1 of 2

০৯. প্রেসিডেন্সি কলেজ

হীরা বুলবুলের পুত্ৰ চন্দ্রনাথকে ভরতি করা উপলক্ষে হিন্দু কলেজ ভেঙে যায়। বারবনিতার সন্তানকে গ্ৰহণ করার জন্য শহরের গণ্যমান্য অভিভাবকরা নিজেদের সন্তানদের এ কলেজ থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে পৃথক কলেজ স্থাপন করেছিলেন। গৌরবোজ্জ্বল, ঐতিহ্যবাহী হিন্দু কলেজের হীন দশা দেখে কর্তৃপক্ষ অচিরেই তাঁদের ভ্ৰম বুঝতে পারেন এবং তা শুধরে নেবার জন্য বিনা আড়ম্বরে, এক কথায় অবাঞ্ছিত কুকুরের মতন চন্দ্রনাথকে দূর করে তাড়িয়ে দেন। নানাপ্রকার প্রলোভন দেখিয়ে প্ৰাক্তন ছাত্রদের ফিরিয়ে আনারও চেষ্টা চলতে থাকে। ছাত্ররা ফিরে আসতেও শুরু করে এবং নব প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন কলেজটি ভেঙে যায়।

কিন্তু হিন্দু কলেজ তার আগেকার রূপ আর ফিরে গেল না। হীরা বুলবুল আর তার পুত্রের ঘটনার প্রভাব মুছে ফেলা সহজ নয়। হিন্দু কলেজের নিয়মকানুনের আমূল সংস্কার করার বিশেষ প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন অনেকেই। এবং তারই পরিণতিতে হিন্দু কলেজ রূপান্তরিত হলো প্রেসিডেন্সি কলেজে। এই প্রেসিডেন্সি কলেজ চলে এলো পুরোপুরি সরকারী ব্যবস্থাপনায়, জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকল ছাত্রেরাই এখানে প্রবেশের সুযোগ পেল। এর স্কুল শাখাটির নাম অবশ্য রইলো হিন্দু স্কুল। অন্যান্য স্থানে আরও কলেজ স্থাপিত হয়েছে এবং ছাত্রসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে বলে প্রেসিডেন্সি কলেজকে কেন্দ্র করে কলকাতায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনেরও উদ্যোগ চলতে লাগলো।

হিন্দু কলেজের অনেক প্রাক্তন ছাত্রই পড়াশুনা করতে লাগলো প্রেসিডেন্সি কলেজে, কিন্তু চন্দ্ৰনাথের পক্ষে আর ফিরে আসা সম্ভব হলো না। এই রকম জীবন থেকে সে চলে গেছে অনেক দূরে। এর মধ্যে তার এমনই পরিবর্তন হয়েছে যে তাকে দেখে আর সহজে চেনার উপায় নেই। ক্ৰোধে, ক্ষোভে, অভিমানে সে মাতৃ-সান্নিধ্য ছেড়ে অনেক আগেই পথ-নিবাসী হয়েছে। রাত্রিকালে যাদের মাথার ওপর ছাদ থাকে না, যাদের দু-বেলা নিশ্চিন্ত অন্ন নেই, তাদের সব সময় একটা লড়াইয়ের মনোভাব রাখতে হয়। প্ৰায় অধিকাংশই এই লড়াই চালিয়ে যায় নিয়তির সঙ্গে। মাত্র দু-একজনই বাস্তব যুদ্ধে জয়ী হয়।

মায়ের কাছে চন্দ্ৰনাথ ছিল অতি আদরের সন্তান, ননী-মাখন খাওয়া শরীর, কখনো কোনো কষ্টভোগ করেনি। জেদের বশে পথে নেমে আসায় সে সব রকম দুঃখ-কষ্টকে অগ্রাহ্য করতে শিখেছে, পরিবেশ অনুযায়ী রূপান্তরিত হয়েছে তার শরীর। কৈশোর ছাড়িয়ে সে এখন যৌবনে উত্তীর্ণ, হঠাৎ অনেক লম্বা হয়ে গেছে, কণ্ঠস্বর বদলেছে, মাথায় বড় বড় চুল, চিবুকে দাড়ির রেখা। তার নামও এখন আর চন্দ্রনাথ নয়, শুধু চাঁদু, বা উচ্চারণ বৈগুণ্যে চেদো।

প্রথম কিছুদিন সে শারীরিক পরিশ্রমের বিনিময়ে আহার সংগ্ৰহ করতো, এখন তার থেকে সহজতর উপায় পেয়েছে। এখন তার ডেরা নিমতলা শ্মশানঘাটে।

মানুষের জীবিকার এমনই বৈচিত্ৰ্য যে কিছু মানুষ শ্মশানে মৃতদেহগুলিকে অবলম্বন করেই চমৎকারভাবে নিজেদের বেঁচে থাকার উপাদান সংগ্রহ করে নেয়। শুধু চণ্ডাল নয়, আরও কিছু কিছু লোক থাকে যাদের ওপর নির্ভর করতেই হয় মৃতের আত্মীয়-স্বজনদের। কাঠ সংগ্ৰহ করা, পুরুত ডেকে আনা থেকে শুরু করে আরও বহুবিধ কাজ থাকে।

চাঁদু এখন ছোটখাটো একটি দলের নেতা। এই নেতৃত্ব তাকে অর্জন করতে হয়েছে। বনের মহিষের পালের মধ্যে একটি করে নেতা-মহিষ থাকে। কোনো আগন্তুক মহিষ দেখলেই সেই নেতা-মহিষটি লড়াই করে তাকে তাড়িয়ে দেয়। কখনো বা আগন্তুক মহিষটিই জেতে এবং তার পরই সে-ই পালটির নেতা হয়ে যায়। দুনিয়ার সর্বত্র এই নিয়মই চলছে।

নিমতলার শ্মশানঘাটে পরগাছাদের দলে চাঁদু সহজে স্থান পায়নি। বেশ কয়েকবার মার খেয়ে তাকে পালাতে হয়েছে সেখান থেকে। তারপর একদিন সে ঐ দলের নেতা ফকিরের সঙ্গে মারামারি করতে করতে দুজনে একসঙ্গে গড়িয়ে পড়ে যায় জলে, সেই জলের মধ্যে ফকিরের ঘাড়টা চাঁদু ঠুসে ধরে থাকে বেশ কিছুক্ষণ। ফকির সেবার মারা যায়নি বটে কিন্তু দেখা গেল যে তার ডান হাতটি ঠাটো হয়ে গেছে। চাঁদু তার হাতটি এত জোরে পিছমোড়া করে ধরেছিল যে মটমট করে তার হাড় ভেঙে যায়। এ সব বৎসর খানেক আগেকার ঘটনা। এখন চাঁদুর কোমরে একটা ছুরি গোঁজা থাকে। মাথায় লাল কাপড়ের ফেটি বাঁধা, হাতে একটি ডাণ্ডা। ইচ্ছে করেই সে তার চেহারাটি ভয়ংকর করে রেখেছে। মৃতদেহ নিয়ে কোনো একটি দল এসে পৌঁছেলেই চাঁদু তার দলটি নিয়ে ঘিরে দাঁড়ায়। তার অনুমতি ছাড়া কোনো ডোমও কাছে এগোয় না। কেমন ধারার দাহ হবে, চন্দন কাঠ না জারুল কাঠ, কতখানি ঘি আর কর্পূর। চার ঘন্টার চিতা না ছ ঘণ্টার চিতা—এইসব বিষয় আগে ঠিক করে নিতে হবে চাঁদুর সঙ্গে। মৃতের গায়ের জামা-কাপড়, খাট-পালঙ্ক এসবও প্রাপ্য চাঁদুর দলের। পোস্তার বাজারে এগুলো ভালো দামে বিক্রি হয়। অবশ্য বিক্রির জন্য এসব নিয়ে চাঁদুদের পোস্তার বাজার পর্যন্ত যেতে হয় না, সেখান থেকেই নিয়মিত ফড়েরা আসে।

তেমন শাঁসালো মড়া তো আর রোজ আসে না, মাসে দু মাসে দুটি একটি। হেঁজিপোঁজি ধরনের লোকই বেশী মরে, তারা অল্প কাঠে কোনো রকমে মুখাগ্নি করে আধাপোড়া শব্ব জলে ভাসিয়ে দেয়। সে সব ক্ষেত্রে ঐ অর্ধদগ্ধ দেহ বহন করে জলে ফেলার মজুরি আদায় করে চাঁদুর দল। যার কাছ থেকে যেমন পাওয়া যায়।

চাঁদুর একটা বিশেষ শখ আছে। চিতায় কিছুক্ষণ জ্বলবার পর একটা সময় শবের মাথাটা জোরে জোরে লাঠির বাড়ি মেরে ফাটাতে হয়, নইলে ও জিনিসটি সহজে পোড়ে না। এই কাজটি চণ্ডালদের বদলে চাঁদু নিজে নেয়। গাঁজার নেশায় চক্ষু লাল, কপালে লাল কাপড়ের ফেট্টি, হাতের প্রকাণ্ড লাঠিটা ঘুরিয়ে চাঁদু লাফিয়ে লাফিয়ে দমাস দমাস করে মারে। খুলিটা চৌচির হয়ে যখন ছিটকে বেরোয় ঘিলু, তখন তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। তখন তাকে দেখায় কালভৈরবের মতন। তখন তাকে দেখলে কে বুঝবে যে একদিন এই লোকটির মাথাতেই শেক্সপীয়ার, বাইরন, কালিদাসের কবিতার লাইন গজগজ করতো।

এই তো পাথুরেঘাটার মল্লিকবাড়ির ছোটবাবুর শব্ব এসেছিল গত মাসে, আর পরশু এসেছিল, বাগবাজারের বোসেন্দের অকালমৃত সেজো ছেলেটি, চাঁদুই তাদের মস্তক চুৰ্ণ করেছে।

যখন চিতা জ্বলে না, শ্মশান জনশূন্য, তখন চাঁদু তার দলবল নিয়ে বসে থাকে জলের ধারে। হাতে। হাতে ফেরে। গাঁজার কন্ধে। তখনও তাদের একটা কাজ থাকে। যতই গল্পে মেতে থাকুক, তাদের চোখ থাকে স্রোতের দিকে।

হীরা বুলবুলের কাছ থেকে একটি গুণ পেয়েছে চাঁদু, তার গানের গলাটি খাসা। নানান উৎসবে বাবুরা গঙ্গায় প্রমোদতরণী নিয়ে বাঈজীদের গান শুনতে শুনতে যায়। রথযাত্রা, লক্ষ্মী পুজোর সময় গঙ্গাবক্ষ এই সব নৌকোতে একেবারে ছয়লাপ। শুনে শুনে কয়েকটা গান চাঁদুর মুখস্থ হয়ে গেছে। তার মধ্যে এই গানটি তার সবচেয়ে প্ৰিয়।

যাবি যাবি যমুনাপারে ও রঙ্গিনী
কত দেখবি মজা রিষড়ের ঘাটে শ্যামা বামা দোকানী
কিনে দেবো মাতা ঘষা, বারুইপুরের খুনসী খাসা
উভয়ের পুরাবি আশা, ও সোনামনি।

হঠাৎ এক সময় গান থামিয়ে চাঁদু চেঁচিয়ে ওঠে, ঐ দ্যাক, দ্যাক! অমনি তার দলের ছেলেরা চেঁচিয়ে ওঠে, কোতা? কোতা?

গঙ্গার স্রোতে প্রায়ই একটি দুটি মৃতদেহ ভেসে যায়। অনেক দূর দূরান্ত থেকেও এমন শব আসে। কিন্তু চাঁদুর দলের ছাড়পত্র না পেয়ে কোনো শব নিমতলা ঘাট পার হতে পারে না।

চাঁদুর নির্দেশ মতন তার দল ঝাঁপিয়ে পড়ে জলে এবং প্রায় শুশুকের মতন ড়ুব সাঁতার দিয়ে ঠিক সেই মৃতদেহটিকে ধরে পারে টেনে আনে। তারপর সেটি তন্নতন্ন ভাবে পরীক্ষা করা হয়। অনেক সময় শবের আঙুলে থাকে সোনার আংটি অথবা পায়ে রূপের চুটকি। তামা বা রূপের তাগা-মাদুলি মৃতদেহ থেকে আত্মীয়রা খুলে নেয় না, সেগুলি সবই চাঁদুদের প্রাপ্য। পাঁচটা শবের মধ্যে অন্তত একটা থেকে কিছু না কিছু পাওয়া যাবেই।

শবদেহ পাড়ের কাছে আসলেই শকুনি আর হাড়গিলের পাল ধেয়ে আসে। তখন চাঁদুর দল লাঠিসোটা নিয়ে তাদের তাড়া করে যায়। শকুনিগুলো উড়ে পালালেও হাড়গিলেরা সহজে যেতে চায় না, তারা রীতিমতন লড়াই করে। কিন্তু হাড়গিলেরা মৃতদেহ ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে, এটা চাঁদুর দল পছন্দ করে না। জলের জিনিস তারা আবার জলকে ফেরত দেয়!

এই শ্মশানে দুটি চণ্ডাল। একজনের নাম ঝিনিয়া, আর একজনের নাম তাড়ু। তাড়ু আবার তার বউকে নিয়ে থাকে একটি গোলপাতার ঘরে। ঝিনিয়াটা যেমন গাঁজাখের, তেমনি মাতাল, অধিকাংশ সময়েই তার চলৎশক্তি থাকে না। ঝিনিয়া যে কোথা থেকে এখানে এসেছে তা জানে না কেউ, অদ্ভুত হিন্দী-বাংলা মেশানো তার ভাষা, বয়েসও হয়েছে যথেষ্ট। চাঁদুর দল ঝিনিয়াকে নিয়ে নানারকম মাস্করা করে, তার গাঁজার কঙ্কে কিংবা মদের ভাঁড় কেড়ে নিয়ে পালায়। তারপর ঝিনিয়া যখন নতুন নতুন স্বরচিত বীভৎস গালাগালির ঝড় বইয়ে দিতে থাকে, সেই সময় ওদের একজন কেউ পেছন দিক থেকে চুপি চুপি গিয়ে তার কোমরের কষি টেনে কাপড়টা খুলে দেয়। অমনি ঝিনিয়া শুরু করে দেয় তাণ্ডব নাচ। এই নিয়ে বেশ সময় কাটে।

তাড়ু সেই তুলনায় বেশ শাস্ত ও গভীর, বয়েসে চল্লিশের বেশী না, কালো কুচকুচে শরীর, মাথার চুল তেল চুকচুকে। তাকে দেখে কেউ চণ্ডাল বলে মনেই করবে না, কিন্তু ঝিনিয়ার চেয়ে তাড়ু কাজে অনেক বেশী দক্ষ। তার বৌয়ের নাম মতিয়া, কিছুদিন আগেও সে ইংরেজ পাড়ায় মেথরানী ছিল। কোন মন্ত্রবলে যে সে মতিয়াকে বিয়ে করে এই শ্মশানে রাখতে পেরেছে, তা তাড়ুই জানে। মতিয়ার সঙ্গে চাঁদুর দলের সকলের বেশ ভাব আছে।

হয়তো তাড়ু স্নানটান করে খেতে বসেছে, এমন সময় কোনো একটা বড় দল এসে উপস্থিত হলো। ঝিনিয়া অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে, তাড়ুকেই আসতে হবে। অভুক্ত অবস্থাতেই তাড়ু চলে আসে, মৃতের আত্মীয়-স্বজনদের কান্নাকাটি পর্বে সে ভাবলেশহীন মুখে দাঁড়িয়ে থাকে এক পাশে, নিজের লাঠিটিতে ভর দিয়ে। তারপর মুখাগ্নি হয়ে গেলে সে সাজানো চিতার তলায় ভালো করে আগুন জ্বেলে দিয়ে আবার খেতে চলে যায়। খাওয়া সেরে আচিয়ে ভেজা মুখেই সে ফিরে এসে শবের পা মুড়ে দেয়।

মতিয়ার সঙ্গে মাঝে মাঝে প্রচণ্ড ঝগড়া বেঁধে যায় ঝিনিয়ার। তাড়ুর বউ আছে, আর তার নেই, এটা মাঝে মাঝে ঝিনিয়া সহ্য করতে পারে না। এক এক রাত্রে সে তাড়ুর গোলপাতার ঘরে জোর করে ঢুকে পড়ে। তাড়ু কিছু বলে না, মতিয়াই সব ব্যবস্থার ভার নেয়। ঠেলতে ঠেলতে সে ঝিনিয়াকে ঘরের বাইরে নিয়ে আসে, তারপর তার বাপান্ত করতে করতে একটা পোড়া কাঠ তুলে নিয়ে তাকে পেটায়।

চাঁদুরা কিছুক্ষণ মজা দেখে। এক সময় অবস্থা চরমে পৌঁছেলে তারা এগিয়ে গিয়ে বলে, আরো আর পেটাসনি, বুড়োটা তো মরে যাবে।

মতিয়া বলে, মরুক, মরুক গিধধরটা!

চাঁদু ওর কাছ থেকে পোড়া কাঠটা কেড়ে নেবার চেষ্টা করলে মতিয়া চোখ পাকিয়ে বলে, তবে তোর মুখ ভেঙে দিব! তোহার ঘিলু ছটকাবো!

চাঁদু হাসতে হাসতে পিঠ ফিরে বলে মার! মারা দেখিনি আমায়!

সবাই মিলে ধরাধরি করে বিনিয়াকে গঙ্গায় ফেলে দেয় ঝপাং করে।

সবাই জানে, ঝিনিয়া ওতেও মরবে না। বড্ড কড়া জান তার, ঠিক আবার বেঁচে উঠবে।

এইভাবে চাঁদুর দিন বেশ কেটে যাচ্ছে।

মাঝখানে একটা ঘটনা ঘটেছিল। হঠাৎ দেখা গেল প্রতিদিন বিকেলবেলা একজন ভদ্রবেশী সুশ্ৰী চেহারার যুবক এখানে এসে জলের ধারে বসে থাকে। এখানে ঘাট বলতে কিছু নেই, কয়েকটি গাছের গুঁড়ি ফেলা আছে, জোয়ারের সময় সেগুলোও ড়ুবে যায়। যুবকটি এসে সেখানে বসে। অপরাহ্নে নদীর জলে সূৰ্য্যাস্তের শোভা দেখতে দেখতে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে এবং মাঝে মাঝে পকেট থেকে একটি নোট বই বার করে তাতে কী সব লেখে।

লোকটিকে দেখে খটকা লাগে চাঁদুর দলের। এ আবার কী চায়? শ্মশানে তো কেউ বিনা কারণে আসে না। পাশের আনন্দময়ীতলায় অনেকে স্নান করতে আসে। এদিকে স্থানার্থীরাও আসে না। এ লোকটা যেন তাদের জায়গা জুড়ে বসেছে।

চাঁদুরা লোকটির পাশে বসে খিস্তি-খাস্তা হই-হল্লা করলেও লোকটি ভ্রূক্ষেপ করে না। সে যেন ধ্যানস্থ, আপনভাবে বিভোর। লোকটির নাকে সোনালী ফ্রেমের রিমলেশ চশমা। গায়ে পাতলা ফিনফিনে জামা, কাঁধে একটি গোলাপী রঙের চাদর।

কখনো জ্বলন্ত চিতার পাশে এসেও দাঁড়িয়ে থাকে লোকটি। তখন তার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ে। এ যে এক তাজ্জব ব্যাপার। কার না। কার মড়া তার ঠিক নেই, সেজন্যও এ লোকটি কাঁদে!

লোকটিকে চাঁদুর সহ্য হয় না। একে জব্দ করার জন্য সে তার সঙ্গীদের নিয়ে একটি মতলব এঁটে ফেলে।

ঘাটের গুঁড়িগুলো অনেক দিন থাকার জন্য কাদার মধ্যে গেথে আটকে আছে। একদিন চাঁদুর দল সেই গুঁড়িগুলো তুলে তুলে আলগা করে রাখে। তারপর সেদিন বিকেলে যুবকটি এসে একটা গুঁড়ির ওপর বসেছে, একটু পরে চাঁদু তার হাতের লাঠিখানা দিয় পেছনে দিক থেকে সেই গুঁড়িটায় একটি চাড় দেয়। অমনি লোকটি সমেত গুঁড়িটি গড়িয়ে চলে জলের দিকে। ধ্যান ভেঙে যুবকটি দু হাত তুলে উচ্চকণ্ঠে বাবা রে, মা রে, গেলুম রে বলে চেঁচিয়ে ওঠে। এবং সটান গিয়ে পড়ে জলের মধ্যে।

বোঝাই যায় যুবকটি সাঁতার জানে না। জলে পড়ে সে দু-একবার মাত্র বাঁচাও, বাঁচাও বলতে পারে, তারপর হাবুড়ুবু খায়। যথেষ্ট নাকানি-চোবানির পর যুবকটি যখন স্রোতের টানে পড়তে যাচ্ছে, সেই

সুদৃশ্য বস্ত্র পরিহিত যুবকটিকে এখন দেখায় ভিজে বেড়ালের মতন চোপসানো। দম নিতে তার খানিকক্ষণ সময় লাগে।

তারপর সে অত্যন্ত কোমল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, তোমরা এমন কেন কল্লে, ভাই?

চন্দ্রনাথের দল হো হো করে হেসে ওঠে।

লোকটি হাতজোড় করে আবার সেই রকম একই কণ্ঠে বললো, ভাই, তোমরা কেন এমন কল্লে? আমি কী দোষ করিচি?

চাঁদুর এক স্যাঙাৎ ন্যাড়া তার কাছা টেনে খুলে দেবার চেষ্টা করলো।

লোকটি তখন মুক্তকচ্ছ অবস্থায় কোনো রকমে মান বাঁচাবার জন্য চোঁ-চাঁ দৌড় মারলো।

চাঁদুর দলের কাছে এটা নির্মল আনন্দের ব্যাপার। ন্যাড়া হাসতে হাসতে বললো, ও বোকচৈতন আর কোনোদিন ইদিকে আসবে না।

চাঁদু বলে, আসবে, আসবে। সব ব্যাটাকেই আসতে হবে। এমন ঘাঁটি আগলে আচি যে সব ব্যাটাকেই আসতে হবে একদিন না একদিন। সব ব্যাটার মাতা ফাটাবো!

এর চেয়ে অনেক বেশী রোমহর্ষক ঘটনাও ঘটে মধ্যে মধ্যে।

এক রাতে ফিনিক দিয়ে জ্যোৎস্না ফুটেছে আর বাতাস বইছে এলোমেলো। এমন রাতে গাঁজার নেশা বড় ভালো জমে আর তার সঙ্গে চেল্লামেল্লি গান। অশথ গাছটার গায়ে একটা গোলপাতার মাচা বেঁধে চাঁদু তার দলবল নিয়ে বসে থাকে। কিন্তু গান গাইবার উপায় কী, তার মধ্যে ঝিনিয়া এসে দারুণ হল্লা লাগিয়ে দেয়, ছেলেদের চড়-চাঁপাটি খেয়েও সে থামতে চায় না।

সেই সময় চারজন লোক একটা শবের খাট বয়ে নিয়ে এসে শ্মশানতলায় সেটি নামিয়ে রেখেই দৌড় লাগায়।

চাঁদু ঠিক দেখে ফেলে তার সাগরেদদের বলে, আরে, আরে, লোকগুলো কোতায় গেল দ্যাক তো!

ন্যাড়া খানিকটা এগিয়ে গিয়ে উচ্চকণ্ঠে জানায়, ব্যাটারা ভোগে যাচ্ছে, ওস্তাদ!

সবাই হই হই করে তাড়া করে যায়। সেই শবযাত্রীদের। কিন্তু তারা দিকবিদিক শূন্য হয়ে ছুটে পালাচ্ছে, তাদের ধরা যায় না। অনেকের ধারণা, এই নিমতলা শ্মশানে দুটো ভূত আছে, সেইজন্য রাত-বিরেতে ভাড়া করা শ্মশানযাত্রীরাও সহজে এদিকে আসতে চায় না। ওরা কি ভূতের ভয়েই পালালো! অথবা ওদের কাছে ঘাট-খরচা নেই!

চাঁদু তার দলবল নিয়ে ফিরে আসে মড়ার খাটের কাছে।

পরিষ্কার চাঁদের আলোয় দেখা যায় চাদর দিয়ে ঢাকা এক আলুলায়িতকুন্তলা, গৌরবর্ণা যুবতীর মুখ। মনে হয় যেন জীবন্ত, চোখ দুটি সম্পূর্ণ খোলা। চাঁদুর মনে হলো সেই চোখ দুটি যেন তার চেয়ে আছে।

চাদরখানি একটুখানি সরাতেই এক দৃশ্য দেখে চাঁদু এবং তার সঙ্গীরা শব্দ করে আঁতকে ওঠে। যুবতীটির নগ্ন বুকের ঠিক মাঝখানে একটি ছুরি বেঁধা। তখনও সেখানে থকথকে রক্ত জমে আছে।

প্রতিদিন নানারকম মৃতদেহ দেখলেও চাঁদুর সঙ্গীরা ভয় পেয়ে যায়। সবাই সরে যায় দূরে।

একজন বলে, কোনো বড় ঘরের মেয়ে, খুন করেছে!

অপর একজন বলে, রেণ্ডি, রেণ্ডি!

আর একজন বলে, বেঁচে আচে, এখুনো বেঁচে আচে।

চাঁদু কাছে গিয়ে ঝুঁকে মেয়েটির গাল ধরে এপাশ ওপাশ নাড়িয়ে দেয়। জীবনের কোনো লক্ষণ তাতে প্ৰকাশ পায় না।

ন্যাড়া একটানে সরিয়ে দেয় চাদরটা। এবার আরও বিস্ময়ের পালা। যুবতীটির অঙ্গে এক টুকরো বস্ত্ৰও নেই।

কয়েক মুহূর্ত ওরা চুপ করে থেকে পরস্পরের দিকে চায়। এমন সুন্দর নারীদেহ ওরা কখনো চক্ষে দেখেনি। চাঁদের আলোয় সেই শরীর যেন আরও অপার্থিব দেখায়।

হঠাৎ ন্যাড়া একটা উৎকট চিৎকার করে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই যুবতীর শরীরের ওপর। পাগলের মতন সেখানে মুখ ঘষতে থাকে।

কী করাচিস, কী করচিস বলে চাঁদু তার চুলের মুঠি ধরে তাকে তোলবার চেষ্টা করে। কিন্তু ন্যাড়া কিছুতেই উঠবে না। শেষ পর্যন্ত চাঁদু এক লাথিতে তাকে ছিটকে ফেলে দেয়।

তখন আরও দুজন ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই মৃতদেহের ওপর। চাঁদু তাদেরও সরাবার চেষ্টা করে। কিন্তু সবাই যেন উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। কেউ আর তার কথা শুনতে চায় না। ন্যাড়া উঠে এসে বলে, তুমি সরে যাও, ওস্তাদ!

বাকি সবাই একেবারে পথের ছেলে, কিন্তু চাঁদুর এক সময় বাড়ি ছিল। সেইজন্য এ বীভৎসতা সে ঠিক সহ্য করতে পারে না। সে একাই চেষ্টা করে সবাইকে সরিয়ে দেবার, কিন্তু এই উপলক্ষে যেন তার দলে একটা বিদ্রোহ দেখা দিল। কেউ তাকে আর মানছে না।

অবিলম্বেই বিদ্রোহ দমন করবার জন্য চাঁদু বিশেষ একজনকে টেনে নেয় এবং নিজে ছুরিটা তার গলায় চেপে ধরে বলে, একদম শেষ করে দেবো। সব কটাকে আজ খতম করবো।

ন্যাড়া সেই যুবতীটির বুক থেকে ছুরিটা টেনে খুলে নিয়ে চাঁদুকে রুখতে আসে। কিন্তু হাতে একটা ছুরি থাকলেই ন্যাড়া যদি জিততে পারতো, তা হলে তো সে-ই নেতা হতো। ন্যাড়া মাটিতে লুটিয়ে পড়ার পর চাঁদু যুবতীর শরীর আড়াল করে দাঁড়ায়। চিৎকার করে বলে, আয়, কে আসবি!

বিদ্রোহ প্রশমিত হলে চাঁদু বলে, ধর, সবাই হাত লাগা, একে মা গঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে হবে।

একজন তখনও দুর্বল গলায় বলে, যদি বেঁচে থাকে এখনো!

—যদি বেঁচে থাকে, মা গঙ্গা ওকে বাঁচাবেন। ধরাধরি করে শেষ পর্যন্ত ওরা যুবতীর দেহটিকে নিয়ে ভাসিয়ে দেয় জলে। ন্যাড়া ভেউ ভেউ করে কেঁদে ওঠে। এ পর্যন্ত ন্যাড়াকে কেউ কখনো কাঁদতে দেখেনি। ভাগ্যহীন যুবতীটি কোন বেঘোরে, কার হাতে মারা গেছে কে জানে! কেউ তার জন্য শোক করেছে কিনা তারও ঠিক নেই। তবু তো শ্মশানঘাটে একজন তার জন্য কাঁদলো।

সম্প্রতি এখানে আরও একটি কাণ্ড ঘটেছে।

বর্ষার রাত্রে চাঁদুরা সবাই ঘুমিয়ে ছিল। সেদিন একটাও মড়া আসেনি। এক সময় শোনা গেল তাড়ুর ঘর থেকে একটা ট্যাঁ ট্যাঁ আওয়াজ। মতিয়াও যেন ভয় পাওয়া গলায় গোঙাচ্ছে। ন্যাড়া প্রথমে সেই আওয়াজে জেগে উঠে ডেকে তুললো চাঁদুকে।

নিশ্চয়ই ও ঘরে হাড়গিলে ঢুকেছে। হাড়গিলেরা মারামারি করবার সময় ঐ রকম আওয়াজ করে।

সবাই মিলে দৌড়ে গেল তাড়ির ঘরের দিকে।

ন্যাড়া প্রথম ঢুকেই বেরিয়ে গেল জিভ কেটে। তারপর মুখের একটা অদ্ভুত ভঙ্গী করে বললো, আরিঃ সাবাশ! মতিয়ার একটা বাচ্চা হয়েছে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *