বিচারপতি তোমার বিচার
জঙ্গল ঠিক বলা যায় না। গাছগাছালি আর ঘন ঝোপঝাড় বেশ কিছুটা অংশ জুড়ে। তপসিয়া থেকে পায়ে হেঁটে লাগল মাত্র মিনিট সাতেক। সবে আলো ফুটেছে ভোরের। রাতের গন্ধ এখনও মুছে যায়নি পুরো। চারদিকে একবার তাকায় উনিশ বছরের যুবক। কলকাতায় সে এসেছে আগে বেশ কয়েকবার। এই জায়গাটার কথা জানাই ছিল না। শহরের মধ্যেই, অথচ কে বলবে শহর? এত শান্ত, এত সবুজ? কিন্তু সুনীলদা এই কাকভোরে এখানে নিয়ে এল কেন?
—একটা পরীক্ষা নেব আজ… দেখি পাশ করতে পারিস কিনা… ওই গাছটা দ্যাখ…
বেশ দশাসই চেহারা গাছটার। লম্বায় যেমন, চওড়াতেও। একবার দেখলে বেশ একটা সমীহ জাগে। আরেকবার দেখতে ইচ্ছে হয়, সময় নিয়ে। সুনীল সোজা চলে গেলেন গাছের সামনে। পকেট থেকে বার করলেন চক, প্রকাণ্ড গুঁড়ির গায়ে বৃত্ত আঁকলেন একটা।
—এই হল তোর চাঁদমারি। চেম্বারে ছ’টা গুলি আছে। মানে চান্স ওই ছ’টাই। দূরে গিয়ে দাঁড়া… আরও পিছনে… হ্যাঁ… এইবার ঠিক আছে…
সুনীল রিভলভার হাতে তুলে দেন যুবকের। পিঠ চাপড়ে দেন একটু। আগ্নেয়াস্ত্র হাতে পজিশন নেন যুবক, সাতপাঁচ চিন্তা ধেয়ে আসে। স্নায়ু চঞ্চল হয়ে ওঠে।
লক্ষ্যভেদের পরীক্ষা? সুনীলদা আগে বলেনি কেন? বললে মানসিকভাবে কিছুটা প্রস্তুত থাকা যেত। এভাবে হুট করে বললে হয়? নাকি ইচ্ছে করেই আগে বলেনি? কত তাড়াতাড়ি মনকে তৈরি করতে পারি, পরখ করছে? তবে করছে যখন, নিশ্চয়ই কোনও দায়িত্ব দেওয়ার কথা ভাবছে। শিরা-ধমনীতে উত্তেজনার স্রোত টের পান যুবক। এবং নিজেই নিজেকে তিরস্কার করেন নিরুচ্চার… এখন উত্তেজিত হলে টার্গেট মিস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা… মনঃসংযোগ দরকার। নির্দিষ্ট দূরত্বে দাঁড়িয়ে রিভলভার তাক করেন। পাখির চোখ ওই চক দিয়ে আঁকা বৃত্ত।
সুনীল পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। দেখছেন।
ছ’টার মধ্যে দুটো লক্ষ্যভ্রষ্ট। চারটে ‘বুলস আই’। বিঁধেছে একদম সাদা বৃত্তের মাঝখানে। সুনীল গুঁড়ির কাছে গিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন। শান্ত পায়ে ফিরে এসে জড়িয়ে ধরেন যুবককে… ‘সাবাশ!’
—আমি তা হলে অ্যাকশনের জন্য ফিট, সুনীলদা?
সুনীল হেসে পিঠে হাত রাখেন, ‘অত উতলা হলে চলে?’
.
বিয়েবাড়ির ব্যস্ততাকেও যেন হার মানিয়ে দেবে আয়োজন। সাতসকালেই ভিড় জমিয়েছে ছাত্র-যুবকেরা। তেরঙা পতাকায় সাজানো হচ্ছে সমিতির ঘর। কিন্তু মাঝারি আয়তনের ঘরে কী করে অত লোক ধরবে? খবর তো ছড়িয়েই পড়েছে, আশেপাশের গ্রাম থেকেও ছেলেছোকরারা আসবে দল বেঁধে। বাইরে মঞ্চ বাঁধা ছাড়া উপায় নেই। কাজও শুরু হয়ে গিয়েছে কাঠের পাটাতন তৈরির, সাদা চাদরে মুড়ে দিয়ে চেয়ার-টেবিল পাতার।
হন্তদন্ত হয়ে তদারকিতে সমিতির কর্তাব্যক্তিরা, যাঁদের বিয়েবাড়ির আগের সন্ধ্যার কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার মতো দেখাচ্ছে। হ্যাঁ রে, মাইক তো এখনও এল না? রাস্তায় যে কাগজের পতাকা দিয়ে চেন ঝোলানোর কথা ছিল একটাও তো দেখছি না? আখড়ার ঘরটা ভাল করে ঝাঁট দেওয়ার সময় হল না কারও? তাড়াতাড়ি কর বাবা তোরা, উনি আর ঘণ্টাদুয়েকের মধ্যে এসে পড়বেন যে!
‘উনি’-ই প্রধান অতিথি আজ জয়নগর ব্যায়াম সমিতির বার্ষিক সভায়। ‘উনি’ আসছেন শুনেই উৎসাহের বান ডেকেছে এলাকার সর্বত্র। ‘ওঁকে’ স্বাগত জানাতেই সীমিত সাধ্যে আয়োজনের আড়ম্বর।
গাড়ি যখন ঢুকল ব্যায়াম সমিতির অপ্রশস্ত রাস্তায়, কালো মাথায় ঢেকে গিয়েছে যেদিকে দু’চোখ যায়। জয়ধ্বনি উঠছে মুহুর্মুহু। সৌম্যকান্তি দীর্ঘদেহী মানুষটি গাড়ি থেকে নামলেন। দৃঢ় পদচারণায় উঠলেন মঞ্চে। শুরুতেই উচ্চারণ করলেন, ‘বন্দে মাতরম!’
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু! পরিচিত চেহারাটা দেখে উল্লাসে ফেটে পড়ল জনতা, সহস্র কণ্ঠের আওয়াজে ধ্বনিত হল ‘বন্দে মাতরম’!
ব্যায়াম সমিতির কর্তা সুনীল চ্যাটার্জীর নজর আটকে যায় একেবারে সামনের সারিতে জয়ধ্বনি দিতে থাকা যুবকের উপর। শক্তসমর্থ চেহারা, উজ্জ্বল দুটি চোখ। গলার শিরা ফুলিয়ে স্লোগান দিচ্ছে মুষ্টিবদ্ধ হাত ঝাঁকিয়ে। কে ছেলেটা? মুখটা চেনা লাগছে, এলাকারই নিশ্চয়ই, কিন্তু সমিতির আখড়ায় দেখেননি কখনও। এর মতো ছেলেই দরকার এখন। নেতাজি ফিরে যাওয়ার পর খোঁজ নিতে হবে। কে ছেলেটা?
.
—মা.. কলকাতার বাইরে যাচ্ছি কয়েকদিনের জন্য। ফিরতে দেরি হতে পারে।
—কোথায় যাচ্ছিস? ফিরতে দেরি হবে মানে? কত দেরি, কী কাজ? সঙ্গে কে যাচ্ছে? মায়ের প্রশ্নবাণে বিরক্তই বোধ করে ছেলে।
—এখনই বলা যাবে না কত দেরি হবে। সমিতির কাজ আছে।
মধ্যবয়সি মহিলা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, কথা বাড়ান না আর। এতদিনে বুঝে গেছেন, হাজারবার জিজ্ঞেস করলেও আর জবাব পাওয়া যাবে না। মাসকয়েক হল এই এক নতুন হুজুগে মেতেছে ছেলে। কী? না, সমিতি!
টানাটানির হতদরিদ্র সংসার, স্বামী গত হয়েছেন। বড়ছেলে তবু কলকাতায় একটা মোটামুটি চাকরি জুটিয়েছে। যত চিন্তা এখন ছোটছেলেকে নিয়েই। পড়াশুনোয় কোনওদিনই বিশেষ মনোযোগ ছিল না, কিন্তু বয়স আঠারো পেরিয়ে উনিশ। চাকরিবাকরির কিছু একটা চেষ্টাচরিত্র তো করতে হবে এবার। তা না, দিনরাত ওই সমিতিতে পড়ে থাকা। পাড়ার লোকে বলাবলি করে, ওটা নামেই ব্যায়াম সমিতি। আসলে নাকি ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের আখড়া।
শোনার পর থেকেই ভয় আরও গাঢ় হয়েছে মনে। ছেলে ছোট থেকেই যা ডাকাবুকো প্রকৃতির, কোনও বিপদে জড়িয়ে পড়বে না তো ওই স্বদেশিদের পাল্লায় পড়ে? এই যে বলছে, ফিরতে দেরি হবে…কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে, কিচ্ছুটি বলবে না। ভয় হবে না? ছেলের অবশ্য তাতে থোড়াই কেয়ার।
—চিন্তা কোরো না মা.. বলছি তো..বেশি দেরি হলে চিঠি লিখব..
.
‘Lt. Col. Simpson was shot dead. Mr J W Nelson, judicial secretary, was wounded in the leg. Another bullet narrowly missed Mr. A. Marr, Finance member….’
উপরের উদ্ধৃতি ১৯৩০-এর ৯ ডিসেম্বরের ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে। প্রসঙ্গ, ৮ ডিসেম্বরের রোমহর্ষক ‘অলিন্দ-যুদ্ধ’, রাইটার্স বিল্ডিংয়ে বিনয়-বাদল-দীনেশের দুঃসাহসিক অভিযান। সর্বজনবিদিত, সিম্পসনকে হত্যা করার পর বাদল আত্মহত্যা করেন পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে। বিনয় আত্মহত্যার চেষ্টা করেন গুলি চালিয়ে এবং ১৩ ডিসেম্বর প্রয়াত হন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। ত্রয়ীর মধ্যে দীনেশ গুপ্ত শুধু বেঁচে যান, বিষ খাওয়া এবং গুলি চালিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করার পরেও।
ব্রিটিশ সরকার চিকিৎসাধীন দীনেশের পরিচর্যায় বিন্দুমাত্র ত্রুটি করেনি। বরং পরম যত্নে তাঁকে বাঁচিয়ে তুলেছিল, যাতে স্পেশ্যাল ট্রাইব্যুনালের বিচার-প্রহসনের সাতপাকে বেঁধে ফেলা যায় অকুতোভয় যুবককে, মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দৃষ্টান্তমূলক বার্তা পৌঁছে দেওয়া যায় বিপ্লবীদের কাছে। ১৯৩১–এর ৭ জুলাইয়ের শেষ রাতে ফাঁসিকাঠের পাটাতন সরে গিয়েছিল দীনেশের পায়ের তলা থেকে।
সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়েছিল, ‘Dauntless Dinesh Dies at Dawn.’। কলকাতা কর্পোরেশনের সভায় গৃহীত হয়েছিল প্রস্তাব, ‘This corporation records its sense of grief at the execution of Dinesh Chandra Gupta who sacrificed his life in the pursuit of his ideal.’
দীনেশের ফাঁসি বঙ্গজ বিপ্লবীদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বারুদে অগ্নিসংযোগের কাজ করল। দীনেশের নিজের হাতে গড়া মেদিনীপুর শাখার Bengal Volunteers (বিভি)-এর বিপ্লবীরা ফেটে পড়লেন ক্রোধে। যত দ্রুত সম্ভব প্রত্যাঘাতের সিদ্ধান্ত হল। যার পরিণতিতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কর্নেল জেমস পেডিকে হত্যা করলেন যতিজীবন ঘোষ এবং বিমল দাশগুপ্ত। বিমলকে চিহ্নিত করল পুলিশ, কিন্তু ধরতে পারল না। বিমল ফেরারি হলেন।
পেডি-হত্যা ছিল প্রতিশোধস্পৃহার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া মাত্র। আসল লক্ষ্য ছিলেন স্পেশ্যাল ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট Ralph Reynolds Garlick, যিনি দীনেশ গুপ্তের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছিলেন। যিনি বিচারাধীন বিপ্লবীদের প্রতি বরাবরই ছিলেন খড়গহস্ত, রাজদ্রোহের যে-কোনও মামলায় অভিযুক্তের প্রতি ছিলেন মাত্রাছাড়া নির্মম।
এহেন গার্লিক সাহেবকে কৃতকর্মের ফল পেতেই হবে, সংকল্প করলেন বিপ্লবীরা। কিন্তু করবে কে কাজটা?
.
কানাইলাল ভট্টাচার্য। উনিশ বছরের চনমনে যুবক, বাড়ি জয়নগর থানার মজিলপুর অঞ্চলে। যাকে জয়নগর ব্যায়াম সমিতির বার্ষিক সভায় চোখে পড়ল এলাকার নেতৃস্থানীয় বিপ্লবী সুনীল চ্যাটার্জীর। নেতাজির নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছে সোৎসাহে। কে ছেলেটা? খোঁজ নিতে হবে সভা মিটে গেলে, সাতদা-কেও বলতে হবে।
‘সাতদা’। সাতকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়। পেশায় হোমিয়োপ্যাথি ডাক্তার। চেম্বার বারুইপুরে। রোগীর আনাগোনা লেগেই আছে অবিশ্রান্ত। আর যাওয়া-আসা ছেলের দলের। চব্বিশ পরগনার বিপ্লবী দলগুলির সর্বজনশ্রদ্ধেয় অভিভাবক। সুনীল অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন সাতদা-র। জয়নগর-মজিলপুরে ব্যায়াম সমিতির প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে রয়েছে সাতদা-রই আশীর্বাদ। স্বয়ং নেতাজি বিশেষ পছন্দ করেন সাতকড়ি ডাক্তারকে। সাতদা-রই অনুরোধে জয়নগরে সুভাষচন্দ্র বসুর পদার্পণ ব্যায়াম সমিতির বিপ্লবীদের উৎসাহ দিতে।
গার্লিক-নিধনের ছক কষা শুরু হল। সুনীল চ্যাটার্জীর উপর দায়িত্ব দিলেন সাতদা, উপযুক্ত ছেলে খুঁজে বার করার। নির্দেশ স্পষ্ট, অ্যাকশন করতে যাওয়ার সময় শুধু রিভলভার নয়, বিষও থাকবে সঙ্গে। কাজ হাসিলের পর পালাতে পারলে ভাল, না পারলে আত্মহত্যা। ধরা দেওয়া যাবে না, কোনও পরিস্থিতিতেই না।
‘ছেলে’ খুঁজে পেতে বিশেষ কষ্ট করতে হল না সুনীলকে। ততদিনে কানাই যোগ দিয়েছে ব্যায়াম সমিতিতে, দীক্ষিত হয়েছে বিপ্লবের মন্ত্রে। সমিতির একঝাঁক তরুণ তুর্কি তখন অ্যাকশনের জন্য মরিয়া। তাত্ত্বিক আলোচনায় তেমন আগ্রহ নেই তাদের, উৎসাহ নেই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায়। মূলধন বলতে শুধু আবেগ আর সাহস। দেশের জন্য কিছু করতে হবে, তাতে মরতে হলে হবে। এই দলে সকলের মধ্যে সহজেই আলাদা করা যায় কানাইকে। পেটানো চেহারা তার, শরীরচর্চার জন্য ব্যায়াম সমিতিতে হাজিরার প্রয়োজন নেই এমনিতে। প্রায় প্রতিদিনই সন্ধের পর সুনীলদা’র কাছে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে, ‘কাজ দেবে না কিছু? কুস্তি-লাঠিখেলা ভাল লাগছে না আর। চান্স দিয়ে দেখোই না একবার অ্যাকশনের, রিভলভার চালানোটা রপ্ত করে ফেলেছি।’
‘চান্স’ এল ১৯৩১–এর জুলাইয়ে। হাজরা রোডে একটি মেসের তিনতলায় একটি ঘর ভাড়া করে রেখেছিলেন সুনীল। কলকাতায় এলে ওখানেই উঠতেন, চলত বিপ্লবীদের গোপন বৈঠক। বাকি সময় ঘর থাকত তালাবন্ধ। সুনীলের নির্দেশে তাঁর দুই সহযোগী কানাইকে জয়নগর থেকে নিয়ে এলেন কলকাতায়। সেদিন ২৫ জুলাই। হঠাৎ তলবে কানাই অবাক, কিছুটা উত্তেজিতও। ঘটনাচক্রে কানাইয়ের মা-ও তখন কলকাতায়, বড়ছেলের বাড়িতে উঠেছেন। সুনীলকে প্রশ্নে প্রশ্নে অতিষ্ঠ করে তুললেন কানাই, উত্তরে জুটল মৃদু হাসি আর পিঠ চাপড়ানি, ‘ঠিক সময়ে সব জানতে পারবি। কাল ভোরভোর উঠবি, একটা জায়গায় নিয়ে যাব।’
‘জায়গা’ বলতে তপসিয়ার কাছে, গাছপালা-ঝোপঝাড়ে ভর্তি ভূখণ্ড। যেখানে কানাইয়ের হাতে রিভলভার তুলে দিয়ে লক্ষ্যভেদের মহড়া নিলেন সুনীল, ‘এই হল তোর চাঁদমারি, চেম্বারে ছ’টা গুলি আছে। মানে চান্স ওই ছ’টা…’
কানাই এতক্ষণে আন্দাজ করে ফেলেছে, তাকে বাছা হয়েছে কোনও অ্যাকশনের জন্য। সুনীলদা এখনও পুরোটা ভাঙছে না, দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর নিয়ে এসেছে আলিপুর কোর্টে। ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছে সব, ‘এইটা মুনসেফ কোর্ট, এখানে সাব-জজরা বসেন। এই বড় ঘরটা হল বার লাইব্রেরি। আর এই লম্বা জায়গাটায় টাইপিস্টরা বসেন। সব ভাল করে দেখে রাখ, কোথা দিয়ে ঢুকলাম আর কোন দিক দিয়ে বেরব। বেরনোর আগে সেশন জজের এজলাসটা দেখিয়ে দিই চল। গার্লিক সাহেব যেখানে বসেন।’
গার্লিক সাহেব! শরীরে অ্যাড্রিনালিনের বাড়তি ক্ষরণ নিমেষে টের পায় কানাই। সেই গার্লিক, যে বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তের ফাঁসির হুকুম দিয়েছিল? সুনীলদার হাত চেপে ধরে কানাই।
—সুনীলদা! তা হলে কি…
সুনীল রাশ টানেন সঙ্গী যুবকের উত্তেজনার।
—বলেছি না উতলা হবি না! ঠান্ডা মাথায় দেখে নে ঘরটা।
ঘরের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে রিভলভারধারী সার্জেন্ট। প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে একাধিক চিঠি সম্প্রতি পেয়েছেন গার্লিক। সরকার নিরাপত্তা বাড়িয়ে দিয়েছে এজলাসে। উকিল-মোক্তার বা সাধারণ মানুষ, যে-ই ঢুকছে ঘরে, সার্জেন্টের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আগে জরিপ করে নিচ্ছে আপাদমস্তক। এজলাসে ঢুকে একটা বেঞ্চে বসেন সুনীল। পাশে কানাই, যে শান্তভাবে তখন চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে ঘরের ডাইনে-বাঁয়ে-সামনে-পিছনে। কয়েকটা তাগড়াই চেহারার লোক জজসাহেবের পিছনে দাঁড়িয়ে। ওরা কারা? সাদা পোশাকের পুলিশ?
শ্রাবণের কলকাতায় তখন বর্ষার একচ্ছত্র দাপট। কোর্ট থেকে ফেরার পথে কানাইয়ের জন্য এক জোড়া ক্যাম্বিসের জুতো কিনলেন সুনীল। ছাতা জয়নগর থেকে নিয়েই এসেছে কানাই। মেসে ফেরা হল যখন, বিকেল গড়িয়ে সন্ধে।
—কানাই… এক কাজ কর.. চট করে মায়ের কাছ থেকে ঘুরে আয় একবার.. মাসিমা তো এখন তোর দাদার বাড়িতে, না?
—হ্যাঁ।
—বলবি… কলকাতার বাইরে যাচ্ছিস কাজে। ফিরতে দেরি হতে পারে।
রাতের খাওয়া মায়ের কাছেই সারলেন কানাই। অগ্রাহ্য করলেন উদ্বিগ্ন প্রশ্নমালা।
—চিন্তা কোরো না মা .. বললাম তো, বেশি দেরি হলে চিঠি লিখব।
.
মেসে ফেরার পর সব খুলে বললেন সুনীল। কানাই যা আন্দাজ করেছিল, তা-ই। গার্লিক সাহেবকে হত্যা করে দীনেশের ফাঁসির বদলা! কাগজ-কলম বার করে কানাইয়ের হাতে দিলেন সুনীল।
—নে… লেখ…
—কী?
—লেখ… ‘বন্দে মাতরম! ধ্বংস হও; দীনেশ গুপ্তর অবিচারে ফাঁসি দেওয়ার পুরস্কার লও: ইতি—বিমল গুপ্ত।’
—লিখলাম… এর পর?
—এই লেখাটা, মানে চিরকুটটা.. রাখবি ডান পকেটে, আর এই পটাশিয়াম সায়ানাইডের প্যাকেট বাঁ পকেটে। ছ’ ঘরা এই রিভলভারটা ছাতার মধ্যে। খেয়াল রাখিস, loaded কিন্তু! Suicide squad-এর যে তালিকা পুলিশের কাছে আছে, তাতে কানাইলাল ভট্টাচার্যের নাম নেই। কেউ চেনে না তোকে। এটা অ্যাডভান্টেজ। ভগবান না করুন, যদি তুই পালাতে না পারিস, বিষটা মুখে ফেলে দিবি। পুলিশ তোর পকেটে চিরকুট পাবে, ভাববে, তুই-ই ম্যাজিস্ট্রেট পেডি-র হত্যাকারী পলাতক বিমল দাশগুপ্ত। ভুল ভাঙবে, কিন্তু আসল আততায়ীর হদিশ পাবে না। বুঝলি?
কানাই মাথা নাড়েন, আর সুনীল বলতে থাকেন।
—তুই আগে যাবি, বেরবি বারোটা নাগাদ। আমি একটু পরে যাব ট্যাক্সিতে। একবার উপরে গিয়ে দেখেও আসব তোকে। তারপর নীচে অপেক্ষা করব গাড়িতে। তোকে একটু সাজিয়েও দেব কাল।
.
২৭ জুলাই, ১৯৩১। রণসাজ সম্পূর্ণ কানাইয়ের। নেহাতই গোবেচারা গ্রাম্য যুবকের বেশ। এলোমেলো চুল, কোঁচা-দোলানো হেটো ধুতি আধময়লা। গলা-আঁটা অপরিষ্কার শার্ট। তার উপর কোট। পায়ে নতুন সাদা ক্যাম্বিসের জুতো। হাতে ছাতা, যার মধ্যে গুলিভরা আগ্নেয়াস্ত্র। বেলা বারোটা নাগাদ আলিপুরগামী ট্রামে উঠে বসলেন কানাইলাল ।
সেশনস কোর্টের গাড়িবারান্দার নীচে যখন সুনীল চ্যাটার্জীকে নিয়ে একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল, ঘড়িতে বেলা একটা। চালক প্রেম সিং বহুদিনের পরিচিত সুনীলের। প্রেম সিং জানে, এঁরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়ছেন, বিপজ্জনক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত। বাড়তি ঔৎসুক্য দেখায় না কখনও। ডাকলেই চলে আসে, সে দিন হোক বা রাত। আজ যেমন। সুনীলবাবু ডাকতেই অন্য সওয়ারিদের তোয়াক্কা না করে হাজির।
সুনীল উপরে উঠলেন। এজলাসে গার্লিক সাহেব নেই, লাঞ্চে গেছেন। একটু পরেই আসবেন। কানাই সুবোধ বালকের মতো বসে আছে আমজনতার ভিড়ে। সাজ এত নিখুঁত হয়েছে, সন্দেহ করার কোনও কারণ খুঁজে পায়নি এজলাসের দোরগোড়ায় দাঁড়ানো সার্জেন্ট। সুনীল নেমে আসেন, চড়ে বসেন ট্যাক্সিতে।
—সিংজি… ইঞ্জিন চালু রাখুন… বললেই স্টার্ট দেবেন।
.
কাঁটায় কাঁটায় দুটোয় গার্লিক ফের এলেন এজলাসে। সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়াল সবাই। গার্লিক বসলেন, শুনানি শুরু হল।
—Me Lord… my humble submission before the Learned Court is that…
উকিলের সওয়াল শুনতে শুনতে যখন মাথা নিচু করে একমনে কিছু নোট করছেন গার্লিক, কানাই ঠিক করলেন, এই হল মোক্ষম সময়। নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয় উঠে দাঁড়ানোর মুহূর্তে, এই লোকটা দীনেশ গুপ্তের প্রাণ নিয়েছে, কত বিপ্লবীকে বাধ্য করেছে কারাবাসে, একে খতম করার সুযোগ পাওয়াটাই তো পরম প্রাপ্তি। ক’জন পায়?
কেউ কিছু বোঝার আগেই কানাই দ্রুত উঠে পড়েন, চকিত ক্ষিপ্রতায় পৌঁছে যান সাক্ষীর শূন্য কাঠগড়ায়। ঘরটা বিশেষ বড় নয়। সামান্যই দূরত্ব কাঠগড়া থেকে জজসাহেবের টেবিলের। সিলিং লক্ষ্য করে প্রথম গুলি… শব্দে সচকিত গার্লিক মুখ তুলতে না তুলতেই কানাই লাফ দিয়ে উঠলেন কাঠগড়ার রেলিংয়ের উপর। সেখান থেকে এক লাফে গার্লিকের টেবিলে, এর চেয়ে ঢের লম্বা লাফ সে হেসেখেলে দিয়ে থাকে ব্যায়ামের আখড়ায়। মাত্র কয়েক হাতের দূরত্ব থেকে সোজা গার্লিকের কপাল লক্ষ্য করে গুলি। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই। লক্ষ্যভেদ, এজলাসেই সম্পন্ন গার্লিক-নিধন।
সাদা পোশাকের পুলিশ গুলি চালাল অভাবিত ঘটনার ঘোর কাটিয়ে। লক্ষ্যভ্রষ্ট। কানাইয়ের পালটা গুলি লাগল পুলিশের কাঁধে। সার্জেন্ট ততক্ষণে ছুটে এসেছেন আওয়াজ পেয়ে। গুলি চালিয়েছেন কানাইকে লক্ষ্য করে। লাগল পেটে আর পায়ে। ভূপতিত কানাইয়ের শরীরে আরও কয়েক রাউন্ড গুলিবর্ষণ অতঃপর। ততক্ষণে পটাশিয়াম সায়ানাইডের শিশির পুরোটাই গলায় ঢেলে দিয়েছেন বীর বিপ্লবী। এজলাসেই মৃত্যু।
আদালতে তুলকালাম তখন। প্রাণভয়ে লোকজন ছুটে বেরচ্ছে এজলাস থেকে। বহির্মুখী জনতার ঠেলাঠেলিতে উলটে পড়েছে চেয়ার-টেবিল-বেঞ্চ। কাগজপত্র লন্ডভন্ড। পাশের ঘর থেকে ফোন গিয়েছে লালবাজারে, সশস্ত্র বাহিনী প্রয়োজন। হাসপাতাল থেকে তলব করা হয়েছে অ্যাম্বুল্যান্স।
কোর্টের বাইরে ট্যাক্সিতে তখন ঠায় বসে সুনীল। ছটফট করছেন টেনশনে। কাজটা হল? কানাই ফিরছে না কেন এখনও? তখনও জানেন না, যাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা, সে এজলাসে পড়ে প্রাণহীন। লোকজনের ভীতসন্ত্রস্ত ছোটাছুটি দেখে এক আইনজীবীকে সুনীল জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে?’
উত্তর এল ঝটিতি।
—Garlick shot dead. Assailant shot dead too!
সুনীল শুনলেন এবং কথা বাড়ালেন না। শান্ত ভঙ্গিতে নির্দেশ দিলেন চালককে।
—সিংজি… গাড়ি স্টার্ট করুন।
.
পুলিশের রিপোর্টে ঘটনার বিবরণ যেমনটা ছিল, তুলে দিলাম হুবহু।
On 27th July 1931 at 2 p. m., Mr. R. R. Garlick, I. C. S., Senior Sessions Judge, 24 parganas, was while sitting in Court, fatally shot through the head by a Bengali Youth.
The assassin, who was immediately shot down by the Sergeant on duty, committed suicide while lying wounded under the table, by swallowing cyanide of potassium from a phial which was found on the floor. The Police Surgeon, who held the postmortem examination, was of opinion that death was due to hydro-cyanic acid poisoning. A bullet of .450 bore, which was extracted from the body, was evidently that fired from the revolver of the Sergeant. In the left hip pocket of the deceased was found a slip of paper with a bullet hole through it, on which was written ‘Bande Mataram; Cursed be your Court, whose injustice condemned Dinesh Gupta to execution. Receive the reward for it. – Bimal Gupta’; while in the other pocket were found 14 live revolver cartridges of .380 bore.
The revolver which was found in the possession of the assailant is a 6-chambered .380 bore, with fall out cylinder, marked ‘Jupitre’ with trade mark ‘E.C.’ and bearing the number 15621 on heel of butt and also the word ‘Eiber.’ It bears Spanish proof mark and the cylinder rotates from right to left. The four live cartridges in the revolver and the fourteen live cartridges found in the coat pocket of the assassin bear the base mark ‘S. & W. .38 Spl.’ and each charged with 16 grs. black power and weighing 140 grs.
The photograph of the deceased assassin was definitely identified by a deponent on 29th October 1932 as that of one Kanai Lal Bhattacharji, son of Nagendra Nath, of Majilpur police-station Joynagar. 24-Parganas.
Mr. Garlick was the President of the Special Tribunal which on 2nd February 1931 convicted and sentenced to death Dinesh Ch. Gupta for the murder of Lt. Col. N. Simpson, I M S Inspector-General of Prisons, Bengal, at Writers’ Buildings, Calcutta, on 8th December 1930.
Sunil Chatarji’s group of the Jugantar Party was responsible for this outrage. (File 439/31)
.
লালবাজারের কর্তারা ছুটে এলেন, মৃত কানাইয়ের পকেট থেকে উদ্ধার হল সেই চিরকুট… ‘ধ্বংস হও…।’ কে এই বিমল গুপ্ত? পেডি-হত্যার ফেরারি আসামি বিমল দাশগুপ্ত? বিমলের আত্মীয়স্বজনদের খবর দিল পুলিশ। জানা গেল অচিরেই, আততায়ী বিমল নন। তবে কে?
‘কে’, জানতে চেষ্টার কসুর করেনি লালবাজার। ব্যর্থ হয়ে বিজ্ঞাপন দিতে হয়েছিল কাগজে, ‘A reward is hereby declared, worth Rupees Five Hundred to be given to one who can identify the murderer of Mr. Garlick.’
সাড়া মেলেনি বিজ্ঞাপনে। ঘটনার এক বছর তিন মাস পর মৃতদেহের ছবি দেখে কানাইলালকে চিহ্নিত করেছিলেন একজন। উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল বিপ্লবীদের। গার্লিক নিহত, অথচ পুলিশ অন্ধকারে ছিল এক বছরেরও বেশি।
কানাই মা-কে বলে গিয়েছিলেন, দেরি হলে চিঠি লিখবেন। মা অধীর অপেক্ষায় ছিলেন। চিঠি আসেনি। দুঃসংবাদ এসেছিল।
.
কানাই একা নন। তাঁর মতো এমন যে কত, যাঁরা অগ্রপশ্চাৎ ভাবেননি দেশের জন্য হাসতে হাসতে জীবন বাজি রাখার আগে, যাঁদের না ছিল অমরত্বের প্রত্যাশা, না ছিল ইতিহাসে ঠাঁই পাওয়ার সুপ্ত বাসনা। যাঁদের প্রাপ্য মর্যাদা দিতে ধারাবাহিক কার্পণ্য করেছে ইতিহাসও। প্রত্যাশিত পরিণাম— বিস্মৃতি!
কেউ মনে রাখেনি, কেউ মনে রাখে না!