০৯. মগনলালের সামনে রূপের ট্রেতে চায়ের সরঞ্জাম

‘আসেন! বসেন।’

টিভির পাশের যন্ত্রটা থেকে একটা তার চলে গেছে ভদ্রলোকের হাতে, সেটার ডগায় একটা সুইচ। ভদ্রলোক সেটা টিপতেই শব্দ সমেত রঙিন ছবি উবে গেল।

‘ওয়েল, মিঃ মিটার?’

আমরা দুটো সোফায় ভাগ করে বসেছি, আমার পাশে লালমোহনবাবু।

এতক্ষণে ভদ্রলোকের মুখটা খানিকটা স্পষ্ট। বিশেষ বদল হয়নি চেহারায়। ধুতিটা এখনও ছাড়েননি, তবে শেরওয়ানিটায় জাত কাটারের ছাপ রয়েছে, আর বোতামগুলো হিরের হলেও হতে পারে। সবচেয়ে বদল হয়েছে পরিবেশে; বেনারসের গলির বাড়ির গদি, আর ফাইভ-স্টার হোটেলের রয়েল সুইটে আকাশ পাতাল তফাত।

‘এবার রিয়েল হলিডে তো?’

‘তার কি আর জো আছে,’ একপেশে হাসি হেসে বলল ফেলুদা। ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে, জানেন তো?’

‘এখানে কী ধান ভানবেন আপনি মিঃ মিত্তর?’

মগনলালের সামনে রূপোর ট্রেতে চায়ের সরঞ্জাম। কাপে শেষ চুমুক দিয়ে সেটা নামিয়ে রেখে পাশের টেবিল থেকে ফোনটা তুলে নিলেন।

‘টি অর কফি? বেস্ট দার্জিলিং টি পাবেন এই হোটেলে।’

‘চা-ই হোক।’

রুম সার্ভিস ডায়াল করে তিনটে চায়ের অর্ডার দিয়ে ফোন রেখে আবার ফেলুদার দিকে চাইলেন মগনলাল।

‘ইন্ডিয়াতে আপনি হিরো—বিগ ডিটেকটিভ। কাঠমাণ্ডু ইজ ফরেন কান্ট্রি মিঃ মিত্তর। এখানে জান-পেহ্‌চান আছে কি আপনার?’

‘এই তো একজন পুরনো আলাপী বেরিয়ে গেল!’

মগনলাল হালকা হাসি হাসলেন। দু’জনের দৃষ্টি পরস্পরের দিক থেকে সরছে না।

‘আপনি কি সারপ্রাইজড্ হলেন আমাকে দেখে?’

‘তা একটু হয়েছি বইকী!’ একটা চারমিনার ধরিয়ে দুটো রিং ছেড়ে জবাব দিল ফেলুদা। ‘আপনি হাজতের বাইরে দেখে নয়; ওটা আপনার কাছে কিছুই না। অবাক হচ্ছি আপনার কর্মক্ষেত্র বদলেছে দেখে।’

‘হোয়াই? বনারস হোলি প্লেস, কাঠমাণ্ডুভী হোলি প্লেস। ওখানে বিশ্বনাথজি, ইখানে পস্‌পতিনাথজি। একই বেপার, মিঃ মিত্তর। যেখানে ধরম, সেখানেই আমার করম। কী বলেন, আঙ্কল?’

‘হেঁঃ হেঁঃ।’

বুঝলাম হাসি ফুটলেও, কথা ফোটার অবস্থা এখনও হয়নি জটায়ুর।

‘করমের কথা যে বলছেন, সেটা কি ওষুধ সংক্রান্ত কোনও কাজ?’

আমার শিরদাঁড়ায় একটা শিহরন খেলে গেল। বাঘের সামনে পড়ে ধরনের বেতোয়াক্কা ব্যবহার একমাত্র ফেলুদার পক্ষেই সম্ভব।

‘ওসূদ? মগনলাল যেন আকাশ থেকে পড়লেন। ‘হোয়াট ওসূদ মিঃ মিত্তর? সূদের কারবার আমার একটা আছে ঠিকই, লেকিন ওসূদকা কেয়া মতলব?’

‘তা হলে আপনি এখানে কী করছেন সেটা জানতে পারি কি?’

‘সার্টেনলি! লেকিন ফেয়ার এক্সচেঞ্জ হোনা চাই।’

‘বেশ। আপনি বলুন। আমিও বলব।’

‘আমার বেপার ভেরি সিম্পল মিঃ মিত্তর। আমি আর্টের কারবারি সেটা তো আপনি জানেন, আর নেপালে যে আর্টের ডিপো, সেটাও আপনি নিশ্চয়ই জানেন।’

ফেলুদা চুপ। লালমোহনবাবু দ্রুত নিশ্বাস ফেলছেন।

‘এবার আপনার বেপার বলুন। ফেয়ার এক্সচেঞ্জ।’

‘আপনি সব কথা খুলে বলেছেন বলে মনে হয় না,’ বলল ফেলুদা, ‘তবে আমার কথা আমি খুলেই বলছি। আমি এসেছি একটা খুনের তদন্ত করতে।’

‘খুন?’

‘খুন।’

‘ইউ মিন দ্য মার্ডার অফ মিঃ সোম?’

আমি থ। ফেলুদাও থ কি না বোঝার উপায় নেই। লালমোহনবাবু শীত লাগার ভাব করে দাঁতে দাঁত চাপলেন সেটা লক্ষ করলাম। হোটেলের ভিতরের টেমপারেচারটা এমনিতেই একটু কমের দিকে। ক্যাসিনোতে লোকের ভিড়ের জন্য বলে বোধহয় ঠাণ্ডা লাগেনি।

‘আপনি ঠিকই ধরেছেন মগনলালজি,’ বলল ফেলুদা, ‘মিস্টার অনীকেন্দ্র সোম।’

চা এল। মগনলালের আদেশে নতুন ট্রে থেকে শুধু তিনটে কাপ-ডিশ আর টি-পট রেখে পুরনোটা থেকে টি-পট আর মগনলালের ব্যবহার করা পৈয়ালাটা তুলে নিয়ে চলে গেল বেয়ারা।

‘আমার বিশ্বাস,’ ফেলুদা বলে চলল, ‘সোম ভদ্রলোকটি এখানকার কোনও ব্যক্তির কিছুটা অসুবিধার সৃষ্টি করেছিল। তাই তাকে খতম করে ফেলা হল।’

মগনলাল চা ঢালছেন আমাদের জন্য।

‘ওয়ান? টু?’

মগনলালের হাতে চিনির পাত্র। কিউব শুগার।

‘ওয়ান,’ আমি বললাম, কারণ প্রশ্নটা আমাকেই করা হয়েছিল।

‘ওয়ান?’

এবার জটায়ুকে প্রশ্ন। আমি জানি জটায়ুর মাথায় এল এস ডি ঘুরছে, আর ঘুরছে সেই লোকটার কথা, যে সিঁড়ি নামছে ভেবে সাত তলার ছাতের কার্নিশ থেকে পা বাড়িয়ে দিয়েছিল।

‘টু? থ্রি?’

‘নো, নো।’

‘নো শুগার?’

‘নো।’

লালমোহনবাবু মিষ্টির ভক্ত, চায়ের দু’ চামচের কম চিনি হলে চলে না, তাও নো বলছেন।

‘ই কেমন কথা হল মোহনবাবু? আপনার রসগুল্লা খাওয়া চেহারা, শুগারে নো করছেন কেন?’

আমি নিয়েছি বলেই বোধহয় ভদ্রলোক শেষ পর্যন্ত সাহস পেলেন।

‘ও-কে। ওয়ান।’

ফেলুদারও একটা। উঠে গিয়ে যে যার চা নিয়ে এসে আবার বসলাম।

ফেলুদা চায়ের কাপটা পাশের টেবিলে রেখে আগের কথার জের টেনে বলল—

‘আমার বিশ্বাস মিঃ সোম জানতে পেরেছিলেন যে এখানে একটা গর্হিত কারবার চলেছে। সে ব্যাপারে তিনি কলকাতা গিয়েছিলেন। একটা উদ্দেশ্য ছিল আমার সঙ্গে দেখা করা। তার আগেই তাকে খুন করা হয়। আপনি যখন খুনের ব্যাপারটা জানেন, তখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে আপনি এ ব্যাপারে জড়িত কি না।’

মগনলাল ভাসা ভাসা চোখে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি নিয়ে কিছুক্ষণ ফেলুদার দিকে চেয়ে রইলেন। আমাদের হাতে ধরা পেয়ালা থেকে ভুরভুর করে হাই ক্লাস চায়ের গন্ধ বেরোচ্ছে; আমি আর লালমোহনবাবু এই অবস্থাতেই চুমুক না দিয়ে পারলাম না।

‘জগ্‌দীশ!’

মগনলাল হঠাৎ হাঁকটা দেওয়াতে চমকে উঠেছিলাম। বসবার ঘরের দু’ দিকেই যে আরও ঘর আছে সেটা এসেই বুঝেছিলাম। এবার মগনলালের পিছনের একটা দরজা খুলে একজন লোক এসে আমাদের ঘরে ঢুকল। সঙ্গে সঙ্গে ‘কিড়িং’ করে যে শব্দটা হল সেটা লালমোহনবাবুর হাতের পেয়ালা কেঁপে গিয়ে পিরিচের সঙ্গে লাগার শব্দ।

জগদীশ নামে যে ভদ্রলোকটি মগনলালের পিছনে এসে দাঁড়ালেন, তিনি হলেন বাটরা নাম্বার টু। কাছ থেকে দেখে বাটরার সঙ্গে সামন্য তফাতটা বুঝতে পারছি। এনার চোখ একটু কটা, কানের দু’ পাশের চুলে সামান্য পাক ধরেছে, হয়তো শরীরে মাংসও কিছুটা বেশি। আরেকটা বড় তফাত হল, এর চাহনিতে মিশুকে ভাবটা নেই।

‘ইনাকে চিনেন?’ প্রশ্ন করলেন মগনলাল।

‘আলাপ হয়নি। দেখেছি,’ বলল ফেলুদা।

‘তবে শুনে রাখুন গোয়েন্দা বাহাদুর। ইনাকে হ্যারাস করবেন না। আমি জানি আপনারা ইনার পিছ্‌নে লেগেছেন। উয়ো আমি বরদাস্ত করব না। জগ্‌দীশ ইজ মাই রাইট হ্যান্ড ম্যান।’

‘যদিও উনি নিজে যা করেন তা বাঁ হাতেই করেন।’

বলিহারি ফেলুদা। এখনো নার্ভ স্টেডি, গলার স্বর একটুও কাঁপছে না।

মগনলাল আর কিছু বলার আগে ফেলুদা একটা প্রশ্ন করল।

‘ওনার চেহারার সঙ্গে প্রায় হুবহু মিলে যায়, এমন একজন লোক কাঠমাণ্ডুতে আছে সেটা আপনি জানেন কি?’

মগনলালের মুখ আরও থমথমে হয়ে উঠল।

‘ইয়েস মিঃ মিত্তর। আই নো দ্যাট। সে তোক যদি আপনার দোস্ত্ হয় তা হলে টেল হিম টু বি ভেরি কেয়ারফুল। সে যেন বুঝে-সুঝে কাম করে। আপনি তো আজ পস্‌পতিনাথজির শ্মশান দেখে এসেছেন, মোহনবাবু?’

লালমোহনবাবু প্রচণ্ড মনের জোরে মগনলালের কথা যেন শুনতে পাননি এমন ভাবে করে বাকি চা-টা ঢক করে খেয়ে পেয়ালাটা ঠং শব্দে পাশের টেবিলে রেখে দিলেন।

মগনলালের দৃষ্টি আবার ফেলুদার দিকে ঘুরল।

‘বাটরা যদি মনে করে সে তার নিজের গলতি কাম জগ্‌দীশের কান্‌ধে ডালবে, তবে তাকে বলে দিবেন, মিঃ মিত্তর, কি ওই শ্মশানে তার ডেডবডির সৎকার হবে উইদিন টু ডেজ।’

‘নিশ্চয়ই বলব।’

ফেলুদাও তার চা শেষ করে কাপটা হাত থেকে নামিয়ে রাখল।

মগনলালের কথা শেষ হয়নি এখনও।

‘আরও একটা কথা বলে দিই মিঃ মিত্তর। আপনি দাওয়াইয়ের কথা বলছিলেন। আপনি জানেন আমাদের দেশের মানুষের সব্‌সে বড়া দুষমন কে? অ্যালোপ্যাথ ডকটরস্! মাইসিন জানেন তো? সিন মানে কী? সিন মানে পাপ! পাকিট ফেঁড়ে পয়সা নেবে, হাথ ফেঁড়ে ব্লাড় নেবে, পেট ফেঁড়ে পিঠ ফেঁড়ে বুক ফেঁড়ে এটা নেবে সেটা নেবে। ওয়র্স দ্যান এনি স্মাগলিং র‍্যাকেট। পেনিসিলিনসে পসপতিনাথের চরণামৃত ইজ হান্ড্রেড টাইমস বেটার! দেশের লোক যদি অ্যালোপ্যাথি ছেড়ে দুস্‌রা দাওয়াই খাবে তো আখেরে দেশের মঙ্গল হবে—এ আপনি জেনে রাখবেন!’

‘শুনলাম আপনার কথা’—ফেলুদা উঠে দাঁড়িয়েছে,—‘কিন্তু আপনি দেখছি নিজে এখনও অ্যালোপ্যাথি ছাড়তে পারেননি। আপনার টেলিফোনের পাশে রাখা ওই শিশিটা নিশ্চয়ই চরণামৃতের শিশি নয়!’

শিশিটা এমনভাবে আড়ালে রয়েছে যে প্রায় চোখেই পড়ে না।

কথাটা যে মগনলালের মোটেই পছন্দ হল না সেটা তার মুখের উপর ঝোড়ো ভাবটা নেমে আসা থেকেই বুলেছি।

‘আসি, মগনলালজি। চা-টা সত্যিই ভাল ছিল।’

মগনলাল তার জায়গা থেকে নড়লেন না।

যখন চারশো তেত্রিশ নম্বর সুইট থেকে বেরোচ্ছি, তখন একটা সুইচের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে শুনলাম মার্কিন ছবির সংলাপ আবার শুরু হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *