০৯. বানরের জন্যে ভালবাসা

৯. বানরের জন্যে ভালবাসা

মুনিয়া এসে রিতুকে বলল, “চাচি, আমরা চা-বাগানে বেড়াতে যাচ্ছি। বল্টুকে আমাদের সাথে নিয়ে যাই?”

রিতু চমকে উঠে বলল, “কী বললে? বল্টুকে সাথে নিয়ে যাবে?”

“হ্যাঁ।”

“তুমি এর মানে জানো?”

“জানি, চাচি।”

“উঁহু। তুমি জানো না। বল্টুকে সাথে নিয়ে যাবার অর্থ আগামী কয়েক দিন তোমাদের ঘুম, খাওয়া-দাওয়া, বেড়ানো সবকিছু শেষ। সারাক্ষণ সে কিছু একটা করবে আর তোমাদের বারোটা বেজে যাবে!”

মুনিয়া হি হি করে হাসল, বলল, “না, চাচি, আমাদের একটুও বারোটা বাজবে না। বল্টু সায়েন্টিস্ট মানুষ–সায়েন্টিস্টরা একটু অন্য রকম হয়।

আমরা সেটা জানি।”

রিতু মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “তোমরা মোটেই জানো না। বল্টু যতক্ষণ না ঘুমিয়ে যায় ততক্ষণ আমি এক সেকেন্ডের জন্য শান্তিতে থাকতে পারি না। সারাক্ষণই ও কিছু না কিছু করছে।”

মুনিয়া বলল, “সেটাও আমরা জানি।”

“আমি ওকে পেটে ধরেছি, আমিই সামলাতে পারি না, তোমরা কেমন করে সামলাবে?”

“আমরা সামলানোর চেষ্টা করব না, ওকে ওর মতো থাকতে দিব। আমাদের নান্টুর সাথে ওর খুব খাতির। দুজন একসঙ্গে থাকলে আমাদের কিছু করতে হবে না। একজন আরেকজনকে ব্যস্ত রাখবে।”

রিতু বলল, “তা ঠিক। নান্টু আর বল্টু দুজন থাকলে অন্যদের একটু রক্ষা হয়।”

মুনিয়া হি হি করে হেসে বলল, “আপনি জানেন চাচি, এ দুজন এখন মুখেও কথা বলে না। আঙুল নেড়ে নেড়ে কীভাবে জানি কথা বলে!”

“তাই নাকি?”

“হ্যাঁ, চাচি। খুব মজা।” মুনিয়া বলল, “তাহলে বল্টু যাবে আমাদের সাথে? আমরা দুদিন থাকব। আব্বুর বন্ধুর একটা চা-বাগান আছে। সেখানে খুব সুন্দর গেস্টহাউস।”

রিতু নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “ঠিক আছে, যাক। আমি তাহলে দুদিন শান্তিতে ঘুমাব!”

বল্টু যখন খবর পেল সে নান্টুদের সঙ্গে চা-বাগানে যাবে, তখন তার উত্তেজনার কোনো সীমা থাকল না। তার প্রথম কৌতূহলটা হলো চা নিয়ে। চা-বাগানে কি বিশাল চায়ের কাপে চা বানানো থাকে? চারদিকে ফুলগাছ, আর মানুষজন সেখানে ঘুরে ঘুরে চা খায়? রিতু যখন বলল, না, সেখানে চায়ের গাছ থাকে, তখন সে ভারী অবাক হলো। জিজ্ঞেস করল, “গাছ থেকে টি-ব্যাগ ঝুলে থাকে?”

রিতু বলল, “উঁহু, গাছ থেকে টি-ব্যাগ ঝুলে থাকে না। যে গাছের পাতা দিয়ে চা বানানো হয়, সেই গাছগুলোর বাগান হচ্ছে চা-বাগান।”

“গাছগুলো কত বড়? আমগাছের মতো?”

“না, এত বড় না। মানুষের পেট সমান উঁচু।”

“গাছের পাতা কি চায়ের পাতার মতো কালো রঙের?”

“না, সবুজ। যখন চা বানানো হয় তখন সেটার রং হয় কালো।”

“কেমন করে চা বানানো হয়?”

“সেখানে ফ্যাক্টরি থাকে, সেই ফ্যাক্টরিতে চা বানানো হয়।”

“আমরা কি ফ্যাক্টরিতে থাকব?”

রিতু হেসে বলল, “না রে পাগল, না। তোরা ফ্যাক্টরিতে থাকবি না। মানুষজন চা-বাগানে বেড়াতে যায়, তার কারণ বাগানগুলো অনেক জায়গা জুড়ে থাকে–টিলার মতো উঁচু-নিচু, তার মধ্যে সবুজ চায়ের গাছ। শহর থেকে দূরে, নির্জন-নিরালা পরিবেশ, সুন্দর গেস্টহাউস খুব সুইট পরিবেশ। মানুষ সে জন্যে চা-বাগানে বেড়াতে যায়।”

“নির্জন, নিরালা?” বল্টু চোখ বড় বড় করে বলল, “মানুষজন থাকে না?”

L

“একটু কম থাকে।”

“বাঘ ভালুক থাকে? ডাকাত থাকে?”।

“বাঘ-ভালুক থাকে না। ডাকাতও থাকে না।”

বল্টুকে পরের কয়েক দিন খুব ব্যস্ত দেখা গেল। যদিও আম্মু বলেছে সেখানে বাঘ-ভালুক নেই, ডাকাত নেই, তবু একটু সতর্ক থাকা ভালো। বল্টু তার ব্যাগের ভেতর নানা ধরনের জিনিস দিয়ে বোঝাই করে ফেলল। কিছু দরকারি জিনিস, কিছু তার আবিষ্কার। যেদিন তারা রওনা দেবে, তার আগের রাতে উত্তেজনায় তার চোখে ঘুম আসছিল না। বিছানায় শুয়ে সে রিতুকে বলল, “খুব সকালে আমাকে তুলে দেবে। ঠিক আছে?”

“ঠিক আছে।”

“দেরি কোরো না কিন্তু, তাহলে নান্টুরা আমাকে রেখে চলে যাবে।”

“না, চলে যাবে না।”

“নান্টু একা একা চা-বাগানে গেলে কিন্তু কিছুই করতে পারবে না। খুবই ঝামেলা হবে। হারিয়ে যাবে, কেউ তাকে খুঁজেই পাবে না।”

“তোকে সেটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।”

মানুষকে ঘুম পাড়ানোর একটা যন্ত্র কীভাবে আবিষ্কার করা যায়, সেটার কথা ভাবতে ভাবতে একসময় বল্টু ঘুমিয়ে পড়ল।

এমনিতে বল্টুকে ঘুম থেকে তোলা খুব কঠিন ব্যাপার, কিন্তু পরদিন সে খুব সহজেই উঠে গেল। হাত-মুখ ধুয়ে কিছু একটা খেয়ে তার ব্যাগ নিয়ে ছুটে গেল নান্টুদের বাসায়। চা-বাগানে যাওয়ার জন্য একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করা হয়েছে। পিছনে জিনিসপত্র তোলা হলো। সামনের সিটে বসেছেন নান্টুর আব্বু। মাঝের সিটে মুনিয়া আর তার আম্মু। পিছনের সিটে নান্টু আর বল্টু। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাইক্রোবাস ছেড়ে দিল। খুব ভোর বলে শহরে গাড়ির ভিড় নেই। দেখতে দেখতে গাড়িটা শহর ছেড়ে বের হয়ে যেতে থাকে।

যখন মাইক্রোবাস চলতে শুরু করেছে, তখন নান্টু আর বল্টু কথা বলতে শুরু করল। অবশ্য বেশির ভাগ সময়ই সে কথা অন্যরা শুনতে পাচ্ছিল না। হাতের আঙুল নাচিয়ে তারা কথা বলার একটা টেকনিক আবিষ্কার করেছে, সেটা দিয়ে মুখে কোনো কিছু না বলেই তারা একটানা কথা বলে যেতে পারে।

.

তারা চা-বাগানে পৌঁছাল দুপুরবেলা। গাড়ি থামিয়ে দরজা খোলার আগেই নান্টু-বল্টু লাফিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেল। সাদা রঙের ছবির মতো একটা গেস্টহাউস, সামনে খুব সুন্দর ফুলের বাগান। গাড়ি থেকে যখন অন্যরা নামছে, তখন গেস্টহাউস থেকে সাদা পোশাক পরা লোকজন বের হয়ে জিনিসপত্র ভেতরে নিতে থাকে।

নান্টু আর বল্টু গেস্টহাউসের বাইরে দিয়ে হাঁটতে থাকে। পিছনে বড় বড় গাছ। একটা গাছের নিচে ডোরাকাটা একটা ছোট জন্তু শিকল দিয়ে বাধা। দুজনই কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেল। তাদের পায়ের শব্দ শুনে ডোরাকাটা জন্তুটা তাদের দিকে ঘুরে তাকাল, তখন তারা অবাক হয়ে দেখল সেটা একটা ছোট বানরের বাচ্চা। বানর যে বাঘের মতো ডোরাকাটা হতে পারে সেটা বল্টু কোনো দিন চিন্তাও করে নাই।

বল্টু আর নান্টুকে দেখে ছোট বানরটা দুই পায়ে ভর দিয়ে এগিয়ে এল। তাদের একটু ভয় লাগছিল। কিন্তু বানরটা মনে হয় ভালো মেজাজের। তাদের হাতগুলো পরীক্ষা করে দেখে আবার গাছের নিচে গিয়ে চুপচাপ বসে রইল।

“বাঘা-বানর কেমন দেখছ?” কথা শুনে দুজন পিছনে তাকলি, গাট্টাগোট্টা একজন মানুষ, হাফপ্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে। বড় মানুষ হাফট্যান্ট পরে থাকলে তাকে বড়মানুষের মতো লাগে না, আবার ছোটদের মতোও লাগে না। মানুষটার গায়ের রং কালো। মাথার সামনে চুল হালকা হয়ে আছে। নাকের নিচে কালো গোঁফ। গায়ের কালো রঙের সঙ্গে মিশে আছে বলে আলাদা করে দেখা যায় না।

বল্টু জিজ্ঞেস করল, “বাঘা-বানর?”

“হ্যাঁ। বাঘের মতো ডোরাকাটা তো। সে জন্যে এই বানরের নাম বাঘা-বানর।”

বল্টু বলল, “আসলে এ রকম বানর হয় না।”

“হয় না মানে? এই যে দেখছ না?”

“এটার গায়ে কালো রং দিয়ে আপনি ডোরা এঁকেছেন।”

কালো মানুষটা একেবারে থতমত খেয়ে গেল, বারকয়েক চেষ্টা করে বলল, “কী বলছ তুমি? পত্রিকায় খবর উঠেছে এই বানরের : চা-বাগানে বিরল প্রজাতির বানর।”

“মিথ্যা খবর। বোঝাই যাচ্ছে, একটা বানরকে ধরে গায়ে কালো কালো দাগ এঁকেছেন। কাজটা ঠিক হয় নাই।”

“কেন, ঠিক হয় নাই কেন?”

“আপনাকে ধরে কেউ যদি আপনার গায়ে কালো কালো দাগ এঁকে দিত, আপনার কি ভালো লাগত?”

কালো মানুষটা বলল, “আ-আমি কি বানর?”

বল্টু গম্ভীর হয়ে বলল, “এখন আপনি মানুষ, আর এটা বানর। একসময় আপনিও বানর ছিলেন।”

“আ-আ-আমি বানর ছিলাম?”

“সবাই বানর ছিল।”

মানুষটা কী বলবে ঠিক বুঝতে পারছিল না। বল্টু হাঁটতে হাঁটতে বলল, “আর, এই বানরটাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছেন কেন?”

“বেঁধে না রাখলে চলে যাবে না?”

“চলে গেলে যাবে। কেউ যদি আপনাকে গলায় শিকল দিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখে, তাহলে আপনার কেমন লাগবে?

বল্টুর কথা শুনে মানুষটা এত অবাক হলো যে কোনো কথাই বলতে পারল না।

দুপুরের খাওয়া-দাওয়া হলো খুব ভালো, তবে সেটা নিয়ে নান্টু বা বল্টুর খুব একটা ঊনিশ-বিশ হলো না। তাদের দুজনেরই খাওয়া নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। কোনো কিছু খেয়ে পেটটা একটু ভরতে পারলেই হলো। মুনিয়ার কথা আলাদা। সে ভালো খাবার খুব পছন্দ করে। তাই সে খেল খুব শখ করে।

খাওয়ার পর নান্টুর আব্বু আর আম্মু বারান্দায় ডেকচেয়ারে বসে চা খেতে লাগলেন। মুনিয়া বাইরে গাছের ছায়ায় চেয়ারে হেলান দিয়ে একটা গল্পের বই নিয়ে বসল। বল্টু আর না বের হলো চা-বাগান ঘুরে বেড়াতে। নান্টুর আম্মু কিছুতেই তাদের একা যেতে দিলেন না। গেস্টহাউসের কেয়ারটেকার ইদরিস মিয়াকে তাদের সঙ্গে পাঠিয়ে দিলেন। ইদরিস মিয়া হচ্ছে কালো গাট্টাগোট্টা মানুষটি, যে বড় মানুষ হয়েও হাফপ্যান্ট পরে থাকে, বানরের গায়ে কালো দাগ দিয়ে যে বাঘা-বানর তৈরি করেছে।

চা-বাগানের ছোট রাস্তা দিয়ে বল্টু আর নান্টু হাঁটতে থাকে, উঁচু-নিচু টিলার মাঝখানে চায়ের গাছগুলো সমান করে কেটে রাখা হয়েছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় সবুজ মখমলের বিছানা। মাঝে মাঝে বড় বড় গাছ। সেসব গাছে চারদিক কেমন যেন ছায়া ছায়া হয়ে আছে।

হাঁটতে হাঁটতে ইদরিস মিয়া তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে, “তোমরা কি স্কুলে পড়ো?”

“হ্যাঁ।”

“কোন ক্লাসে পড়ো?”

বল্টু বলল, “আমি পড়ি ক্লাস থ্রিতে। আর নান্টু ক্লাস ওয়ান।”

“ভালো, ভালো, খুব ভালো। লেখাপড়া করা খুব ভালো।”

বল্টু বলল, “আপনি লেখাপড়া করেন নাই?”

“করেছি। আমিও একটু লেখাপড়া করেছি। আমি ম্যাট্রিক পাস, ইন্টার ফেল।”

“ইন্টারে ফেল? আপনি পরীক্ষায় ফেল করেছেন?”

ইদরিস মিয়া দাঁত বের করে হাসার চেষ্টা করে বলল, “ইংরেজিতে আটকে গিয়েছিলাম। মুখস্থ করতে পারি নাই।”

নান্টু কম কথা বলে। এবার সে বলল, “কখনো মুখস্থ করতে হয় না। বুঝে বুঝে পড়তে হয়।”

বল্টু জিজ্ঞেস করল, “আপনি বারটা ধরেছেন কেমন করে?”

“কোন বানর? বাঘা-বানর?”

“হ্যাঁ।”

“জাল দিয়ে।”

“জাল দিয়ে তো মাছ ধরে।”

ইদরিস মিয়া দাঁত বের করে হাসল। বলল, “জাল দিয়ে বানরও ধরা যায়! টেকনিক জানতে হয়।”

বল্টু একটু রাগ রাগ গলায় বলল, “আপনি কেন বানর ধরেন? বানর ধরা ঠিক না, জঙ্গলের বানর জঙ্গলে থাকতে হয়।”

“বানরের জাতি খুবই পাজি …”

“মোটেই না। বানর খুবই সুইট।”

হাঁটতে হাঁটতে তারা চা-বাগানের একপাশে চলে এল। নিচে শুকনো একটা খাল। খালের উল্টো পাশে একটু দূরে একটা ভাঙা বাড়ি। দেখে মনে হয় পোড়োবাড়ি। নান্টু জিজ্ঞেস করল, “ওটা কী?”

ইদরিস মিয়া বলল, “ওইটা কিছু না।”

বল্টু অবাক হয়ে বলল, “ওটা কিছু না মানে? ওই যে দেখছি একটা অনেক ভাঙাচোরা বাসা!”

“ওই তো … এইটা কিছু না। সাপখোপ থাকে, ওইখানে কেউ যায় না।”

বল্টু হাতের আঙুল নাচিয়ে নান্টুর সঙ্গে কথা বলল, যার অর্থ হলো “আমাদের ওই বাসাটাতে যেতে হবে।” নান্টু হাতের আঙুল নাচাল, “ঠিক আছে!”

চা-বাগানটা ঘুরে বল্টু আর নান্টু গেস্টহাউসে ফিরে এল। বিকেলে তারা গেল ফ্যাক্টরিটা দেখতে। কোথাও চায়ের পাতা শুকানো হচ্ছে, কোথাও ফারমেন্ট করা হচ্ছে, কোথাও গ্যাসের আগুনে গরম করা হচ্ছে, কোথাও আলাদা করা হচ্ছে–বিশাল ব্যাপার। পুরো ব্যাপারটা দেখে সবার চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়।

ফ্যাক্টরি থেকে ফিরে সবাই চা-নাশতা খেল। এমনিতে বাসায় চা খায় শুধু বড়রা। আজকে ছোট বড় সবাই চা খেলো। চা-বাগানের চায়ে ভারি সুন্দর একটা ঘ্রাণ।

অন্ধকার হয়ে যাওয়ার পর পুরো চা-বাগান একেবারে অন্য রকম হয়ে গেল। চারদিকে একেবারে সুনসান নীরবতা। শুধু অনেক দূর থেকে মাঝেমধ্যে কোনো বুনো পশুরের ডাক ভেসে আসে। শুনে বুকের মধ্যে কেমন কাঁপুনি শুরু হয়ে যায়। আকাশে চাঁদ উঠেছে। সে চাঁদের নরম আলোয় সবকিছু কেমন যেন অন্য রকম দেখায়। সবাই বারান্দায় বসেছিল। কথা বলছিল আস্তে আস্তে। যেন জোরে কথা বললেই কিছু একটা ভুল হয়ে যাবে।

মুনিয়া ফিসফিস করে বলল, “জোত্সায় সবকিছু কেমন সুন্দর দেখায়, দেখেছ?”

বল্টু বলল, “রড আর কোন।”

নান্টুর আম্মু বললেন, “সেটা আবার কী?”

“আমাদের চোখের রেটিনাতে দুই রকম কোষ থাকে–একটা হচ্ছে রড, আরেকটা হচ্ছে কোন। কম আলোতে কাজ করে রড়, আর বেশি আলোতে কাজ করে কোন। কোন দিয়ে রং দেখা যায়, রড দিয়ে দেখা যায় না। এখন তো খুব কম আলো, তাই চোখের রডগুলি কাজ করছে। সে জন্যে আমরা কোনো রং দেখতে পাচ্ছি না।”

নান্টুর আম্মু বললেন, “তাই নাকি! ইন্টারেস্টিং।”।

বল্টু একবার কিছু একটা বোঝাতে শুরু করলে চট করে থেমে যেতে পারে না, তাই বলল, “আমাদের চোখে একটা লেন্স থাকে। আলো সে লেন্সের ভেতর দিয়ে চোখের রেটিনার যে জায়গায় পড়ে সেটার নাম ফোভিয়া।

“ফোভিয়া?” নান্টুর আলু জিজ্ঞেস করলেন, “ফোভিয়া মানে তো ভয়! ক্লস্ট্রোফোবিয়া, অ্যাক্রোফোবিয়া …”

“না, ফোভিয়া না।” বল্টু মাথা নেড়ে বলল, “শব্দটা হচ্ছে ফোভিয়া। কোনগুলি থাকে ফোভিয়ার ভেতরে, আর রডগুলি থাকে ফোভিয়ার চারদিকে

মুনিয়া জিজ্ঞেস করল, “তুমি কেমন করে জানো?”

“আমি পড়েছি। আর ইচ্ছা করলে তুমি পরীক্ষা করে দেখতে পারো।”

“কীভাবে পরীক্ষা করে দেখব?”

বল্টু বলল, “আকাশে খুব ঝাপসা একটা তারার দিকে সোজাসুজি তাকালে সেটা দেখা যায় না, একটু পাশে তাকালে সেটা দেখা যায়। সোজাসুজি তাকালে আলোটা এসে পড়ে ফোভিয়াতে …”

নান্টুর আলু বললেন, “বল্টু ঠিকই বলেছে। আমরা ছোট থাকতে যখন আকাশের তারার দিকে তাকাতাম, তখন দেখতাম যেদিকে তাকাই সেইটা দেখি না। কিন্তু পাশের তারাটা দেখি!”।

আলোচনা আরও এগিয়ে যেত, কিন্তু ঠিক তখন ইদরিস মিয়া জানাল টেবিলে খাবার দেওয়া হয়েছে। কাজেই সবাই খেতে গেল। চা-বাগানে আসার পর থেকে সবার খিদে বেড়ে গেছে।

টেবিলে ভুনাখিচুড়ির সঙ্গে মাংস। খাবারের সুন্দর গন্ধে সবার খিদে আরও বেড়ে গেছে বলে মনে হলো। সবাই খুব উৎসাহ নিয়ে খেল। খাওয়ার পর আরও কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে শুতে চলে গেল সবাই। এখানে কোনো টেলিভিশন নেই, তাই টেলিভিশন দেখে কেউ আর সময় নষ্ট করতে পারল না।

বন্দুদের ঘরে দুটো বিছানা। একটা বিছানায় ঘুমাবে মুনিয়া, অন্যটিতে বল্টু আর নান্টু। গেস্টহাউসের লোকজন মশারি টানিয়ে দিয়েছে। চা বাগানের সবকিছু ভালো, শুধু মশার উৎপাত একটু বেশি। ঘরে মশার ওষুধ স্প্রে করেছে। তারপরও মোটা মোটা মশা কোনদিক দিয়ে যেন চলে আসছে।

বিছানায় শুয়ে শুয়ে তিনজন কথা বলতে বলতে একসময় ঘুমিয়ে গেল। প্রথমে নান্টু, তারপর বল্টু, সবার শেষে মুনিয়া।

.

গভীর রাতে মুনিয়ার ঘুম ভেঙে গেল। কার যেন কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। মুনিয়া তার বিছানায় উঠে বসল। আসলেই কোনো ভুল নেই। স্পষ্ট কান্নার শব্দ। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেউ কাঁদছে। খুব কাছাকাছি কোনো জায়গা থেকে শব্দটা আসছে, ঘরের বাইরে, ইনিয়ে-বিনিয়ে কান্না। মুনিয়া পাশের বিছানায় গিয়ে বল্টুকে ঠেলে তুলল। “বল্টু, এই বল্টু …”

বল্টুর ঘুম সহজে ভাঙে না, কিন্তু অপরিচিত জায়গায় ঘুমটা হয় অন্য রকম। তাই চট করে ভেঙে গেল। সে ধড়মড় করে উঠে বসে বলল, “কী হয়েছে, মুনিয়া আপু?”

“কে যেন কাঁদছে।”

“কাঁদছে?”

“হ্যাঁ, শোন।”

বল্টু শোনার চেষ্টা করল, সত্যিই কান্নার শব্দ। কিন্তু এত রাতে কে কাঁদবে!

মুনিয়া ভয় পাওয়া গলায় বলল, “ভূত না তো?”

বল্টু বিজ্ঞানী মানুষ। ভূতের কথা এত সহজে মানতে পারছিল না। তবু এই গভীর রাতে ভূতের কথাটাই প্রথমে মনে এল। সে গম্ভীর হয়ে বলল, “ভূত বলে কিছু নাই! আসো, জানালা দিয়ে বাইরে দেখি।”

দুজন জানালার কাছে গিয়ে পর্দা টেনে বাইরে তাকাল। গেস্টহাউসের কাছে একটা বড় গাছ। গাছের ডালের সঙ্গে বাঘা-বানরকে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছে। বানরের বাচ্চাটি কাঁদছে, ঠিক মানুষের মতো গলায়। দুজন জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই কাছাকাছি ডালে একটু হুটোপুটির শব্দ শোনা গেল। তারপর একটা বড় বানর ডাল থেকে নেমে এল। বানরের বাচ্চাটি ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল বড় বানরের কোলে। বড় বানরটি গভীর ভালোবাসা দিয়ে বানরের বাচ্চাটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখল।

মুনিয়া ফিসফিস করে বলল, “ছোট বাচ্চাটাকে ধরে রেখেছে তো, তাই তার মা-টা এসেছে।”

বল্টু জীবনের প্রথম তার আম্মুকে ছাড়া একা একা আছে হঠাৎ তার বুকের ভেতরটা কেমন জানি করে উঠল। তার চোখে পানি এসে গেল।

মা-বানরটা তার বাচ্চার গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করছে। ছোট বাচ্চাটা তার ভাষায় কিছু একটা বলছে। বল্টু বলল, “চলো আপু, বাচ্চাটাকে ছেড়ে দিই।”

“এখন? এত রাতে?”

“হ্যাঁ, এখনই ভালো।”

“ইদরিস মিয়ার বানর, সে কী বলবে?”

“যা ইচ্ছে হয় বলুক।”

মুনিয়া বলল, “চলো তাহলে।”

বল্টু বলল, “দাঁড়াও, আমার ব্যাগটা নিয়ে যাই। এইখানে শেকল কাটার ক্লিপার্স আছে!”

বল্টু তার ব্যাগটা নেয়। তারপর দুজন দরজা খুলে খুব সাবধানে বাইরে বের হয়। ঝিঁঝি পোকা ডাকছিল। তাদের পায়ের শব্দ শুনে হঠাৎ ডাক বন্ধ করে দিয়ে একটু পরে আবার ডাকতে থাকে। আবছা অন্ধকারে দুজন গেস্টহাউসের পিছনে গাছের নিচে আসতেই মা-বানরটা তার বাচ্চাকে ছেড়ে গাছের ডাল বেয়ে ওপরে উঠে গেল। ছোট বাচ্চাটি শেকল থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য টানাটানি করে। আবার কুঁই কুঁই করে ঠিক কান্নার মতো শব্দ করতে থাকে।

বল্টু এগিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, “কাঁদিস না। আয় তোকে খুলে দিই।”

বানরের বাচ্চাটা কী বুঝল কে জানে! শান্ত হয়ে জুলুজুলু চোখে বল্টুর দিকে তাকিয়ে রইল।

বল্টু বানরের বাচ্চার গলায় হাত দিয়ে বোঝার চেষ্টা করল কী দিয়ে বাঁধা। মনে হচ্ছে, একটা চামড়ার বেল্ট দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। বল্টু হাতড়ে হাতড়ে খোলার চেষ্টা করল। পারল না। বানরের বাচ্চাটা দুই হাত দিয়ে বল্টুর হাত ধরে রাখল। একটুও প্রতিবাদ করল না।

বল্টু ফিসফিস করে বলল, “একটু অপেক্ষা কর। তোর এটা এত শক্ত করে বেঁধেছে যে খেলা যাবে না। এটা কাটতে হবে। আমি একটা ক্লিপার্স বের করি।”

মনে হলো বানরের বাচ্চাটা বল্টুর কথা বুঝল এবং মাথা নেড়ে সায় দিল। বল্টু তার ব্যাগে হাত দিয়ে একটা ছোট টর্চলাইট আর একটা ক্লিপার্স বের করল। টর্চ লাইটটা মুনিয়ার হাতে দিয়ে বলল, “মুনিয়া আপু, তুমি একটু লাইটটা ধরো।”

মুনিয়া টর্চ লাইটটা ধরল। বল্টু ক্লিপার্সটা দিয়ে সাবধানে বেল্টটা ধরে চাপ দিতেই বেল্টটা কেটে দুই ভাগ হয়ে গেল। বানরের বাচ্চাটা ছাড়া পাওয়ার পরও ঠিক বুঝতে পারল না যে সে আসলেই ছাড়া পেয়ে গেছে। কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দুই পায়ে ভর দিয়ে বল্টুর হাঁটু ধরে দাঁড়িয়ে রইল। বল্টু বানরের বাচ্চাটার পিঠে থাবা দিয়ে বলল, “যা, পিচ্চি বানর, যা। তোর আম্মুর কাছে যা।”

বানরটা তার গলায় হাত দিয়ে অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করল। বল্টুকে ঘিরে একবার ঘুরে এল। এমনিতেই ছোট একটা লাফ দিল। তারপর পায়ে পায়ে গাছের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। তাকে দেখে মনে হতে থাকে, এখনো সে বিশ্বাস করতে পারছে না সে আসলেই ছাড়া পেয়ে গেছে। গাছের কাছাকাছি গিয়ে হঠাৎ করে সে দৌড়াতে থাকে। দৌড়াতে দৌড়াতে গাছের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। ঠিক তখন গাছের ওপর থেকে মা-বানরটা নেমে এল। বাচ্চাটা এক লাফে তখন মায়ের কোলে উঠে পড়ল।

বল্টু বলল, “বুঝলি পিচ্চি, মাকে বেশি জ্বালাবি না।”

মুনিয়া বলল, “আর এই যে আম্মু, তুমি তোমার বাচ্চাকে দেখেশুনে রেখো। ঠিক আছে?”

বল্টু আর মুনিয়ার স্পষ্ট মনে হলো মা-বানরটা তার মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক আছে।”

বল্টু বলল, “যাও এখন, অনেক রাত হয়েছে।”

মা-বানরটা তার বাচ্চাকে কোলে নিয়ে এক লাফে একটা ভাল ধরে অদৃশ্য হয়ে গেল।

মুনিয়া বলল, “ফার্স্ট ক্লাস কাজ!”

বল্টু বলল, “চলো, এখন ঘুমাই।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *