০৯. ফেরার পথে

॥ ৯ ॥

ফেরার পথে অল্পক্ষণের মধ্যেই আরো অন্ধকার হয়ে এলো। অথচ বেলা যে খুব বেশি হয়েছে তা নয়। ঘড়িতে বলছে চারটে পঁচিশ। তাহলে আলো এত কম কেন?

গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বার করে আকাশের দিকে চাইতেই কারণটা বুঝতে পারলাম। সাদার বদলে এখন ছাই রঙের মেঘে আকাশ ছেয়ে গেছে। বৃষ্টি হবে কি? আশা করি না। এমনিতেই রাস্তা পিছল। যদিও আমরা নিচের দিকে নামছি, তার মানে এই নয় যে, আমাদের গাড়ি আরো জোরে চলবে। বরং উৎরাইয়ের স্কিড করার ভয়টা.আরো বেশি। ভরসা এই যে, এ সময়টা রাস্তায় গাড়ি চলাচল প্রায় নেই বললেই চলে।

ফেলুদা ড্রাইভারের পাশে চুপ করে বসে আছে, তার দৃষ্টি সামনের রাস্তার দিকে। যদিও তার মুখটা দেখতে পাচ্ছি না, তবুও কেন জানি মনে হচ্ছে তার ভুরুটা কুঁচকোন। বেশ বুঝতে পারছিলাম ওর মাথার মধ্যে কী চিন্তা ঘুরছে। হয় দীননাথবাবু না হয় ধমীজা মিথ্যে কথা বলছেন। ধমীজার বৈঠকখানাতেও আলমারি বোঝাই বই দেখেছি। তার পক্ষে শম্ভুচরণের নামটা জানা কি সম্ভব নয়? পঞ্চাশ বছর আগে ইংরিজিতে লেখা তিব্বতের ভ্রমণকাহিনীর উপর কি তার লোভ থাকতে পারে না? কিন্তু ধমীজার কাছেই যদি লেখাটা থাকে তাহলে ফেলুদা সেটা উদ্ধার করবে কি করে?…

বেশ বুঝতে পারছিলাম যে রহস্য এখন একটার জায়গায় দুটো হয়ে গেছে—একটা হীরের, একটা শম্ভুচরণের লেখার। একা ফেলুদার পক্ষে এই দুটো জাঁদরেল রহস্যের জট ছাড়ানো কি সম্ভব?

শীত বাড়ছে। নিশ্বাসের সঙ্গে নাক দিয়ে ধোঁয়াও বেরোচ্ছে বেশ। লালমোহনবাবু ওভারকোটের একটা বোতাম খুলে ভিতরে হাত ঢুকিয়ে মুখ দিয়ে ভক্‌ ভক্‌ করে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ‘বুমের‍্যাংটাও ঠাণ্ডা বরফ। অস্ট্রেলিয়ান জিনিস, শীতের দেশে কাজ করবে তো?’ আমার বলার ইচ্ছে ছিল অস্ট্রেলিয়াতেও অনেক জায়গায় খুবই শীত পড়ে, এমন কি বরফও পড়ে, কিন্তু সেটা আর বলা হল না। সামনে, প্রায় একশো গজ দূরে, একটা গাড়ি উল্টো দিক থেকে এসে টেরচাভাবে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। হয়ত চেষ্টা করলে কোনোরকমে কসরৎ করে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাওয়া যায়, কিন্তু সেটা বোধ হয় বেশ বিপজ্জনক হবে।

আমাদের ড্রাইভার বার বার হর্ন দিয়েও যখন কোনো ফল হল না তখন বুঝলাম ব্যাপারটার মধ্যে কোনো গণ্ডগোল আছে।

ফেলুদা কথা না বলে স্টিয়ারিং-এর উপর হাত রেখে গাড়ি থামাতে বলল, আর ড্রাইভারও খুব সাবধানে গাড়িটাকে রাস্তার একপাশে পাহাড়ের দিকটায় নিয়ে গিয়ে থামালো। আমরা চারজনই কাদা আর বরফে প্যাচপেচে রাস্তায় নামলাম।

চারিদিকে একটা নিঝুম ভাব। এত গাছ থাকা সত্ত্বেও একটা পাখিরও ডাক শোনা যাচ্ছে না। সবচেয়ে আশ্চর্য এই যে, সামনে একটা গাড়ি রয়েছে—আমাদেরই মতো একটা অ্যাম্বাসাডর—কিন্তু তার যাত্রী বা ড্রাইভার কাউকেই দেখা যাচ্ছে না, কারুরই কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।

আমরা খুব হিসেব করে রাস্তার দিকে চোখ রেখে বরফের উপর যেখানে চাকার দাগ, সেই দাগের উপর পা ফেলে ফেলে এগোচ্ছি, এমন সময় লালমোহনবাবু হঠাৎ চমকে গিয়ে ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে পা হড়কে একেবারে বরফের উপর মুখ থুবড়ে পড়লেন। একটা আচমকা ‘ছপাৎ’ শব্দই এই ভড়কানির কারণ। আমি জানি শব্দটা হয়েছে পাইন গাছের ডাল থেকে বরফের চাপড়া পিছলে মাটিতে পড়ার ফলে। এই অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতার মধ্যে হঠাৎ শব্দটা শুনে সত্যিই চমকে উঠতে হয়।

লালমোহনবাবুকে কোনোরকমে হাত ধরে টেনে তুলে আমরা আবার এগোতে লাগলাম।

আরো খানিকটা এগোতেই বুঝলাম গাড়িটার মধ্যে একজন লোক বসে আছে। সামনে। ড্রাইভারের সীটে।

আমাদের ড্রাইভার বলল লোকটাকে চেনে। ট্যাক্সিটাও ওর জানা। লোকটা ওই ট্যাক্সিটার ড্রাইভার। নাম অরবিন্দ্। ‘উও মর গিয়া হোগা…ইয়া বেহুঁশ হো গিয়া’—আমাদের ড্রাইভার হরবিলাস মন্তব্য করল।

ফেলুদার হাত ওর কোটের ভিতরে চলে গেছে। আমি জানি ওখানে আছে ওর রিভলবার।

ছপাৎ!

আবার এক চাবড়া বরফ মাটিতে পড়ল কাছেই কোনো একটা গাছ থেকে। লালমোহনবাবু চমকে উঠলেও এবার আর আছাড় খেলেন না। কিন্তু তার পরমুহূর্তেই যে ব্যাপারটা ঘটল তাতে আরেকবার তাকে বরফে গড়াগড়ি দিতে হল।

একটা কান-ফাটানো পিস্তলের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সামনে ঠিক দু’ হাত দূরে রাস্তার খানিকটা বরফ তুবড়ির মতো ফিন্‌কি দিয়ে উঠল, আর শব্দটা বেশ কিছুক্ষণ ধরে চারিদিকের পাহাড় থেকে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।

আমরা গাড়িটার বেশ কাছাকাছি এসে পড়েছিলাম। শব্দটা শোনা মাত্র ফেলুদা এক হ্যাঁচ্‌কায় আমাকে টেনে নিয়ে গাড়িটার পাশে বরফের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল, আর তার পরমুহূর্তেই লালমোহনবাবু গড়াতে গড়াতে আমাদের ঠিক পাশেই এসে হাজির হলেন। আমাদের ড্রাইভারও এক লাফে গাড়িটার পিছনে এসে আশ্রয় নিয়েছে। যদিও সে বেশ জোয়ান লোক, তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে এর আগে কখনো এরকম অবস্থায় পড়েনি।

গুলিটা এসেছে আমাদের রাস্তার ধারের খাড়াই পাহাড়টার উপরের দিক থেকে। আন্দাজে মনে হয় এখন আর আততায়ী আমাদের দেখতে পাচ্ছে না, কারণ এই কালো অ্যাম্বাসাডরটা আমাদের গার্ড করে রেখেছে।

আমি এই মাটিতে মুখ থুবড়োনো অবস্থাতেও বুঝতে পারলাম কী যেন একটা নতুন ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে। আমার ঘাড়ে কী যেন একটা ঠাণ্ডা জিনিস সুড়সুড়ি দিচ্ছে। ঘাড়টা ঘুরিয়ে পাশে তাকাতেই বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা কী। চারিদিক ঘিরে আকাশ থেকে মিহি তুলোর মতো বরফ পড়তে শুরু করেছে। কী অদ্ভুত সুন্দর এই বরফের বৃষ্টি! এই প্রথম জানলাম যে বরফ পড়ার কোনো শব্দ নেই। লালমোহনবাবু কী যেন একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ফেলুদা জিব দিয়ে একটা সাপের মতো শব্দ করে তাকে থামিয়ে দিল।

হঠাৎ চারিদিকের নিস্তব্ধতা আবার ভেঙে গেল। এবার বন্দুকের শব্দ নয়, গাছ থেকে বরফ পড়ার শব্দ নয়, বরফের উপর গাড়ির চাকার শব্দ নয়। এবার মানুষের গলা।

‘শুনুন মিস্টার মিত্তির!’

এ কার গলা? এ গলা যে চেনা চেনা মনে হচ্ছে!

‘শুনুন মিস্টার মিত্তির—আমি আপনাদের বাগে পেয়েছি সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। কাজেই কোনো কারসাজি দেখাবেন না। ওতে কোনো ফল তো হবেই না, বরং আপনাদের প্রাণ নিয়ে টানাটানি হতে পারে।’

চেঁচিয়ে বলা এই কথাগুলো উল্টো দিকের পাহাড়ের গা থেকে বার বার প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এসে ঠাণ্ডা নিস্তব্ধ পরিবেশটাকে গম্‌গমিয়ে দিল। তারপর আবার কথা শুরু হল—

‘আমি আপনার কাছে শুধু একটি জিনিস চাই।’

‘কী জিনিস?’—ফেলুদা উপরে পাহাড়ের দিকে মুখ তুলে প্রশ্নটা করল।

‘আপনি গাড়ির পিছন থেকে বেরিয়ে সামনে আসুন। আমি আপনাকে দেখতে চাই, যদিও আপনি আমাকে দেখতে পাবেন না। আপনি বেরিয়ে এলে তারপর আপনার প্রশ্নের জবাব পাবেন।’

আমার কানের কাছেই একটা অদ্ভুত শব্দ হচ্ছিল কিছুক্ষণ থেকে, আমি ভাবছিলাম সেটা গাড়ির ভেতর থেকে আসছে; এখন বুঝলাম সেটা হচ্ছে লালমোহনবাবুর দাঁতে দাঁত লাগার ফলে।

ফেলুদা বরফ থেকে উঠে গাড়ির উল্টো দিকে গিয়ে দাঁড়াল। তার মুখে একটা কথা নেই। বোধ হয় সে বুঝতে পেরেছে এ অবস্থায় আদেশ মানা ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই। ফেলুদাকে এমন বেগতিকে কখনো পড়তে হয়েছে বলে মনে পড়ল না।

‘আপনার সঙ্গে যে তিনজন রয়েছে’, আবার কথা এলো, ‘তারা যদি কোনো রকম চালাকি করে, তাহলে তৎক্ষণাৎ তাদের ফল ভোগ করতে হবে—এটা যেন তারা মনে রাখেন।’

‘আপনি কী চাইছেন সেটা এবার বলবেন কী?’ ফেলুদা জিগ্যেস করল। গাড়ির পিছনের চাকার পাশ দিয়ে ফেলুদাকে দেখতে পাচ্ছিলাম। সে উপরের দিকে চেয়ে আছে। তার সামনেই পাহাড়ের গায়ে অনেকখানি জায়গা জুড়ে শুধু বরফের ঢাল; তার উপরে রয়েছে ঝাউবন। সেই ঝাউবনের আড়াল থেকে আততায়ী কথা বলছে আর আমাদের দেখছে।

আবার কথা এলো—

‘আপনার রিভলভারটা বার করুন।’

ফেলুদা বার করল।

‘ওটা ছুঁড়ে আপনার সামনে পাহাড়ের গায়ে বরফের ওপর ফেলে দিন।’

ফেলুদা ফেলল।

‘আপনার কাছে কোডাকের কৌটোটা আছে?’

‘আছে।’

‘দেখান।’

ফেলুদা কোটের পকেট থেকে হল্‌দে কৌটোটা বার করে তুলে ধরল।

‘এবারে ওর ভেতরে যে পাথরটা ছিল সেটা দেখান।’

ফেলুদার হাত এবার কোটের বুক পকেটে চলে গেল। পাথরটা পকেট থেকে বেরিয়ে এলো। ফেলুদা সেটাকে দু’ আঙুলের ডগায় তুলে ধরল।

কয়েক সেকেণ্ড কোনো কথা নেই। লোকটা নিশ্চয়ই পাথরটা দেখছে। বাইনোকুলার আছে কি ওর সঙ্গে?

‘বেশ। এবার ওই কৌটোর মধ্যে ওটাকে পুরে আপনার ডান দিকে রাস্তার পাশের কালো পাথরটার উপর রেখে আপনারা সিমলা ফিরে যান। যদি মনে করেন—’

ভদ্রলোকের কথা শেষ হবার আগেই ফেলুদা বলে উঠল—‘আপনার পাথরটা চাই তো?’

‘সেটাও কি বলে দিতে হবে?’ বরফের মতো ঠাণ্ডা গলায় উত্তর এলো।

‘তাহলে এই নিন!’

ব্যাপারটা এত হঠাৎ ঘটল যে আমি কয়েক সেকেণ্ডের জন্য যেন চোখে অন্ধকার দেখলাম।

ফেলুদা কথাটা বলেই তার হাতের পাথরটা সটান ছুঁড়ে দিল যেখান থেকে কথা আসছে সেইদিকে। আর তার পরেই হল এক রক্তজল-করা বীভৎস ব্যাপার। আমাদের অদৃশ্য দুশমন সেই হীরেটাকে লুফবার জন্য ঝাউগাছের আড়াল থেকে লাফিয়ে সামনে আলোয় এসে বরফের একটা বিরাট চাঁই পা দিয়ে ধ্বসিয়ে টাল হারিয়ে সেই বরফের সঙ্গে পাহাড়ের গা বেয়ে প্রায় পঞ্চাশ হাত উপর থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে একেবারে রাস্তার পাশে বরফজমা নালাটার উপর এসে স্থির হলেন। গড়িয়ে আসার সময়ই অবিশ্যি তার হাত থেকে বাইনোকুলার আর রিভলভার, চোখ থেকে কালো চশমা আর থুঁতনি থেকে ছুঁচোল নকল দাড়ি ছিট্‌কে বেরিয়ে গিয়ে বরফের এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।

এই ঘটনার পর আর লুকিয়ে থাকার কোনো মানে হয় না, তাই আমরা তিনজনেই দৌড়ে এগিয়ে গেলাম ফেলুদার কাছে। আমার ধারণা ছিল যে এতটা দূর থেকে গড়িয়ে পড়ায় লোকটা মরে না গেলেও, অজ্ঞান তো হবেই। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম, সে বরফের উপর চিত অবস্থাতেই ফেলুদার দিকে জ্বলজ্বল কটা চোখে চেয়ে আছে, আর জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলছে।

গলাটা যে চেনা চেনা মনে হয়েছিল তাতে আর আশ্চর্য কী? ইনি হলেন ব্যর্থ ফিল্ম অভিনেতা শ্ৰীঅমরকুমার, ওরফে শ্রীপ্রবীরকুমার লাহিড়ী, দীননাথ লাহিড়ীর ভাইপো।

ফেলুদা ঠাণ্ডা শুকনো গলায় বলল, ‘বুঝতেই তো পারছেন প্রবীরবাবু, এখন কে কা’কে বাগে পেয়েছে। কাজেই আর কিছু লুকিয়ে লাভ নেই। বলুন, আপনার কী বলার আছে।’

অমরকুমারের চিত হওয়া মুখের উপর বরফের গুঁড়ো এসে পড়ছে। সে এখনো একদৃষ্টে চেয়ে আছে ফেলুদার দিকে। আমার কাছে এখনো সব ধোঁয়াটে, কিন্তু আশা করছি প্রবীরবাবুর কথায় রহস্য দূর হবে।

ফেলুদা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, ‘বেশ, আপনি না বলেন তো আমাকেই বলতে দিন। প্রতিবাদ করার হলে করবেন।—হীরেটা আপনি পেয়েছিলেন নেপালী বাক্সটা থেকে। খুব সম্ভবত এই মহামূল্য রত্নটাই নেপালের মাতাল রাজা কৃতজ্ঞতার নিদর্শন হিসেবে শম্ভুচরণকে দিয়েছিলেন। নেপালী বাক্সটা আসলে সম্ভবত শম্ভুচরণের। সেটা তিনি তাঁর মৃত্যুর আগে তাঁর বন্ধু সতীনাথ লাহিড়ীকে দিয়ে যান। সতীনাথের গুরুতর অসুখের জন্য সে হীরেটার কথা কাউকে বলতে পারেনি। এই ক’দিন মাত্র আগে হীরেটা আপনি বাক্স থেকে পান। তারপরে সেটাতে রং মাখিয়ে সুপুরি বানিয়ে কোডাকের কৌটোর তলায় আঠা দিয়ে আটকে রাখেন, আর নিরাপদ জায়গা মনে করে কৌটোটা কাকার কাছ থেকে পাওয়া বাক্সটাতে রাখেন। কিন্তু সে বাক্স যে তার পরদিনই আপনার ঘর থেকে আমার ঘরে চলে আসবে সেটা তো আর আপনি ভাবেননি! সেদিন আড়ি পেতে আমাদের কথা শোনার পর থেকেই আপনি বাক্সটা হাত করার তাল করছেন। প্রথমে মিস্টার পুরির নাম দিয়ে ভাঁওতা টেলিফোন আর প্রিটোরিয়া স্ট্রীটে গুণ্ডা লাগানো। তাতে ফল হল না দেখে আমাদের ধাওয়া করে দিল্লী আসা। কিন্তু তাতেও হল না। জনপথ হোটেলে আপনার বেপরোয়া প্ল্যানটিও মাঠে মারা গেল। তাই বাধ্য হয়েই সিমলা আসতে হল। আর তারপর আজকের এই অবস্থা!…’

ফেলুদা থামল। আমরা সবাই ফেলুদাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছি, এমনকি আমাদের ড্রাইভার পর্যন্ত।

‘বলুন প্রবীরবাবু—আমি কি ভুল বলেছি?’

প্রবীরবাবুর উগ্র চোখে হঠাৎ একটা ঝিলিক খেলে গেল। অদ্ভুত ধূর্ত চাহনিতে ফেলুদার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কিসের কথা বলছেন আপনি? কোন্ হীরে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’

আমার বুকের ভিতরটা ধড়াস করে উঠল। হীরেটা তো বরফের তলায় তলিয়ে গেছে, আর তার উপরে আরো বরফ জমা হচ্ছে এখন।

‘কেন, এটা কি আপনি চেনেন না?’

আবার চমক লাগার পালা। ফেলুদা এবার তার বুক পকেট থেকে আরেকটা পাথর বার করল। এই বরফ-পড়া মেঘলা বিকেলেও তার ঝলকানি দেখে তাক্ লেগে যায়।

‘বরফের উপরে যেটা রয়েছে সেটার দাম কত জানেন? পাঁচ টাকা। আজই সকালে মিলার জেম কোম্পানি থেকে কেনা। আর এটাই হল—’

প্রবীরবাবু বাঘের মতো লাফ দিয়ে উঠে ফেলুদার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার হাত থেকে হীরেটা ছিনিয়ে নিয়েছে!

ঠকাং!

আচমকা একটা মোক্ষম অস্ত্র প্রচণ্ড জোরে প্রবীরবাবুর মাথায় বাড়ি মেরে তাকে অজ্ঞান করে দিল। তার শরীরটা আবার এলিয়ে পড়ল বরফের উপর। তার হাতের মুঠো খুলে গেল। তার হাত থেকে হীরে আবার ফিরে এলো ফেলুদার হাতে।

‘থ্যাঙ্ক ইউ, লালমোহনবাবু!’

ফেলুদার ধন্যবাদটা লালমোহনবাবুর কানে গেল কিনা জানি না। তিনি এখনো তাঁর নিজেরই হাতে ধরা বুমের‍্যাঙটার দিকে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *