০৯. বর্ণসমাজের নিম্নস্তর

বর্ণসমাজের নিম্নস্তর

পালরাজাদের অধিকাংশ লিপিতে সাময়িক বর্ণসমাজের নিম্নতমস্তরের কিছু পরোক্ষ সংবাদ পাওয়া যায়। লিপিগুলির যে অংশে ভূমি দানের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হইতেছে সেখানে বাজপাদোপজীবী বা রাজকর্মচারীদের সুদীর্ঘ তালিকার পরেই উল্লেখ করা হইতেছে ব্রাহ্মণদের, তাহার পরে প্রতিবাসী ও ক্ষেত্রকর বা কৃষকদের, এবং কুটুম্ব অর্থাং স্থানীয় ধান প্রধান গৃহস্থ লোকদের (লক্ষণীয় যে ক্ষত্ৰিয়বৈশ্যাদের কোনও উল্লেখ নাই; ইহাদের পরই অন্যান্য যেসব স্তরের লোক তাহাদের সকলকে একত্র করিয়া গাঁথিয়া উল্লেখ করা হইতেছে মেদ, অন্ধ্র ও চণ্ডালদের। চণ্ডালরাই যে সমাজের নিম্নতম স্তব তাতে লিপির এই অংশটুকু উল্লেখ করিলেই বুঝা যাইবে : প্রতিবাসিনশ্চ ব্রাহ্মণোত্তরান্‌ মহত্তরকুটম্বিপুরোগমেদান্‌ ধ্ৰুকচণ্ডালপয্যন্তান্‌। ভবদেব ভট্টের স্মৃতিশাসনে চণ্ডাল অন্তজ পর্যায়ের, চণ্ডাল ও অন্ত্যজ এই দুইই সমার্থক। মেদরাও ভবদেবের মতে অন্ত্যজ পর্যায়ের। মেদ ও চণ্ডালদের সঙ্গে অন্ধ্রদের উল্লেখ হইতে মনে হয়, ইঁহাদেরও স্থান নির্দিষ্ট হইয়াছিল বাঙালী সমাজের নিম্নতম স্তরে। কিন্তু, কেন এইরূপ হইয়াছিল, বুঝা কঠিন। বেতনভূক সৈন্য হিসাবে মালব খস কুলিক, হূণ, কর্ণাট, লাট প্রভৃতি বিদেশী ও ভিনপ্রদেশী অনেক লোক পালবাষ্ট্রেব সৈন্যদলে ভর্তি হইয়াছিল; এই তালিকায় অন্ধ্রদের দেখা পাওয় যায় না। ইহারা স্বভাবতঃ জীবিকার্জনের জন্য নিজের দেশ ছাড়িয়া বাংলাদেশে আসিয়া এদেশের বাসিন্দা হইয়া গিয়াছিলেন, এবং সামাজিক দৃষ্টিতে হেয় বা নীচ এমন কোনও কাজ করিয়া জীবিকানির্বাহ করিতেন।

ইঁহাদের ছাড়া “চযাঁগীতি” বা “চযাঁচর্যবিনিশ্চয়” গ্রন্থে আরও কয়েকটি তথাকথিত নীচ জাতের খবর পাওয়া যাইতেছে, যথা ডোম বা ডোম্ব, চণ্ডাল, শবর ও কাপালি। ডোমপত্নী অর্থাং ডোমনী বা ডোম্বি ও কাপালি বা কাপালিক সম্বন্ধে কাহ্নুপাদের একটি পদের কিয়দংশ উদ্ধার করা যাইতে পারে। (১)

নগর বাহিরি রে ডোম্বি তোহেরি কুড়িআ (কুঁড়েঘর)।
ছোই ছোই জাহ সো বাহ্মণ নাড়িআা (নেড়ে ব্রাহ্মণ)।।
আলো (ওলো) ডোম্বি তোত্র সম করিব ম সঙ্গ।
নিঘিন (নিঘৃণ — ঘৃণা নাই যার) কাহ্ন কাপালি জোই (যোগী) লাংগ (উলঙ্গ)।।…
তান্তি (তাঁত) বিকণঅ ডোম্বি অরবনা চাংগেড়া (বাশের চাঙ্গাড়ি)।
তোহোর অন্তরে ছাড়ি নড়-পেড়া ॥

ডোমেরা যে সাধারণতঃ নগরের বাহিরে কুঁড়ে বাঁধিয়া বাস করিত, বাঁশের তাঁত ও চাঙাড়ি তৈরি করিয়া বিক্রয় করিত, এবং ব্রাহ্মণস্পর্শ যে তাহাদের নিষিদ্ধ ছিল, এই পদে তাহার পরিচয় পাওয়া যাইতেছে! ডোম পুরুষ ও নারী নৃত্যগীতে সুপটু ছিল। কপালী বা কাপালি(ক)রাও নিম্নস্তরের লোক বলিয়া গণ্য হইত; এই পদে তাহার ও ইঙ্গিত বিদ্যমান। ভবদেব ভট্ট চণ্ডাল ও পুক্‌কশদের সঙ্গে কাপালিকদেরও অন্ত্যজ পর্যায়ভুক্ত করিয়াছেন। কাপালিকরা ছিল লজ্জাঘৃণাবিরহিত, গলায় পরিত হাড়ের মালা, দেহগাত্র থাকিত প্রায় উলঙ্গ। শবরেরা বাস করিত পাহাড়ে জঙ্গলে, ময়ূরের পাখ্‌ ছিল তাহাদের পরিধেয়, গলায় গুঞ্জা বীচির মালা, কর্ণে বজ্রকুণ্ডল। (২)

উঁচা উঁচা পাবত তহিঁ বসই সবরী বালী।
মোরঙ্গি পীচ্ছ পরহিণ সবরী গিবত গুঞ্জরী মালী॥…
একেলী শবরী এ বন হিণ্ডই কর্ণকুণ্ডলবজ্রধারী!
তিঅ ধাউ খাট পাড়িলা সবরো মহাসুখে সেজি ছাইলী।
সবোর ভূজঙ্গ নৈরামণি দাবী পেহ্মরাতি পোতাইলী।।

শবর-শবরীদের গানের একটা বিশিষ্ট ধরণ ছিল; সেই ধরণ শবরী রাগ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছে। কয়েকটি চযাঁগীতি যে এই শবরী রাগে গীত হইত সে-প্রমাণ এই গ্রন্থেই পাওয়া যাইতেছে। এই চৰ্যাগীতিটির মধ্যেই আমরা বজ্রযান বৌদ্ধদেবতা পর্ণশবরীর রূপাভাস পাইতেছি, এ-তথ্যের ইঙ্গিতও সুস্পষ্ট। একাধিক চযাঁগীতির ইঙ্গিতে মনে হয় ডোম্ব ও চণ্ডাল অভিন্ন (১৮ ও ৪৭ সংখ্যক পদ) কিন্তু ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে ডোম ও চণ্ডাল উঠাই অন্ত্যজ অস্পৃশ্য পর্যায়ভুক্ত, কিন্তু পৃথক পৃথকভাবে উল্লিখিত। চযাঁপদের সাক্ষ্য হইতে এই ধারণা করা চলে যে সমাজের উচ্চতর শ্রেণী ও বর্ণের দৃষ্টিতে ইহাদের যৌনাদর্শ ও অভ্যাস শিথিল ছিল। পরবর্তী পর্বে দেখা যাইবে, এই শৈথিল্য উচ্চশ্রেণীর ধর্মকর্মকেও স্পর্শ করিয়াছিল। পাহাড়পুরের ধ্বংসস্তুপের পোড়ামাটির ফলকগুলিতে বাঙালীসমাজের নিম্নস্তরের এইসব গোষ্ঠী ও কোমদের দৈহিক গঠনাকুতি ও দৈনন্দিন আহারবিহার বসনব্যসনের কতকটা পরিচয় পাওয়া যায়। বৃক্ষপত্রের পরিধান, গলায় গুঞ্জাবীচির মালা, এবং পাতা ও ফুলের নানা অলঙ্কার দেখিলে শবরী মেযেদের চিনিয়া লইতে দেরী হয় না।

——————
(১) চযাঁপদ ১০ নং।
(২) চযাঁপদ ২৮ নং।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *