০৯. মজুরের বস্তি, কুলি-হাট সব

মজুরের বস্তি, কুলি-হাট সব।

ছিটে-বেড়ায় ঘেরা, উলুখড়ের ছাউনি; ঘোট ঘোট ঘর, শুইলে এ দেওয়ালে মাথা ঠেকে, ওদিকের দেওয়ালে পা ঠেকে; দাঁড়াইলে চালে ঠেকে মাথা, একেবারে মাপা, যে লোক বেশি লম্বা, সে নাকি অনাসৃষ্টির সৃষ্টি, সৃষ্টিছাড়া।

এক এক আঙিনা ঘেরিয়া তিন-চারি ঘরের বাস; এক একজনের দুটি কুঠুরি, একটি বারান্দা, তাই ঘেরিয়া রান্না হয়।

উহারই ভাড়া মাসে দু টাকা, কলের মালিক মাস মাস বেতন হইতে কাটিয়া লয়।

এ আঙিনায় থাকে তিন জন; পূর্বদিকে ফিটার-বুড়া, দক্ষিণের ভাগটায় ছোট মিস্ত্রি, পশ্চিমের খালি ভাগটা মিলিল দামিনী আর গোষ্ঠর অদৃষ্টে।

দামিনী কহে, এ যে অন্ধকূপ, আলো নাই, বাতাস নাই, ভিজে জ্যাবজাব করছে।

এরই ভাড়া মাসে দু টাকা—বত্রিশ আনা—একশো আটাশ পয়সা। যেখানকার যা, শহরের এই বটে।

ঝাঁটা মার শহরের মুখে, এ যে বুক চেপে ধরেছে।

তাও ভাল ঘাড় তো ধরছে না কেউ।

ওপাশ হইতে ঘোট মিস্ত্রি নেশার ঝোঁকে মাটিতে চাপড় মারিয়া কহে, কভি নেহি, কোইকো এক্তিয়ার নেহি হ্যায়।

গোছগাছ কর তুমি। দামিনী সংসার পাতিতে বসে।

ঘরের মাঝে সে শুধু বসিয়া ভাবে, অভাব যে ষোল আনার-চাল, ডাল, জল, হাড়ি, কলসি, থালা, বাটি, সব কিছুরই।

শুধু সে খুঁটে বাঁধা সেই বালা দুইগাছা নাড়েচড়ে আর কাঁদে।

ওপাশে গোষ্ঠ ছোট মিস্ত্রির সঙ্গে বসিয়া গল্প করে, ওই সেই কথা। ছোট মিস্ত্রি বলে, মালিক কই নেহি।

উত্তেজনায় বাঙালি হিন্দি বাত ঝাড়ে।

গোষ্ঠ বলে, মালিক ভগবান!

নেহি, ভগমান কৌন হয়, ভগমান রহনেসে দুনিয়াকা এইসা হাল হোতা, কেউ দুধে ভাতে খেত, কেউ এঁটো পাত চাটত?

গোষ্ঠ চুপ করিয়া যায়, মন যেন সায় দেয়, কিন্তু স্বীকার করিতে ভয় হয়, সংস্কার চোখ রাঙায়।

বস্তির প্রতিবেশীর দল আসিয়া জোটে, ফায়ারম্যান, রেলের পয়েন্টসম্যান, জমাদার, পদস্থ কুলির দল সব।

ছোট মিস্ত্রি পরিচয় করাইয়া দেয়, এ ফয়রমন, এ পাইন্টমন, ই—

পয়েন্টসম্যান গান ধরিয়া দেয়–

বৃন্দাবনের কিষণলাল মথুরার রাজা,
সেথায় খেতেন লঙ্কা ছাতু হেথায় খান গাঁজা।

ফায়ারম্যান ঢোলকটা পাড়িয়া ধমধম বেতালা বাজনা জুড়িয়া দেয়।

আর একজন মাথায় হাত দিয়া নাচে।

এমনই তাণ্ডবের মাঝে পরিচয় হয়। গোষ্ঠর অন্তর কেমন হাঁপাইয়া ওঠে। জমাদার চেঁচায়, এ বইঠ যাও, বইঠ যাও।

শেষে নৃত্যপর ব্যক্তিটির হাত ধরিয়া টানিয়া বসাইয়া দিয়া কহে, গাঁজা তৈয়ার কর।

পয়েন্টসম্যান সঙ্গে সঙ্গে গান বন্ধ করিয়া হাত পাতে, গাঁজা টিপিতে টিপিতে টেপার সঙ্গে জোর দিয়া কহে, সাত কাট, নয় টি-প, তবে হবে গাঁ-জা ঠিক।

ফায়ারম্যান এতক্ষণে গোষ্ঠর সঙ্গে আলাপ করে, বাড়ি কোথা ভাই?

সে অনেক দূর, খাটতে এসেছি খাটব, থাকব, বাস্।

তবু কি নাম গায়ের?

সে কথা আর ছেড়ে দাও, সেথার সঙ্গে সম্বন্ধ চুকিয়ে এসেছি আমি।

তবু–

এবার চটিয়া গোষ্ঠ কহে, বাড়ি আমার নাই।

ও বাবা, চটছ কেন হে? আঃ আঃ, উ কি করলি, কাটু, গাঁজাটা কাটু, তবে তো ঠিক হবে। তা নামটি কি তোমার?

গোষ্ঠ নামটা গোপন করিতে চায়, মনে মনে একটা নাম খোঁজে।

গাঁজার কলিকা চলে।

টানিতে টানিতে গোষ্ঠ ভাবিয়া চিন্তিয়া বলে, কাঙালী, আমার নাম কাঙালী, হাম কাঙালী। তো হ্যায়, হামারা নাম কাঙালী ঘোষ। বাড়ি হ্যায় নিশ্চিন্দিপুর—নিশ্চিন্দিপুর।—বলিয়া আপন মনেই হা-হা করিয়া হাসে।

ফায়ারম্যান বলে, সচ বাত নেহি হ্যায়; কাঙালীভি ঝুটা, নিশ্চিন্দিপুরভি ঝুটা।

পয়েন্টস্ম্যান বলে, ফেরারী নাকি হে?

খবরদার!—গোষ্ঠ মারিতে ওঠে।

গাঁজায় দম দিতে দিতে পয়েন্টস্ম্যান কহে, ঠারো ঠারো, ইস্টিম হামকো লেনে দাও। আও, আব চলা আও!

ফায়ারম্যান হাততালি দিয়া ওঠে, লাগে পালোয়ান লাগে।

মিস্ত্ৰি হাত ধরিয়া গোষ্ঠকে মানাইয়া লয়, বস বস, ভাই-বেরাদারের সঙ্গে ঝগড়া করে না।

জমাদার বলে, হ্যাঁ হ্যাঁ, মান যাও ভাই, মান যাও।

ফায়ারম্যান দাঁত মেলিয়া হাসে, পয়েন্টস্ম্যানও হাসে, যেন কিছুই হয় নাই।

চিৎকার শুনিয়া দামিনী বাহিরে আসিয়া দাঁড়ায়।

ফায়ারম্যানের দৃষ্টি সেদিকে পড়ে, চোখ দুইটা জ্বলজ্বল করিয়া ওঠে; সে শুধু আঙুল দেখাইয়া কহে, আরে!

জমাদার কহে, এ ভেইয়া, ই কাঁহাকা আমদানি?

একজন গান ধরিয়া দেয়, গোবর-বনে কোন কারণে ফুটল কমলফুল!

পয়েন্টস্‌ম্যানটা চিৎ হইয়া শুইয়া পড়িয়া বলে, জান গিয়া মেরা, জান গিয়া। কথাগুলা প্রায়ই সব একসঙ্গে উপরে উপরে পড়ে।

গোষ্ঠ আবার লাফাইয়া ওঠে, পয়েন্টসম্যানকে বিশেষ করিয়া শাসায়, জিভ ছিঁড়ে নেব।

ওদের ভয়ও হয় না, লজ্জাও হয় না, হি-হি করিয়া হাসে; যুগান্তব্যাপী তমসার মাঝে এই নির্লজ্জ হাসির কুৎসিত রূপ যে উহাদের চোখে কখনও পড়ে নাই।

পয়েন্টসম্যান আবার বলে, এ তুমি খাঁটি কারও কপালে তেঁতুল গুলেছ বাবা।

গোষ্ঠ আর সেখানে দাঁড়ায় না, দামিনীকে টানিয়া লইয়া ঘরে ঢুকিয়া মাথায় হাত দিয়া ভাবে। দামিনী নিৰ্বাক।

তখনও ওদের কথা শোনা যাইতেছিল, পঞ্চাশ টাকা বাজি, ফেরারী না হয়ত কি বলেছি।

এত কোলাহলেও বাহির হয় না বড় মিস্ত্রি।

লোকটা যেন কেমন কাজের শেষে ঘরে আসিয়া ঢোকে, আবার বাহির হয় কাজের সময়। বাঁধাধরা কাজ কয়টি ছাড়া আর যেন দুনিয়ায় কিছু নাই, লোহার মতন শরীর, লোহা পেটা কাজ, যেন একটা যন্ত্র, ও যেন বস্তির অতীতের ধারা, বৰ্তমানকে স্থান ছাড়িয়া দিয়া ক্ষীণ যোগসূত্রের মত পড়িয়া আছে।

তবু লোকটার মাঝে কি আছে, ওই নিস্পন্দতার মাঝখানে যেন বিপুল উদ্দাম কিছু আছে। দেখিলে ভয় হয়।

সহসা গোষ্ঠ কহে, নাঃ, হেথা আর থাকব না।

দামিনী অকূল চিন্তার মাঝ হইতে কহে, কোথায় যাবে? যেন সে কূল পায় না।

গোষ্ঠও হতাশ হইয়া কহে, কোথায় বা যাব? সবারই গতিক যে ওই! রাস্তায়, ঘাটে, সবখানে, দেখলে না ভদ্রলোকদের চাউনি?

নিরাশ্রয় দুটি নরনারী ব্যাকুল অন্তরে অন্তদৃষ্টি হানিয়া একটা নিরুপদ্রব নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য বিশ্বসংসার খুঁজিয়া ফেরে।

হঠাৎ গোষ্ঠ আগুন হইয়া কহে, ফের যদি তুই বাইরে বেরুবি তো খুন করে ফেলব। বললাম।—বলিয়া সে দুয়ারটায় শিকল দিয়া বাহির হইয়া যায়।

ঈষৎ ম্লান হাসি ক্ষীণ রেখায় দামিনীর অধরপ্রান্তে আসিয়া আবার মিলাইয়া যায়।

নিরুপায় ওই আশ্রয়টুকুই আঁকড়াইয়া ধরে।

আধারভেদে আধেয়ের রূপ পাল্টাইয়া যায়।

এই দুইটি নরনারীর জীবনধারা যেন কদনভরা করুণ কীৰ্তনের সুরে চলিতে চলিতে সহসা খেয়ালের সুরে চলিতে শুরু করিল।

অন্ধকার ঘরে দামিনী তাহা অনুভব করিল, কিন্তু গোষ্ঠের কোনো ভ্রূক্ষেপ হইল না।

সে কলে খাটে, বয়লারে কয়লা ঠেলে, বাকানো হাঁটুর পরে কনুইয়ের চাপ দিয়া হাতল ভরা কয়লা তোলে, আর বয়লারের অগ্নিগহ্বরে ঝপাঝপ মারে, শেষ হইলে ঘড়াং করিয়া মুখের ঢাকনিটা বন্ধ করিয়া মাথায় জড়ানো গামছাটায় কপালের স্বেদ মুছে, পা দুইটি ছড়াইয়া বিড়ি টানে।

জ্বলন্ত আগুনের সঙ্গে লড়াই, ভ্রুক্ষেপও নাই, আক্ষেপও নাই।

গোষ্ঠ বলে, আমার বেশ লাগে।

গাঁজাটা যেদিন বেশি টানে, সেদিন বুকের তাণ্ডব যেন বাড়িয়া ওঠে, কহে, বহুৎ আচ্ছা, এই তো আগকে সাথ ফাগ খেলা রে ভাই। আমি দিই কয়লা, ও ছিটোয় আঁচ। আর ফাগ হেঁই রে।

সে কয়লা মারে, হু-হু করিয়া আগুনের আঁচ আগাইয়া আসে। গোষ্ঠর কৌতুক লাগে, সে হাসে।

ওই উত্তাপে সব যেন আগুন হইয়া ওঠে, বক্ষে রক্ত, চক্ষে ধরা সরাখানার মতনই তুচ্ছ ঠেকে।

ওদিকে হাউজের ধারে মেয়েরা সব কাজ করে, স্টাম-পাইপের গোল হাতলটা ঘুরাইয়া হাউজের মুখে গরম ছাড়িয়া দেয়। মেয়ের দল ছুটিয়া পালায়, উ উ বাবাঃ লো!

গোষ্ঠ হাসে, ছোট মিস্ত্ৰি হাসে।

মেয়েরা গালি দেয়, মর মুখপোড়া, উ কি আমোদ নাকি? উহাদের আমোদ বাড়ে।

কাজের শেষে, কয়লায় কালো, আগুনে ঝলসানো দেহ, শুষ্ক বক্ষে মরু-তৃষ্ণা লইয়া সে যখন মদের দোকানের পানে ছোটে, তখন সে যেন একটা মদগ্ধ শব, প্রেতত্ব লইয়া চিতা হইতে জাগিয়া উঠিয়াছে।

সমগ্ৰ বিশ্বমানবসভ্যতার ধারা এ মূৰ্তি দেখিয়া বোধ করি শিহরিয়া ওঠে। এ যে তাহারই আর একটা অন্য দিকের রূপ।

ওই উন্মত্ত আচরণ বুঝি বিশ্বসভ্যতার কাহিনী কয়।

ওই সুপ্রকট কঙ্কালের মালার আখরে বুঝি তাহার ব্যর্থতার ইতিহাস লেখা।

সে কপট ঘৃণায় মুখ ফিরাইয়া ওই দৃশ্য দেখিতে বাঁচিয়া থাকে। কলের ঘরে তখন তহবিল মিল হয়, টাকা বাজে ঝমাঝম।

গোষ্ঠর মজুরি মেলে বার আনা।

অর্ধেক তার নেশায় যায়, বাকি ছয় আনা দামিনীর দিকে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিয়া কহে, ওই নে।

আর তুমি তোমার নয়, এখন তুই তোর; বুকে মুখে সবেই আগুন ধরিয়াছে, ভাষা পর্যন্ত ওই আগুনের আঁচেই বুঝি উগ্র হইয়া উঠিয়াছে।

সন্ধ্যায় এ রূপ আরও বিকট ভয়াল হইয়া ওঠে; এই শিক্ষাদীক্ষাহীন মানুষগুলার বুকের নগ্ন পশুত্ব বিপুল তাণ্ডবে জাগিয়া ওঠে; জাগে তো অবিরাম, কিন্তু অন্ধকারে বুঝি আবরণের সুযোগ পায়; উন্মুক্ত আলোকে লজ্জা হয়। এতটুকু লজ্জার রেশ আজও আছে; ওইটুকুই বুকের মানুষটির। অতি ক্ষীণ অবশেষের পরিচয় দেয়, ওই এতটুকুই আজও আছে যে।

ওপাশে বাউরিপাড়ায় সে কি কোলাহল! ঢোল বাজে এক তালে গান হয় অন্য তালে, একসঙ্গে চার-পাঁচ জন গায়। রাখনা গায়, ইস্কাতনের টেক্কা রে প্রাণ রুপিতনের টেক্কা! নিতাই ধরে, বনের ফল খাওরে কানাই, ফল এনেছি চেখে চেখে। শশন ওরফে শশধরের আজ আধবাটি মদ পড়িয়া গিয়াছিল, সে সেই তখন হইতেই করুণ সুরে গাহিতেছে, আধ বাটি মদ প–ড়ে গে–ল, আধ বাটি প–ড়ে গে–ল হায় গো! ওই তাহার গান, তাহার বিরাম নাই।

মেয়েরা রাস্তার ধারে বসিয়া জটলা পাকায়, পরনে এখন চওড়াপাড় মিহি শাড়ি, অল্প চুলে যোগান দিয়া খোপা বাঁধা, দীপ্তিহীন চক্ষে অন্ধকারের মাঝেও বক্ষের উদগ্র ক্ষুধা জ্বলজ্বল করে। কিন্তু ওই জ্বলজ্বলে চক্ষু শুধু তো মানুষের পথপানে চায় না, চায় সে রজতের ঔজ্জ্বল্যের পানে। চক্ষে ওই জ্বলজ্বলে দৃষ্টির মাঝে শুধু বুকের ক্ষুধাই নাই, পেটের জ্বালায় ভোগের লিপ্সাও জ্বলে।

ওরা বলে, কত ভাগ্যে মনুষ্য জন্ম, পেটে খাব না, গায়ে পরব না তো করব কি?

লক্ষ্য যে ওদের অন্ধকারে ঢাকা। ওদের পাপের ভয় শুধু দেবতার ঘরে উঠিতে, পূজা করা ফুল পায়ে ঠেকিলে।

আর কোনো পাপ ওদের মনে ছাপ মারে না; জীবনের ধারার জন্য দুঃখ নাই, অনুশোচনা নাই, আসলে পাপপুণ্য মানে না।

সাবি কপালে হাত বুলাইয়া বলে, উঃ, কপালটা ফুলে উঠেছে ভাই, পাশের বাড়ির মেজো বউ—

মাইতুরী চিবাইয়া চিবাইয়া বলে, কার পায় মাথা ঠুকে লো?

সাবি ঠোঁটের ডগায় তাচ্ছিল্যের পিচ কাটে, এত নেকন, বলে যে সেই—পায়ে ধরতে পারলে সখি, ঘুটে কুড়োতে পড়ে থাকি।

তবে?

ওই মুখপোড়া বুড়ো ভালুক খাতাঞ্চী লো।—বলিয়া হাসিয়া সারা, কৌতুকে কথা আর শেষ করতে পারে না, ঠুই করে ঢেলিয়ে দিলে, আর চোখের সে কি ইশেরা, সূর্যিমামা ড়ুবুড়ুবু। আবার হি-হি হাসি।

তুই কি বললি?—কৌতুকব্যগ্র প্রশ্ন হয়।

সন্ধ্যাবেলায় টাকা-ভরা বাক্সটা দেবে? অমনই মুখখানা চুন, বিড়বিড় করতে করতে চলে গেল।

পাড়ার ভিতর পাঁচীর ঘরে কোলাহল ওঠে, জমাদার আর ফায়ারম্যানের গলা শোনা যায়। খবরদার!

খবরদার।

সব ছুটিয়া যায়; তখন যুদ্ধ বাঁধিয়া গিয়াছে, জমাদারের হাতে ঝাটা, ফায়ারম্যান একখানা বাখারি লইয়া, পরস্পরকে মারে।

সকলে হাততালি দেয়, হাসে। পাচী গালি দেয়, নেমে যা বলছি আমার ঘর থেকে, বাঁশমুখো, কালামুখো। কি বিপদ মা, ঝাটাগাছটা সুষ্ঠু নিয়েছে, দে তো ভাই পরী, তোর বঁটাগাছটা

পশ্চিম পাড়ায় উচ্চতর শ্রেণীর বাস, সেখানে আড বসে কোনো দিন ছোট মিস্ত্রির ঘরে, কোনো দিন স্টেশনের ধারের সেই বটতলায়। গল্প করে বুড়া ড্রাইভার; খালি গা, পরনে চৌকোনা ঘরকাটা লুঙ্গি, গলায় কালো কারে বাধা রুপার তক্তি, বাহুতে একটা; দক্ষিণ মণিবন্ধে শুধু কার চার ফেরা করিয়া বাধা; প্রত্যেক পেশীটি সুপ্রকট, বুকখানা বোধ করি চল্লিশ-বিয়াল্লিশ ইঞ্চি।

দেখো ভাই, হামারা উমর হুয়া বহত, দেখা যায় বহত। কেতনা ধরমঘট হুয়া পহেলে, কেতো আদমী ভুখাসে মর গিয়া, দানা নেহি মিলা, পানি—শুধু পানি পিয়ে ধরমঘট চালায়; আখের মে হুয়া কি, কোইকো নোকরি গিয়া, কোইকো জেহেল হুয়া, যিসকো নোকরি নেহি গিয়া উসকা তলব কম হো গিয়া।

ছোট মিস্ত্রি বলে, সে তো বটেই, প্রথম যারা কষ্ট করে গিয়েছে, তাদের দৌলতেই আজ যেটুকু হয়েছে।

সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সঙ্গে সঙ্গে ফেলে সবাই। সে দীর্ঘশ্বাস বোধ করি অতীতের সহকর্মী নির্যাতিত বন্ধুদের প্রতি উহাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

ফায়ারম্যান বলে, আরে আজকাল তো বহুত সুবিধা, ধরমঘট বললেই হল।

ছোট মিস্ত্রি বলে, হ্যাঁ, এখন আর–

কথার উপর কথা দিয়া গোষ্ঠ বলে, এখন আর তখন—এ তফাত বড় কিছু হয় নি ভাই। তখন ধমক দিয়ে কাজ সারত, আর এখন ফন্দি করে–

ফন্দি-টন্দিতে বড় কিছু হবে না, আর সে গুড়ে বালি–

বালি দিলে ওরা জলে গুলে গুড়ের পানা করে নিতে জানে। আচ্ছা, মুখে তো বল, হীরে। আর জিরের দামের তফাত মানুষের করা

আর সে তো বটেই, জানের দাম তো সবারই সমান। তবে সমান দামে আমরা বিকুতে পারি না, সে দোষ কার বলব?

নসিবের।

কে জানে! ছোট মিস্ত্ৰি বসিয়া ভাবে, কথাটা তাহার মনে ধরে না, দুর্বল রিক্ত মস্তিষ্কও ইহার সমাধান করিতে পারে না; তাহার পর সমস্ত সংস্কারের তমসায় আচ্ছন, দৃষ্টি আর যায় না।

গোষ্ঠ বলে, দাদা রে, বুদ্ধি যার, বল তার, আর দুনিয়ার মালিক সে চিরদিন।

ড্রাইভার বলে, জরুর, বুদ্ধিকে মারে সব হোতা হ্যায়। একদকে কেয়া হুয়া শুনো। হুয়া কি, এক দরখাস হামলোক দিয়া কি, দেশোয়াল ড্রাইবর, ফয়ারম্যানকো গ্ৰেড বাড় যায়, ডিপার্টমেন্টকো সব কোইকো সাথ সমান হো যায়; নেহি তো হামলোক কাম ছোড় দেবে।

ধর্মঘট হল তা হলে।

নেই হল, দরখাসকে আচ্ছা হুকুম নেই হোনেসে হোবে এই ঠিক হল। হ্যাঁ, উসকে বাদ তিন ডিভিসনকে তিন ডি. টি. এস. বাহাল হল, দরখাসকে হাল মালুম করনেকে লিয়ে।

হ্যাঁ, হল তো ঘোড়ার ডিম?

না ভেইয়া, বহুত বাত আচ্ছ; হাঁ, হুয়া কি, ওহি তিন সাব লোক হুকুম দিয়া কি সব। ডিবিসনসে দেশোয়াল আদমীর তিন তিন সর্দার বড়েমে ভেজ দেনা, হুয়া সাব লোককা সাথ বাত হোগা। হাঁ, দেশোয়াল লোক তো গেইললা, থান্ট কিলাসমে; ময়লে ওদের লুগা, বিড়ি পিতা, উ লোক জরুর থাট কিলাসমে যাবে। হ্যাঁ, হাবড়েমে মুলাকাত তো হুয়া। দেশোয়াল লোক বোলা, সাব দেখো, উঁখামে ময় মর যাতা, লুগা না মিলতো; মে-লোগনকা তিয়াষকো পানি না মিলি, দেশোয়াল মাটি পাথল তোড়কে লাইন বানা, উসকে শিরমে ললাহে গিরতা, কাঠ গিরতা, জান দেতা, আওর, সাব বোলা, ই তো ঠিক বাত, জরুর তুমাহারা তলব বাড় যায়গা।

গোষ্ঠ বলে, বাস, ওই বলে ভুক্তি দিয়ে চলে গেল!

নেহি, উস বখৎ টিফিনকা টায়েম হুয়া রহ্যাঁ, সাব বোলা, বহুত আচ্ছা, টিফিনকো বাদ ইয়ে বাত হোগা, যাও বাবালোক, তুম লোগভি টিফিন করকে আও। সাব সব কইকো এক এক। রূপৈয়া দিহিস। টিফিনকে বাদ সাব পহিলে পুছা কি, তুম সব কেয়া খায়া, কেতনেকো খায়া; কোই খায়া চারপয়সেকা সত্ত্ব, এক পয়সেকা নিমক, পয়সে ভর মরচাই; কোই খায়া চার পয়সেকা চানা। লেকেন দো আনেকা জাস্তি কোই নেহি খায়া, আওর চৌদ্দ আনা কোই জেবমে, কোই লগামে বাঁধ লিয়া। সাব বোলা, ময় কেতনোকো খায়া জানতা—চার রূপৈয়া। ওহিমে বস্ সব মাটি হো গিয়া, তলব কুছ যাস্তি মিলা, লেকেন সমান না মিলা।

বাঃ রে! আমার মেহত, তার দাম আমি পাব, সে পয়সা খরচ করি না করি আমার খুশি।

বেশি খেতে, ভাল খেতে কেউ জানে না, ভাল বাড়িতে থাকতে কেউ ভালবাসে না!

ওহি তো ভেইয়া, খায়া নেহি কাহে? রূপৈয়া ভোর খানেসে তো বহুত জাস্তি তলব মিল জাতা।

নেহি মিলতা, টাকা ভর খেলে কি বলত জান, বলত, যত পাবে ততই খাবে; পয়সা তোমরা রাখতে জান না, দিয়ে কি হবে?

আরে বাপু, এতদিন না খেয়ে যে পেট মরে আছে, আজ যে খেতে ভয় লাগে, হজম হবে না; মনে যে হয় না, এমনই ভাল চিরদিনই খেতে পাব।

ভেইয়া, হুয়া তো লেকিন এহি; আর ইয়ে হাল উলট যারা কব, কৌন জানতা!

ছোট মিস্ত্ৰি কহে, আবার তোমরা বল—

বাত চলতা হ্যায়, মালুম হোত ধরমঘট চলেগ। তামা–ম দেশোয়াল এক সাথমে কাম। ছোড় দেগা। চার বাবু আয়াথা উ রোজ, মুশকিলকে বাত ইয়ে হ্যায় কি, গরিব আদমি তামাম ধরমঘটকে বখত খানে নেহি মিলতা। বাবু লোক কুছ কুছ দেতা হ্যায়, হামলোককা তরফসে বাতভি করতা হ্যায়; আওর কোই কোই ঘুষভি খা লেতা হ্যায়।

উ লোক জরুর ঘুষ খায়েগা ভাই; বিনা গরজে ওরা এক পা হাঁটে না।

গোষ্ঠর মনে জাগে জমিদারের কথা, মহাজনের কথা, সকলেরই মনে জাগে।

দোষ নাই; যুগ-যুগান্তর যাহারা ইহাদের লুটিয়া খাইয়াছে, তাহাদের বিশ্বাস করিবার মত শক্তি ইহাদের নাই। কথাটা এত খোলাভাবে ইহারা বোঝে না, কিন্তু জন্মগত সংস্কার, অহিনকুলের জন্মগত বিরোধের মত।

হঠাৎ ছোট মিস্ত্রি বলে, তোমরাও লাগাও, আমরাও লাগাব, ধৰ্মঘট করব, জরুর করব; সারাদিন খেটে এক টাকা, বার আনা, আট আনা পয়সা, নেহি চলেগ। জরুর ধর্মঘট করব।

গোষ্ঠ কহে, মুশকিল ওই বাউরি বেটাদের নিয়ে; কিছুতেই ঘামবে না, ওরা বলবে, বেশ চলছে ভাই, কে হাঙ্গামা করে।

না করে তো মজা দেখাব।

রাত্রের কথা রাত্রের অন্ধকারেই ড়ুবিয়া থাকে, না অভাবের তাড়নায় বুকের মাঝে কর্মের সময়ে পুঞ্জীভূত হইতে থাকে, কে জানে!

প্ৰভাতে আবার সব কাজে ছোটে।

সারাটা দিন আবার গা দিয়া ঘাম ঝরে, দুরন্ত রৌদ্ৰে দেহ তাতিয়া ওঠে, আগুনের আঁচে ঝলসায়, বুকের রক্ত শুকায়।

কাজের শেষে, বেলা চারটায়, আবার অবসন্ন দেহে আসিয়া অফিস-ঘরে হাত পাতিয়া দাঁড়ায়।

খাজাঞ্চীর তবু অবকাশ হয় না, বলে, দাঁড়া রে বাপু, ঘোড়ায় চড়ে এলি যে সব! তিন পয়সা আর দুই পয়সা পাঁচ পয়সা—আরে গেল, এই চাপরাসী, ই লোককে ভাগা দেও তে।

অফিস-ঘরের ঘড়িটা অবিরাম চলে টুকটাক টুকটাক; সে হিসাব দেয়, দিনের এগার ঘণ্টা, বার মিনিট, ছত্রিশ সেকেন্ড গেল—

গোষ্ঠ বলে, চারটে বেজে বার মিনিট, গোটা দিনটাই গেল—

ছোট মিস্ত্রি বলে, একটা দিন যায়, আর আমাদের পেরমাই যায় কদিন, তার হিসেব ও ঘড়িতে মিলবে না।

সত্য কথা, ইহাদের জীবনের যে কত ঘণ্টা গেল, তাহার হিসাব ওই ঘড়িটা দিতে পারে। না, সে গতিতে ছুটিতেও পারে না।

সেদিন তখন দশটা বাজে।

বয়লারের গর্ভে আগুন জ্বলে, উৎপাদিত বিপুল শক্তি গুমগুম শব্দ করে।

শ্রমিকের দল আপন আপন কাজে লাগিয়া যায়।

কলের ছোট বড় চাকাগুলা ঘুরিতে শুরু করে, প্রথমে ধীরে ধীরে, তারপর দ্রুত—দ্রুততর।

দাঁতওয়ালা চাকাগুলা তে দাঁত মিলিয়া অবহেলে ওই বিরাট লোহার রাজ্য চালাইয়া চলিয়াছে, শ্ৰান্তি নাই, বিরক্তি নাই, অবসাদ নাই।

গোষ্ঠ বয়লারটার পানে তাকাইয়া কি ভাবিতে ভাবিতে আপন মনেই বলে, ঠিক ওই ছুঁড়ে মালিকদের মত, দুনিয়াটা পাঁতে পাঁতে টেনে গিলেই চলেছে, গিলেই চলেছে; অরুচি নাই, বিরাম নাই, অবিরাম।

একটা ছেলে আসিয়া কয়খানা কাগজ দিয়া যায়, গোষ্ঠ কহে, কি রে?

ছেলেটা সরিয়া যাইতে যাইতে কহে, চুপ। ম্যানেজার দেখতে পাবে, পড়ে দেখ না।

গোষ্ঠ কাগজটা পড়ে, শ্রমিক মিলিত হও।

গোষ্ঠ তাচ্ছিল্যভরে কাগজখানা বয়লারের মুখে ফেলিয়া দিল, সেখানে অগ্নিগর্ভ লৌহপুরীটার আঁচেই হইয়া গেল তামাটে, সঙ্গে সঙ্গে কুঁকড়াইয়াও গেল। এমন কাগজ প্রায়ই পাওয়া যায়, ওই বাবুরা দেয়।

অন্য একজন ফায়ারম্যান কিন্তু সেটা মন দিয়া পড়ে।

এমন সময় সেখানে আসিয়া পড়িল মাদ্রাজী ম্যানেজার।

ম্যানেজার আসিয়াই কহে, সব ঠিক হ্যায় টিন্ডাল?

হেড ফায়ারম্যান টিন্ডাল, সে সেলাম বাজাইয়া কহে, হাঁ হুজুর, সব ঠিক হ্যায়।

স্টিম কেতনা?—বলিয়া ম্যানেজার নিজেই উপরের মিটারটার পানে চাহিয়া দেখে।

সহসা ম্যানেজারের নজরে পড়ে ওই ফায়ারম্যানের হাতের কাগজখানা, উত্তপ্তকণ্ঠে সে। কহে, উ কেয়া হ্যায়?

ফায়ারম্যানটি কহে, একঠো কাগজ হুজুর।

কেয়া লিখা হ্যায় উসমে, মিল তোড় দেও, স্ট্রাইক চালাও?

নেহি হুজুর, এক সাথ মিলনেকো লিয়ে লিখা হুয়া হ্যায়।

হা হ্যাঁ, ওহি বাত হ্যায়, ইউনিয়ন করনেকা লিয়ে লিখা হ্যায়। কোন্ দিয়া হ্যায়?

রাস্তামে মিল গিয়া হুজুর।

লায়ার, ঝুটা বাত, সচ কহো।

এবার সাহেব মাটিতে পা ঠোকে।

অগ্ন্যুত্তপ্ত শ্রমিক, তাহারও প্রাণে এ আঘাত সয় না, তাহার মনে হয়, ও লাথি মাটির বুকে তো নয়, উহাদেরই বুকে পড়িল। গোষ্ঠ গম্ভীর কণ্ঠে কহে, গালি মত দেন হুজুর।

ছোট মুখে বড় কথায় ম্যানেজারেরও মেজাজ গরম হইয়া ওঠে, সে হাতের বেতটা সপাং করিয়া গোঙর পিঠে বসাইয়া চলিয়া যায়।

যাইতে যাইতে কি ভাবিয়া ফিরিয়া দাঁড়াইয়া পকেট হইতে একটা টাকা গোষ্ঠের দিকে ষ্টুড়িয়া দিয়া আবার চলিয়া যায়, যাইবার সময় মোলায়েম সুরে বলিয়া যায়, ওইসিন কাগজ মিলনেসে বয়লারকো অন্দর ফেক দেনা, মগজ বিগাড় যায়ো।

বেতের জ্বালায়, অপমানের দহে গোষ্ঠ গুম হইয়া বসিয়া থাকে। ওই বয়লারটার শব্দ যেন ওর আহত বুকের মাঝে বাজে, ক্ষণপরে সহসা বয়লারটার ঢাকনিটা খুলিয়া, অপমানের দাম, ওই তাচ্ছিল্যভরে ঘুড়িয়া দেওয়া টাকাটা বিরাট অগ্নিতাবের ভিতর ফেলিয়া দেয়।

রুপাটা গলিয়া গলিয়া গড়াইয়া জ্বলন্ত কয়লার চারের মধ্যে কোথায় মিলাইয়া যায়, গোষ্ঠ একদৃষ্টে তাই দেখে।

টাকাটার ওই গতিতে তবু তাহার মনে সান্ত্বনা আসে।

মুক্ত দ্বারপথে বয়লারের আগুন যেন বিকট শব্দে বিশ্বগ্ৰাসে আগাইয়া আসিতে চায়।

রক্তচক্ষে গোষ্ঠ আপন মনেই কহে, পারবি, বাইরে এসে সারা সৃষ্টিটা অমনই করে গলিয়ে ফেলতে পারবি? দূর দূর, লোহার ঢাকনিটাই ফাটাতে পারি না, তা সৃষ্টি। মানুষের গোলাম তুই; আবার বলে, আগুন দেবতা!

অসম্ভব জোরে সে লোহার দরজাটা বন্ধ করিয়া দেয়, বলে, মর, ওরই ভেতরে গুমরে। গুমরে মর।

অন্য সঙ্গী কয়টি তাহারই পানে চাহিয়া বসিয়া থাকে, একটা সহানুভূতির দৃষ্টি সকলেরই চক্ষে, কিন্তু সান্ত্বনা দিবার ভাষা যেন পায় না, অক্ষমতার দোহাই দিয়া সান্ত্বনা দিতে মন বুঝি উহাদের আর ওঠে না, গোষ্ঠ আপন মনেই বুকের উষ্ণ আক্ষেপ প্রকাশ করিয়া যায়, ঠিক আমাদেরই মত, বুকের আগুন বুকের মাঝে অমনই গুমগুম করে, বেরিয়ে আসতে পারে না।

এইবার টিন্ডাল একটা কথা খুঁজিয়া পায়, কহে, আসবে রে, আসবে একদিন; বাবুরা বলে শুনিস নি?

তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে গোষ্ঠ বলে, হ্যাঁ, বেরুবে যেদিন, সেদিন আর এই হাড়পাঁজরাগুলো থাকবে না। আমাদের পোড়াতে আর আগুন লাগবে না, আর পোড়াবেই বা কে? টেনে ফেলে দেবে, মাটিতে হাড়গুলো মিশে যাবে, মাংস খাবে শেয়াল-শকুনি।

টিন্ডাল সহসা দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলে, নাঃ, এর বিধান করতেই হবে।

গোষ্ঠ হাসে অবিশ্বাসের হাসি।

টিন্ডাল বলে, চল, আজ বাবুদের কাছে যাব। ওরা বলে, সভা করলেই এর উপায় হবে; সব কেঁচো হয়ে যাবে।

অন্য একজন ফায়ারম্যান বলে, হ্যাঁ, ওদের কাছে যাবি, ওরা তাদের বুকের উপর বসে খাবে, আমি দু-দুবার দেখেছি, আমাদের দিয়ে ধর্মঘট করালে, আর শেষে ওরাই ঘুষ খেয়ে আমাদের সর্বনাশ করলে। ও বাবা, সাপের দুটো মুখ, যেমন মালিক, তেমনই ওই বাবুরা।

টিন্ডাল ঘন ঘন মাথা নাড়িয়া প্ৰতিবাদ করিয়া কহে, না না না, ওই যে শিবকালী আর সুরেনবাবু, ওই যে রে খদ্দর পরে, আমাদের পাড়ায় যায় মাঝে মাঝে, ওরা তা নয়। পাপী আদমির চেহারাই আলাদা হয় রে, মহাত্মাজীর শিষ্য ওরা। এই ছোকরা, এই!

ও পাশের কর্মরত ছোকরাটা এ-পাশ ও-পাশ চাহিয়া দেখিয়া ছুটিয়া আসে। হেড ফায়ারম্যান বলে, যা তো, বড় মিস্ত্রি, ছোট মিস্ত্রি আর রামকিষণ–এদের বলে আয়, যেন টিফিনে সব এইখানে আসে, কাজ আছে, বাড়ি না যায়।

ছোকরাটা বলে, সায়েব যদি দেখে?

টিন্ডাল কলে দিবার তেলের চুঙ্গিটা ওর হাতে দিয়া কহে, এইটে হাতে করে যা।

ছোঁড়াটা চুঙ্গি হাতে চলিয়া যায়।

বারটার ভে বাজে-টিফিনের ছুটির সিটি, সিটিটা আজ হয় অনাবশ্যক দীর্ঘ, আর ঘন ঘন ফায়ারম্যানগুলির মন যেন উৎকণ্ঠিতভাবে বলে, সাথীরা আয় আয়। বয়লারের বাঁশির সুরে তেমনই ভাষা উহারা ফুটাইতে চায়, মনে করে, এই অভিনবত্বের মাঝে আহ্বানের ইঙ্গিতটা সাথীরা বুঝিবে।

বড় মিস্ত্রি আসে, তেমনই নিম্প্রভ দৃষ্টি, যন্ত্রচালিতের মত ভাব। ছোট মিস্ত্রি আসে গান ধরিয়া, আর বাঁশি বাজায়ো না শ্যাম।

কি, সব খবর কি? কিছু পেয়েছিস নাকি, খাওয়াবি?

গোষ্ঠ বলে, ভাগ নিবি? এই দেখ।—বলিয়া পিঠটা খুলিয়া দেখায়, রক্তমুখী দড়ির মত। দাগ। কথায়, চোখে তাহার ব্যথার জ্বালা ফুটিয়া বাহির হয়, যেন বয়লারের মুখের ঢাকনিটা খুলিয়া দেওয়া হইয়াছে।

তাহার আঁচটা উহাদেরও উত্তপ্ত করিয়া তোলে।

বড় মিস্ত্রি গম্ভীর কণ্ঠে কহে, কে মেলে?

ছোট ম্যানেজার।

চল, বড় সায়েবের কাছে যাব।

টিন্ডাল বলে, হ্যাঁ, ওদের কাছে তো সব হবে, সব মুখ সেখাসঁখি হয়ে যাবে, ও হবে না।

তবে?

আমি বলছিলাম, চল, বাবুদের কাছে চল্‌।

ছোট মিস্ত্রি ঘৃণার ভঙ্গিতে কহে, ওরা আমাদের চেয়েও ভেড়া।

হেড ফায়ারম্যান বলে, তবু ওরা আমাদের দিকে তাকাবে, ওরাও চাকর, আমরাও চাকর, বুঝলি? আর যদি ঠকায়ই ওরা, তা হলে ওদের উপকার তো হবে।

অসহিষ্ণুভাবে ছোট মিস্ত্ৰি কহে, তা হবে না বাবা, ওসব আমি বুঝি না, যদি ঠকায় আমাদের, তবে জান নেব, স্পষ্ট কথা আমার; রাজি হও, তবে আমরা ওদের কাছে যাব।

টিন্ডাল বলে, না রে, শিবকালীবাবু সুরেনবাবু ঠকাবার আদমি নয়, ওরা মহাত্মাজীর চেলা।

ছোট মিস্ত্রি বলে, বিশ্বাস আমি কাউকে করি নে, সে চেলাই হোক আর ফেলাই থোক! আমাদের ভাতে মারে, আমরা হাতে মারব—এই বোঝাপড়া হয়, রাজি আছি।

তোর মনের দোষ, বুঝলি?

ঠকে আর ঠেকেই মানুষ শেখে; মুখ দেখে মন বোঝা যায় না, বুঝলি? বিশ্বাসের কাল নাই আর, যাকে বিশ্বাস করবি, সেই ঠকাবে; আঁটি কথা। আর দোষ দিস আমার?

কথাটা সত্যই খাঁটি, দোষ কাহার?

বঞ্চিতের, না বঞ্চকের?

যুগ-যুগান্তর ধরিয়া এই ক্ষুধাতুরের দল শুধু যে স্বার্থেই বঞ্চিত হইয়া আসিতেছে, তাহা তো নয়; যে বিশ্বাস মানুষের জীবনের একটা পরম আশ্বাস-শান্তি, সেটুকুতেও দুনিয়া এদের নিঃস্ব করিয়া তুলিয়াছে।

তাই এই রত্নভরা সারা বসুন্ধরা উহাদের চোখে আজ শুধু মেকি আর ফাঁকি ছাড়া কিছুই নয়।

যুগ-যুগান্তরের বঞ্চনায় আজ উহারা অন্তরে বাহিরে রিক্ত; হাহাকার আজ উহাদের বাণী।

বঞ্চনার ভয়ে ওরা এস্ত।

অবিশ্বাস আজ উহাদের সংস্কার।

বড় মিস্ত্রি বলে, ওরে, এতটা অবিশ্বাস ভাল নয়।

ওর সংস্কারগত বিশ্বাস আজও মরে নাই। বড় মিস্ত্রি আবার বলে, দুনিয়াতে আর বিশ্বাস রইল না, এরপর বাপও আর ছেলেকে বিশ্বাস করবে না।

ছোট মিস্ত্রি বলে, করবে নাই তো, তোমাদের সে এক কাল গিয়েছে, লোকে বিশ্বাস করে ঘরের কোণে লুকিয়ে টাকা ধার দিয়ে এসেছে; পাওনাদার মরে গিয়েছে, দেনাদার তার ওয়ারিশকে টাকা দিয়ে এসেছে; আর আজ, ঘোর দেখি সারা বাজারটা, একটা লোক সত্যি কথা কয়? দোকানি দাম বলে চার ডবল, খদ্দের তাতেই রাজি, মতলব হচ্ছে তার ফাঁকি দেবার, মিথ্যে বৈ সারা বাজারটায় কিছুই নাই। আর আমরা, আমাদের গলা তো সবাই কাটে, মালিক কাটে, খাজাঞ্চী কাটে, দোকানি কাটে, তুমি আমার কাট, আমি তোমার কাটি। অবিশ্বাসের দোষ আছে?

বড় মিস্ত্ৰি ভাবে; সমস্ত শ্রোতার দলও নির্বাক হইয়া ভাবে।

হেড ফায়ারম্যান নীরবতা ভঙ্গ করিয়া কহে, তা বেশ তো, আমাদের ওদের সঙ্গে মিলে কাজ কি আছে, ওদের পরামর্শ নিতে তো দোষ নাই, ওদের একটু খাঁটিয়ে নে না।

বড় মিস্ত্রি বলে, সেই ভাল, চল, ওদের দুজনকে সন্ধেতে আমাদের ওখানে যেতে বলে আসি। দল বাঁধিয়া সব বাবুদের বাসার দিকে যায়। শিবকালী কেরানী, আর সুরেন টাইপিস্ট।

পঁচিশ ছাব্বিশ বছর বয়স; শতকরা আশি জন বাঙালির ছেলের মতই দুর্বল দেহ; কিন্তু চোখে স্বপ্ন, বুকে আশা। চোখ হইতে মাঝে মাঝে আগুনের ঝলকও বাহির হয়; সহকর্মীরা শিহরিয়া ওঠে, কিন্তু আড়ালে ব্যঙ্গ করিয়া বলে, ভারত উদ্ধারের দল।

সুরেন বলে, আমরাই তার ভিত্তি গড়ে যাব। সুগভীর বিশ্বাস উহার বাক্যের প্রতি অক্ষরের মধ্যে রনরন করিয়া বাজে, সে ঝঙ্কারে সহকর্মীদের ব্যঙ্গ মূক হইয়া যায়।

শিবকালী বলে, সে শুভ প্রভাতের আলোর রেশ আকাশে লেগেছে, আকাশ লালচে হয়ে উঠেছে। এত বড় দুর্দশা, একটা এমনই বড় উন্নতির ইঙ্গিত নিশ্চয় করছে।

ওর কথার বেশ অর্থ হয় না, তবু সহকর্মীদের কেমন ভয় করে, অদূর ভবিষ্যতে একটা জীবন-মরণের যুদ্ধের ছবি মনে জাগিয়া ওঠে।

আবার বুকের এক কোণ হইতে লুপ্তপ্রায় একটা উত্তাপ যেন জাগিয়া ওঠে, খানিকটা উত্তেজনাও যেন লাগে, তারাও ভারত উদ্ধারের কথা কয়।

নাঃ, আর বেশি দেরি নাই।

একজন বৃদ্ধ কহে, তাও আমাদের নীতির আমলের আগে নয়।

দেশবন্ধু থাকলে কিন্তু আরও আগে হত।

মহাত্মাই কি করেন দেখ।

খবরের কাগজের নিয়মিত পাঠক একটি ছোকরা বলে, মহাত্মা কি হে, অর্ধ-উলঙ্গ রাজদ্রোহী ফকির বল।

থিয়েটারে হিরোয়িনের পার্ট করে রমেশ, সে ভাবাবেশে গান ধরে, আমরা ঘুচাব মা, তোর দৈন্য, আমরা ঘুচাব মা, তোর ক্লেশ।

একজন বলে, আন্, ড়ুগি তবলা আন্, হারমোনিয়ম আন্, আসর পাতু, তা না, ভারত আর ভারত। আদার ব্যাপারির জাহাজের খোঁজে কাজ কি বাপুঃ ভারত উদ্ধার হলে তোদের কি রাজ্যলাভ হবে শুনি?

খবরের কাগজের পাঠক ছোকরা উষ্ণ হইয়া কহে, কি বললে, কিছু হবে না?

কি হবে শুনি? জিওগ্রাফিতে পড় নি ধনমণি যে, পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরিতেছে, কিন্তু তাহা আমরা অনুভব করিতে পারি না; কেমন, না একটি বলের উপর একটি পিপীলিকা ছাড়িয়া দিয়া উহাকে যেভাবেই ঘুরাও না কেন, পিপীলিকা তাহার গতি বুঝিতে পারে না। বাবা, আমরা। হলাম পিপীলিকা।

স্বাধীনতা অধীনতায় কোনো ভেদ নাই দাদা, কোনো ভেদ নাই।

কলম পিষিয়া যাই, কলম পিষিয়া খাব,
বাঁশরী বাজার শুয়ে যেমন বাজাই।

ইহার পর আর মতভেদ থাকে না, ওরা বাঁশি বাজায়। স্বল্পপ্রবণ তরুণ দুইটি তখন ঘরের মাঝে বসিয়া শ্রমিক-সঙ্ গড়িয়া তুলিবার কর্মপন্থা ছকে।

শ্রমিকদের সঙ্গে মিলিবার চেষ্টাও উহাদের ছিল, গোষ্ঠ এখানে আসিবার পূর্বে উহারা দুই জনে শ্রমিকদের আড্ডায় যাইত; উহাদের মত হইয়া মিলিবার চেষ্টা করিত, কিন্তু মিলিত না। উহারা যাইতেই গায়কের গান বন্ধ হইয়া যাইত, কিষণলাল ঢোলকটা পাশে সরাইয়া রাখিত।

সুরেন কহিত, রাখলে কেন, লাগাও, আমরাও শুনি।

উহাদের বিছানাতেই বসিয়া পড়িত, কিন্তু তাহাদের হাতে বিষম আপত্তি।

বড় মিস্ত্রি একটা ময়ূর-আঁকা মাদুর বিছাইয়া কহিত, ওখানে নয়, বাবু, এখানে বসুন, এখানে বসুন।

ব্যবধান একটা থাকিয়াই যায়।

ফিরিবার পথে দুই বন্ধুতে তাই লইয়া আলোচনা হইত।

সুরেন কহিত, এ ব্যবধান আমাদের স্বখাত-সলিল। যাক, এ ব্যবধান পুড়িয়ে ফেলতে হবে। অসহিষ্ণু হলে চলবে না, দশ দিন, বিশ দিন, দু মাস, ছ মাস–একদিন ভুল ভাঙতে বাধ্য। হাত বাড়িয়ে অপেক্ষা করতে হবে, হতাশ হয়ে, অসহিষ্ণু হয়ে ফিরিয়ে নিলে চলবে না, একদিন ওরা সে হাত ধরবেই।

শিবকালী কহে, নিশ্চয়, এই যে একটা স্বাতন্ত্র, এই সে মিলনের সূচনা; দুনিয়াতে প্রত্যেক জিনিসেরই একটা প্রতিক্রিয়া আছে; বৈশাখের শুষ্ক নদী শ্রাবণের বন্যার পূর্বাভাস।

ইহাদের এই আসা-যাওয়াটা কিন্তু শ্রমিকদের বেশি দিন ভাল লাগিল না; সন্দিগ্ধ চক্ষে, অধঃপতিত মনে নানা কথা জাগিয়া উঠিল; ফলে এমন কুৎসা তাহারা রটাইল যে সুরেনশিবকালীকে যাওয়া-আসা বন্ধ করিতে হইল, কিন্তু রাগ করিল না।

সহকর্মীরা ইঙ্গিত করিল, বাবা, সিংকিং সিংকিং ওয়াটার ড্রিংকিং।

সেটা কিন্তু প্রত্যক্ষে নয়, পরোক্ষে।

সুরেন সে শুনিয়া আগুন হইয়া ওঠে; শিবকালী কিন্তু ফুৎকারে কথাটা উড়াইয়া দিতে চাহিয়া কয়, ডোন্ট বি সেন্টিমেন্টাল।

সেদিন শিবকালী আর সুরেন টিফিনের ছুটিতে মেসে বসিয়া ওই কথাই কহিতেছিল, ও ঘরে বাবুরা বসিয়া তামাক টানিতেছিল, এমন সময় শ্রমিকদের দল আসিয়া সেলাম জানাইল।

শিবকালী আপনার ও সুরেনের বিছানা দুইটা টানিয়া পাতিয়া দিয়া কহে, বসো বসো মিস্ত্রি, বসো সব।

বড় মিস্ত্রি জোড়হাত করিয়া কহে, মাপ করবেন বাবু, তেল কালি কয়লায় গায়ে একটা খোলস পড়ে গিয়েছে, বসলে বিছানাই মাটি হবে, আমরা এসেছি, একবার সন্ধেবেলায় আমাদের ওখানে পায়ের ধুলো দিতে হবে।

সুরেন কহে, কি ব্যাপার হে মিস্ত্রি?

আজ্ঞে, সেইখানেই বলব সব, যাবেন তা হলে, যেতে বলতে মুখ তো আমাদেরই নাই।

শিবকালী হাসিয়া কহে, সেজন্যে লজ্জিত হয়ো না মিস্ত্রি, পাঁচজনের মন তো সমান নয়, তাই পাঁচজনে পাঁচ কথা কয়; তা যাব আমরা। তবে কি জন্যে যেতে হবে জানা থাকলে সুবিধে হত।

ছোট মিস্ত্ৰি কহে, আমরা একটা সভা গড়তে চাই, তবে আপনারা শুধু গড়ে দেবেন, আপনাদের সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ থাকবে না।

শিবকালী ছোট মিস্ত্রিকে আবেগে আলিঙ্গন করে।

বড় মিস্ত্ৰি কহে, কালি লাগবে বাবু, কালি লাগবে।

শিবকালী কহে, মিস্ত্রি, কালি-লাগা জামাটা আমি রেখে দেব? এ কালি আমি মুছব না।

সুরেন কহে, আর আমাদের গায়ের কালি বড় মিস্ত্রি, এ যে চামড়া না তুললে উঠবে না; কালিতে লজ্জাই বা কি, আর ক্ষতিই বা কি?

ছোট মিস্ত্রি বলে, আমরা কিন্তু কিছু জলখাবারের ব্যবস্থা করব। সরল ব্যবহারে ছোট মিস্ত্রিরও উহাদের বেশ ভাল লাগে।

সুরেন বলে, বেশ বেশ, বহুত আচ্ছা, খেতে আমি খুব ভালবাসি।

শিবকালী কহে, আর আমি বুঝি বাসি না, আমি বুঝি মার খেতে, গাল খেতে ভালবাসি?

সকলে হাসিয়া ওঠে, লঘু-হাস্যপরিহাসের মধ্য দিয়া সকলে কেমন একটা সরল আত্মীয়তার সরল সমভূমিতে আসিয়া দাঁড়ায়; ওই লঘু হাস্যপরিহাসের মধ্য দিয়াই বুঝি প্রথম আত্মীয়তার সৃষ্টি হয়, ক্ৰমে সে গভীরতার মধ্য দিয়া সুদৃঢ় বিরাট হয়।

বীজ উপ্ত হয় স্বল্প মাটির নিচে, গাছ বড় হয়, তখন মূল চলিয়া যায় মাটির গভীরতা ভেদ করিয়া সুদূর অন্তরে—অন্তরতম প্রদেশে।

ওদিকে সিটি বাজে-কাজ, কাজ, কাজ।

শ্রমিকদের দল চলিয়া যায়।

হেড ফায়ারম্যান বলে, দেখলি কেমন লোক?

বুড়া মিস্ত্রি বলে, ওরা বুকে করে নিতে চায়, আমাদেরই বিশ্বাস হয় না, আর আমাদের বুকে কাটা আছে, সহ্যও হয় না।

ছোট মিস্ত্রি বলে, পাড়াগাঁয়ের বাবু বোধহয়; তাই এমন ধারা। পাড়াগাঁয়ের মুচিও গ্রামসুবাদে মামা হয়।

গোষ্ঠ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আজ তাহার গ্রামকে মনে পড়ে, রমাপতি মাস্টার, মুদি খুড়ো, যোগী কত্তা; সত্য সেখানে অভাব থাক, নিদারুণ হতাশা থাক, তবু মমতা ছিল।

আবার আপন আপন কাজে লাগিয়া যায়।

ওই আগুনের সঙ্গে লড়াই করিতে মন আবার হালকা হইয়া ওঠে। গোষ্ঠর মুখেও গান আসে, হাসি ফোটে।

এতক্ষণে সে হেড ফায়ারম্যানকে বলে, যাই বল বাপু, এও বেশ, খাই দাই কাম বাজাই, ধার কারুর ধারি না। আর এ কাম কি, একটা দৈত্যের সঙ্গে লড়াই!

কর্মের মাঝে একটা আনন্দ আছে, আত্মপ্রসাদ আছে যে।

 

সেইদিনই সন্ধ্যায় শ্রমিকস গঠিত হইয়া যায়; বড় মিস্ত্রি, ছাট মিস্ত্রি, টিন্ডাল, কিষণলাল, গোষ্ঠকে লইয়া এক পঞ্চায়েত গঠিত হয় উহাদের।

কত নূতন নিয়মকানুন হয়।

বেশ একটা আনন্দও পায়। কি যেন গভীরভাবে বুঝিবার চেষ্টা করে।

বাবুরা বলে, মাটির বুক চিরে ফসল ফলায় কারা?

তোমরা।

আগুনের সঙ্গে লড়াই করে কল চালায় কারা?

তোমরা।

মাটির ভেতর খনির অন্ধকূপে সোনা রুপো হীরে জহরত খুঁড়ে বের করে কারা?

তোমরা।

তোমরা হচ্ছ দুনিয়ার হাত, তোমরা দুনিয়ার মুখে আহার তুলে দাও, তবে দুনিয়া খায়।

কথাটায় মনের ভিতর উহাদের অহঙ্কার জাগে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের এত বড়, এত শক্তিমান ভাবিতে বুক কাঁপিয়া ওঠে, নিজেকে যেন নিজেরই ভয় হয়।

বুড়ি সাবি বাউরিনী বলে, না বাবু, ও আবার কি কথা, আমরা গরিব মানুষ, গরিবের মত থাকব–না বাপু, ভয় লাগছে আমার।

সভার কাজ সারিয়া তরুণ দুইটিও ফেরে নীরব নিস্তব্ধ। তাহারাও ভাবে।

সহসা সুরেন কহে, ওদের এখন চাই সেলফ-কশাস্নেস; আত্মবিস্মৃতি না টুটলে জাগরণ আসবে না; শিক্ষার ব্যবস্থা না হলে তা হবে না, নাইট স্কুল স্টার্ট করে ফেলা যাক।

শিবকালী বলে, এদের জন্যে তার প্রয়োজন নেই, সে ব্যর্থ হয়ে যাবে। লঘু মেঘ, সে হল বাষ্প, তার মধ্যে শত সাধনাতেও বজ্রের সন্ধান পাবে না, কিন্তু ঝড় এসে তাদের মিলিত করে দেয়, বর্ষণে বজ্রে ধরণী সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে।

যুগ-যুগান্তরের উচ্ছঙ্খল শক্তি কিন্তু একদিনে সংযত হয় না, দূর-দূরান্তরের প্রবহমানা নদীর ঘূর্ণিভরা বন্যা সহসা বাঁধনে বাঁধা যায় না।

উহাদের আজন্মের উদ্দাম দুর্দম প্রকৃতি নিয়মের বাঁধন মানিতে চায় না। দল আবার ভাঙিতে শুরু করে, একদিনের কথার ঘায়ে জাগানো অনুভূতি ধীরে ধীরে সুপ্ত হইয়া পড়ে।

বাউরির দল আগে ভাঙিল।

একদিন উহারা আসিয়া কহিল, তোমাদের সঙ্গে আমরা আর নাই বাপু।

বড় মিস্ত্রি বলে, কি হল কি, কেন, থাকবি না কেন শুনি?

মানতে হয় আমরা মালিককে মানব, তোমাদের কেন মানব? খেতে পরতে দাও তোমরা?

আরে, শোন্ শোন্‌, তোরাই সব পঞ্চায়েত হবি, আয় না, আমরা ছেড়ে দিচ্ছি।

কে সে কথা শোনে, উহারা কিছুতেই মানে না, জবাব দিয়া চলিয়া যায়, তখন পাড়ায় উহাদের মহোৎসব চলিতেছে, মালিক-পক্ষ আজ মদের জন্য করকরে দশ টাকা বকশিশ করিয়াছে।

সুরেন আবার প্রাণপণ চেষ্টা করে, কিন্তু কিছু হয় না; ভাঙা দল আর জোড়া লাগে না।

শিবকালী কহিল, কেন মিছে চেষ্টা করছ সুরেন, চাপ না পড়লে ওরা এক হবে না; দেখেছ, আকাশে আকাশে মেঘ আসে, চলে যায়, কিন্তু যেদিন বায়ুপ্রবাহ চাপ দেয় সেদিন বিচ্ছিন্ন মেঘমালা জমাট বেঁধে এগিয়ে আসে।

সুরেও যাওয়া-আসা ছাড়িল।

আবার যা ছিল তাই; সেই নেশা, নাচ, গান, তাণ্ডব, কোনোরূপে জীবনটাকে টানিয়া লইয়া যাওয়া, জীবনের দিন কয়টাকে ক্ষয় করা।

হঠাৎ কাজের চাপ পড়ায় কোম্পানি শ্রমিকদের কাজের সময় সাময়িকভাবে এক ঘণ্টা বাড়াইয়া দিল, মজুরিও বাড়িল, কিন্তু সে বাড়া অতি সামান্য, বিশেষ সারাটা দিন পরিশ্রমের প্রচণ্ড ক্লান্তি, অবসাদের মধ্যে আরও এক ঘণ্টা পরিশ্রমের বিরক্তিক্লান্তির তুলনায় তাহার মূল্য নগণ্য, মজুরদের হাতে তৃপ্তি হইল না।

একটা অসন্তোষ, মনের মধ্যে সহিয়া যাওয়া পুঞ্জ ভূত অসন্তোষের উপরে আসিয়া সে অসন্তোষকে নাড়া দিয়া যেন সজীব করিয়া তুলিল।

মদের দোকানে ভিড় বেশি জমিতে শুরু হইল; এই অবসাদ এই ক্লান্তি দূর করিতে, সারাদিনের আয়ুর দামে, আয়ুক্ষয়-করা বিষ উহারা আকণ্ঠ গিলিতে শুরু করিল।

গোষ্ঠ যেন মদে পাগল হইয়া উঠিল; কোনোদিন মজুরির অর্ধেক যায়, কোনোদিন বা বার আনার ষোল আনাই নেশায় চলিয়া যায়।

সেদিন গোষ্ঠ শূন্য হাতে ফিরিয়া আসিয়া ভাম হইয়া দাওয়ার উপর এলাইয়া পড়িল।

দামিনীর তখনও রান্না চাপে নাই, গোষ্ঠই রোজ ফিরিবার পথে বাজার করিয়া আনে, আজ তাহার শুন্য হাত আর নেশার অবস্থা দেখিয়া শঙ্কা হইল।

চোখ দিয়া দুই ফোটা জলও গড়াইয়া পড়িল, আজ মনে হয়, শত দীনতা, শত নির্যাতনের মধ্যে সে ছোট গ্রামখানি, সে ছিল ভাল।

মনে পড়ে সাতু ঠকুরঝিকে, এমন দিনে দুই মুঠা চালের অভাব সেখানে কোনোদিন হইত না। এখানে লোকের নিজেরই কুলায় না, অপরকে দিবে কোথা হইতে?

বহুক্ষণ অপেক্ষা করিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া সে কহিল, খরচ–?

গোষ্ঠ মুখ বাকাইয়া কহে, কেয়া খরচ, কিস্কে খরচ, খরচ হামরা নেহি হ্যায়, জমা ক{ লেও, সব জমা হোগা; সেরেফ হামকো খরচ লিখু দেও।

চোখ মুছিতে মুছিতে দামিনী গোষ্ঠর মুখে-চোখে জল দিয়া বাতাস করিয়া বলে, ওগো, রান্না হবে কিসে, খরচ কই, খরচ?

দুই হাতেরই বুড়ো আঙুল দুইটা প্রবলভাবে নাড়িয়া গোষ্ঠ কহে, ফক্কা, ফক্কা।

দামিনীর সারা অঙ্গ যেন হিম হইয়া যায়, উদরের মাঝে ক্ষুধার অগ্নিদাহ দাউদাউ করিয়া জ্বলে, সে তো উপেক্ষার নয়, ক্ষুধার তাড়নায় জননী সন্তানের মাংস খাইয়াছে; সে উম্মাভরে কহে, তারপর পেটপেট চলবে কিসে?

গোষ্ঠ হাত-পা ছুঁড়িয়া খুব উৎসাহের সহিত চেঁচায়, আগুন জ্বালাও, পেটমে আগুন জ্বালাও।

দামিনী আর কথা কয় না; ঘরের মেঝের উপর কাপড় বিছাইয়া শুইয়া পড়ে, পেটে তো নয়, তাহার ইচ্ছা করে সংসারজীবনে আগুন দিতে। ইচ্ছা করে, যাই মহান্তর কাছে। শুধু একটি মিষ্ট কথার অপেক্ষা; ওই কথাটির দামে সে যাহা দিবে সে অনেক, এই স্বামীর ঘরে তাহা কল্পনার বস্তু।

দামিনী যায়ও ঘরের দুয়ার পর্যন্ত; কিন্তু কেমন যেন আর পা ওঠে না; মনে পড়ে তার দৃষ্টির লোলুপতা!

সারা অঙ্গ তাহার ঘিনঘন করিয়া ওঠে।

সে আবার ফিরিয়া আসিয়া শোয়।

উপবাসের অবসাদে দামিনী তন্দ্ৰাচ্ছন্ন হইয়া পড়ে, সারাটা দিন সে শুধু জলের উপর আছে, ওবেলা ঘরে যাহা ছিল, তাহাতে গোষ্ঠর জলখাবারও পুরা হয় নাই।

তার ঘোরে সে স্বপ্ন দেখে, মহান্ত তাহাকে ডাকে, সম্মুখে তাহারথালার উপর নানা উপচারে সাজানো নৈবেদ্য, পাশেই একখানি সুন্দর আসন পাতা, যেন সে বলে, এস, দেবীর মতই তোমায় পূজা করব। সহসা একটা প্রবল আকর্ষণে তাহার তন্দ্ৰা ছুটিয়া যায়।

মাতাল গোষ্ঠ তাহার চুলের মুঠি ধরিয়া উঠাইয়া বসাইয়া দিয়া কহে, এই, ভাত দে—ভাত।

আগুনের দাহে নেশার বিষে এতক্ষণে তাহার উদরে বিশ্বাসী আগুন জ্বলিয়া উঠিয়ছিল।

দামিনী রুক্ষ দৃষ্টিতে স্বামীর পানে চায়, স্বপ্নে সুখ এ তাহাকে দিবে না?

বুভুক্ষু মদ্যপের কাছে এ নীরবতা অসহ্য বলিয়া বোধ হয়, গোষ্ঠ একটা চড় কইয়া কহে, নবাবের বেটি, হারামজাদী–

শরমস্তব্ধ নারীকণ্ঠ একবার অতর্কিতে ফুটিয়া, আবার নীরব হইয়া যায়; শুধু চোখের জল বাঁধ মানে না।

সম্মুখেই ও ঘরে বসিয়া ছোট মিস্ত্রি ব্যাপারটা অনুভব করিয়া গোষ্ঠকে তিরস্কার করে, এই উল্লু, এই গোষ্ঠ, কি হচ্ছে কি? মেয়েলোকের গায়ে হাত? খবরদার–

গোষ্ঠ ঘরের ভিতর হইতেই পড়িয়া পড়িয়া আস্ফালন করে, উঠিতে পারে না।

নারীকন্ঠের চাপা ক্ৰন্দনের আভাস তখনও পাওয়া যায়।

ছোট মিস্ত্রি আসিয়া ঘরের মধ্যে উঁকি মারে; চোখে পড়ে দামিনী।

দামিনী বড় বাহির হইত না, ইহাদের এই লোলুপ দৃষ্টি যেন তাহাকে বিধিত। সামনের বারান্দায় গোষ্ঠ আবার একটা অবরোধ তুলিয়াছিল। দামিনীকে দেখিয়া ছোট মিস্ত্রির দৃষ্টি আর ফিরিল না, লোলুপ উদগ্ৰ ক্ষুধা তাহার মত্ত চোখে জ্বলজ্বল করে। অবরোধের মাঝে থাকিয়া দামিনীর রং আরও খুলিয়াছে, অশান্তি-অভাবের পীড়নে সে শীর্ণ হওয়ায় তাহাকে যেন লম্বা দেখায়, কিন্তু মানায় যেন বেশি, বেশ ছিপছিপে দীর্ঘ দেহ।

দামিনী মিস্ত্রিকে দেখিয়া তাড়াতাড়ি মাথায় কাপড় টানিয়া দিতে গেল, কিন্তু শতছিন্ন। কাপড়খানার এক পাশ টানিতে আর এক পাশ নগ্ন হইয়া পড়ে; সেদিকে দামিনীর ভ্রুক্ষেপ ছিল না, সে মুখখানা ঢাকিল, কিন্তু অঙ্গের ওই একটা দিকের নগ্ন সৌন্দর্যেই মাতাল ছোট মিস্ত্রি উন্মত্ত হইয়া ওঠে; সে হাত বাড়াইয়া দামিনীকে ডাকে, একটা পা ঘরের মধ্যেও আগাইয়া দেয়।

ভয়ে দামিনীর বুক কাঁপিয়া ওঠে, সে ছুটিয়া গিয়া ওই জ্ঞানশূন্য স্বামীকে জড়াইয়া ডাকে, ওগো, ওগো, ওঠ গো, ওঠ।

ছোট মিস্ত্রি এবার পালায়, বলিতে বলিতে যায়, শালার ফাঁসি দিতে হয়, এমন পরিবারের গায়ে কাপড় না দিয়ে শালা মদ খায়।

দামিনী এবার উঠিয়া তাড়াতাড়ি দরজাটা বন্ধ করিয়া দেয়। ওই মুহূৰ্তটুকুতে সে দেখে, আরও একজনের দৃষ্টি তাহারই উপর আবদ্ধ, সেই ঘোলাটে চোখের নিষ্প্রভ দৃষ্টি।

দামিনীর আপন দেহের পরে ধিক্কার জন্মিয়া যায়।

সে ফিরিয়া গিয়া আবার শোয়।

আরও একজোড়া দৃষ্টি তখন দামিনীর পরে আবদ্ধ ছিল; পিছনের ছোট ঘুলঘুলির মধ্য দিয়া পিপাসিত চক্ষু জাগিয়া ছিল সুবলের।

পান-বিড়ি, মুড়ি-মুড়কির দোকান ফেলিয়া সে দিনে দশবার সেথায় আসিয়া চোখ পাতিয়া থাকিত, বউকে একটি পলক দেখার জন্য।

স্টেশনের জমাদারকে কহিত, দেখো তো দাদা দোকানটা, আমি এলাম বলে, বিড়ি খাও ততক্ষণ।

ঘুলঘুলি তো নয়, যেন তমসার দ্বারপথ, অন্ধকার—অন্ধকার; দৃষ্টি শিহরিয়া ওঠে, চোখের তারা শঙ্কা পায়, একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া সুবল ফিরিয়া আসিত। আবার হয়ত ঘণ্টাখানেক পরে, বালতির জলটা ফেলিয়া দিয়া আপন মনেই কহে, এঃ, ময়লা কত! জল পালটে আনি, দোকানটা দেখো তো ভাই পানিপাঁড়ে।

পানিপাড়ে হাসিয়া কহে, এ যে জল ফেলে জল আনতে যাওয়া হে, বলি, কোন্ ঘাটে হে, এ পাড়া না নাম-পাড়া। বাউরিপাড়ার পানে আঙুল দেখায়।

সুবলও আর সে সুবল নাই, এই মুখর আবহাওয়ায় সে বেশ জীবন্ত হইয়া উঠিয়াছে, মুখ ফুটিয়াছে, ছলনায় আর বাধে না; সে কহে, ঘাটে নয় হে, কলের মুখে।

পিরীতি করবি, গোপনে রাখবি, তবে তো থাকবি সুখে, বেশ, বেশ, বেঁচে থাক কালাচাঁদ।

দেখ, এই দেখ, জলে পোকা দেখ।

জল-ফেলা জায়গায় কয়টা পিঁপড়ে পড়ে, সুবল তাহাই দেখায়। তারপর ত্বরিত পদে সে চলিয়া যায়।

আজিও এমনই একটি গোপন চোখ-পাতার অবসরে এই ঘটনাটি তাহার চোখে পড়িল; অন্ধকারের মাঝে দামিনীকে উজ্জ্বলভাবে দেখা না গেলেও দামিনীর আর্ত কণ্ঠ, গোষ্ঠর গালিগালাজ, ছোট মিস্ত্রির ওই কাপড়ের কথা সুবলের কানে গেল; তাহার অরুদ্ধ দৃষ্টির সম্মুখে ভাসিয়া উঠিল অনাহারক্লিষ্টা, শীর্ণা, অবসন্না, অশ্রুমুখী দামিনী, পরনে জীর্ণ বাস; লাজতস্তা নারীর এ-পাশ আবরণ করিতে ও-পাশ নগ্ন হইয়া যায়। সে বুঝি মাটিতে লুটাইয়া পড়িয়া ধরিত্রী জননীর কোলে আশ্রয় চায়।

সুবলের আর জল ওয়া হইল না; সে ফিরিল।

কিছুক্ষণ পরেই সে একটা চাঙারি মাথায় করিয়া গোষ্ঠদের বাড়ি ঢুকিয়া হাঁকিল, কই হে, মোড়ল কই?

ছোট মিস্ত্রি দাওয়ায় বসিয়া কহে, কি হে দোকানি?

এই ভাই একটা সিধে আছে, মোড়লের বাড়ি দিতে হবে; অনেক দিন থেকেই মনে করছি, দোকান করলাম, মোড়ল গায়ের লোক, একদিন খাওয়াব; তা ভাই, আমার কে রাধে বাড়ে, তাই সিধে দিয়েই সারি। কই, মোড়ল কই?

বলিয়া সুবল গোষ্ঠর বারান্দায় উঠিয়া রুদ্ধ দ্বারে আঘাত করে।

ধীরে ধীরে দুয়ারটা খুলিয়া দিয়া দামিনী সরিয়া দাঁড়ায়, সুবল সম্ভারপাত্রটি মেঝের উপর নামাইয়া দিয়া মৃদু কণ্ঠে কহে, এমন দিনে আমাকে একটা খবর দিলেও তো পার।

দামিনী উত্তর দিতে পারে না, কাঁদিয়া ফেলে।

দামিনীর চোখে জল দেখিয়া সুবলও কাঁদিয়া ফেলিয়া কহে, বউ!—বলিয়া সে সান্ত্বনা দিবার অভিপ্ৰায়ে দামিনীর হাত দুইটি ধরিতে যায়, মুহূর্তে দামিনী হাত দুই পিছাইয়া গিয়া তাহার পানে তাকায়, সজল চোখেও দামিনী ঝলকিয়া যায়।

সুবল পলায়। গোষ্ঠর তখন নাক ডাকে, যেন মরণ-ঘুম।

দামিনী ঘরে খিল দিয়া ওই আহার্যসম্ভারের পানে চাহিয়া বসিয়া থাকে।

ভোরে উঠিয়া গোষ্ঠ ক্ষুধার যাতনায় চারিদিকে চায়, দামিনী তখন ওপাশে ভোরের দিকে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে।

চোখে পড়ে সেই খাবারের চাঙারিটা।

গোষ্ঠ সেটা কাছে টানিয়া জলখাবারের আয়োজনটুকু গোগ্ৰাসে গিলিতে থাকে।

একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দে পিছন ফিরিয়া সে দেখে, দামিনী তাহারই পানে একদৃষ্টে চাহিয়া আছে।

গোষ্ঠ ধীরে ধীরে তাহার পানে ফিরিয়া বসিয়া লজ্জিতভাবে কহে, কাল কি তোমাকে মেরেছিলাম?

দামিনী কথা কয় না, কাঁদে।

গোষ্ঠ কহে, আমাকে মাপ কর, করবে না?

দামিনী আবেগরুদ্ধ আব্দার-ভরা সুরে কহে, ওগুলো আর খেয়ো না।

 

ওই গোগ্রাসে গিলিয়া গোষ্ঠ কলের পানে ছোটে; ভভারবেলা হইতেই ফায়ারম্যানের বয়লারে আগুন দিতে হয়, হাতলের পর হাতল ভরা কয়লা অগ্নিগহ্বরে নিক্ষেপ করে, দাউদাউ করিয়া আগুন জ্বলে, চিমনি দিয়া রাশি রাশি কালো ধোঁয়া প্ৰভাতের স্বর্ণ-আলোর পথ রোধ করিয়া সমস্ত স্থানটা ম্লান ছায়াচ্ছন্ন করিয়া তোল।

বয়লারটা আপনার তেজে আপনি কঁপে, গোঙায়–গুমগুম, গুমগুম।

সাতটায় সিটি পড়ে, ভোঁ-ভোঁ।

গোষ্ঠ হাসে আর বয়লারটাকে তারিফ করিয়া বলে, বাঃ বেটা, বাঃ, বেশ বলছিস, ভোঁ–ভোঁ, দে সব ভোঁ-দৌড়।

কুলিমজুরদের দল সিটির শব্দে কলের পানে ছুটে হা অন্ন হা অন্ন করিয়া, মুখের রবে কথাটা রটে না বটে, কিন্তু তাহাদের ওই ক্ৰস্ত ভঙ্গিমার গতিতে তাহা ফুটিয়া ওঠে।

কল চলে। বয়লার গোঙায়, ইঞ্জিনের সঘন সুউচ্চ নির্মম শব্দ স্টিমের ফেঁসানি, বেটিঙের টানে বড় বড় চাকাগুলা অবিরাম ঘুরপাক খায়; শব্দ হয় একটা অনুনাসিক ঘন-ঘন ঘং ঘন ঘন ঘং বিপুল বিচিত্র বিকট শব্দ।

মজুরেরা কাজে মাতে; ওই শব্দরাজ্যে নিজের শ্বাস-প্রশ্বাস পড়ে কি না বোঝা যায় না; যন্ত্রের মত কাজ করিয়া চলে; ওই নির্মম বিরাট শব্দে একটা অনুরূপ আবহাওয়ার সৃষ্টি করে।

ওই আবহাওয়ায় মানুষের বুকে হৃৎপিণ্ডের কোমল নৃত্য ক্রমশ কঠোর প্রবল হইয়া ওঠে, ওই ইঞ্জিনটার সঙ্গে তাণ্ডবের তাল রাখিয়া ধকধক করিয়া চলিতে শুরু করে।

শ্বাস-প্রশ্বাস মুখ দিয়া হা-হা করিয়া পড়ে, যেন ঐ স্কিমের ফোঁসানির সঙ্গে সমতা রাখিতেই হইবে।

পেশিগুলা ওই যন্ত্রের মতই কঠিন হইয়া ওঠে।

মানুষের অন্তর ওই দাঁতওয়ালা চাকাগুলার মতই নিৰ্মম কঠোর হইয়া ওঠে।

একটা ছোঁড়া আসিয়া হেডফায়ারম্যান টিন্ডালকে কি ফিসফিস করিয়া বলিয়া যায়।

গোষ্ঠও ভুরু তুলিয়া ইঙ্গিতে প্ৰশ্ন করে, কি?

টিন্ডাল বলে, শিবকালীবাবু এসেছিল বড় মিস্ত্রির কাছে, বলছে যে আজ থেকে আর ওভারটাইম খাটব না।

গোষ্ঠ কহে, তারপর?

না শোনে, ধর্মঘট হবে, বাউরি শালারাও রাজি হয়েছে, বলে গেল।

আবার ছোঁড়াটা আসে, বলে, সব ঠিক, সবাই রাজি হয়েছে। আর আজ রাত্তিরে বটগাছতলায় সভা হবে, বলে দিলে; সব বলে এলাম।

সবারই বুকে যেন একটা আনন্দ জাগিয়া ওঠে।

দুনিয়াতে বড় কাজের একটা আনন্দ আছে; শক্তিরও একটা আনন্দ আছে।

আজ পরস্পরের পানে তাকাইয়া উহারা মিষ্ট হাসি হাসে।

অতীতের ছোটখাটো মনোমালিন্যের কথা মনে পড়ে না।

বেলা বারটায় আবার সিটি বাজে; টিফিনের ছুটি। সব দলে দলে বাড়িপানে চলে, মৃদু। গুঞ্জনে সবাই আজ ওই কথাই বলে।

গোষ্ঠ চলে সবার শেষে; ফায়ারম্যানদের তাই নিয়ম। ওদিকে অগ্নিগর্ভ বয়লারটা শুধু ফোঁসায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *