০৯. মর্জিনার বাবার কবর

মর্জিনা তার বাবার কবর চালাঘরের উত্তরদিকে দিয়েছে। পাকুরগাছের নিচে। বড় গাছপালার নিচে কবর হওয়া ভালো। গাছ আল্লাহপাকের নাম নেয়। এতে কবরবাসীর গোরআজাবি কমে। এখন তার মনে হচ্ছে, এত কাছে কবর দেওয়া ঠিক হয় নি। সন্ধ্যার পর থেকে মর্জিনার ভয় ভয় লাগে। এক রাতে সে স্পষ্ট দেখেছে, বুড়োমতো এক লোক কবরের ওপর বসে জিকিরের ভঙ্গিতে মাথা দোলাচ্ছে। বুড়োটা যে তার বাবা এই বিষয়ে সে নিঃসন্দেহ। শুভ্রকে সে ঘটনাটা বলেছে। শুভ্ৰ শব্দ করে হেসেছে।

মর্জিনা বলল, হাসেন কী জন্যে?

শুভ্র বলল, তোমার কথা শুনে হাসি।

মর্জিনা বলল, হাসির কথা কী বললাম?

শুভ্ৰ বলল, যে কবরের ওপর বসে ছিল তার গায়ে কাপড় ছিল?

মর্জিনা বলল, অবশ্যই। লুঙ্গি ছিল। গেঞ্জি ছিল। মাথায় টুপি ছিল।

শুভ্র বলল, ধরে নিলাম তোমার বাবার ভূত কবরে বসা ছিল। সে জামাকাপড় পাবে কোথায়? জামাকাপড়ের তো ভূত হবার সুযোগ নেই।

মর্জিনা বলল, তাইলে আমি দেখলাম কী?

শুভ্র বলল, আকাশে চাঁদ ছিল। চাঁদের আলোয় পাকুরগাছের ছায়া পড়েছে কবরের ওপর। বাতাসে গাছ দুলছে। তোমার কাছে মনে হয়েছে ছায়া দুলছে। তোমার মস্তিষ্ক সঙ্গে সঙ্গে কল্পনা করে নিয়েছে এই ছায়া তোমার বাবা।

মর্জিনা বলল, আপনের মাথা! যদিও সে বলল আপনের মাথা, কিন্তু শুভ্রর যুক্তি ফেলে দিতে পারল না। যতই দিন যাচ্ছে ততই সে মানুষটার কাজকর্ম এবং কথাবার্তায় মুগ্ধ হচ্ছে। প্রতি শনিবার রাতে স্কুলঘরের উঠানে বসে শুভ্ৰ নানান কথা বলে। চারের সবাই মন দিয়ে শোনে। কথাগুলির একটা নামও আছে-ছাইনছের (science) কথা। মেয়েরা এইসব কথা শুনতে যায় না। তবে মর্জিনা যায়। তার ভালো লাগে এবং অস্থির লাগে। অস্থির লাগার কারণ, এই মানুষ সারা জীবন চরে পড়ে থাকবে না। একসময় যেখানকার মানুষ সেখানে ফিরে যাবে। তখন তার কী হবে? চার থেকে তাকে উচ্ছেদ করলে সে যাবে কোথায়? নাটি মেয়ে হয়ে যাবে? পাড়ায় বাস করা শুরু করবে?

মর্জিনা!

বলেন, কী বলবেন।

শুভ্র বলল, একটা কাজ করো, এখন থেকে একটা হারিকেন জ্বলিয়ে কবরের মাঝখানে রেখে দিয়ে। তাহলে আর কোনো ছায়াও দেখবে না, ভয়ও পাবে। না।

মর্জিনা বিরক্ত গলায় বলল, আপনের কী যে কথা! কবরে হারিকেন জ্বলে এমন কথা কোনোদিন শুনছেন? আপনের মাথা খারাপ। আপনের মাথায় উল্টাপাল্টা চিন্তা আসে; আমার তো মাথা খারাপ না। কবরের উপরে হারিকেন। কী যে কথা!

শুভ্রর প্রস্তাব বিরক্ত হয়ে বাতিল করে মর্জিনা হারিকেনে কেরোসিন ভর্তি করে। কাচ পরিষ্কার করে হারিকেন জ্বালায়। তার বাবার কবরে হারিকেন রাখতে রাখতে মনে মনে বলে, বাপজান, ভয় দেখায়ো না গো।

সে বাড়ির উঠানে বসে তাকিয়ে থাকে। বাবার কবরের হারিকেনের দিকে। শুভ্র তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। তারাভর্তি আকাশ। চাঁদ উঠলেই তারাদের ঔজ্জ্বল্য কমে যাবে। তখন অন্য শোভা।

মর্জিনা!

বলেন, কী বলবেন। চা দিতে বলবেন না। ঘরে চায়ের পাত্তি নাই।

শুভ্র বলল, একটা দুরবিন থাকলে ভালো হতো। আকাশের তারা দেখতে পারতাম। আধুনিক দুরবিন আবিষ্কার করেন জ্যোতির্বিদ কেপলার। বেচারার চোখ ছিল আমার চেয়েও খারাপ। দুরবিন দিয়ে তিনি কিছুই পান নি।

মর্জিনা হাই তুলতে তুলতে বলল, উনার কপালে নাই। উনি কী করব!

শুভ্ৰ বলল, টমাস আলভা এডিসন আবিষ্কার করেছিলেন গ্রামোফোন। বেচারা তাঁর আবিষ্কার করা গ্রামোফোন থেকে কোনো শব্দ শুনতে পান নি। উনি তখন ছিলেন বধির।

মর্জিনা বলল, প্যাচাল বন্ধ করেন। আপনার প্যাচাল শুনতে ভালো লাগে না।

শুভ্ৰ চুপ করে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মর্জিনার মন খারাপ হয়ে গেল। সে ঠিক কথা বলে নি। শুভ্রর প্যাচাল শুনতে তার খুব ভালো লাগে। শুভ্রর আশেপাশে থাকতে ভালো লাগে। তাকে নিয়ে আজেবাজে চিন্তা করতেও ভালো লাগে। রোজ রাতে সে শুভ্ৰকে নিয়ে আজেবাজে চিন্তা করে। সেইসব চিন্তায় শুভ্রর সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে। চাঁদনি রাতে দুজনে হাতধরাধরি করে নদীতে সিনান করতে যাচ্ছে। সিনানের অংশটাও মর্জিনা চিন্তা করে। এই অংশ ভয়ঙ্কর।

মর্জিনা বারান্দা থেকে উঠে ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। এই মুহুর্তে সে একটা জটিল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শুভ্ৰ যেদিন চর ছেড়ে চলে যাবে সেদিনই সে পাকুড়গাছে দড়ি ঝুলিয়ে ফাঁস নিবে। বাবার কবরের ওপর সে মরে দোল খেতে থাকবে। সিদ্ধান্তটা নেবার পর তার মনের অস্থিরতা অনেকটা কমল। সে শুভ্রর পাশে এসে দাঁড়াল। হালকা গলায় বলল, ভাইজান চা খাবেন?

শুভ্ৰ বলল, তুমি না বললে চা-পাতা নেই!

হেকমতের দোকান থাইকা আইন্যা দিব। দোকান খোলা আছে। আমি চা নিয়া আসি, আপনে আসমানের তারা দেখতে থাকেন।

শুভ্র বলল, চা আনতে হবে না। বসো এখানে, গল্প করি। মর্জিনা বলল, আগে চা নিয়া আসি। তারপর যত ইচ্ছা গল্প করবেন।

 

হেকমত বলল, রাইতে একলা আসছ চা নিতে, সমস্যা কী?

মর্জিনা বলল, ভাইজানের চায়ের পিয়াসা লাগছে, এইজন্যে আসছি।

হেকমত বলল, পিয়াস তো আমারও লাগছে। অন্য পিয়াস। এর গতি কী?

মর্জিনা বলল, বিয়া করেন। বিয়া ছাড়া এর গতি নাই।

হেকমত বলল, তুমি রাজি থাকলে তোমারে বিবাহ করতে পারি। রাজি আছ?

মর্জিনা বলল, এক শর্তে রাজি আছি।

শর্তটা কী?

মর্জিনা বলল, আপনে আপনের দোকান থাইকা হামাগুড়ি দেওয়া শুরু করবেন। দূর থাইকা যেন মনে হয় চরের বেওয়ারিশ কুত্তা হাঁটতেছে। এইভাবে আমার বাড়িতে উপস্থিত হইয়া বলবেন, মর্জিনা, তোমারে বিবাহ করতে চাই। আমি সাথে সাথে রাজি হব। কাজি ডাইক্যা বিবাহ। ভাইজান হইব সাক্ষী। আমারে আপনের হাতে তুইল্যা দিব।

হেকমত বলল, পাগলের সাথে রাইতদিন থাকস বইলা তোরও মাথা খারাপ হইছে। যা ভাগ।

 

চর এলাকায় ভূমি সেটেলমেন্টের কানুনগো এসেছেন চেইন নিয়ে। চর মাপা হবে। সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ। কানুনগোর নাম গঙ্গা ভট্টাচার্য। তিনি চরে নেমেই ঘোষণা দিয়েছেন যে, তিনি ঘুষ খান না। একটা ছেড়া দুই টাকার নোটও না। ঘুষ তার কাছে গোমাংসের মতো। তবে তিনি বাড়িতে একটা স্কুল দেবেন বলে মানত করেছেন। সেই উদ্দেশ্যে যদি কেউ কিছু দিতে চায়, তাহলে আলাদা কথা।

চরের বেশ কিছু লোক তার সঙ্গে ঘুরছে। চেইন টানছে। কাজটায় তারা খুবই উৎসাহ পাচ্ছে। গঙ্গা ভট্টাচাৰ্য এক পর্যায়ে জিজ্ঞেস করলেন, চরের নাম কী?

কোনো নাম তো নাই। গঙ্গা ভট্টাচার্য বললেন, একটা নাম তো দেওয়া দরকার। আপাতত দিয়ে রাখি। সরকার যদি বদলাতে চায় পরে বদলাবে।

একজন বলল, নাম দেন শুভ্রর চর।

কী বললেন?

শুভ্রর চর।

উপস্থিত সবাই বলল, এটা একটা ভালো নাম হয়েছে।

গঙ্গা ভট্টাচাৰ্য সেটেলমেন্টের খাতায় লিখলেন চরের নাম শুভ্রর চর। অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার, এই নাম অতি দ্রুত স্থায়ী হয়ে গেল। খেয়াঘাটের মাঝি বলা শুরু করল, নাও ছাড়ে, নাও ছাড়ে, শুভ্রর চর শুভ্রর চর।

জমি মাপামাপির তৃতীয় দিন দুপুরে গঙ্গা ভট্টাচার্যের কাছে হারুন এসে উপস্থিত। হারুন টিফিন কেরিয়ারে করে খাবার নিয়ে এসেছে। কানুনগো সাহেবের সঙ্গে একত্রে দুপুরের খানা খাবে। হারুন বলল, আপনি নিষ্ঠাবান মানুষ খবর পেয়েছি। ছেঁড়া দুই টাকার নোটও নেন না।

গঙ্গা ভট্টাচার্য বললেন, সঠিক খবর পেয়েছেন। ঘুষ এবং গোমাংস আমার কাছে তুল্য মূল্য। তবে স্কুল দিচ্ছি। স্কুলের সাহায্যার্থে যে যা দিবে তাই নিব।

তখন কি মাপ উনিশ-বিশ করবেন?

করব।

একটা ভালো কাজ করতে হলে কিছু মন্দ কাজও করতে হয়। স্কুল দেওয়া বিরাট কাজ।

হারুন বলল, আপনার মতো পুণ্যবান মানুষের সঙ্গে খানা খাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আসেন। দুইজনে মিলে খানা খাই। আমি খানা নিয়ে এসেছি। খাসির মাংস খান তো?

গঙ্গা ভট্টাচার্য বললেন, খাসির মাংসে কোনো আপত্তি নাই।

গঙ্গা ভট্টাচাৰ্য তৃপ্তি করে খেলেন। মুসলমান বাড়ির মাংস রাধা যে অসাধারণ এই কথা কয়েকবার বললেন।

হারুন বলল, খাসির মাংস হিসাবে যা খেয়েছেন তা গরুর মাংস। আপনার জাত চলে গেছে। সেটা কোনো বিষয় না। জীবন যে এখনো আছে, এইটাই বড় কথা। তাড়াতাড়ি চর ছাইড়া ভাগেন। বিরাট মারামারি হবে। আপনি নিরীহ মানুষ। চর দখলের মারামারিতে জীবন দিবেন, এইটা কেমন কথা!

আপনি কি সত্যই আমাকে গরুর মাংস খাইয়েছেন?

আরে না। তামাশা করেছি। আপনারে গরুর মাংস খাওয়ায়ে আমার লাভ কী?

গঙ্গা ভট্টাচাৰ্য স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।

হারুন বলল, সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় বিদায় হয়ে যান। মারামারি রাতেই শুরু হওয়ার কথা। তিন-চাইরটা লাশ পড়বে। সবই মুসলমান। একটা হিন্দু লাশ পড়া দরকার। এই ভেবে কেউ আপনার ক্ষতি করতে পারে। যদিও আপনি এখন আর হিন্দু না। গরুর মাংস খেয়ে জাত গেছে। পাবলিক তো এই খবর জানে না।

আপনি না বললেন গরুর মাংস না! আমার সঙ্গে তামাশা করছেন?

হারুন বলল, ব্রাদার, আমি তামাশা করার লোক না।

গঙ্গা ভট্টাচাৰ্য গলায় আঙুল দিয়ে বমি করার অনেক চেষ্টা করলেন। বমি হলো না। তিনি সন্ধ্যার আগেই চর ছেড়ে বিদায় হলেন।

 

চায়ের দোকানের হেকমত সকাল থেকেই অস্থির বোধ করছে। অস্থিরতার কারণে সে কয়েক কাপ চা খেয়ে ফেলেছে। চায়ের সঙ্গে বিড়ি টানছে। অস্থিরতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সে মুখভর্তি পান থাকা সত্ত্বেও চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ফেলেছে। অস্থির না হয়ে উপায় কী? তার কাছে খবর আছে আজ বিকালে ঘটনা ঘটবে। এই জাতীয় ঘটনা রাতের আঁধারে ঘটে। আজকেরটা ঘটবে দিনের আলোয়, সবার চোখের সামনে। যাতে সবাই শিক্ষা পায়। শুভ্ৰ নামের মানুষটার নাম আজ খারিজ হয়ে যাবে। চরবাসীদের নামের তালিকায় এই নাম আর থাকবে না।

কাৰ্যসমাধার লোকজন চলে এসেছে। হারুনের লোক। তাদের দুজন হেকমতের দোকানো রঙ চা খেয়ে গেছে। অন্য আরেক পার্টি নাজেল হয়েছে। আকবরের পার্টি। এরা হারুন গ্রুপের সঙ্গে হাঙ্গামায় যাবে, তবে শুভ্রকে বিদায় করার ব্যাপারে আকবর গ্রুপের কোনো আপত্তি নেই। হাঙ্গামা বিকাল থেকে শুরু হবে। মাঝরাতে মোটামুটি একটা মীমাংসা হবে। শুভ্র ছাড়াও আরও কিছু লোকজনের নাম খারিজ হবে। অর্ধেকের মতো বাড়িঘর জ্বলিয়ে দেওয়া হবে। আশা করা যাচ্ছে পরদিন ভোর থেকে সব শান্তিমতো চলবে। হেকমত দোয়া ইউনুস পড়ে যাচ্ছে, তার কোনো ভয় নেই। তারপরেও কিছু বলা যায় না। সে মাছির মতো চারদিকে নজর রাখার চেষ্টা করছে। একটা লঞ্চকে কয়েকবার যাওয়া-আসা করতে দেখা গেছে। এখন লঞ্চটা মাঝনদীতে। চর থেকে অনেক দূরে। লঞ্চে কী ঘটনা কে জানে!

মর্জিনা চা নিতে এল। হেকমত গলা নিচু করে বলল, খবর কিছু জানো?

মর্জিনা বলল, জানি না।

ঘটনা যে ঘটবে সেইটা জানো!

না। চা নিতে আসছি চা দেন। ঘটনা নিতে আসি নাই। ঘটনা নিতে আসলে গ্লাস ভর্তি কইরা গরম ঘটনা নিতাম।

হেকমত বলল, নানান কিসিমের লোকজন চরে ঘুরাফিরা করতেছে।

মর্জিনা বলল, করুক। আপনের সমস্যা কী? আপনের বরং লাভ। আপনের দোকানে আইসা নগদ পয়সায় চা খাবে।

তোমার ভাইজানের খবর কী? সে লেখাপড়া নিয়া আছে। একটা ইংরেজি বই আছে। পড়ে। আর কুট কুট কইরা হাসে। বইটার নাম-মাছির রাজা।

হেকমত বলল, তোমারে একটা ভালো পরামর্শ দিব, শুনবা?

মর্জিনা বলল, না। এই দুনিয়াতে আমি একজনের পরামর্শই শুনব। ভাইজানের পরামর্শ।

হেকমত বলল, বেশিদিন তার পরামর্শ শুনতে পারবা বইলা তো মনে হয় না। ঘটনা ঘটে যাবে। তোমার ভাইজান মইরা চেগায়া পইরা থাকবে।

মর্জিনা স্বাভাবিক গলায় বলল, তখন আপনের সাথে হাঙ্গা বসব। আপনে আমারে পরামর্শ দিবেন। আমারে চা খাওয়াবেন আর পরামর্শ দিবেন। ইচ্ছা করলে ভাইজানের মতো ছাইনছের বক্তৃতাও দিতে পারেন। আমরা আগে বান্দর ছিলাম। পরে মানুষ হইছি–এইসব হাবিজাবি।

মর্জিনা চা নিয়ে চলে গেল। হেকমত বিড়বিড় করে বলল, মাগি তোর উপকার করতে চাইছিলাম। তুই বুঝলি না; তোর নিজের দিনও ঘনাইছে।

 

শুভ্ৰ নদীতে গোসল করতে যাবে তার প্রস্তুতি চলছে। গায়ে সরিষার তেল মাখা হচ্ছে। মর্জিনা চায়ের গ্লাস হাতে নিয়ে উপস্থিত হলো।

গরম গরম চা খান। চা খায়া নদীতে নামেন। সাঁতার তো শিখছেন। শিখছেন না?

শুভ্ৰ আনন্দিত গলায় বলল, শিখেছি। এখন ডুব সাঁতার ট্রাই করছি।

মর্জিনা নিজের জন্যে সামান্য রেখে চায়ের গ্লাস শুভ্রর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, চরে মনে হয় গণ্ডগোল হইব।

শুভ্র বলল, আসার পর থেকেই শুনছি চরে গণ্ডগোল হবে। হচ্ছে না তো। একবার হয়ে ঝামেলা শেষ হওয়া ভালো।

মর্জিনা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, গণ্ডগোল তো হইবই। আইজ না হইলে কাইল! আমারে নিয়ে চিন্তার কিছু নাই। চিন্তা আপনেরে নিয়া। আমি যদি আপনের পায়ে ধইরা একটা অনুরোধ করি রাখবেন?

শুভ্ৰ বলল, যে অনুরোধ পায়ে ধরে করতে হয় সেটা অবশ্যই অন্যায় অনুরোধ। এই অনুরোধ আমি রাখব না।

তাইলে কিছুক্ষণ আমার সঙ্গে গল্প করেন, তারপর গোসলে যান।

শুভ্ৰ বলল, অংকের গল্প শুনবে? মর্জিনা হাই তুলতে তুলতে বলল, যা বলবেন তা-ই শুনব। আপনে তো আর পীরিতের গল্প জানেন না। উপায় কী?

শুভ্ৰ চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আগ্রহের সঙ্গে বলল, ৩৭ সংখ্যাটা সম্পর্কে বলি। বিস্ময়কর একটি সংখ্যা। এটা একটা প্ৰাইম নাম্বার। প্রাইম নাম্বার কী জানো?

না।

যে সংখ্যাকে ১ বা সেই সংখ্যা ছাড়া অন্য কোনো সংখ্যা দিয়ে ভাগ দেওয়া যায় না। তাকে বলে প্ৰাইম নাম্বার।

মর্জিনা হাই তুলতে তুলতে বলল, ও আচ্ছা। এখন বুঝলাম।

শুভ্র বলল, ৩৭ বিস্ময়কর সংখ্যা। কারণ ৩৭ দিয়ে ১১১, ২২২, ৩৩৩, ৪88, ৫৫৫, ৬৬৬, ৭৭৭, ১৮৮৮, ৯৯৯ এদের ভাগ দেয়া যায়।

মর্জিনা বলল, ভাগ দিলে লাভ কী?

শুভ্ৰ বলল, তুমি কি সবকিছু লাভ লোকসান দিয়ে বিচার করো?

মর্জিনা বলল, দুনিয়াই চলে লাভ লোকসানে, আমি চলব না? যান সিনান কইরা আসেন। আপনের গফ শুনা আর চোরের পাদ শুনা একই রকম।

শুভ্ৰ বলল, তুমি এই নোংরা কথাগুলি বলা কবে বন্ধ করবে?

মর্জিনা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, যেদিন থাইকা আপনে পীরিতের গাফ বলা শুরু করবেন। সেইদিন ছাড়ব। এখন যান সাঁতার দিয়া আসেন। আইজ কি ছাইনছের বক্তৃতা আছে?

শুভ্র বলল, আছে। আজকের বিষয়বস্তু হলো সূর্য। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে, এটা কি জানো?

মর্জিনা বলল, লোকে আপনেরে পাগল ডাকে, এইটা কি জানেন?

জানি। ডাকুক যার যা ইচ্ছা।

শুভ্র ড়ুব সাঁতারের চেষ্টা করছে। চরের পাড়ে বসে মুগ্ধচোখে দেখছে মর্জিনা। তার কাছে মনে হচ্ছে, এত সুন্দর দৃশ্য সে তাঁর জীবনে আর দেখে নাই। কোনোদিন যে দেখবে এমন সম্ভাবনাও নাই।

ভোর সাতটা।

 

মেরাজউদ্দিন দিনের প্রথম চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। তখনই ভালো খবরটা পেলেন। চিকেন ফেদার কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার আহসান খবর নিয়ে ভোর ছাঁটায় এসে স্যারের ঘুম ভাঙার অপেক্ষায় ছিলেন।

মেরাজউদ্দিন বললেন, শুভ্রর খবর পেয়েছ?

জি।

অথেনটিক খবর?

জি। আপনি বললেই আমি এক্ষুনি রওনা হয়ে যাব। স্যারকে ফিরিয়ে নিয়ে আসব।

মেরাজউদ্দিন বললেন, তোমাকে দেখেই তোমার স্যার হুড়মুড় করে ঢাকার পথে রওনা হবে, এরকম ভাবার কি কোনো কারণ আছে?

আহসান বলল, স্যার, আপনি কি যাবেন? হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করি। চরে। নামিয়ে দেবে।

মেরাজউদ্দিন বললেন, তুমি সে কোথায় আছে বের করেছ, তোমার দায়িত্ত্ব শেষ! তুমি শুধু বড় একটা মাছ কেনার ব্যবস্থা করো।

বড় মাছ?

হ্যাঁ। আমাদের কালচারে শুভ সংবাদের সঙ্গে বড় মাছ যুক্ত।

আহসান বলল, স্যার যদি কিছু মনে না করেন, আপনি কি যুথী মেয়েটাকে পাঠাবার কথা ভাবছেন?

মেরাজউদ্দিন বললেন, হ্যাঁ। মেয়েদের কাছে দুষ্ট শিশু শান্ত করার অনেক কৌশল আছে। যুথী তাকে দুষ্ট শিশু হিসেবেই দেখবে। শান্ত করে নিয়ে আসবে। মেয়েটার এই ক্ষমতা আছে বলে আমার ধারণা। বড় মাছটা যুথীর জন্যে।

 

অনেকক্ষণ ধরেই থেমে থেমে কলিংবেল বাজছে।

যুথীর শরীর খারাপ। সে বিছানায় শুয়ে আছে। তার হাতে খবরের কাগজ। হকারকে সে এই মাস থেকে কাগজ দিতে নিষেধ করেছে। খরচে পোষাচ্ছে না, তারপরেও সে কাগজ দিয়েই যাচ্ছে।

খবরের কাগজে বাংলাদেশের এক শিল্পপতির কাঠমুণ্ডুতে আত্মহত্যার খবরটা ভেতরের পাতায় এসেছে। যুথী ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল-করিম আঙ্কেল আত্মহত্যা টাইপ না। তার কাছে বেঁচে থাকা অত্যন্ত জরুরি। কখন মানুষের মনে কী উঠে আসে কে জানে!

কলিংবেল আবারও বাজছে। যুথী কাগজ হাতেই দরজা খুলল। দরজার বাইরে মেরাজউদ্দিন দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর ড্রাইভারের হাতে বিশাল এক কাতল মাছ।

মেরাজউদ্দিন বললেন, এত বড় কাতল মাছ দেখেছ?

যুথী বলল, না।

মেরাজউদ্দিন বললেন, মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি, ভাবলাম একটা মাছ নিয়ে যাই। মাছটা তোমার বাবা-মাকে দেখাও। তারা আনন্দ পাবেন বলে আমার ধারণা। তারপর ড্রাইভারকে দিয়ে কাটিয়ে আনবে। এত বড় মাছ ঘরে কাটা সম্ভব না!

সাজসজ্জা দেখতে লাগলেন। পেনসিালে আঁকা রবীন্দ্রনাথের একটা বঁধানো ছবি ছাড়া চোখে পড়ার মতো কিছু নেই। ছবিটা সুন্দর। ছবির চোখে স্বপ্ন। হাতে এঁকে চোখে স্বপ্ন আনা সহজ ব্যাপার না। মেরাজউদ্দিন বললেন, কার আঁকা ছবি?

যুথী বলল, আমার বড়ভাইয়ের। তার আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার শখ ছিল। গোপনে ভর্তি হয়েও ছিল। খবর পেয়ে বাবা তাকে জুতাপেটা করে ছড়িয়ে এনেছিলেন।

মেরাজউদ্দিন নিজের মনেই বললেন, Full many a flower is born to blush unseen.

যুথী বাবা-মাকে মাছ দেখাতে নিয়ে গেল। আজহার মাছ দেখে বললেন, এই মাছে কেউ হাত দিবি না। খবরদার। কেউ হাত দিলে হাত কেটে ফেলব। মাছ আমি নিজের হাতে জামাইকে দিয়ে আসব।

যুথী বলল, জামাইটা কে?

আজহার বললেন, আমার সঙ্গে ফাজলামি করিস? ডাক্তারকে তুই চিনিস না? তুই কি ভেবেছিস তোদের গোপন বিয়ের কথা জানি না?

যুথী বলল, জামাই জামাই খেলাটা বন্ধ করো তো বাবা। তোমার এই খেলা অন্য কেউ ধরতে পারুক বা না-পারুক আমি পারি। মাছটা একজন আমার জন্যে আগ্রহ করে এনেছেন। এখানেই রান্না হবে। তুমি চাইলে ডাক্তার সাহেবকে খেতে বলতে পার।

এত বড় মাছ তোকে কে দিল? নিশ্চয়ই কোনো ব্যাপার আছে। আমি বার্লি জল খাই না যে ব্যাপার বুঝব না।

সালমা বললেন, তোর বাবার কথায় যুক্তি আছে। এই এক মানুষ, যুক্তি ছাড়া কোনো কথা বলে না।

আজহার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসলেন।

যুথী মার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার মতো স্বামীপ্রেমে অন্ধ মানুষও আমি আমার জীবনে দেখি নি। এখন আমি কী করব? মাছ ফেরত দিয়ে দিব?

সালমা বললেন, তোর বাপ যেটা বলে সেটা করবি। এই সংসারের প্রধান তোর বাপ, তুই না।

আজহার বললেন, একজন শখ করে একটা মাছ এনেছে। ফেরত দিলে মনে কষ্ট পাবে। মানুষকে কষ্ট দেওয়া আর কাবাঘরের পাথর খুলে নেওয়া একই জিনিস।

যুথী বলল, মাছটা তাহলে কাটতে পাঠাই?

আজহার বললেন, এই মাছ আমি কাটিয়ে আনব। ইনসট্রাকশান দিয়ে কাটাতে হবে। রাতে পোলাও করতে হবে। এত বড় মাছ পোলাও ছাড়া জমবে না। পোলাওয়ের চাল ঘরে আছে না কিনতে হবে? ঘরে তো কিছুই থাকে না। মাছটা এনেছে কে?

শুভ্রর বাবা এনেছেন।

বুঝাই যাচ্ছে উনি বিশিষ্ট ভদ্রলোক। যুথী, ভালোমতো আদর যত্ন কর। আমি সামনে যাব না। পাগল মানুষ, কী বলতে কী বলে ফেলব।

যুথী লক্ষ্য করুল, অনেকদিন পর তার বাবা স্বাভাবিক আচরণ করা শুরু করেছেন। একটা বড় মাছ পরিস্থিতি বদলে দিয়েছে।

 

মেরাজউদ্দিন চা খেতে খেতে যুথীর সঙ্গে গল্প করছেন। যুথী খুবই অস্বস্তিতে পড়েছে, কারণ তাঁকে যে চায়ের কাপটা দেওয়া হয়েছে সেখানে ঠিক চুমুক দেওয়ার জায়গাটা সামান্য ভাঙা। মেরাজউদ্দিন ভাঙাটা সরিয়ে সাবধানে চুমুক দিচ্ছেন। ঘরে ভালো কাপও ছিল। বেছে বেছে এই কাপটাই সে দিল! যুথী বলল, স্যার, আমি আপনার কাপটা বদলে দেই?

মেরাজউদ্দিন বললেন, কাপ বদলাতে হবে না। এই কাপে চা খেয়ে আমি খুবই আনন্দ পাচ্ছি। আনন্দ পাওয়ার কারণটা শুনতে চাও?

চাই।

আমার বাবা ছিলেন স্কুল টিচার। একজন স্কুল টিচারের আর্থিক অবস্থা তো বুঝতেই পার। বাবার জন্যে যে চায়ের কাপটা ছিল, সেটা ঠিক এই জায়গায় ভাঙা ছিল। বাবাকে নতুন কাপ অনেকবার কিনে দেওয়া হয়েছে, তিনি তারপরেও ভাঙা কাপে চা খেয়ে গেছেন। তিনি বলতেন, আমি ভাঙা কপাল নিয়ে জন্মেছি। আমি তো ভাঙা কাপেই চা খাব।

যুথী বলল, তিনি কি আপনার উত্থান দেখে যেতে পেরেছেন?

মেরাজউদ্দিন বললেন, না। তিনি কিছুই দেখে যেতে পারেন নি। মৃত্যুশয্যায় তিনি আমাকে বললেন, উত্তরাধিকারসূত্রে ছেলেমেয়েরা অনেক কিছু পায়। আমি তোর জন্যে কিছু ঋণ রেখে গেলাম। তুই কিছু মনে করিস না। ঋণ শোধের ব্যবস্থা করিস।

মা, আমি এই কাপে আরেক কাপ চা খাব। এবং যাবার সময় এই কাপটা সঙ্গে করে নিয়ে যাব। সস্তা সেন্টিমেন্টালিটি আমার মধ্যে নেই। বাবার কথা হঠাৎ মনে হওয়ায় নিজের ভেতর খানিকটা স্যাতস্যাতে ভাব চলে এসেছে।

যুথী আরেক কাপ চা নিয়ে এল। মেরাজউদ্দিন বললেন, আমি তোমার কাছে একটা কাজে এসেছি। আমার ছেলে কোথায় আছে, কোন চরে বাস করছে তা তুমি খুঁজে বের করবে এবং তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। আমার ধারণা, তোমার চেয়ে ভালো করে কেউ এই কাজটা করতে পারবে না। মা, ঠিক আছে?

যুথী বলল, আমি আজই রওনা হব। মেরাজউদ্দিন বললেন, ছেলের চিন্তায় তার মা নানান পাগলামি শুরু করেছেন। মাঝরাতে বিছানায় উঠে বসে শুভ্ৰ কই? শুভ্ৰ? বলে চোঁচাতে থাকেন। ঠিক করেছি। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেব।

উনি তার ছেলেকে খুব পছন্দ করেন?

কোন মা তার ছেলেমেয়েকে পছন্দ করে না তুমি বলো দেখি? কোনো ছেলে যদি খুন করে এসে মায়ের পাশে দাঁড়ায়, মা তার মাথায় হাত রাখবেন।

যুথী বলল, বাবা মাথায় হাত রাখবেন না?

মেরাজউদ্দিন বললেন, না। সব সন্তান তার মায়ের অংশ। বাবার অংশ নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *