অধ্যায় ৯
বিজ্ঞান ও নৈতিকতা
বিজ্ঞানের অপ্রতুলতায় যারা বিশ্বাস করেন, যেমনটা আমরা এর আগের অধ্যায় দুটোতে দেখলাম, তাঁরা এই ঘটনায় বিশ্বাস রাখেন যে, মূল্যবোধ’ নিয়ে বিজ্ঞানের কিছু বলার নেই। এটা আমি স্বীকার করি। কিন্তু যখন এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছনো হয় যে, মূল্যবোধ যে-সত্য ধারণ করে, সেটা বিজ্ঞান প্রমাণ বা অপ্রমাণ করতে পারে না, তখন আমি এ-কথাটা অস্বীকার করি। পদার্থ এমন একটা কিছু যার সম্পর্কে পরিষ্কার ভাবনা-চিন্তা করা আদপেই সহজ নয়। এ সম্পর্কে তিরিশ বছর আগে যে ধারণা ছিল আমার ধারণা তার থেকে আলাদা। কিন্তু এটা সম্পর্কে পরিষ্কার হওয়া দরকার যদি আমরা পরম উদ্দেশ্যের তত্ত্ব সম্পর্কে এ-ধরণের যুক্তিগুলো যাচাই করে দেখতে চাই। নৈতিকতা সম্পর্কে মতবাদগুলোর কোনো ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি। এই কারণে এটা অবশ্যই বুঝতে হবে যে, যা ধারণা করব, সেসব আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, বিজ্ঞানের প্রবচন নয়।
ঐতিহ্যগতভাবে, নৈতিকতার গঠন-পাঠনের দুটো ভাগ। একটা নৈতিক মূল্যবোধের সঙ্গে যুক্ত। অন্যটির কথা, ভালোর নিজস্ব ধারণার ভালো কী, এ বিষয়টা। আচরণবিধির অনেকগুলোর একটা অনুষ্ঠানগত মৌলিকতা আছে। এটা অসভ্য এবং আদিম মানুষের জীবনে একটা বিরাট ভূমিকা পালন করে। গোষ্ঠীপ্রধানের থালা থেকে খাবার খাওয়া নিষিদ্ধ অথবা ছাগছানাকে তার মায়ের দুগ্ধপানে বিরক্ত না করা; দেবদেবীর কাছে আত্মত্যাগের নির্দেশ প্রদান, এগুলো উন্নতির একটা ধাপে ভীষণই প্রয়োজন যদিও এসব মানুষের জন্য নয়। অন্যান্য নৈতিক মূল্যবোধগুলো যেমন খুন ও চৌর্যবৃত্তির নিষিদ্ধকরণ, এগুলোর স্পষ্টতই অধিকতর সামাজিক উপযোগিতা রয়েছে। এবং এসব আদিম ধর্মতাত্ত্বিক প্রথার সঙ্গে মূলগতভাবে যুক্ত থাকায় এগুলো কালোত্তীর্ণ হয়েছে। কিন্তু মানুষের চিন্তাশীলতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তারা এসব বিধানের উপর কম জোর দিয়ে মনের অবস্থার উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করতে শুরু করেছে। এই পরিবর্তন দুটো উৎস থেকে উঠে এসেছে। একটি দর্শন। অন্যটি অতীন্দ্রিয় ধর্ম। আমরা সবাই পয়গম্বর এবং সুসমাচারের বক্তব্যগুলোর সঙ্গে সুপরিচিত। এসবে হৃদয়ের পবিত্রতাকে বিধান-এর খুঁটিনাটির চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেন্ট পল কর্তৃক বদান্যতার সবিশেষ প্রশংসা অথবা ভালোবাসা একই নীতি শেখায়। একই জিনিস খ্রিস্টীয় অথবা অখ্রিস্টীয় সমুদয় অতীন্দ্রিয়বাদীর মধ্যেই দেখা যাবে। এঁরা সবাই মনের অবস্থানকেই মূল্য দেন এবং এই মূল্য থেকেই, যেমনটা তারা মনে করেন, সঠিক আচরণ সুনিশ্চিত হবে। বিধানকে বাহ্যিক মনে হয় এবং এটা পরিস্থিতির সঙ্গে অপর্যাপ্তভাবে অভিযোজিত।
পন্থাসমূহের মধ্যে একটা পন্থায় বাহ্যিক আচরণবিধির কাছে আবেদনের প্রয়োজনীয়তা এড়িয়ে চলা হয়েছে। এই এড়িয়ে চলাটা আসলে ‘বিবেক’-এ বিশ্বাস রাখা। এটা আবার প্রটেস্টান্ট নৈতিকতায় একটা সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটা ধরে নেওয়া হয়েছে যে, কোনটি ঠিক এবং কোটা ভুল, ঈশ্বর এটা প্রতিটি মানবহৃদয়ের কাছে প্রকাশ করেন, যাতে পাপ এড়ানোর জন্য মানুষ কেবল অন্তরের বাণীটাই শুনতে পান। এই তত্ত্বে অবশ্য দুটো অসুবিধা রয়েছে। প্রথমত, বিবেক বিভিন্ন মানুষকে বিভিন্ন বাণী শোনাতে পারে। দ্বিতীয়ত, নির্জনের পাঠ আমাদেরকে ন্যায়পরায়ণতার জাগতিক কারণসমূহের ধারণা দিয়েছে।
বিবেকের বাণীর ভিন্নতা সম্পর্কে বলা যায়, তৃতীয় জর্জের বিবেক তাকে বলেছে যে, ক্যাথলিক মুক্তি মঞ্জুর করা তাঁর অনুচিত। কারণ তিনি যদি এটা করেন তাহলে তিনি করোনেশন ওথের শপথ ভঙ্গ করবেন। কিন্তু পরবর্তী সম্রাটদের এ-ধরনের কোনো ঔচিত্য-অনৌচিত্য বোধ ছিল না। বিবেক কাউকে কাউকে গরিবদের দ্বারা ধনীদের লুণ্ঠনপ্রবৃত্তিকে নিন্দা করতে পরিচালিত করে। এমনটা বলে থাকেন কমুনিস্টরা। অন্যদের আবার এই বিবেকই ধনীদের দ্বারা গরিবদের শোষণকে নিন্দা করতে বলে। এমন শোষণই পুঁজিপতিরা করে থাকে। বিবেকই একজনকে নির্দেশ দেয়, আগ্রাসনের সময় মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে। আবার অন্যকে বলে, যুদ্ধে অংশগ্রহণ অনিষ্টকর। মহাযুদ্ধের সময় কর্তৃপক্ষ, যাদের মধ্যে কেউ কেউ নৈতিকতার পাঠ নিয়েছেন, তাঁদের কাছে বিবেকটাকে জটিল রহস্য বলে মনে হয়েছিল। তারা কিছু কৌতূহলী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সেগুলো, একজন ব্যক্তির নিজের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য বিবেকসম্মত উচিত-অনুচিত বোধ থাকা দরকার। কিন্তু অন্য একজন মানুষের বিরুদ্ধে যিনি যুদ্ধক্ষেত্রে কর্মরত, তার বিরুদ্ধে লড়াই করা ঠিক নয়। তারা আরও মনে করেন যে, যখন বিবেক সব ধরনের যুদ্ধকে অনুমোদিত করে না, তখন চলতে-থাকা যুদ্ধকেও হতোদ্যম করাটা ঠিক নয়। যে-কোনো কারণেই হোক, যারা যুদ্ধ করাকে অন্যায় মনে করেছিলেন, তারা কিছুটা আদিম এবং ‘বিবেকের অবৈজ্ঞানিক ধারণায় তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
.
বিবেকের নির্দেশের বৈচিত্র হলো যখন এর মৌলিকতা বোঝা যাবে তখন প্রত্যাশাটা কী হবে। প্রথম যৌবনে কতিপয় ধরনের কার্যাবলী অনুমোদিত হয়। এবং অন্য কিছু কাজ অনুমোদিত হয় না। সংযুক্তির স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়, আনন্দ এবং অস্বস্তি কার্যাবলীর সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করে। এই যুক্ত করার ক্ষেত্রে অনুমোদন এবং অননুমোদনের কোনো ভূমিকা থাকে না। সময় চলতে থাকার সঙ্গে, আমরা আমাদের আগের নৈতিক প্রশিক্ষণ ভুলে যেতে পারি। তবু আমরা তখনও কতিপয় কাজ সম্পর্কে আমাদের অস্বস্তি অনুভব করি। আর অন্যান্য কাজ আমাদের নৈতিক উৎকর্ষের প্রভাব দিতে পারে। অন্তদর্শনে এসব উপলব্ধি রহস্যময়, কারণ যে-পরিস্থিতি মূলত এসব কাজের হেতু ছিল সেটাকে আমরা আর স্মরণে রাখি না। অতএব এটা স্বাভাবিক যে, এসব কাজকে হৃদয়ে ঈশ্বরের বাণী বলে মনে করি। কিন্তু আসলে বিবেক হলো শিক্ষার উপজাত। এই বিবেককে মানবজাতির বিপুল সংখ্যাধিক্য মানুষের মধ্যেই অনুমোদন কিংবা অননুমোদনের প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়, যেমনটা শিক্ষাবিদগণ উপযুক্ত মনে করবেন। সুতরাং বাহ্যিক নৈতিক বিধান থেকে নৈতিকতাকে মুক্ত করার ইচ্ছেটা একটা অধিকার। এটা অবশ্য বিবেকের ধারণার দ্বারা সন্তোষজনকভাবে লাভ করা কঠিন।
দার্শনিকগণ ভিন্ন পথে ভিন্ন অবস্থানে পৌঁছেছেন যেখানে আচরণের নৈতিক বিধানের একটা গৌণ স্থান রয়েছে। তারা ‘ভালো’র একটা ধারণা তৈরি করেছেন। এ ধারণার দ্বারা তারা বোঝাতে চাইছেন যে, যা অস্তিত্বশীল তাই আমরা দেখতে চাই। এই ধারণার মানুষেরা যদি আস্তিক হন তাহলে ভালো বলতে তাঁরা তাই বুঝবেন যা ঈশ্বরের কাছে আনন্দদায়ক। বেশিরভাগ মানুষই এ-বিষয়ে একমত হবেন যে, দুঃখের চেয়ে আনন্দ কাম্য, বন্ধুত্বহীনতার চেয়ে বন্ধুতাই কাম্য এবং এমনতর আরও কিছু। এই ধারণার তেমন নৈতিক বিধানগুলোই যুক্তিপূর্ণ যদি তারা নিজ থেকে যা-ভালো তার উন্নতি বিধানে সাহায্য করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খুন নিষিদ্ধ করার বিধানকে খুনের পরিণতি দিয়ে যুক্তি সিদ্ধ করা যায়। কিন্তু বিধবাদের তাদের স্বামীর চিতায় পুড়িয়ে মারার অভ্যাসের ন্যায্যতা যুক্তিসিদ্ধ করা যায় না। এই কারণে আগের বিধানটা রক্ষা করতে হবে, পরেরটা নয়। এমনকি সর্বশ্রেষ্ঠ নৈতিক বিধানের কতিপয় ব্যতিক্রম থাকে, কারণ কোনো ধরনের কাজেরই সর্বদা খারাপ পরিণতি হয় না। আমাদের তাহলে তিনটি পৃথক ধারণা রয়েছে যা দিয়ে বোঝা যায় একটা কাজ নৈতিকভাবে প্রশংসনীয় কেন। এগুলো হলো, (১) প্রাপ্ত নৈতিক আচরণ অনুযায়ী এটা হতে পারে (২) শুভ পরিণতির আন্তরিক ইচ্ছা থাকতে পারে (৩) এতে বাস্তবত উত্তম পরিণতি থাকতে পারে। যাই হোক, তৃতীয় ধারণাটা নৈতিকতায় অনুমোদিত। গোঁড়া ধর্মমত অনুসারে জুডাস ইসকেরিটাসের বিশ্বাসঘাতকতার কাজটার একটা উত্তম পরিণতি হয়েছিল কারণ প্রায়শ্চিত্তের জন্য এটা প্রয়োজনীয় ছিল। কিন্তু এই কারণেই এটা প্রশংসনীয় ছিল না।
বিভিন্ন দার্শনিক মহত্ত্বের’ নানা ধারণা গঠন করেছেন। কেউ কেউ মনে করেন, এটা ঈশ্বরের জ্ঞান ও ভালোবাসায় গঠিত। অন্যেরা মনে করেন, চিরন্তন ভালোবাসায়। অন্য অনেকের ধারণা, এটা আছে সৌন্দর্যের উপভোগে। অন্য অনেকের মনে হয় এটা রয়েছে আনন্দ উপভোগে। মহত্ত্বটা একবার সংজ্ঞায়িত হয়ে গেলে, অন্যান্য নৈতিকতা একে অনুসরণ করে। আমাদের অবশ্যই সেভাবে কাজ করা উচিত যেভাবে আমরা বিশ্বাস করি। এটা করা যায় সেভাবেই চেষ্টা করা উচিত। নৈতিক বিধি গঠন, যতক্ষণ চরম শুভ জ্ঞাত বলে ধারণা, এটাই বিজ্ঞানের বিষয়। উদাহরণস্বরূপ, চৌর্যবৃত্তির জন্য কি মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা উচিত? অথবা এই মৃত্যুদণ্ড কি কেবল খুনের ঘটনার জন্য নির্দিষ্ট থাকবে? নাকি এটা একদমই থাকবে না? জেরমি বেন্থাম আনন্দকে শুভ বলে মনে করতেন। কোন্ দণ্ডবিধি বেশি করে আনন্দ সৃষ্টি করবে এটা প্রচলনের লক্ষ্যে তিনি নিজেই কাজ করেছেন। অবশেষে তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, এই দণ্ডবিধি বর্তমানে প্রচলিত দণ্ডবিধির তুলনায় কম কঠোর হবে। কেবল আনন্দই শুভ, এই ধারণা ছাড়া বাকি সবকিছু বিজ্ঞানের পরিসরে আসবে।
এটা অথবা ওটা ‘শুভ’ বলে আমরা যা বুঝি, সেটা সুনির্দিষ্ট করতে যখন আমরা চেষ্টা করি, তখনই আমরা নিজেদেরকে বিরাট অসুবিধার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে ফেলি। বেন্থামের মতবাদ, আনন্দই হলো ‘শুভ’। তাঁর এই মতবাদ প্রবল বিরোধিতার মুখে পড়েছিল। এটাকে বলা হতো শূকরের দর্শন। তিনি কিংবা তার বিরোধীরা কোনো যুক্তি দিতে পারেননি। একটা বৈজ্ঞানিক প্রশ্নে, দুই তরফেই সাক্ষ্য হাজির করতে হয়। শেষ পর্যন্ত এক পক্ষের সাক্ষ্য অধিকতর ভালো বলে গণ্য হয়। অথবা, এটা যদি নাও ঘটে সেক্ষেত্রে প্রশ্নটা অমীমাংসিত থেকে যায়। কিন্তু প্রশ্নটা যদি এমন হয়, এটা কিংবা ওটা, কোনটা পরম শুভ? সেক্ষেত্রে কোনো তরফেই কোনো সাক্ষ্য নেই। প্রতিপক্ষ কেবল তার নিজের আবেগের কাছে আবেদন জানাতে পারে। এবং এমন বাগাড়ম্বড়পূর্ণ কৌশল অবলম্বন করতে পারে যাতে অন্যের মধ্যে এই একই ধরনের আবেগ জেগে ওঠে।
উদাহরণস্বরূপ, একটা প্রশ্নের কথা ধরুন, যেটা বাস্তব রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বেন্থাম বলেছেন যে, একজন মানুষের আনন্দ অন্য একজন মানুষের আনন্দের মতো একই গুরুত্ব রয়েছে, যদি পরিমাণটা একই হয়। এবং এই যুক্তিতে তিনি গণতন্ত্রের পক্ষে সওয়াল করলেন। পক্ষান্তরে, নিৎসে মনে করেন যে, কেবলমাত্র মহৎ ব্যক্তি নিজেদের কারণেই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হতে পারে এবং মানবজাতির অনেকেই তার কল্যাণের উপায়মাত্র। তিনি সাধারণ মানুষকে এমনভাবে দেখতেন যেভাবে অনেক মানুষ প্রাণীদের দেখে থাকে। সাধারণ মানুষকে ব্যবহার করাটা তিনি যুক্তিযুক্ত মনে করতেন। সাধারণ মানুষের ভালোর জন্য নয়, সুপারম্যানদের ভালোর জন্য। এবং এই ধারণাটাই সেই থেকে গণতন্ত্র বাতিল করাকে যুক্তিসিদ্ধ করতে গৃহীত হয়েছে। এখানে একটা বিশাল বাস্তব গুরুত্বের ব্যাপারে আমাদের তীব্র মতভেদ রয়েছে। কিন্তু আমাদের বৈজ্ঞানিক অথবা বৌদ্ধিক, আদৌ কোনো উপায় নেই যার দ্বারা আমরা একদলকে বোঝাতে পারি যে, অন্যরা সঠিক। এই বিষয়ে মানুষের মতামত পরিবর্তনের উপায় আছে সত্য, কিন্তু এসব উপায়সমূহ সবই আবেগগত, বৌদ্ধিক নয়।
‘মূল্যবোধ’-এর প্রশ্নে, অর্থাৎ পরিণতি ব্যতীত স্বাধীনভাবে কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ–এটা বলা বিজ্ঞানের এক্তিয়ারের বাইরে। এই কথাটাই ধর্মরক্ষাকারীরা জোরালোভাবে ঘোষণা করেন। আমি মনে করি এ-বিষয়ে তাঁরা সঠিক। কিন্তু আমি আরও একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছই, যে-সিদ্ধান্তে তারা পৌঁছন না, সেটা হলো, ‘মূল্যবোধ’-এর প্রশ্নটা পুরোপুরি জ্ঞানের এক্তিয়ারের বাইরে। এ কথার অর্থ হলো, আমরা যখন বলি যে, এটা কিংবা ওটার মূল্যবোধ’ আছে, তখন আমরা কেবল আমাদের নিজেদের আবেগের প্রকাশ ঘটাই। এটা নয় যে, আমাদের ব্যক্তিগত অনুভূতি ভিন্নতর হলেও বিবৃত ঘটনাটা তখনও সত্যিই থেকে যাবে। এই বিষয়টা পরিষ্কার করতে আমাদের শুভ-এর ধারণাটাকে পরিষ্কার করার চেষ্টা করতে হবে।
এটা স্পষ্ট যে, ভালো ও মন্দের পুরো ধারণাটারই ‘ইচ্ছা’র সঙ্গে কিছু যোগাযোগ রয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে, আমরা সবাই যা পেতে ইচ্ছে করি তাই ‘ভালো’ এবং আমরা সকলে যেটা ভয় করি সেটা মন্দ। আমরা সবাই যদি আমাদের ইচ্ছার ব্যাপারে একমত হই, তাহলে বিষয়টাকে সেখানেই ছেড়ে দেওয়া যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমাদের ইচ্ছেগুলো দ্বন্দ্বে নামে। যদি আমি বলি আমি যা চাই সেটা ভালো’; আমার প্রতিবেশী বলবে, না, আমি যা চাই, সেটাই ভালো। যদিও এমনটা নয়, নৈতিকতা হলো, আমি যেমনটা ভাবি, একটা সফলতা, এই অহংচিন্তার থেকে সরে যাওয়া। প্রতিবেশীর সঙ্গে আমার বিরোধে স্বভাবতই আমি দেখাতে চেষ্টা করব যে, আমার ইচ্ছাগুলোর এমন কিছু গুণ রয়েছে যা প্রতিবেশীর ইচ্ছার থেকে বেশি সম্মান পেতে পারে। আমি যদি আমার অধিকার রক্ষা করতে চাই, আমি জেলার ভূমিহীন অধিবাসীদের কাছে আবেদন জানাবো। কিন্তু তিনি তার দিক থেকে ভূস্বামীদের কাছে আবেদন জানাবেন। আমি বলব, গ্রামের সৌন্দর্যের প্রয়োজনীয়তা কী যদি কেউ এটা চোখ মেলে না দেখেন?’ তিনি চটজলদি বলবেন কোন সৌন্দর্য বাকি থাকবে যদি প্রমোদ ভ্রমণকারীরা ধ্বংস ছড়িয়ে দেবার অনুমতি পায়?’ প্রত্যেকে তার সমর্থক বাড়াতে চান এটা দেখিয়ে যে, তার নিজের ইচ্ছেগুলো অন্য মানুষের ইচ্ছেগুলোর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। যখন এটা স্পষ্টতই অসম্ভব, যেমনটা সিঁধেল চোরের ক্ষেত্রে, তখন উক্ত ব্যক্তিটি জনমতে ধিকৃত হন এবং তার নৈতিক অবস্থানটা একজন পাপিষ্ঠের মতো হয়ে দাঁড়ায়।
নৈতিকতা হলো তাই রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। এটা একটা দলের যৌথ ইচ্ছেগুলোকে ব্যক্তিবিশেষের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। কিংবা বিপরীত ক্রমে, ব্যক্তির ক্ষেত্রে তার ইচ্ছেকে তার দলের ইচ্ছের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া। এই পরের ইচ্ছেটা অবশ্য তখনই সম্ভব যদি ইচ্ছেগুলো স্পষ্টতই সাধারণ স্বার্থের বিপরীতে না যায়। সিঁধেল চোর কখনোই মানুষকে এমনটা বোঝাতে চেষ্টা করবে না যে, মানুষের ভালো করছে, যদিও ধনদর্পীরা এরকম চেষ্টাই করছে এবং প্রায়ই সফল হচ্ছে। যখন আমাদের ইচ্ছেগুলো এমন জিনিসের জন্য সেগুলো সাধারণভাবে সবাই উপভোগ করতে পারে তখন এটা আশা করা যুক্তিসম্মত যে, অন্যেরা একমত হবেন। দার্শনিকরা সত্যবাদিতা, মহত্ত্ব এবং সৌন্দর্যকে মূল্য দেন। এগুলো তাঁদের নিজেদের কাছে নিজেদের ইচ্ছের প্রকাশ নয়, কিন্তু এগুলো মানবজাতির কল্যাণের নির্দেশ। সিঁধেল চোরের বিপরীতে দাঁড়িয়ে দার্শনিক এমন বিশ্বাসে সমর্থ যে, তার ইচ্ছেগুলোর এমন কিছুর জন্য সেগুলো নৈর্ব্যক্তিক অর্থেও মূল্যবান।
নৈতিকতা হলো এমন এক প্রয়াস যেটা কেবলমাত্র আমাদের কতিপয় ইচ্ছাকে ব্যক্তিগত নয়, চিরন্তন গুরুত্ব প্রদান করে। আমি আমাদের ইচ্ছেগুলোর মধ্যে কতিপয় কথাটা বলছি কারণ এমন আরও অনেক ইচ্ছে রয়েছে যেগুলো স্পষ্টতই অসম্ভব, যেমনটা আমরা সিঁধেল চোরের ক্ষেত্রে দেখেছি। যে-ব্যক্তি কিছু গুহ্য জ্ঞানের ভিত্তিতে স্টক এক্সচেঞ্জে টাকা বাড়াচ্ছেন, তিনি অন্যদের এই ব্যাপারে সমজ্ঞানী হবার কথা ভাববেন না। সত্যটা তার ক্ষেত্রে একটা ব্যক্তিগত অধিকার, দার্শনিকের সাধারণ মান্য মহত্ত্বের মতো নয়। এটা সত্য যে, একজন দার্শনিক যখন কিছু আবিষ্কারের দাবি করেন, তিনি তখন একজন শেয়ার বাজারের দালালের পর্যায়েও নামতে পারেন। কিন্তু এটা একটা বিচ্যুতি, কারণ তাঁর পূর্ণ দার্শনিক সামর্থ্যে তিনি কেবলমাত্র সত্যের প্রত্যাশা উপভোগ করতে চান এবং এটা করার জন্য তিনি কোনোভাবেই অন্যের ব্যাপারে নাক গলান না, অন্যেরাও এমনটাই করতে চান।
আমাদের ইচ্ছেগুলোকে চিরন্তন গুরুত্ব দেওয়া যায়। এটা নৈতিকতার কাজ। দুটো ধারণা থেকে এই চেষ্টা করা সম্ভব। একটা আইন প্রণেতার দিক থেকে। অন্যটা ধর্মপ্রচারকের দিক থেকে। প্রথমে আমরা আইন প্রণেতার দিকটা দেখব।
যুক্তির খাতিরে আমি ধরে নেব যে, আইন প্রণেতা ব্যক্তিগতভাবে অনাগ্রহী। বলা যায়, যখন তিনি তার একটা ইচ্ছেকে নিজের কল্যাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে চিনতে পারেন, তখন আইন প্রণয়ণে নিজেকে প্রভাবিত হতে দেন না। উদাহরণে বলা যায়, যেন তার ব্যক্তিগত ভাগ্যকে সুপ্রসন্ন করতে বিধানটা তৈরি হচ্ছে না। কিন্তু তার অন্য আরও ইচ্ছে রয়েছে যেগুলো নৈর্ব্যক্তিক বলে মনে হয়। তিনি রাজা থেকে কৃষক পর্যন্ত একটি সুশৃঙ্খল শ্ৰেণীকাঠামোতে বিশ্বাস করতে পারেন। কিংবা খনিমালিক থেকে চুক্তিবদ্ধ কালো শ্রমিক পর্যন্ত আর একটা শ্রেণীকাঠামোতে। তিনি বিশ্বাস করতে পারেন যে, নারীদের পুরুষদের প্রতি অনুগত থাকা উচিত। তিনি মনে করতে পারেন যে, নিচুশ্রেণীর মধ্যে জ্ঞানের বিস্তার বিপজ্জনক। এমনতর আরো অনেক কিছু। এমন হলে যদি তিনি পারেন, তাহলে তিনি এমন বিধান গড়ে তুলবেন যেটা হবে তার ব্যক্তিগত স্বার্থ অনুসারে। এই আত্মস্বার্থকেই তিনি বেশি মূল্য দেন। এবং তিনি নৈতিক নির্দেশের এমন একটা ব্যবস্থা গড়ে তুলবেন যেটা, যেখানে সফল হবে, মানুষকে নিকৃষ্ট বলে অনুভব করাবে, যদি তারা তাঁর(১) উদ্দেশ্য ছাড়া অন্যদের উদ্দেশ্য অনুসরণ করে। এইভাবে ‘সুনীতি’ একটা ঘটনা হয়ে দাঁড়াবে। যদিও বিষয়ীগত মূল্যবিচারে নয়, আইন প্রণেতার ইচ্ছের উপায়স্বরূপ। কারণ তিনি বিবেচনা করেন এসব ইচ্ছেগুলো চিরন্তন হবার যোগ্য।
ধর্মপ্রচারকের দৃষ্টিকোণ এবং পন্থা প্রয়োজনীয়ভাবে কিছুটা ভিন্নতর। কারণ তিনি রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করেন না এবং সেইকারণে নিজের এবং অন্যদের ইচ্ছেসমূহের মধ্যে একটি কৃত্রিম ঐক্য গড়ে তুলতে পারেন। তাই তার একমাত্র পন্থা হলো এটা চেষ্টা করা যে, তিনি নিজে যে ইচ্ছেটা পোষণ করেন সেটাকে অন্যদের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে। এই উদ্দেশ্যে তাকে আবেদন রাখতে হয় অন্যদের আবেগের কাছে। এভাবেই রাস্কিন মানুষকে গথিক স্থাপত্য পছন্দ করতে বলেছেন, যুক্তির সাহায্যে নয়, ছন্দময় গদ্যের চলমান প্রভাবের দ্বারা। ‘আঙ্কেল টমস্ কেবিন’ নিজেদের দাস হিসাবে কল্পনা করে দাসপ্রথা যে-খারাপ এমনভাবে ভাবতে বলেছে মানুষকে। কিছু জিনিস এমনিতেই ভালো (বা খারাপ); এসবের ফলাফলের উপর নির্ভরশীল নয়–এটা মানুষকে বোঝাতে প্রতিটি চেষ্টা নির্ভর করে অনুভূতি জাগানোর শিল্পকৌশলের উপর, সাক্ষ্যের প্রতি আবেদনের উপর নয়।
প্রত্যেকটি ঘটনায় ধর্মপ্রচারকের দক্ষতা নির্ভর করে নিজের আবেগের অনুরূপ আবেগ অন্যের মধ্যে জাগিয়ে তোলার দক্ষতায়। তিনি একজন কপট হলে এই দক্ষতা নির্ভর করে নিজের আবেগের বিপরীত আবেগ জাগিয়ে তোলায়। একজন ধর্মপ্রচারকের সমালোচনা হিসাবে নয়, আমি এটা বলছি তাঁর কাজের গুরুত্বপূর্ণ প্রকৃতি সম্পর্কে একটা বিশ্লেষণ হিসাবে।
একজন মানুষ যখন বলেন, এটা স্বভাবতই ভালো’ তখন তিনি একটা বিবৃতিই প্রদান করেন। যেমনটা, তিনি যদি বলতেন, এটা একটা চতুর্ভুজ অথবা ‘এটা মিষ্টি। এটাকে আমি মিথ্যা বলে বিশ্বাস করি। আমি মনে করি মানুষটি সত্যি সত্যি যা বোঝাতে চান, সেটা হল, আমি প্রত্যেককে এমনটা ইচ্ছে করতে বলি’ অথবা ‘প্রত্যেকে এমনটাই ইচ্ছে করবে।’ তিনি যা বলেন সেটা যদি বিবৃতি হিসাবে ব্যাখ্যা করতে হয়, এটা কেবল তাঁর ব্যক্তিগত ইচ্ছের একটা স্বীকৃতি। পক্ষান্তরে, এটা যদি সাধারণভাবে ব্যাখ্যা করা হয়, তাহলে এটা কিছুই ব্যক্ত করে না, কেবলমাত্র কিছু ইচ্ছে ‘প্রকাশ করে। একটা ঘটনা হিসাবে ইচ্ছেটা ব্যক্তিগত, কিন্তু এটা যা পেতে চায় সেটা চিরন্তন। আমার মতে, বিশেষ’ এবং ‘চিরন্তনের’ কৌতূহলী সংলগ্নতার ক্ষেত্রে এত বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে।
বিষয়টা সম্ভবত পরিষ্কার হতে পারে একটা নৈতিক বাক্যের সঙ্গে একটা বিবৃতির বৈশাদৃশ্য তুলনা করলে। যদি আমি বলি, সমস্ত চীনারাই বৌদ্ধ’ তাহলে আমার কথাটা প্রত্যাখান করা যেতে পারে একজন চীনা খ্রিস্টান অথবা একজন চীনা মুসলমানকে হাজির করে। যদি আমি এভাবে বলি, আমি বিশ্বাস করি যে, সমস্ত চীনারাই বৌদ্ধ’, তাহলে চীনের কোনো সাক্ষ্য থেকেই আমার কথাটা বাতিল করা যাবে না। কিন্তু আমার কথাটা বাতিল করা যাবে এমন সাক্ষ্য থেকে যে, আমি যা বললাম তা আমি বিশ্বাস করি না কারণ আমি যা বিবৃত করলাম সেটা কেবল আমার মনের একটা অবস্থা। এখন যদি একজন দার্শনিক বলেন, সৌন্দর্য ভালো, আমি এভাবে তাঁর কথাটার ব্যাখ্যা করতে পারি, এটা কি এমন যে, প্রত্যেকেই সৌন্দর্য ভালোবাসে’ (এরকম কথাটা হলো, সমস্ত চীনারাই বৌদ্ধ’) অথবা ব্যাখ্যা করতে পারি এভাবেও, আমি চাই প্রত্যেকেই সৌন্দর্যকে ভালোবাসুন’ (এরকম কথাটার মানে দাঁড়ায়, আমি বিশ্বাস করি যে সমস্ত চীনারাই বৌদ্ধ’)। এই বক্তব্যগুলোর মধ্যে প্রথম বক্তব্যগুলো কোনো বিবৃতি তৈরি করে না, একটা আকাঙ্খা ব্যক্ত করে; কারণ এটা কোনো কিছুই স্পষ্ট করে বলে না। এটা যৌক্তিকভাবেই অসম্ভব যে, এর পক্ষে বা বিপক্ষে সাক্ষ্য থাকবে অথবা সত্যতা কিংবা মিথ্যাত্ব থাকবে। দ্বিতীয় বাক্যটি কেবলমাত্র ইচ্ছাসূচক না হয়ে বিবৃতিমূলক হয়ে উঠেছে। কিন্তু এগুলো দার্শনিকের মনের অবস্থা হয়ে উঠেছে। এটা এমন সাক্ষ্য দিয়েই বাতিল করা যাবে যে, দার্শনিক যে-আকাঙ্খর কথা বলেছেন, সে আকাঙ্খা তার নেই। এই দ্বিতীয় বাক্যটি নৈতিকতার বিষয় নয়, মনোবিদ্যা অথবা জীবনীর বিষয়। প্রথম বাক্যটা যা নৈতিকতার। বিষয়, সেটা কোনো কিছুর আকাঙ্খা ব্যক্ত করে কিন্তু কোনো কিছু বিবৃত করে না।
উপরের বিশ্লেষণ সত্য হলে, নৈতিকতার সত্য বা মিথ্যা, কোনো বিবৃতি নেই, কিন্তু সাধারণ ধরনের কতিপয় আকাঙ্ক্ষা আছে। প্রধানত এমন আকাঙ্ক্ষা যা সাধারণভাবে মনুষ্যজাতির আকাক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এবং আকাঙ্ক্ষাগুলো সংশ্লিষ্ট দেবদেবী, দেবদূত, শয়তানদের আকাক্ষার সঙ্গেও, যদি তারা বাস্তবে থেকে থাকেন। বিজ্ঞান এই আকাঙ্ক্ষার কারণ নিয়ে আলোচনা করতে পারে, আলোচনা করতে পারে এগুলো পাবার উপায় নিয়েও। কিন্তু বিজ্ঞান সত্যিকারের নৈতিক বাক্য ধারণ করতে পারে না, কারণ এটা সত্য অথবা মিথ্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
যে-তত্ত্বটা আমি প্রতিষ্ঠা করতে চাইছি, সেটা হলো মতবাদের একটা রূপ, যাকে মূল্যবোধের দৃষ্টিভঙ্গি’ বলা হয়। এই মতবাদ মনে করে যে, যদি দু’জন ব্যক্তি মূল্যবোধ নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করে, তাহলে এই দু’জনের মধ্যে যে-কোনো ধরনের সত্য নিয়ে মতানৈক্য নেই, এটা হলো আসলে রুচির ভিন্নতা। যদি একজন বলে যে, ‘ঝিনুক ভালো এবং যদি অন্যজন বলে, আমি মনে করি ঝিনুক খারাপ’, এ নিয়ে তর্ক করার কিছু নেই। আলোচ্য তত্ত্বটা মনে করে, মূল্যবোধ নিয়ে সমস্ত ভিন্নতা এই ধরনের। যদিও আমরা স্বভাবতই এরকমটা মনে করি না যখন আমরা এমন বস্তু নিয়ে কাজ করি যেগুলো ঝিনুক থেকে বেশি উন্নত। এই ধারণা পোষণের প্রধান কারণ হলো, কোনো যুক্তি খুঁজে পাবার পরিপূর্ণ অক্ষমতা। এই অক্ষমতা প্রমাণ করতে পারে না যে, এটা অথবা ওটার মৌলিক মূল্য রয়েছে। আমরা সবাই যদি একমত হই তাহলে আমরা সহজাত জ্ঞানে মূল্য বুঝতে পারি। একজন বর্ণান্ধ ব্যক্তির কাছে আমরা প্রমাণ করতে পারি না যে, ঘাস সবুজ, লাল নয়। কিন্তু তার কাছে এটা প্রমাণ করার অনেক উপায় রয়েছে যে, বেশিরভাগ মানুষের মতো পার্থক্য করার ক্ষমতা তার নেই। কিন্তু মূল্যবোধের ক্ষেত্রে এ-ধরনের কোনো উপায় নেই। রঙের ক্ষেত্রের চেয়ে মূল্যবোধের ক্ষেত্রে মতানৈক্য অনেক বেশি ব্যাপক। মূল্যবোধ নিয়ে মতানৈক্যের পার্থক্য ঘোচাবার কোনো উপায়ের কথা কল্পনাও করা যায় না। এক্ষেত্রে সিদ্ধান্তটা আমাদের উপর চেপে বসে যে, মত পার্থক্যটা রুচির, কোনো বিষয়গত সত্যের নয়।
এই মতবাদটার পরিণামফল প্রচুর। প্রথমত, কোনো পরম ধারণায় ‘পাপ’ বলে কোনো জিনিস নেই। একজন ব্যক্তি যেটা ‘পাপ’ বলে মনে করেন, অন্য এক ব্যক্তি সেটাকেই ‘পুণ্য’ বলতে পারেন। এবং এই পার্থক্যের জন্য তার একজন অন্যজনকে অপছন্দ করতে পারেন। কিন্তু কেউ কাউকে বৌদ্ধিক ভুল করছেন বলে অভিযুক্ত করতে পারেন না। অপরাধী ব্যক্তিটি বজ্জাত, এই যুক্তিতে তার বিরুদ্ধে শাস্তিকে ন্যায্য বলে প্রতিপন্ন করা যায় না। শাস্তিকে ন্যায্য বলে প্রতিপন্ন করা যায় এইভাবে যে, অপরাধী এমনভাবে আচরণ করেছেন যেটাকে অন্যেরা নিরুৎসাহিত করতে চান। নরক, পাপিষ্ঠদের শাস্তির স্থান হিসাবে পুরোপুরি বিবেচনাহীন।
দ্বিতীয়ত, মুল্যবোধ সম্পর্কে কথা বলার ধরনটা বজায় রাখা অসম্ভব সেটা ঐশ্বরিক উদ্দেশ্যে বিশ্বাসীদের একটা সাধারণ ধারণা। তাদের যুক্তি হলো, কতিপয় বস্তু যেগুলোকে বিকশিত করা হয়েছে সেগুলো ভালো। সুতরাং বিশ্বের একটা উদ্দেশ্য থাকতেই হবে যেটা নৈতিকভাবে প্রশংসনীয়। বিষয়ীগত মূল্যবোধের ভাষায়, যুক্তিটা এমন দাঁড়ায় : পৃথিবীর কতিপয় জিনিস আমাদের পছন্দের, সুতরাং এগুলোকে একজন স্রষ্টার আমাদের রুচি অনুযায়ী সৃষ্টি করতেই হয়। এই স্রষ্টাকে আমরা পছন্দও করি এবং যিনি ফলত ভালো। এখন এটা পুরোপুরি স্পষ্ট যে, পছন্দ এবং অপছন্দ নিয়ে প্রাণীদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে হলে, তাদের নিজেদের পরিবেশে কিছু বস্তু তাদের পছন্দ করতেই হবে, নতুবা তাদের জীবন অসহ্য হয়ে উঠবে। আমাদের মূল্যবোধসমূহ আমাদের বাকি দৈহিক গঠন অনুযায়ী বিকশিত হয়েছে এবং মৌলিক উদ্দেশ্য বলে কোনো কিছুর সিদ্ধান্ত করা যায় না এমন ঘটনা থেকে যে, তারা তেমনই রয়েছে, যেমন তারা আছে।
যারা ‘বিষয়গত’ মূল্যবোধে বিশ্বাস করেন, প্রায়ই তারা বলেন যে, আমি যে ধারণার পক্ষে সওয়াল করছি তার অনৈতিক ফলাফল রয়েছে। আমার কাছে এটা ত্রুটিপূর্ণ যুক্তি বলে মনে হয়। ইতোমধ্যেই যেমনটা বলা হয়েছে, কতিপয় বিষয়ীগত মূল্যবোধের মতামতের নৈতিক ফলাফল রয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রতিহিংসা পরায়ণ শাস্তি এবং পাপে’র ধারণা। কিন্তু ব্যাপক সাধারণ ফলাফল যেগুলোকে ভয় করা হচ্ছে, যেমন, সমস্ত নৈতিক বাধ্যবাধকতার অবক্ষয়, এগুলো কিন্তু যৌক্তিকভাবে সিদ্ধান্তকৃত নয়। নৈতিক বাধ্যবাধকতা, এটাকে যদি আচরণকে প্রভাবিত করতে হয়, তাহলে এটাতে কেবল বিশ্বাস থাকলেই হবে না, আকাঙ্ক্ষাও থাকতে হবে। আকাঙ্ক্ষা হলো, আমাকে বলা হতে পারে যে, এটা এক অর্থে ‘ভালো’ হবার একটা ইচ্ছে, যেটা আমি অনুমোদন করি না। কিন্তু আমরা যখন আকাঙ্ক্ষাকে ‘ভালো’ বলে বিশ্লেষণ করি, এটা সাধারণভাবে নিজের একটা আকাঙ্ক্ষা করে তুলতে চায়। অথবা বিপরীতক্রমে কতিপয় সাধারণ ফলাফল আনতে চায় যেগুলো পেতে আমরা ইচ্ছে করি। আমাদের আকাক্ষা রয়েছে যেগুলো পুরোপুরি ব্যক্তিগত নয়, এবং আমাদের যদি এসব না থাকত, তাহলে কোনো পরিমাণ নৈতিক শিক্ষাই আমাদের আচরণকে প্রভাবিত করত না। যে-ধরণের জীবন আমরা বেশিরভাগ মানুষ তারিফ করি, সেটা বৃহৎ নৈর্ব্যক্তিক আকাক্ষা দ্বারা পরিচালিত। এখন এই ধরনের আকাক্ষা নিঃসন্দেহে উদাহরণ, শিক্ষা, জ্ঞান দ্বারা উৎসাহিত করা যায়। কিন্তু তাদের এমন বিমূর্ত বিশ্বাস দ্বারা সৃষ্টি করা যায় না যে এগুলো ভালো কিংবা ভালো’ শব্দটি দ্বারা যা বোঝায় তা বিশ্লেষণ করেও নিরুৎসাহিত করা যায় না।
আমরা যখন মানবজাতির কথা ভাবি, আমরা এমনটা আকাঙ্ক্ষা করতে পারি যে, এটা সুখী হবে অথবা স্বাস্থ্যবান অথবা বুদ্ধিশীল অথবা যুদ্ধবাজ প্রভৃতি। এর যে কোনো একটি আকাক্ষা যদি শক্তিশালী হয়, তাহলে এটা এর নিজের নৈতিকতা সৃষ্টি করবে। কিন্তু আমাদের যদি এ-ধরনের কোনো সাধারণ আকাক্ষা না থাকে, আমাদের আচরণ আমাদের মূল্যবোধ যাই হোক, এতে সামাজিক উদ্দেশ্য সাধন করবে না; যদি আত্ম-স্বার্থ এবং সামাজিক স্বার্থের মধ্যে সংহতি না থাকে। যতদূর সম্ভব জ্ঞানী প্রতিষ্ঠানগুলোর এ-ধরনের সংহতি তৈরি করাই কাজ। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পক্ষে আমাদের মূল্যবোধের তাত্ত্বিক সংজ্ঞা যাই হোক, আমাদের অবশ্যই নৈর্ব্যক্তিক আকাক্ষার অস্তিত্বের উপর নির্ভরশীল হতে হবে। আপনি এমন একজন ব্যক্তির সংস্পর্শে এলেন যার সঙ্গে আপনার নৈতিক মতানৈক্য রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, আপনি মনে করেন যে, সমস্ত মানুষই সমান, আর তিনি একটা শ্রেণীকে গুরুত্বপূর্ণ বলে বেছে নেন। আপনি তার সাথে মানিয়ে চলার কোনো উপায় খুঁজে পাবেন না যদি আপনি বিষয়গত মূল্যবোধে বিশ্বাস করেন, কিংবা না করেন। যে-কোনো ক্ষেত্রে, আপনি কেবল তার আকাঙ্ক্ষা প্রভাবিত করে, তার আচরণ প্রভাবিত করতে পারেন। এতে আপনি সফল হলে তার আচরণবিধি পরিবর্তিত হবে, যদি এতেও তার আচরণবিধির পরিবর্তন না ঘটে, তাহলে কখনও সেটা ঘটবে না।
কিছু মানুষ মনে করেন একটা সাধারণ আকাক্ষার, ধরা যাক, মানবজাতির সুখ, যদি পরম ভালোর অনুমোদন না থাকে, তাহলে এটা কোনো-না-কোনো ভাবে বিবেচনাহীন। এটা বিষয়গত মূল্যবোধের একটা দীর্ঘস্থায়ী বিশ্বাস। একটা বিশ্বাস স্বভাবতই বিবেচনাপ্রসূত অথবা বিবেচনাহীন হতে পারে না। এটা অন্যান্য আকাক্ষার সঙ্গে বিরোধে জড়াতে পারে এবং এর ফলে অসুখী হওয়ার দিকে পরিচালিত হতে পারে। এটা অন্যদের মধ্যে বিরোধিতা জাগিয়ে তুলতে পারে এবং এটা সন্তুষ্টির অযোগ্য। কিন্তু এটা বিবেচনাহীন’ বলে বিবেচিত হতে পারে না কারণ এটা অনুভব করার জন্য কোনো কারণ দর্শানো যায় না। আমরা ক-র আকাঙ্ক্ষা করতে পারি কারণ এটা খ-র একটা উপায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা যখন উপায়কে ত্যাগ করছি তখন আমাদের এমন কিছুতে আসতে হয় যেটা কোনো কারণ ছাড়াই আমরা আকাঙ্ক্ষা করেছি, কিন্তু সেই কারণেই এটা ‘বিবেচনাহীন ভাবে’ নয়। নৈতিকতার সমুদয় পদ্ধতিই তাদের আকাঙ্ক্ষাকে মূর্ত করে যারা সেসবের সওয়াল করে, কিন্তু এই ঘটনাকে শব্দের ধোঁয়াশায় গোপন করা হয়। বস্তুত আমাদের আকাঙ্ক্ষাসমূহ, যেমনটা অনেক নৈতিকতাবাদী কল্পনা করেন, তার চেয়ে অধিকতর সাধারণ এবং কম স্বার্থান্ধ। এটা যদি না হত, নৈতিকতার কোনো তত্ত্বই উন্নতির পক্ষে অসম্ভব হত। এটা বস্তুত, নৈতিক তত্ত্বের দ্বারা নয় বরঞ্চ ভয় থেকে মুক্তি, সুখ, বুদ্ধি এসবের বৃহৎ এবং মহৎ আকাক্ষার অনুশীলন দ্বারা মানুষকে বেশি কাজ করানো যায়। মানুষ বর্তমানে যে উপায়ে সাধারণ সুখের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ যে-পরিমাণ কাজ করছে, প্রস্তাবিত পরিমাণটা তার থেকে বেশি হবে। আমাদের ‘ভালো’-এর সংজ্ঞা যাই হোক এবং আমরা এটাকে বিষয়ীগত অথবা বিষয়গত যাই বলে বিশ্বাস করি না কেন, যারা মানবজাতির সুখের আকাঙ্ক্ষা করেন না, তাঁরা এটাকে প্রসারিত করার চেষ্টা করবেন না। এবং যারা এটা পেতে চান তারা এটা পেতে, যা পারেন, তাই করবেন।
আমি সিদ্ধান্ত করছি এই বলে, এটা সত্য যে, বিজ্ঞান মূল্যবোধের প্রশ্নটার ফয়সালা করতে পারে না। এর কারণ এই প্রশ্নগুলোকে আদৌ বৌদ্ধিকভাবে নিষ্পত্তি করা যায় না। এবং এগুলো সত্য এবং মিথ্যার চৌহদ্দির বাইরে থাকে। যেটুকু জ্ঞান আয়ত্ত করা যায়, সেটুকুই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আয়ত্ত করতে হবে। এবং বিজ্ঞান যা আবিষ্কার করতে পারে না, তা মানবজাতি জানতেও পারে না।
——–
১. অ্যারিস্টটলের সমসাময়িক জনৈক (গ্রিক নয়, চৈনিক) ব্যক্তির নিচের উপদেশটা তুলনা করুন : শাসকদের এমন ব্যক্তিদের কথা শোনা উচিত নয় যারা নিজেদের মতামত থাকা ব্যক্তিদের বিশ্বাস করেন এবং ব্যক্তিবিশেষের গুরুত্বেও বিস্বাস রাখা ঠিক নয়। এই ধরনের শিক্ষা মানুষদের নির্জন স্থানে চলে যাবার কারণ হিসাবে কাজ করে এবং এরা গুহায় কিংবা পাহাড়ের উপরে লুকিয়ে থাকেন, সেখান থেকে ক্ষমতাসীন সরকারকে তিরস্কার করেন, কর্তৃত্বে-থাকা ব্যক্তিদের প্রতি অবজ্ঞা দেখান, পদমর্যাদার গুরুত্ব ও পারিশ্রমিক তুচ্ছ করেন এবং অফিসের পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের ঘৃণা করেন। Waley-এর, The Way and its Power, পৃষ্ঠা ৩৭ দ্রষ্টব্য।