মেয়েটা এক ফোঁটাও কাঁদল না। অঞ্জলি যখন তাকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল তখন সে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পরনে বেনারসীতে সে বেশ জবুথবু, মাথার মুকুট সাইজের চেয়ে সামান্য বড় হওয়ায় একটু বেঢপ লাগছে। কিন্তু এসবে তার কোন প্রতিক্রিয়া হচ্ছিল বলে মনে হল না। ওপাশে মনোরমা কাঁদছিলেন মুখে আঁচল চেপে। অমরনাথ ধারে কাছে ছিলেন না। জিনিসপত্র যা দেবার উঠে গেছে গাড়িতে।
কেউ একজন বলল, ঋণশোধ করিয়ে দাও চটপট। দেরি হয়ে যাচ্ছে—।
অঞ্জলি কাঁদতে কাঁদতেই চেঁচিয়ে উঠল, কিসের ঋণ? না ওসব করতে হবে না।
হঠাৎ মেয়ে কথা বলল, আমি করব।
যেন বাজ পড়লেও কেউ এত চমকে যেত না। যে বলেছিল তার দিকে শক্ত মুখে তাকিয়ে আছে মেয়ে। অঞ্জলি বাধা দিল, আমি বলছি দরকার নেই। আমার কাছে তোর কোন ঋণ নেই যে শোধ করবি। আমি শুধু চাই তুই ভাল থাকিস, ভালভাবে থাকিস।
আমি ঋণ শোধ করব। হঠাৎ মেয়েটার বয়স যেন এক লাফে অনেক বেডে গেছে।
খোকনের মা ছোট থালাটা এগিয়ে ধরলেন। পোয়া খানেক চাল, একটা রুপোর টাকা, দুর্বো ধানে সেটা ভর্তি। দীপা হাত বাড়িয়ে সেটা নিল। খোকনের মা বললেন, অঞ্জলি আঁচল পাতবে আর তুমি এসব সেখানে ঢেলে দিয়ে বলবে, এতদিন যা খেয়েছি তা আজ শোধ করে গোলাম।
কথা শেষ হওয়ামাত্র অঞ্জলি দৌড়ে ভেতরে চলে গেল মেয়েকে ছেড়ে দিয়ে। মনোরমা নাতনির দিকে তাকালেন। সবাই এ ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে।
দীপা ধীরে ধীরে থালাটা মাটিতে নামিয়ে রাখল। তারপর স্পষ্ট গলায় বলল, এতদিন এই বাড়িতে যা পেয়েছি তা–। হঠাৎ সে থেমে গেল।
সবাই দেখল মেয়েটা টলছে। মনোরমা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন, কি হল? শরীর খারাপ লাগছে? মাথা ঘুরছে? দীপা মাথা নেড়ে না বলল।
ছেলেকে আগেভাগেই গাড়িতে বসিয়ে দিয়েছিলেন প্রতুলবাবু। বাগানের সমস্ত মানুষ সার দিয়ে দাঁড়িয়ে। দীপাকে নিয়ে সুভাষচন্দ্র এগিয়ে আসছেন ঘরের পর ঘর ডিঙ্গিয়ে। বারান্দায় এসে তিনি বললেন, ঠাকুমাকে প্ৰণাম কর।
মনোরমা কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে বাইলেন। দীপা ঝুঁকে তাঁকে প্ৰণাম করল। সুভাষচন্দ্ৰ বারান্দা থেকে ওকে নিয়ে মাঠে নেমে ডাকলেন, অমরদা! অমরদা কোথায়? এদিকে আসুন, দীপা আপনাকে প্ৰণাম করে গাড়িতে উঠবে। সবাই এপাশ ওপাশ তাকাতে লাগল। কিন্তু অমরনাথ এগিয়ে এলেন না। মিনিট দুয়েক ডাকাডাকি চলল। শেষ পর্যন্ত প্রতুলবাবু বললেন, মেয়ের যাওয়ার সময় সামনে থাকতে পারবেন না বলছিলেন একটু আগে। পরশু তো আমার ওখানে দেখা হবেই। আর দেরি করিয়ে দেবেন না। ঘাট থেকে মাঝিবা চলে গেলে বিপদে পড়ব।
অতএর সুভাষচন্দ্ৰ দীপাকে নিয়ে গাড়ির দিকে এগোলেন। চারপাশে তখন উলুধ্বনি দিচ্ছে বাগানের মহিলারা, শঙ্খ বাজাচ্ছে। হঠাৎ মেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তার নজর বিশু আর খোকনের দিকে। গাড়ির সামনে দুই বন্ধু হাত ধরে দাঁড়িয়ে দীপাকে দেখছে। গত কয়েকদিন ওরা দীপার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পায়নি। একটি বারের জন্যেও দীপা বাড়ির বাইরে আসেনি। আজ ওরা অদ্ভুত চোখে যে মেয়েটাকে দেখছে সে যেন তাদের অচেনা। শাড়ি এবং মুকুটে সম্পূৰ্ণ বদলে গিয়েছে মেয়েটা। অনেক বড়, তাদের চেয়ে অনেক বড় লাগছে এখন। চোখাচৌখি হতেই বিশু হাসতে চেষ্টা করল। করে কেঁদে ফেলল। খোকন তাকে আঁকড়ে ধরল। সুভাষচন্দ্ৰ গাড়ির খোলা দরজায় দীপাকে আলতো করে ঠেলে দিলেন। দীপা গাড়িতে উঠে বসল। তার পাশে এসে বললেন প্রতুলবাবু। অন্য পাশে অতুল সিটে মাথা হেলিয়ে বসেছিল, এবার মুখ ফিরিয়ে তাকাল। প্রতুলবাবু নির্দেশ দিলেন গাড়ি চালু করতে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করল দীপা। তার কানে ইঞ্জিনের শব্দ, শঙ্খধ্বনি, উলুর আওয়াজ। সে বুঝতে পারল গাড়ি এখন মাঠের ওপর দিয়ে যাচ্ছে। এই গাড়ি মাঠ ছেড়ে আসাম রোডে উঠল। চোখ বন্ধ করে সে জানল বা দিকে কুলি লাইন, ডান দিকে অনেকটা দূরে চা-বাগানের ভেতর ফ্যাক্টরি, এইবার বা দিকে বাঁক নিতেই অংরাভাসা নদী এগিয়ে আসছে। এখান থেকেই ওরা হাতির তাড়া খেয়ে চা-বাগান ছেড়ে রাস্তান্য উঠেছিল। ওই চা-বাগানের ভেতরেই শ্যামলদা ললিতাদির সঙ্গে,–সমস্ত শরীরে কাঁটা ফুটল তার। ললিতাদি কি এখনও বেঁচে আছে? এই সময় প্রতুলবাবুর চিৎকারে কেঁপে উঠল সে, শুযোরের বাচ্চা, এটা কি গাড়ি চালানো হচ্ছে? দূর করে দেবো চাকরি থেকে। জোরে চালা।
নিস্তব্ধ রাত্রের রাস্তায় গাড়ির আওয়াজ ছাপিয়ে চিৎকারটা এত জোরে এবং অশ্লীল শোনাল যে এই প্রথম কান্না পেল দীপার। গত রাত থেকে সে প্ৰতিজ্ঞা করেছিল আর কখনও কাঁদবে না। গত রাত্রে সে পাগলের মত কান্নাকাটি করেছে। মনোরমা আর অঞ্জলি ওর সামনে বসে এক এক করে সব কথা বলে যাওয়ার পর সে ঠোঁট উল্টে বলেছিল, যাঃ, বিশ্বাস করি না। আমি তোমাদের কথা।
মনোরমা বলেছিলেন, তোর এসব কথা জানা দরকার। এসবই সত্যি কথা।
অঞ্জলি তাকে জড়িয়ে ধরেছিল, তোর জন্মের গল্প সত্যি কিন্তু তার চেয়ে সত্যি তুই আমাদের মেয়ে।
অবাক হয়ে তাকিয়েছিল দীপা। তারপর বিড়বিড় করেছিল, সত্যি বলছ?
ওঁরা কেউ জবাব দেননি। দীপা আবার জিজ্ঞাসা করেছিল, তুমি আমার মা নাও? আমার মা মরে গেছে? বল, তুমি আমার মা নও?
তোকে পেটে ধরিনি বলে আমি তোর মা হব না?
সেই সময় চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিল দীপা। মনোরম আর অঞ্জলি কিছুতেই সামলাতে পারছিলেন না মেয়েকে। কান্না শুনে অমরনাথ ভেতরে এসেছিলেন। দীপা ছুটে গেল তাঁর সামনে, তুমি সত্যি কথা বল, তুমি আমার বাবা নাও?
অমরনাথ মাথা নিচু করেছিলেন। তাঁর হাত জড়িয়ে ধরে দীপা পাগলের মত জিজ্ঞাসা করে যাচ্ছিল, বল, চুপ করে আছ কেন? তুমি আমার বাবা নাও? বল?
অমরনাথ হাত ছাড়িয়ে সেই সময় চলে গিয়েছিলেন। অনেক সময় লেগেছিল অঞ্জলির মেয়েকে আপাত শান্ত করতে। অনেক দিন আড়ালে রাখা দীপার মা-বাবার বিয়ের ছবি ট্রাঙ্ক থেকে বের করে মেয়ের হাতে দিয়েছিল অঞ্জলি, সে চলে গিয়েছে তোর জন্মের ঠিক পরেই। কিন্তু তোর শরীরে তার রক্ত আছে। ছবিটা চিরকাল নিজের কাছে রাখবি।
অনেক রাত্ৰে মনোরমা যখন বড় ঘরে অঞ্জলির সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারে আলোচনা করছিলেন তখন নিঃশব্দে অমরনাথ মেয়ের বিছানার পাশে এসেছিলেন। দীপা উপূড় হয়ে শুয়েছিল। তখনও অমরনাথের মনে হয়েছিল বিয়েটা না দিলেই হত। মেয়েটাকে শুধু গোত্রান্তর করে দেওয়া হচ্ছে না, ওর আশৈশব লালিত ধারণাকে আজ এক লহমায় ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া হল। এই মুহুর্তে ও যদি ভাবে পৃথিবীতে ওর কেউ নেই তাহলে দোষ দেওয়া যায়? অথচ তিনি নিজেই স্ত্রী এবং মাকে বলেছিলেন বিয়ের আগে দীপাকে সত্যি কথাটা জানিয়ে দিতে। মেয়ের পাশে বসতেই দীপা চোখ মেলেছিল। পাশ ফিরে। তারপর অমরনাথের কোলের ওপর মুখ তুলে বাঁধভাঙ্গা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল। কয়েক মিনিট স্থির থেকে অমরনাথ বলেছিলেন ভারী গলায়, আমি আছি। আমিই তোর বাবা। যে তোকে জন্মমাত্র দায়িত্ব অস্বীকার করে চলে গেছে সে তোর জন্মদাতা হতে পারে। কিন্তু বাবা নয়। আমি তোকে বলছি তুই কাঁদিসনে, মনে রাখবি সবসময় তোর একফোঁটা চোখের জল একশ ফোঁটা রক্তের চেয়ে দামী।
প্রতুলবাবু পাশ ফিরতেই দীপার শরীরে চাপ পড়ল। হেঁ হেঁ করে হাসলেন তিনি, তুমি তো দেখছি বেশ শক্ত মেয়ে। কান্নাকাটির মধ্যে নেই। ভাল, খুব ভাল। তবে কথাটা কি জানো, লজ্জার মত কান্নাও মেয়েমানুষের ভূষণ। মেয়েদের কাঁদতে দেখলে ছেলেদের ভাল লাগে।
উথলে আসা কান্নাটাকে ভেতরে পাঠিয়ে দেবার শক্তি পেয়ে গেল দীপা।
মধ্যরাতে দুটো গাড়ি এসে থামল বার্নিশের ঘাটে। প্রতুলবাবুর গাড়ির পেছনে ছোট ভ্যানে আসছিল বরযাত্রীরা। তারা নিচে নেমে চিৎকার করে মাঝিদের ডাকতে লাগল। শাল এবং টুপিতে নিজেকে মুড়ে প্রতুলবাবুও নামলেন। অন্ধকার গাড়িতে এখন দীপা এবং অতুল। মুখ তুলে দীপা নদীর দিকে তাকাল। গাড়ির কাঁচ তোলা। ঝাপসা নদীর বুকে অন্ধকার। বরযাত্রীদের টর্চের আলোয় মাঝে মাঝে চকচকে আলো দেখা যাচ্ছে। দীপা তার ডান দিকে তাকাল। শাল মোড়া একটা শীর্ণ শরীর কুঁকড়ে পড়ে আছে মাথা হেলিয়ে। নিঃশ্বাসের যে শব্দ উঠছে তাতে বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না যে ঘুম কত গভীর। মনোরম বলেছেন চিরকাল মনে রাখতে, পতি পরম দেবতা। এই লোকটা তার পতি। এতক্ষণ পাশে বসে আছেন তা প্রতুলবাবু তাকে নানান ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। যতক্ষণ গাড়ি চলছিল ততক্ষণ একের পর এক প্রশ্ন করে গেছেন। বেশীর ভাগ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে সে হুঁ হ্যাঁ বলে। শেষ প্রশ্ন ছিল দীপা যখন গাড়িতে উঠছিল তখন যে ছেলেটা ড়ুকরে কেঁদে উঠেছিল সে তার কে হয়? বন্ধু বলতে গিয়ে ঢোঁক গিলেছিল। মনোরমা তাকে পইপই করে বলে দিয়েছিলেন যে সে ছেলেদের সঙ্গে মিশতো একথা যেন শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে গল্প না করে, ঘুণাক্ষরে। সে মাথা নেড়েছিল, কেউ না।
কেউ না হলে কাঁদবে কেন? প্রতুলবাবু তীক্ষ্ণ গলায় জানতে চেয়েছিলেন।
আমি জানি না। দীপা মুখ নিচু করে জবাব দিয়েছিল।
হুম। আর কিছু বলেননি। তিনি। কিন্তু তাঁর ছেলে যে পাশে বসে আছে তা একবারের জন্যেও টের পায়নি দীপা। এই মুহূর্তে ওর ইচ্ছা করল খোঁচা মেরে ওকে ঘুম থেকে তুলে দিতে। এইসময় লণ্ঠন হাতে মাঝিরা বেরিয়ে এল। ড্রাইভার হেডলাইট জ্বালালে সামনে জোড়া নৌকো দেখা গেল। সাবধানে জোড়া নৌকোর ওপর পাতা পাটাতনের ওপর গাড়ি দুটো উঠে এল পর পর। চাকার তলায় কাঠ দিয়ে সামাল দেওয়া হলেও প্রতুলবাবু গাড়িতে উঠলেন না। তিস্তার ওপর হু হু বাতাস বইছিল। তিনি একবার ছেলের নাম ধরে ডাকলেন, অতুল, এখন গাড়ি থেকে নেমে এস। নদীতে নৌকো চললে গাড়ির ভেতর বসে থাকা ঠিক না।
দীপা কথাগুলো অবাক হয়ে শুনল। প্রতুলবাবু তাকে ডাকছেন না কেন? এখন গাড়ি যদি গড়িয়ে নেমে যায় নদীতে তাহলে সেও তো মারা যাবে! কিন্তু যাকে ডাকা হল তার ঘুম ভাঙ্গার কোন লক্ষণ দেখা গেল না। এদিকে তখন নৌকো ছেড়েছে ঘাট। মাঝিরা বড় বড় লগি নিয়ে চিৎকার করে নৌকো চালাচ্ছে। প্রতুলবাবুর মুখ গাড়ির কাচে ঝাপসা দেখাল। কি ভাবলেন তিনি। তারপর গাড়ির দরজা সামান্য ফাঁক করে ছেলের শরীরে হাত রেখে গাড়ির পাশেই দাঁড়িয়ে রইলেন। ভাবখানা এমন যদি গাড়ি গড়িয়ে যায় তাহলে তৎক্ষণাৎ ছেলেকে টেনে বের করে নেবেন। কাঁটা হয়ে বসে রইল দীপা। তারপর ধীরে ধীরে ডান হাত বাড়িয়ে রাখল অতুলের শরীরের কাছে। নৌকো থেকে যদি গাড়ি গড়িয়ে যায় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে সে অতুলকে আঁকড়ে ধরবে। প্রতুলবাবু ছেলেকে বের করতে চাইলে তাকেও সেইসঙ্গে বের করতে বাধ্য হবেন। নয়তো সে এক কিছুতেই মরবে না। মরতে যদি হয় এই ঘুমন্ত লোকটাকে সঙ্গে নিয়েই মরবে।
ভালয় ভালয় এপারে চলে এল নৌকো। গাড়ি এবার তিস্তার চর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে। বালির ওপর স্পীড বেশী তোলা যাচ্ছে না। প্রতুলবাবু বললেন, থাক, আর কেরামতি দেখাতে হবে না। বাড়ির কাছে এসে ড্রাইভিং দেখাচ্ছে। চাকা যদি পলিতে ফাঁসে তবে তোকে আমি ফাঁসাবো। এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, এরকম বিয়ে বাপের জন্মে দেখিনি। শীতে হাড়ে মরচে পড়ে গেল। কত করে বললাম আটটার মধ্যে ছাড়তে তা না যত ন্যাকামি। শেষ কথাটা যে অমরনাথের উদ্দেশে তা স্পষ্ট বুঝতে পারল দীপা। মনোরমা বলেছেন এখন থেকে এই লোকটাকে বাবা বলে ডাকতে হবে। অমরনাথ কখনও এমন গলায় কথা বলেন না। তিনি কি ধরনের ন্যাকামি করেছেন তাও সে বুঝতে পারছিল না। শেষ সময়ে বাবা কেন সামনে ছিলেন না? অভিমানটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠতেই দীপার খুব অস্বস্তি হল। বাঁ দিক থেকে একটা তীব্র কটু গন্ধ ভেসে এল। তার নাকে। প্রতুলবাবু যখন মুখ ফেরাচ্ছেন তখনই গন্ধটা আসছে। তিনি তিস্তার ঘাটে নামবার আগে এই গন্ধটা একবারের জন্যেও পায়নি দীপা। গন্ধে গা গোলানি ভাবটা বেড়ে যাওয়ায় অভিমান কার্যকরী হল না। তার মনে পড়ল অমরনাথের কথা, এক ফোঁটা চোখের জল একশ ফোঁটা রক্তের চেয়ে দামী।
কখন শহরে গাড়ি ঢুকেছিল, গেট পেরিয়ে আলো ঝলমলে বাড়ির সামনে গাড়িটা কিভাবে চলে এল তা টের পাযিনি দীপা। ড্রাইভার ইঞ্জিন বন্ধ করতেই উলুধ্বনি বাজল। মাত্র দুই কি তিনটি গলায় উলু দেওয়া হচ্ছে। প্রতুলবাবু গাড়ি থেকে নেমে চিৎকার করলেন সব শব্দ ছাপিয়ে, মাঝ রাত্রে সব আলো জ্বেলে রেখেছে কেন? যত্তসব! একটি মহিলাকণ্ঠ যেন কিছু বলল কথার জবাবে। প্রতুলবাবু চলে গেলেন ভেতরে। শঙ্খ বাজছে। বরযাত্রীদের কেউ কেউ বলে উঠল, বরকনে নামাও, বরণ কর। ছেলেমানুষ ঘুমিয়ে কাদা হয়ে আছে সব। আত রাত্ৰেও গাড়ির সামনে যারা ভিড় করেছিল তারা সাজগোজ করেছিল সব। একটি পুরুষ কণ্ঠ জোরে বলে উঠল, ছেলেরা সরে যাও। এটা মেয়েদের ব্যাপার, ওদের করতে দাও।
একজন মহিলা দীপাকে ধরে নামাল গাড়ি থেকে। নামিয়ে বলল, বাঃ, খাসা বউ হয়েছে, লক্ষ্মী ঠাকুরণের মত দেখতে লাগছে। না গো।
আর একজন বলল, লক্ষ্মী না সরস্বতী তা কে বলবে? ঘুমে তো ঢুলছে।
ঢুলবে না? কতদূর থেকে আসছে?
আজ তো ঢুললে চলবে না। আজ বাসর রাত। রাত জগতে হবে।
সর সর। এসো গো, বউ ঘরে তোল।
যাবতীয় মেয়েলি আচার অনুষ্ঠান শেষ হবার পর দীপাকে একটি সাজানো ঘরে যখন নিয়ে যাওয়া হল তখন সেখানে তাকিয়ায় মাথা রেখে অতুল চোখ মেলার চেষ্টা করছে। দীপাকে তার পাশে বসিয়ে একজন বলল, তোমার নাম তো দীপাবলী, তা ইনি হলেন তোমার শাশুড়ি, আজ থেকে তোমার মা। ও নলিনী, বউ-এর মুখ তো দেখলে, কিন্তু কিছু দিলে না যে?
শাশুড়ি যিনি তাঁর নাম নলিনী। নলিনী বললেন, সব যার জন্যে তাকে আর আলাদা করে কি দেব? এবার তোমরা সর তো, ও হাত মুখ ধুক, বাথরুম করুক। রাত তো শেষ হতে চলল, যাও না। সবাই, এই বেলা গড়িয়ে নাও।
ওমা! সে কি কথা? আজ বাসর জগতে হবে না? ঘুমাবো কি?
না। বাবা! আমার ছেলে জগতে পারবে না। অনেক পরিশ্রম হয়ে গেছে ওর।
পরিশ্রমের তো অনেক বাকি। ফুলশয্যে আসুক, তখন থেকেই তো পরিশ্রম।
আঃ নতুন দি, তোমার মুখ বড় আলগা!
ওমা, আমি কি শ্ৰাদ্ধবাসরে এসেছি নাকি যে মুখে কুলুপ আঁটবো? মেয়ে মানুষেবা মুখ খোলার জায়গা হল আজ, এই বাসর রাতে।
তোমার বরের বুঝি খুব পরিশ্রম হত নতুন দি? আর একটি গলা জিজ্ঞাসা করল।
তা হত। আমার চেহারা তো দেখছিস তোরা, তিনটে বাঘে খেতে পারবেনা, আর তাকে, একটা টিকটিকিও সাবাড় করে দেবে।
সঙ্গে সঙ্গে হাসির ফোয়ারা উঠিল। নলিনী বললেন, এই যে মেয়ে, তোমার নাম দীপাবলী? এ বাড়িতে অত শৌখিন নাম চলবে না বাপু। তোমাকে আমরা আজ থেকে আশা বলে ডাকব। বুঝলে? দীপাবলীকে পাল্টে আশা করলাম।
শুধু আশা বড় ন্যাংটো ন্যাংটো লাগছে গো। নতুন দি বলে উঠলেন, যেন ব্লাউজ পরালে কিন্তু ভেতরের জামা পরাওনি। আশার সঙ্গে কিছু জোড়।
নলিনী হাসলেন, সেটাও ভেবেছি। আশালতা। খুব মিষ্টি নাম, কি বল?
সবাই এবার প্রশংসা করতে লাগল। নতুনদি দীপার চিবুক ধরে মুখ সামান্য তুলে বললেন, শুনলে তো? এখন থেকে তুমি আমাদের আশালতা। দীপাবলী নিবিয়ে ফেল। আশার লতা হয়ে অতুলচন্দ্ৰকে জড়িয়ে ধর।
জড়াবে কি, সে তো ঘুমিয়েই কাদা।
বাথরুমে যাবে? নলিনী জিজ্ঞাসা করলেন।
দীপা মাথা নাড়ল, না। তার খুব ঘুম পাচ্ছিল। ওরা কেউ তাকে ঘুমাতে বলছে না।
এই ঘরে কেউ শোয় না। তবে বিয়ে উপলক্ষে যারা এসেছে তাদের কেউ কেউ ছিল গত রাতে। মেয়েলি আচার অনুষ্ঠান সেরে আজ যে যার বাড়িতে ফিরে গিয়েছে। বেশীর ভাগ আত্মীয়স্বজন এই শহরেরই। নলিনী দুপুরের খাবারের পর দীপাকে নিয়ে এলেন সেই ঘরে, নাও, যদি খুব ঘুম পেয়ে যায় এখানে গড়িয়ে নাও। আজ তো কাল রাত্তির। কাজের মেয়েটি বলে উঠল পেছন থেকে, ঘুম পেয়ে যায় বলছি কি, সকাল থেকে তো ঢুলছে সমানে। একটু ঘুমাতে দাও।
তুই বড্ড কথা বলিস আনু। আমি কি ওকে এখানে এনেছি জাগিয়ে রাখতে? নলিনী তেড়ে উঠলেন। এইসময় আর একজন কাজের লোক এসে বলল, মা তোমাকে বাবু ডাকছে। খুব মেজাজ খারাপ!
মেজাজ খারাপ! ও আনু, কি হল রে?
আমি জানব কি করে? আশ্চর্য। আনু নামের কাজের মেয়েটি মুখ বাঁকালো।
নলিনী প্ৰায় ছুটে বেরিয়ে গেলেন ঘর ছেড়ে। অন্য কাজের মেয়েটি তাঁর সঙ্গ নিল।
আনু এবার দীপার দিকে তাকাল, পুতুলের মত দাঁড়িয়ে থাকলে শরীর আরাম পারে? শুয়ে চোখ বন্ধ কর না। দীপা আনুর দিকে তাকাল। মধ্যবযসী মানুষটিকে খুব রাগী বলে মনে হল তার। আনু এগিয়ে এসেছিল কাছে, যা হবার তা তো হয়ে গেছে। সময়ে নিষেধ করলেও যদি মানুষ না শোনে তাহলে তাদের জন্যে দুঃখ করে কোন লাভ হয় না। আর দুঃখ করতেই বা যাব কেন? বয়েই গেছে। যেমন খাবে তেমন হাগবে। তোমার মা যদি কালা হয় তো আমি কি করার। শুয়ে পড়। প্ৰায় জোর করেই কনুই ধরে তাকে খাটের ওপর বসিয়ে আনু চলে গেল। বিছানায় বসামাত্র শরীর টানতে লাগল সেটা। বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল সে। সমস্ত শরীরে ম্যাজম্যাজানি, একটু জ্বরো জ্বরো ভাব। চোখ বন্ধ করেই দীপার মনে পড়ল এদের রান্নাব কথা। কি মিষ্টি দেয। ডাল ত ক্ষরি সব কিছুতেই। মা বা ঠাকুমার রান্নার পরে এসব খাওয়াই যায় না। মা এবং ঠাকুমা শব্দদুটো মনে পড়তেই সে ঠোঁট কামড়ালো। ওরা তার মা ঠাকুমা নয়? মাসী আর মাসীর শাশুড়ি? অসম্ভব। একদিনের জন্যেও তার যাদের অন্য কিছু বলে মনে হয়নি। আজ দুম করে বলে দিলেই হল? এই যেমন এ বাড়িতে পা দিতে না দিতেই এরা নামটা পাল্টে দিল। কি নামের ছিরি, আশালতা। যত বুড়ি বুড়ি নাম। আচ্ছা, এভাবে নাম বদলালে সে ভুলে যাবে নিজেকে? আমি দীপা দীপা দীপা। বড় জোর দীপাবলী। আমি কখনই আশালতা নাই। চোখ বন্ধ করল সে। আশ্চর্য ঘুম আসছে না তার। হঠাৎ গালের পাশটা ভিজে ভিজে লাগল। আঙুল, দিয়ে স্পর্শ করতেই জল এবং তার উৎস টের পেল। সে কখন কাঁদল? না। কাঁদতেই চোখ দিয়ে জল গড়ায় নাকি? তার মনে হল এই জলের দাম নিশ্চয়ই একশ ফোঁটা বক্তের চেয়ে বেশী নয়।
নলিনী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ক্ষিপ্ত প্রতুলবাবু দ্রুত পায়চারি করছিলেন ঘরে। হঠাৎ থেমে দাঁড়িয়ে গর্জন করে উঠলেন, লোকটা আত্মহতা করল আর বাগানের কেউ জানল না। এ হতে পারে? নিশ্চয়ই আমার কাছে চেপে গিয়েছিল ওরা। এখন দাদা বলছেন যে তিনি বউভাতে আসতে পারবেন না। বেয়াই মারা গেছে আর তিনি উৎসবে এসেছেন জানলে তাঁর পাবলিক ইমেজ খারাপ হবে। অন্যসময় হলে কে কেয়ার করত! কিন্তু দাদা না আসা মানে কি হবে জানো?
নলিনী মুখ তুলে বললেন, দিদি আসবে না, ছেলেমেয়েরা—!
নিকুচি করেছে। তাদের জন্যে যেন আমি হাপিত্যেস করে বসে আছি। বি সি রায় আসছেন জলপাইগুড়িতে। দাদাকে বলে রেখেছিলাম খগেন দাশগুপ্তকে বলে রাখতে। খগেনবাবু ইচ্ছে করলে বি সি রায়কে নিয়ে বউভাতে আসতে পারেন। পাঁচ মিনিটের জন্যে হলেও। এদিকে দাদা যদি নিজেই না আসেন, উঃ! আমার হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছে। একবার চিফ মিনিস্টারকে যদি আনতে পারা যায় তাহলে আর দেখতে হবে না। সব প্ল্যান ঠিকমত এগোছিল। গত ইলেকশনে দশ হাজার দিয়েছিলাম, এবার তিরিশ পর্যন্ত উঠতাম, সেই পাতিবাবুটা মরে গিয়ে ভেস্তে দিল সব।
নলিনী বললেন, মরল কি করে?
গলায় দড়ি দিয়ে। কি না, তার ছেলে নাকি কোন আইবুড়ো মেয়েকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। সেই মেয়ে বিষ খেয়ে এখন জলপাইগুড়ি হাসপাতালে ধুকছে। ব্যাস। পাতিবাবুর প্রেস্টিজে লেগে গেল আর তিনি দড়িতে লটকে পড়লেন। কিন্তু কথা হল নলিনী, লোকটাকে আমি খাওয়ার পরও দেখেছি। আশীর্বাদ ফাসির্বাদের সময় সঙ্গে ছিল। হেঁ হেঁ করে বাজে কথা বলে যাচ্ছিল। এসব যে করে সে কখনও প্ল্যান মাফিক আত্মহত্যা করতে পারে? নিশ্চয়ই ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। প্রতুলবাবু আবার পায়চারি করতে লাগলেন, বাগানের একটা মেয়ে বিষ খেয়েছে সেকথা কেউ আমাকে জানায়নি। আমরা চলে আসার পর দাদার বেয়াই-এর ডেডবডিকে ঝুলতে দেখেছে সবাই। আমি পুলিশকে বলেছি। এটা আত্মহত্যা বলে মনে হচ্ছে না। যদি মার্ডার কেস হয় তাহলে দাদার শোকটা একটু কমে গেলেও যেতে পারে, কি বল?
মার্ডার?
মার্ডার মানে খুন।
ওমা, কে খুন করবে?
সেটা আমাদের জানার কথা নয়। তবে আমরা যখন বাড়ি ছেড়ে বের হলাম। তখন তোমার বেয়াই অমরনাথবাবুকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। আরে বাবা নিজের মেয়ে না। হোক, এতদিন ধরে তুই পালছিস, সে যখন চিরদিনের জন্যে চলে যাচ্ছে তখন একবার সামনে এসে দাঁড়াবি না?
সে কি? বেয়াই মশাই খুন করেছেন? নলিনী চমকে উঠল।
সেটা আমাদের জানার কথা নয়। তবে চাকরি করে তো চা-বাগানে। মাইনে কত পায় তা সবাই জানে। খাওয়া পরার কষ্ট নেই, থাকার জায়গা ফ্রি। কিন্তু সারা বাড়ি আলো করা, সানাই বাজানো, মাছ মাংস দই মিষ্টি খাওয়ানো, এসব তো মুফতে হয়নি। ধার করেছে নিশ্চয়ই। সেটা কার কাছে করেছে তা পুলিশ বের করুক।
তুমি না জেনে এসব বলছ বুঝি!
আমি কিছুই বলছি না। এখন আগামী কাল যদি লোক এসে বলে চা-বাগানে একজন মরে গেছে বলে কেউ বউভাতে আসতে পারবে না তাহলে বাঁচোয়া।
সে কি? কনেপক্ষর লোক আসবে না?
আমি মানা করিনি। নিজে হাত জোড় করে নেমন্তন্ন করেছি। না এলে কি করব। ও হ্যাঁ, মাথার ঠিক নেই, মেয়েটা একটু টিটিয়া টাইপের আছে বলে মনে হল তোমার?
টিটিয়া টাইপ? কই না তো! যা বলছি শুনছে তো!
হুম! আর কেউ যেন জানতে না পারে মেয়েটা অমরনাথের নিজের নয়।
না। আমার পেট থেকে বেরুবে না।
সে তো জানি। পেট থেকে একটি যা বেরিয়েছে তার জন্যে সারাজীবন জ্বলতে হবে?
কথা শেষ করে নিজের অফিসঘরে চলে এসে টেলিফোন তুললেন প্রতুলবাবু। জেলার উচ্চপদস্থ এক কংগ্রেসী নেতাকে ধরতে পারলেন তিনি, নমস্কার দাদা, প্রতুল বাঁড়ুয্যে বলছি। আরে না, না। আপনাকে আসতেই হবে। বউদিকেও নিয়ে আসবেন। চিঠি আমি বউদির হাতে দিয়ে এসেছিলাম। খগেনদা কোথায় এখন? ও, আচ্ছা আচ্ছা। চীফ মিনিস্টার আসছেন? তারপর? ড়ুয়ার্স থেকে ফিরবেন। কখন? সন্ধের আগেই। মিটিং শেষ কখন? আমি যাচ্ছি একটু বাদে। আপনাকে একটা উপকার করতে হবে। কোন কথা শুনতে চাই না। আপনি তো জানেন আপনাদের জন্যে আমি সবসময় আছি। গিয়েই বলব। রাখছি দাদা। রিসিভার নামিয়ে প্রতুলবাবু দেখলেন হরদের ঘোষাল ঢুকছে। হরদেবকে নিয়ে একদা ব্যবসা শুরু করেছিলেন তিনি। লোকটা এত অলস যে পরিশ্রম করতে চাইত না। ওর টাকা মিটিয়ে দিয়ে ব্যবসাটাকে নিজের করে নিতে দেরি করেননি। হরদের তবু মাঝে মাঝে আসে। দশ বিশ টাকা ধার নিয়ে যায়। লোকটাকে এখনও তিনি সহ্য করেন। কাবণ মাঝে মাঝে ওর মাথা চমৎকার খুলে যায়। ভাল পরামর্শ দেয় তখন। এক গাল হেসে তিনি বললেন, এস হরদেব, পেয়েছ তো?
পেয়েছি মানে? তুমি আমাকে নেমন্তন্নর চিঠি পাঠিয়েছ যে পাব? পকেট থেকে বিড়ির কৌটো বের করেও হরদের পিটপিটিয়ে প্রতুলবাবুর সিগারেটের প্যাকেট দেখতে থাকে। একটা সিগারেট বের করে এগিয়ে দিয়ে প্রতুলবাবু বললেন, উঃ, কি ভুলই না হয়ে যাচ্ছে। এই একটু আগে জলধারদা ফোনে বললেন তিনিও চিঠি পাননি। আরে তোমার সঙ্গে কি আমার সেই সম্পর্ক যে চিঠি না পেলে ছেলের বিয়েতে খেতে আসবে না? বল, খবর কি?
বিশ টাকা দাও।
দাও? একেবারে দাও?
বাঃ! তোমার বউ-এর মুখ দেখতে কিছু কিনতে হবে না?
বেশ নেবে। কিন্তু হরদেব, একটা উপায় বাতলাও তো। চীফ মিনিস্টার কাল জলপাইগুড়িতে আসছেন। কি করে তাঁকে একবার বউভাতে আনা যায়?
হরদের চোখ বন্ধ করে সিগারেট মুঠোয় নিয়ে টান দিতে লাগল। এটা নাকি বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দেওয়া। প্রতুলবাবুর খুব রাগ হচ্ছিল কিন্তু তিনি চুপ করে রইলেন। লম্বা ছাইটা হাতের তুড়িতে ফেলে দিয়ে হরদের বলল, আরও পঞ্চাশটা টাকা দাও।
ইয়ার্কি পেয়েছ?
মোটেই না। ফুল কিনতে হবে।
ফুল? প্রতুলবাবু হতবাক।
চীফ মিনিস্টার আসছেন আর ফুল দেবে না? তবে তার সঙ্গে দশ হাজার টাকা চাই। উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন নিয়ে বিধান রায় হিমসিম খেয়ে যাচ্ছেন। ফুলের তোড়া আর দশ হাজার টাকা তুমি উদ্ধান্তু পুনর্বাসন তহবিলে দান করবে। টাকাটা দিতে হবে চীফ মিনিস্টারের হাতে। তিনি নিশ্চয়ই খুশি হবেন। হরদের সিগারেট টান দিল।
উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ালেন প্রতুলবাবু, কোথায় গিয়ে দেব?
উনি এ বাড়িতে এলে নতুন বউ-এর হাত দিয়ে দিলেই ভাল হয়।
কিন্তু যদি না আসেন?
বিধান রায় মানুষ হিসেরে সাধারণের চেয়ে অনেক বড়। নতুন বউ বউভাতের রাতে দেশের উদ্বাস্তুদের জন্যে দশ হাজার টাকা দিতে চাইছে জানলে তিনি না এসে পারবেন না। মনে রেখ, তুমি দিচ্ছ না, নতুন বউ দিচ্ছে। খবরের কাগজের রিপোর্টারা সারা দেশে এই খবর পাঠাবে।
নতুন বউ দেবে মানে? টাকাটা আমার নামে দিতে হবে।
তোমার নামে দিলে তুমি তো সার্কিট হাউসে গিয়ে ওঁর হাতে দিয়ে আসতে পার। নতুন বউ বউভাতের সময় বাড়ির বাইরে যেতে পারে না বলে তিনি এ বাড়িতে আসবেন।
অসম্ভব! নতুন বউ দিলে নাম হবে তার। আমার কি?
তুমি বলেছিলে কি করলে চীফ মিনিস্টারকে এ বাড়িতে আনা যায় তার উপায় বাংলাতে। আমি সেটা বলে দিলাম। টাকাটা দাও। হাত বাডাল হরদেব।
কালরাত্ৰি কেটে গেল। জানলা দিয়ে এ বাড়ির গাছপালা আর আকাশ দেখে সকালটা কাটল দীপার। এ বাড়িতেও কয়েকটা বাতাবি লেবুর গাছ আছে। জলপাইগুড়িতে চা-বাগানের মত ঠাণ্ডা পড়ে না। শাড়ি পরে থাকায় শীত কম লাগছে। ফ্রক পরলে হাত পা খালি থাকে। কিন্তু এতক্ষণ শুধু শাড়ি পরে জীবনে সে থাকেনি। ট্রাঙ্ক গোছাবার সময় যে অঞ্জলি ফ্ৰক দেয়নি তা সে লক্ষ্য করেছে। দীপার খুব ইচ্ছে করছিল ফ্রক পরে বাগানে ছুটে যেতে। ওর মনে হল একমাত্র গাছেরাই সবসময় খুব চেনাজানা হয়।
আজ বিকেলে অমরনাথ আসবেন। অঞ্জলি আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আজ অবধি কোন মা নাকি মেয়ের বউভাতে যায়নি বলে মনোরমা তাকে নিষেধ করেছেন। বলেছেন, বাপ গেলে মেয়ে একটু কান্নাকাটি করবে। মাত্র, তার বেশী কিছু হবে না। হাজার হোক বাপ হল ছেলে। তার সঙ্গে দূরত্ব থাকেই। কিন্তু মাকে দেখলে নিজেকে সামলাতে পারবে না মেয়ে। এই কারণেই মায়েরা মেয়ের বউভাতে যায় না। এসব কথা দীপার সামনেই হয়েছে। যদি গাড়ির ব্যবস্থা করা যায় তাহলে অমরনাথের সঙ্গে বাগানের কয়েকজন বাবু আসবেন। না হলে অমরনাথ একা এসে বউভাত খেয়ে হোটেলে রাত কাটাবেন। মেয়ের বিয়ের তিন বছরের মধ্যে নাকি কুটুম বাড়িতে রাত কাটাতে নেই। দীপার মনে হল সে যেন অনেকদিন এখানে রয়েছে। বাবা মা ঠাকুমা আর ক্ষুদে দুটোকে দেখার জন্যে তার মন আকুলি-বিকুলি করতে লাগল।
এই সময় নলিনী এলেন, তুমি নাকি সকালে দুধ খাওনি। এটা খাব না। ওটা খাব না মেয়েরা বলে বিয়ের আগে, বিয়ের পরে না। এসব কথা কি তোমার মা ঠাকুমা শিখিয়ে দেয়নি?
জানলার ধারে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল দীপা। নলিনী ডাকলেন, আনু দুধটা নিয়ে আয়।
আনু দুধের গ্লাস নিয়ে এল, নাও, খেয়ে নাও। জল হয়ে গিয়েছে।
জলই খাবে। ধরে গ্লাসটাকে। শোন, তোমার স্বাস্থ্য ভাল করতে হবে।
দীপা প্ৰতিবাদ করার চেষ্টা করল, আমি কখনও দুধ খাই না।
আহাবে! দুধ খাই না! তোমার শ্বশুব শুনলে মজা টের পাইয়ে ছাড়বে। খাও।
ধমকটা এত জোরে হল দীপা গ্লাসটা নিল। সমস্ত শরীর গুলিয়ে দুধটা গলা দিয়ে নামাল। আঁচলে মুখ মুছল। নতুন শাড়ির আঁচল খরখরে লাগল ঠোঁটে।
নলিনী বললেন, তোমাব বাবা আজ আসবেন তো? শুনেছি, কে যেন মরে গেছে ওখানে?
কে মরেছে? প্রশ্নটা করেই ঝট করে ললিতাদির মুখটা ভেবে ফেলল সে।
একটা লোক। দেখো বাপু, তিনি না এলে লোকে নিন্দে করবে। শহরের কেউ তো বাকি নেই, সবাই আসবে। তার ওপর শুনছি। বিধান বায় আসবেন। বিধান বায়ের নাম শুনেছে? দেশের রাজা। কলকাতায় থাকে।
বাজা নয়, মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী। মাথা নিচু করেই শুধরে দিল দীপা।
ওই হল। এবার স্নানটান কবো। দুপুরে ভাত পরিবেশন করতে হবে তোমাকে। জ্ঞাতি ভাইদের পাতে ভাত দিয়ে। তবে আমাদের সংসারের মানুষ হবে।
নলিনী চলে গেলেন আনকে সঙ্গে নিয়ে। দীপার মুখে তখন ঠাণ্ডা দুধেব বিস্বাদ।
নতুন বউ ভাত পরিবেশন করবে কিন্তু বাড়িতে ফেরার সময় পাচ্ছিলেন না প্ৰতুল বন্দোপাধ্যায়। চীফ মিনিস্টার টাউনে এসে গিয়েছেন। কম্যুনিস্ট পার্টি থেকে বিক্ষোভ দেখাতে পারে এই আশংকায় সার্কিট হাউসে্র সামনে পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। তবু প্ৰতুল বাবু একবার সার্কিট হাউস আর একবার কংগ্রেস অফিস করে বেড়াচ্ছেন। নেতারা কথা দিয়েছেন যেমন করেই হোক পাঁচ মিনিটের জন্যেও চীফ মিনিস্টারকে নিয়ে যাবেন বিয়েবাড়িতে। সাংবাদিকরা জেনে গিয়েছেন প্রতুলবাবু উদ্ধাস্তু পুনর্বাসন তহবিলে দশ হাজার টাকা প্ৰদান করবেন। চীফ মিনিস্টার এখন ডুয়ার্সে। ফিরে এসে মিটিং করবেন প্রশাসনের কর্তাদের সঙ্গে। প্রতুলবাবু সার্কিট হাউস ছেড়ে আসতে ঠিক ভরসা পাচ্ছিলেন না। যেভাবে দ্রুত সব কিছু পাল্টে যাচ্ছে তাতে চোখের আড়াল হলে নেতাদের চাপের মধ্যে রাখা যাবে না। দাদা নেই। তিনি খগেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের সঙ্গে ড়ুয়ার্সে গিয়েছেন আগেই। এদিকে ঘড়িতে এখন তিনটে বাজে। বাড়ি থেকে লোক এসে দুবার ঘুরে গিয়েছে। বউ বসে আছে ভাত নিয়ে। তিনি না খেলে বউভাত হতে পারছে না। চুলোয় যাক বউভাত। একদিন ভাত না খেলে কোন ক্ষতি হবে না। কিন্তু চীফ মিনিস্টারকে নিয়ে যদি আজকের রাতের অনুষ্ঠানে যাওয়া যায় তাহলে দুদুটা বড় কন্ট্রাক্ট পকেটে এসে যাবে। তখন খাও না কত ভাত খাবে। দশ হাজার টাকা অনেক গুণ হয়ে ফেরত আসবে। তিনি বলে পাঠালেন যাব খিদে পেয়েছে সে যেন খেয়ে নেয। তাঁর ফিরতে দেরি হবে।
চীফ মিনিস্টার এলেন বিকেল পাঁচটায়। লম্বা স্বাস্থ্যবান মানুষটি সার্কিট হাউসে এখনই মিটিং-এ বসবেন। একজন বড় নেতা প্রতুলবাবুকে সেই ফাঁকে তাঁর কাছে নিয়ে গেলেন, ইনি এখানকার একজন বিখ্যাত ব্যবসাদার। আমাদের সমর্থক। উদ্বাস্তুদের জন্যে দশ হাজার টাকা দিতে চান।
খুব ভাল কথা। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আপনি চেকটা জেলাশাসকের মাধ্যমে কলকাতায় পাঠিয়ে দেবেন। আপনাদের মত মানুষ যত এগিয়ে আসবেন তত সমস্যার মোকাবিলা করা সহজ হবে আমার।
আর একজনের দিকে ফিরে কথা শুরু করতেই নেতা প্রতুলবাবুকে ইশারা করলেন বেরিয়ে যেতে। প্রতুলবাবু তাঁকে ফিসফিস করে বিয়েবাড়িতে যাওয়ার কথা বললেন।
নেতা জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি তো আজ রাত্রে জলপাইগুড়িতেই থাকছেন?
না হে। শিলিগুড়িতে চলে যাব এখনই। কই, মিটিঙের ব্যবস্থা হয়েছে?
ছটার সময় খেতে বসলেন প্রতুলবাবু। আজ বাড়ির বেশীর ভাগ মানুষ অভুক্ত। খিদেয়, ঘুমিয়ে পড়েছিল দীপা। তাকে তুলে আনা হল। বাইরে আলো জ্বলছে। সানাই বাজছে। রাতের নিমন্ত্রিতরা আসতে শুরু করেছে এর মধ্যে। নলিনীর নির্দেশে এক হাতা ভাত গামলা থেকে তুলে শ্বশুরের পাতে দিল দীপা। ঠাণ্ডায় ভাত ডেলা পাকিয়ে গিয়েছিল। সেটা ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে দাঁতে দাঁত চাপালেন প্রতুলবাবু, অপয়া।