০৯. বর্ষার প্রধান প্রস্তুতি শেষ

বর্ষার প্রধান প্রস্তুতি শেষ হয়েছে।

সোহাগীর চারপাশে বাঁশ পুঁতে চইল্যা গাছ ঢুকিয়ে মাটি শক্ত করা হয়েছে। প্রবল হাওয়ায় যখন হাওড়ের পানি এসে আছড়ে পড়বে, সোহাগীতে তখন যেন মাটি ভেঙে না পড়ে।

উত্তর বন্দ সবচেয়ে নিচু। সেটি ড়ুবল সবার আগে। তারপর এক দিন সকালে সোহাগীর লোকজন দেখল যেন মন্ত্রবলে চারদিক ড়ুবে গেছে। থৈথৈ করছে জল। হুমম শব্দ উঠছে হাওড়ের দিক থেকে। জংলা ভিটার বাঁশ আর বেত-বনে প্রবল হাওয়া এসে সারাক্ষণ বোঁ-বোঁ শো-শোঁ আওয়াজ তুলছে। চিরদিনের চেনা জায়গা হঠাৎ করে যেন রহস্যময় হয়ে উঠেছে। আদিগন্তবিস্তৃত জলরাশির মধ্যে হঠাৎ যেন জেগে উঠেছে সবুজ রঙের ছোট্ট সোহাগী। নাইওরিদের আসবার সময় হয়েছে।

গভীর রাত্রে হাওড়ের নৌকার আলোগুলি কি অদ্ভুতই না লাগে। বিদেশী নায়ের মাঝিরাও লোহাগীর দিকে অবাক হয়ে ঢাকায়।

টেনে টেনে জিজ্ঞেস করে– কোন গ্রাম? কো-ও-ও-ন-গ্রা—ম?

সোহাগী, গ্রামের নাম সোহাগী।

চারদিকের অথৈ জলের মাঝখানে ছোট্ট গ্রামটি ভেসে থাকে। চৌধুরীবাড়ির লোকজন সাদা কেরোসিন তেলের হারিকেন জ্বালিয়ে সারা রাত হিজল গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখে। গভীর রাত্রে যখন গ্রামের সব আলো নিভে যায় তখন সেই আলো মিটমিট করে জ্বলে। দূর থেকে সেই আলো দেখে সোহাগীর নাইওরি মেয়েরা আহ্লাদে নৌকা থেকে চেচিয়ে ওঠে, ওই আমার বাপের দেশ, ওই দেখা যায় চৌধুরীবাড়ির লণ্ঠন। গাঢ় আনন্দে তাদের চোখ ভিজে ওঠে।

ছেলেপুলেদের আনন্দের সীমা নেই। এখন বড়োই সুসময়। পানিতেই তাদের সারা দিন কাটে। এখন ডিঙি নৌকা নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেও কেউ কিছু বলবে না। বরং খুশি হবে। পানির সঙ্গে পরিচয় হোক। এক দিন এদেরকেই তো ঝড়ের রাত্রে একা-একা হাওড় পাড়ি দিতে হবে।

আমিন ডাক্তার চৌধুরীবাড়ির একটি অন্ধকার কোঠায় তার স্কুল সাজিয়ে বসে থাকে। প্রথম দিনে গোটা কুড়ি ছাত্র ছিল, এখন এসে ঠেকেছে দুই জনে। কালাচানের ছোট ছেলে বাদশা মিয়া আর কৈবর্তপাড়ার গণেশ। অন্য ছাত্ররা পড়ে থাকে হাওড়ের পানিতে। কার দায় পড়েছে আমিন ডাক্তারের অন্ধকার ঘরে বসে থাকার? দুটি ছাত্রকে নিয়েই আমিন ডাক্তার মহা উৎসাহে লেগে থাকে। বাদশা মিয়া বোকার হন্দ। আমিন ডাক্তার যখন কয়ের উপর আল রেখে জিজ্ঞেস করে এইটা কী? বাদশা মিয়া তখন আকাশ-পাতাল চিন্তা করে গম্ভীর হয়ে বলে, স্বরে আ। আমিন ডাক্তার প্রচণ্ড চড় লাগায়, কিন্তু বাদশা মিয়ার বিদ্যার্জনের স্পৃহা সীমাহীন। সে পরদিন আবার স্লেট-পেনসিল নিয়ে হাজির হয়। অন্য দিকে গণেশের পড়াশোনায় খুব মন। তাকে পড়াতে বড়ো ভালো লাগে। কী চমৎকার, বলামাত্রই সব শিখে ফেলে। দ্বিতীয় বার আর বলতে হয় না। কী সুন্দর গোটাগোটা হাতের লেখা।

চৌধুরীবাড়ি খেতে যেতে এখন আর আগের মতো লজ্জা লাগে না। চৌধুরীদের পাগলা ছেলের বৌটা খুব যত্ন করে। পর্দার আড়াল থেকে মধুর স্বরে বলে, আরেকটু মাছ নেন চাচাজী।

আর না মা।

না চাচাজী নেন। আরেক টুকরা নেন।

তাকে মাছ নিতেই হয়।

ইঁচা মাছ আর চোকাইয়ের তরকারি কোন দিন খাইছেন চাচাজী?

না মা, খাই নাই।

খুব সুআদ। আমার বাপের দেশে করে।

এক দিন কইরো।

জ্বি আইচ্ছা।

তোমার বাপের দেশ কোথায়?

বহুত দূর। গাঁয়ের নাম বেতসি। নবীনগর ইউনিয়ন।

ভাটি অঞ্চল? জ্বি না, উজান দেশ।

খাওয়ার পর পান আসে। একটা কামলা এসে তামাক সাজিয়ে দিয়ে যায়। পর্দার আড়াল থেকে বৌটি বলে, পেট ভরছে চাচাজী?

আলহামদুলিল্লাহ্, খুব খাইছি।

আপনের যেটা খাওনের ইচ্ছা হয় আমারে কইবেন।

বৌটিকে আমিন ডাক্তারের খুব দেখতে ইচ্ছা করে। কিন্তু চৌধুরীবাড়ীর পর্দা বড় কঠিন পর্দা। দেখা হয় না। ভাত খেয়ে ফেরার পথে চৌধুরীর পাগল ছেলেটার সঙ্গে প্রায় রোজই দেখা হয়। ছেলেটি হুঙ্কার ছাড়ে, কে যায়? আমিন ডাক্তার। এই শুওরের বাচ্ছা, এদিকে আয় তো।

আমিন ডাক্তার না-শোনার ভান করে এগিয়ে যায়। পাগলটা দারুণ হৈ-চৈ শুরু করে, এই শালা কথা কস না যে, এই শালা।

বৌটার কথা চিন্তা করে আমিন ডাক্তারের বড়োই খারাপ লাগে। রোজ ভাবে চৌধুরী সাহেবকে বলে ছেলেটাকে নিখল সাব ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। বলা আর হয় না।

 

ভাদ্র মাসে হঠাৎ মতি মিয়া ফিরে এল। তার গায়ে দামী একটা চাদর। মাথায় ঢেউখেলান বাবড়ি চুল। হলুদ রঙের একটা মটকার পাঞ্জাবিতে দুটি রূপার মেডেল ঝুলছে। মেডেল দুটির মধ্যে একটি সে সত্যি সত্যি পেয়েছে। কেরানিগঞ্জের এক বেপারি খুশি হয়ে দিয়েছে। মতি মিয়া এখন নাকি বড়ো গাতক।

সন্ধ্যার পর বাড়িতে লোজন ভিড় করে।

মতি ভাই, এটু গান-বাজনা হউক। হুনলাম উজান দেশে তোমারে লইয়া কাড়াকাড়ি।

মতি মিয়া গম্ভীর হয়ে থাকে। শইল আইজ যুইত নাই। আইজ না।

বলামাত্রই এখন আর গানে টান দেওয়া যায় না। বড়ো গায়কদের মান থাকে না তাতে। বড় গাতকদের গান সাধ্য-সাধনা করে শুনতে হয়।

একখান গাও মতি ভাই।

কাইল আইও, নিজের বান্দা গান হুইয়াম।

নিজে গান বান্দ? কও কি মতি ভাই।

মতি মিয়া গম্ভীর হয়ে থাকে। গ্রামের লোক বড়োই চমৎকৃত হয়।

কাইল কিন্তু বেবাক রাইত গান অইব, কী কও মতি ভাই? চানি রাইত আছে। বেবাক রাইত গান। বুদ্ধিটা কেমুন?

দেখি।

চেষ্টাকৃত একটা গাম্ভীর্য বহু কষ্টে মতি মিয়াকে ধরে রাখতে হয়।

পরের রাতে মতি মিয়ার বাড়িতে কিন্তু কেউ আসে না, কারণ সন্ধ্যার কিছু আগে কোন খবর না দিয়ে কানা নিবারণ হঠাৎ এসে উপস্থিত হয়েছে, আজ রাতটাই শুধু থাকবো চৌধুরীদের আলায়বসেছে গানের আসর। ছেলেবুডোসবসন্ধ্যা থেকেই বলা। মেঘমুক্ত পরিষ্কার আকাশে সুন্দর চাঁদ উঠেছে। এক সময় কানা নিবারণ গানে টান দিল। গ্রাম্য দুঃখী মেয়ের চিরকালের গান। শ্রাবণ মাস চলে গিয়েছে, ভাদ্র মাসও যায় যায়–তবুও তো নৌকা সাজিয়ে বাপের দেশ থেকে আমাকে কেউ নাইওর নিতে এল না।

গানের মাঝখানে একটি অল্পবয়েসী বউ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। মেয়েটিকে এ বৎসর কেউ নিতে আসে নি। তাকে কাঁদতে দেখে অনেকেই চোখে আঁচল দিল। কিন্তু কানা নিরণকে এই সব কিছুই স্পর্শ করছে না। সে সমস্ত জাগতিক ব্যথাবেদনার উর্ধ্বে। ফকফকা জ্যোৎস্নায় গ্রামের সমস্ত দুঃখী বউ-ঝিরা কানা নিবারণের মধ্য দিয়ে তাদের চিরকালের কান্না কাঁদতে লাগল–

শ্রাবণ মাস গেছে গেছে ভাদ্র মাসও যায়।
জানি না কি ভাবেতে আছে আমাব বাপ ও মায়।

মতি মিয়া তার বাড়ির উঠোনে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। আজ রাতে সোহাগীর মানুষের আর তাকে প্রয়োজন নেই। রহিমা এক সময় এসে বলল, ভাত দেই মতি ভাই?

নাহ্, খিদা নাই। তুমি গান শুনতে গেলা না?

রহিমা কথা বলল না। মতি মিয়া ধরাগলায় বলল, যাও, কানা নিবারণের গান হন গিয়া। বড়ো ওস্তাদ লোক। তার মতো গায়ক আর হইত না।

মতি মিয়ার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল।

সে দিন দশেক থাকবে ভেবে এসেছিল, কিন্তু থাকল না। পরদিন ভোরেই শম্ভুগঞ্জ চলে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *