০৯. মনিরুজ্জামান ওসি সাহেবের সামনে

মনিরুজ্জামান ওসি সাহেবের সামনে বসে আছে। মনিরুজ্জামানের গায়ে থ্রি পিস সুট, লাল টাই! কোটের বাটন হোলে পাতাসহ গোলাপের কুঁড়ি। গোলাপটা ঠিক আছে-পাতা দুটি মরে গেছে। মনিরুজ্জামানের মুখে তেলতেলে ভাব হাসি। সে আজ সারা দিনে প্রচুর পান খেয়েছে বলে মনে হয়। দাঁত খয়েরি বর্ণ ধারণ করেছে। ঠোঁট দুটিও লাল। মনিরুজ্জামানের হাতে সাদা রুমাল। কিছুক্ষণ পরপর ঠোঁট মোছার জন্যে রুমাল ব্যবহার করতে হচ্ছে।

মনিরুজ্জামানের পাশে আছে হারুনুর রশীদ। হারুনুর রশীদের কাজ হচ্ছে মনিরুজ্জামানকে ছায়ার মতো অনুসরণ করা। হারুনুর রশীদ পাতলা একটা পাঞ্জাবি পরে আছে। নিচে গেঞ্জি নেই বলে পাঞ্জাবির ভেতর দিয়ে তার লোমভৰ্তি বুক দেখা যাচ্ছে। হারুনুর রশীদের মুখ খুব গম্ভীর। সেই তুলনায় মনিরুজ্জামানের মুখ হাসি-হাসি।

মনিরুজ্জামান বলল, তারপর ওসি সাহেব, ভাই, কেমন আছেন বলেন দেখি।

জি, ভাল আছি।

সকলে চলে আসতাম–ফার্স্ট ফ্লাইট পেলাম না। গাড়িতে রওনা হলে পৌঁছতে পৌঁছতে বিকাল হবে। সেকেন্ড ফ্লাইটে এসেছি।

ভালো করেছেন।

আমি এসেই আপনার বিষয়ে খোঁজখবর করেছি; খবর যা পেয়েছি তাতে মনটা ভালো হয়েছে। আমি হারুনুর রশীদকে বললাম, এরকম অফিসার যদি দশটা থাকে, তাহলে দেশ ঠিক হয়ে যায়। কী হারুন, বলি নাই?

হারুন হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ে।

মনে হচ্ছে সে কথা কম বলে। কিংবা মাথা নাড়াই তার চাকরি।

দেশের আজ যে অবস্থা তা কিন্তু দেশের জনগণের জন্যে না। খারাপ অফিসারের জন্যে। জনগণ কখনো ভুল করে না।

আপনি আমার বিষয়ে কী খোঁজ পেয়েছেন?

সব খোঁজই পেয়েছি ভাই। প্ৰদীপ জ্বলে উঠলে দূর থেকে টের পাওয়া যায়-আলো দেখা যায়। বুঝলেন রহমান সাহেব, আমি খবর পেয়েছি, আপনি অত্যন্ত অনেস্ট অফিসার। ঘুষ খান না। অন্যায় করেন না। ঠিক শুনি নাই রহমান সাহেব?

জি, ঠিকই শুনেছেন।

আপনার নাম রহমান তো?

আব্দুর রহমান আমার নাম।

এত বড় একটা কাজ যে আপনি করলেন, অনেস্ট অফিসার বলেই করতে পারলেন। ঘুষ-খায় অফিসারের আত্মা থাকে ছোট—সাহস থাকে না। কী হারুন, আমি এই কথা বলি নাই?

হারুন আবার হ্যাঁ-সূচক ঘাড় নাড়ল।

মনিরুজ্জামান গলা নিচু করে বলল, এত বড় একটা কাজ সুন্দরভাবে করার জন্যে আমি ছোটভাই হিসেবে আপনাকে সামান্য উপহার দিতে চাই। না করবেন না। না করলে মনে ব্যথা পাব।

মনিরুজ্জামান হারুনুর রশীদের দিকে তাকিয়ে ইশারা করল। হারুনুর রশীদ ব্রিফকেস খুলে ব্ৰাউন পেপারের একটা মোটা মোড়ক ওসি সাহেবের ফাইলের কাছে রেখে ভারি গলায় বলল—ফিফটি আছে।

ওসি সাহেব বললেন, ফিফটি কি?

ফিফটি থাউজেন্ড স্যার।

মনিরুজ্জামান বলল, উপহার কী কিনব, কী আপনার পছন্দ, তা তো জানি না। এই জন্যেই ক্যাশ। পছন্দমতো একটা কিছু কিনে নেবেন ভাই সাহেব। ছোট ভাইয়ের ওপর মনে কিছু নিবেন না।

আচ্ছা।

বুঝলেন ভাই সাহেব, খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম। আপনি রাগই করেন কি-না। উপহার এক জিনিস আর ঘুষ ভিন্ন জিনিস।

তা তো বটেই।

এখন ভাই সাহেব, মেয়েটাকে বের করে দেন-ঢাকায় নিয়ে যাই।

মেয়েটাকে বলছেন কেন? বলুন স্ত্রীকে বের করে দিন।

ও হ্যাঁ হ্যাঁ। অল্পদিন হয়েছে বিয়ে, এখনো অভ্যস্ত হইনি। যাই হোক, আমি স্ত্রীকে নিয়ে যেতে এসেছি। আমার স্ত্রীর যে বড় চাচা উনিও আসছেন। বাই রোডে আসছেন।

ওসি সাহেব শান্ত গলায় বললেন, ব্যাপারটা আপনি যত সহজ ভাবছেন তত সহজ না। সামান্য জটিলতা আছে।

কী জটিলতা? মনিরুজ্জামান চোখ সরু করে বলল।

আপনার স্ত্রী জবানবন্দি দিয়েছেন, আপনার সঙ্গে বিয়ে হয় নি। যে রাতে বিয়ে হবার কথা সেই রাতে উনি পালিয়ে গেছেন।

ও বললে তো হবে না। ও তো এখন এরকম বলবেই। আরো যে জঘন্য কিছু বলে নাই সেটাই আমার সৌভাগ্য। বিয়ে যে হয়েছে তার কাগজপত্র আছে। দেখতে পারেন। হারুন, কাবিননামাটা দেখাও তো।

হারুন ব্রিফকেস খুলে কাবিননামা বের করল।

মনিরুজ্জামান বলল, খুব ভালো করে দেখেন। আমার স্ত্রীর দস্তখত আছে। দেখতে পাচ্ছেন?

জি।

চারজন সাক্ষী আছে। সাক্ষী কারা এইটাও একটু লক্ষ করুন। আপনারা পুলিশের লোক, কিছুই আপনাদের চোখ এড়াবে না। তবু মনে করিয়ে দেয়া। একজন আছেন মিনিস্টার, প্রতিমন্ত্রী না, আসল মন্ত্রী। একজন আর্মির ব্রিগেডিয়ার, একজন হচ্ছেন ইউনিভার্সিটির ফুল প্রফেসর। আরেকজন বিশিষ্ট শিল্পপতি এ আর খান। নাম শুনেছেন আশা করি।

বলেন কী! এঁরা সবাই কি আপনার আত্মীয়?

জি না। তবে পরিচিত।

সাধারণত দেখা যায়, বিয়েতে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনরা সাক্ষী হয়। আপনার বেলাতেই ব্যতিক্রম দেখলাম।

আমার সবই ব্যতিক্রম। দেখলেন না—বৌকে বিয়ের পরেই ভাগিয়ে নিয়ে চলে গেল। তবে হজম করতে পারে নাই-বদহজম হয়ে গেছে। হা-হা-হা।

আপনাকে খুব আনন্দিত মনে হচ্ছে।

অবশ্যই আনন্দিত। আম ছালা সব ধরা পড়ে গেছে। সাথের বদগুলোকে মাইন্ড পিটন দিয়েছেন তো?

জি না, দেই নাই। ভদ্রলোকের ছেলেপুলে, পিটন দিয়ে শেষে কোন বিপদে পড়ি!

কোনো বিপদে পড়বেন না। আমি তো আছি আপনার পিছনে। আমি মানুষটা ছোটখাটো কিন্তু আল্লাহর দয়ায় আমার যোগাযোগ ভালো।

সেটা বুঝতে পারছি।

অনেকেই বুঝতে পারে না। প্রয়োজন বোধ করলে হেভি পিটন দিয়ে দেন। এদের চুরির মামলায় ফেলে নাকানি-চুবানি খাওয়ানো যায় না? আমার স্ত্রীর গায়ে চার লাখ টাকার জড়োয়া গয়না ছিল—এই মামলা … ধান দেখেছে, বুলবুলি দেখে নাই। এইবার বুলবুলি দেখবে। ছোট্ট বুলবুলি।

হারুনুর রশীদ বলল, স্যার আপনি কাইন্ডলি বেগম সাহেবকে রিলিজ করে দেন। আমরা ঢাকার দিকে রওনা হয়ে যাই। বেলাবেলি পৌঁছতে হবে।

এত সহজে তো ভাই হবে না। মামলা করেছেন, আমরা আসামি কোর্টে চালান দেব। কোর্ট যা করার করবে।

সে কী?

আপনি মামলা করেছেন ঢাকায়—আমরা আসামি ঢাকা পাঠাব।

তাহলে এত যন্ত্রণার প্রয়োজন নাই। মামলা তুলে নিব। আপনি আমার স্ত্রীকে শুধু রিলিজ করে দিন।

সেটাও সম্ভব না। একটা বেড়াছেড়া লেগে যাবে বলে মনে হয়।

কী বেড়াছেড়া?

যাদের থানা-হাজতে আটকে রেখেছি তারা এত সহজে ছেড়ে দেবে তা মনে হয় না।

যারা আমার স্ত্রীকে নিয়ে এসেছে ওদের ওপর আমার কোনো রাগ নাই। ছেলেমানুষ ভুল করেছে। মানুষমাত্রই ভুল করে। তাছাড়া সমস্যাটা মূলত তৈরি করেছে আমার স্ত্রী। কাজেই শাস্তি যা দেবার আমি আমার স্ত্রীকেই দেব। আপনি ওদের ছেড়ে দিন। আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে চলে যাই।

আপনি বিকেলে আসুন।

বিকেলে আসব কেন?

আমি আসতে বলছি। এইজন্যে আসবেন।

ওসি সাহেব, আপনি তো ঝামেলা করছেন। আমি ঝামেলা পছন্দ করি না।

ঝামেলা আমিও পছন্দ করি না। মহিলাকে আমি ছেড়ে দিলাম, আপনিও গাড়িতে করে জোর করে নিয়ে গেলেন, পরে দেখা গেল আসলেই আপনাদের বিয়ে হয় নি।

কাগজপত্র দেখালাম না?

কাগজপত্রের দাম নাই।

মনিরুজ্জামান সাহেব, পুলিশে কাজ করছি। দশ বছর ধরে—এই দশ বছরে একটা জিনিস শিখেছি-মানুষের চেয়ে বেশি মিথ্যা বলে কাগজ।

সিগনেচার আপনি বিশ্বাস করেন না?

জি না।

আমি কিন্তু জানি কী করে বিশ্বাস করাতে হয়। বিশ্বাস করাবার মতো ব্যবস্থা নিয়ে আসব।

আসুন। বিশ্বাস করাতে পারলে আমি ওনাকে ছেড়ে দেব। আপনি নিয়ে চলে যাবেন। শান্তি দিতে চাইলে দেবেন। পথেই কোথাও গলা টিপে মেরে ফেলতে পারেন। আপনার সমস্যা হবে না। ডাক্তাররা পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আপনার কথামতো দেবে। পুলিশও ফাইনাল রিপোর্ট যা চাইবেন তাই দেবে।

শুধু আপনি দিবেন না?

জি না।

কোন দিবেন না?

কারণ আমি মানুষটা খারাপ।

আমি ঠিক এক ঘণ্টা পরে আসব।

এক ঘন্টা পরে এলে হবে না। আপনাকে বিকেলে আসতে বলেছি—আপনি বিকেলে আসবেন।

হাতিঘোড়া গেল তল, চার পয়সার ওসি বলে কত জল?

ওসি সাহেব হাই বলল, মনিরুজ্জামান বলল, মেয়েটা কোথায়? আমি ঐ মেয়েটার সঙ্গে কথা বলব। আমাকে কথাও বলতে দেবেন না?

দেব। কথা বলতে দেব।

মনিরুজ্জামান হারুনুর রশীদের দিকে তাকিয়ে ইশারা করল।

হারুনুর রশীদ অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে পঞ্চাশ হাজার টাকার ব্ৰাউন পেপারের প্যাকেট হাতে নিয়ে ঝট করে ব্রিফকেসে ভরে ফেলল। কাজটা সে করল দেখার মতো দ্রুততায়।

 

পাগলী নতুন শাড়ি পরেছে। মাথায় চুল আঁচড়েছে। তাকে আর চেনা যাচ্ছে না। সে নিজেও মনে হয় হকচকিয়ে গেছে। চুপচাপ বসে আছে, কোনোরকম হৈচৈ করছে না। কিছুক্ষণ পরপর নিজের দুটা হাত তার চোখের সামনে ধরে গভীর মনোযোগের সঙ্গে কী যেন দেখছে। জরী বলল, তুমি কী দেখো?

পাগলী হাসল।

নাম কী তোমার?

পাগলী জবাব দিল না।

তোমার কি শাড়িটা পছন্দ হয়েছে?

পাগলী হ্যা-সূচক মাথা নাড়ল এবং আবারও তার দুটা হাত চোখের সামনে মেলে ধরল।

মুনা বলল, জরী আপা, মেয়েটাকে কী সুন্দর লাগছে দেখছেন?

হুঁ, দেখছি।

এত সুন্দর একটা মেয়ে পথে ঘোরে! আশ্চর্য!

নইমা শুয়ে আছে। কম্বল বিছানো হয়েছে। কম্বলের উপর ফুলতোলা নতুন চান্দর। নতুন বালিশ। সবই আনানো হয়েছে। নইমা বালিশে মাথা রেখেই ঘুমুচ্ছে। তার জ্বর এসেছে। মুনা বসে আছে। নইমার মাথার কাছে।

আনুশকা বলল, ওর জ্বর কি বেশি মুনা?

হুঁ।

সমস্যা হয়ে গেল তো!

আপনাকে দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে না। আপা কোনো সমস্যা আছে। শান্তমুখে বসে আছেন।

আনুশকা হাসল। মুনা বলল, আপা, আমাদেরকে কি ওরা এখানে রাতেও আটকে রাখবে?

না, ছেড়ে দেবে। সন্ধ্যার আগেই ছেড়ে দেবে।

কীভাবে বলছেন?

আমাদের সঙ্গে শুভ্ৰ আছে না? শুভ্রর কোনো সমস্যা তার বাবা-মা হতে দেবেন না।

ওনারা তো আর জানেন না এখানে কী হচ্ছে।

ইতোমধ্যে জেনে গেছেন বলে আমার ধারণা। তারা তাদের ছেলের ওপর লক্ষ রাখবেন না, তা হয় না।

আনুশকার কথার মাঝখানেই মনিরুজ্জামান এসে দাঁড়াল। জরী হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। ভূত দেখলেও কেউ এত চমকায় না।

মনিরুজ্জামান বলল, খেল তো ভালো দেখালে। যাই হোক, এখন সমস্ত খেলার অবসান হয়েছে। বিকেলে তোমাকে নিয়ে ঢাকা রওনা হব।

আমাকে নিয়ে ঢাকা রওনা হবেন মানে? আমি আপনার সঙ্গে ঢাকা যাব কেন?

স্বামীর সঙ্গে কোথাও যাবে না, এটা কেমন কথা?

আপনি আমার স্বামী?

অবশ্যই। বিয়ের কাবিননামাও নিয়ে এসেছি। ওসি সাহেবকে দেখলাম।

বিয়ের কাবিননামা?

এক লক্ষ এক টাকা কাবিনের কাবিননামা। বিকেলের মধ্যে তোমার বড় চাচাও চলে আসবেন।

জরীর মুখে কথা আটকে গেল। কী একটা কথা অনেক বার বলতে গিয়েও বলতে পারল না।

মনিরুজ্জামান হৃষ্ট গলায় বলল, আচ্ছা যাই—দেখা হবে বিকেলে।

জরী তাকাল আনুশকার দিকে। আনুশকা হাসছে। আনুশকার হাসি দেখে পাগলীও হাসতে লাগল। এতে নইমার ঘুম ভেঙে গেলো। সে উঠে বসল এবং আনন্দিত গলায় বলল, কী হয়েছে? কী হয়েছে?

মনিরুজ্জামান আর দাঁড়াল না। তার অনেক কাজ বাকি আছে। কাজ শেষ করতে হবে। নষ্ট করার মতো সময় হাতে নেই। ওসির স্ক্রু টাইট দিতে হবে, তবে যাবার আগে দলের ছেলেগুলিকে দেখে যাওয়া দরকার।

রানা দেখল, থ্রি পিস সুট পরা এক ভদ্রলোক আসছেন। সে উৎসাহের সঙ্গে উঠে বসল। মনে হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ কেউ আসছে। তাদের মুক্তির ব্যবস্থা হচ্ছে। রানাই আগ বাড়িয়ে বলল, স্লামালিকুম।

মনিরুজ্জামান বলল, ওয়ালাইকুম সালাম। আপনারা ভালো?

জি স্যার, আছি মোটামুটি।

কষ্ট হয় নি তো?

মোতালেব বলল, কোনো কষ্ট হয় নি। অত্যন্ত আনন্দে সময় কাটছে। সময় কি ব্যাপার আগে জানতাম না। এখন জানি। আরো বৎসরখানেক এখানে থাকতে পারলে সায়েন্সের অনেক কিছু শিখতাম। আপনাকে তো ভাই চিনতে পারিছ না-আপনার পরিচয়?

আমার নাম মনিরুজ্জামান। আমি জরীর হাসবেন্ড।

কার হাসবেন্ড?

জরীর। আমি তাকে নিতে এসেছি। বিকেলে ওকে নিয়ে চলে যাব। আপনারা যেখানে যাচ্ছেন চলে যান। আপনাদের ওপর আমার কোনো রাগ নেই। আপনাদের একটু সমস্যা হলো—তার জন্যে আমার স্ত্রীর হয়ে আমি আপনাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।

রানা বলল, কী বললেন? আপনি কে?

জরীর হাসবেন্ড।

শুভ্ৰ বিস্মিত হয়ে বলল, জরী তো বিয়ে করে নি!

মনিরুজ্জামান হাসিমুখে বলল, আপনাদের তাই বুঝিয়েছে, ঘটনা ভিন্ন। বিয়ে হয়েছে, কাবিন হয়েছে। এক লক্ষ এক টাকা মোহরানা। যাই, কেমন? খোদা হাফেজ।

মনিরুজ্জামান হন।হন করে এগুচ্ছে। তার পেছনে হারুনুর রশীদ। হারুনুর রশীদ যে এতটা লম্বা তা আগে বোঝা যায় নি। এখন বোঝা যাচ্ছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, একটা তালগাছ ব্রিফকেস হাতে কুজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

দলের সবাই খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। সঞ্জু বলল, অবস্থা ভালো মনে হচ্ছে না। শুভ্ৰ, তুই কি একটা কাজ করবি?

কী কাজ?

তুই তোর বাবাকে টেলিফোন করে ঘটনাটা বলবি? জরীকে একটা লোক জোর করে ধরে নিয়ে চলে যাবে-আর আমরা যাব দারুচিনি দ্বীপে। তা কী করে হয়?

শুভ্ৰ চুপ করে আছে। সঞ্জু বলল, কথা বলছিস না কেন?

বাবাকে কী বলব?

তোর কিছু বলতে হবে না। তোর বাবাই তোর ভেতর থেকে সব কথা টেনে বের করে নিয়ে আসবেন।

শুভ্ৰ অস্বস্তির সঙ্গে চুপ করে আছে। রানা রাগী ভঙ্গিতে বলল, তুই এমন স্টোন ফেস হয়ে গেলি কেন? বাবার সঙ্গে কথা বলতে লজ্জা লাগছে?

শুভ্র বলল, বাবাকে কিছু বলার দরকার নেই।

বলার দরকার নেই কেন?

আমার ধারণা বাবা সবই জানেন।

গাধার মতো কথা বলবি না শুভ্ৰ। তোর বাবা কোনো পীর-ফকির না যে সব জানে। তোকে টেলিফোন করতে বলা হয়েছে, তুই টেলিফোন করবি এবং কাঁদো-কাঁদো গলায় বলবি, আমাদের রক্ষা করো। এস ও এস। বাঁচাও বাঁচাও।

এরা কি আমাদের টেলিফোন করতে দেবে?

এইটা একটা টেকনিক্যাল কথা বলেছিস। তোকে টেলিফোন করতে দেবে। কি-না সেটা হচ্ছে কথা। সম্ভবত দেবে না—তবে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

বল্টু বলল, প্রয়োজনে আমি ওসি সাহেবের পা চেপে ধরব। অনেক ধরনের মানুষের পা ধরেছি, পুলিশের পা কখনো ধরি নি। পা ধরে সবচে বেশি মজা কখন পেয়েছিলাম জানিস? একবার এক পীর সাহেবের পা ধরেছিলাম-কী মোলায়েম পা! ধরলে ছাড়তে ইচ্ছা করে না।

 

শুভ্র ওসি সাহেবের সামনে বসে আছে। ওসি সাহেব টেলিফোন সেট তার দিকে বাড়িয়ে বললেন, নিন, টেলিফোন করুন।

শুভ্ৰ বিব্রত মুখে বলল, আমি নাম্বার ভুলে গেছি।

নাম্বার ভুলে গেছেন মানে? নিজের বাসার নাম্বার মনে নেই?

জি না। বাসায় তো কখনো টেলিফোন করা হয় না। তবে আমার হ্যান্ডব্যাগের পকেটে একটা ডায়েরি আছে—সেখানে নাম্বার লেখা আছে।

আচ্ছা, হ্যান্ডব্যাগ আনিয়ে দিচ্ছি। শুভ্র ডায়েরির জন্যে অপেক্ষা করছে। ওসি সাহেব কৌতূহল এবং আগ্রহ নিয়ে শুভ্ৰকে দেখছেন।

টেলিফোন ধরলেন শুভ্রর মা। শুভ্র বলল, মা, কেমন আছ?

রাহেলা প্ৰায় হাহাকার করে উঠলেন, তুই কেমন আছিস বাবা?

ভালো।

তোর চশমা! তোর চশমা আছে?

হুঁ, আছে।

খাওয়া-দাওয়ার কি কোনো সমস্যা হচ্ছে?

না, কোনো সমস্যা হচ্ছে না।

বাইরের পানি খাচ্ছিস না তো?

উঁহু।

একসঙ্গে বেশি করে পানির বোতল কিনে নে।

আচ্ছা মা, নেব।

গত রাতে ভালো ঘুম হয়েছিল তো?

হুঁ।

এদিকে আমি সারারাত ঘুমুতে পারি নি। শুধু দুঃস্বপ্ন দেখেছি। শুভ্ৰ, তুই ভালো আছিস তো?

আমি ভালো আছি মা।

তোর বন্ধুরা? ওরা ভালো আছে তো?

হ্যাঁ, ওরাও ভালো আছে। আচ্ছা মা, বাবা কি অফিসে, না বাসায়?

তোর বাবা বাসায়। আজ কোথাও যায় নি। ওর শরীরটা নাকি ভালো না।

বাবা কী করছেন?

বিছানায় শুয়ে শুয়ে রেস্ট নিচ্ছে। বই পড়ছে।

কী বই পড়ছেন মা?

কী বই পড়ছে তা তো দেখিনি—দেখে আসব?

না, তুমি বাবাকে দাও।

তুই আমার সঙ্গে আরেকটু কথা বল শুভ্ৰ। তারপর তোর বাবাকে দেব।

উঁহু, তুমি আগে বাবাকে দাও। তারপর আমি আবার তোমার সঙ্গে কথা বলি।

তুই কি আমাকে মিস করছিস শুভ্র?

হুঁ। মা, তুমি বাবাকে দাও।

ইয়াজউদ্দিন সাহেব টেলিফোন-রিসিভার হাতে নিয়ে ভারি গলায় বললেন, হ্যালো।

শুভ্র বলল, বাবা, তুমি কী বই পড়ছ? তোমার হাতে এখন কী বই?

বইটার নাম হলো Moon is down.

শুভ্ৰ খুশি-খুশি গলায় বলল, তুমি আমার টেবিল থেকে বইটা নিয়েছ, তাই না?

হুঁ।

এটা তোমার জন্মদিনে দেবো বলে আনিয়ে রেখেছিলাম। প্যাকেট করা বই তুমি খুললে কেন? না বলে প্যাকেট খোলা তো নিষেধ।

মানুষের প্রকৃতি এমন যে সে সব সময় নিষেধ অমান্য করে।

বইটা তোমার কেমন লাগছে বাবা?

ভালো, খুব ভালো।

তোমার কি চোখে পানি এসেছে?

এখনো আসেনি।

পঞ্চাশ পৃষ্ঠার পর থেকে দেখবে—একটু পরপর চোখ ভিজে উঠেছে। তুমি ক পৃষ্ঠা পর্যন্ত পড়েছ?

কুড়ি-পঁচিশ পৃষ্ঠা হবে।

বাবা তোমার সঙ্গে আমার খুব জরুরি কয়েকটা কথা আছে।

এখন তুমি ছুটি কাটাতে গেছ, এখন আবার জরুরি কথা কী? এখন শুধু হালকা কথা বলবে।

কথাটা খুব জরুরি বাবা।

আমি তোমার কোনো জরুরি কথা শুনতে চাচ্ছি না।

বাবা, আমরা খুব বিপদে পড়েছি।

মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করেছ, বিপদে তো পড়বেই। বিপদে পড়বে, আবার বিপদ থেকে বের হয়ে আসবে। আবার পড়বে। দিস ইজ দ্য গেম।

পুলিশ আমাদের ধরে এনে হাজতে রেখে দিয়েছে।

ও, আচ্ছা।

আমাদের সঙ্গে জরী নামের যে মেয়েটি আছে—তার হাসবেন্ড এসেছে তাকে নিয়ে যেতে।

হাসবেন্ড নিয়ে যেতে চাইলে তো তোমরা কিছু করতে পারবে না। পুরুষশাসিত সমাজে স্বামীর অধিকার স্বীকৃত।

লোকটির সঙ্গে জরীর বিয়ে হয় নি। লোকটা মিথ্যা কথা বলছে। মিথ্যা কথা বলে মেয়েটিকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে।

উল্টোটাও তো হতে পারে। হয়তো মেয়েটাই মিথ্যা বলছে। মেয়েরা পুরুষদের চেয়েও গুছিয়ে মিথ্যা বলতে পারে। একজন পুরুষ যখন মিথ্যা কথা বলে তখন বোঝা যায়। সে মিথ্যা বলছে। কিন্তু একটা মেয়ে যখন মিথ্যা বলে তখন বোঝার কোনো উপায়ই নেই সে মিথ্যা বলছে।

তুমি খুবই অদ্ভুত কথা বলছ বাবা।

এটা আমার কথা না। যে বইটা এই মুহূর্তে আমি পড়ছি সেই বইয়ের নায়ক বলছে, তোর প্রিয় বই Moon is down-এ-ই এটা লেখা।

ঐ লোকটা একটা ফ্রড বাবা। ওর প্রতিটা কথাই মিথ্যা।

ও আচ্ছা।

বাবা শোনো—আমরা ভয়ংকর বিপদে পড়েছি। তুমি কি কিছু করতে পারো আমাদের জন্য?

না।

না কেন?

আমি তোমাকে বিপদে ফেলি নি, কাজেই বিপদ থেকে তোমাকে টেনে তোলার দায়িত্বও আমার নয়। তুমি স্বাধীনতা চেয়েছ, তোমাকে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। বন্ধু-বান্ধব নিয়ে রওনা হয়েছ। এখন তুমি হুট করে আমার সাহায্য চাইতে পারো না।

শুভ্ৰ চুপ করে রইল। ইয়াজউদ্দিন সাহেব বললেন, তা ছাড়া আমি সারা জীবন বেঁচে থাকব না। এ জীবনে আমি যা সঞ্চয় করেছি সেইসব রক্ষার দায়িত্ব তোমার। আজ যদি এই সামান্য বিপদ থেকে নিজের চেষ্টায় বের হতে না পারো, তাহলে ভবিষ্যতে বড় বড় বিপদ থেকে উদ্ধার পাবে কী করে? বুঝতে পারছি আমি কী বলছি?

পারছি।

যখন কোনো সমস্যা আসবে তখন সমস্যাটাকে একটা বস্তুর মতো তোমার সামনের টেবিলে রাখবে। নানান দিক থেকে সমস্যাটা দেখবে। এক সময় লক্ষ করবে সমস্যাটির একটা দুর্বল দিক আছে। তুমি আক্রমণ করবে দুর্বল দিকে।

আমার সমস্যার দুর্বল দিক কোনটা বাবা?

যে লোক সমস্যা তৈরি করেছে, মেয়েটির হাসবেন্ড বলে যে নিজেকে দাবি করছে সেই সবচে দুর্বল। সে দুর্গ তৈরি করেছে মিথ্যার উপর। এ জাতীয় লোকেরা ভীতু প্রকৃতির হয়। এদের ভয় দেখালে এরা অসম্ভব ভয় পায়। এদের ভয় দেখাতে হয়। ছোটখাটো ভয় না। বড় ধরনের ভয়।

ভয় কীভাবে দেখাব?

সেটা তুমি জানো কীভাবে ভয় দেখাবে।

আমি ভয় দেখালেই সে ভয় পাবে কেন?

তুমি ভয় দেখালে সে ভয় পাবে, যদি সে জানে তুমি কে। তোমার ক্ষমতা কী?

বাবা, আমার তো কোনো ক্ষমতা নেই।

তোমার ক্ষমতা হচ্ছে, তোমার অর্থ! তোমার সঙ্গে চেকবই আছে না?

জি, আছে।

তুমি যদি চেকবই বের করে এক কোটি টাকার একটা চেক লিখে দাও, সেই চেক ফেরত আসবে না। ব্যাংক সেই চেক অনার করবে। এইখানেই তোমার ক্ষমতা। এই ক্ষমতা দিয়ে তুমি যে কোনো মানুষকে ভয় দেখাতে পারো।

কিন্তু বাবা, এই ক্ষমতা তো মিথ্যা ক্ষমতা। হ্যাঁ, এই ক্ষমতা মিথ্যা। কোনো ক্ষমতাবান লোকই এই ব্যাপারটা জানে না। Thats the thing about you. শুভ্র অনেকক্ষণ কথা হলো, এখন টেলিফোন রাখি?

তুমি আর কিছু বলবে না বাবা?

হ্যাঁ বলব। I love you my son. এবং তুমি তোমার মুন ইজ ডাউন বইটিতে আমার সম্পর্কে যে উক্তি করেছ তা আমি পড়েছি। থ্যাংক য়্যু।

ইয়াজউদ্দিন টেলিফোন নামিয়ে রেখে হাতের বই খুললেন। প্রথম পাতায় শুভ্র সবুজ কালি দিয়ে লিখে রেখেছে

বাবা,
জন্মদিন শুভেচ্ছা।
আমার খুব ইচ্ছা করে আমি তোমার মতো হই।
শুভ্র।

ইয়াজউদ্দিন দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে বললেন, শুভ্ৰ শুভ্রর মতোই থাকুক। ওকে আমার মতো হতে হবে না।

রাহেলা বললেন, তুমি টেলিফোন রেখে দিলে কেন? আমি শুভ্রের সঙ্গে কথা বলতাম।

স্যারি। আমি আবার যোগাযোগ করে দিচ্ছি।

না লাগবে না।

রাহেলার চোখে পানি এসে গেছে। তিনি চোখ মুছছেন।

ওসি সাহেব বললেন, শুভ্র সাহেব, আপনার টেলিফোনের কথা তো শেষ হয়েছে।

জি।

কী বললেন আপনার বাবা?

বাবা আমাকে মনিরুজ্জামান নামের ঐ লোকটার সঙ্গে কথা বলতে বললেন।

কথা বলবেন?

জি, কথা বলব।

উনি চলে এসেছেন। আমি ডেকে দিচ্ছি। আপনারা কথা বলুন। নিরিবিলি কথা বলুন।

ওসি সাহেব, আপনিও থাকতে পারেন।

মনিরুজ্জামান এসে বসল শুভ্রর সামনের চেয়ারে। মনিরুজ্জামানের পাশে বসেছে হারুনুর রশীদ। সে কৌতূহলী হয়ে শুভ্রকে দেখছে।

শুভ্র বলল, স্লামালেকুম।

ওয়ালাইকুম সালাম। আমি আপনাকে চিনতে পারি নি ভাই। আপনি ইয়াজউদ্দিন সাহেবের ছেলে। বাহ ভালো। আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুব আনন্দিত হয়েছি। ছিছি, এটা তো বিরাট লজ্জার ব্যাপার হয়ে গেল, ইয়াজউদ্দিন সাহেবের ছেলে কি-না হাজতে। ইয়াজউদ্দিন সাহেবের কাছে তো মুখ দেখাতে পারব না।

শুভ্র বলল, আপনি আমাদের এই ঝামেলা দূর করবেন, আশা করি।

অবশ্যই, অবশ্যই। আমি ওসি সাহেবকে বলে দিয়েছি। আপনাদের ওপর থেকে যত চার্জ ছিল সব তুলে নেয়া হয়েছে। আপনারা আপনাদের মতো বেড়াতে যাবেন। আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে ফিরে যাব।

জরীও আমাদের সঙ্গে যাবে।

কী বললেন?

শুভ্ৰ শান্তমুখে বলল, আপনি যথেষ্ট যন্ত্রণা করেছেন। তার পরেও আপনাকে ক্ষমা করেছি। এরচে বেশি যন্ত্রণা করার চেষ্টা করলে ক্ষমা করব না।

কী করবেন?

আপনি জীবিত ঢাকা ফিরবেন না।

কী বললেন?

এই বাক্যটি আমি দ্বিতীয় বার বলব না। তবে যে বাক্যটি বলা হয়েছে—তা কার্যকর করার সমস্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এই তথ্যটা আপনার জানা থাকা দরকার।

শুভ্ৰ উঠে দাঁড়াল। মনিরুজ্জামান বলল, আরে বসেন, বসেন। রাগ করে উঠে যাচ্ছেন কেন? চা খান। ওসি সাহেব, আমাদের একটু চা খাওয়ার ব্যবস্থা করেন না রে ভাই।

শুভ্ৰ বলল, আমি চা খাই না।

মনিরুজ্জামান হাত ধরে টেনে তাকে বসিয়ে ফেলল। হাসিমুখে বলল, আমাদের মধ্যে একটা ভুল বোঝাবুঝি থাকবে এটা কেমন কথা? আমরা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে …

এখানে আলাপ-আলোচনার কিছু নেই।

আচ্ছা, না থাকলে নাই। চা তো খাওয়া যাবে। আমার সঙ্গে চা খেতে তো অসুবিধা নেই?

অসুবিধা আছে।

ওসি সাহেব হাই তুলতে তুলতে বললেন, শুভ্ৰ সাহেব, ঢাকা থেকে আপনার কাছে এক ভদ্রলোক এসেছেন। রফিক নাম। উনি থানার বাইরে অপেক্ষা করছেন। আপনি কি ওনার সঙ্গে কথা বলবেন?

শুভ্র বলল, ওনাকে অপেক্ষা করতে বলুন।

মনিরুজ্জামানের মুখ ছাইবৰ্ণ হয়ে গেল। সে পরপর দুবার টোক গিলল।

শুভ্ৰ দেখল তার বাবার কথাই ঠিক হয়েছে। ভয় কাজ করছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *