৯ বিলু আপার জন্যে তেলইর পানি
বিলু আপা, আর পুষু আপা পারুল আপা, দিন দিন ক্লান্ত হয়ে উঠছে, আগের মতোই খিলখিল ফিসফিস করে তারা, তবে রাশেদের মনে হয় তাদের খিলখিল হাসিতে ক্লান্তি ধরেছে, ফিসফিস কথায় বিষণ্ণতা লেগেছে, শাড়ির পাড়ে বিষণ্ণ ক্লান্তি ভারি হয়ে ঝুলে আছে। তারা খিলখিল করার থেকে এখন ফিসফিসই করে বেশি, তাদের সব কথাই গোপন হয়ে উঠছে, একদিন হয়তো ফিসফিসটুকুও করবে না তারা, একেবারে স্তব্ধ হয়ে যাবে। গ্রামে কোনো মেয়ের বিয়ে হলেই তারা আরেকটুকু ক্লান্ত হয়ে পড়ে; কোনো মেয়ের বিয়ের কথা হচ্ছে শুনলে খুব বিব্রত হয়ে পড়ে তারা, মুখ তুলে তাকায় না, মাটির দিকে চেয়ে থাকে, একটা দীর্ঘশ্বাস কোমলভাবে চেপে ফেলে। বিলু আপা যে কতো দীর্ঘশ্বাস চেপেছে তার হিশেব নেই কোনো, অথচ রাশেদ আজো একটাও দীর্ঘশ্বাস ফেলে নি, চাপার কথাই ওঠে না; রাশেদ জানেই না কোথা থেকে কতো গভীর থেকে উঠে আসে দীর্ঘশ্বাসগুলো, আর কতোটা ঠাণ্ডা আর ভারি করে তোলে বুক। এগুলো যে খুব ঠাণ্ডা, বরফের থেকেও, তা বুঝতে পারে রাশেদ বিলু আপার মুখের দিকে চেয়ে। বাড়িতে যেই আসে সে-ই দু-এক কথার পরই তোলে বিলু আপার বিয়ের কথা, বিলু আপার এখনো যে বিয়ে হয় নি তাতে খুব অবাক হয়; শুনে মা এলোমেলো। কথা বলে, বিলু আপাকে আর ধারেকাছেই পাওয়া যায় না। রাশেদেরও খুব খারাপ লাগে এসব কথা শুনলে, সে একবার এক বুড়িকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়েছিলো;–বুড়ি এসেই ঘরের দরোজায় পিড়িতে বসে মাকে বলে যে মেয়েটাকে বিয়ে দেয়া হচ্ছে না কেননা, বিয়ে হলে তিন পোলার মা হতে পারতো, সে নিজে এ-বয়সে তিনটা পোলা বিহয়েছিলো। সে জানতে চায় মেয়েটাকে ঘরের থাম করে রাখার ইচ্ছে আছে কিনা। রাশেদের মার সম্পর্কে শাশুড়ি হয় বুড়িটা, তাই মা কিছু বলতে পারছিলো না, শুধু একটা জামাই দেখার কথা বলছিলো, বলতে গিয়ে মার কণ্ঠ ভারি হয়ে উঠছিলো; কিন্তু রাশেদ সহ্য করতে পারে নি, সে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়েছিলো বুড়িকে; বলেছিলো, এসব বলার জন্যে আপনি আমাদের বাড়ি আসবেন না। বিলু আপা তাতে সুখী হয়েছিলো মনে হয়, রাশেদকে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে ছিলো আমগাছের পাশে, বলেছিলো রাশেদ খুব ভালো, তবে ওই বুড়িটুড়ির মতো মানুষের সাথে ঝগড়া করার। দরকার নেই। মেয়েদের এসব কথা চিরকালই শুনতে হয়, মেয়েদের অপরাধের কোনো শেষ নেই। বিলু আপার যে বিয়ে হচ্ছে না এটা তো ভালোই লাগে রাশেদের; আর আজিজের কাছে ওইসব শোনার পর থেকে রাশেদের ইচ্ছে হয় বিলু আপার যেনো কোনো দিন বিয়ে না হয়। বিলু আপা একটা অচেনা লোকের সাথে শোবে এটা ভাবতে তার শরীর ঘিনঘিন করে ওঠে, প্রথম যখন আজিজের কাছে শুনেছিলো তখন খুব বেশি ঘেন্না লেগেছিলো; এখন ঘেন্নাটা কমে এসেছে, বিয়ে হয়ে গেলে সে কষ্ট পাবে, কিন্তু। কষ্টটা সহ্য করতে পারবে, তবে বিয়ে যে হচ্ছে না এটা বেশ লাগছে তার। বিলু আপার ক্লান্তি আর বিষণ্ণতা রাশেদকে খুব কষ্ট দেয়, ভাত খেতে বসে তার মনে হয় বিলু আপার মাজা পেতলের থালাটি ভরে ক্লান্তির ছাপ লেগে আছে, সে বিলু আপার আঙুল দিয়ে মেখে দেয়া বিষণ্ণ ক্লান্তির ওপর ভাত মাছ দুধ রেখে খাচ্ছে। সে বিলু আপার ক্লান্তি খাচ্ছে বিষণ্ণতা পান করছে।
বিলু আপা কি দেখতে খারাপ? রাশেদের তো তা মনে হয় না, বিলু আপাকে রাশেদের মনে হয় সবচেয়ে সুন্দর, অমন সুন্দর সে বেশি দেখে নি, কুমড়োডগার মতো। সুন্দর বিলু আপা। তার গায়ের রঙের কথা ওঠে, রঙটা ফরশা নয় বলে অনেকেই সুন্দরী মনে করে না তাকে; গাল ভাঙা নাক বাঁকা ঠোঁট উল্টোনো মেয়েদেরও সবাই মনে করে সুন্দরী গায়ের রঙ ফরশা হলে, কিন্তু বিলু আপা এতো সুন্দর তবু তাকে সুন্দরী মনে। করে না লোকেরা রঙটা ফরশা নয় বলে। ফরশাই কি সুন্দর? পাশের বাড়ির বউটি দেখতে বাঁশপাতার মতো, গালে একটা দাগ, কিন্তু রঙটা ফরশা, তাই সবাই তাকে সুন্দরী বলে, আর সেও গর্ব করে; রাশেদ তার দিকে তাকাতেই পারে না, মনে হয় একটি শাদাপেত্নী দেখছি। অনেক মাস কোনো প্রস্তাব আসে নি বিলু আপার জন্যে, বছরখানেক আগে একটি এসেছিলো, রাশেদই বাতিল করে দিয়েছিলো সেটা। একটি প্রস্তাব এসেছিলো অনেক দূরের গ্রাম থেকে, রাশেদকে তারা নিয়ে গিয়েছিলো বাড়িঘর দেখাতে, রাশেদ বাড়িঘর আর লোকটিকে দেখে এসে বিয়েতে মত দেয় নি। তার। কিছুই পছন্দ হয় নি, লোকটিকে পছন্দ হয় নি একেবারেই। রাশেদ মাঝেমাঝে ভাবে লোকটি কি খুব খারাপ ছিলো? কখনো তার মনে হয় খুব খারাপ ছিলো না, আবার মনে হয় খুব খারাপ ছিলো, ওই লোকটি বিলু আপার পাশে ঘুমোবে এটা ভাবতে তার ঘেন্না। লেগেছিলো। লোকটি রাশেদকে খুব আদর করেছিলো, বাজারে নিয়ে মিষ্টি খাইয়েছিলো, নতুন শার্ট বানিয়ে দেবে বলে দর্জির দোকানে নিয়ে গিয়েছিলো, দর্জিটা খুব সুন্দর একটা কাপড় বের করেছিলো, কিন্তু রাশেদ রাজি হয় নি মাপ দিতে; তাদের বাড়িতে দু-তিন দিন থাকার জন্যে রাশেদকে বারবার অনুরোধ করেছিলো, রাশেদ থাকে নি। রাশেদ রাজি হলে বিলু আপার বিয়ে হয়ে যেতো এতোদিনে, তাহলে তার ক্লান্তি থাকতো না বিষণ্ণতা থাকতো না। রাশেদের মনে হচ্ছে একটা অপরাধ করে ফেলেছে সে, আবার মনে হচ্ছে না ওই লোকটির সাথে বিয়ে হতে পারে না বিলু আপার। বিলু আপা কি মনে মনে রাশেদকে দোষ দেয়? না, বিলু আপা রাশেদকে দোষ দিতে পারে না, বিলু আপা তো তাকে বলেছে সে পছন্দ না করলে বিলু আপাও পছন্দ করবে না, রাশেদ পছন্দ করলেই তার পছন্দ হবে। বিলু আপা নিজের পছন্দ মতো কিছুই করে না, মার আর বাবার পছন্দ মতো করে, এমনকি রাশেদের পছন্দ মতো করে। তার কি পছন্দ নেই? বিলু আপা বলে মেয়েদের আবার পছন্দ কি? বিলু আপা চার বছরের বড়ো। রাশেদের থেকে, কিন্তু রাশেদের মনে হচ্ছে বিলু আপা রাশেদের থেকে ছোটো হয়ে যাচ্ছে দিন দিন; আগে বিলু আপার কথা মতো চলতো রাশেদ, এখনো বিলু আপা ‘চলতে চায় রাশেদের কথা মতো; সব কিছুতেই বলে, তুই বল। রাশেদ যা বলে তাই নাহয়, তাই করে বিলু আপা, রাশেদকে কিছু করতে আর বলে না।
পুব পাড়ার মরির বিয়ে হতে যাচ্ছে, সংবাদটি রাশেদ জানতো না, জানার কথা নয়; খুব গরিব ওরা, ওদের বাড়িতে রাশেদ কখনো যায় নি, মেয়েটির নামও শোনে নি, এই প্রথম শুনলো। রান্নাঘরের উত্তর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো রাশেদ, শুনতে পেলো বড়ো আম্মা মাকে বলছে পুব পাড়ার মরির বিয়ে হবে তিন চার দিনের মধ্যে; তবে মাকে একটি সংবাদ দেয়ার জন্যেই সে কথাটি বলছে না, বলার পেছনে লুকিয়ে আছে একটি উদ্দেশ্য, যা তার গলার স্বরে ধরা পড়ছে। সে বুড়ো মানুষ, তার কেউ নেই; সে থাকে রাশেদদের সাথেই, তারা তাকে বড়ো আত্মা বলে, সারা গ্রাম ভরে সে ঘোরে, যা পায় তাই নিয়ে। আসে, ভীষণ আদর করে রাশেদ আর তার ভাইবোনদের। বিলু আপার বিয়ের জন্যে। তারও চিন্তার শেষ নেই। সে বলছে মরির বিয়ে হবে, মরির তেলইর–গায়েহলুদের পানি চুরি করে এনে সে-পানি দিয়ে গোশল করাতে হবে বিলু আপাকে, তাহলে বিয়ের। ফুল ফুটতে দেরি হবে না। শুনে রাশেদ খুব আহত বোধ করে। কোনো মেয়ের তেলইর, পানি দিয়ে যে-মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না তাকে গোশল করালে নাকি তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়। তার, এমন কথা রাশেদ শুনেছে, কিন্তু সে কখনো ভাবতে পারে নি বিলু আপাকেও অমন পানি দিয়ে গোশল করতে হবে। বিলু আপা কি রাজি হবে মরির তেলইর পানি। দিয়ে গোশল করতে? রাশেদ যদি মেয়ে হতো, সে কি রাজি হতো অন্যের তেলইর চুরি করা পানি দিয়ে গোশল করতে? কথাটি শুনে কাঁপছে রাশেদ, আর কেমন লাগছে বিলু। আপার, সে তো রান্নাঘরেই আছে বলে মনে হচ্ছে। বিলু আপাও কি তাড়াতাড়ি বিয়ে। হওয়ার জন্যে গোশল করতে চায় মরির তেলইর পানি দিয়ে? মরি যদি খা-বাড়ির মেয়ে হতো, তাহলে না হয় কথা ছিলো; মরির বাবা কামলা খাটে, তার মেয়ের তেলইর পানি দিয়ে গোশল করতে হবে বিলু আপাকে? মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে রাশেদের মা জানতে চাইছে কীভাবে পাওয়া যাবে পানি, কে এনে দেবে, আর চুরি করে পানি আনতে গিয়ে ধরা পড়লে খুব লজ্জার কথা। বড়ো আম্মা মাকে বলছে পানি সে-ই চুরি। করে এনে দেবে, চুরি করেই এই পানি আনতে হয়, চেয়ে আনলে কাজ হয় না। ধরা পড়লে অবশ্য খুব অপমান। তেলইর দিন উঠোনে বালতি করে পানি আর তার পাশে তেল হলুদ দুর্বা কী সব দুপুর ভরে রেখে দেয়া হয়; সেখান থেকে পানি চুরি করে আনতে হয়, এনে সে-পানি দিয়ে সন্ধ্যার পরে বড়ো ঘরের পশ্চিম কোণে দাঁড় করিয়ে গোশল করাতে হয় আইবুড়ো মেয়েকে। মাকে বড়ো আম্মা কথা দিচ্ছে সে তেলইর দিন ঠিকই পানি নিয়ে আসবে, কেউ তাকে দেখতে পাবে না। রাশেদের ভয় লাগতে থাকে বড়ো আম্মা পানি চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছে, সবাই জিজ্ঞেস করছে কার জন্যে সে পানি চুরি করছে, সে বিলু আপার নাম বলছে, সবাই বিলু আপাকে আইবুড়ি বলে গাল দিচ্ছে।
রাশেদ ভেবেছিলো বিলু আপা রাজি হবে না মরির তেলইর পানি দিয়ে গোশল। করতে, তার ঘেন্না লাগবে, অপমান লাগবে। রাশেদ খুব উদ্বেগের মধ্যে থেকেছে দুটি দিন, বড়ো আত্মা যদি ধরা পড়ে, বিলু আপা যদি রাজি না হয়, তখন কেমন হবে; আর যদি বড়ো আম্মা ঠিকই পানি নিয়ে আসে, বিলু আপাও রাজি হয় ওই পানিতে গোশল করতে, তাহলেও তার রক্তে কাঁটা বিধতে থাকবে। তখন সন্ধ্যা গম্ভীর হয়েছে, রাশেদ পড়ার টেবিল থেকে শুনতে পাচ্ছে বড়ো আম্মা আর মা ডাকছে বিলু আপাকে। সন্ধ্যার পরেই রাশেদ ঘরের পশ্চিম কোণায় দেখেছে এক বালতি পানি, তার পর থেকেই তার মন অস্থির হয়ে আছে, সে পড়তে পারছে না, খুব অপমান লাগছে। বিলু আপা বড়ো আম্মা আর মায়ের ডাকে সাড়া দিচ্ছে না, ঘরের কেবিনে চুপ করে বসে আছে; বড়ো, আম্মা কেবিনে ঢুকছে বিলু আপাকে বের করে আনার জন্যে, রাশেদ পড়তে পারছে না, তার রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে নিঝুম হয়ে যাচ্ছে আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। মাথা নিচু করে বেরিয়ে আসছে বিলু আপা রাশেদ দেখতে পাচ্ছে তার পড়ার টেবিল থেকে, তার ইচ্ছে হচ্ছে উঠে গিয়ে বিলু আপাকে জড়িয়ে ধরে ফেলতে, যাতে সে গোশল করতে যেতে না পারে। বড়ো আম্মা তাকে ধরে বাইরে নিয়ে যাচ্ছে, মায়ের হাতে একটি পেতলের ঘটি, ওই ঘটিটিতেই হয়তো রয়েছে মরির তেলইর পানি, যে-পানি বড়ো আম্মা ছিটিয়ে দেবে বিলু আপার মাথায় মুখে শরীরে, তারপর গোশল করিয়ে দেবে বালতির পানি দিয়ে। বিলু আপা যদি হাত দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয় ঘটির পানিটুকু? রাশেদ তাতে খুব খুশি হবে, কিন্তু বিলু আপা তো ছুঁড়ে ফেলে দেবে না, সে তত শেষে সবই মেনে নেয়। বিলু আপা। গোশল করে ঘরে ঢুকে যখন চুল আঁচড়াচ্ছে তখন রাশেদ তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো, . তার মুখটিকে বিষণ্ণ দেখালেও উজ্জ্বল দেখাচ্ছে, মনে হচ্ছে বিলু আপা বিশ্বাস করছে। এতে তার বিয়ে হবে। রাশেদের মুখ দেখেই বিলু আপা বুঝতে পেরেছে রাশেদ কিছু জানতে চায়; বিলু আপা বললো, মেয়েদের কতো কিছুই করতে হয়, আরো কতোবার যে পরের পানিতে নাইতে হবে। বিলু আপার কথাই ঠিক হলো, গ্রামে পর পর কয়েকটি মেয়ের বিয়ে হলো, বড়ো আম্মা প্রত্যেকটি মেয়ের তেলইর পানি চুরি করে আনলো, আর গোশল করাতে লাগলো বিলু আপাকে। এখন আর বিলু আপাকে ডেকে কেবিন, থেকে বের করতে হয় না, সন্ধ্যার বেশ পর মা বিলু আপাকে পানিভর্তি ঘটটি দেয়, আর বিল আপা নিজেই গিয়ে পোশল করে ঘরের পশ্চিম কোণায় দাঁড়িয়ে। গোশলের পর বিলু আপা চুল আঁচড়ায়, কিন্তু রাশেদ আর তার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় না; কিন্তু বিলু আপা তার পড়ার টেবিলের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে, তোর এতে খুব খারাপ লাগে, নারে? রাশেদ মাথা নিচু করে থাকে, তার ভেতর থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতে চায়, রাশেদ চেপে ফেলে। বিলু আপা রাশেদকে একটি অমূল্য সম্পদ উপহার দিয়েছে এর মাঝে, সেটি দীর্ঘশ্বাস, আর দিয়েছে তা চেপে ফেলার বিস্ময়কর শক্তি।
রাশেদ গিয়েছিলো মামাবাড়ি বেড়াতে, সেখানে সবুজ উদ্ভিদের সবুজ জ্যোত্সার মধ্যে সে দেখতে পায় এমন এক দৃশ্য, যা অলৌকিক মনে হয় তার, এবং এই প্রথম সে দেখে অলৌকিককে; তার চোখ মন শরীর ভরে যায়, যা দেখার স্বপ্ন সে দেখে আসছে। রক্তের ভেতরে, কিন্তু দেখতে পায় নি, সে তার চেয়ে অনেক বেশি দেখতে পায়। কোনো দেবতাকে দেখলেও সে এমন শিহরিত হতো না। মামাবাড়ি তার ভালো লাগে ওই গ্রামের গাছপালার সবুজ আলো-অন্ধকারের জন্যে; ওই গ্রাম গাছপালার, মানুষের নয়, মানুষ থাকে গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে গাছপালার আদরে, রাশেদ ওই গ্রামে ঢুকলেই গাছপালা তাকে আদর করতে শুরু করে। দীর্ঘ মোমবাতির মতো শুপুরিগাছগুলোর শীর্ষে জ্বলছে সবুজ শিখা, ঘরগুলো ঢাকা পড়ে আছে নারকেল আর খেজুরগাছের। আঁচলের নিচে, আমগাছ বাড়িয়ে দিয়েছে বড়ো বড়ো ডাল, শিমুলগাছ ওপরে উঠে গেছে। সব গাছ ছাড়িয়ে, কালোসবুজ পাতা ছড়িয়ে স্তব্ধ নিঝুম হয়ে আছে গাবগাছ, বাঁশবনে শনশন শব্দ হচ্ছে, বেতগাছ এলিয়ে আছে, গোঁড়ালেবুগাছের ঝোঁপ থেকে ভেসে আসছে সবুজ গন্ধ, আর রয়েছে গভীর সঙ্গল, যেখানে লুকিয়ে থাকলে খুঁজে পাওয়া যায় না। দুপুর পেরিয়ে গেছে, চারপাশে কোমল নিশ্ৰুপ বিকেল, রাশেদ জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। একলা হাঁটছিলো; একটা নতুন পথ তৈরি করতে করতে সে হাঁটছে, তার ভালো লাগছে ডাল ডিঙ্গিয়ে আর ডালের নিচ দিয়ে মাথা গলিয়ে চলতে। সে কোথায় যাবে জানে না, হয়তো যাবে না কোথাও, বা যাবে এষাদের বাড়ি। মামাবাড়ি এলেই এষাকে তার মনে পড়ে, মামাবাড়ি এলেই ছোটোবেলা থেকেই সে খেলে এষা আর ফাতুর সাথে। এষা আর ফাতু খুব বড়ো হয়ে গেছে, হঠাৎ বড়ো হয়ে গেছে তার থেকে; ওরা শাড়ি পরে এখন, অথচ রাশেদ হাফপ্যান্ট ছাড়ে নি, বিয়ের জন্যে অপেক্ষা করছে ওরা। সামনে। বেতগাছ দিয়ে ঘেরা একটা জায়গা, ঢুকে বসে থাকলে কেউ দেখতে পায় না, মাসখানেক আগেও রাশেদ সেখানে বসে অনেক কিছু ভেবেছে, জায়গাটায় বসলেই ভাবনা আসে। আজো সে কিছুক্ষণ বসবে সেখানে, দেখবে ভাবনা আসে কিনা, নিশ্চয়ই। আসবে, নীরব জায়গায় আজকাল একলা বসলেই তার ভাবনা আসে। ওই নিবিড় নিচুপ জায়গাটিতে কারা যেনো বসে আছে; রাশেদ উঁকি দেয় বেতপাতার সরু ফাঁক দিয়ে, দেখে এষা আর ফাতু মুখোমুখি বসে আছে। শাড়ি পরেছে তারা, তাদের ওপরের। দিকটা সম্পূর্ণ উদোম, এষার শরীর ধবধব করছে, এষা কোমলভাবে নাড়ছে ফাতুর দুধ, ফাতু চোখ বুজে আছে, ফাতুও কোমলভাবে ছুঁইছে এষার দুধ, এষা চোখ বুজছে। হাত সরিয়ে এষা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকছে ফাতুর বুকের দিকে, কী যেনো বলছে, ফাতু। মিষ্টি করে হাসছে; ফাতু এষার দুধে একবার ঠোঁট চুঁইয়ে জড়িয়ে ধরলো এষাকে। রাশেদের মনে হলো এই প্রথম সে দেখলো সৌন্দর্য, গোলাপের থেকে আগুনের থেকে চাঁদের থেকে শিশিরের থেকে সুন্দর এ-সৌন্দর্য। ওই সৌন্দর্যকে ঘিরে সময় থেমে। আছে। তার ইচ্ছে হচ্ছিলো অনন্তকাল দাঁড়িয়ে থেকে এ-দৃশ্য দেখতে বা তার সব ইচ্ছে তখন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো;-তার ভেতরে জ্বলে উঠলো মোমের শিখা, গলতে শুরু করলো, ফুটতে লাগলো শিউলি, ঝরে ঝরে পড়তে লাগলো মাটিতে। তার চোখ অন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কিছু দেখতে পাচ্ছে না সে, তার প্রতিটি রক্তকণা অন্ধ হয়ে যাচ্ছে; রাশেদ বসে পড়লো, চিবোতে লাগলো একটা ঘাস ছিঁড়ে; সে এষাদের বাড়ি যাবে না, মামাবাড়িও যাবে না, তার খুব দূরে যেতে ইচ্ছে করছে, নদীর কাছে যেতে ইচ্ছে করছে, মেঘের ভেতরে যেতে ইচ্ছে করছে, ইচ্ছে করছে নিজের রক্তকণিকার থেকে কোটি কোটি মাইল দূরে যেতে।
ওই সুন্দরের আগুনে যদি তার চোখ পুড়ে যেতো, রক্ত ছাই হয়ে যেতো, সুখ পেতো রাশেদ; কিছুই না পুড়ে তার ভেতরে লাখ লাখ চোখ নিশ্চল হয়ে তাকিয়ে আছে ওই সৌন্দর্যের দিকে। চোখ কেনো আরো বেশি করে দেখতে পারে না, চোখ দিয়ে কেনো ছুঁয়ে দেখা যায় না, কেনো স্বাদ নেয়া যায় না চোখ দিয়ে? যদি তার চোখ ছুঁয়ে দেখতে পারতো ওই সৌন্দর্যকে, জিভের মতো স্বাদ নিতে পারতো ওই সৌন্দর্যের, তাহলে হয়তো সে এমন কিছু অনুভব করতে, যাকে বলা হয় সুখ। রাশেদ মামাবাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে, হাঁটতে থাকে নিজেদের গ্রামের দিকে, সে দেখতে পায় দুলছে ধবধবে যুগল চাঁদ, বন জুড়ে দুলছে যুগল ফল। আমি আর আগের মতো নেই, রাশেদ মনে মনে নিজেকে শোনায়, আগের মতো কখনো হবো না, আমি এখন অনেক কিছু জানি, আমি অনেক কিছু দেখেছি, আমি আরো অনেক কিছু জানবো, আরো অনেক কিছু আমি : দেখবো। আজিজকে সে বলবে তার এ-অলৌকিক অভিজ্ঞতার কথা? না, সে বলবে না। কাউকে; সে নিজের ভেতরে বইবে অলৌকিক সৌন্দর্য, অভাবিত অভিজ্ঞতা; কারো কাছে সে তার সুন্দরকে প্রকাশ করবে না। অনেক দিন ধরেই রাশেদ টের পাচ্ছে এমন সুন্দর আছে, যা রক্তমাংসের সাথে বাঁধা; কচুরিফুলের বা মেঘের বা পদ্মার পশ্চিম পাড়ে সূর্যাস্তের সৌন্দর্যের সাথে রক্তমাংসের কোনো সম্পর্ক নেই, কিন্তু যে-সুন্দর সে আজ দেখেছে, তার জন্ম তার রক্তে তার মাংসে, তা তার রক্তমাংসের সাথে জড়ানো। সে নিজেকে বহন করতে পারছে না, তার রক্তমাংসে সুন্দর যে-চাপ সৃষ্টি করেছে, তাতে সে চৌচির হয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো বিলু আপার, রাশেদের পছন্দ হয় নি, কিন্তু সে কারো কাছে তার অপছন্দ প্রকাশ করে নি; তাহলে হয়তো বিয়ে হবে না, তখন মা কষ্ট পেতে থাকবে বাবা কষ্ট পেতে থাকবেন বিলু আপাও কষ্ট পেতে থাকবে, আর কষ্ট পেতে। থাকবে সে নিজে, নিজেকে তার মনে হবে অপরাধী। লোকটিকে দেখতে একেবারেই ভালো লাগে নি রাশেদের, বা এমনও হতে পারে বিলু আপাকে বিয়ে করতে চায় এমন কোনো লোককেই তার পছন্দ হয় না; আর বিলু আপা তো দেখেই নি লোকটিকে; মেয়েদের দেখতে হয় না, সব পুরুষই মেয়েদের জন্যে সুন্দর, দশজনের মধ্যে একজন, রাজপুত্র। বিলু আপা একদিন রাশেদকে জিজ্ঞেস করেছিলো, লোকটি দেখতে কেমন রে; রাশেদ তার কোনো উত্তর দেয় নি, বিলু আপা বুঝেছিলো রাশেদ কেনো উত্তর দিচ্ছে না, তখন সে বলেছিলো, আমার ভাগ্যে কি আর রাজপুত্র আছে? তবে বিলু আপাকে সুখীই মনে হচ্ছিলো, বিয়ে হচ্ছে এটাই সুখ, ক-দিন খুব ফিসফিস করেছিলো পুষু আপা আর পারুল আপা বিলু আপার সাথে, রাশেদ তাতে কান দেয় নি, তার মনে হয়েছিলো। মেয়েরা একই বিষয়ে দিনের পর দিন ফিসফিস করতে পারে। বিলু আপাকে আর আমগাছের পাশে দাঁড়িয়ে দিগন্তের ওই পারের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না, এতেই সুখ পাচ্ছিলো রাশেদ। লোকটি বিলু আপার থেকে অনেক বড়ো হবে, তেরো-চোদ্দ বছরের বেশি হবে, হাসতেই জানে না, আইএ ফেল, রাশেদের পছন্দ হয় নি, কিন্তু সে কোনো কথা বলে নি। লোকটিকে দুলাভাই বলতে হবে, খুব লজ্জা লাগবে রাশেদের, প্রথম প্রথম হয়তো সে লোকটিকে দুলাভাই বলতেই পারবে না। বিলু আপার বিয়ে হয়ে গেলো, রাশেদ সাথে গেলো বিলু আপার শ্বশুরবাড়িতে; পাল্কি থেকে বিলু আপাকে। নামানোর সময় রাশেদ শুনতে পেলো মেয়েরা বিলু আপাকে কালো বলছে, শুনে। রাশেদের মুখ শুকিয়ে গেলো, মনে হচ্ছিলো সে কাউকে মুখ দেখাতে পারবে না। বিলু। আপার শাশুড়ি বউ নামাতেই এলো না, কয়েকটি মেয়েলোক বিলু আপাকে নামিয়ে নিয়ে গেলো উত্তরের ঘরটিতে। বিলু আপা কি তখন কাঁদছিলো, কিন্তু রাশেদের কান্না পাচ্ছিলো। অনেক পরে রাশেদ গেলো বিলু আপার কাছে, বিলু আপা বুড়ো ঘোমটা দিয়ে বসে আছে, যে-ই আসছে সেই বলছে, ভাইটা দেহি সোন্দর, বইনটা এমন কালা অইল ক্যামনে, শুনে খুব রাগ হচ্ছিলো রাশেদের; একবার সে বলে ফেললো, আপা। কালো নয়, আপনারা কালো বলেন কেনো? বিলু আপার স্বামী বললো, কালরে কাল বলব না ত কী বলব? কান্না পাচ্ছিলো রাশেদের, খুব অপমান লাগছিলো তার; বিলু আপা কাঁদছিলো, রাশেদ বিলু আপাকে এমনভাবে কোনো দিন কাঁদতে দেখে নি। এতো খারাপ দিন রাশেদ আর কাটায় নি, সে ভেবেছিলো খুব আনন্দ হবে, কোনো কিছুই। তাকে আনন্দ দিতে পারছিলো না, যদিও সবাই তাকে খুবই আদর করার চেষ্টা করছিলো। তার ইচ্ছে করছিলো বিলু আপার পাশে বসে থাকতে, কিন্তু বেশিক্ষণ বসতে অস্বস্তি লাগছিলো, সে সারাক্ষণ বাড়ি ভরে হাঁটছিলো, কখনো বসে বসে কষ্ট চাপার। চেষ্টা করছিলো কালরাত, কালরাত কথাটি রাশেদ শুনতে পাচ্ছে বারবার। কোনো বাড়িতে বিয়ে হলেই কথাটি শোনা যায়, শুনে ভয় লাগে, আজ তার আরো ভয় লাগছে। বর-বউ যে-রাতে প্রথম একসাথে থাকে, সেটাকে বলে কালরাত। সেটা খুব ভয়ের রাত, জিন এসে ভর করতে পারে বর-বউর ওপর, এমনকি সাপ এসেও কামড় দিতে পারে বলে শুনেছে রাশেদ। দুলাভাইর দুলাভাই হয় এমন একটা লোক ঘিনঘিনে রসিকতা করার চেষ্টা করছে রাশেদের সাথে, বলছে, আমার শালাডা ত বিয়াইর বইনরে লইয়া থাকব রাইতে, বিয়াই থাকবা কার লগে, আমার লগেই থাইক্ক। রাশেদ এখন জানে কালরাতে কী হয়। বিলু আপা উত্তরের ঘরে থাকবে, কালরাত হবে ওই ঘরে, শুনছে রাশেদ; তার দুলাভাইটিকে একটু খুশি খুশি দেখাচ্ছে, কিন্তু রাশেদের কষ্ট হচ্ছে ভয় লাগছে। বিলু আপা আর বিলু আপা থাকবে না আজ রাতের পর, মনে হচ্ছে রাশেদের, বিলু আপা। নোংরা হয়ে যাবে, সাথে সাথে যেনো নোংরা হয়ে যাবে রাশেদও। বেশ রাত হয়ে গেছে, ঘুমোতে পারছে না রাশেদ, তখন রাশেদ বিলু আপার কান্না শুনতে পায় উত্তরের ঘর থেকে। বিলু আপা চিৎকার করে ওঠে নি, তাহলে রাশেদ লাফিয়ে উঠতো, কিন্তু রাশেদ শোনে খুব কষ্টের একটা কান্না ভেসে আসছে পাশের ঘর থেকে। রাশেদ অন্ধকারে কান পাতে, শুনতে পায় বিলু আপা না, না, না করছে, আর কাঁদছে, আর দুলাভাইটি খুব জোরে ধমক দিয়ে উঠছে। রাশেদ শুধু শুনতে পাচ্ছে বিলু আপার কান্না, তার ঘুম আসছে না, সে ঘুমোতে পারবে না। কারা যেনো অন্য ঘর থেকে বেরোলো, রাশেদ দু-তিনজন। মহিলার কণ্ঠ শুনতে পেলো; তারা উত্তরের ঘরের দরোজায় গিয়ে দুলাভাইর নাম ধরে ডাকলো। এক মহিলা বলছে, শুনতে পাচ্ছে রাশেদ, এমন বুড়া মাইয়া আবার : কালরাইতে কান্দে নি, আমাগ ত বিয়া অইছিল বার বচ্ছর বয়সে, আমরা ত কান্দি নাই, কালরাইতেই ত যা করনের করছিল, রাইত ভইরাই করছিল, লউয়ে বিছনা ভাইস্যা গেছিল। আরেক মহিলা বলছে, অ নাতি, আমরা ভাবছিলাম এর মইদ্যে যা করনের কয়বার কইর্যা হালাইছ, অহন দেকছি তুমি মরদ অও নাই, আগে আমাগ কইলেই ত আমরা রান ফাঁক কইর্যা ধরতাম, লউয়ে চাদ্দইর ভিজাইতে না পারলে আবার মরদ। কিয়ের। আরেক মহিলা বলছে, রাজি না অইলে পাও বাইন্দা লইতে অয়, মাইয়া মানুষ গরুর লাহান, পাও বাইন্দা জবই করন লাগে। তারা সবাই উত্তরের ঘরে ঢুকছে বলে মনে হচ্ছে রাশেদের। রাশেদের ভয় হচ্ছে তারা সবাই মিলে এখন বিলু আপাকে হয়তো বাঁধবে। রাশেদ বিলু আপার কান্না শুনতে পাচ্ছে, না, না শুনতে পাচ্ছে। মহিলারা ঘর। থেকে বেরিয়ে এলো। এক মহিলা বলছে, চিৎ কইর্যা আতপাও বাইন্দা দিয়া আইলাম, অহনও যদি জোয়াইনকা না পারে তাইলে অর খুডাডা ভাইঙ্গা হালামু। আরেক মহিলা বলছে, যা মাইয়া তাইতে ত টু করনেরও কতা না, রজ্জইবারই মরনের কতা, এই। মাইয়ারে কাবু করতে অইলে অর খাড়নের জোর থাকব না। তখন রাশেদ একটা তীব্র চিৎকার শুনতে পায়, রাশেদ দু-হাতে কান বন্ধ করে বালিশে মাথা চেপে ধরে।
রাশেদ ঘুম থেকে উঠে দেখে বিলু আপার ভেজা শাড়িটা উত্তরের ঘরের পাশে একটি রশিতে ঝুলছে, তার পাশে ঝুলছে একটা ভেজা লুঙ্গি; বিলু আপার শাড়িতে একটা বড়ো কালচে দাগ দেখে সে চোখ ফিরিয়ে নেয়। ঘরে ঢুকে দেখে বিলু আপা বিছানার ওপর স্থূপের মতো পড়ে আছে, রাশেদ ডাকতেই বিলু আপা মুখ ঘুরিয়ে তার দিকে তাকায়, রাশেদ তার মড়ার মতো মুখ দেখে চমকে ওঠে। তার গালে লাল দাগ, রাশেদ মুখ ঘুরিয়ে নিলো অন্য দিকে; বিয়ের পর মেয়েদের মুখে এমন দাগ সে আরো দেখেছে। রাশেদকে বসতে বলে বিলু আপা, নিজেও একবার বসার চেষ্টা করে, কিন্তু বসতে না পেরে আবার স্কুপের মতো শুয়ে পড়ে। বিলু আপার তো কোনো অসুখ ছিলো না, বিলু আপা তো এতো দুর্বল ছিলো না, বসার চেষ্টা করে বিলু আপা তো কখনো শুয়ে পড়ে। নি। রাশেদের মনে হয় বিলু আপা সম্পূর্ণ চুরমার হয়ে গেছে, তার মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে, সে আর কখনো উঠে দাঁড়াতে পারবে না। দুলাভাইটিকে খুব প্রফুল্ল মনে হচ্ছে, মনে হচ্ছে বিজয়ী, সে কিছু একটা জয় করেছে এমন একটি ভাব সে রাশেদের কাছেও প্রকাশ করছে। সে বিলু, বিলু নাম ধরে বিলু আপাকে ডাকছে মাঝেমাঝে, রাশেদের তা ভালো লাগছে না; তার মনে হচ্ছে বিলু আপার নাম ধরে ডাকার অধিকার তাকে কে দিয়েছে? সারা দিন বিলু আপা উতেও বসলো না, পড়ে রইলো স্কুপের মতোই; পরের রাতে রাশেদ আবার শুনতে পেলো বিলু আপার না, না, না, আর কান্না। ভোরে বিলু আপা দাঁড়াতেই পারলো না, সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলা হয়েছে বিলু আপাকে। পাল্কি এসে গেছে। রাশেদদের বাড়ি থেকে বিলু আপা আর তার জামাইকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে; পাল্কিতে উঠোনোর সময় বিলু আপা দাঁড়াতেই পারলো না। বিছানা থেকে নেমে একবার দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিলো, দাঁড়াতে পারলো না, মেঝেতে পড়ে যাচ্ছিলো, তাকে পাল্কিতে উঠোনো হলো ধরাধরি করে। বাড়ি পৌঁছোনোর পর রাশেদ দেখে সবাই খুব। খুশি, সেও খুশি হওয়ার চেষ্টা করলো, বিলু আপাকে নামানোর পর তাকে পিঁড়িতে বসাতে গেলে বিলু আপা গড়িয়ে পড়ে গেলো। ধরাধরি করে বিলু আপাকে শুইয়ে দেয়া হলো বড়ো ঘরের কেবিনে, স্কুপের মতো পড়ে রইলো বিলু আপা; তার সইরা, পুষু আর পারুল আপা, বসে রইলো পাশে। উত্তরের ঘরে বিছানা পাতা হয়েছিলো বিলু আপা আর জামাইর জন্যে, সেখানে গেলো না বিলু আপা; জামাইকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো, জামাইটিকে ম্লান দেখাতে লাগলো।
রাশেদকে ডাকছে বিলু আপার জামাই, ওই লোকটিকে দুলাভাই ভাবতে এখনো। রাশেদের কেমন যেনো লাগছে, তার কাছে যেতে ইচ্ছে করছে না রাশেদের, মনে হচ্ছে সে তাকে ছুঁলে সেও নোংরা হয়ে যাবে বিলু আপার মতো। বিলু আপাকে দেখতে ইচ্ছে করছে রাশেদের, তবে দ্বিধা হচ্ছে কেবিনে ঢুকতে, সেখানে মেয়েলোকেরা ফিসফিস করে কথা বলছে। পাশের বাড়ির বুড়িটি বলছে, মরদ জামাই অইলে অ্যামুনিই অয়, মাজা ভাইঙ্গা দেয়, জোয়াইনকাগ কি সবুর সইয্য অয়। রাশেদের ইচ্ছে করে পালিয়ে যেতে, কিন্তু পারে না সে; খেজুরগাছের গোড়ায় বসে কখনো, আমগাছে হেলান দিয়ে। দাঁড়িয়ে থাকে, কখনো গিয়ে বসে পড়ার টেবিলে। বইগুলোকে অচেনা মনে হয়। সন্ধ্যার পর বিলু আপাকে উত্তরের ঘরে নেয়ার কথা ওঠে; কেউ কেউ বলে জামাই একলা আছে, মেয়েকে ওই ঘরে পাঠানো দরকার, কিন্তু বিলু আপা যেতে রাজি হচ্ছে না। কেউ শুনছে না তার কথা, রাজি না হওয়ার অধিকার তার নেই, বসতে না পারলেও তাকে যেতে হবে, জামাই একলা রাত কাটাতে পারে না। জালালদ্দির বউ ভণ্ডকথা বলতে পারে গান গাওয়ার মতো, কিছু আটকায় না তার মুখে; সে লোকটিকে বলছে, নাতনি ত জামাইর লগে হুইতে চায় না, আমার নাতনিডারে ত খুইদ্যা হালাইছ, আইজ রাইতে আমারে লইয়াই হোও সোনারচান। লোকটিও কম যায় না, বলছে নাতনিরে লইয়া আসেন, দুইজনরে লইয়াই শুই, দুইজনের মাজাই ভাইঙ্গা দেই। তারা দুজনেই ভণ্ডকথায় মেতে ওঠে, রাশেদ আমগাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে শুনছে তাদের কথা, তার ঘেন্না লাগছে, কিন্তু দূরে চলে যেতে পারছে না। লোকটিকে খুব অস্থির মনে হচ্ছে, একা একা থেকে সে অস্থির হয়ে উঠেছে; সে জালালদ্দির বউকে বলছে, নাতনিরে লইয়া আহেন, আর কতোক্ষণ একলা থাকব। জালালদ্দির বউ ছুটে গেলো বড়ো ঘরের দিকে, সে নিশ্চয়ই মাকে খবর দিতে গেলে যে জামাই উতলা হয়ে উঠেছে মেয়ের জন্যে, এখনি পাঠাতে হবে তাকে। রাশেদ বড়ো ঘরে গিয়ে দেখলো বিলু আপা রাজি হচ্ছে না, কিন্তু তাকে যেতে হবে; মা তাকে যেতে বলছে, অন্য মেয়েলোকেরাও বলছে যেতে, জামাই একলা থাকলে মেয়েলোকের গুনা হয়। তারা জোর করে বিলু আপাকে কেবিন থেকে উঠিয়ে নিয়ে এলো, বিলু আপা হাঁটতে পারছে না, পা ফেলতে কষ্ট হচ্ছে তার, সে পড়ে গেলো; তিনটি মেয়েলোক চেষ্টা করেও বিল আপাকে তুলতে পারছে না। জালালদ্দির বউ লোকটিকে ডেকে বললো, অ সোনারচান, নিজের জিনিশ নিজেই কান্দে কইরা লইয়া যাও। লোকটি সম্ভবত এরই জন্যে অপেক্ষা করছিলো, সে বেরিয়ে এসে পাজা কোলে করে তুলে নিয়ে গেলো বিলু আপাকে, বিলু আপা তার কোলে পড়ে রইলো একটা মৃত মেষের মতো।
কয়েক দিন বেড়িয়ে লোকটি বিলু আপাকে রেখে চলে গেলো, তাদের বাড়ি গেলো না, চাকুরি করতে শহরে চলে গেলো। এ-ক-দিন রাশেদ বিলু আপার দিকে তাকাতে পারে নি, এবার তাকিয়ে দেখলো বিলু আপা হাঁটতে না পারলেও মিষ্টি করে হাসছে, তাকে সুখী মনে হচ্ছে, তাতে রাশেদ আহত বোধ করলো অনেকটা, আবার ভালোও লাগলো। বিলু আপার শরীর থেকে অন্য রকম গন্ধ উঠছে, আগে বিলু আপার শরীরে গন্ধরাজের গন্ধ ছিলো, এখন সেখানে সেন্টের গন্ধ উঠছে, ওই গন্ধে চঞ্চল হয়ে উঠছে রাশেদের রক্ত। লোকটি দু-তিনটি বই দিয়ে গেছে বিলু আপাকে, একটি হচ্ছে সে-বইটি যেটি পড়তে গিয়ে চঞ্চল হয়ে উঠেছিলো রাশেদ, যাতে মেয়েটির চুল কেটে নিয়ে। গিয়েছিলো পুরুষটি আর মেয়েটি সংগ্রহ করে রেখেছিলো পুরুষটির জুতো, যে-বই রাশেদ শেষ করতে পারে নি বাবা কেড়ে নিয়েছিলেন বলে; রাশেদ বইটি দেখে আবার চঞ্চল হয়ে উঠলো। বইটি কি সে এখন পড়তে পারে? বিলু আপার কাছে চাইলে কি বিলু আপা তাকে দেবে বইটি? নাকি সে এখনো ওই বই পড়ার উপযুক্ত হয়ে ওঠে নি? তবে তার পড়তে খুব ইচ্ছে করছে। রাশেদ বিলু আপাকে না বলেই বইটি নিয়ে এলো, চুপ করে পড়তে বসলো টেবিলে, মনে মনে ভয় লাগতে লাগলো; তবে এবার আর ভালো লাগছে না, তার মনে প্রশ্ন জাগতে শুরু করলো লেখক সম্পর্কে, কাহিনী সম্পর্কে; মনে হলো লেখক চান তাঁর পাঠকপাঠিকাঁদের খাঁটি মুসলমান করে তুলতে, রাশেদের। মনে প্রশ্ন জাগছে সে নিজে কি এমন পুরুষ হবে? না, সে এমন পুরুষ হবে না। লোকটি এক আস্ত মৌলভি, এমন লোক তার পছন্দ নয়; বউটিও কম নয়, সে এক মহিলা। মৌলানা। হতাশ হলো রাশেদ বইটি শেষ করে, এমন বাজে বই সে আর পড়বে না। মুসলমান লেখকেরা কেনো ভালো বই লিখতে পারে না, এমন একটি প্রশ্নও দেখা দিলো রাশেদের মনে। পরদিন রাশেদ আরেকটি বই নিয়ে এলো বিলু আপার বইগুলো থেকে, বইটা খুলেই একরাশ সুরা আর দোয়ার মধ্যে পড়ে গেলো; কথায় কথায় যে এতো দোয়া পড়তে হয়, তা জানা ছিলো না তার। এতে দোয়া পড়তে হলে সবাইকে মৌলভিসাব হতে হবে। প্রায় সব কিছুই তার মনে হলো হাস্যকর আর অপাঠ্য, পড়ার কিছু নেই বইটিতে; রাশেদ পাতা উল্টোতে লাগলো, এক জায়গায় এসে রাশেদ চমকে উঠলো, দেখলো লেখা রয়েছে, যদি আমি কাহাকেও সেজদা করিতে হুকুম করিতাম। তবে নিশ্চয়ই স্ত্রীদিগকে হুকুম করিতাম যে, তোমরা তোমাদের স্বামীগণকে সেজদা কর। পড়ে ভয় পেয়ে গেলোরাশেদ, সে কখনো এভাবে দেখে নি, সে মা ও বাবাকে সমানই দেখে এসেছে যদিও বাবাকে বেশি ভয় করেছে। কিন্তু বইটি বলছে পুরুষরা। বউদের কাছে অনেকটা আল্লার মতো। বিলু আপার কাছে ওই লোকটি অনেকটা আল্লার মতো? রাশেদের শ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে, ভয় হচ্ছে পাতা উল্টোতে, কিন্তু পাতা উল্টোতেই তার চোখে পড়লো লেখা রয়েছে, পুরুষগণ (আপন আপন) স্ত্রীগণের উপর কর্তা, কেননা আল্লাহতাআলা একের উপর অন্যকে সম্মান দিয়াছেন। এর পর লেখা আছে, এই আয়াতে বুঝা যায় যে, পুরুষগণ সকল সময়েই আপন আপন স্ত্রীগণের সর্বাঙ্গের উপর কর্তা। অতএব তাহারা যাহা ইচ্ছা তাহাই করিতে পারিবেন। স্ত্রীরও কর্তব্য এই যে, সর্বদা তাহার স্বামীকে সন্তুষ্ট রাখিয়া তাহার হুকুম তালীম করিয়া চলিতে থাকে। তাহা হইলে মৃত্যুর পরেই সে বেহেশতে যাইতে পারিবে। মেয়েরা পুরুষদের দাসী? রাশেদ একবার ভাবলো, দেখলো তাই তো, তাদের গ্রামের সব মেয়েলোকই তো দাসীর মতো, তার চেয়েও খারাপ স্বামীদের কাছে। বিলু আপাও এখন ওই লোকটির দাসী, ওই লোকটি বিলু আপার ওপর যা ইচ্ছে তা করতে পারবে।
রাশেদ কি অমন এক পুরুষ হয়ে উঠবে? কর্তা হয়ে উঠবে? তার মাথায় এমন ভাবনা আসছে। না, সে বিয়েই করবে না; বিয়ের কথা মনে মনে ভাবলেও তার লজ্জা লাগে, কিন্তু সে যদি বিয়ে করে, তাহলে সে তার স্ত্রীর কর্তা হবে? না, তার তো স্ত্রীই থাকবে না; সে বিয়েই করবে না। রাশেদ বইটির পাতা উল্টোতে উল্টোতে এক জায়গায় একটি শব্দ পায়, ওই শব্দটি আগে সে শোনে নি,–ছোহবত–শুনতেই তার অদ্ভুত লাগে, কিছুই বুঝতে পারে না। একটু পড়তেই শব্দটির বাঙলা অনুবাদ পায় সে, সাথে সাথে তার হাত কাঁপতে শুরু করে, রক্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে। কেউ যদি এসে পড়ে? বাবা এসে যদি দেখেন? এ-সম্পর্কে আগে সে কিছু পড়ে নি, রাশেদের ইচ্ছে হচ্ছে এক পলকে সবগুলো পাতা পড়ে ফেলতে, যতোই পড়ছে তার অদ্ভুত লাগছে, তার রক্তের ভেতরে খসখসে অনুভূতি সৃষ্টি হচ্ছে। বইটিতে লিখেছে দুলহা-দুলহান আগে অজু করিবে; তারপর একটা দোয়া পড়িবে, তারপর ছোহবত করিবে। রাশেদের অদ্ভুত। লাগতে থাকে, তার শরীর চঞ্চল হয়ে উঠেছে, কিন্তু অজু আর দোয়ার কথা পড়ে মন খটখট করতে থাকে; এ-কাজও করতে হয় অজু করে দোয়া পড়ে? গ্রামের লোকেরা তো অজুই করতে জানে না, তারা এই ‘জান্নেবনাশশাইত্বানা ওয়া জান্নিবিশ’ জানে? রাশেদ এক জায়গায় পড়ে, ‘যাহারা হাসিখুশীতে ও রাজী রগবতে আপন আপন বিবিদের সঙ্গে একবার ছোহবত করিবে, আল্লাহতাআলা তাহাদের আমলনামায় দশ দশ নেকা করিয়া লিখিয়া দিবেন।‘ আল্লা এর সংবাদও রাখে, এতেও নেকা হয়? পাতা উল্টিয়েই রাশেদের চোখে পড়ে ‘ছোহবতের সময় বিবির শরমগাহের উপর দৃষ্টি করিলে এবং তাহাতে গর্ভধারণ করিলে সেই সন্তান টেরা চক্ষুওয়ালা হইবে’; ‘বিবির শরমগাহের দিকে দেখিয়া দেখিয়া ছোহবত করিলে এবং তাহাতে সন্তান জন্মিলে সেই সন্তান। বেতমিজ ও বেআদব হইবে।’ রাশেদ আর পড়তে পারে না, তার পৃথিবী ঘিনঘিনে হয়ে ওঠে; না, সে কখনো ছোহবত করবে না, ওই দোয়া সে পড়তে পারবে না। রাশেদ উঠে গিয়ে বইটি খুঁড়ে রাখে বিলু আপার বইগুলোর পাশে। সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে; পুকুরে সাঁতার কাটছে হাঁস, টলমল করছে পানি, রাশেদের পায়ের নিচে সবুজ ঘাস, উড়ে গেলো একঝাঁক উস্ফুল্ল কাক, ধলিবক এসে বসছে দূরের তেঁতুলগাছে–সুখী হয়ে উঠছে রাশেদ, তার পৃথিবী আবার হয়ে উঠছে সুন্দর।
কয়েক দিন ধরে হেডস্যার ও রাশেদের মধ্যে চলছে মধুর বিষণ্ণ অভিমানের পালা, বুক ভারি হয়ে আছে তার, সুখও লাগছে, মনে হচ্ছে একটা ভিন্ন জীবন যাপন করছে সে; যেনো সে সমান হয়ে গেছে হেডস্যারের, বন্ধু হয়ে গেছে তাঁর, মনে হচ্ছে তার সমান। হয়ে উঠেছে হেডস্যার, বন্ধু হয়ে উঠেছে তারা, বন্ধুদের মধ্যে অভিমান চলছে, কথা হচ্ছে। মনে মনে, মুখে কোনো কথা হচ্ছে না। হেডস্যারের সাথে দেখা হয়ে যেতে পারে, তাই রাশেদ ইস্কুলে এসে সেই যে পেছনের বেঞ্চে বসছে আর উঠছে না, আর হেডস্যার তাদের ক্লাশের পাশ দিয়ে বারবার যাচ্ছেন আসছেন, ঘুরে ফিরে ইস্কুল দেখছেন, একটু বেশি করেই দেখছেন ইস্কুল, কিন্তু তাদের ক্লাশের দিকে একবারও তাকাচ্ছেন না। রাশেদ সব সময় বসে প্রথম বেঞ্চে, অভিমানপর্ব শুরুর পর থেকে বসছে শেষ বেঞ্চে, মাথা নিচু করে বসে থাকছে, স্যার ক্লাশে ঢুকে কোনো দিকে না তাকিয়ে ইংরেজি ব্যাকরণ পড়াচ্ছেন, রাশেদের দিকে একবারও তাকাচ্ছেন না। ক্লাশের সবাই প্রতিমুহূর্তে তাকাচ্ছে তাদের দিকে, দেখছে হেডস্যার রাশেদের দিকে তাকান কিনা, আর রাশেদ তাকায় কিনা হেডস্যারের দিকে, এবং না তাকিয়ে তারা কীভাবে থাকে। হেডস্যার। দেখতে বিশাল, কথা বলেন খুব উঁচু কণ্ঠে; তার গলা ইস্কুলের পশ্চিম থেকে পুব পর্যন্ত সমান শোনা যায়। সবাই জানে তিনি বেশি ভালো পড়াতে পারেন না, তবে ইস্কুল চালাতে পারেন সবচেয়ে ভালো; রসিকতা করতেও তিনি পছন্দ করেন ছাত্রদের সাথে, ধমকও দেন ভয়ঙ্কর। রাশেদ হেডস্যারকে ভালোবাসে, রাশেদের মনে হয় হেডস্যার। অসহায়, তার বিশাল শরীরে একধরনের অসহায় ভাব আছে বলে মনে হয় রাশেদের, এজন্যেই রাশেদের ভালো লাগে স্যারকে। হেডস্যার যে ভালোবাসে রাশেদকে, তা। সবাই জানে। একদিন স্যার ক্লাশে একটি ইংরেজি কবিতার কয়েকটি পংক্তি বলেন, কবিতাটি তাদের বইতে নেই, রাশেদ কবিতাটি পড়েছে একটি পুরোনো বইতে; স্যারের মুখে পংক্তিগুলো শুনে ঝলমল করে ওঠে রাশেদ, আনন্দে সে কবিতাটির পরের দু-তিনটি পংক্তি আবৃত্তি করে ফেলে। রাশেদ ভেবেছিলো স্যার খুশি হবেন; কিন্তু স্যার রেগে যান, রাশেদের মনে ভীষণ কষ্ট দিয়ে বলেন, আজ থেকে আপনিই এই ক্লাশে পড়ান, আমি যাই। স্যারের কথাশুনে খুব দুঃখ পায় রাশেদ; সে চুপ করে বসে থাকে, কোনো কথা বলে না, নাম ডাকার সময়ও সাড়া দেয় না। স্যার মুখ তুলে রাশেদের। দিকে তাকিয়ে মুখ নামিয়ে নেন। সেই থেকে শুরু হেডস্যার ও রাশেদের অভিমানের পালা। এ-অভিমান কি শেষ হবে না? রাশেদ পেছনের বেঞ্চে বসে বসে হাঁপিয়ে উঠছে, পাগল হয়ে উঠছে সামনের বেঞ্চে বসার জন্যে, কথা বলতে না পেরে দম বন্ধ হয়ে। আসছে তার; কিন্তু সে সামনের বেঞ্চে বসবে না, কোনো কথা বলবে না স্যারের ক্লাশে। আমি কি কোনো অপরাধ করেছিলাম, রাশেদ নিজের সাথে কথা বলে মাঝেমাঝে, আমি তো আনন্দে বলে ফেলেছিলাম ওই লাইনগুলো, তার জন্যে আমার তো ওই অপমান পাওয়ার কথা ছিলো না; আমি আগে কথা বলবো না স্যারের সাথে, স্যার বললেই কথা। বলবো আমি। সেদিন রাশেদ শেষ বেঞ্চে বসে আছে, হেডস্যার পড়াচ্ছেন ইংরেজি ব্যাকরণ, মন দিয়ে শুনছে রাশেদ; স্যার একটি উদাহরণে পড়লেন ‘আর্কিটেক্ট’, শুনে। চমকে উঠলো রাশেদ। স্যার বাক্যটি শেষ করেই বললেন, রাশেদ, তুমি কি কোনো। দিন কথা বলবে না? স্যার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে পড়াচ্ছেন, বইটি তাঁর হাতে, স্যারের কথা শুনে সবাই তাকালো রাশেদের দিকে। রাশেদ তো অনেক দিন ধরেই কথা বলতে চায়, এখন সময় এসেছে, কিন্তু সে কি এখন মারাত্মক কথাটি বলবে, যা তার মনে আসছে? তাতে কি স্যার সুখী হবেন? নাকি আরো রেগে যাবেন? রাশেদ দাঁড়ালো, সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে; মৃদু স্বরে বললো, স্যার, ওই শব্দটি হচ্ছে ‘আর্কিটেক্ট’। চমকে উঠলেন স্যার, চমকে উঠলো সবাই; স্যার বইটি খুলে আরেকবার পড়ার চেষ্টা করলেন, কিন্তু তিনি উচ্চারণ করলেন না শব্দটি। অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি, তাদের ক্লাশটিতে নীরবতা ভারি হয়ে উঠলো পাথরের মতো। স্যার একটু বিচলিতভাবে বেরিয়ে গেলেন ক্লাশ থেকে, মাথা নিচু করে শেষ বেঞ্চে বসে রইলো রাশেদ, আর সবাই নিশ্ৰুপ হয়ে বসে রইলো। এমন নীরবতা তাদের জীবনে আর আসে নি। কিছুক্ষণ পর তার ঘর থেকে ফিরে এলেন হেডস্যার, সরাসরি হেঁটে এলেন রাশেদের কাছে, ক্লাশের সবাই নিশ্বাস বন্ধ করে ফেলেছে, স্যার জড়িয়ে ধরলেন রাশেদকে। হু হু করে কেঁদে ফেললো রাশেদ। রাশেদকে জড়িয়ে ধরে প্রথম বেঞ্চে এনে বসিয়ে দিয়ে বললেন, তুমি সব সময় প্রথম বেঞ্চে বসবে, ওটিই তোমার স্থান। মাথা নিচু করে বসে রইলো রাশেদ, তার মনে গুনগুন করতে লাগলো, সব সময়, সব সময়।