বিদ্যা, অবিদ্যা, বন্ধন ও মোক্ষের ব্যাখ্যা
অথ নবম-সমুল্লাসারম্ভঃ
অথ বিদ্যা বিদ্যা বন্ধমোক্ষবিষয়ান ব্যাখ্যাস্যামঃ
বিদ্যাং চাবিদ্যাং চ য়স্তদ্বেদোভবওঁ সহ। অবিদ্যয়া মৃত্যুং তীৰ্বা বিদ্যয়ামৃতমতে ॥ ॥ যজু অ০ ৪০ ॥ ১৪ ॥
যে মনুষ্য বিদ্যা ও অবিদ্যার স্বরূপ যুগপৎ জ্ঞাত হয়, সে ‘অবিদ্যা অর্থাৎ কর্মোপাসনা দ্বারা মৃত্যু অতিক্রম করিয়া বিদ্যা অর্থাৎ যথার্থ জ্ঞানদ্বারা মোক্ষ লাভ করে।
অবিদ্যার লক্ষণ –
‘অনিত্যাশুচিদুঃখানাত্মসু নিত্যশুচিসুখাত্মখ্যাতিরবিদ্যা ॥ ইহা যোগসূত্রের বচন ॥
অনিত্য সংসার ও দেহাদিতে নিত্য বুদ্ধি, অর্থাৎ যে কাৰ্যজগৎ দৃষ্ট ও শ্রুত হয় তাহা চিরকাল থাকিবে, চিরকাল আছে এবং যোগবলে দেবগণের এই শরীর চিরকালই থাকে, এইরূপ বিপরীত বুদ্ধি হওয়া অবিদ্যার প্রথম অংশ। অশুচি’ অর্থাৎ মলময় স্ত্রী আদির (শরীর) এবং মিথ্যা ভাষণ ও চৌর্য্য প্রভৃতি অপবিত্র বিষয়ে পবিত্র বুদ্ধি দ্বিতীয় (অংশ)। অত্যধিক বিষ-সম্ভোগরূপ দুঃখে সুখবুদ্ধি তৃতীয় (অংশ)। অনাত্মায় আত্মবুদ্ধি অবিদ্যার চতুর্থ (অংশ)। এই চারি প্রকারের বিপরীত জ্ঞানকে অবিদ্যা বলে ॥
ইহার বিপরীত অর্থাৎ অনিত্যে অনিত্যবুদ্ধি, নিত্যে নিত্যবুদ্ধি, অপবিত্রে অপবিত্র এবং পবিত্রে। পবিত্র বুদ্ধি, দুঃখে দুঃখবুদ্ধি, সুখে সুখবুদ্ধি, অনাত্মায় অনাত্মবুদ্ধি এবং আত্মায় আত্মবুদ্ধির জ্ঞান। হওয়া ‘বিদ্যা’। অর্থাৎ বেত্তি যথাবৎ পদার্থস্বরূপং সা বিদ্যা। য়য়া তত্ত্বস্বরূপং ন জানাতি ভ্ৰমাদন্যস্মিন্যন্নিশ্চিনোতি সাবিদ্যা’। যদ্বারা পদার্থ সমূহের যথার্থ স্বরূপ-জ্ঞান=বোধ হয়, উহা ‘বিদ্যা’ এবং যদ্বারা তত্ত্ব স্বরূপ জ্ঞাত হওয়া যায় না এবং একবস্তুকে অন্য বস্তু বলিয়া প্রতীত হয় উহাকে ‘অবিদ্যা’ বলে।
অর্থাৎ কর্ম ও উপাসনাকে ‘অবিদ্যা’ বলিবার কারণ এই যে, ইহা বাহ্য ও অন্তর ক্রিয়াবিশেষ, জ্ঞান বিশেষ নহে। এই জন্য বিশেষ নহে। এই জন্য উক্ত মন্ত্রে বলা হইয়াছে, যে, শুদ্ধ কর্ম ও পরমেশ্বরের উপাসনা ব্যতীত কেহ মৃত্যু-দুঃখ হইতে উত্তীর্ণ হইতে পারে না। অর্থাৎ পবিত্র কর্ম, পবিত্র উপাসনা এবং পবিত্র জ্ঞান হইতেই মুক্তি, আর অপবিত্র মিথ্যাভাষণ প্রভৃতি কর্ম, পাষণাদি মূর্তির উপাসনা ও মিথ্যাজ্ঞান হইতে বদ্ধ হইয়া থাকে। কোন মনুষ্যই ক্ষণমাত্রের জন্যও কর্ম, উপাসনা ও জ্ঞানরহিত হয় না। অতএব ধর্মানুমোদিত সত্যভাষণাদি কর্মানুষ্ঠান এবং মিথ্যাভাষণাদি অধর্ম ছাড়িয়া দেওয়াই মুক্তির সাধন।
প্রশ্ন –কাহার মুক্তি লাভ হয় না?
উত্তর –যে বদ্ধ।
প্রশ্ন –বদ্ধ কে?
উত্তর –যে জীব অধর্ম ও অজ্ঞানে আবদ্ধ।
প্রশ্ন –বদ্ধ এবং মোক্ষ কি স্বাভাবিক অথবা নৈমিত্তিক?
উত্তর –নৈমিত্তিক। কেননা যদি স্বাভাবিক হইত তাহা হইলে বদ্ধ ও মুক্তির নিবৃত্তি কখনও হইত না।
প্রশ্ন –ন নিরোধোন চোৎপত্তির্নবদ্ধো ন চ সাধকঃ। ন মুমুক্ষুর্ন বৈ মুক্তিরিত্যেষা পরমার্থত৷ এই শ্লোক মাণ্ডকোপনিষদ্ বিষয়ক।
জীব ব্রহ্ম হওয়ায় বাস্তবিক পক্ষে জীবের ‘নিরোধ’ নাই অর্থাৎ জীব কখনও আবরণগ্রস্ত হয় না, জন্মগ্রহণ করে না ও বন্ধন প্রাপ্ত হয় না। আর জীব সাধক নহে অর্থাৎ সামান্য মাত্র সাধনা করে না, মুক্তি পাইবার ইচ্ছা করে না এবং ইহার মুক্তিও নাই। কেননা যখন পরমার্থ দ্বারা বন্ধনই হইল না, তাহার আবার মুক্তি কীসের?
উত্তর –নবীন বেদান্তীদের এইরূপ উক্তি সত্য নহে। কারণ জীবের স্বরূপ অল্প সুতরাং জীব আবরণে আবদ্ধ হয়, শরীরের সহিত প্রকট হইয়া জন্মগ্রহণ করে, পাপকর্মের ফলভোগরূপ বন্ধনে আবদ্ধ হয় সেই বন্ধন মোচনের সাধন অবলম্বন করে, দুঃখ হইতে মুক্ত হইবার ইচ্ছা করে এবং দুঃখ বিমুক্ত হইয়া পরমানন্দ পরমেশ্বরকে প্রাপ্ত হইয়া মুক্তিও ভোগ করে।
প্রশ্ন –এই সকল ধর্ম, দেহ ও অন্তঃকরণের, জীবের নহে। কেননা জীব তো পাপপুণ্য রহিত সাক্ষী মাত্র। শীতোষ্ণ প্রভৃতি তো শরীরাদির ধর্ম, আত্মা নির্লিপ্ত।
উত্তর– দেহ ও অন্তঃকরণ জড় পদার্থ, ইহাদের শীতোষ্ণ প্রাপ্তি ও ভোগ নাই। যেমন প্রস্তর শীতোষ্ণ প্রাপ্তি ও ভোগ করে না। চেতন মনুষ্যাদি যে প্রাণী উহাকে স্পর্শ করে শীতোষ্ণ উপলব্ধি ও ভোগ তাহারই হয়, তদ্রপ প্রাণও জড়। উহার ক্ষুধাও নাই, পিপাসাও নাই, কিন্তু প্রাণবান জীবেরই ক্ষুধা তৃষ্ণার অনুভব হইয়া থাকে। সেইরূপ মনও জড়, উহার হর্ষ বা শোক হইতে পারে না। কিন্তু জীব মন দ্বারা হর্ষ-শোক ও সুখ-দুঃখ ভোগ করে। জীব যেরূপ শ্ৰোত্রাদি বাহ্যেন্দ্রিয়ের দ্বারা ভাল-মন্দ শব্দাদি বিষয় গ্রহণ করিয়া সুখ- দুঃখ ভোগ করে সেইরূপ অন্তঃকরণ অর্থাৎ মন-বুদ্ধি-চিত্ত-অহঙ্কার দ্বারা সংকল্প-বিকল্প, নিশ্চয়, স্মরণ ও অভিমানী (জীব) দণ্ড ও সম্মানভাজন হইয়া থাকে।
যেরূপ তরবারি দ্বারা হত্যাকারী দন্ডনীয়, তরবারি দণ্ডনীয় নহে সেইরূপ দেহ-ইন্দ্রিয়-অন্তঃ করণ এবং প্রাণরূপ সাধন দ্বারা ভাল মন্দকর্মের কর্তা জীবই সুখ দুঃখ ভোগ করিয়া থাকে। জীব কর্মের সাক্ষী নহে, কিন্তু কর্তা এবং ভোক্তা। কেবলমাত্র এক অদ্বিতীয় পরমাত্মাই কর্মের সাক্ষী। কর্মানুষ্ঠাতা জীবই কর্মে লিপ্ত হয়। জীব ঈশ্বররূপ সাক্ষী নহে।
প্রশ্ন –জীব ব্রহ্মের প্রতিবিম্ব। যেমন দর্পণ ভাঙিয়া গেলে বিম্বের কিছুই অনিষ্ট হয় না, সেইরূপ যতকাল অন্তঃকরণরূপ উপাধি থাকে, ততকাল পর্যন্ত ব্রহ্মের প্রতিবিম্বস্বরূপ জীব থাকে। অন্তঃকরণ বিনষ্ট হইলে জীব মুক্ত হয়।
উত্তর –ইহা বালকের কথা। কারণ সাকারেই সাকারের প্রতিবিম্ব হইয়া থাকে যেমন মুখ ও দর্পণ সাকার এবং একটি অপরটি হইতে পৃথক ও বটে; না হইলে প্রতিবিম্ব হইতে পারে না। ব্রহ্ম নিরাকার ও সর্বব্যাপক সুতরাং তাহার প্রতিবিম্ব হইতে পারে না।
প্রশ্ন –দেখ, (যেরূপ) গভীর স্বচ্ছ জলে নিরাকার ও ব্যাপক আকাশের আভাস পতিত হয়। সেইরূপ স্বচ্ছ অন্তঃকরণে পরমাত্মার আভাস পতিত হয়। এইজন্য ইহাকে চিদাভাস বলে।
উত্তর –ইহা বালকবুদ্ধির মিথ্যা প্রলাপ। কারণ আকাশ দৃশ্যমান নহে। চক্ষু দ্বারা কীরূপে দৃষ্ট হইতে পারে?
প্রশ্ন –যাহা উপরে নীল ও ধুম্রাকার দৃষ্ট হয় তাহা আকাশ কিনা?
উত্তর –না।
প্রশ্ন –তবে উহা কী?
উত্তর –পৃথিবী, জল এবং অগ্নির পৃথক পৃথক ত্রসরেণু দৃষ্ট হইয়া থাকে। তন্মধ্যে যে নীলিমা দেখা যায়, উহা অধিক জলরাশি। যাহা বর্ষিত হয় উহাই নীলিমা। যাহা ধূম্রাকার দৃষ্ট হয়, উহা বায়ুমণ্ডলে ঘূর্ণায়মান পৃথিবী হইতে উত্থিত ধূলিরাশি। ঐ সকলের প্রতিবিম্ব জলে অথবা দর্পণে দৃষ্ট হইয়া থাকে, আকাশের কখনও নহে।
প্রশ্ন –যেমন ঘটাকাশ, মঠাকাশ, মেঘাকাশ এবং মহাদাকাশের ব্যবহারিক ভেদ হইয়া থাকে, সেইরূপ ব্রহ্মের ব্রহ্মাণ্ড ও অন্তঃকরণের উপাধিগত ভেদ বশতঃ ঈশ্বর ও জীব নাম হইয়া। থাকে। ঘটাদি নষ্ট হইলে মহাদাকাশই বলা হয়।
উত্তর –ইহাও অবিদ্বান ব্যক্তিদের কথা। কারণ আকাশ কখনও ছিন্নভিন্ন হয় না। কাৰ্য্যকালে ‘ঘট আনো’ ইত্যাদি ব্যবহার হইয়া থাকে। কেহ কি বলে ‘ঘটের আকাশ আনো’। সুতরাং পূর্বোক্ত বাক্য যুক্তি সঙ্গত নহে।
প্রশ্ন –যেমন মৎস্য ও কীট প্রভৃতি সমুদ্রে এবং পক্ষী প্রভৃতি আকাশে বিচরণ করে, সেইরূপ চিদাকাশ ব্রহ্মে অন্তঃকরণ সমূহ বিচরণ করিয়া থাকে। অন্তঃকরণ জড় পদার্থ হইলেও সর্বব্যাপক
পরমাত্মার সত্তা দ্বারা; অগ্নি-সংযুক্ত লৌহ যেরূপ (উষ্ণ), সেইরূপ চেতন হইয়া থাকে। যেরূপ। তাহারা চলাফেরা করে, কিন্তু আকাশ এবং ব্রহ্ম নিশ্চল সেইরূপ জীবকে ব্রহ্ম স্বীকার করিলে কোন দোষ ঘটে না।
উত্তর –তোমার এই দৃষ্টান্তও সত্য নহে। কারণ যদি সর্বব্যাপী ব্রহ্ম অন্তঃকরণে প্রকাশমান। হইয়া জীব হয়, তবে তাহাতে সর্বজ্ঞত্বাদি গুণ থাকে কি না? যদি বল যে আবরণ বশতঃ সর্বজ্ঞতা। থাকে না, তবে বল ব্ৰহ্ম কি আবৃত না খণ্ডিত, অথবা অখণ্ডিত? যদি বল যে, ব্রহ্ম অখণ্ডিত; তাহা হইলে তাহার মধ্যে কোন আবরণ আরোপিত হইতে পারে না। আবরণ না থাকিলে, সর্বজ্ঞতা থাকিবে না কেন?
যদি বল যে ব্রহ্ম তাঁহার স্বরূপ বিস্মৃত হইয়া অন্তঃকরণের সহিত চলমানবৎ হয়, স্বরূপতঃ নহে। যখন ব্রহ্ম স্বয়ং চলমান নহেন, অন্তঃকরণ পূর্বপ্রাপ্ত যে যে স্থান পরিত্যাগ করিবে এবং যে
যে স্থানে অগ্রসর হইতে থাকিবে, সে সে স্থানের ব্রহ্ম ভ্রান্ত ও অজ্ঞান হইয়া পড়িবে। আর যে সকল স্থান পরিত্যক্ত হইবে, সে সকল স্থানের ব্রহ্ম জ্ঞানী, পবিত্র এবং মুক্ত হইতে থাকিবে। এইরূপে অন্তঃকরণ,সৃষ্টির সর্বত্র ব্রহ্মকে বিকৃত করিবে এবং বন্ধ এবং মুক্তিও ক্ষণে ক্ষণে হইতে থাকিবে। তোমার কথিত প্রমাণ অনুসারে ঐরূপ হইলে কোন জীবের পূর্বদৃষ্ট ও শ্রুত বিষয়ের স্মরণ হইত না। কারণ যে ব্রহ্ম দেখিয়াছিল, সেই ব্রহ্ম থাকিল না অতএব ব্রহ্ম ও জীব, জীব ও ব্রহ্ম, কখনও এক নহে, সর্বদা পৃথক পৃথক্ ॥
এই সমস্ত অধ্যারোপ মাত্র। অর্থাৎ এক বস্তুতে অন্য বস্তু স্থাপন করাকে ‘অধ্যারোপ’ বলে। ব্রহ্মবস্তুতে সমস্ত জগৎ ও তাহার ব্যবহারের অধ্যারোপ করিয়া জিজ্ঞাসুকে বুঝান হইয়া থাকে, বস্তুতঃ সমস্তই ব্রহ্ম।
প্রশ্ন –অধ্যারোপ করায় কে?
উত্তর –জীব।
প্রশ্ন –জীব কাহাকে বলে?
উত্তর –অন্তঃকরণাবচ্ছিন্ন চেতনকে।
প্রশ্ন –অন্তঃকরণবিচ্ছিন্ন চেতন কি অন্য, না উহাই ব্রহ্ম?
উত্তর –উহাই ব্রহ্ম।
প্রশ্ন –তবে কি ব্রহ্মই নিজের মধ্যে জগতের মিথ্যা কল্পনা করিলেন?
উত্তর –ব্রহ্মের ইহাতে ক্ষতি কী?
প্রশ্ন –মিথ্যা কল্পনাকারী কি মিথ্যাবাদী হয় না?
উত্তর –না। কারণ যাহা মন ও বাণী দ্বারা কল্পিত অথবা কথিত হয়, সে সমস্ত মিথ্যা।
প্রশ্ন –আবার মন ও বাণী দ্বারা মিথ্যাবাদী ব্রহ্ম, কল্পিত ও মিথ্যাবাদী হইল কিনা?
উত্তর –হউক। আমাদের ইষ্টাপত্তি আছে।
চমৎকার! মিথ্যাবাদী বেদান্তিগণ! তোমরা সত্যস্বরূপ, সতাকাম এবং সত্যসংস্কল্প পরমাত্মাকে মিথ্যাচারী করিলে! ইহা কি তোমাদের দুর্গতির কারণ নহে? কোন্ উপনিষদে সূত্রগ্রন্থে অথবা বেদে লিখিত আছে যে, পরমেশ্বর মিথ্যাসঙ্কল্পকারী ও মিথ্যাবাদী? তোমাদের কথা যেন ‘উল্টা চোর কোতবালকো দণ্ডে’, অর্থাৎ চোরের কোতবালকে দণ্ড দিবার কাহিনীর ন্যায়। দারোগা চোরকে দণ্ড দিবে ইহাই ত উচিত, কিন্তু চোর দারোগাকে দণ্ড দেওয়া বিপরীত কথা। সেইরূপ তোমরা মিথ্যা সঙ্কল্পকারী ও মিথ্যাবাদী হইয়া তোমাদের দোষ ব্রহ্মে বৃথা আরোপ করিতেছ।
ব্রহ্ম মিথ্যাজ্ঞানী, মিথ্যাবাদী এবং মিথ্যাকারী হইলে সমস্ত অনন্ত ব্রহ্ম সেইরূপই হইয়া পড়িবে। কেননা ব্রহ্ম এক রস,সত্যস্বরূপ, সত্যমানী সত্যবাদী এবং সত্যকারী। পূর্বোক্ত দোষগুলি তোমাদের ব্রহ্মের নহে।
তোমরা যাহাকে বিদ্যা বলিতেছ উহা অবিদ্যা। আর, তোমাদের অধ্যারোপও মিথ্যা। কারণ, তোমরা স্বয়ং ব্রহ্ম না হইয়া নিজেদের ব্রহ্ম এবং ব্রহ্মকে জীব মনে করিতেছ। ইহা মিথ্যাজ্ঞান নয় তো কী? যিনি সর্বব্যাপক তিনি কখনও পরিচ্ছিন্ন ও অজ্ঞান হন না এবং কখনও বন্ধনেও আবদ্ধ হন না। কারণ জীবই অজ্ঞান, পরিচ্ছন্ন, একদেশী, অল্প এবং অল্পজ্ঞ; সর্বজ্ঞ এবং সর্বব্যাপী ব্রহ্ম সেইরূপ নহেন।
[ মুক্তি বন্ধন বিষয়ে বিচার ]
প্রশ্ন –মুক্তি কাহাকে বলে?
উত্তর –’মুঞ্চন্তি পৃথগ্ভবন্তি জনা য়স্যাং সা মুক্তিঃ।’ যাহা হইতে মুক্ত হওয়া যায় তাহার নাম মুক্তি।
প্রশ্ন –কী হইতে মুক্ত হওয়া?
উত্তর –সকল জীব যাহা হইতে মুক্ত হইতে ইচ্ছা করে।
প্রশ্ন –কী হইতে মুক্ত হইতে ইচ্ছা করে?
উত্তর –যাহা হইতে মুক্ত হইতে চায়।
প্রশ্ন –কী হইতে মুক্ত হইতে চায়?
উত্তর –দুঃখ হইতে।
প্রশ্ন –মুক্ত হইয়া কাহাকে লাভ করে এবং কোথায় থাকে?
উত্তর –সুখ লাভ করে এবং ব্রহ্মে থাকে।
প্রশ্ন –কী কী কর্ম করিলে মুক্তি এবং কী কী কর্ম করিলে বন্ধ হয়?
উত্তর –পরমেশ্বরের আজ্ঞা পালন; অধর্ম, অবিদ্যা, কুসঙ্গ, কুসংস্কার, মন্দ অভ্যাস। পরিত্যাগ ও সত্যভাষণ, পরোপকার, বিদ্যা, পক্ষপাতরহিত ন্যায়, ধর্মের বৃদ্ধি করা; পূর্বোক্ত প্রকারে পরমেশ্বরের, স্তুতি, প্রার্থনা ও উপাসনা অর্থাৎ যোগাভ্যাস করা; বিদ্যা অধ্যয়ন-অধ্যাপন এবং ধর্ম পূর্বক পুরুষাৰ্থ করিয়া জ্ঞানের উন্নতি করা, সর্বোত্তম সাধন করা এবং যাহা কিছু করা। হউক না কেন, তাহা সব পক্ষপাতরহিত ন্যায়ধর্মানুসারেই করা। ইত্যাদি সাধন দ্বারা মুক্তি এবং ইহার বিপরীত ঈশ্বরাজ্ঞা ভঙ্গ করা ইত্যাদি কর্ম বন্ধের কারণ হইয়া থাকে।
প্রশ্ন –মুক্তিতে জীবের লয় হয়? না, জীব বিদ্যমান থাকে।
উত্তর –বিদ্যমান থাকে।
প্রশ্ন– কোথায় থাকে?
উত্তর –ব্রহ্মে।
প্রশ্ন –ব্রহ্ম কোথায় আছেন? মুক্ত জীব কি একস্থানে থাকে অথবা স্বেচ্ছাচারী হইয়া সর্বত্র। বিচরণ করে?
উত্তর –ব্রহ্ম সর্বত্র, পূর্ণ, মুক্ত জীবের তাহাতে অব্যাহতগতি অর্থাৎ কোন স্থানে তাহার বাধা থাকে না এবং সে বিজ্ঞান ও আনন্দপূর্ণ হইয়া স্বাধীনভাবে বিচরণ করে।
প্রশ্ন –মুক্ত জীবের স্থূল শরীর থাকে কিনা?
উত্তর –থাকে না।
প্রশ্ন –সুখ ও আনন্দ কীরূপে ভোগ করে?
উত্তর –মুক্ত জীবের সত্যসঙ্কল্প প্রভৃতি স্বাভাবিক গুণ ও সামর্থ্য থাকে, ভৌতিক সঙ্গ থাকে না। যথা—
শৃণ্বন্ শ্রোত্রংভবতি, স্পর্শয়ত্বভবতি, চক্ষুৰ্ভবতি, পশ্যন্সয়ন্রসনা ভবতি, জিম্রাণং ভবতি, মনে মনে ভবতি, বোধয় বুদ্ধির্ভবতি, চেতয়শ্চিত্তম্ভবত্যহঙ্কুর্বাণোহঙ্কারো ভবতি ॥ শতপথ কাং ১৪
মোক্ষে জীবাত্মার সঙ্গে ভৌতিক শরীর অথবা ইন্দ্রিয় গোলক থাকে না কিন্তু তাহার স্বাভাবিক শুদ্ধ গুণ থাকে। মুক্তি অবস্থায় জীবাত্মা শুনিতে ইচ্ছা করিলে স্বশক্তি দ্বারাই শ্রোত্র, স্পর্শ করিতে ইচ্ছা করিলে ত্বক, দেখিবার সংকল্প হইলে চক্ষু, স্বাদ গ্রহণের জন্য ঘ্রাণ, সংকল্প বিকল্প করিবার জন্য মন, নিশ্চয় করিবার জন্য বুদ্ধি, স্মরণ করিবার জন্য চিত্ত, অহংবুদ্ধির জন্য অহঙ্কার এবং সংকল্পমাত্র শরীর হইয়া থাকে। শরীরের আধারে থাকিয়া জীব যেমন ইন্দ্রিয়গোলকের দ্বারা স্বকাৰ্য্য। সিদ্ধ করে সেইরূপ মুক্তি অবস্থায় স্বশক্তি দ্বারা সমস্ত আনন্দ ভোগ করে।
প্রশ্ন –জীবাত্মার শক্তি কত প্রকারের এবং কী পরিমাণ?
উত্তর –মুখ্য শক্তি এক প্রকার। কিন্তু বল, পরাক্রম, আকর্ষণ, প্রেরণা, গতি, ভীষণ, বিবেচন ক্রিয়া, উৎসাহ, স্মরণ, নিশ্চয়, ইচ্ছা, প্রেম, দ্বেষ, সংযোগ,বিভাগ, সংযোজক, বিভাজক, শ্রবণ, স্পর্শন, দর্শন, আস্বাদন, গন্ধ গ্রহণ তথা জ্ঞান–এই (২৪) চতুর্বিংশ প্রকার সামর্থযুক্ত জীব। জীব ইহার দ্বারা মুক্তি অবস্থাতেও আনন্দ ভোগ করিয়া থাকে।
মুক্তির সঙ্গে জীবের লয় হইলে, মুক্তিসুখ কে ভোগ করিত? জীবের নাশকেই যে মুক্তি মনে করে সে মহামূর্খ। কারণ জীবের পক্ষে দুঃখ বিমুক্ত হইয়া আনন্দস্বরূপ, সর্বব্যাপক এবং অনন্ত পরমেশ্বরের সানন্দে অবস্থান করাই মুক্তি। দেখ বেদান্ত শারীরক সূত্রেঃ
অভাবং বাদরিরাহ হ্যেব ॥
ব্যাসদেবের পিতা যিনি বাদরি তিনি মুক্তি অবস্থায় জীবের সহিত মনের বিদ্যমানতা স্বীকার করেন। অর্থাৎ মুক্তিতে পরাশর জীবের এবং মনের লয় স্বীকার করেন না। সেইরূপ —
ভাবং জৈমিনির্বিকল্লামননাৎ ॥
আচাৰ্য জৈমিনি মুক্ত অবস্থায় জীবের মনের ন্যায় সূক্ষ্মশরীর, ইন্দ্রিয় এবং প্রাণ প্রভৃতিরও বিদ্যমানতা স্বীকার করেন, অভাব স্বীকার করেন না।
দ্বাদশাহবদুভয়বিধংবাদরায়নোতঃ ॥
ব্যাসমুনি মুক্তি অবস্থায় ভাব ও অভাব উভয়ই স্বীকার করেন। অর্থাৎ তখন শুদ্ধসামর্থযুক্ত জীব বিদ্যমান থাকে; অপবিত্রতা, পাপাঁচরণ, দুঃখ এবং অজ্ঞানাদির অভাব স্বীকার করেন।
য়দা পঞ্চাবতিষ্ঠন্তে জ্ঞানানি মনসা সহ। বুদ্ধিশ্চ ন বিচেষ্টতে তমাহুঃ পরমাং গতিম্ ॥ কঠ উপনিষদের বচন।
যখন জীবের সহিত শুদ্ধ মনযুক্ত পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় বিদ্যমান থাকে এবং বুদ্ধি স্থির নিশ্চয় হয়, সেই অবস্থাকে পরমগতি অর্থাৎ ‘মোক্ষ’ বলে।
য় আত্মা অপহতপামা বিজরো বিমৃত্যুার্বিশোয়কো বিজিঘৎসোপিপাসঃ সত্যকামঃ সত্যসঙ্কল্পঃ সোয়ন্বেষ্টব্যঃ স বিজিজ্ঞাসিতব্য সর্বাংশ্চ লোকানাপোতি সর্বাংশ্চ কামান্ য়স্তমাত্মানমনুবিদ্য বিজানাতীতি। ছান্দো ॥
স বা এষ এতেন দৈবেন চক্ষুষা মনসৈন্ কামান পশ্য রমতে ॥ ছান্দো ॥
য় এতে ব্রহ্মলোকে তং বা এতং দেবা আত্মানমুপাসতে তস্মাত্তেওঁ সর্বে চ লোকা আত্তাঃ সর্বে চ কামাঃ স সর্বাংশ্চ লোকানাপ্নোতি সর্বাংশ্চ কামান্ য়স্তমাত্মানমনুবিদ্য বিজানাতীতি ॥ ছান্দো ॥
মঘবৰ্মং বাইদওঁশরীরমাত্তংমৃত্যুনা তদস্যামৃতস্যা শরীরস্যাত্মনো ধিষ্ঠানমাত্তো বৈ সশরীরঃ প্রিয়াপ্রিয়াভ্যাং ন বৈ সশরীরস্য সতঃ প্রিয়াপ্রিয়য়োরপহতিরস্ত্যশরীরং বাব সন্তং ন প্রিয়াপ্রিয়ে শ্বশতঃ ॥ ছান্দো ॥
যে পরমাত্মা অপহতপাপমা; সর্ব-পাপ-জরা-মৃত্য-শোক-ক্ষুধাপিপাসা রহিত, যিনি সত্যকাম, সত্যসংকল্প তাঁহার অনুসন্ধান করা, তাঁহাকে জানিবার ইচ্ছা করা কর্তব্য। সেই পরমাত্মার সহিত সম্বন্ধযুক্ত হইয়া মুক্তজীব সমস্ত লোক ও সমস্ত কামনা প্রাপ্ত হন। যিনি পরমাত্মাকে জানিয়া মোক্ষ সাধন করিতে এবং নিজেকে শুদ্ধ করিতে জানেন, সেই মুক্ত জীব শুদ্ধ দিব্য নেএ ও শুদ্ধ মন দ্বারা কামনা সমূহ প্রত্যক্ষ করেন এবং ঐ সকল প্রাপ্ত হইয়া আনন্দে বিচরণ করেন।
তিনিব্রহ্মলোকে অর্থাৎ দর্শনীয় পরমাত্মায় স্থির থাকিয়া মোক্ষসুখ ভোগ করেন। মুমুক্ষুবিদ্বান্ব্যক্তিরা সেই সর্বান্তর্যামী পরমাত্মারই উপাসনা করিতে থাকেন। তদ্বারা তাহারা সর্বলোক ও সর্বকাম প্রাপ্ত হন। অর্থাৎ যাহা যাহা সংকল্প করেন সেই সেই কাম্য পদার্থ হন। সেই মুক্ত জীবগণ স্থূল শরীর পরিত্যাগ করিয়া সংকল্পময় শরীর দ্বারা আকাশে পরমেশ্বরে বিচরণ করেন। কেননা, যিনি শরীরধারী তিনি সাংসারিক দুঃখরহিত হইতে পারেন না।
যেরূপ প্রজাপতি ইন্দ্রকে বলিয়াছিলেন,–“হে পরমপুজিত ঐশ্বৰ্য্যশালী পুরুষ। এই স্থূল শরীর মরণধর্মী। সিংহের মুখে ছাগীর ন্যায় এই শরীর মৃত্যুর মুখে অবস্থিত। এই শরীর মরণ ও শরীর রহিত জীবাত্মার নিবাস স্থান। এইজন্য জীব সর্বদা সুখ ও দুঃখগ্রস্ত থাকে। কেননা, শরীরধারী জীবের সাংসারিক সুখের নিবৃত্তি ঘটে এবং যে শরীর রহিত মুক্ত জীবাত্মা ব্রহ্মে অবস্থান করে, সাংসারিক সুখ দুঃখ তাহাকে স্পর্শ করে না, কিন্তু সে সর্বদা আনন্দে থাকে”।
প্রশ্ন –জীব মুক্তিপ্রাপ্ত হইয়া পুনরায় কখনও জন্ম মরণ রূপ দুঃখে পতিত হয় কিনা? কারণ : ‘ন চ পুনরাবৰ্ত্ততে ন চ পুনরাবৰ্ত্ততে ইতি ॥ উপনিষদ্বচন ॥
অনাবৃত্তিঃ শব্দানাবৃত্তিঃ শব্দাৎ ॥ শারীরক সূত্র ॥ য় গত্বা ন নিবৰ্ত্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম ॥ ভগবদ্গীতা ॥ ইত্যাদি বচন হইতে জানা যায় যে,যে অবস্থা হইতে জীব পুনরায় কখনও সংসারে প্রত্যাবর্তন। করে না, তাহার নাম মুক্তি।
উত্তর— একথা ঠিক নহে। কারণ, বেদে ইহা নিষেধ করা আছে। যথা : কস্য নূনং কতমস্যামৃতানাং মনামহে চারু দেবস্য নাম।
কো না মহ্যাঁ অদিতয়ে পুনর্দাৎ পিতরং চ দৃশেয়ং মাতরং চ ॥ ১
অগ্নের্বয়ং প্রথমস্যামৃতানাং মনামহে চারু দেবস্য নাম। স নো মহ্যাঁ অদিয়ে পুনর্দাৎ পিতরং চ দৃশেয়ং মাতরং চ ॥২॥ ঋ০ম০ ১ ॥ ২৪ ॥ ১-২ ॥ ইদানীমিব সর্বত্র নাত্যন্তোচ্ছেদঃ ॥ ৩॥ । সাংখ্য সূত্র।
প্রশ্ন— আমরা কাহার নাম পবিত্র বলিয়া জানিব? অবিনাশী পদার্থ সমূহের মধ্যে বিদ্যমান, চিরপ্রকাশরূপ কোন্ দেব আমাদের সকলকে মুক্তি সুখ ভোগ করাইয়া, পুনরায় এই সংসারে জন্মদান করেন এবং পিতৃমাতৃ-দর্শন করান ॥১॥
উত্তর– আমরা এই স্বপ্রকাশ স্বরূপ, অনাদি এবং সদামুক্ত পরমাত্মার নাম পবিত্র বলিয়া জানিব। তিনি আমাদের সম্পর্কে মুক্তিতে আনন্দ ভোগ করাইয়া পুনরায় মাতাপিতার সংযোগে জন্মদান করাইয়া তাহাদের দর্শন করান। সেই পরমাত্মাই মুক্তিবিধাতা এবং সকলের অধিপতি ॥২॥
বর্তমানে যেরূপ বদ্ধ ও মুক্ত স্বভাব জীব আছে, সেইরূপ সর্বদাই থাকে। বন্ধন ও মুক্তির অত্যন্তবিচ্ছেদ কখনও হয় না। আবার বন্ধন ও মুক্তি সর্বদা থাকে না ৷৩ ॥
প্রশ্ন– ‘তদত্যন্তবিমোক্ষোউপবর্গঃ ॥ দুঃখজন্মপ্রবৃত্তিদোষমিথ্যাজ্ঞানানামুত্তরোত্তরাপায়ে তদন্তরাপায়াদপবর্গঃ। ন্যায় সূত্র ॥ দুঃখের অত্যন্ত বিচ্ছেদকে ‘মুক্তি’ বলে। কেননা, মিথ্যা জ্ঞান-অবিদ্যা, লোভাদি দোষ তা বিষয় দুষ্ট ব্যসনে প্রবৃত্তি, জন্ম ও দুঃখের উত্তরোত্তর অবসানে পূর্ব পূর্বের হইতে নিবৃত্তি হইলেই মোক্ষ হইয়া থাকে এবং উহা সর্বদা বিদ্যমান থাকে।
উত্তর— ইহা আবশ্যক নহে যে, ‘অত্যন্ত’ শব্দের অর্থ অত্যন্তাভাবই হইবে। যেমন, “অত্যন্তং দুঃখমত্যন্তং সুখং চাস্য বৰ্ত্ততে”,– এই ব্যক্তির অত্যন্ত দুঃখ এবং অত্যন্ত সুখ। ইহা দ্বারা জানা যায় যে, ইহার অনেক দুঃখ এবং অনেক সুখ। সেইরূপ এস্থলেও ‘অত্যন্ত’ শব্দের অর্থ বুঝিতে হইবে।
প্রশ্ন—- যদি মুক্তি হইতেও জীব পুনরায় ফিরিয়া আসে তাহা হইলে সে কতকাল পৰ্য্যন্ত মুক্তি অবস্থায় থাকে?
উত্তর –তে ব্রহ্মলোকে হ পরান্তকালে পরামৃতাৎ পরিমুচ্যন্তি সর্বে ॥
ইহা মুণ্ডক উপনিষদের বচন। মুক্ত জীবন লাভ করিয়া মুক্ত অবস্থায় ব্রহ্মের আনন্দ ভোগ করে এবং পুনরায় মহাকল্পের পর মুক্তিসুখ ত্যাগ করিয়া সংসারে প্রত্যাগমন করে ॥
মহাকল্পের গণনা এইরূপ — তেতাল্লিশ লক্ষ, বিংশ সহস্র বৎসরে এক চতুর্যগী; দুই সহস্র চতুর্যগীতে এক অহোরাত্র; এইরূপ ত্রিংশ অহোরাত্রিতে এক মাস; এইরূপ বারমাসে এক বৎসর এবং এইরূপ শত বৎসরে এ পরান্তকাল হইয়া থাকে। ইহা গণিতের নিয়মানুসারে সম্যক্ রূপে লইবে। মুক্তিসুখ ভেগের পরিমাণ কাল এইরূপ।
প্রশ্ন –সমস্ত সংসারের তথা সকল গ্রন্থকারের মত এই যে, জীব মুক্তি হইতে প্রত্যাবর্তন করিয়া পুনরায় কখনও জন্ম-মরণ গ্রস্ত হয় না।
উত্তর –ইহা কখনও হইতে পারে না। কারণ প্রথমতঃ জীবের সামর্থ্য ও দেহাদির সাধন পরিমিত। সুতরাং ঐ সকলের ফল অনন্ত কীরূপে হইতে পারে? জীবের অসীম সামর্থ্য, কর্ম এবং সাধন নাই। এই কারণে জীব অনন্ত সুখ ভোগ করিতে পারে না। যাহাদের সাধন অনিত্য, তাহাদের ফল নিত্য হইতে পারে না। আবার, যদি কেহই মুক্তি হইতে প্রত্যাবর্তন না করে, তবে সংসারে উচ্ছেদ ঘটিবে অর্থাৎ জীব নিঃশেষ হইবে।
প্রশ্ন –যত সংখ্যক জীব মুক্ত হয়, ঈশ্বর ততসংখ্যক নূতন জীব উৎপন্ন করিয়া সংসারে আনয়ন করেন বলিয়া জীব নিঃশেষিত হয় না।
উত্তর –তাহা হইলে জীব অনিত্য হইয়া পড়ে। কারণ যাহার উৎপত্তি হয়, তাহার বিনাশও হয়। এমতাবস্থায় আপনার মতানুসারে জীব মুক্তি পাইয়াও বিনষ্ট হইবে। সুতরাং মুক্তি অনিত্য হইয়া পড়িবে। আর মুক্তির স্থানে অনেক ভীড় হইবে। কেননা, সে স্থানে আয় অধিক আর ব্যয় কিছুই না হওয়াতে বৃদ্ধির সীমার পরিসীমা থাকিবে না।
আবার দুঃখানুভব ব্যতীত সুখানুভব হইতে পারে না। যেরূপ কটু না থাকিলে কাহাকে মধুর বলা যাইবে? আর মধুর না থাকিলে কটু বা কাহাকে বলা যাইবে? প্রথমতঃ স্বাদ ও দ্বিতীয়তঃ রসের বিরুদ্ধ হওয়ায় উভয়ের পরীক্ষা হইয়া থাকে। যদি কেহ কেবল মিষ্ট-মধুর দ্রব্যই পানভোজন করিতে থাকে, তাহা হইলে সকল প্রকার রসভোগীর ন্যায় তাহার সুখানুভব হয় না।
আবার যদি ঈশ্বর সান্ত কর্মের অনন্ত ফল দান করেন, তবে তাহার ন্যায়শীলতা নষ্ট হইবে। যে ব্যক্তি যে পরিমাণ ভার উত্তোলন করিতে পারে, তাহার উপর সেই পরিমাণ ভার ন্যস্ত করা বুদ্ধিমানের কর্তব্য। যে ব্যক্তি এক মণ ভার উত্তোলন করিতে পারে, তাহার মস্তকের উপর দশ মন ভার চাপাইয়া দিলে এমন ভারাপণকারীর নিন্দা হইয়া থাকে, সেইরপ অল্পজ্ঞ ও অল্পসামর্থ্য বিশিষ্ট জীবের উপর অনন্ত সুখের ভারাপণ করান ঈশ্বরের পক্ষে উচিত কাৰ্য্য নহে।
আবার যদি পরমেশ্বর নূতন নূতন জীব সৃষ্টি করেন, তাহা হইলে যে কারণ হইতে সৃষ্টি হয়, উহা নিঃশেষ হইবে। কেননা, কোন ধনভাণ্ডার সে যত বিশাল হউক না কেন, যদি ইহাতে কেবল । ব্যয়ই হইতে থাকে, কিন্তু আয় না হয়, এক সময় না এক সময়, উহা নিঃশেষ হইবেই। সুতরাং মুক্তি হইতে প্রত্যাগমন করা–এই ব্যবস্থাই ঠিক। স্বল্পমেয়াদী কারাদণ্ডভোগকারী অপরাধী কি আজন্ম কারাদণ্ড ভোগ করাকে অথবা ফাঁসিকে ভাল মনে করে? মুক্তি হইতে প্রত্যাবর্তন না। থাকিলে, আজীবন কারাগারের সহিত মুক্তির প্রভেদ এই যে, মুক্তিতে বাধ্যতামূলক পরিশ্রম নাই। আর ব্রহ্মে লয় হওয়া সমুদ্রে ডুবিয়া মরার ন্যায় হইবে।
প্রশ্ন– পরমেশ্বরের ন্যায় জীব নিত্যমুক্ত ও পূর্ণসুখী হইলে কোন দোষ ঘটিবে না।
উত্তর– পরমেশ্বর অনন্ত স্বরূপ। তাহার গুণ-কর্ম-স্বভাব ও সামর্থ্য অনন্ত। এই কারণে তিনি কখনও অবিদ্যা ও দুঃখবন্ধনে পতিত হয় না। জীব মুক্ত হইয়াও শুদ্ধস্বরূপ, অল্পজ্ঞ ও পরিমিত গুণ-কর্মস্বভাববিশিষ্ট থাকে। জীব কখনও পরমেশ্বরের সমান হয় না।
প্রশ্ন –যদি এইরূপই হয় তাহা হইলে মুক্তি ও জন্ম মরণ সদৃশ। অতএব শ্রম করা বৃথা।
উত্তর –মুক্তি জন্ম-মরণ সদৃশ নহে। কেননা (৩৬০০০) ছত্রিশ সহস্রবার সৃষ্টি ও প্রলয় হইতে যে পরিমাণ কালের প্রয়োজন হয়, ততকাল পর্যন্ত জীবসমূহের মুক্তির আনন্দে থাকা এবং দুঃখ ভোগ না করা কি সামান্য কথা? যদি আজ পানভোজন করা সত্ত্বেও কাল ক্ষুধা হয়, তাহা হইলে পানভোজনের ব্যবস্থা কর কেন? ক্ষুধা-তৃষ্ণা-সামান্য ধন, রাজ্য প্রতিষ্ঠা, স্ত্রী এবং সন্তানাদির জন্য ব্যবস্থা করার প্রয়োজন থাকিলে মুক্তির জন্য ব্যবস্থা করা প্রয়োজন থাকিবে না কেন? মৃত্যু। অবশ্যম্ভাবী হওয়া সত্ত্বে যেমন জীবন ধারণের উপায় অবলম্বন করা হয়, সেইরূপ মুক্তি হইতে প্রত্যাবর্তন করিয়া জন্মগ্রহণ করিতে হইলেও মুক্তির উপায় অবলম্বন করা নিত্যন্ত আবশ্যক।
প্রশ্ন –মুক্তির সাধন কী কী?
উত্তর –কতকগুলি সাধন সম্বন্ধে পূর্বে লিখিত হইয়াছে। কয়েকটি বিশেষ বিশেষ সাধন এইরূপ। –মুক্তিকামী জীবনমুক্ত হইবে অর্থাৎ মিথ্যাভাষণ প্রভৃতি যাবতীয় পাপ কর্মের ফল যে দুঃখ সে সকল পরিত্যাগ করিবে এবং সুখরূপ ফলদায়ক সত্যভাষণ প্রভৃতি ধর্মাচরণ অবশ্যই করিবে। যিনি দুঃখমোচন ও সুখপ্রাপ্তির ইচ্ছা করিবেন, তাঁহাকে অবশ্যই অধর্ম পরিত্যাগ করিয়া ধর্মাচরণ করিতে হইবে। কারণ পাপাঁচরণ দুঃখের এবং ধর্মাচরণ সুখের মূল কারণ।
সৎ পুরুষের সংসর্গে থাকিয়া ‘বিবেক’ অর্থাৎ সত্যাসত্য, ধর্মাধর্ম এবং কর্তব্য-কর্তব্য নির্ণয় করিবে। এইগুলিকে পৃথক পৃথক্ করিয়া জানিবে। জীব শরীর অর্থাৎ জীবের পঞ্চকোষ সম্বন্ধে বিচার করিবে।
পঞ্চকোষ প্রথম –“অন্নময়। উহা ত্বক হইতে অস্থি পৰ্য্যন্ত সমুদায় পৃথিবীময় বিস্তৃত। দ্বিতীয়–”প্রাণময়’ যাহাতে ‘প্রাণ’ অর্থাৎ যাহা ভিতর হইতে বাহিরে যায়; ‘অপান যাহা বাহির হইতে ভিতরে আসে; সমান’যাহা নাভিস্থ হইয়া সর্বত্র শরীরে রস সঞ্চারিত করে; ‘উদান’, যাহা দ্বারা কণ্ঠস্থ অন্নজল আকৃষ্ট হয় ও বল পরাক্রম বৃদ্ধি পায় এবং ব্যান’যদ্বারা জীব সমস্ত শারীরিক চেষ্টাদি কর্ম করে। তৃতীয় ‘মনোময়। যাহাতে মনের সহিত অহঙ্কার ও পাঁচ কর্মেন্দ্রিয় অর্থাৎ বাক্, পাণি, পাদ, পায়ু এবং উপস্থ থাকে। চতুর্থ–”বিজ্ঞানময়’ যাহাতে বুদ্ধি, চিত্ত এবং শ্রোত্র, ত্ব, নেত্র, জিহ্বা ও নাসিকা–এই পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় থাকে, যদ্বারা জীব জ্ঞানাদি কাৰ্য্য সম্পাদন করে। পঞ্চম –‘আনন্দময়’ যাহাতে প্রীতি, প্রসন্নতা অল্পবিস্তর আনন্দ এবং আধার কারণরূপ প্রকৃতি থাকে। এই পঞ্চকোষ দ্বারা জীব সর্ববিধ জ্ঞান,কর্ম উপাসনা প্রভৃতি জ্ঞানাদি ব্যবহার সম্পাদন করিয়া থাকে।
‘অবস্থা’ ত্রিবিধ–প্রথম ‘জাগৃত’, দ্বিতীয়–‘স্বপ্ন’ এবং তৃতীয় –‘সুষুপ্তি’।
ত্রিবিধ শরীর–প্রথম ‘স্থূল’শরীর যাহা দৃষ্ট হয়, দ্বিতীয় পঞ্চ প্রাণ,পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয় পঞ্চসূক্ষ্মভূত ও মন তথা বুদ্ধি –এই সপ্তদশ তত্ত্বের সমষ্টিকে ‘সূক্ষ্ম শরীর’ বলে। এই সূক্ষ্ম শরীর জীবনে মরণেও জীবের সঙ্গে থাকে। ইহা দ্বিবিধ–প্রথম ভৌতিক অর্থাৎ সূক্ষ্ম ভূতের অংশ দ্বারা নির্মিত। দ্বিতীয়, ‘স্বাভাবিক’ ইহা জীবের স্বাভাবিক গুণস্বরূপ। এই দ্বিতীয় ‘অভৌতিক’ শরীর মুক্তিতে থাকে। ইহা দ্বারাই জীব মুক্তিতে সুখ ভোগ করে। তৃতীয়–‘কারণ’ যাহাতে সুষুপ্তি অর্থাৎ গাঢ় নিদ্রা হয়। উহা প্রাকৃতিকরূপ হওয়ায় সর্বত্র ব্যাপক এবং সকল জীবের পক্ষে একই প্রকার। চতুর্থ –’তুরীয়’ শরীর, যাহাতে জীব সমাধি দ্বারা পরমাত্মার আনন্দস্বরূপে মগ্ন থাকে। এই সমাধি সংস্কারজন্য শুদ্ধ শরীরের পরাক্রম মুক্তিতেও যথাবৎ সহায়করূপে থাকে।
ইহা সকলেই জানে যে, জীব এই সকল কোষ এবং অবস্থা হইতে পৃথক্। কেননা, মৃত্যু হইলে সকলেই বলে যে জীব বাহির হইয়া গেল। এই জীবকেই সকল বিষয়ের প্রেরয়িতা, ধৰ্ত্তা, সাক্ষী এবং ভোক্তা বলা হয়। যদি কেহ বলে যে, জীব কৰ্ত্তা, ভোক্তা নহে, তবে জানিবে যে, সে অজ্ঞ ও বিচার বিবেচনা হীন। কারণ, জীব ব্যতীত জড়পদার্থ সমূহের সুখ দুঃখ ভোগ অথবা পাপ পূণ্যের কর্তৃত্ব অন্য কাহারও হইতে পারে না। অবশ্য এই সকলের সম্বন্ধ বশতঃ জীব পাপ-পুণ্যের কর্তা ও সুখ-দুঃখের ভোক্তা হইয়া থাকে।
যখন ইন্দ্রিয় সমূহ অর্থের সহিত, মন ইন্দ্রিয় সমুহের সহিত এবং আত্মা মনের সহিত যুক্ত হইয়া প্রেরণাদ্বারা প্রাণকে ভাল-মন্দ কর্মে নিয়োজিত করে, তখনই উহা বহির্মুখী হইয়া যায়। তখন ভিতর হইতে আনন্দ, উৎসাহ, অভয় এবং কুকর্মে ভয়, শঙ্কা এবং লজ্জা হয়। ইহা অন্তর্যামী পরমাত্মার শিক্ষা। যিনি এই শিক্ষানুসারে আচরণ করেন, তিনিই মুক্তিজন্য সুখ প্রাপ্ত হন। যিনি বিপরীত আচরণ করেন, তিনি বন্ধজন্য দুঃখ ভোগ করেন।
এইরূপ পৃথিবী হইতে পরমেশ্বর পর্যন্ত পদার্থ সমূহের গুণ-কর্ম-স্বভাব জানিয়া ঈশ্বরের আজ্ঞা পালন করা, উপাসনায় তৎপর থাকা, তাঁহার বিরুদ্ধ আচরণ না করা এবং সৃষ্টি হইতে উপকার গ্রহণ করাকে ‘বিবেক’ বলে।
মুক্তির দ্বিতীয় সাধন ‘বৈরাগ্য’ অর্থাৎ বিবেক দ্বারা সত্যাসত্য জানা, সত্যাচরণ গ্রহণ এবং অসত্যাচরণ বর্জন করাকে ‘বৈরাগ্য বলে।
অতঃপর মুক্তির তৃতীয় সাধন ‘যটক সম্পত্তি’, অর্থাৎ ষড়বিধ কর্মানুষ্ঠান।
প্রথম শম’–নিজ আত্মাকে অন্তঃকরণের সহিত অধর্মাচরণ হইতে নিবৃত্ত করিয়া সর্বদা ধর্মাচরণে নিযুক্ত রাখা।
দ্বিতীয় ‘দম’ শ্ৰোত্রাদি ইন্দ্রিয় সমূহ এবং শরীরকে ব্যভিচারাদি কুকর্ম হইতে নিবৃত্ত করিয়া জিতেন্দ্রিয় থাকা ও এইরূপ শুভকর্মে প্রবৃত্ত থাকা।
তৃতীয় ‘উপরতি’ অর্থাৎ দুষ্কর্মকারীদের সংসর্গ হইতে সর্বদা দুরে থাকা।
চতুর্থ –“তিতিক্ষা’, নিন্দা, স্তুতি, হানি, লাভ যতই হউক না কেন, হর্ষ-শোক পরিত্যাগ করিয়া সর্বদা মুক্তিসাধনে তৎপর থাকা।
পঞ্চম –শ্রদ্ধা বেদাদি সত্যশাস্ত্র ও ইহার জ্ঞান দ্বারা পূর্ণ আপ্ত বিদ্বান্ এবং সত্যোপদেষ্টা মহাত্মাদিগের বাক্যে বিশ্বাস করা।
যষ্ঠ –‘সমাধান’ চিত্তের একাগ্রতা। এই ছয়টি মিলিয়া তৃতীয় সাধন নামে প্রসিদ্ধ।
চতুর্থ (সাধন) মুমুক্ষুত্ব’–অর্থাৎ ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্তের যেমন অন্নজল ব্যতীত অপর কিছুই ভাল লাগে না, সেইরূপ মুক্তিসাধন ও মুক্তি ব্যতীত কিছুতেই প্রীতি না রাখা। এই চতুর্থ সাধন।
অতঃপর চারি অনুবন্ধ’, অর্থাৎ সাধনের পর এইগুলি অনুষ্ঠান কর্ম।
(প্রথম ‘অধিকারী’–) ইহাদের মধ্যে যিনি এই চতুর্বিধ সাধনাযুক্ত পুরুষ তিনিই মোক্ষের ‘অধিকারী’ হইয়া থাকেন।
দ্বিতীয় ‘সম্বন্ধ’–ব্রহ্মপ্রাপ্তিরূপ মুক্তিপ্রতিপাদ্য এবং বেদাদি শাস্ত্র প্রতিপাদক–এই দুইটিকে সম্যকরূপে বুঝিয়া অন্বিত করা।
তৃতীয় বিষয়ী’ –সকল শাস্ত্রের প্রতিপাদ্য বিষয় ব্রহ্ম বিষয় বিশিষ্ট পুরুষের নাম ‘বিষয়ী।
চতুর্থ প্রয়োজন’ –সমস্ত দুঃখনিবৃত্তির পর পরমানন্দ প্রাপ্ত হইয়া সুখ ভোগ করা। এগুলিকে ‘অনুবদ্ধ চতুষ্টয়’ বলে।
তদন্তর শ্রবণ চতুষ্টয়’–প্রথম ‘শ্রবণ’–যখন কোন বিদ্বান ব্যক্তি উপদেশ দান করেন, তখন শান্তভাবে মনোনিবেশ সহকারে উহাশ্রবণ করা। বিশেষতঃ ব্রহ্মবিদ্যাশ্রবণে অত্যন্ত মনোযোগী হওয়া আবশ্যক। কারণ, সকল বিদ্যার মধ্যে ব্রহ্মবিদ্যা সূক্ষ্ম ॥
শ্রবণের পর দ্বিতীয় –মনন’ অর্থাৎ নির্জন স্থানে উপবেশন করিয়া শ্রুতবিষয় সম্বন্ধে বিচার বিবেচনা করা। যে বিষয়ে সংশয় হয়, তাহা পুনরায় জিজ্ঞাসা করা এবং শ্রবণকালে বক্তা ও শ্রোতা উচিত মনে করিলে জিজ্ঞাসা ও সমাধান করা।
তৃতীয় –”নিদিধ্যাসন’শ্রবণ-মনন পূর্বক নিঃসন্দেহ হইবার পর সমাধিস্থ এবং যাহা শ্রবণ-মনন করা হইয়াছে,তাহা ধ্যানযোগে প্রত্যক্ষ উপলব্ধি করা এবং যাহা শ্রবণ-মনন করা হইয়াছে, উহা সেইরূপ কিনা জানা ॥
চতুর্থ –সাক্ষাৎকার’ অর্থাৎ পদার্থের গুণ-কর্ম-স্বভাব যথার্থরূপে জানা। এই চারিটিকে ‘শ্রবণ চতুষ্টয়’ বলে।
সদা তমোগুণ’= অর্থাৎ ক্রোধ, মলিনতা, আলস্যপ্রমাদ প্রভৃতি; রজোগুণ’ = অর্থাৎ ঈষ্যা, দ্বেষ, কাম, অভিমান ও বিক্ষেপাদি দোষ হইতে সদা দূরে থাকিয়া, ‘সত্ত্ব’ = অর্থাৎ শান্ত প্রকৃতি, পবিত্রতা, বিদ্যা-বিচার প্রভৃতি ধারণ করিবে।’মৈত্রী’ = সুখীজনের সহিত মিত্রতা, করুণা’=দুঃখী জনে দয়া করিবে, মুদিতা’ = পুণ্যাত্মাদর্শনে আনন্দিত হইবে। উপেক্ষা = দুষ্টাত্মাদিগের প্রতি প্রীতি প্রদর্শন বা বৈরভাবও পোষণ করিবে না। মুমুক্ষু প্রত্যহ ন্যূনকল্পে দুই ঘন্টাকাল অবশ্য ধ্যান করিবে। তদ্বারা অভ্যন্তরস্থ মন প্রভৃতি পদার্থ প্রত্যক্ষ হইয়া থাকে।
দেখ! জীব চেতন বলিয়া জ্ঞানস্বরূপ এবং মনের সাক্ষী। কারণ যখন মন শান্ত, চঞ্চল, প্রফুল্ল। অথবা বিষাদযুক্ত হয়, তখন জীব তাহাকে যথার্থরূপে দর্শন করে। সেইরূপ জীব ইন্দ্রিয় ও প্রাণ প্রভৃতির জ্ঞাতা, পূর্বদৃষ্টবিষয়ের স্মরণকর্তা, এবং একই সময়ে অনেক পদার্থের বেত্তা, ধারণ ও আকর্ষণ কর্তা; এবং সমস্ত পদার্থ হইতে পৃথক্। পৃথক্ না হইলে এই সকলের স্বতন্ত্র কৰ্ত্তা, প্রেরক এবং অধিষ্ঠাতা হইতে পারিত না।
অবিদ্যাচস্মিতারাগদ্বেষাভিনিবেশাঃ পঞ্চ ক্লেশা ॥ যোগশাস্ত্রে পাদ ২। সূ০ ৩ ॥
এই সকলের মধ্যে অবিদ্যার স্বরূপ পূর্বে কথিত হইয়াছে। পৃথক্ বৰ্ত্তমান বুদ্ধিকে আত্মা হইতে পৃথক্ মনে না করা ‘অস্মিতা। সুখে প্রীতির নাম ‘রাগ’, দুঃখে অপ্রীতির নাম ‘দ্বেষ। প্রাণীমাত্রেই এই ইচ্ছা সদা থাকে সে সর্বদা এই শরীরেই থাকি, আমি যেন কখনও না মরি। মৃত্যুদুঃখ হইতে যে ত্রাস হয়, তাহাকে ‘অভিনিবেশ’ বলে। যোগাভ্যাস এবং বিজ্ঞান দ্বারা এই ‘পঞ্চক্লেশ’ দূর করিয়া ব্রহ্মকে লাভ করিয়া মুক্তির পরমানন্দ উপভোগ করা উচিত।
প্রশ্ন –আপনি যেরূপ মুক্তি মানেন, অন্য কেহ সেইরূপ মানে না। দেখুন! জৈনগণ মোক্ষশিলা, বা শিবপুরে যাইয়া চুপচাপ বসিয়া থাকাকে, খৃষ্টানগণ চতুর্থ আকাশ যেখানে বিবাহ, গীতবাদ্য, বস্ত্রাদি ধারণ করিয়া আনন্দভোগ করাকে; তদ্রপ মুসলমানগণ সপ্তম আকাশকে; বামমার্গিগণ শ্রীপুরকে; শৈবগণ কৈলাসকে; বৈষ্ণবগণ বৈকুণ্ঠকে এবং গোকুলের গোঁসাইগণ গোলোকে যাইয়া সুন্দরী স্ত্রী, অন্ন, পানীয় বস্ত্র এবং স্থানাদি লাভ করিয়া আনন্দে থাকাকে মুক্তি মনে করে।
পৌরাণিকগণ (সালোক্য) ঈশ্বরলোকে নিবাস, (সানুজ্য) কনিষ্ঠ ভ্রাতার ন্যায় ঈশ্বরের সহিত থাকা, (সারূপ্য) উপাস্য দেবতার আকৃতিবিশিষ্ট হইয়া যাওয়া, (সামীপ্য) সেবকের ন্যায় ঈশ্বরের সমীপে নিবাস, (সায়ুজ্য) ঈশ্বরের যহিত সংযুক্ত হওয়া, এই চারি (পাঁচ) প্রকারের মুক্তি স্বীকার করেন। বেদান্তিগণ ব্রহ্মে লয় হওয়াকে মোক্ষ বলিয়া জ্ঞান করেন।
উত্তর –দ্বাদশ, ত্রয়োদশ এবং চতুর্দশ সমুল্লাসে যথাক্রমে জৈন, খৃষ্টান এবং মুসলমানদিগের মুক্তি বিষয়ে বিশেষরূপে লিখিত হইবে। বামমার্গিগণ যে শ্রীপুরে লক্ষ্মীর ন্যায় স্ত্রীসম্ভোগ, মদ্য, মাংস ভোজন এবং আমোদ প্রমোদ করাকে মুক্তি মনে করেন, সেখানে ইহলোক অপেক্ষা অধিক কিছুই নাই। সেইরূপ শৈব ও বৈষ্ণবদের মহাদেব ও বিষ্ণুসদৃশ আকৃতি বিশিষ্ট পুরুষের পার্বতী ও লক্ষ্মী সদৃশ স্ত্রীর সহিত আনন্দ সম্ভোগ করা সম্বন্ধে এখানকার ধনাঢ্য ও রাজাদের অপেক্ষা এইমাত্র অধিক লিখিত হইয়াছে যে সে স্থানে রোগ হইবে না এবং চিরযৌবন থাকিবে। তাহাদের এই সকল কথা মিথ্যা। কারণ যে স্থানে ভোগ সে স্থানে রোগ। যে স্থানে রোগ সে স্থানে বার্ধক্য অবশ্যই হয়।
আর পৌরাণিকদের জিজ্ঞাসা করা উচিত যে, তাহাদের যে চারি প্রকারের মুক্তি আছে, তাহা কৃমি, কীট-পতঙ্গ এবং পশ্বাদিগণও স্বাভাবিকরূপে প্রাপ্ত হয় কিনা? সমস্ত লোক ঈশ্বরের এবং সমস্ত জীব তাহাতেই অবস্থান করে। সুতরাং সালোক্য মুক্তি’অনায়াসে (সকলের পক্ষে) প্রাপ্তব্য। ‘সামীপ্য’–ঈশ্বর সর্বত্র ব্যপ্ত বলিয়া সকলেই তাহার সমীপস্থ। অতএব ‘সামীপ্য’ মুক্তি ও স্বতঃ সিদ্ধ। সানুজ্য’–জীব ঈশ্বর অপেক্ষা সর্বপ্রকারে ক্ষুদ্র এবং চেতন বলিয়া স্বতঃবন্ধুবৎ। সুতরাং ‘সানুজ্য’ মুক্তিও প্রযত্ন ব্যতীত সিদ্ধ হইয়া থাকে। সকল জীব সর্বব্যাপক পরমাত্মায় ব্যপ্ত বলিয়া তাহার সহিত সংযুক্ত। সুতরাং ‘সায়ুজ্য’ মুক্তিও স্বতঃসিদ্ধ। অন্য সাধারণ নাস্তিকগণ মৃত্যুর পর তত্ত্বের মিলন হওয়াকে যে পরম মুক্তি মানে, তাহা কুকুর ও গর্দভাদিও প্রাপ্ত হইয়া থাকে।
এগুলি মুক্তি নহে, বরং এক প্রকারের বন্ধন। কারণ সকল লোক শিবপুর বা মোক্ষশিলা, চতুর্থ আকাশ, সপ্তম আকাশ, শ্রীপুর, কৈলাস, বৈকুণ্ঠ এবং গোলককে কোনও এক স্থানবিশেষকে মুক্তিস্থান বলিয়া মনে করিয়া থাকে। ঐ সকল স্থান হইতে বিচ্ছিন্ন হইলে মুক্তির অবসান হইয়া যায়। সুতরাং কোন নগরের সীমার মধ্যে নজরবন্দী হইয়া থাকার ন্যায় উহাও একপ্রকার বন্ধন হইবে। যে অবস্থায় জীব ইচ্ছানুসারে সর্বত্র বিচরণ করিতে পারে, কোথাও প্রতিরূদ্ধ হয় না, এবং যে অবস্থায় কোনও প্রকার ভয়, সংশয় ও দুঃখ থাকে না তাহাকে মুক্তি বলে। জন্মকে সৃষ্টি এবং মৃত্যুকে প্রলয় বলে। (জীব) যথাসময়ে জন্মগ্রহণ করে।
প্রশ্ন –জন্ম এক না অনেক?
উত্তর –অনেক ॥
প্রশ্ন –যদি অনেক হয়, তাহা হইলে পূর্ব জন্ম ও মৃত্যুর কথা স্মরণ হয় না কেন?
উত্তর –জীব অল্পজ্ঞ, ত্রিকালদর্শী নহে, সে কারণ স্মরণে থাকে না। আবার যে মন দ্বারা জানা যায়, তাহাও একই সময়ে দুই জ্ঞান ধারণ করিতে পারে না। পূর্বজন্মের কথা দূরে থাকুক, এই দেহই যখন জীব গর্ভে ছিল,তাহার শরীর গঠিত হইয়াছিল, তৎপশ্চাৎ সে ভূমিষ্ঠ হইয়াছিল এবং পঞ্চম বৎসরের পূর্ব পর্যন্ত যে যে ঘটনা ঘটিয়াছিল, সে সকল কথা স্মরণ হয় না কেন? আবার জাগ্রত ও স্বপ্নাবস্থায় নানা বিষয় প্রত্যক্ষ করিবার পর সুপ্তি অর্থাৎ গাঢ় নিদ্রা হইলে, জাগ্রত প্রভৃতি অবস্থার কথা স্মরণ হয় না কেন?
যদি কেহ তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, বার বৎসর পূর্বে, ত্রয়োদশ বৎসরের পঞ্চম মাসের নবম। দিবসে দ্বাদশ ঘটিকার সময় প্রথম মিনিটে তুমি কী করিয়াছিলে? তখন তোমার মুখ, হস্ত, কর্ণ, নেত্র, এবং শরীর কোন দিকে কীরূপে ছিল? তুমি মনে মনে কী চিন্তা করিতেছিলে? সে সব বিষয়ের তুমি কিছুই উত্তর দিতে পারিবে না। যখন এই শরীরেরই এইরূপ অবস্থা, তখন পূর্বজন্মের কথা স্মরণ সম্বন্ধে সংশয় করা কেবল ছেলেমানুষী। আর এই সকল কথা স্মরণ হয় না বলিয়াই জীব সুখী। নতুবা (জীব) পূর্ব পূর্ব জন্মের দুঃখ স্মরণ করিয়া দুঃখে মরিয়া যাইত। কেহ পূর্ব এবং পরজন্মের কথা জানিতে ইচ্ছা করিলেও সে জানিতে পারে না। কারণ জীবের জ্ঞান, এবং স্বরূপ অল্প। ঈশ্বরের পক্ষে ঐ সকল বিষয় জানা সম্ভব,–জীবের পক্ষে নহে।
প্রশ্ন –যখন জীব পূর্বজ্ঞান সম্বন্ধে অজ্ঞ এবং ঈশ্বর তাহাকে দণ্ডদান করেন, এই অবস্থায় জীবের সংশোধন হইতে পারে না। কারণ সে যদি জানিতে পারিতে যে সে এইরূপ কাৰ্য্য করিয়াছিল তাহারই এই ফল, তাহা হইলে সে পাপকর্ম হইও রক্ষা পাইত?
উত্তর –তুমি কয় প্রকার জ্ঞান স্বীকার কর?
প্রশ্ন –(পূর্বপক্ষ)–প্রত্যক্ষাদি প্রমাণসহ আট প্রকারের।
উত্তর –তবে তুমি সংসারে জন্ম হইতে বিভিন্ন সময়ের রাজ্য, ধন, বিদ্যা, বুদ্ধি, দারিদ্র্য, নির্বুদ্ধিতা, মুখর্তা এবং সুখ-দুঃখ প্রভৃতি দেখিয়া পূর্ব জন্মের জ্ঞান করিতে পার না কেন? যদি এক বৈদ্য ও অন্য এক বৈদ্যকে কোনও প্রকার রোগ আক্রমণ করিলে যিনি বৈদ্য তিনি রোগের নিদান অর্থাৎ কারণ জানিতে পারিবেন কিন্তু বিদ্যাহীন জানিতে পারে না। কারণ এই যে, যিনি বৈদ্য তিনি চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়াছেন আর অপর ব্যক্তি করে নাই। কিন্তু জ্বরাদি রোগ হইলে যিনি অবৈদ্য তিনি ইহা অবশ্য জানিবেন যে, সে কোনও কুপথ্য সেবন করায় তাহার এই রোগ হইয়াছে। সেইরূপ জগতে বিচিত্র সুখ-দুঃখ প্রভৃতির হ্রাস-বৃদ্ধি দেখিয়া পূর্ব জন্মের বিষয় অনুমান করিতে পার না কেন?
পূর্বজন্ম না মানিলে, পরমেশ্বর পক্ষপাতী হইয়া পড়েন। কারণ, তিনি পাপ ব্যতীত দুঃখ দারিদ্র্য এবং পূর্ব সঞ্চিত পুণ্য ব্যতীত রাজ্য, ধনাঢ্যতা এবং নিবুদ্ধিতা দান করিবেন কেন? পরমেশ্বর পূর্বজন্মের পাপ-পুণ্য অনুসারে দুঃখ ও সুখ দিয়া থাকেন বলিয়া তিনি যথার্থ ন্যায়কারী।
প্রশ্ন –একটি মাত্র জন্ম হইলেও ন্যায়কারী হইতে পারেন। কারণ, রাজা সর্বোপরি বর্তমান, তিনি যাহা করেন, তাহাই ন্যায়। উদ্যানপালক নিজ উদ্যানে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ নানাপ্রকার বৃক্ষ রোপণ করে, তন্মধ্যে যে কোনো বৃক্ষকে কাট-ছাঁট করে, কোন বৃক্ষকে রক্ষা ও বৃদ্ধি করে। সেইরূপ যাঁহার যে বস্তু, তিনি ইচ্ছানুসারে রাখিতে পারেন। তাহার উপর এরূপ অন্য কেহ ন্যায়কারী নাই, যে তাহাকে দণ্ড দিতে পারে অথবা ঈশ্বর তাহাকে ভয় করিয়া থাকেন।
উত্তর –পরমাত্মা ন্যায় করেন বলিয়া তিনি কখনও অন্যায় করেন না। এইজন্য তিনি পূজনীয় ও মহান। ন্যায়বিরুদ্ধ কাৰ্য্য করিলে তিনি ঈশ্বরই হইতে পারেন না। যেমন উদ্যানপালক নির্বিচারে রাস্তায় অথবা অস্থানে বৃক্ষ রোপণ করিলে, কর্তনযোগ্য বৃক্ষকে কর্তন না করিলে, আর অযোগ্য বৃক্ষকে বর্ধিত করিলে এবং যোগ্য বৃক্ষকে বর্ধিত না করিলে দোষভাজন হয়, সেইরূপ বিনা কারণে কাৰ্য্য করিলে ঈশ্বরেও দোষ ঘটে। পরমেশ্বর স্বভাবতঃ পবিত্র এবং ন্যায়কারী। এইজন্য তিনি ন্যায়সঙ্গত কাৰ্য্যই করিয়া থাকেন। উন্মত্তের ন্যায় কাৰ্য্য করিলে তিনি পৃথিবীস্থ একজন উচ্চস্থানীয় ন্যায়াধীশ অপেক্ষাও হীন হইবেন এবং কুখ্যাত হইবেন। এ জগতে যোগ্যতা ও উত্তম কর্ম ব্যতীত সম্মান দান করিলে এবং দুষ্ট কর্ম ব্যতীত দণ্ডদান করিলে কি তাহার নিন্দা ও অকীৰ্ত্তি হয় না? সুতরাং ঈশ্বর অন্যায় করেন না এবং এই কারণেই কাহাকে ভয়ও করে না।
প্রশ্ন –পরমাত্মা প্রথম হইতেই যাহাকে যে পরিমাণ দেওয়া স্থির করেন তাহাকে তিনি সেই পরিমাণই দেন, এবং যাহার জন্য যাহা করা উচিত বিবেচনা করেন, তাহার জন্য তাহাই করেন।
উত্তর –এ বিষয়ে জীবগণের কর্মানুসারেই বিচার হইয়া থাকে, অন্যথা হইলে তিনি অপরাধী অথবা অন্যায়কারী হইয়া পড়েন।
প্রশ্ন –ছোটবড় সকলের দুঃখ একই প্রকার। বড় লোকের বড় চিন্তা, ক্ষুদ্রের ক্ষুদ্র চিন্তা। উদাহরণ স্বরূপ, কোন ধনীর লক্ষ টাকার জন্য রাজদ্বারে বিচার উপস্থিত হইলে, তিনি গ্রীষ্মকালে পাল্কি করিয়া গৃহে হইতে বিচারলয়ে গমন করেন। তাঁহাকে বাজারের মধ্যে দিয়া যাইতে দেখিয়া অজ্ঞ লোকেরা বলিতে থাকে, “পাপ-পুণ্যের ফল দেখ। একজন পাল্কির মধ্যে আনন্দে বসিয়া আছে, অন্যেরা নগ্নপদে ঘর্মাক্ত কলেবরে পাল্কি বহন করিতেছে।” কিন্তু যাহারা বুদ্ধিমান্ তাহারা বুঝিতে পারে যে, ন্যায়ালয় যতই নিকটবর্তী হইতে থাকে, ততই ধনীর মনস্তাপ ও সন্দেহ এবং পাল্কিবাহকদের আনন্দ বৃদ্ধি পাইতে থাকে। বিচারালয়ে উপস্থিত হইয়া ধনাঢ্য ব্যক্তি এখানে সেখানে যাইবার কথা ভাবিতে থাকেন। একবার মনে করেন, উকিলের নিকট যাই, আবার ভাবেন। সেরেস্তাদারের নিকট যাই। আজ জয় কি পরাজয় হইবে জানি না। অন্যদিকে পাল্কি বাহকেরা তামাক খাইতে খাইতে পরস্পর কথোপকথন করে এবং অবশেষে নিদ্রা হয়। যদি ধনাঢ্য ব্যক্তি জয়লাভ করেন, তবে তাহার কিঞ্চিৎ আনন্দ হয়, কিন্তু পরাজয় হইলে তিনি দুঃখসাগরে নিমগ্ন হন। পাঞ্চিবাহকেরা কিন্তু যেমন তেমনই থাকে। এইরূপে রাজা- সুন্দর ও সুকোমল শয্যায় শয়ন করিলেও তাহার শীঘ্র নিদ্রা আসে না কিন্তু শ্রমজীবীগণ কাকর-পাথরময় মৃত্তিকা এবং উচ্চনীচ ভূমিতেও শয়ন করিয়া শীঘ্রই ঘুমাইয়া পড়ে। এইরূপ সর্বত্র বুঝিতে হইবে।
উত্তর –অজ্ঞ লোকেরা এইরূপই মনে করিয়া থাকে। যদি কোন ধনীকে বলা যায়, ‘তুমি পাল্কিবাহকের কাৰ্য্য কর, এবং পাল্কি বাহককে বলা হয়, তুমি ধনাঢ্য হও, তাহা হইলে ধনী কখনও পাল্কিবাহক হইতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু পাল্কিবাহক ধনী হইতে ইচ্ছা করে। সুখ-দুঃখ সমান হইলে কেহ নিজ নিজ অবস্থা হইতে উন্নত অথবা অবনত হইতে ইচ্ছা করিত না।
দেখ! একজন বিদ্বান্ পুণ্যাত্মা ও ঐশ্বৰ্য্যশালী রাজা রাণীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করে, অপর একজন। মহাদরিদ্র ঘাসকৰ্ত্তিকার গর্ভে জন্মগ্রহণ করে। একজন গর্ভ হইতে আরম্ভ করিয়া আজীবন সকল প্রকার সুখ, অপর একজন সকল প্রকার দুঃখ ভোগ করে। একজন ভূমিষ্ঠ হইবার পর সুন্দর, সুগন্ধযুক্ত জলে স্নান করে, বুদ্ধিপূর্বক তাহার নাড়ীচ্ছেদন করা হয়, পরে তাহাকে দুগ্ধপানাদি করান হয়। সে দুগ্ধপান করিতে ইচ্ছা করিলে, তাহাতে মিশ্রি মিশ্রিত করিয়া যথেষ্ট দুগ্ধ দেওয়া হয়। তাহাকে আনন্দিত রাখিবার জন্য ভৃত্য, খেলনা ও বাহন রাখা হয়। সে উত্তম স্থানে লালিত পালিত হওয়াতে আনন্দ লাভ করে। অপর জনের অরণ্যে জন্ম হয়, সে স্নানের। জন্য জলও পায় না। দুগ্ধপান করিতে ইচ্ছা করিলে দুগ্ধদানের পরিবর্তে তাহাকে কিল চড় মারা হয়। তখন সে অত্যন্ত আর্তস্বরে রোদন করিতে থাকে। কেহ তাহাকে জিজ্ঞাসাও করে না। এই সমস্ত সুখ-দুঃখ জীবের (পূর্বজন্মার্জিত) পাপ-পুণ্য ব্যতীত লাভ হইলে ঈশ্বরের উপর দোষ ঘটে।
দ্বিতীয়ত : –কৃতকর্ম ব্যতীত সুখ-দুঃখ প্রাপ্তি হইলে স্বর্গ-নরক ও থাকা উচিত নহে। পরমেশ্বর যদি কর্ম ব্যতীত বর্তমানে সুখ-দুঃখ দিয়া থাকেন, তবে মৃত্যুর পরেও যাহাকে ইচ্ছা তাহাকে নরকে অথবা স্বর্গে প্রেরণ করিবেন। তাহা হইলে সকল জীব অধার্মিক হইয়া যাইবে। তাহারা ধর্ম করিবে কেন? কারণ ধর্মের ফলপ্রাপ্তি সম্বন্ধে তাহাদের সন্দেহ হইবে। সমস্তই পরমেশ্বরের অধীন, তাহার যেরূপ ইচ্ছা তিনি সেইরূপ করিবেন। ফলে পাপকর্মে ভয় থাকিবে না এবং সংসারে পাপবৃদ্ধি ও ধর্মক্ষয় হইতে থাকিবে। সুতরাং পূর্বজন্মের পাপ পুণ্যানুসারে। বর্তমান জন্ম এবং বর্তমান ও পূর্বজন্মের কর্মানুসারে ভবিষ্যৎ জন্ম হইয়া থাকে।
প্রশ্ন –মনুষ্য এবং অন্য পশ্যাদি প্রাণীর শরীরে জীব কি একই প্রকারের অথবা বিভিন্ন প্রকারের?
উত্তর –জীব একই প্রকারের। কিন্তু পাপ-পুণ্য অনুসারে অপবিত্র অথবা পবিত্র হইয়া থাকে।
প্রশ্ন –মনুষ্যের জীব পশ্যাদিতে এবং পশ্বাদির জীব মনুষ্যের শরীরে, স্ত্রীর জীব পুরুষের শরীরে এবং পুরুষের জীব স্ত্রীর শরীরে গমনাগমন করে কিনা?
উত্তর –হ্যাঁ, অবশ্য গমনাগমন করে। কারণ পাপের বৃদ্ধি পুণ্যের হ্রাস হইলে মনুষ্যের জীব পশ্বাদির নীচদেহ প্রাপ্ত হয়। সেইরূপ ধর্ম অধিক এবং অধর্ম অল্প হইলে দেব অর্থাৎ বিদ্বাদের শরীর লাভ হয়। পাপ-পুণ্য সমান হইলে সামান্য মনুষ্যদেহ লাভ হয়। তন্মধ্যেও উত্তম, মধ্যম ও অধম পাপপুণ্যানুসারে মনুষ্যাদির উত্তম, মধ্যম ও নিকৃষ্ট শরীর লাভ হইয়া থাকে। অধিক পাপের ফল পশ্বাদির শরীরে ভোগ করিবার পর, পুনরায় পাপ-পুণ্য সমান। হইলে জীব মনুষ্যের শরীর ধারণ করে এবং পুণ্যফল ভোগ করিবার পর পুনরায় মধ্যম মনুষ্য শরীর ধারণ করে।
জীবের শরীর হইতে পৃথক হওয়ার নাম ‘মৃত্যু’ এবং শরীরের সংযুক্ত হওয়ার নাম ‘জন্ম’।
জীব দেহত্যাগ করিবার পর ‘যমালয়’ অর্থাৎ আকাশস্থ বায়ুতে থাকে। ‘য়মেন বামুনা’ বেদে লিখিত আছে। বায়ুর আর এক নাম ‘যম’, গরুড় পুরাণের কল্পিত যম নহে। ইহার বিশেষ খণ্ডন-মণ্ডন একাদশ সমুল্লাসে লিখিত হইবে। পরে ‘ধর্মরাজ’ অর্থাৎ পরমেশ্বর সেই জীবের পাপপুণ্য অনুসারে। জন্মের ব্যবস্থা করেন।
জীব ঈশ্বরের প্রেরণায় বায়ু, অন্ন, জল অথবা দেহছিদ্র দ্বারা অপরের শরীরে প্রবেশ করে। শরীরে প্রবিষ্ট হইয়া ক্রমশঃ বীর্য্যে গিয়া গর্ভে স্থিত হয়, শরীর ধারণ করিয়া বাহিরে আসে। যদি স্ত্রী দেহ ধারণ করিবার উপযুক্ত কর্ম থাকে তাহা হইলে স্ত্রীদেহ এবং পুরুষদেহ ধারণ করিবার উপযুক্ত কর্ম থাকিলে সে পুরুষদেহ ধারণ করে। গর্ভস্থিতি কালে স্ত্রী-পুরুষ সংসর্গে রজোবীৰ্য্য সমান হইলে ‘নপুংসক’ হয়। এইরূপে জীব যতকাল উত্তম কর্ম, উপাসনা ও জ্ঞান লাভ করিয়া মুক্তি না পায়, ততকাল সে বহু জন্ম-মৃত্যুর মধ্যে পড়িয়া থাকে। উত্তম কর্মের ফলে মনুষ্যদের মধ্যে উত্তম জন্ম লাভ করে এবং মুক্তিতে মহাকল্প পৰ্য্যন্ত জন্ম-মরণ দুঃখ রহিত হইয়া আনন্দে অবস্থান করে।
প্রশ্ন –মুক্তি কি এক জন্মে লাভ হয়, অথবা অনেক জন্মে?
উত্তর –অনেক জন্মে কেননা :– ভিদ্যতে হৃদয়গ্রন্থচ্ছিদ্যন্তে সর্বসংশয়াঃ। ক্ষীয়ন্তে চাস্য কর্মাণি তস্মিন্ দৃষ্টে পরাবরে ॥ মুণ্ডক ॥
যখন জীবের হৃদয়স্থিত অবিদ্যা অজ্ঞানরূপী গ্রন্থি কাটিয়া যায়, সকল সংশয় ছিন্ন এবং দুষ্ট কর্মের ক্ষয় হয় তখন সেই পরমাত্মা যিনি জীবের আত্মার অন্তরে ও বাহিরে ব্যাপ্ত হইয়া রহিয়াছেন; তাহাতে নিবাস করেন।
প্রশ্ন –মুক্তি অবস্থায় জীব কি পরমেশ্বরে মিশিয়া যায়; অথবা পৃথক থাকে?
উত্তর –পৃথক্ থাকে। কেননা, মিশিয়া গেলে মুক্তিসুখ ভোগ করিবে কে? এমতাবস্থায় মুক্তির যাবতীয় সাধন নিষ্ফল হইয়া যাইবে। উহা মুক্তি নহে, কিন্তু উহাকে জীবের প্রলয় জানা উচিত। যে জীব পরমেশ্বরের আজ্ঞা পালন, সৎকর্মানুষ্ঠান, সৎসঙ্গ ও যোগাভ্যাস এবং পূর্বোক্ত সমস্ত সাধনা অবলম্বন করে, সেই মুক্তি পায়।
সত্যং নমনন্তংব্রহ্ম য়ো বেদনিহিতং গুহায়াং পরমে ব্যোম। সোডমুতে সর্বাঙ্কামাসহ ব্ৰহ্মণা বিপশ্চিতেতি। তৈত্তিরী
যে জীবাত্মা স্বীয় বুদ্ধি ও আত্মায় অবস্থিত সত্য, জ্ঞান ও অনন্ত আনন্দস্বরূপ পরমাত্মাকে জানে, সে সেই সর্বব্যাপক ব্রহ্মে থাকিয়া বিপশ্চিৎ’অনন্ত বিদ্যাযুক্ত ব্রহ্মের সহিত সমস্ত কাম লাভ করে অর্থাৎ সে যে সমস্ত আনন্দ কামনা করে, সেই সমস্ত আনন্দ প্রাপ্ত হয় তাহাই মুক্তি ॥
প্রশ্ন –জীব যদি শরীর ব্যতীত সাংসারিক সুখ ভোগ করিতে না পারে মুক্তি অবস্থায় সে শরীর ব্যতীত কীরূপে আনন্দ ভোগ করিতে পারে?
উত্তর –পূর্বে এ বিষয়ে মীমাংসা করা হইয়াছে। আরও কিঞ্চিৎ শ্রবণ কর। যেরূপ জীব শরীরের আধারে সাংসারিক সুখ ভোগ করে সেইরূপ পরমেশ্বরের আধারে জীব মুক্তি আনন্দ ভোগ করে। সেই মুক্ত জীব অনন্ত ব্যাপক ব্রহ্মে স্বচ্ছন্দে বিচরণ করে, শুদ্ধ জ্ঞান দ্বারা সমস্ত সৃষ্টি দর্শন করে, অন্য মুক্তদিগের সহিত মেলামেশা করে, সৃষ্টিবিদ্যাকে ক্রমানুসারে দর্শন করিয়া সমস্ত লোক লোকান্তরে অর্থাৎ সমস্ত দৃশ্য ও অদৃশ্য লোকে পরিভ্রমণ করে। সে তাহার জ্ঞানাতীত পদার্থ সমূহকে দর্শন করে। জ্ঞান যত অধিক হইতে থাকে তাহার আনন্দও তত অধিক হইতে থাকে।
মুক্ত অবস্থায় জীবাত্মা নির্মল থাকে বলিয়া সে পূর্ণ জ্ঞানী হইয়া সন্নিহিত সমস্ত পদার্থের অনুভূতি যথার্থস্বরূপ হয়। এই সুখ বিশেষই ‘স্বর্গ। আর বিষয় তৃষ্ণায় আবদ্ধ হইয় দুঃখ বিশেষ ভোগ করার নাম নিরক’। সুখের নাম ‘স্ব’। স্বঃ সুখং গচ্ছতিয়স্মিন স স্বর্গঃ অতো বিপরীতে দুঃখ ভোগো (যস্মিন্ ন) নরক ইতি’। যাহা সাংসারিক সুখ উহা সামান্য স্বর্গ’ এবং পরমেশ্বরের সাক্ষাৎকারজনিত আনন্দকে বিশেষ স্বর্গ’ বলে। সকল জীব স্বভাবতঃ সুখাভিলাষী। সকলেই দুঃখ হইতে মুক্তির ইচ্ছা করে। কিন্তু যত সময় জীব ধর্মাচরণে প্রবৃত্তি না হইবে এবং পাপ পরিত্যাগ না করিবে, ততসময় তাহার সুখপ্রাপ্তি এবং দুঃখের নিবৃত্তি হইবে না। কেননা, যাহার ‘কারণ’ অর্থাৎ মূল থাকে তাহা কখনও বিনষ্ট হয় না। যথা–
ছিন্নে মূলে বৃক্ষো নশ্যতি তথা পাপেক্ষীণে দুঃখং নশ্যতি ॥
যেরূপ মূল ছিন্ন হইলে বৃক্ষ নষ্ট হয়, সেইরূপ পাপ দূরীভূত হইলে দুঃখের নাশ হয়।
দেখ! মনুস্মৃতিতে পাপ-পুণ্যের বহুপ্রকার গতি বর্ণিত হইয়াছে ॥
মানসংমনসৈবায়মুপভুক্তে শুভাশুভ। বাঁচা বাঁচাকৃতং কর্ম কায়েনৈব চ কায়িক ॥ ॥ শরীরজৈঃ কর্মদোষৈয়াতি স্থাবরতাংনরঃ ॥ বাঁচিকৈঃ পক্ষিমৃগতাংমানসৈন্ত্যজাতিতা ॥ ২ ॥ মোয়দৈং গুণে দেহে সাকল্যেনাতিরিচ্যতে ॥ স তদা তগুণপ্রায়ং তং করোতিশরীরিণ ॥ ৩৷ কা) সত্ত্বং জ্ঞানং তমোজ্ঞানং রাগদ্বেষৌ রজঃ স্মৃত।) এতদ্ব্যাপ্তিমদেতেষাং সৰ্ব্বভূতাতিং বপুঃ ॥ ৪ ॥ তত্রয়ৎপ্রীতিসংযুক্তংকিঞ্চিদাত্মানি লক্ষয়েৎ। প্রশান্তমিব শুদ্ধাভংসত্ত্বং তদুপধারয়েৎ ॥ ৫ ॥ য় দুঃখসমায়ুক্তম প্রীতিকরমাত্মনঃ ॥ তদ্রজোতপ্রতিঘং বিদ্যাৎসততং হারি দেহিনা৷ ৬ ॥ য় স্যান্মোহসংয়ুক্তমব্যক্তং বিষয়াত্মক। অপ্রতৰ্কমবিজ্ঞেয়ং তমস্তদুপধারয়েৎ ॥ ৭ ॥ এয়োমপি চৈতেষাং গুণানাং য়ঃ ফলোদয়ঃ। অগ্রো মধ্যো জঘন্যশ্চ তং প্রবক্ষ্যাম্যশেষতঃ ॥ ৮ ॥ বেদাভ্যাসস্তপো জ্ঞানং শৌচমিন্দ্রিয়নিগ্রহঃ। ধর্ম ক্রিয়াত্মচিন্তা চ সাত্ত্বিকং গুণ লক্ষণ৷ ৯ ॥ আরম্ভরুচিতাধৈর্য্যমসকার্যপরিগ্রহঃ। বিষয়গাপসেবা চাজস্রং রাজসং গুণ লক্ষণ ॥ ১০ ॥ লোভঃ স্বপ্নে ধৃতিঃ ক্রৌয়ং নাস্তিক্যং ভিন্নবৃত্তিতা। যাচিষ্ণুতা প্রমাদষ্ণ তামসং গুণ লক্ষণ ॥ ১১ ॥ য়ৎকর্ম কৃত্বা কুর্বংশ্চ করিষ্যংশ্চৈব লজ্জতি ॥ তজ্ঞেয়ং বিদুষা সর্বং তামসং গুণলক্ষণ৷১২ ॥ যেনাস্মি কর্মর্ণা লোকে খ্যাতিমিচ্ছতি পুষ্কলাম্। ন চ শোচত্যসম্পত্তৌ তদ্বিজ্ঞেয়ং তু রাজসম্ ॥ ১৩ ॥ য়ৎ সর্বেণেচ্ছতি জ্ঞাতুংয়ন্ন লজ্জতি চাচার। তেন তুষ্যতি চাত্মাস্য তৎ সত্ত্বগুণ লক্ষণ ॥ ১৪ ॥ তমসসা লক্ষণং কামো রজসস্তুর্থ উচ্যতে। সত্ত্বস্য লক্ষণং ধর্মঃ শ্রৈষ্ঠ্যমেষাংয়োত্তর৷ ১৫ ॥ মনু অ০ ১২ ॥
অর্থাৎ মনুষ্য এইরূপে উত্তম, মধ্যম এবং অধম স্বভাব জানিয়া উত্তম স্বভাব গ্রহণ এবং মধ্যম ও অধম স্বভাব পরিত্যাগ করিবে। ইহাও নিশ্চয় জানা আবশ্যক যে, জীব মন, বাণী এবং শরীর দ্বারা যে শুভ অথবা অশুভ কর্ম করে তাহার ফুল যথাক্রমে মন, বাণী ও শরীর দ্বারা ভোগ করে অর্থাৎ সুখ-দুঃখ ভোগ করে ॥ ১ ॥
মনুষ্য শরীর দ্বারা চৌর্য্য, পরস্ত্রী গমন, শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদিগের হত্যা প্রভৃতি কুকর্ম করিলে বৃক্ষাদি স্থাবর জন্ম; বাণী দ্বারা পাপ করিলে পক্ষী ও মৃগাদি জন্ম এবং মন দ্বারা করিলে চণ্ডালাদির শরীর লাভ হয় ॥ ২.
যে জীবের শরীরে যে গুণ অধিক থাকে, সেই গুণ তাহাকে আত্মবৎ করিয়া তোলে ॥ ১ ॥
যখন আত্মায় জ্ঞান থাকে, তখন সত্ত্বগুণ, যখন অজ্ঞানতা থাকে তখন তমঃ এবং যখন রাগ-দ্বেষ থাকে তখন রজোগুণ প্রবল বলিয়া জানিতে হইবে। এই তিন প্রকৃতির গুণ যাবতীয় সাংসারিক পদার্থে ব্যপ্ত হইয়া আছে ॥ ৪ ॥
এ বিষয়ে জানা আবশ্যক যে, যখন আত্মায় প্রসন্নতা থাকে, মন প্রসন্ন এবং প্রশান্ত অবস্থার ন্যায় শুদ্ধ ভাবযুক্ত থাকে, তখন বুঝিতে হইবে যে সত্ত্বগুণ প্রধান, রজঃ ও তমোগুণ অপ্রধান রহিয়াছে ॥ ৫ ॥
যখন আত্মা ও মন দুঃখিত ও অপ্রসন্ন হইয়া বিষয়ে ইতস্ততঃ বিচরণ করে, তখন বুঝিতে হইবে যে, রজোগুণ প্রধান এবং সত্ত্ব ও তমোগুণ অপ্রধান রহিয়াছে ॥ ৬ ॥
যখন মোহ অর্থাৎ আত্মা ও মন সাংসারিক পদার্থে জড়িত ও বিবেক শূন্য অবস্থায় থাকে এবং বিষয়াসক্ত হেতু তর্ক-বিতর্ক রহিত ও জ্ঞানের উপযুক্ত থাকে না, তখন নিশ্চয় বুঝিতে হইবে যে, তমোগুণ প্রধান এবং সত্ত্ব ও রজোগুণ অপ্রধান রহিয়াছে ॥ ৭ ॥
এখন আমরা এই গুণত্রয়ের উত্তম, মধ্যম এবং অধমের যাহা ফলোদয় তাহা পূর্ণরূপে আলোচনা করিতেছি ॥ ৮ ॥
বেদাভ্যাস, ধর্মানুষ্ঠান, জ্ঞানোন্নতি, পবিত্রতা লাভের ইচ্ছা, ইন্দ্রিয়নিগ্রহ, ধর্মক্রিয়া এবং আত্মচিন্তন সত্ত্বগুণের লক্ষণ ॥ ৯ ॥
যখন রজোগুণের উদয় এবং সত্ত্ব ও তমোগুণের অন্তর্ভাব ঘটে, তখন কাৰ্যারম্ভে রুচি ধৈৰ্য্যত্যাগ, অসৎ কর্ম-গ্রহণ এবং নিরন্তর বিষয়ভোগে প্রীতি হইয়া থাকে। তখনই বুঝিতে হইবে যে, আমার মধ্যে রজোগুণ প্রধানরূপে ক্রিয়া করিতেছে ॥ ১০ ॥
যখন তমোগুণের আবির্ভাব এবং অন্য দুই গুণের অন্তর্ভাব ঘটে, তখন অত্যধিক লোভ অর্থাৎ সকল পাপের মূল বৃদ্ধি পায়, অত্যাধিক আলস্য ও নিদ্রা; ধৈৰ্য্য নাশ,ক্রতা জন্মে, ‘নাস্তিক্য’অর্থাৎ বেদ ও ঈশ্বরের প্রতি অশ্রদ্ধা; অন্তঃকরণের বিভিন্ন বৃত্তি ও একাগ্রতার অভাব যাহার তাহার নিকট যাঞ্চা অর্থাৎ ভিক্ষা করা, প্রমাদ অর্থাৎ মদ্যপানাদিদুষ্ট ব্যসনে বিশেষ আসক্তি জন্মে তখন বিদ্বান্ব্যক্তি উহাকে তমোগুণের লক্ষণ বলিয়া জানিবে ॥ ১১ ॥
এই সব তমোগুণের লক্ষণ বিদ্বানদের জানা উচিৎ মে, যখন কোনো কর্ম করিতে,কোনো। কর্ম করিয়া এবং করিবার ইচ্ছা হইলে নিজ আত্মায় লজ্জা, সংশয় ও ভয় অনুভব করে, তখন বুঝিতে হইবে যে, আত্মায় তমোগুণের প্রাবল্য হইয়াছে ॥ ১২ ॥
যখন জীবাত্মা কর্ম দ্বারা ইহলোকে বিপুল যশোলাভের আকাঙ্ক্ষা করে এবং দরিদ্র হইয়াও চারণভাট ইত্যাদিকে দান দেওয়া ত্যাগ করে না তখন বুঝিতে হইবে যে আমার আত্মায় রজোগুণ প্রবল হইয়াছে ॥ ১৩ ॥
যখন মানবাত্মা সর্বত্র জ্ঞানলাভের ইচ্ছা করে, গুণ গ্রহণ করিতে থাকে, সৎকর্মে লজ্জা অনুভব করে না এবং সৎকর্মে প্রসন্ন হয় অর্থাৎ ধর্মাচরণে রুচি থাকে, তখন বুঝিতে হইবে যে, আমাতে সত্ত্বগুণ প্রবল হইয়াছে ॥ ১৪ ॥
তমোগুণের লক্ষণ কাম, রজোগুণের লক্ষণ অর্থসংগ্রহের ইচ্ছা এবং সত্ত্বগুণের লক্ষণ ধর্ম সেবা। তমোগুণ অপেক্ষা রজোগুণ এবং রজোগুণ অপেক্ষা সত্ত্বগুণ শ্রেষ্ঠ।
এবার জীব যে যে গুণ দ্বারা যে যে গতি প্রাপ্ত হয়, তাহা বর্ণিত হইতেছে– দেবত্বং সাত্ত্বিকায়ান্তি মনুষ্যত্বঞ্চ রাজসাঃ ॥ তিয়ত্বং তামসা নিত্যমিত্যে ত্রিবিধা গতিঃ ॥১॥ স্থাবরাঃ কৃমিকীটাশ্চমৎস্যাঃ সর্পাশ্চ কচ্ছপাঃ। পশবশ্চ মৃগাশ্চৈব জঘন্যা তামসী গতিঃ ॥ ২ ॥ হস্তিনশ্চ তুরঙ্গাশ্চ শূদ্রা ম্লেচ্ছাশ্চ গহিতাঃ। সিংহা ব্যাঘ্রা বরাহাশ্চ মধ্যমা তামসী গতিঃ ॥ ৩ ॥ চারণাশ্চ সুপর্ণশ্চ পুরুষাশ্চৈব দাম্ভিকঃ। রক্ষাংসি চপিশাচাশ্চ তামসীমূত্তমা গতিঃ ॥ ৪ ॥ ঝল্লা মল্লা নটাশ্চৈব পুরুষাঃশস্ত্রবৃত্তয়ঃ। দূতপানপ্রসক্তাশ্চ জঘন্যা রাজসী গতিঃ ॥ ৫ ॥ রাজানঃ ক্ষত্রিয়শ্চৈব রাজ্ঞং চৈব পুরোহিতাঃ। বায়ুদ্ধ প্রধানাশ্চ মধ্যমা রাজসী গতিঃ ॥ ৬ ॥ গন্ধর্বা গুহ্যকা য়ক্ষাবিবুধামুচরাশ্চ য়ে। তথৈবাষ্পরসঃ সর্বা রাজসীমূত্তমা গতিঃ ॥ ৭ ॥ তাপসায়তয়ো বিপ্রা য়ে চ বৈমানিকা গুণাঃ। নক্ষত্রাণি চ দৈত্যাশ্চ প্রথমা সাত্ত্বিকী গতিঃ ॥ 8 ॥ য়জ্বান ঋষয়গা দেবা জ্যোতীংষি বৎসরাঃ ॥ পিতরশ্চৈব সাধ্যাশ্চ দ্বিতীয়া সাত্ত্বিকী গতিঃ ॥ ৯ ॥ ব্রহ্মা বিশ্বসৃজো ধর্মো মহানবক্তমেব চ। উত্তমাংসাত্ত্বিকীমেতাং গতিমাহুর্মনীষিণঃ। ১০ ॥ ইন্দ্রিয়াণাং প্রসঙ্গেন ধর্মস্যাসেবনেন চ। পাপাসংয়ান্তি সংসারানবিদ্বাংসোনরাধমাঃ ॥১১ ॥ মনু
সাত্ত্বিক মনুষ্য দেব অর্থাৎ বিদ্বান, রজোগুণান্বিত মনুষ্যেরা নীচগতি প্রাপ্ত হইয়া থাকে। ॥১॥
যাহারা অত্যন্ত তমোগুণান্বিত, তাহারা স্থাবর বৃক্ষাদি, কৃমি, কীট, মৎস্য, সর্প, কচ্ছপ, পশু এবং মৃগজন্ম প্রাপ্ত হয় ॥ ২ ॥
যাহারা মধ্যম তমোণ্ডণান্বিত তাহারা হস্তী, অশ্ব, শূদ্র, ম্লেচ্ছ, নিন্দিত কর্মকারী, সিংহ, ব্যাঘ্র এবং বরাহ অর্থাৎ শূকরজন্ম প্রাপ্ত হয় ॥ ৩ ॥
যাহারা উত্তম তমোগুণান্বিত, তাহারা চরণ (কবিতা ও পদ্য প্রভৃতি রচনা করিয়া মনুষ্যের গুণকীর্তনকারী), সুন্দর পক্ষী, দাম্ভিক পুরুষ, অর্থাৎ নিজের সুখের জন্য আত্মপ্রশংসাকারী, রাক্ষস, হিংসক = পিশাচ এবং অনাচারী অর্থাৎ মদ্যাদি পানকারী ও অপবিত্র থাকে। এই সব উত্তম তমোগুণের কর্মফল ॥ ৪ ॥
যাহারা জঘন্য রজোগুণান্বিত, তাহারা ঝল্লা অর্থাৎ তরবারী প্রভৃতি দ্বারা আঘাতকারী, অথবা কোদাল প্রভৃতি দ্বারা খননকারী, মল্লা, অর্থাৎ নৌকাদির চালক, নট অর্থাৎ বাঁশ প্রভৃতির উপর লক্ষ্যদান, আরোহণ প্রভৃতিকলা প্রদর্শনকারী,শস্ত্রধারী ভৃত্য এবং মদ্যপানাসক্ত মনুষ্যরূপে জন্মগ্রহণ করে। ইহা জঘন্য রজোগুণের ফল ॥ ৫ ॥
যাহারা মধ্যম রজোগুণবিশিষ্ট তাহারা রাজা, ক্ষত্রিয়বর্ণস্থ রাজার পুরোহিত, বাদবিবাদকারী, দূত, প্রাড়বিবাক (উকিল ব্যারিষ্টার) এবং যুদ্ধ বিভাগের অধ্যক্ষ রূপে জন্মগ্রহণ করে ॥ ৬ ॥
যাহারা উত্তম রজোগুণবিশিষ্ট তাহারা ‘গন্ধর্ব’ (গায়ক) ‘গুহ্যক’ (বাদিত্ৰবাদক), যক্ষ’ (ধনাঢ্য), বিদ্বাদিগের সেবক এবং অপ্সরা অর্থাৎ উত্তম রূপবতী স্ত্রী এই সকলের জন্মলাভ করে ॥ ৭ ॥
যাঁহারা তপস্বী যতি=সন্নাসী, বেদপাঠী, বিমানচালক, জ্যোতির্বিদ এবং দৈত্য অর্থাৎ দেহরক্ষক মনুষ্য। তাহাদিগকে প্রথম সত্ত্ব গুণজনিত কর্মের ফল বলিয়া জানিতে হইবে ॥ ৮ ॥
যাঁহারা মধ্যম সত্ত্বগুণবিশিষ্ট হইয়া কর্ম করেন, সেই সব জীব যজ্ঞকর্তা, বেদার্থবিদ, বিদ্বান, বেদ-বিদ্যুৎ-কাল-বিদ্যাবিৎ, রক্ষক, জ্ঞানী এবং সাধ্য কাৰ্যসিদ্ধির জন্য সেবনীয় অধ্যাপক জন্ম লাভ করেন। ॥ ৯ ॥
যাহরা উত্তম সত্ত্বগুণবিশিষ্ট হইয়া কর্ম করে, তাহারা ব্রহ্মা’ সকল বেদের বেত্তা, ‘বিশ্বসৃজ’= সমস্ত সৃষ্টি ক্রমবিদ্যা জানিয়া বিবিধ বিমানাদি যান নির্মাণকারী, ধার্মিক, সর্বোত্তম বুদ্ধিসম্পন্ন ও অব্যক্তের জন্ম এবং প্রকৃতিবশিত্ব সিদ্ধি প্রাপ্ত হন। ॥ ১০ ॥
যাহারা ইন্দ্রিয়ের বশীভূত হইয়া বিষয়াসক্ত হয়, ও ধর্ম পরিত্যাগ করিয়া অধর্মচারী এবং মুখ হয়, তাহারা মনুষ্যদিগের মধ্যে নীচ ও দুঃখরূপ ঘৃণিত জন্ম প্রাপ্ত লাভ করে ॥ ১১ ॥
এইরূপে সত্ত্ব, রজঃ এবং তমোগুণের প্রভাবে জীব যেরূপ করে তদ্রপ ফল প্রাপ্ত হয়।
যাঁহারা মুক্তিকামী তাহারা গুণাতীত অর্থাৎ সমস্ত গুণের স্বভাবে আবদ্ধ না হইয়া মহাযোগী হইয়া মুক্তিসাধন করিবেন। কারণ—
যোগশ্চিত্তবৃত্তিনিরোধঃ ॥১॥ তদা দ্রষ্টুঃস্বরূপেবস্থান৷ ২ ॥ ইহা যোগ শাস্ত্র পাতঞ্জলের সূত্র
মনুষ্য রজোগুণ ও তমোগুণযুক্ত কর্ম হইতে মনকে বিরত করিয়া শুদ্ধ সত্ত্বগুণযুক্ত কর্ম দ্বারা মনকে বশীভূত করিয়া শুদ্ধসত্ত্বগুণযুক্ত হইলে তাহাকে নিরোধ করিয়া একাগ্র অর্থাৎ এক পরমাত্মা এবং ধর্মযুক্ত কর্মইহাদের অগ্রভাগে চিত্তকে স্থির রাখা ‘নিরুদ্ধ’অর্থাৎ সকল বিষয় হইতে চিত্তবৃত্তিকে রুদ্ধ করিবে ॥ ১।
যখন চিত্ত একাগ্র ও নিরুদ্ধ হয়, তখন সর্বদ্রষ্টা ঈশ্বরের স্বরূপে জীবাত্মার স্থিতি হইয়া থাকে ৷ ২ ॥ এই সকল সাধন মুক্তির জন্য অবলম্বন করিবে এবং ॥
অথ ত্রিবিধদুঃখাত্যন্তনিবৃত্তিরত্যন্তপুরুষার্থঃ ॥ ইহা সাংখ্যর সূত্র ॥
আধ্যাত্মিক অর্থাৎ শরীর সম্বন্ধীয় পীড়া, আধিভৌতিক অর্থাৎ অন্য প্রাণীদিগের দ্বারা দুঃখপ্রাপ্ত হওয়া এবং আধিদৈবিক অর্থাৎ অতিবৃষ্টি অতি তাপ, শীত, মন এবং ইন্দ্রিয়ের চঞ্চলতা হইতে যে দুঃখ উৎপন্ন হয়, এই ত্রিবিধ দুঃখ হইতে মুক্তিলাভ পরম পুরুষার্থ।
অতঃপর আচার, এবং ভক্ষাভক্ষ্য বিষয় লিখিত হইবে।
ইতি শ্রীমদ্দয়ানন্দ সরস্বতী স্বামীকৃতে
সত্যার্থপ্রকাশে সুভাষবিভূষিতে বিদ্যা বিদ্যা বন্ধমোক্ষ বিষয়ে
নবমঃ সমুল্লাসঃ সম্পূর্ণ ॥ ৯ ॥