কাল রাত্রি। বাগিচার কক্ষ। মোহাফেজ ও তাতারী।
–মোহাফেজ।
–জনাব।
–তুমি জানো চারদিন আগে আমি কি ছিলাম?
–জনাব, তা জানি বৈকি।
–কিন্তু তুমি কি ছিলে, তা জানো না। জানো?
–আপনি কি বলতে চান, জনাব?
–তোমার মত অনেকেই জানে না যে তারা কী। আমি গোলাম ছিলাম, খুব নীচুদরের গোলাম। কিন্তু তুমি-ও গোলাম, আমিরুল মুমেনীনের গোলাম। অবশ্যি উঁচুদরের গোলাম।
–তা সত্যি, জনাব।
–আজ চাকা ঘুরে গেছে। তুমি আমার চেয়ে অনেক নীচুদরের গোলাম। আমারও গোলাম।
–আলবৎ।
–কিন্তু আমি ভুলে যাই নি, আমি গোলাম ছিলাম।
–জনাব, তাতারী। আপনি বড় হক কথা বলেন।
–শোনো, মোহাফেজ। এসো হাতে হাত মেলাও। মনে রেখো, তুমি-ও যা, আমিও তা-ই।
–শুক্রিয়া, জনাব।
–কিন্তু বড় গোলামেরা ছোট গোলামদের মনে রাখে না। ছোট গোলাম বড় গোলাম হলে তার-ও সেই অবস্থা ঘটে। গোলামখানার এ এক মহা দস্তুর।
–আপনার কথা শুনতে বড় মিষ্টি লাগে।
–এখন শোনো, মোহাফেজ। বাইরে আমাদের যে-সম্বন্ধ আছে তা থাক। কিন্তু ভেতরে আমরা পরস্পরের মোহাফেজ–রক্ষক।
–শুকরিয়া, জনাব।
–জেনে রেখো, আমি গোলাম গোলাম-ই আছি।
–না, না, জনাব।
–সত্যি। সত্যি বছি। তুমি কি মনে করো, এই বাঁদী গোলাম মুজরানী ইমার গালিচার মধ্যে খুব ষোয়াস্তিতে আছি?
–কোন তক্লীফ হচ্ছে, বলুন। নচেৎ আমিরুল মুমেনীন আমার গর্দান নিয়ে নেবেন।
–না, তোমার দোষ নয়। আমরা অর্থাৎ গোলামেরা নিজের যোগ্যতা আর মেহনৎ দিয়ে কোন জিনিস অর্জন না করলে, স্বোয়াস্তি পাই না। যোগ্যতা, মেহনতের বাইরে থেকে হঠাৎ কিছু যদি আমাদের উপর ঝরে পড়ে, তাতে সুখ কোথায়? মগজ আর তাগদের জোরে কোন জিনিস না পেলে আমরা মজা পাই না। এই বাগাবাগিচা আমার মেহনতের ফল নয়।
–সত্যি হুজুর?
–হ্যাঁ, সত্যি। মনে রেখো, যোগ্যতা থেকে কোন চিজ না পেলে তা ঢিলে লেবাসের মত বেখাপ্পা-ই দেখায়। আর যোগ্যতা-মেহনৎ ব্যতিরেকে যারা পুরস্কার প্রার্থী–তারাই হচ্ছে দুনিয়ার আসল গোলাম।
–জাঁহাপনা, আপনি উজীর মরহুম জাফর বারমেকীর মত আক্কেলমন্দ কথা বলেন।
–চুপ। জাফরের নাম তোমার মুখে শুনলে খলিফা জিভ ছিঁড়ে ফেলবে।
–হুঁজুর আপনি, তাই বলছি।
–আমাকে জনাব-হুঁজুর সম্বোধনে ডাক দিও না। আমরা বন্ধু।
–আপনি যখন অভয় দিলেন—
–শোনো, তোমাকে আমার একটা খবর দিতে হবে।
–খবর?
–হ্যাঁ, খবর। তুমি কি বগ্দাদের সড়কে, কাফিখানায় ফরসুৎ-মত ঘোরাঘুরি কর না?
–তা করি বৈকি।
–তুমি তাহলে খবর যোগাড় করতে পারত্রে।
–কি খবর বলুন?
–কিন্তু, এ-খবর খোদ আমিরুল মুমেনীনের কাওসুল আকদার প্রাসাদের খবর।
–জনাব, পাথরে, দেওয়ালে খবর আটকা থাকে না। যারা মহলে থাকে, তারাও মানুষ। চোখে দেখলে বা কানে শুলে মুখে না বলে পারে না। চোখের, কানের, মুখের একটা যোগসাজশ আছে।
–আছে?
–আছে বৈকি। বেগম খৈজুরান যে নিজের বড় ছেলে হাদীকে দাসী দিয়ে গলা টিপিয়ে মেরেছিল, তা কি করে জানাজানি হলো? খলিফা হাদী মারা গেলেন, তাই না হারুনর রশীদ খলিফা হলেন!
–তা-ই নাকি?
–আপনি জানেন না? বগ্দাদের সবাই জানে, আর আপনি জানেন না? যাকে জিজ্ঞেস করেন, সে-ই ঐ জবাব দেবে, কিছু জানে না। বড় মজার ব্যাপার।
–শোনো মোহাফেজ, যদিও মহলের খবর, কিন্তু খবর একটা তুচ্ছ ব্যক্তির।
–কে সে?
–বলছি। তুচ্ছ ব্যক্তি সে। বেগম জুবায়দার খাস-বাঁদী মেহেরজান। তারই খবর চাই।
–শাহী সড়কের এক কাফিখানায় আমি কাল সন্ধ্যায় বসেছিলাম। সেখানে খবর শুনলাম।
–কি খবর।
–আমার ত তেমন শোনার গা ছিল না। একজন আর একজনকে বলছে, মহলে নাকি এক রূপের তুফান এসেছে–এক আরমেনী বাঁদী। খলিফা নাকি তাকে শাদীও করতে পারে।
–আর কি শুনলে?
–হুঁজুর, আমার কান তো বেশি ওদিকে যায় না, বয়স পঞ্চাশের উপর। জওয়ান হলে এসব রসালো কথার দিকে মন যায়। কানও যায়।
–আজ তুমি বেড়াতে বেরিয়ে দ্যাখো যদি কোন খবর আনতে পারো।
–আচ্ছা, জনাব।
–আবার জনাব কেন? এসো, হাতে হাত মেলাও।