০৯. বান্ধবপুর গ্রামের নৌকাঘাটায়

বান্ধবপুর গ্রামের নৌকাঘাটায় চৈত্রমাসের এক সকালে ছইওয়ালা একটা নৌকা ভিড়েছে। নৌকার আরোহী তরুণ এক যুবাপুরুষ। তার চোখে বাহারি চশমা। গাত্রবর্ণ গীের। এই গরমেও তার গায়ে ঘিয়া রঙের চাদর। কালো চামড়ার একটা ব্যাগ তার সঙ্গে। নৌকা ঘাটে ভেড়ার পরও যুবাপুরুষ নৌকা থেকে নামছে না। কাছেই কোথাও গুলির শব্দ হচ্ছে। একটা শব্দ না। অনেক শব্দ।

এই নিস্তরঙ্গ গহীন গ্রামে গোলাগুলির শব্দ হবে কেন? যুবাপুরুষ অবাক হয়ে নৌকার মাঝিকে জিজ্ঞেস করল, শব্দ কিসের গো?

মাঝি বলল, শিমুল ফুলের বিচি ফাটতাছে। এই অঞ্চলে শিমুল গাছ বেশি। মাছহাঁটায় আছে সাতটা শিমুল গাছ।

যুবাপুরুষ ব্যাগ হাতে নৌকার ছাঁইয়ের ভেতর থেকে বের হয়ে মুগ্ধ হয়ে গেল। গাছ থেকে মেঘের ছোট ছোট খণ্ডের মতো শিমুল তুলা বিচি ফেটে বের হচ্ছে, বাতাসে উড়ে উড়ে যাচ্ছে। তার কাছে মনে হলো, সে তার জীবনে এত সুন্দর দৃশ্য দেখে নি।

মাঝি বলল, আপনে যাবেন কই?

শশী মাস্টারের কাছে যাব। শশী মাস্টারকে চেন?

চিনব না কী জন্যে? উনারে কে চিনে না বলেন। পাগলা মাস্টার।

পাগল না-কি?

বিরাট পাগল। চরের বালি দিয়া শরীর ঢাইক্যা শুইয়া থাকে। সারারাইত হাঁটে।

কেন?

ক্যামনে বলব? পাগল মানুষের কাজের কোনো ঠিকানা থাকে না। তয়। লোক ভালো। শিক্ষক ভালো। আমার এক পুলা তার স্কুলে যায়। পুলার নাম তমিজ মিয়া।

বাহ, সুন্দর নাম।

আপনার নাম কী? আমার নাম মফিজ।

মোহাম্মদ মফিজ।

মাঝি অবাক হয়ে বলল, আপনি মুছলমান?

নাম শুনে কী মনে হয়?

আমি ভাবছিলাম আপনে হেন্দু। আপনের চেহারার মধ্যে হেন্দু আছে।

আমার গালে দাড়ি দেখছি না?

অনেক হেন্দুর মুখেও দাড়ি আছে। শশী মাস্টারের গালেও দাড়ি।

শশী মাস্টারের কাছে যাব কীভাবে বলে দাও।

বাজারের রাস্তা বরাবর যাবেন। শেষ মাথায় দেখবেন ডাইনে এক রাস্তা। বঁয়ে আরেকটা। ডাইনের রাস্তায় যাবেন। জুম্মাঘর পাইবেন। জুম্মাঘরে মাওলানা ইদরিস সাহেবরে পাইবেন, সে পথ বাতলায়া দিবে। পাগলা মাস্টার নদীর ধারে ঘর বানায়া একলা থাকে। হরিবাবুর বাড়ি পুরা খালি। সেখানে থাকবে না। তার নাকি ‘জল’ না দেখলে ঘুম আসে না।

মোহাম্মদ মফিজ নৌকা থেকে নামল। শিমুল গাছের নিচ থেকে কিছু তুলা কুড়ালো, তারপর হাঁটতে শুরু করল। আজ হাটবার না থাকায় দোকানপাট বেশিরভাগই বন্ধ। যুবাপুরুষকে কেউ লক্ষ করল না।

এই রূপবান যুবাপুরুষের আসল নাম জীবনলাল চট্টোপাধ্যায়। বাড়ি ঢাকা জেলার পাত্রসারে। পিতা জানকিনাথ। ১৯০৭ সনে ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলায় প্রথম গ্রেপ্তার হন। প্রমাণাভাবে ছাড়া পান। আলীপুর বোমা মামলার পর বাঘা যতীনের সংস্পর্শে আসেন। এখন তিনি পলাতক। পুলিশ ভয়ানক সন্ত্রাসী হিসেবে তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। তার মাথার দাম পাঁচ হাজার টাকা ঘোষণা করেছে। জীবনলাল এসেছেন। আত্মগোপন করতে।

 

মাওলানা ইদরিস মসজিদের সামনে কাঠের টুলে বসে আছেন। তার চোখেমুখে মুগ্ধতা। মুগ্ধতার কারণ মসজিদের টিউব কল। হরিচরণ এই টিউবওয়েল করে দিয়ে জায়গাটা বাঁধিয়ে দিয়েছেন। লোকজন পাত্র নিয়ে পানি নিতে আসে, তাঁর দেখতে খুব ভালো লাগে। আল্লাহর অসীম রহমতে পানি বের হয়েছে অতি স্বাদু। যে একবার এই পানি খাবে, তার স্বাদ মনে থাকবে। তাঁর মনে একটাই কষ্ট – হিন্দু সম্প্রদায়ের কেউ পানি নিতে আসছে না। পানির তো আর হিন্দু মুসলমান নেই। মসজিদের টিউব কলের পানি যে-কেউ খেতে পারে। হিন্দুরা খায় না। ন্যায়রত্ন রামনিধি ঘোষণা দিয়েছেন, যে এই জল পান করবে সে মহাপাতকি হবে।

আসসালামু আলায়কুম!

মাওলানা ঘাড় ঘুরিয়ে অচেনা আগন্তুককে দেখলেন। উঠে দাঁড়িয়ে বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ওয়ালাইকুম সালাম। জনাব, আপনার পরিচয়?

আমার নাম মোহাম্মদ মফিজ। আমি বাবু হরিচরণের স্কুলের নতুন শিক্ষক।

মাওলানার মন আনন্দে পূর্ণ হলো। আশেপাশের অঞ্চলের কোনো স্কুলেই মুসলমান শিক্ষক নেই। এই প্রথম একজন পাওয়া গেল। মাওলানা এগিয়ে গেলেন। হাত মেলালেন।

শশী মাস্টারের বাড়িতে যাব। কোনদিকে যাব যদি বলে দেন।

মাওলানা বললেন, আমি নিজে আপনাকে নিয়ে যাব। প্রথম এই অঞ্চলে এসেছেন, জুম্মাঘরের সীমানায় পা দিয়েছেন, দুই রাকাত নফল নামাজ পড়েন, তারপর চলেন। আপনাকে নিয়ে যাই। আপনার দেশের বাড়ি কোথায়?

জব্বলপুর।

শুনে খুশি হলাম। আপনি কোন মাজহাবের?

আমি হানাফি। ইমাম আবু হানিফার মাজহাব।

আলহামদুলিল্লাহ। আমি নিজে হানাফি মাজহাবের। একটা কথা বলব, যদি কিছু মনে না নেন।

অবশ্যই বলবেন।

আপনি অল্পবয়সে সুন্নতি দাড়ি রেখেছেন দেখে ভালো লাগছে। কিন্তু ভাই সাহেব, দাড়ির সঙ্গে গোঁফ রাখা ঠিক না। আমাদের নবিজি সাল্লাল্লাহু আলায়হেস সালাম গোঁফ রাখতেন না। দাড়িগোঁফ একসঙ্গে রাখা সুন্নতের বরখেলাফ। কোনো খাদ্যদ্রব্যের সাথে যদি গোঁফের স্পর্শ হয় সেই খাদ্যদ্রব্য নাপাক হয়ে যায়।

আগুন্তুক বলল, আমার মায়ের কারণে গোঁফ রাখতে হয়েছে। মা বলেন গোঁফ ছাড়া দাড়িতে আমাকে না-কি খুবই খারাপ দেখায়।

তাহলে ঠিক আছে। মায়ের মনে কষ্ট দেয়া কোনোক্রমেই ঠিক না। নবিজির হাদিস আছে- ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।’ আপনার কি অজু আছে? না-কি অজু করবেন?

অজু করব।

আসেন অজু করেন। আমি কল চাপব। এই কল নতুন বসানো হয়েছে। অতি সুমিষ্ট পানি। এক চুমুক খেলে দিল ঠাণ্ড হয়।

মাওলানা তাকিয়ে আছেন। আগন্তুক অজু ঠিকমতো করতে পারছে কি-না এটাই তাঁর দেখার বিষয়। বেশিরভাগ মানুষ অজু ঠিকমতো করতে পারে না। হাতে ধরে অজু শেখাতে হয়। অজুর দোয়া শেখাতে হয়।

আপনি কি অজুর নিয়ত জানেন?

আরবিতে জানি না। নিয়ত বাংলায় পড়ি।

বাংলায় পড়লেও হবে। সোয়াব সামান্য কম হবে। আমি আপনাকে আরবি নিয়ত শিখায়া দিব।

আগুন্তুক বললেন, শুকরিয়া।

আগন্তুক সুষ্ঠুমতে অজু করল। মাওলানা আনন্দ পেলেন।

 

মোহাম্মদ মফিজ শশী মাস্টারের বাড়ি দেখে বলল, বাহ্।

শশী বলল, বাহ মানে কী? আনন্দের বাহ না অবজ্ঞার বাহ?

মফিজ বলল, বিস্ময়ের বাহ। তোর বাড়িঘর দেখে মনে হচ্ছে ইংরেজ থাকুক। ইংরেজের মতো। আমরা এইখানে জীবন পার করে দেই। মৎস্য মারিব খাইব সুখে।

শশী মাস্টার বলল, এক্কেবারে আমার মনের কথা।

মফিজ বলল, এটা কি তোর মাছ মারার জায়গা?

হুঁ। সুন্দর কি না বল?

‘বাহ্’। টাইপ সুন্দর।

মাছ ধরার জায়গাটা বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া। হিজল গাছের বড় দুটা ডাল মাধাইখালের উপর দিয়ে কিছুদূর যাবার পর উপরের দিকে উঠেছে। ডাল দুটার উপর পাটাতন বিছিয়ে মাছ ধরার জায়গা করা হয়েছে। রোদ যেন মাথায় না। লাগে সেই ব্যবস্থাও আছে।

শশী মাস্টার বলল, নিজের হাতে মাছ ধরি, রান্না করি।

মফিজ বলল, কাজকর্ম না থাকলে তুই না-কি চরের বালি মেখে শুয়ে থাকিস?

হুঁ। বালু চিকিৎসা।

এতে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। আমাদের উচিত লো প্রোফাইলে থাকা, দৃষ্টি আকর্ষণ করা না।

শশী মাস্টার বলল, আমি একমত হলাম না। হাই প্রোফাইলের মানুষ সবসময় চোখের সামনে থাকে বলে তাদের নিয়ে মাথা ঘামায় না। কৌতূহল তৈরি হয় লো প্রোফাইলের মানুষের দিকে।

মফিজ বলল, বিনোদের ফাঁসি হয়েছে, খবর পেয়েছিস?

হুঁ।

ফাঁসির সময় হঠাৎ না-কি খুব ভড়কে গিয়েছিল। চিৎকার চেচামেচি শুরু করেছিল। কিছুতেই ফাঁসিতে ঝুলিবে না। টেনে হিঁচড়ে তাকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছে।

শশী মাস্টার বলল, গাধা।

গাধা তো বটেই। এতে অন্য বিপ্লবীদের মন দুর্বল হয়। ভালো কথা, আমার থাকার জায়গা কি তোর এখানে?

না। আমি সাত্ত্বিক ব্ৰাহ্মণ। তোর মতো যবনকে নিজের বাড়িতে স্থান করে দেব কেন! তুই থাকিবি ঋষি হরির বাড়িতে।

ঋষি হরিটা কে?

যার স্কুলের আমি শিক্ষক তাঁর নাম হরিচরণ। লোকে তাঁকে অলৌকিক শক্তি সম্পন্ন সাধুপুরুষ হিসেবে জানে। যদিও তিনি জাতিচ্যুত। ধর্মচুত। ভালো কথা, তুই থাকিবি কতদিন?

জানি না কতদিন। তবে তোকে চলে যেতে হবে। তোর ডাক এসেছে। নতুন মিশন।

কবে যেতে হবে?

শিগগিরই যেতে হবে। তুই যাবি চট্টগ্রামে। মাস্টারদার সঙ্গে যোগ দিবি।

গুড। গেটআপ ভালো নিয়েছিস। দেখেই মনে হচ্ছে, অতি ধর্মপ্ৰাণ মাওলানা। নামাজের নিয়মকানুন জানিস?

অবশ্যই।

শশী মাস্টারের বর্শিতে মাছ ধরা পড়েছে। সে বর্শি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মাছের ঝাঁপাঝাপিতে মনে হচ্ছিল বিশাল কোনো মাছ। দেখা গেল বিশাল কিছু না, মাঝারি আকৃতির আড় মাছ।

শশী মাস্টার বলল, আমার মায়ের কোনো খবর রাখিস?

না। প্ৰাণ নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি।

তোর বাবা মা’র খবর কী?

জানি না। তোর গানাবাজনা কি চলছে?

হুঁ।

তোর জন্যে দুটা রেকর্ড এনেছি। কানা কেস্টর কীর্তন। এখনই বের করে দেব, না পরে নিবি?

এখন দে। সেলিব্রেট করি।

সেলিব্রেশনটা কিসের?

দুই বন্ধুর মিলন।

কলের গানে গান বাজছে। দুই বন্ধু পাশাপাশি বসে আছে।

তনু যৌবনে তপন তাটিনি
খেলে। কৃষ্ণ দ্বজ যায়…
যমুনায়, যমুনায়।…

শশী মাস্টার গান শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে বলল, ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে আমি প্রথম কাজ কী করব জানিস? বিবাহ করব।

অতি উচ্চশ্রেণীর কোনো চিন্তা বলে তো মনে হচ্ছে না।

এটা যে কত বড় উচ্চশ্রেণীর চিন্তা বিবাহের পর বুঝতে পারবি। পতিত কন্যা বিবাহ করব।

ডোম কন্যা? আছুৎ?

শশী মাস্টার জবাব না দিয়ে দ্বিতীয় রেকর্ডটি কলের গানে রাখল।

 

মোহাম্মদ মফিজের স্থান হলো হরিচরণের বাড়িতে।

শশী মাস্টার ব্যবস্থা করে দিলেন। শশী মাস্টার বললেন, মোহাম্মদ মফিজ আমার পরিচিত। জব্বলপুরের মানুষ। শহরের নোংরা আবহাওয়ায় শরীর খারাপ করেছে বলে কিছুদিন গ্রামে থাকবেন। আমি বাবার সঙ্গে দেখা করতে যাব। আমার অনুপস্থিতিতে উনি ছাত্র পড়াবেন।

হরিচরণ বললেন, কোনো অসুবিধা নাই। যতদিন ইচ্ছা থাকবেন। আমার বাড়ি তো খালি পড়ে আছে।

অতিথিকে হরিচরণের পছন্দ হলো। নির্বিরোধী ভালো মানুষ। পড়াশোনায় খুবই আগ্ৰহ। বেশিরভাগ সময় বই নিয়ে আছেন। বই পড়ার স্থানও বিচিত্র। কখনো পুকুরঘাটে, কখনো শতরঞ্চি পেতে শিউলিতলায়, আবার কখনো বা বই হাতে হাঁটতে হাঁটতে পড়া। হরিচরণের সঙ্গে অতিথির কথাবার্তা হয় না বললেই চলে। মানুষটা স্বল্পবাক।

টুকটাক কথা যা হয় খাবার সময় হয়। একদিন মফিজ বললেন, শুনেছিলাম আপনার দুটা হাতি আছে। হাতি কই?

হরিচরণ বললেন, পুরুষ হাতিটা বিক্রি করে দিয়েছিলাম। দুটা হাতি বাহুল্য ভেবেছি। মেয়ে হাতিটা আসামের জঙ্গলে পাঠিয়েছি। পুরুষ সঙ্গী খুঁজে বের করবে। কিছুদিন তার সাথে থাকবে, তারপর গর্ভবতী হয়ে ফিরে আসবে।

মফিজ বললেন, এও কি সম্ভব!

হরিচরণ বলল, সম্ভব কি-না জানি না। একটা পরীক্ষা বলতে পারেন। হাতির অন্তরে মায়াভোব প্রবল। সে গৃহকতাঁর কাছে ফিরে আসে। গৌরীপুরের মহারাজার একটা মাদী হাতি পালিয়ে আসামের জঙ্গলে চলে গিয়েছিল। গৰ্ভবতী। হয়ে সে মহারাজার কাছে ফিরে আসে। হাতি জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আসার বুদ্ধি সেখান থেকে পাওয়া।

আপনার এই জংলি বাগান অতি মনোহর। কত ধরনের গাছ আপনার আছে জানেন?

না।

আমি গাছের একটা পূর্ণ তালিকা তৈরি করছি। আপনার এখানে কিছু দুর্লভ গাছ আছে। কপূর গাছ যে আছে আপনি জানেন?

না। আমার বাবার গাছের শখ ছিল, তিনি নানান জায়গা থেকে গাছ এনে লাগিয়েছিলেন। আমার গাছের শখ নাই।

আপনার কিসের শখ?

আমার কোনোকিছুর শখ নাই। তবে আপনার গাছের প্রতি আগ্রহ দেখে ভালো লাগল।

আমাদের নবিজির গাছপালার প্রতি প্ৰবল আগ্রহ ছিল। একটা হাদিসে আছে তিনি বলেছেন– ‘তুমি যদি জানো পরের দিন রোজ কেয়ামত, তারপরেও একটা গাছ রোপণ করো।’

হরিচরণ মুগ্ধ গলায় বললেন, বাহ সুন্দর কথা তো!

মফিজ বললেন, নবিজির অনেক সুন্দর সুন্দর কথা আছে। আপনি আগ্রহী হলে আমি আপনাকে বলব।

হরিচরণ বললেন, আরেকটা বলুন।

মফিজ বললেন, আপনি নিশ্চয়ই জানেন, আরবের অন্ধকার যুগে কন্যা শিশুদের নানাভাবে নির্যাতন করা হতো। অনেককে জীবন্ত কবর দেয়া হতো। নবিজি। সারাজীবন চেষ্টা করেছেন শিশুকন্যাদের মঙ্গল করতে। তার একটা হাদিস আছে, তিনি বলেছেন— ‘যারা শিশুকন্যাদের জন্যে কোনো উপহার নিয়ে আসে, তারা যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে খাদ্যসামগ্ৰী আনার মতো পুণ্যের কাজ করে।’

হরিচরণ বললেন, আপনার তো ধর্ম বিষয়ে অনেক জানাশোনা, কিন্তু আপনাকে ধর্মকর্ম করতে দেখি না। মুসলমানদের দৈনিক পাঁচবেলা নামাজ পড়ার বিধান আছে বলে শুনেছি।

ঠিকই শুনেছেন। আমি সেরকম ধাৰ্মিক মানুষ না। আমি শুধু জুম্মাবারে মসজিদে যাই। এখন আপনি যদি বিব্রত না হন, তাহলে আপনাকে একটা প্রশ্ন করি?

করুন।

আপনি ধর্মচ্যুত হয়েছেন বলে শুনেছি। আপনি আমাদের পবিত্র ইসলাম ধর্ম গ্ৰহণ করছেন না কেন?

হরিচরণ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, সমাজ আমাকে ধর্মচ্যুত করেছে। আমি তো নিজেকে করি নাই।

ব্ৰাহ্মধর্ম গ্ৰহণ করতে পারেন। অনেক বিশিষ্টজন ব্ৰাহ্মধর্ম গ্রহণ করেছেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাদের মধ্যে একজন।

ব্ৰাহ্মধর্ম বিষয়ে আমি কিছু জানি না।

আপনি অনুমতি দিলে এই বিষয়েও আপনাকে কিছু বলব।

ব্ৰাহ্মধর্মের বিষয়ে আমি জানতে চাই।

আমি যা জানি আপনাকে বলব। এই ধর্মের প্রচলন করেন রাজা রামমোহন রায়। ইসলামধর্ম এবং খ্রিষ্টধর্ম সম্পর্কে উনার প্রচুর জ্ঞান ছিল। এই ধর্মে প্রভাবিত হয়ে তিনি ব্ৰাহ্মধর্ম শুরু করেন। এই ধর্মের মূল বিষয় একেশ্বরবাদ। ব্ৰাহ্মরা মূর্তিপূজার ঘোরবিরোধী। আপনি জনহিতকর কাজ করতে চান এমন শুনেছি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে সাহায্য করবেন?

হরিচরণ বিস্মিত হয়ে বললেন, তার সাহায্যের প্রয়োজন কী?

তিনি বিশ্বভারতী নামের ইউনিভার্সিটি শুরু করেছেন। তাঁর প্রচুর অর্থ প্রয়োজন।

আমার মতো অভাজনের অর্থ কি তিনি গ্রহণ করবেন?

অবশ্যই করবেন। আমি কি আপনার হয়ে অর্থ প্রেরণের ব্যবস্থা করব?

করলে ভালো হয়।

হরিচরণ আনন্দিত। এই তরুণের বিভিন্ন বিষয়ের জ্ঞান তাকে মুগ্ধ করেছে। তিনি বিস্মিত।

বান্ধবপুরের আরো একজনকে মফিজ বিস্মিত করল। তার নাম ইদরিস। মসজিদের ইমাম। জুম্মার দিনে, নামাজের পরে দু’জন বসে থাকেন। ধর্মের নানান খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। মফিজ ধর্ম নিয়ে নবিজিকে নিয়ে নানান কথা বলেন। মাওলানা ইদরিসের বড় ভালো লাগে। নবিজি কখনো তসবি পড়তেন না, হাতের আঙুলে গুনতেন- এই তথ্য মাওলানা ইদরিস জানতেন না। নবিজি ঘাড় পর্যন্ত উঁচু একটা লাঠি সবসময় ব্যবহার করতেন, এই তথ্যও মাওলানা ইদরিসের অজানা। তিনি জানতেন নবি হযরত মুসা। আলায়হেস সালামই শুধু লাঠি ব্যবহার করতেন— যে লাঠি মাটিতে ফেললে সাপ হয়ে যেত।

জুম্মাবারে নামাজ পড়ার কারণে মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রায় সবার সঙ্গেই মোহাম্মদ মফিজের সখ্য হলো। সবচে’ বেশি হলো ধনু শেখের সঙ্গে। ধনু শেখের বাড়িতে যে-কোনো উৎসবে মোহাম্মদ মফিজের ডাক পড়ে। ছেলের খৎনা, মেয়ের জন্ম উপলক্ষে আকিকা, অন্য কেউ থাকুক না-থাকুক মোহাম্মদ মফিজ আছে। খাওয়া-দাওয়ার শেষে খাসকামরায় গল্পগুজব।

ধনু শেখ পান চাবাতে চাবাতে হুক্কার নল টানতে টানতে দরাজ গলায় বলে, মফিজ ভাই! আমি যে দিলখোলা লোক এইটা বুঝেন তো? পূর্ব-পশ্চিম-উত্তরদক্ষিণ সবদিক আমার খোলা।

মফিজ বলেন, শুধু চারদিক কেন? বাকি ছয়দিকও আপনার খোলা।

বাকি ছয়দিক কী? ঈশান, নৈঋত, বায়ু, অগ্নি, উর্ধ্ব, অধ।

বাহবা। আপনার তো জ্ঞানের সীমা নাই। আমি মূর্থি, মহামুর্থ। তবে এমন মুর্থ যার ধন আছে।

শুধু ধন না, বুদ্ধিও আছে। বুদ্ধি বিনা ধন আসে না।

মারহাবা। ভালো বলেছেন। এইজন্যেই আপনাকে পিয়ার করি। আমার বুদ্ধি কেমন সেই বিষয়ে একটা গল্প শুনবেন?

শুনব।

ধনু শেখ গলা নামিয়ে বলল, আপনাকে অতি আপনা লোক ভেবে বলতেছি। আর কাউরে এই ঘটনা বলা যাবে না। যৌবন বয়সে এই বুদ্ধি মাথায় আসল। কোনো হিন্দুমেয়েকে যদি কোনোরকমে পাট খেতে ঢুকায়ে ফেলা যায়, তার সঙ্গে কুকর্ম করা যায়, সে এই কথা প্রকাশ করবে না। প্রকাশ করলে তার জাত যাবে। তার গুষ্ঠির জাত যাবে। কাজেই কুকর্মের কথা কেউ জানবে না।

মফিজ বললেন, বুদ্ধিমতো কাজ করেছেন?

কয়েকবার করেছি। যা ভেবেছিলাম। তাই হয়েছে। কেউ মুখ ফুটে কিছু বলে নাই। হিন্দুর কাছে জাত বিরাট জিনিস। ঠিক না?

হুঁ।

বুঝেছি। কাজটা অন্যায়। দুষ্ট বয়সে কিছু অন্যায় সবাই করে। আমিও করেছি। পাপ হয়েছে মানি। সেই পাপ কাটান দেয়ার ব্যবস্থা নিয়েছি।

কী ব্যবস্থা?

এই অঞ্চলে মাদ্রাসা দিব। মাদ্রাসায় তালেবুল এলেমরা আল্লাখোদার নাম নেবে। তারা যে সোয়াব কামাবে তার একটা অংশ আমি পাব। ভালো বুদ্ধি না?

হুঁ।

আরো ব্যবস্থা রেখেছি। প্রতি ঈদুল ফিতরের নামাজের আগে আমি তওবা করি। এতে আগের সব পাপ কাটা যায়। নিম্পাপ অবস্থা শুরু হয়। বুদ্ধি ঠিক আছে না?

যিনি পাপ পুণ্য দেন। তিনি কি আর আপনার কূটবুদ্ধি বুঝবেন না?

তাও ঠিক। তারপরেও চেষ্টা চালায়ে যাব। কোনো এক ফাঁক দিয়ে বের হয়ে যাব। কানি জাল ফেলার পরে জাল যখন টানা হয়, তখন দেখা যায় কিছু মাছ ফাক দিয়ে আরামসে বের হয়। হয় না?

হয়।

মাদ্রাসার ব্যাপারে আপনি আমাকে সাহায্য করবেন। টাইটেল পাশ মাওলানা রাখব। ছাগলা ইদরিসকে দিয়ে কাজ হবে না।

ইদরিস মাওলানা মানুষ হিসেবে প্রথম শ্রেণীর।

ইদরিস মানুষ খারাপ। এইটা আমি বলব না, তবে তার প্রধান দোষ–মালাউনরে তোয়াজ করা। মালাউনরে তোয়াজের কী আছে?

মফিজ বললেন, হিন্দুদের প্রতি আপনার এই প্রবল বিদ্বেষের কারণ কী?

কারণ একটাই— এরা মুসলমানদের মানুষই মনে করে না। মনে করে আমরা কুকুরের অধম। ছোটবেলায় এক মিষ্টির দোকানে ভুলে ঢুকে পড়েছিলাম। ময়রা কী করল শুনেন। দোকানের সব মিষ্টি নিয়ে পুকুরে ফেলল। আমারে মারতে মারতে মিষ্টির উপরে ফেলল। কেউ কিছুই বলল না। মুসলমানরাও না। আফসোস কি-না বলেন?

অবশ্যই আফসোস।

বদগুলা স্বরাজ স্বরাজ করতেছে। স্বরাজ আসুক, পিটায়া লাশ বানাব। ইংরাজ পুলিশের ভয়ে এখন কিছু করতে পারতেছি না। হিসাব মতো হিন্দুস্থানের মালিক আমরা। দিল্লির সিংহাসন ছিল আমাদের। যদি স্বরাজ হয়, হিন্দুস্থানের নাম বদলায়া করব।– মুসলমান স্থান।

 

সপ্তাহে একদিন হরিচরণের কাছে ‘কলিকাতা গেজেট’ নামের পত্রিকাটি আসে। মফিজ পত্রিকাটি অতি আগ্রহের সঙ্গে পড়েন। বিপ্লবীরা কোথায় কী করছে সব খবর পাওয়া যায়। পুলিশের কর্মকাণ্ডের খবরও থাকে।

ব্রিটিশ সিংহ কিছুটা নরম হয়েছে এটা বোঝা যাচ্ছে। প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হয়েছে। ব্রিটিশ সরকারের ভারতবাসীর সমর্থন দরকার। তাদের ভাবভঙ্গি থেকে মনে হচ্ছে, তারা যুদ্ধে জিতলে কিছুটা ছাড় দেবে। অনেকেই ব্রিটিশদের কথা বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন। কাজী নজরুল ইসলাম তখন শিয়ারশোল রাজ

যোগ দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে নিজেকে সরাসরি যুক্ত করেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বঙ্গদেশের মুসলমানদের জন্যে শুভ হয়েছিল। মুসলমানদের বড় অংশ চাষী শ্রেণীর। পাট তাদের প্রধান কৃষিপণ্য। যুদ্ধের কারণে পাটের দাম লাফিয়ে বাড়তে শুরু করে। পাঁচ টাকা মণ থেকে সত্তর টাকা মণে পৌঁছে যায়।

হতদরিদ্র চাষী মুসলমান শ্রেণীর হাতে প্রথম কিছু কাঁচা টাকা চলে আসে। বেশিরভাগই সেই কাঁচা টাকা ব্যয় করে ফুর্তির পেছনে। রঙিলা বাড়ি ঝলমল করতে থাকে। ঘাটু গান এবং যাত্ৰা গানের জোয়ার শুরু হয়।

চাষী মুসলমান শ্রেণীর একটা ক্ষুদ্র অংশ কাঁচা টাকা ব্যয় করেন সন্তানদের পড়াশোনার পেছনে। বেশকিছু মুসলমান ছাত্র প্রথমবারের মতো স্কুলে ভর্তি হলো। কোলকাতায় বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত মেমোরিয়েল গার্লস স্কুলযার যাত্রা শুরু হয়েছিল এগারোজন ছাত্রী নিয়ে তার ছাত্রী সংখ্যা বেড়ে হলো সত্তর। বেশিরভাগই মুসলমান ছাত্রী।

 

হরিচরণ রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে একটা চিঠি পেয়েছেন। মোটা হলুদ কাগজে টানা লেখা। শেষে নামসই করা— শ্ৰী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। চিঠিতে লেখা—

শ্ৰী হরিচরণ সাহা, প্রীতিভাজনেষু,

বিনয় সম্ভাষণপূর্বক নিবেদন— আপনার প্রেরিত অর্থ পাইয়াছি। এই অর্থ গ্রীষ্মের তাপদাহে শীতল জলধারার মতো বোধ হইয়াছে। আপনার কল্যাণ হোক।

ইতি
শ্ৰী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শান্তিনিকেতন।

হরিচরণ এই চিঠি। দীর্ঘসময় কপালে ছুইয়ে রাখলেন। তারপরেও মনে হলো চিঠির যথাযোগ্য সম্মান করা হলো না।

চিঠি তাকে মহাবিব্রত করল। সেই চিঠি পত্ৰবাহক মারফত হাতে হাতে পাঠিয়েছেন মনিশংকর দেওয়ান। সেই চিঠিতে লেখা–

আমি মহাবিপদে পড়িয়া আপনার শরণাপন্ন হইলাম। একমাত্র পুত্র শিবশংকর দুরারোগ্য রোগে মৃত্যুপথযাত্রী। ডাক্তার-কবিরাজ কেহই রোগের কারণ বা প্ৰতিকারের পথ দিতে পরিতেছে না। আমি সাহেব ডাক্তার দেখাইয়াছি। ইউনানী চিকিৎসাও করিয়াছি। আমার পুত্রের যন্ত্রণা সীমাহীন। পিতা হিসেবে এই যন্ত্রণা দেখা আমার পক্ষে অসম্ভব হইয়া দাঁড়াইয়াছে। লোকমুখে শুনতে পাই আপনি ঈশ্বরের আশীর্বাদে রোগহরণ করিতে পারেন। শেষ চেষ্টা হিসেবে আপনার দ্বারস্থ হইলাম। আমি পুত্রকে নিয়া যেকোনো সময় বান্ধবপুরে উপস্থিত হইব। আপনি যথাসাধ্য করিবেন। ইহাই আমার প্রার্থনা। যাত্রার শুভদিন নির্ণয়ের জন্যে পঞ্জিকা দেখিতেছি। বুধবার বারবেলা শুভদিন পড়িয়াছে। ঐ দিন রওনা হইবার সম্ভাবনা আছে। বুধবার রওনা হইলে শুক্রবার নাগাদ পৌছিবার কথা। বাকি ঈশ্বরের ইচ্ছা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *