০৯. বৃষ্টি হচ্ছে সকাল থেকে

বৃষ্টি হচ্ছে সকাল থেকে।

আতাহারের হাতে ছাতা। লাল-নীল ফুল আঁকা বাহারি ছাতা। মিলির কাছ থেকে নেয়া। মিলি বিশ্চিমত গলায় বলেছে, মেয়েদের ছাতা নিয়ে রাস্তায় হাঁটতে পারবি?

হাতে হাঁটতে অসুবিধা কি। বৃষ্টি নামবে কি না সেটাই হল বিবেচ্য।

হারাবি না ভাইয়া।

না, হারাবো না।

মেয়েদের রঙিন ছাতা মাথায় দিয়ে ইটো শুরুতে যতটা বিপদ্জনক মনে হয়েছিল রাস্তায় বের হয়ে ততটা বিপজ্জনক মনে হল না। কেউ তার দিকে তাকাচ্ছে না। যারা তাকাচ্ছে তারা অবাক বা বিস্মিত হচ্ছে না। ঢাকা শহরের চরিত্রে গুণগত একটা পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয়। শহরের মানুষরা অন্যের ব্যাপারে মাথা ঘামাচ্ছে না। যার যে ভাবে ইচ্ছা চলবে। তাতে কিছুই যায় আসে না।

আতাহারের প্যান্টের পকেটে রবার্ট ফ্রস্টের চারটি কবিতার অনুবাদ। অনুবাদগুলি সাজ্জাদের করা। অফিসে বসে তার প্রধান কাজ হচ্ছে কবিতা অনুবাদ করা। আতাহারের দায়িত্ব পড়েছে চারটা মূল কবিতা অনুবাদসহ গনি সাহেবের কাছে পৌঁছে দেয়। আতাহার খালি হাতে যাচ্ছে না। কবিতার সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে কনিয়াকের একশ মিলিলিটারের একটা বোতল। সাজ্জাদ গিনি সাহেবের কাছে শুধু কবিতা কখনো পাঠায় না।

রবট ফ্রস্টের কবিত্তার অনুবাদ কেন বাংলা ভাষায় হওয়া উচিত সেই বিষয়ে গনি সাহেবকে কিভাবে বলতে হবে সাজ্জাদ তাও শিখিয়ে দিয়েছে। সাজ্জাদ বলেছে, আতাহার, তুই গম্ভীর গলায় বলবি, কবি রবার্ট ফস্ট খুব ইন্টারেস্টিং একটা দিনে জন্মেছেন–২৬শে মার্চ। আমাদের স্বাধীনতা দিবস। তাঁর প্রথম দুটি কবিতার বই কিন্তু নিজ দেশে প্রকাশিত হয়নি–প্রকাশিত হয়েছে ইংল্যান্ডে। এই কবি চারবার পুলিৎজার প্রাইজ পেয়েছেন। এবং তিনি ছিলেন চাষা-কবি। যিনি নগরজীবন পরিত্যাগ করে আক্ষরিক অর্থেই চাষাবাদ করে জীবন কাটাতে চেয়েছেন। খুব গুছিয়ে বলবি। পারব না?

পাবার তো কথা।

গনি সাহেব চাইলে আমি কবিতার সঙ্গে ছোট্ট করে রবার্ট ফ্রস্টের জীবনীও লিখে দিতে পারি।

তোর মাথায় কি এখন রবার্ট ফ্রস্ট ভর করেছে?

সাজ্জাদ গম্ভীর গলায় বলেছে, আমার মাথায় কিছুই ভর করে না। আমি মাঝে মাঝে অন্যের উপর ভর করি। এই মূহুতে সিন্দাবাদের বুড়ের মতো ফ্রস্টের কাধে ভর করেছি। এবং মনে হচ্ছে উনি পঁচিশ ক্যারেট গোল্ডের কবি। পৃথিবীর বেশিরভাগ কবিই আঠারো ক্যারেটের। খাদ বেশি। পঁচিশ ক্যারেট কবির সংখ্যা কম।

শামসুর রাহমান, উনি কত ক্যারেটের?

উনারটা এখনো হিসেব করি নি।

বাংলা কবিদের ভেতর পঁচিশ ক্যারেটের কারা আছে?

অনেকেই আছে। জীবনানন্দ দাশ আছে।

আমি কত ক্যারেটের?

তুই হচ্ছিস ব্রোঞ্জ-কবি। তোর মধ্যে সোনা নেই, পুরোটাই ব্রোঞ্জ।

আতাহারের একটু মন খারাপ হল। মন খারাপ ভাবটাকে তেমন পাত্তা দিল না।

 

সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। গনি সাহেবের বাসার সামনে হাঁটুপানি থাকার কথা। অদ্ভুত কোন কারণে বাসার সামনেটা খটখোট শুকনা। ড়েনেজ, সিস্টেমে রাতারাতি কোন বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয়। গনি সাহেবের বাসার গেটে খাকি পোশাক পরা শুকনা লম্বা এক লোক। মাথায় সবুজ টুপি, পায়ে বুট। প্রথম দৰ্শনে মনে হয় পুলিশ বা আনসার বাহিনীর কেউ। ভাল করে তাকালে সেই ভুল ভেঙে যায়। সিকিউরিটির লোক। কঁধে পেতলের ছাচে লেখা–সিকিউরিটি গার্ড।

কার কাছে যাইবেন?

গনি সাহেবের কাছে।

খাতায় নাম, ঠিকানা, টেলিফোন নামার লেখেন। তারপর যান।

ব্যাপারটা কি?

সিকিউরিটি গার্ড ব্যাপার কি সেই ব্যাখ্যায় গেল না। খাতা এবং বল পয়েন্ট কলম বের করে দিল। খাকি পোশাক মানুষের চরিত্র হনন করে। খাকি পোশাক পরলেই লোকজন কম কথা বলে। নাম-ঠিকানা লিখতে লিখতে আতাহারের মনে হল, হোসেন সাহেবকে একটা খাকি পোশাক পরিয়ে দিতে পারলে ভাল হত। উনার কথা বলা রোগ সেরে যেত।

 

গনি সাহেব দরজা খুলে অপ্রসন্ন দৃষ্টিতে আতাহারের দিকে তাকালেন। আতাহার বলল, আপনার বাসায় মিলিটারী পাহারা বসিয়েছেন, ব্যাপার কি?

গনি সাহেব চোখ সরু করে বললেন, ব্যাপার কি তুমি জান না?

জ্বি-না।

পুরো ঢাকা শহরের সবাই জানে আর তুমি জান না?

জ্বি না–আমি জানি না।

ভেতরে এসে বোস। বলছি। লম্বা ইতিহাস।

সাজ্জাদ আপনার জন্যে এক বোতল কনিয়াক পাঠিয়েছে।

গুড। বর্ষার স্যাতস্যাতে আবহাওয়ায় আমার হাঁপানির মত হয়েছে। কনিয়াকটা কাজে লাগবে। কনিয়াক ইস্পানির ভাল মেডিসিন। ও আছে কেমন?

জ্বি, ভাল আছে।

অনেকদিন ওকে দেখি না। একদিন নিয়ে এসো। খুবই ফোর্সফুল ছেলে। প্রাণশক্তিতে ভরপুর। কবিতায় লেগে থাকলে ওর হবে। কবিতায় সে কিছু কিছু ইমেজারি এমন ব্যবহার করে যে মুগ্ধ হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। তুমি চা খাবে আতাহার?

জ্বি-না।

খাও এক কাপ চা। চা খেতে খেতে শোনা বাড়িতে কেন সিকিউরিটি গাড় রেখেছি। শুনে যাও, কিন্তু কারো সঙ্গে ডিসকাস করবে না। আমি চাই না। এই কদর্য ব্যাপার লোকজন জানুক। অবশ্যি সবাই জেনে গেছে। খুব কম লোকই আছে যে জানে না।

ব্যাপারটা কি?

গনি সাহেব সিগারেট ধরিয়ে ঘটনা বলতে শুরু করলেন। তার চোখে-মুখে হতাশ ভাব ফুটে উঠল–

গত বন্ধুবারের আগের বুধবারের ঘটনা। তুমি তো জান আমি আলি রাইজার। যত রাত জেগেই পড়াশোনা করি না কেন–সূর্য ওঠার আগে ঘুম থেকে উঠি। হাত-মুখ ধুয়ে দুধ-চিনি ছাড়া এক কাপ চা খেয়ে মনিং ওয়াকে বের হই। সেদিনও তাই করব বলে সদর খুলেছি–দেখি বারান্দা ভর্তি পুরীষ। বিকট গন্ধ আসছে।

পুরীষটা কী?

পুরষ জান না? বাংলা ভাষায় তোমাদের দখল এত কম? আশ্চর্য! পুরীষ হল বিষ্টা। গ্রাম্য ভাষায় গু। মানুষের গু।

আতাহার হতভম্ব গলায় বলল, বারান্দা ভর্তি পু্রীষ?

হ্যাঁ, মনে হচ্ছে দুই-তিন টন পুরীষ রাতে এসে ঢেলে রেখে গেছে।

সে কি?’

শত্রুতা করে কেউ করিয়েছে।

আপনার সঙ্গে কার এমন শত্রুতা থাকবে?

সেটাই তো বুঝছি না। আমি নিবিরোধী মানুষ। লেখাপড়া নিয়ে থাকি। কেউ বলতে পারবে না। আমি কারো সঙ্গে উঁচু গলায় কথা বলেছি।

তা তো বটেই।

সারাদিন লাগল আমার এই নোংরা পরিস্কার করাতে। তিনজন মেথর লেগেছে। ডেটল দিয়ে ধুইয়েছি, ফিনাইল দিয়ে ধুইয়েছি। তারপরেও গন্ধ যায় না।

খুবই যন্ত্রণা হয়েছে তো।

যন্ত্রণা তো বটেই। যন্ত্রণার চেয়ে বেশি হল হিউমিলিয়েশন। প্রতিবেশীরা সবাই আমার দিকে বিশেষ দৃষ্টিতে তাকায়। শুকনা মুখে জিজ্ঞেস করে, ব্যাপারটা কি? কিন্তু তাদের ঠোঁটের কোণার কাছে হাসি।

এটা তো হাসির কোন ব্যাপার না।

হাসির ব্যাপার নয় তো বটেই। কিন্তু মানুষের হাসি তো তুমি বন্ধ করতে পারবে না। আমি থানায় জ্বি ডি এন্টি করাতে গোলাম, ঘটনা শুনে রমনা থানার ওসি দেখি ভ্যাক ভ্যাক করে হাসে। যাই হোক, ঘটনার এইখানে সমাপ্তি হলে একটা কথা ছিল–তা না, পরের বুধবারে আবার এই ঘটনা।

বলেন কি?

আমার স্ত্রী তো কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন। তিনি এখানে থাকবেন না। ফ্ল্যাট ভাড়া করে সাত-আট তলার দিকে থাকবেন।

আমার তো মনে হচ্ছে সেটাই করতে হবে।

তুমি কি পাগল হলে? গুণ্ডমি-বদমায়েশীর কাছে নতি স্বীকার করব? ক্যান আই ড়ু দ্যাটা? আমি তো বদমায়েশীর মূল টান দিয়ে বের করব। চব্বিশ ঘণ্টার জন্য সিকিউরিটি গার্ড রেখেছি। জলের মত পয়সা খরচ হচ্ছে। হোক। আমি ছাড়ব না। আমি সিআইডি দিয়ে ইনভেস্টিগেট করাব।

করা তো উচিত।

ওরা ঘুঘু দেখেছে, ফাঁদ দেখেনি। আমি নিবিরোধী লোক–এটা ঠিক আছে। তাই বলে আমাকে নিবিষ, ঢোরাসাপ মনে করার কোন কারণ নেই।

ঘটনা শুনে আতাহারের আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল। কি সর্বনাশের কথা! সাজ্জাদ যে সত্যি সত্যি গু-চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে তা তো বলেনি। এই সব ব্যাপার চাপা থাকে না। ঘটনা প্রকাশ হয়ে পড়বে। তার ফলাফল খুব শুভ হবার কথা না।

গনি ভাই, উঠি।

উঠবে? আচ্ছা যাও। মন খুলে যে সাহিত্য-টাহিত্য নিয়ে আলাপ করব সে উপায় নেই। মনটা ঐ ঘটনার পর থেকে বিক্ষিপ্ত। যাই হোক, সাজ্জাদকে একদিন নিয়ে এসো। ও যেনো তার রিসেন্ট কিছু কবিতা নিয়ে আসে।

কয়েকটা অনুবাদ অবশ্য সে আমার সঙ্গে দিয়ে দিয়েছে। রবার্ট ফ্রস্টের অনুবাদ।

ভেরী গুড। রেখে যাও। মেজর পয়েটদের কবিতা অনুবাদ করলে হাত খুলে। রবট ফ্রস্ট অবশ্যি মেজর পয়েটদের মধ্যে পড়ে না। তার কবিতায় কথকতার একটা ঢং আছে। পড়তে আরাম, এহছুকহ। টেলিফোনের উপর তাঁর একটা কবিতা আছে। তুমি জান?

জ্বি–না।

একজন প্রধান কবি টেলিফোন নামক যন্ত্র নিয়ে কবিতা লিখছেন, এটাকে তুমি কিভাবে দেখবো?

কি লিখেছেন সেটা না জানলে বলা মুশকিল।

গনি সাহেব তৎক্ষণাৎ পুরো কবিতা আবৃত্তি করে শোনালেন। এই প্রথমবারের মত আতাহারের মনে হল, এই লোকের পড়াশোনা আসলেই ব্যাপক।

When I was just as far as I could walk
From here to-day.
There was an hour
All still
When leaning with my head against a flower
I heard you talk.
Don’t say I didnt, for I heard you say–
Do you remember what it was you said?
First tell me what it was you thought you heard.

আতাহার বলল, গনি ভাই, কবিতাটা কেমন?

গনি সাহেব বললেন, অসাধারণ।

আপনি বলেছিলেন উনি একজন মাইনর কবি।

মাইনর কবি তো বটেই। মাইনর কবিরাও মাঝে মাঝে দু-একটা মেজর কবিতা লিখে ফেলে।

গনি সাহেব, আতাহারকে গোট পর্যন্ত আগিয়ে দিলেন। কেন দিলেন আতাহার জানে না। গোটে দাঁড়িয়ে থাকা সিকিউরিটি গার্ড বুট প্রচণ্ড শব্দ করে স্যালুট দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *