মতি ছুটতে ছুটতে যাচ্ছে। তার পেছনে পেছনে একজন মেয়ে যাচ্ছে–সে তার মত ছুটতে পারবে কিনা এদিকে তার খেয়াল নেই। শাহানা অবশ্যি মতির সঙ্গে তাল মিলিয়েই ছুটছে। একবার শুধু সে আকাশ দেখল–আকাশ ঘন কালো। এরকম কালো আকাশ সচরাচর দেখা যায় না।
শাহানা বলল, রোগির অবস্থা কি খুব খারাপ?
মতি ঘাড় না ফিরিয়েই বলল, জ্বি! মারা যাইতেছে।
শাহানার মনে হল মৃত্যুর জন্যে দিনটি সুন্দর। আকাশ জোড়া মেঘ। বর্ষার অপূর্ব সকাল। তার নিজের মৃত্যুর সময় প্রকৃতি কেমন থাকবে? সে কি রাতে মারা যাবে, না দিনে? সবচে ভাল হত পূর্ণিমার রাতে মরতে পারলে–একটা গান আছে না–চান্নি পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়। মতি মিয়া কি গানটা জানে?
শাহানা সহজ গলায় বলল, শুনুন, আপনি কি এই গানটা জানেন–ঐ যে চান্নি পহর রাইতে যেন আমার মরণ হয়?
মতি অবাক হয়ে পেছন ফিরল–কি আশ্চর্য, এই সময় কোন মেয়ের মাথায় গানের কথা আসে?
গানটা জানেন না, তাই না?
জি-না।
খুব সুন্দর গান। আমার গলায় সুর নেই। সুর থাকলে আপনাকে শুনাতাম। রোগির বাড়ি কত দূর?
ঐ যে দেখা যায়।
শাহানার মনে হল রোগির বাড়ি আরেকটু দূর হলে ভাল হত। কেন জানি এই ভোরবেলায় ছুটতে ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে হঠাৎ বয়স কমে গিয়ে সে নীতুর বয়েসী হয়ে গেছে।
পরাণের উঠোনে অনেকেই দাঁড়িয়ে আছে। গ্রামের আনুষদের এই এক অভ্যাস–বিপদে তেমন সাহায্য করতে পারে না কিংসাই পাশে এসে দাঁড়ায়। তারা কৌতূহলী হয়ে দেখছে শাহানাকে। বাচ্চা একরীমেয়ে–জটিল ও ভয়াবহ বিপদে এই মেয়ে কি করবে?
শাহানা সবার কৌতূহলী চোখের উপর ঘরে ঢুকল।
ঘরে তেমন আলো নেই। আকাশ মেঘলা থাকায় আলো স্লান ও বিবর্ণ। গ্রামের বাড়িগুলির জানালা থাকে না। একটামাত্র দরজা–সেই দরজা বন্ধ। ঘর অন্ধকার। একটা হারিকেন জ্বলছে, একটা কুপি জ্বলছে। হারিকেন ও কুপির ক্ষীণ আলো অন্ধকার কাটাতে পারছে না।
খোদেজার মা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে শাহানার দিকে। কি মিষ্টি কিশোরীদের মত মুখ! কি মায়া মায়া টানা চোখ। এই মেয়ের দিকে তাকালেই মনে হয় এই মেয়ে পৃথিবীর কোন জটিলতাই জানে না। কিন্তু মেয়েটি হাঁটু গেড়ে দূর্গার চৌকির কাছে বসেছে। তার বসার ভঙ্গি বলে দিচ্ছে সে কি করবে বা কি করবে না সে সম্পর্কে তার খুব পরিষ্কার ধারণা আছে। তার মধ্যে কোন অস্পষ্টতা নেই। মেয়েটি দূর্গার পেটে হাত রেখেই চমকে উঠল। তার চমকানি বলে দিচ্ছে সে তার কাজ জানে। শুধু যে জানে তাই না–খুব ভাল করে জানে। খোদেজার মা হঠাৎ খানিকটা ভরসা পেল। যুদ্ধক্ষেত্রে রণক্লান্ত সৈনিকের পাশে একজন তুখোড় যোদ্ধা এসে দাঁড়ালে ক্লান্ত যোদ্ধা যে ভরসা পায়–সেই ভরসা।
শাহানার হাত কাপছে। বুক ধ্বক ধ্বক করছে। দুটাই খারাপ লক্ষণ; নার্ভ দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। নার্ভ ঠিক রাখতে হবে। এই পরিস্থিতিতে নার্ভ ঠিক রাখা কি সম্ভব? এই বিদ্যা যারা তাকে দিয়েছেন–তাঁরা কি নার্ভ ঠিক রাখতে পারতেন? পরিস্থিতি ভয়াবহ–শিশুটি যে পজিশনে আছে তাতে ডেলিভারি হবে না। সে চলে এসেছে বার্থ ক্যানেলের মুখে। সেখানে তার মাথা থাকার কথা–মাথা নেই। শিশুটি বার্থ ক্যানেলে আড়াআড়িভাবে পড়ে আছে। তার অক্সিজেনের অভাব হচ্ছে। মায়ের যে জরায়ু তাকে এতদিন আশ্রয় দিয়েছে সেই জরায়ু এখন তাকে ঠেলে বের করে দিতে যাচ্ছে।
অসহায় শিশু আটকা পড়ে গেছে। মা বলে শিশুটি মনে মনে হয়ত কাঁদছে। অচেতন মা শিশুর সেই কান্না শুনতে পাচ্ছেন না।
এই পরিস্থিতিতে আমার কি করণীয়? আমি শাহানা। মেডিক্যাল কলেজের সর্বকালের সেরা কিছু ছাত্র-ছাত্রীদের একজন। প্রতিটি বিষয়ে আমি ডিসটিংশন পেয়েছি। রাষ্ট্রপতির দেয়া গোল্ড মেডেল আমাদের বসার ঘরের আলমিরায় সাজানো। আমার স্মৃতিশক্তি অসাধারণ। আমি কোন কিছুই ভুলি না–। মেডিসিনের প্রফেসর জালাল উদ্দিন ভাইভা বোর্ডে হাসতে হাসতে বলেছিলেন–মাই লিটল গার্ল, ইউ হ্যাভ এ ফটোগ্রাফিক মেমোরী।
কিন্তু শাহানার কিছু মনে পড়ছে না। এই পরিস্থিতিতে তাকে কি করতে হবে–গাইনীর প্রফেসার ভূঁইয়া ক্লাসে একদিন বলেছিল–প্রসবকালীন সময়ে মন থেকে মায়া জিনিশটা সরিয়ে দিও। কারণ মাঝে মাঝে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হবে যে, মায়ার কারণে মা এবং শিশু দুজনকে তুমি রক্ষা করতে যাবে–দুজনকেই হারাবে। সে সময় মায়া কম থাকলে–অন্তত একজন রক্ষা পাবে।
শাহানা কি করবে? একজনকে বাঁচানোর চেষ্টা করবে? কাকে বাঁচাবে? মাকে, শিশুটিকে? শাহানা খোদেজার মার দিকে তাকিয়ে বলল–গরম পানি আছে? হাত ধোব।
খোদেজার মা গামলায় গরম পানি নিয়ে এল। এই পানিতে জীবাণুনাশক কিছু দেয়া হয়নি। জীবাণুনাশকের জন্যে অপেক্ষা করারও কোন অর্থ হয় না। পানি অতিরিক্ত গরম–শাহানা সেই গরম অনুভব করছে না। শীত-গরমের সংবাদ যে স্নায়ু মস্তিষ্কে পৌঁছায় সেই স্নায়ু অসাড় হয়ে আছে। তার সমস্ত চেতনাই অসাড়।
খোদেজার মা বলল, আফা কি করবেন অখন? . কি করবে শাহানা নিজেও জানে না। তার কি করা উচিত তা যদি একজন কেউ বলে দিত! দূর থেকে শুধু যদি বলত–শাহানা, এখন এটা কর এখন ওটা কর। শাহানা করত। নির্ভুলভাবে করত। শাহানকে বলে দেবার কেউ নেই।
ভূঁইয়া স্যার একবার ক্লাসে বলেছিলেন–মেডিকেল প্রফেশনে মাঝে মাঝে তোমরা ভয়াবহ সমস্যায় পড়বে। তখন আল্লাহর সাহায্য কামনা করবে। দেখবে এতে নার্ভের জড়তা কেটে যাবে। সহজভাবে চিন্তা করতে পারবে।
শাহানা বলেছিল, নার্ভের জড়তা কে কাটিয়ে দেন? আল্লাহ?
স্যার বলেছিলেন, হয়ত তিনিই কাটান। কিংবা হয়ত তার কাছে প্রার্থনা করার কারণে নিজের মনের ভেতর থেকে এক ধরনের শক্তি আসে।
যে আল্লাহ ডাক্তারের নার্ভের জড়তা কাটান তিনি কেন সরাসরি রোগিকে সুস্থ করে দেন না?
সেটা উনি বলতে পারবেন। আমি পারব না। উনার কর্ম পদ্ধতি বোঝা মানুষের সাধ্যের বাইরে।
শাহানা কঠিন গলায় বলেছিল, স্যার, আমার ধারণা, আল্লাহ্ ধর্ম এইসব মানুষের সৃষ্টি। আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেন নি। ম্যান ক্রিয়েটেড গড।
হতে পারে। এটা যেহেতু ধর্মতত্ত্বের ক্লাস না সেহেতু আমরা আমাদের টপিকে ফিরে যাই–শরীরতত্ত্ব।
আজ এতদিন পর তার কেন মনে হচ্ছে–আল্লাহ বলে একজন কেউ থাকলেও থাকতে পারেন। তাঁর কাছে সাহায্য চাওয়া যেতে পারে।
শাহানা বুক ভর্তি করে নিঃশ্বাস নিয়ে মনে মনে বলল, ও গড অলমাইটি, প্লীজ হেল্প মি। প্লীজ হেল্প মি।
খোদেজার মা আবার বলল, আফা, অখন কি করবেন?
শাহানা শান্তস্বরে বলল, পেটের ভেতর শেষ মুহূর্তে বাচ্চা উল্টে দেয়ার একটা প্রাচীন পদ্ধতি আছে। ঐটা চেষ্টা করব। একবারই করব…
যদি না হয়…
যদি না হয়, যদি পদ্ধতি কাজ না করে তখন কি হবে শাহানা তা বলতে পারছে না। তার কপালে ঘাম জমছে–হাত আবারও কাঁপছে। পদ্ধতিটা কি সে জানে? ভাসাভাসা জানে। ব্রাকষ্টোন হাইক পদ্ধতি। পুরোনো দিনের একজন অসাধারণ ডাক্তার প্রফেসর ব্রাকষ্টোন হাইক এই পদ্ধতি বের করে অনেক জীবন রক্ষা করেছেন। এই পদ্ধতির কোন প্রচলন এখন নেই–আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র প্রাচীন। সব পদ্ধতিকে দূরে ছুঁড়ে ফেলেছে–
প্রথমে বাচ্চার পা খুঁজে বের করতে হবে। তিনটি আঙুলে দুটি পায়ের গোড়ালি ঠেলে ধরতে হবে। তারপর সামান্য উপরের দিকে ঠেলে ধরতে হবে। উপরের দিকে ঠেলার সময়টা সিনক্রোনাইজড হতে হবে জরায়ুর প্লাসমের সাথে, একটা হাত থাকবে বাইরে পেটের উপর–বাচ্চার মাথার কাছাকাছি। বাইপোলার পদ্ধতি–এক হাতে বাচ্চার পা ঠেলে দেয়া, এক হাতে মাখার নিচের দিকে চাপ দেয়া। শাহানা কি পারবে? বই পড়া বিদ্যা এবং বাস্তব ক্ষেত্র আলাদা। অভিজ্ঞতা শাহানাকে কোন সাহায্য করছে না। তার অভিজ্ঞতা শূন্য। শাহানা মনে মনে ইংরেজিতে বলল, আই স্টার্ট বাই দ্যা নেম অব গড। গড অলমাইটি, হেল্প মি।
শাহানা কি পারছে? শিশুটি সাড়া দিচ্ছে শাহানার আঙুলের ইশারায়? শিশুটির একটি পা পাওয়া গেছে–আরেকটি পা কোথায়? প্রেসেন্টার নালী যদি পায়ে পেঁচিয়ে থাকে তখন কি করণীয়…? ঘামে শাহানার কপাল ভিজে গেছে। ভুরু ছাপিয়ে সেই ঘাম তার চোখের দিকে আসছে। সে শান্ত গলায় খোদেজার মার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি আমার কপালের ঘাম মুছে দিন। বাঁ হাতটা সে শিশুর মাখার উপর রেখেছে। ডান হাতে সে খুঁজছে শিশুটির পা। তার নিজের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। বুক ধ্বক ধ্বক করছে। শিশুর দ্বিতীয় পাটি পাওয়া যাচ্ছে না।… এই তো, এই তো পাওয়া গেছে। ও গড প্লীজ হেল্প মি।
আধো তন্দ্রা আধো জাগরণের ভেতর দিয়ে দূর্গা শুনছে খোদেজার মার আনন্দিত গলা–দেখ, তোমার কন্যারে দেখ। কি সুন্দর কন্যা!
দূর্গা অনেক কষ্টে চোখ মেলল। কই, সে তার বাচ্চাটাকে তো দেখছে না–সে দেখছে পরীর মত সুন্দর একটা মেয়েকে এই সুন্দর মেয়েটা কে? কার বাড়ির মেয়ে? সে এখানে কেন?
প্রবল ঘুমে দূর্গা আচ্ছন্ন হয়ে আসছে। ঘুমের ঘোরেই সে শুনল–শিশু কাঁদছে। কাছে কোথাও নয়–দূরে, অনেক দূরে—এই শিশুটি তার। হারানো দুই কন্যাই কি আবার ফিরে এসেছে?
খোদেজার মা শাহানার দিকে অকিয়ে বলল, আফা, এই মেয়ে বড় হইলে আপনের মত সুন্দর হইব–দেখেন কি গায়ের রঙ! ওমা, আপনের দিকে প্যাটপ্যাট কইরা আবার দেখি চায়। আপনেরে হিংসা করতেছে আফা…।
শাহানা দরজা খুলে বের হয়েছে। কোনদিকে না তাকিয়ে সে প্রায় ছুটে যাচ্ছে। সে চায় না কেউ তাকে এখন দেখুক। তার চোখ ভর্তি পানি। চোখ ছাপিয়ে এত পানি কেন আসছে তাও সে জানে না।
না, সে কোনদিন বড় ডাক্তার হতে পারবে না। বড় ডাক্তাররা হন আবেগশূন্য–তারা অর্ধেক মানুষ, অর্ধেক যন্ত্র। শাহানা শাড়ির আচলে চোখ মুছে নিজেকে শান্ত করল। তার ইচ্ছা হচ্ছে সে কিশোরীদের মত ছুটতে ছুটতে যায়–কিন্তু তার শরীর অবসন্ন। পা চলছে না।
তার পেছনে পেছনে মতি যাচ্ছে। অদ্ভুত এক ধরনের শব্দ হওয়ায় শাহানা পেছন ফিরে মতিকে দেখল। মতি শব্দ করে কাঁদছে।
শাহানা বলল, কি হয়েছে আপনার?
মতি অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, কিছু হয় নাই। এত আনন্দ হইতেছে, মনে হইতেছে চিকুর দিয়া কান্দি।
শাহানা হাসল। তার মনে হচ্ছিল তাকে হাসতে দেখে মতিও নিজেকে সামলে নিয়ে হাসার চেষ্টা করবে–তা হল না। মতি কাঁদছেই।
বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। শাহানা বলল, আপনাকে আমার পেছনে পেছতে, আসতে হবে না। আপনি আপনার বাড়িতে চলে যান।
আপনার জন্যে একটা ছাতি নিয়া আসি।
আমার জন্যে কিছু আনতে হবে না। আমি আজ বৃষ্টিতে ভিজব। অনেকদিন বৃষ্টিতে ভেজা হয় না। বাবা বৃষ্টির সময় আমাদের ছাদে যেতে দেয়া বাবার ধারণা ছাদে গেলেই–আমাদের মাথায় বজ্রপাত হবে।
শ্রাবণমাসের বৃষ্টিতে বজ্রপাত হয় না।
তাই না-কি? জানতাম না তো। হলেও আজ আমিনের সাধ মিটিয়ে ভিজব।
মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঘোর বর্ষণ। শাহনা খুশি খুশি গলায় বলল, খবর্দার আপনি আমার পেছনে পেছনে আসবেন না।
শাহানা এবার কিশোরীদের মতোই ছুটছে। তীরের ফলার মত বৃষ্টি এসে তাকে বিঁধছে। হাওয়ায় উড়ছে শাড়ির আঁচল। সে ছুটে যাচ্ছে হাওড়ের দিকে। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সে হাওড়ের পানি ছুঁয়ে দেখবে।
হাওড়ের দিক থেকে শোঁ শোঁ শব্দ আসছে। বাতাস পেয়ে ফুলে ফেঁপে হাওড় হয়েছে সমুদ্রের মত। ভয়ংকর আক্রোশে সে গর্জন করছে…