০৯. বন্ধু এবং বন্ধু

০৯. বন্ধু এবং বন্ধু

আমি যখন পরদিন স্কুলে গেলাম তখন ক্লাসের সবাই ভিড় করে দাড়িয়েছিলআমাকে কেউ বলে দেয় নি কিন্তু আমি দেখেই বুঝতে পারলাম আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। আমাকে দেখে সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠল, কোন সন্দেহ নেই যে সবচেয়ে জোরে চিৎকার করছে প্রিয়াংকা, কিন্তু তার গলায় এখনো কোন শব্দ নেই। মোটাসোটা কয়েকজন আমাকে কীভাবে কীভাবে জানি ঘাড়ে তুলে ফেলল। অন্যেরা আমাকে ঘিরে লাফাতে লাগলো। মৌটুসি কোথা থেকে জানি কয়েকটা ফুল নিয়ে এসেছে, সেগুলো ছিঁড়ে পাপড়িগুলো সবাই মিলে আমার ওপর ছিটাতে শুরু করলো। আমি মেডেলটা পকেটে করে নিয়ে এসেছিলাম, সেটা টের পেয়ে জয়ন্ত পকেট থেকে বের করে নিয়ে এসেছে, সবাই সেটা গলায় দিয়ে লাফালাফি করতে লাগলো। সেখানেই শান্ত হলো না, আমাকে ঘাড়ে নিয়ে তারা স্কুলের মাঠে চলে গেলো, সেখানে কয়েকজন আমাকে ঘাড়ে নিয়ে স্কুলের মাঠে চক্কর দিতে লাগলো–অন্যেরা চিৎকার করতে করতে পিছনে পিছনে ছুটতে লাগলো। স্কুলের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের আনন্দ হলো সবচেয়ে বেশি তারা পিছনে পিছনে ছুটতে লাগলো আর চিৎকার করে বলতে লাগলো, অঙ্ক ভাই, অঙ্ক ভাই, অঙ্ক ভাই অঙ্ক ভাই…চেঁচামেচি হৈচৈ শুনে স্যার আর ম্যাডামরা বের হয়ে এলেন, বের হয়ে এই দৃশ্য দেখে সবাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাসতে লাগলেন।

স্কুলের এসেম্বলিতে প্রিন্সিপাল ম্যাডাম গণিত প্রতিযোগিতা নিয়ে দুই একটি কথা বললেন। তখন ক্লাস থ্রির যে মেয়েটা পুরস্কার পেয়েছে তাকে আর আমাকে সামনে ডেকে আনা হলো। স্কুলের দপ্তরি কয়েকটা খবরের কাগজ নিয়ে দাড়িয়ে ছিল, প্রিন্সিপাল ম্যাডাম সেখান থেকে কিছু কিছু জায়গা পড়ে শোনালেন। আমার জন্যে সারা দেশে আমাদের স্কুলের সুনাম কেমন বেড়ে গেছে সেটা বলার পর সবাই হাততালি দিতে লাগলো। আমি আড়চোখে রাজাকার স্যারকে দেখার চেষ্টা করলাম, মাত্র কয়দিন আগেই রাজাকার স্যার টি.সি. দিয়ে আমাকে বিদায় করে দেবার কথা বলেছিলেন, তা না হল নাকী পুরো স্কুলের বেইজ্জতি হবে! এখন রাজাকার স্যার কী বলবেন?

 

গণিত প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়নদের চ্যাম্পিয়ন হবার পর একেবারে ম্যাজিকের মতো স্কুলে আমার অবস্থাটা পাল্টে গেলো। আগে আমাকে দেখলে ছেলেমেয়েরা দূরে সরে যেতো, এখন আমাকে দেখলেই সবাই দাত বের করে হেসে বলে, কী খবর আইনস্টাইন? আজকে কোন কিছু আবিষ্কার হলো? আমি তাদের অনেকবার বলেছি আইনস্টাইন হচ্ছেন একজন বৈজ্ঞানিক–গণিতবিদ না, কিন্তু কোন লাভ হয় নাই। আগে মেয়েরা আমাকে রীতিমতো ভয় পেতো, চোখ পাকিয়ে কারো দিকে তাকালেই মনে হতো এখনই ভ্যা করে কেঁদে দিবে। এখন আমাকে ভয় তো পায়ই না উল্টো আমার সাথে গল্প করার জন্যে চলে আসে! এলজেবরা জ্যামিতি বা ত্রিকোণমিতির কোন কিছু না বুঝলেই এখন তারা আমার কাছে চলে আসে, আমাকে সেগুলো বুঝিয়ে দিতে হয়। মেয়েগুলি দুষ্টও কম না, বেশি সময় থাকার জন্যে অনেক সময় বুঝেও না বোঝার ভান করে! তবে সবচেয়ে মজা হয় ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে তাদের ধারণা আমি ভাল অঙ্ক জানি, তার মানে আমি নিশ্চয়ই বড় বড় গুণ করতে পারি। দেখা হলেই বলে, অঙ্ক ভাই, অঙ্ক ভাই, সাতশ তেইশ আর নয় হাজার চব্বিশ গুন করলে কতো হয়?

আমার মাথায় যেটা আসে সেটাই বলে দিই, পঁয়ষট্টি লক্ষ চব্বিশ হাজার তিনশ বাহান্ন। উত্তরটা ভুল হলো না শুদ্ধ হলো সেইটা নিয়ে তারা মাথা ঘামায় না, কিছু একটা উত্তর পেলেই তারা খুশি!

স্কুলের স্যারেরাও আমাকে আজকাল একটু ভাল চোখে দেখেন। সবচেয়ে মজা হয়েছিল সেদিন জ্যামিতি ক্লাসে, স্যার ক্লাসে এসে বললেন, আমার খুব একটা জরুরি কাজ পড়ে গেছে রে! তপু তুই ক্লাসটা নিতে পারবি না?

আমি বললাম, পারব স্যার। কিন্তু কেউ আমার কথা শুনবে না, খালি আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে।

স্যার বললেন, করে দেখুক। আমি টেনে কল্লা ছিঁড়ে ফেলব না!

স্যার টেনে কল্লা ছিঁড়ে ফেলবেন শোনার পরেও সবাই হাসাহাসি করলো কিন্তু তার মাঝেই আমি জ্যামিতি ক্লাসটা নিয়ে নিলাম। কঠিন কঠিন কয়েকটা উপপাদ্য বুঝিয়ে দিলাম। আমার মনে হয় সবাই বেশ ভালই বুঝেছে। দিলীপকেও দেখলাম কয়েবার মাথা নাড়ল।

আমার এরকম নতুন জীবন শুরু হওয়ায় সবচেয়ে খুশি হয়েছে প্রিয়াংকা! তার ভাঙ্গা গলা ঠিক হতে পাকা এক সপ্তাহ লেগে গেলো, কাজইে সে যে কীভাবে আমাকে আবিষ্কার করে গণিত প্রতিযোগিতায় নিয়ে গেছে এবং আমাকে চ্যাম্পিয়নদের চ্যাম্পিয়ন বানিয়ে ফেলেছে এবং এই ব্যাপারটাতে পুরো কৃতিত্বটাই যে তার এবং আমার কোনই কৃতিত্ব নই সে বিষয়টা সবার শুনতে এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হলো। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হতে লাগলো আমি যেন কোরবানির গরু এবং আমার নাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে সে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এবং সবাইকে বলছে যে এরকম মোটাতাজা কোরবানির গরুটা কিনে আনার পুরো কৃতিত্বটাই তার! তবে প্রিয়াংকাকে সবাই পছন্দ করে, কাজেই সবাই তার সব কথা মেনে নেয়। আর এটা তো কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে প্রিয়াংকার আগে কেউ কোন দিন আমার সাথে ভাল করে কথাও বলে নি! সত্যিই সে আমাকে আবিষ্কার করেছে।

ক্লাসের কেউ আমার সাথে আম্মু নিয়ে কথা বলে না কিন্তু আমার ধারণা কীভাবে কীভাবে সবাই আসল ব্যাপারটা জেনে গেছে। কিন্তু আমার ধারণা এখানেও প্রিয়াংকার একটা হাত আছে, সে সবাইকে বলে রেখেছে কেউ যদি ভুলেও আমার সাথে আম্মু নিয়ে কথা বলে তাহলে সে পিটিয়ে তাদের হাটুর মালাই চাকি খুলে রাখবে।

শুধু বাসাতে আমার জীবন মোটামুটি আগের মতোই থেকে গেল। একেবারে কিছু পরিবর্তন হয় নাই তা নয়, আমাকে আর বাথরুম ধুতে হয় না, দুলি খালাকে রান্নাবান্নায় সাহায্যও করতে হয় না। আগে স্কুলে বেতনের জন্যে অনেক আগে থেকে আপুর পিছনে পিছনে ঘুরতে হতো, এখন আপু নিজেই একটা খামে করে বেতনের টাকাটা দিয়ে যায়। অথচ মজার ব্যাপার হলো আমাকে স্কুলে আর বেতন দিতে হয় না। শুধু যে বেতন দিতে হয় না তা নয়। উল্টো আমাকে মাসে মাসে তিনশ টাকা বৃত্তি দেয়া হয়। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আমাকে ডেকে একদিন জিজ্ঞেস করলেন আমি টিউশানি করাতে রাজি আছি কী না। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে একটা ভাল ছাত্র ম্যাথমেটিক্সের একটা টিউটর। খুঁজছে। যদি এই টিউশানিটা পেয়ে যাই তাহলে প্রতি মাসে কমপক্ষে নিশ্চয়ই দুই হাজার টাকা করে পাব। ইংলিশ মিডিয়ামে যারা পড়ে তাদের কাছে টাকা নাকী হাতের ময়লা!

প্রিয়াংকা আগের মতোই আছে। এখনো সে গোপনে বিক্ষিপ্তভাবে আনন্দ বিতরণ করে যাচ্ছে! এগুলো গোপনীয় হলেও সে মাঝে মাঝে আমাকে বলে। আমি তার সাথে যেতে চাইলে আমাকে নিয়েও যায়। একদিন একটা থুত্থুড়ে বুড়োকে একটা দাবার বোর্ড আর খুঁটির প্যাকেট দিয়ে ফিরে আসছে, তখন আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, তুই যে এভাবে একলা একলা জায়গায়-অজায়গায় ঘুরে বেড়াস তোর বাসা থেকে কিছু বলে না?

প্রিয়াংকা রেগে বলল, আমি মোটেও জায়গায়-অজায়গায় ঘুরে বেড়াই।

আচ্ছা ঠিক আছে–ঠিক আছে। আমি নিজেকে শুদ্ধ করে বললাম, তুই যে একলা একলা নানারকম ইন্টারেস্টিং জায়গায় ঘুরে বেড়াস–তোকে বাসা। থেকে কিছু বলে না?

উঁহু।

তোর আব্বু-আম্মু দুজনেই তোকে এভাবে ঘুরে বেড়াতে দেয়?

আমার আম্মু নেই।

ও। আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। ইতস্তত করে বললাম, তোর আব্বু?

আল্লু আছেন। ও।

আমরা দুজন কিছুক্ষণ নিঃশব্দে হাঁটলাম। একসময় প্রিয়াংকা বলল, আমার বাসার কাছাকাছি চলে এসেছি। যাবি?

আমি তাকিয়ে দেখলাম, সত্যিই তাই। জিজ্ঞেস করলাম, তোর আব্বু কী বাসায় আছেন?

আছেন। সব সময়ে থাকেন।

আ-আমাকে দেখে রাগ হবেন না তো?

প্রিয়াংকা হি হি করে হাসলো, বলল, ধুর গাধা, রাগ হবেন কেন?

আমি লজ্জা পেয়ে বললাম, না মানে ইয়ে

আমরা আরো কিছুক্ষণ হাঁটলাম, সরু একটা রাস্তার পাশে পুরানো একটা বাসার সামনে দাড়িয়ে প্রিয়াংকা বলল, এই যে আমাদের বাসায় এসে গেছি।

আমি বললাম, ও। প্রিয়াংকা দরজায় শব্দ করল। কয়েক মিনিট পরে ঘুট করে শব্দ করে দরজা খুলে গেলো। আমি দেখলাম হুইল চেয়ারে বসে থাকা একজন মানুষ। মানুষটার চেহারা খুব সুন্দর, এক মাথা কালো চুল, কানের কাছে সেই চুলে পাক ধরেছে। চোখে পাতলা ধাতব রিমের একটা চশমা। প্রিয়াংকা একটু আগে বলেছিল তার আব্লু সবসময় বাসায় থাকেন, এখন তাকে দেখে বুঝতে পারলাম কেন। হুইল চেয়ারে করে কোথায় আর যাবেন?

প্রিয়াংকা বলল, আব্বু, দেখো একজন গেস্ট এসেছে।

প্রিয়াংকার আব্বু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমাদের বিখ্যাত গণিতবিদ?

হ্যাঁ, আব্বু।

ভেরি গুড। এসো তপু এসো। প্রিয়াংকার কাছে তোমার অনেক গল্প শুনেছি। পত্রিকায় তোমার ছবি দেখে ভেবেছিলাম তুমি আরো বড়! তুমি তো আসলে অনেক ছোট।

আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। প্রিয়াংকা নিজের জুতো খুলে খালি পায়ে ভেতর থেকে একটু ঘুরে এসে বলল, তপু, আমার আব্বু হচ্ছেন একজন। লেখক।

আমি চোখ বড় বড় করে বললাম, সত্যি? হা সত্যিকার লেখক। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী নাম।

প্রিয়াংকা হি হি করে হাসল, বলল, নাম বললে তুই চিনবি না। আসলে কেউই চিনবে না। আল্লু দুই তিন বছর পরিশ্রম করে যে বই লিখে সেটা ছাপা হয় দশ কপি। যে ছাপায় সে কিনে পাঁচ কপি আর আলু কিনে পাঁচ কপি!

প্রিয়াংকার আব্বু বললেন, সেই পাঁচ কপি কিনে তোর আব্বু কী করে সেটাও বলে দে।

বাসায় যদি কেউ আসে জোর করে তাকে একটা কপি ধরিয়ে দেয়। আজকে তুই এসেছিস তোকেও আব্বুর বইয়ের এক কপি নিয়ে যেতে হবে দেখিস!

আমি এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে প্রিয়াংকা আর তার আব্বুর দিকে তাকিয়ে রইলাম, দেখে মনে হচ্ছে দুইজন সমবয়সী বন্ধু কথা বলছে! আমার আব্বু যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে আমিও কী এভাবে কথা বলতে পারতাম?

আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কীসের ওপর বই লিখেন?

প্রিয়াংকার আব্বু কথা বলার আগেই প্রিয়াংকা বলল, তুই শুনলে বিশ্বাস করবি না। আব্বু যে সব বিষয়ের ওপর বই লিখে সেসব বিষয় যে আছে সেটাও তুই জানিস কী না সন্দেহ আছে!

প্রিয়াংকার আব্বু বললেন, ব্যস অনেক বাপের বদনাম করা হয়েছে। এখন তোর বিখ্যাত বন্ধুর জন্য চা-নাস্তা কিছু নিয়ে আয়।

প্রিয়াংকা বলল, আনছি বাবা আনছি।

প্রিয়াংকা রান্নাঘরের দিকে চলে যাবার পর প্রিয়াংকার আব্বু আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বললেন, আমার বইগুলো হচ্ছে অবলুপ্ত প্রাণীদের ওপর।

অবলুপ্ত প্রাণী?

হ্যাঁ। আমাদের এই অঞ্চলে এক সময় গণ্ডার থাকতো তুমি জানো?

আমি জানতাম না, তাই অবাক হয়ে তাকালাম। প্রিয়াংকার আব্বু বললেন। শুধু গণ্ডার না, এখানে বনরুই বলে একটা প্রাণী থাকতো, নীল গাই নাম এক ধরনের প্রাণী থাকতো এখন সব অবলুপ্ত হয়ে গেছে, না হয় অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আমি ভাবলাম প্রাণীগুলো যখন থাকবেই না অন্তত তার ইতিহাসটা বেঁচে থাকুক। কী বলো?

আমি গম্ভীর ভাবে মাথা নাড়লাম। আমি এখন আস্তে আস্তে বুঝতে পারছি প্রিয়াংকা কেমন করে প্রিয়াংকা হয়েছে! তার আব্বু আমার সাথে এমন ভাবে কথা বলছেন যেন আমি একজন বড় মানুষ। প্রিয়াংকার সাথেও নিশ্চয়ই এভাবে কথা বলেন, তাই প্রিয়াংকা নিজে বোঝার আগেই বড় হয়ে গেছে। তার। কথাবার্তা, চালচলন সব বড় মানুষের মতো। আমি আড় চোখে কয়েকবার প্রিয়াংকার আব্বুর দিকে তাকালাম, হুইল চেয়ারে তার পাগুলো দেখে মনে হয়।

সেখানে কোন সমস্যা আছে কিন্তু আসলে নিশ্চয়ই আছে। তা না হলে হুইল চেয়ারে কেন? কী হয়েছিল কে জানে!

কিছুক্ষণের মাঝেই প্রিয়াংকা চানাচুর আর চা নিয়ে এলো। এইটুকুন সময়ের মাঝে চানাচুরগুলো কাঁচা মরিচ আর পেঁয়াজ দিয়ে মাখিয়ে নিয়ে এসেছে। ছোট একটা টেবিল ঘিরে আমরা বসেছি–আমি আর প্রিয়াংকা চেয়ারে, প্রিয়াংকার আব্বু হুইল চেয়ারে। চা খেতে খেতে প্রিয়াংকা কথা বলতে লাগলো–প্রিয়াংকার আব্বু এক সময় তাকে থামালেন, বললেন, প্রিয়াংকা তোর কথা তো প্রত্যেক দিনই শুনি–আজকে তোর গেস্টের মুখ থেকে কিছু শুনি।

প্রিয়াংকা হি হি করে হেসে বলল, তাহলেই হয়েছে। আমাদের তপু মাত্র তিনটা শব্দ জানে। একটা হচ্ছে ও, আরেকটা আচ্ছা আর আরেকটা তাই নাকী! তাই তুমি যদি তপুর কথা শুনতে চাও এই তিনটাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে।

প্রিয়াংকার আলু হেসে বললেন, ঠিক আছে, এই তিনটাতেই না হয় সন্তুষ্ট থাকব, কিন্তু তার মুখ থেকে শুনে সন্তুষ্ট থাকি!

প্রিয়াংকার আব্বু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, খবরের কাগজে তোমার সম্পর্কে যেটা লিখেছে সেটা পড়ে মনে হলো তুমি হয়তো একটা ইয়াং প্রডিজি। প্রডিজি কী জানো তো খুব কম বয়সে যাদের মেধার অস্বাভাবিক বিকাশ ঘটে তাদেরকে বলে প্রডিজি।

আমি অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বসলাম, না–সেরকম কিছু না!

তোমার বিনয় করার প্রয়োজন নেই। দেখা গেছে গণিত সঙ্গীত এসব বিষয়ে মেধা সাধারণত খুব কম বয়সে বিকশিত হয়।

আমি বললাম, ও। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, তুমি সেটাকে কন্ট্রোল করতে পারবে তো?

কন্ট্রোল?

হ্যাঁ। প্রিয়াংকার আলু চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, আমার মেয়ে তোমাকে রাতারাতি বিখ্যাত বানিয়ে ফেলে মহাখুশি। আমার প্রশ্ন হলো সেটা তোমার জন্যে কী ভাল হলো, নাকী খারাপ হলো?

প্রিয়াংকা ঠকাস কার কাপটা টেবিলে রেখে বলল, কী বলছ তুমি আব্বু? এটা আবার খারাপ হবে কেমন করে?

আমি সেটাই বলার চেষ্টা করছি। খ্যাতি খুব বিচিত্র একটা জিনিস। এটা লটারির মতো অনেক চেষ্টা করেও এটা পাওয়া যায় না। যারা পাবার তারা এমনিতেই পায়। আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার কী জানিস?

কী?

বেশিরভাগ সময়ে খ্যাতিটা অপাত্রে যায়। যারা পায় তারা সেটা ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে না।

প্রিয়াংকা বলল, বুঝলি তপু, এই জন্যে আমাদের বাসায় কেউ আসতে চায় না। আসলেই আলু এমন জ্ঞানের কথা শুরু করে দেয় যে সে কোন মতে প্রাণ নিয়ে পালায়।

প্রিয়াংকার আবু বললেন, বাজে কথা বলবি না। আজকে প্রথম তুই একজন বিখ্যাত মানুষ এনেছিস। এর আগে বিখ্যাত কেউ এসেছে?

আমি অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বসে বললাম, আমি মোটেও বিখ্যাত না–

প্রিয়াংকার আব্বু বললেন, কিন্তু তোমার ভেতরে বিখ্যাত হবার সবগুলো এলিমেন্ট আছে। সে জন্যে তোমাকে জিজ্ঞেস করছি যদি কখনো খ্যাতি এসে তোমার হাতে ধরা দেয়, তুমি সেটা কন্ট্রোল করতে পারবে?

আমি এই প্রশ্নের কী উত্তর দেব সেটা বুঝতে পারলাম না। মাথা চুলকে বললাম এ্যাঁ, এ্যাঁ-এ্যাঁ-

প্রিয়াংকা হি হি করে হেসে বলল, তপুর তিন শব্দের সাথে চার নম্বর শব্দ যোগ হলো সেটা হচ্ছে এ্যাঁ!

প্রিয়াংকার আবু বললেন, আসলে এইটুকুন ছেলেকে অনেক বড় প্রশ্ন করে ফেলেছি তো–উত্তর দেবে কী ভাবে?

আমি বললাম, আপনি উত্তরটা দিয়ে দেন!

আমি দিলে সেটা তো আমার উত্তর হবে তোমার উত্তর হবে না?

আমি আবার মাথা চুলকে বললাম, এ্যাঁ, এ্যাঁ, এ্যাঁ…

সেটা শুনে প্রিয়াংকা আবার হি হি করে হেসে ফেলল। প্রিয়াংকার আব্বুও একটু হাসলেন, হেসে বললেন, আমার কয়েক জন খুব বিখ্যাত বন্ধু আছে, নাম বললে তোমরা চিনবে। আমি তাদেরকে খুব ভাল করে স্টাডি করেছি। করে কী দেখেছি জানো?

কী?

খ্যাতিটা গুরুত্বপূর্ণ না। যে গুণের জন্যে খ্যাতি এসেছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ। তাই মিছিমিছি খ্যাতির পিছনে ছুটতে হয় না। মানুষ তো একটামাত্র জীবন পায়, সেই জীবনটাকে পুরোপুরি উপভোগ করতে হয়। তাই বলছিলাম একজন বিখ্যাত মানুষ হয়ে বিশেষ লাভ নেই কিন্তু একজন পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে অনেক লাভ-

প্রিয়াংকা বলল, এই জন্যে আমি বাসায় কাউকে আনতে চাই না। সুযোগ পেলেই তুমি উল্টাপাল্টা কথা বলে মাথা আউলাঝাউলা করে দাও।

প্রিয়াংকার আব্বু বললেন, ঠিক আছে, আর আউলাঝাউলা করব না। তার চাইতে আমার লাস্ট বইটা নিয়ে আয়, তপুকে দেখাই।

কোন জ্ঞানের কথা বলতে পারবে না কিন্তু।

ভয় পাস না, বলব না।

প্রিয়াংকা তখন শেলফ থেকে তার আব্বুর লেখা বেশ কয়েকটা বই নামিয়ে আনল।

 

আমি যখন বিকালবেলা প্রিয়াংকার বাসা থেকে বের হচ্ছিলাম তখন সে আমাকে একটু এগিয়ে দিতে এলো। আমি যখন বললাম কোন দরকার নেই তখন সে বলল মোড়ের দোকান থেকে তার নাকী ডিম আর তেল কিনতে হবে।

রাস্তা দিয়ে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে আমি বললাম, আচ্ছা প্রিয়াংকা, তোকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করি?

আবু কেন হুইল চেয়ারে সেটা জিজ্ঞেস করবি তো?

আমি থতমত খেয়ে বললাম, হ্যাঁ।

আমি যখন ছোট তখন একটা গাড়ি একসিডেন্ট হয়েছিল। আম্মু স্পট ডেড। আর কোমর থেকে নিচে প্যারালাইজড।

আমি কিছুক্ষণ প্রিয়াংকার দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, তোর সাথে আমার একটা মিল আছে দেখেছিস?

কী মিল?

আমার বেলায় একসিডেন্টে আলু স্পট ডেড, আম্মু প্যারালাইজড! তোর আব্বুর শরীর আর আমার আম্মুর মন?

প্রিয়াংকা কোন কথা না বলে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলল। আমি অন্যমনস্কভাবে চিন্তা করতে লাগলাম, কোনটা ভাল? শরীর অবশ হয়ে যাওয়া নাকী মন অবশ হয়ে যাওয়া?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *