এর একটি শীর্ষস্থানীয় নদী। এখানে এখনো একটি টিলা বা নিচু পাহাড় রয়েছে। একে বলা হয় হাবাং-হবিগঞ্জের কিছুটা দক্ষিণে অবস্থিত।

১১। সোনার গাঁও ঢাকা থেকে ১৫ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে। এটা ছিল মুসলিমগণের বঙ্গদেশের অন্যতম পুরাতন রাজধানী এবং এর নাম দেওয়া হয়েছিল বাংলার তিনটি জেলার একটিকে। তৃতীয়টি ছিল সাতগাঁও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *