০৯. বাঁশের ফুল

০৯. বাঁশের ফুল

রাঙ্গামাটি বেড়াতে গিয়েছি, সেখানকার স্থানীয় মানুষদের সাথে কথা বলছিলাম তাদের কাছ থেকে অত্যন্ত বিচিত্র একটা তথ্য জানতে পারলাম। তারা বললেন, এই বছর বাঁশের ফুল এসেছে এবং সেটা একটা মহাদুর্যোগের সংকেত। আমরা ফুলকে সবসময়ই সৌন্দর্যের সাথে তুলনা করি, তাই বাঁশের ফুল কেমন করে মহাদুর্যোগের সংকেত হতে পারে সেটা চট করে । বুঝতে পারছিলাম না, তাই তারা আমাদের বুঝিয়ে দিলেন।

বাঁশ পঞ্চাশ বছর পর একবার ফুল দেয়। সেই ফুল থেকে ফল হয় এবং ফল দেয়ার পর সেই বাঁশ মরে যায়। ব্যাপারটা ঘটে পঞ্চাশ বছর পর পর, শেষবার ঘটেছিল 1958 সালে, তাই এই বছরটা আবার সেই সময়। পাহাড়ি অঞ্চলে যেখানে বাঁশ জন্মায় সেখানে সবাই দেখছে বাঁশে ফুল আসতে শুরু করেছে, কিছুদিনেই সেখানে ফল হবে তারপর বাঁশগুলো মরে যাবে। বাঁশগুলো মরে গেলেই শেষ হয়ে যাবে না, মৃত্যুর আগে তারা শেষ যে ফলগুলো দিয়ে গেছে সেই ফলের বিচি থেকে জন্ম নেবে নূতন বাশ গাছ। আগামী পঞ্চাশ বছর সেই বাশ গাছ বেঁচে থাকবে–বাঁশঝাড় থেকে জন্ম নেবে নূতন বাঁশ গাছ, তারপর আরও পঞ্চাশ বছর পর আবার ফুল হবে, সেই ফুল থেকে ফল হয়ে আবার সব বাঁশ মরে যাবে। শত শত বৎসর থেকে এটা ঘটে আসছে।

যারা পাহাড়ি মানুষ তারা নানাভাবে বাঁশের উপর নির্ভর করে থাকে, হঠাৎ করে সেই বাঁশ যদি উজাড় হয়ে যায় তাহলে তাদের ওপর দুর্যোগ নেমে আসতেই পারে। কিন্তু রাঙ্গামাটির স্থানীয় মানুষেরা যে মহাদুর্যোগের কথা বলছিলেন সেটা এই বাঁশের উজাড় হয়ে যাওয়া নয়, সেটা অন্য একটা মহাদুর্যোগ।

তারা বললেন, বাঁশের ফুল থেকে যে ফল হয় সেটা ইঁদুরের খুব প্রিয় একটা খাবার। তাই ইঁদুর খুব শখ করে এই ফলগুলো খায়। আর এই ফল খাওয়ার সাথে সাথে তাদের ভেতর একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটে হঠাৎ করে তারা ব্যাপকভাবে বংশ বৃদ্ধি করতে থাকে। দেখতে দেখতে লক্ষ লক্ষ ইঁদুরের জন্ম হয়। সেই ইঁদুরের আকার-আকৃতিও অস্বাভাবিক, অনেক বড় এবং খানিকটা হিংস্র, তারা দল বেঁধে এদিক-সেদিক আক্রমণ করতে শুরু করে। রাতারাতি তারা একটা ফসলের ক্ষেত খেয়ে শেষ করে ফেলে। সংখ্যায় এই ইঁদুর এত বেশি যে তাদেরকে প্রতিরোধ করার কোনো উপায় নেই। স্থানীয় মানুষ খুব সঙ্গত কারণেই ইঁদুরের এই ভয়াবহ আক্রমণের নাম দিয়েছে ইঁদুরের বন্যা। সেই ইঁদুরের বন্যায় ফসল নিঃশেষ হয়ে যায়–তখন আসে দুর্ভিক্ষ। মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যায়। এই ভয়াবহ দুর্যোগ কমপক্ষে তিন-চার বছর থাকে, তারপর খুব ধীরে ধীরে সবকিছু আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে। বাঁশের ফলে কী এমন জিনিস থাকে যার কারণে হঠাৎ করে তাদের এমন বংশ বৃদ্ধি হতে থাকে সেটা তারা আমাদের বলতে পারলেন না কিন্তু তারা দিব্যি দিয়ে বললেন কথাটি সত্যি। শুধু যে ইঁদুরের বংশ বৃদ্ধি হয় তা নয়, পাহাড়ের বন মোরগ যখন বাশের ফলের বিচিগুলো খায় তাদেরও বংশ বৃদ্ধি হতে থাকে। যখনই বাঁশের ফল হয়, তখনই পাহাড়ে বন মোরগের সংখ্যা হঠাৎ করে বেড়ে যায় ইঁদুরের মতোই!

আমি রাঙ্গামাটি থেকে এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে ফিরে এসেছি। স্থানীয় মানুষ যে কথাগুলো বলেছেন সেগুলো তারা পরিবারের বয়োবৃদ্ধদের কাছে শুনেছেন, কিছু কিছু ব্যাপার হয়তো নিজেও দেখেছেন, তার কিছু সত্যি, কিছু হয়তো অতিরঞ্জন, কিছু হয়তো আসলে সত্যি নয়। ব্যাপারটা নিয়ে অনুসন্ধান করে আমি যেটুকু জানতে পেরেছি তার বড় অংশই অত্যন্ত বিচিত্র।

প্রথমত সব বাঁশই যে পঞ্চাশ বছর পর ফুল দিয়ে মারা যায় সেটা সত্যি নয়, কিছু কিছু বাঁশ আছে যারা হয়তো প্রতি বছরই ফুল দেয়। তবে এটা সত্যি প্রায় পঞ্চাশ বছরের যে কথাটি আছে বাংলাদেশের রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি কিংবা ভারতের ত্রিপুরা, মিজোরাম এই এলাকার বাঁশের জন্যে সেটা সত্যি। যারা খবরের কাগজ পড়েন তারা সবাই মিজোরাম এলাকার সশস্ত্রবিচ্ছিন্নতাবাদীদের কথা জানেন। ভারতবর্ষে প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ বছর থেকে এই বিছিন্নতাবাদীরা যুদ্ধ করে আসছে এবং ভারতবর্ষের জন্যে সেটা অনেক বড় একটা সমস্যা। শুনে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে সেটা শুরু হয়েছে বাঁশের ফুলের কারণে।

মিজোরাম এলাকার মানুষের দীর্ঘদিন থেকে বাঁশের সাথে বসবাস। তারা অনেকদিন থেকে এই বাঁশের ফুলের কথা এবং তার সাথে সাথে শুরু হওয়া মহাদুর্যোগের কথা জানে, 1908 সালে তারা দুর্ভিক্ষের মাঝে পড়েছিল এবং 1958 আসার আগেই তারা জানে আবার তারা এই বিপদের মাঝে পড়বে। আগে পরাধীন দেশে ব্রিটিশ রাজের কাছ থেকে কিছু পায় নি কিন্তু স্বাধীন ভারতবর্ষে তারা ভেবেছিল সরকার নিশ্চয়ই তাদের পাশে এসে দাঁড়াবে। আগে থেকেই তারা সরকারকে জানিয়ে রেখেছিল যে সামনে দুর্যোগের সময় আসছে, যখন সব বাশ মরে যাবে এবং হিংস্র ইঁদুরের আক্রমণে তারা বিপর্যস্ত হয়ে যাবে–সন্তানের মুখে তুলে দেবার জন্য একটা শস্য কণাও থাকবে না! ভারতবর্ষের সরকার মিজোরাম অঞ্চলের অধিবাসীদের কথা কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিল। সত্যি সত্যি যখন সেই মহাদুর্যোগ নেমে এলো তখন ভারতবর্ষ সরকারের সেটা সামলানোর ক্ষমতা থাকল না–অসংখ্য মানুষ মারা গেল দুর্ভিক্ষে। ক্ষুব্ধ এবং ক্রুদ্ধ মিজোরামবাসী তখন হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে এক দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শুরু করে দিল, যার জের এখনো ভারতবর্ষের সরকারের টানতে হচ্ছে।

যে বিষয়টি বিচিত্র সেটি হচ্ছে বাঁশের ফুল হওয়ার সময়ে ইঁদুরের বংশ বৃদ্ধির ব্যাপারটি। এটি সত্যি কিন্তু ঠিক কেমন করে হয় সেটা খুব স্পষ্ট নয়, এর নানা রকম ব্যাখা আছে। বাঁশ ঘাস প্রজাতির গাছ, ধান বা গমের গাছও সে রকম। ধান এবং গমের গাছের বিচি আমরা ভাত এবং আটা হিসেবে খুব শখ করে খাই, কাজেই বাঁশ গাছের ফলও যে প্রাণীকুল শখ করে খাবে সেটি বিচিত্র কী? বাঁশের ফল এভোকাডোর মতো অত্যন্ত প্রোটিন সমৃদ্ধ। তাই ইঁদুর যখন সেটা খায় তখন সে সত্যিকার অর্থে মোটা-তাজা হয়ে যায়। এমনিতে ইঁদুর হয়তো বছরে দুই-তিন বার বাচ্চা দেয়, কিন্তু মোটা-তাজা হওয়ার কারণে তাদের বাচ্চা জন্মানোর সংখ্যা বেড়ে যায়। দেখা গেছে বছরে তারা আট বার পর্যন্ত বাচ্চা দিতে শুরু করে। কাজেই দেখতে দেখতে ইঁদুরের সংখ্যা একেবারে ভয়াবহভাবে বাড়তে শুরু করে।

ইঁদুরের সংখ্যা বেড়ে যাবার আরও একটা কারণ থাকতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। বাচ্চা জন্মানোর পর পুরুষ ইঁদুর নিজেরাই তাদের বাচ্চাদের খেতে শুরু করে–মা ইঁদুর চেষ্টা-চরিত্র করে তার যে কয়টি সন্তানকে বাঁচাতে পারে সেটাই ইঁদুরের বংশধারাকে কোনোমতে টিকিয়ে রাখে। যখন একসাথে হাজার হাজার বাঁশে ফুল ফুটে আর সেই ফুল থেকে ইঁদুরের জন্যে অত্যন্ত সুস্বাদু আর পুষ্টিকর ফল জন্মাতে শুরু করে তখন হঠাৎ করে ইঁদুরের খাবারের অভাব মিটে যায়, বাঁশের ফল খেয়ে পেট ভরা থাকে বলে নিজের সন্তানদের খেয়ে শেষ করার প্রয়োজন থাকে না। তাই স্বাভাবিক অবস্থায় যখন অল্প কয়টি ইঁদুরের বাচ্চা টিকে থাকত এখন প্রায় সবগুলো টিকে থাকে, সেটা হয় প্রায় ডজন হিসেবে। সেগুলো বড় হয়ে দেখতে দেখতে বাচ্চা দেয়া শুরু করে আর হঠাৎ করে দেখা যায় শুধু ইঁদুর আর ইঁদুর।

ইঁদুরের বন্যা থেকে উদ্ধার পাবার জন্যে ইঁদুর নিধনের একটা চেষ্টা করা হয়। মাঝে মাঝে সরকার থেকে ঘোষণা দেয়া হয় ইঁদুর মেরে তার লেজ কেটে জমা দিলে প্রতি লেজের জন্যে নগদ টাকা দেয়া হবে, সেই উৎসাহে লক্ষ লক্ষ ইঁদুর মারাও হয় কিন্তু তার পরেও ইঁদুরের বন্যাকে সামাল দেয়া যায় না। প্রকৃতির নিজস্ব উপায়ে সেটা যখন কমে আসে মানুষ তখনই রক্ষা পায় তার আগে নয়।

অনেকেই মনে করেন বাঁশের ফুল থেকেই যখন সমস্যা এবং সবাই যখন বহু আগে থেকেই জানে কবে এই ফুল ফুটবে তখন আগে থেকে বাঁশগুলো কেটে ফেললেই হয়। তাহলে বাঁশগুলো ব্যবহার করা যাবে, সাথে সাথে ফুল, ফল এবং ইঁদুরের সমস্যাও থাকবে না। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে এটা আসলে সমাধান নয় এবং সত্যি কথা বলতে কী এটা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর একটা প্রস্তাব। বাঁশের ফুল হবার আগেই বাঁশ গাছকে কেটে ফেলা একটা হত্যাকাণ্ডের মতো, নিজের অজান্তেই আমরা তখন বাঁশের এই প্রজাতিকে নির্বংশ করে ফেলব। গর্ভবতী হলেই যদি কোনো প্রাণীকে মেরে ফেলা হয় তাহলে সেই প্রাণী কী টিকে থাকতে পারে? এটাও অনেকটা সে রকম।

ইঁদুরের বন্যায় ফসলের খুব ক্ষতি হয় বলে পাহাড়ি জনপদের মানুষকে বলা হয় এই সময়টাতে এমন ফসল লাগাতে ইঁদুর যেটা খুব অপছন্দ করে। সেরকম ফসল হচ্ছে হলুদ এবং আদা। দেখা গেছে হলুদ এবং আদার তীব্র গন্ধে ইঁদুর শত হস্ত দূরে থাকে–খেয়ে নষ্ট করার তো কোনো প্রশ্নই আসে না।

অনেক খোঁজাখুঁজি করেও আমি কোথাও বাঁশের ফুল আর ফলের সাথে বন মোরগের বংশবৃদ্ধির সম্পর্কটা বের করতে পারি নি। আমাদের স্থানীয় মানুষেরা যেহেতু এটি বলেছেন নিশ্চিতভাবেই এর মাঝে সত্যতা আছে, আর সত্যতা যদি থাকে তার ব্যাখ্যাটিও খুঁজে বের করতে হবে। ইঁদুরের বংশবৃদ্ধির যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে বন মোরগের বেলায় সেটা কী খাটে? যদি না খাটে তাহলে কি অন্য কোনো ব্যাখ্যা আছে?

আমার দেশের কোনো বিজ্ঞানী এই ব্যাখ্যাটা খুঁজে বের করবেন আমি সেই আশায় দিন গুনছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *