০৯. বাজা-ঘড়ি বা চাইমিং ক্লক

॥ ৯ ॥

বাজা-ঘড়ি বা চাইমিং ক্লক অনেক শুনেছি, কিন্তু মহাদেব চৌধুরীর বাড়িতে ঢুকতে না-ঢুকতে ছ’টা বাজার যেসব অদ্ভুত শব্দ একটার পর একটা ঘড়ি থেকে আমাদের কানে আসতে লাগল, সেরকম ঘড়ির বাজনা আমি কোনওদিন শুনিনি। লালমোহনবাবু বললেন, ‘এ যেন স্বর্গদ্বার দিয়ে ঢুকছি মশাই। মাঙ্গলিক বাজছে। এ রিসেপশন ভাবা যায় না।’

ঢুকতেই যে ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হল তা নয়। একজন কর্মচারী গোছের লোক এসে বলল, মিঃ চৌধুরী ব্যস্ত আছেন, আমাদের একটু অপেক্ষা করতে হবে। আমরা একটা আপিস ঘরে গিয়ে বসলাম। এই ছোট্ট ঘরেও দুটো বাহারের ঘড়ি—একটা দেয়ালে, একটা বুকশেলফের ওপর।

ঘড়ির শব্দ থামতে এখন বাড়িটা থমথমে মনে হচ্ছে। পেল্লায় হাল ফ্যাশানের বাড়ি, পায়ের নীচে শ্বেতপাথরের মেঝেতে মুখ দেখা যায়।

একটা গলার স্বর বাড়ির ভিতর থেকে মাঝে মাঝে শুনতে পাচ্ছি; ফেলুদা বলল সেটাই নাকি মহাদেব চৌধুরীর গলা। মখমল কি না সেটা এখান থেকে বোঝা মুশকিল, তবে এই গলাটাই যে হঠাৎ সপ্তমে চড়ে আর মখমল রইল না সেটা বেশ বুঝতে পারলাম।

মহাদেব চৌধুরী কাকে যেন বেদম ধমক দিচ্ছেন। আমরা তিনজনে প্রায় দমবন্ধ করে অনিচ্ছাসত্ত্বেও আড়ি পাতছি। দ্বিতীয় ব্যক্তি গলা তুলছে না, তাই তার কথা বুঝছি না। কথা হচ্ছে ইংরিজিতে। চৌধুরীর গলায় হুমকানি শোনা গেল—

‘এসব ব্যাপারে আমি অ্যাডভান্স দিই না—আপনি অত করে বললেন বলে দিলাম—আর এখন বলছেন, সে টাকা খরচ হয়ে গেছে? আপনার একটা কথাও আমি বিশ্বাস করি না। আর এই সামান্য কাজটা করতে এত টাকা কেন লাগবে সেটাও আমি বুঝছি না। যাই হোক, আমি দিচ্ছি টাকা, কিন্তু দুদিনের মধ্যে আমি মাল চাই। আমি কোনও অসুবিধার কথা শুনতে চাই না, বুঝেছেন?’

কিছুক্ষণ সব চুপচাপ, তারপর একটা জুতোর শব্দ পেলাম: মনে হল সেটা সদর দরজার দিকে চলে গেল। এক মিনিটের মধ্যেই কর্মচারীটি আবার এল।—

‘আপলোগ আইয়ে।’

মিঃ চৌধুরীর মাথার চুল থেকে জুতোর ডগা পর্যন্ত সত্যিই মখমলের মতো। ভদ্রলোক দিনে দুবার দাড়ি কামান নিশ্চয়ই, না হলে সন্ধ্যা ছ’টায় পুরুষ মানুষের গাল এত মসৃণ হয় না। (পরে লালমোহনবাবু বলেছিলেন, মনে হচ্ছিল গালে মাছি বসলে পিছলে যাবে)। যে বিশাল বৈঠকখানা ঘরটাতে আমরা বসেছি সেটাও মিঃ চৌধুরীর মতোই পালিশ করা। আনাচে-কানাচে কোথাও এক কণা ধুলো বা একটাও পিঁপড়ে বা আরশোলা থাকতে পারে বলে মনে হয় না।

সোনার হোল্ডারে ধরা সিগারেটে একটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে ফেলুদার দিকে চেয়ে প্রশ্ন কললেন মিঃ চৌধুরী—

‘ওয়েল—ঘড়িটা এনেছেন সঙ্গে?’

আমরা সকলেই অবাক; ফেলুদা তো বটেই।

‘ঘড়ি? কী ঘড়ি বলুন তো?’ প্রশ্ন করল ফেলুদা।

‘আপনি যে বললেন একটা ঘড়ির ব্যাপারে দেখা করতে আসছেন? আমি তো ভাবলাম আমার বিজ্ঞাপন পড়ে ফোন করছেন আমাকে।’

‘মাপ করবেন মিস্টার চৌধুরী—আমি আপনার বিজ্ঞাপন পড়িনি। আমার একটা ব্যাপার একটু জানার দরকার হয়ে পড়েছে, সেটা সম্ভবত ঘড়ি সংক্রান্ত। শুনলাম আপনি ঘড়ির বিষয় অনেক কিছু জানেন, তাই—’

মখমলে ভাঁজ পড়েছে। ভদ্রলোক একটু যেন বিরক্তির সঙ্গেই নড়েচড়ে বসে বললেন—

‘আমার সময় বেশি নেই মিঃ মিটার। একটু পরেই কলকাতার বাইরে চলে যাব। আপনার কী জানার আছে সংক্ষেপে বলুন।’

‘পেরিগ্যাল রিপিটার জিনিসটা কী সেটা জানতে চাইছিলাম।’

মখমল হঠাৎ পাথর হয়ে গেল। সিগারেট হোল্ডার ঠোঁটের কাছে এসে থেমে গেছে। চোখের মণি পাথর, দৃষ্টি ফেলুদার দিকে, নিষ্পলক।

‘আপনি কোথায় পেলেন নামটা?’

‘ঊনবিংশ শতাব্দীর একটা ইংরেজি উপন্যাসে।’

তার কাজের সুবিধের জন্য যে ফেলুদা অম্লানবদনে মিথ্যে কথা বলতে পারে সেটা আগেও দেখেছি।—‘রিপিটার যে ঘড়িও হতে পারে বন্দুকও হতে পারে সেটা অভিধানে দেখেছি, কিন্তু পেরিগ্যাল সম্বন্ধে কেউ কিছু বলতে পারল না।’

মহাদেব চৌধুরী এখনও সেইভাবেই চেয়ে আছেন ফেলুদার দিকে। এর পরের প্রশ্নটাতে মখমলের সঙ্গে মেশানো একটা ধারালো ভাব দেখা দিল।

‘আপনি কি সব সময়ই কথার মানে জানতে অচেনা লোকের বাড়ি ধাওয়া করেন?’

‘বিশেষ প্রয়োজন হলে করি বইকী।’

আমি ভেবেছিলাম ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করবেন বিশেষ প্রয়োজনটা কী; কিন্তু তা না করে সেই একইভাবে ফেলুদার দিকে তাকিয়ে থেকে যে কথাটা বললেন, তাতে আমার ডান পাশের টেবিলের উপরে ঘড়িটা যেভাবে টিক্‌টিক্‌ করছে, আমার হৃৎপিণ্ডটাও ঠিক সেইভাবেই টিক্‌টিক্‌ করতে আরম্ভ করে দিল।

বাজা-ঘড়ি বা চাইমিং ক্লক

‘আপনি তো গোয়েন্দা, তাই না?’

ফেলুদার নার্ভের বলিহারি। জবাবটা দিতে বোধহয় পাঁচ সেকেন্ড দেরি হয়েছিল, কিন্তু যখন এল তখন তারও গলা মখমল।

‘আপনি খবর রাখেন দেখছি।’

‘রাখতেই হয় মিস্টার মিটার। খবর সংগ্রহের জন্য লোক থাকে।’

‘আমার প্রশ্নটা বোধহয় ভুলে গেছেন। হয়তো উত্তরটা আপনার জানা নেই। আর যদি জেনেও জবাব না দিতে চান তা হলে আমি উঠি। বৃথা আপনার সময় নষ্ট করতে চাই না।’

‘সিট ডাউন, মিস্টার মিটার।’

ফেলুদা উঠে পড়েছিল, তাই এই হুকুম। লালমোহনবাবুকে দেখে মনে হচ্ছে তাঁর নিজের থেকে ওঠার অবস্থা নেই; ধরে উঠিয়ে দিতে হবে।

‘সিট ডাউন, প্লিজ।’

ফেলুদা বসল।

‘রিপিটার মানে বন্দুকও হয়’, বললেন মহাদেব চৌধুরী, ‘তবে তার সঙ্গে পেরিগ্যাল যোগ দিলে সেটা হয় ঘড়ি। পকেট ওয়াচ। ফ্রানসিস পেরিগ্যাল। ইংলিশম্যান। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে পেরিগ্যালের মতো ঘড়ির কারিগর পৃথিবীতে কমই ছিল। দুশো বছর আগে ইংল্যান্ডেই সবচেয়ে ভাল ঘড়ি তৈরি হত, সুইটজারল্যান্ডে নয়।’

‘আজকের দিনে একটা পেরিগ্যাল রিপিটারের দাম কত হতে পারে?’

‘সে ঘড়ি কেনার সামর্থ্য তো আপনার নেই মিঃ মিটার।’

‘তা জানি।’

‘আমার আছে।’

‘তাও জানি।’

‘তা হলে দাম জেনে কী হবে?’

‘কৌতূহল।’

‘ব্যর্থ কৌতূহল।’

মিঃ চৌধুরী সিগারেটে শেষ টান দিয়ে হোল্ডার থেকে সেটা খুলে পাশে কাচের অ্যাশট্রেতে ফেলে দিয়ে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।

‘আপনি যা জানতে চেয়েছিলেন সেটা আপনার জানা হয়ে গেছে’, বললেন মিঃ চৌধুরী। ‘এবার আপনি আসুন। পেরিগ্যাল রিপিটার কলকাতায় যেটা আছে সেটা আমিই পাব, আপনি পাবেন না।—পেয়ারেলাল!’

একজন কর্মচারী এসে দাঁড়াল। সেই একই লোক—যিনি আমাদের আপিস ঘরে বসিয়েছিলেন। আমরা উঠে পড়লাম। যখন ঘর থেকে বেরোচ্ছি, তখন মখমলের মতো গলাটা আরেকবার শোনা গেল।

‘আমার কাছে অন্যরকম রিপিটারও আছে মিঃ মিটার; তবে তার আওয়াজ ঘড়ির মতো সুরেলা নয়।’

* * *

‘আপনার বর্তমান কাহিনীর নায়ক তো ইনিই বলে মনে হচ্ছে’, বললেন জটায়ু।

আমরা আলিপুর পার্ক থেকে ফিরছি। গাড়ির কাচ আবার তুলে দিতে হয়েছে, কারণ বৃষ্টি। জাজেস কোর্ট রোডে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বৃষ্টিটা নেমেছে।

ফেলুদা লালমোহনবাবুর কথার কোনও জবাব না দিয়ে জানালার বাইরে দৃশ্য দেখতে লাগল। লালমোহনবাবু একটানা বেশিক্ষণ কথা না-বলে থাকতে পারেন না। বললেন, ‘জানি নায়ক না বলে ভিলেন বলা উচিত, কিন্তু আপনি যে বলেন ক্রাইমের ব্যাপারে সকলকেই সন্দেহ করা উচিত—যে-কেউ ভিলেন হতে পারে— তাই আর বললুম না। অবিশ্যি সন্দেহটাও যে ঠিক কী কারণে করা উচিত, সেটা এখনও আমার কাছে পরিষ্কার নয়। কবর খোঁড়াটা কি ক্রাইমের মধ্যে পড়ে?’

ফেলুদা কোনও কথারই জবাব দিচ্ছে না দেখে লালমোহনবাবু এবার অসহিষ্ণু হয়ে বললেন—‘ও মশাই, আপনি যে দমে গেলেন বলে মনে হচ্ছে। তা হলে আমাদের কী দশা হবে ভেবে দেখুন! একে তো ভদ্রলোকের হাবভাব দেখে হাড়গোড় নড়বড়ে হয়ে যাবার অবস্থা। তারপরে ওই অতগুলো ঘড়ির ঢং ঢং, আর তার উপরে আবার আপনি গুম্, বাইরে বৃষ্টি, রাস্তায় গাড্ডা…’

এতক্ষণে ফেলুদা মুখ খুলল।

‘আপনার অনুমান ভুল, মিঃ গাঙ্গুলী। আমি দমিনি মোটেই। জটিল গোলকধাঁধার মধ্যে পথ পেয়ে গেলে কি লোকে দমে? বরং উলটো।’

‘পথ পেয়ে গেছেন?’

‘পেয়েছি, তবে পথের শেষে কী আছে তা এখনও জানি না। পথ অত্যন্ত ঘোরালো। আরও বেশ কিছুটা এগোলে পরে শেষ দেখা যাবে।’

আমরা বাড়ি ফেরার পরও টিপ্ টিপ্ করে বৃষ্টি পড়তে লাগল। লালমোহনবাবু বলে গেলেন কাল সকাল সকাল আসবেন।—‘এ কেসটায় আমি ছাড়া আপনার গতি নেই, ফেলুবাবু! বাস-ট্রামে ঘোরাঘুরি করতে গেলে আপনার কত সময় লাগত ভাবুন দিকি!’

আজ দুপুরে নিজামে বসে থাকতেই লক্ষ করেছিলাম, ফেলুদা তার খাতায় কী যেন হিজিবিজি কাটছে; রাত্রে খাবার পর ওর ঘরে এসে জানতে পারলাম সেটা কী। ও যে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিল তা নয়; এমনিতেই আমার ওর জন্য ভাবনা হচ্ছিল; মহাদেব চৌধুরীকে দেখে আর তার কথা শুনে অবধি দুশ্চিন্তা হচ্ছিল; ভদ্রলোকের মুখটা মনে করলেই কেমন জানি বুকটা কেঁপে উঠছিল। লালমোহনবাবু হিরো ভিলেন যা ইচ্ছে তাই বলুন না কেন, আমার কাছে উনি একটি ভয়াবহ চরিত্র। বাইরেটা মখমল হলে কী হবে, ভিতরটা থর মরুভূমির কাঁটা-ঝোপের জঙ্গল।

অবিশ্যি ফেলুদাকে দেখে মনেই হল না যে তার কোনও দুশ্চিন্তা হচ্ছে। সে এখন সামনে খাতা খুলে বসে একমনে একটা নকশার দিকে দেখছে। আমি ঢুকতে ‘এই দ্যাখ শাখাপ্রশাখা’ বলে খাতাটা আমার দিকে এগিয়ে দিল। তাতে যে জিনিসটা আঁকা রয়েছে সেটা আমি তুলে দিচ্ছি—

‘ডান দিকটা কী রকম খালি-খালি লাগছে না?’ বলল ফেলুদা।

আমি বললাম, ‘তা তো লাগবেই। শার্লট তো বিয়েই করেনি।’

‘শার্লটকে নিয়ে সমস্যা নয়। সমস্যা ওই জন ব্যক্তিটিকে নিয়ে। ওই একটি শাখার বাকি অংশটা লুকিয়ে আছে। অবিশ্যি একটা জিনিস উলটো অবস্থায় দেখেছি; সেটা সোজা দেখলে পরে কিছুটা আলোকপাত হতে পারবে। অর্থাৎ কাল সকালে।’

এটা ফেলুদার একটা মার্কামারা হেঁয়ালি; আর যখন হেঁয়ালি করে বলছে, তখন হেঁয়ালি করবার জন্যই বলেছে।

আমাদের কথার ফাঁকেই বৃষ্টিটা থেমে গিয়েছিল। ফেলুদাকে হঠাৎ ব্যস্তভাবে বিছানা থেকে উঠতে দেখে অবাক লাগল।

বললাম, ‘বেরোবে নাকি?’

‘ইয়েস স্যার।’

‘সে কী? কোথায়?’

‘ডিউটি আছে।’

‘কীসের ডিউটি?’

‘পাহারা।’

তার হান্টিং বুট-জোড়া বার করে রেখেছে ফেলুদা সেটা এতক্ষণ দেখিনি। ওটা দেখলেই আমার গায়ে কাঁটা দেয়, কারণ ফেলুদার প্রত্যেকটা বিখ্যাত তদন্তের সঙ্গে ওটা জড়িয়ে আছে। মাঝরাত্তিরে গোরস্থানে চলতে ফিরতে হলে ওটা ছাড়া গতি নেই।

‘গোরস্থানে?’ ধরা গলায় জিজ্ঞেস করলাম আমি।

‘আর কোথায় বল!’

‘একা যাবে?’

‘চিন্তা নেই। সঙ্গী আছে। রিপিটার।’

ফেলুদা আলমারি থেকে তার ৩২ কোল্টটা বার করে পকেটে পুরল। আমার ভাল লাগছে না ব্যাপারটা মোটেই। বললাম, ‘কিন্তু ওখানে কী ঘটনা ঘটবে বলে আশা করছ? কবর তো খোঁড়া হয়ে গেছে। ঘড়ি যদি পেয়ে থাকে সে তো নিয়ে গেছে।’

‘নেয়নি। যে বা যারা খুঁড়ছিল তারা মড়ার খুলি দেখেই ভয়ে পালিয়েছে। নইলে ওভাবে কোদাল ফেলে দিয়ে যায় না। হয় নিয়ে যাবে, না হয় লুকিয়ে রাখবে।’

এ জিনিসটা আমার একেবারেই খেয়াল হয়নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *