মহিম তার কাজের জিনিসপত্র সব গুছিয়ে বেরোবার উপক্রম করতেই হঠাৎ আবার অহল্যা এসে ঢুকল। মহিমকে সর গুছোতে দেখে অহল্যা হু তুলে গভীর মুখে বলল, একজন তো মামলা লড়তে বের হইলেন। আর একজনের নিশানা কোন দিকে?
মহিম বলল, দেখি একবার কুঁজো মালা গেল কুঠাই। আর যাব একবার লতার ঠাঁই।
তাই ভাল, বাঁকা ঠোঁটে হেসে রহস্য করে বলল অহল্যা, কাল বলছিলে রাতে, কোন্ এক অপরূপ সোন্দরী নাকি দেখে আসছ। মুখ নাকি তার তোমারগড়া বুদ্ধদেবতার মতো মিষ্টি। ভাবি, বুঝি রাত পোয়াতেই সেই মুখের খোঁজে চললা।
সহজ জবাব না দিয়ে মহিম বলল, কেন, আমাদের ঘরের বউ বুঝিন কুচ্ছিত?
—পোড়া কপাল অমন সোন্দরের।
কথা বলতে গিয়ে কথা আটকায় বুকে অহল্যার। বুকের মধ্যে কোথায় যেন কীসের এক হ্রাস জমিয়ে বাসা বাঁধে। কথা নয়, যেন চোরাবালুতে সন্তর্পণে পা ফেলে চলেছে। মুহূর্তের এদিক ওদিকে বুঝি চিরদিনের জন্য তলিয়ে যেতে হবে বসুমতীর গর্ভে।
হেসে তেমনি রহস্য করে বলল, নিজের জন্য একটি খুঁজে আনতে হবে তো। না, কি চিরদিনই। ভায়ের বউয়ের মুখ দেখে চলবে!
চলছে না নাকি! তা যা-ই বল, ও পরের মেয়ের ঝামেলায় আর যাচ্ছিনে বাপু।
আমি বুঝি পরের মেয়ে নই?
তুমি? মহিম চোখ তুলল। অহল্যা তার তীক্ষ্ণ অপলক দৃষ্টি চকিতে নিল সরিয়ে।
মহিম বলল, সে কথা মোর মনে লয় নাই কোনও দিন। তুমি আবার পরের মেয়ে হলে কবে? তুমি যদি পরের মেয়ে, তবে আর মোদের আছে কে?
কশাঘাত নয়, তবু যেন কীসের আচমকা আঘাতে অহল্যার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে। পরমুহূর্তেই মুখে হাসি টেনে নিজেকে মনে মনে গাল দেয় সে, মুখপুড়ি, পাষাণী আর কী শুনতে চাস তুই এ নরম মানুষটার কাছ থেকে? বলল, হ্যাঁ, মোরে ছাড়া তো তোমাদের জগৎ সমসার খা খা করতেছে।
পরের কথা নয়, মোর কথা বলল। শুনি, জন্ম দিয়ে মা মরেছিল, বাপকেও মোর মনে নাই। দাদা হল অন্য মানুষ, তার মনের তল পাই না। তোমার মনের হদিসও আমি হারিয়ে ফেলি মাঝে মাঝে। তবু, এই তোমার পা ছুঁয়ে বলছি, সেই ছোটকালে তোমারে যদি না পেতাম, তবে বুঝিন জ্যান্ত থেকে এত বড়টা হইতাম না।
চকিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো ফিরে অহল্যা দু-হাতে মহিমের মুখে হাত চাপা দিল। থামো– থামো খুব হইছে মোর মস্করা। এ কী কথার ছিরি?
তারপর তার সমস্ত হৃদয়কে মুচড়ে দিল মহিমের চোখের দু-ফোঁটা জল। মহিমের এক মাথা চুলের মধ্যে হাত ড়ুবিয়ে দিয়ে অহল্যা চোখে জল নিয়ে একটু হাসবার চেষ্টা করে বললে, মস্করা বোঝো না বাপু তুমি। বড় নরম মানুষ।
চোখ মুছে মহিম বলে, আর তুমি বুঝি পাথরের? তবে পাথরের চোখে জল কেন? পর বলে বুঝি?
নেও হইছে, কোথা যাচ্ছিলে যাও। দেখ, বেলাটুকুন কাটিয়ে আসো না যেন।
আমি আসব, তুমি বসে থেকো না, বলে মহিম বেরিয়ে যায়।
আশ্চর্য! অহল্যার ঠোঁটে এক বিচিত্র হাসি ফুটে ওঠে। চোখ পলকহীন। সে দৃষ্টি, সে হাসি সুখের না দুঃখের, কিছু চাওয়া না পাওয়ার তা বুঝি সে নিজেই জানে না। তার পর আরও আশ্চর্যতর, যখন আচমকা দমকা হাওয়ায় কেঁপে ওঠা ফুলের পাপড়ির মতো কেঁপে উঠল তার ঠোঁট, চোখে ছুটে এল বন্যা। অমিত তার বেগ। কেন?
এ কি সেই তার নিজের হাতে বাঁধা বীণার তারে বেসুর?